দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-০১

0
7

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#সূচনা_পর্ব

“বিয়ের আগে দেখা করার ব্যাপারে ছেলেদের বেশি আগ্রহ থাকে বলে আমি জানতাম। কিন্তু আমার বেলায় যে আমার হবু বউয়ের বেশি আগ্রহ থাকবে কে জানতো?”

কথাটা বলে ঠোঁট চেপে হাসলো তাওসিফ। দৃষ্টি তার সম্মুখে নত মস্তকে বসা রমণীর দিকে। তার কথায় মৃদু হাসলো অধরা। ঠোঁট দুটো একটু প্রসারিত হলো। বা’গালে একটু গর্ত হলো। তাওসিফ মুগ্ধ হয়ে দেখলো সব। তারা বসে আছে স্বপ্ন উদ্যানে। জামালখান মোরে অবস্থিত নান্দনিক ফোয়ারা। রাস্তার সাইডে তৈরি পথচারীদের জন্য বসায় জায়গা এবং পাশে গাছ লাগানো। এই গাছময় বসার স্থানটির নাম স্বপ্ন উদ্যান। পিছন থেকে তাওসিফকে ওর বন্ধুরা ডাকলো। তাওসিফ তাকাতেই ইশারায় জ্বা*লাচ্ছে ওরা। রাহাত বারবার চোখ টিপ দিচ্ছে। তাওসিফ কটমট চোখে তাকালো ওদের দিকে। ওদের কোন হেলদোল নেই। কারণ ওরা জানে তাওসিফ এখন উঠে আসতে পারবে না। সো মাইর খাওয়ার কোন চান্স নেই। তাওসিফ ওদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফের সম্মুখে তাকালো। অধরা মৃদুস্বরে বলল,

“আপনি বোধহয় ব্যস্ত। আমি বেশিক্ষণ সময় নিব না।”

“আরে না। তুমি আসতে বলেছো না? আমি সময় নিয়েই এসেছি।”

অধরা একপলক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাওসিফের বন্ধুদের দিকে চাইলো, পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নত মস্তকে বলল,

“আপনার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”

তাওসিফ নিজে এবার তাকালো তার অসভ্য বন্ধুদের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“ওদের কোন কাজ নেই, এসেছেই জ্বালানোর জন্য। সো জ্বালাবেই। তুমি ওদের দিকে না তাকিয়ে তোমার কথা বলো।”

অধরা শুনলো। তাকালো তাওসিফের দিকে। মাথা নুইয়ে প্রশ্ন করলো,

“বিয়ের ডেইট ফিক্সড করে ফেলেছে, অথচ আপনি আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাননি কেন?”

তাওসিফ নিঃশব্দে হাসলো। সে হাসি পরোখ করতে অক্ষম হলো অধরা। তাওসিফ উত্তর দিচ্ছে না দেখে অধরা তার দিকে চাইলো। তাওসিফ যেন এই সময়টির অপেক্ষা করছিল। অধরার চোখে চোখ রেখে বলল,

“আস্তে আস্তে জেনে নিব। একবারে জেনে গেলে তো সমস্যা!”

অধরা এবার চোখ নামিয়ে নিলো না। তাওসিফের চোখ পানে তাকিয়ে বলল,

“একাবারে কখনো কাউকে জানা যায় না, কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। আপনার ধারণাটুকু নেওয়া উচিত না?”

“খুব দরকার?”

“কারো জীবনে জীবন জড়িয়ে ফেলবেন অথচ দরকার নয় বলছেন?”

তাওসিফ হাসলো। উত্তর দিলো না। উত্তরের অপেক্ষাও করলো না অধরা। বলল,

“আপনি চান আর না চান, আমি আমাকে জানাতে চাই।”

তাওসিফ নিবিড় ভাবে পরোখ করতে থাকলো অধরাকে। চোখে মুগ্ধতা। এটা প্রথম দেখা যদিও তাওসিফের জন্য নয়। তবুও যতবার তাওসিফ এই রমণীকে দেখে ততবার মুগ্ধ হয়। তাওসিফের কাছে মুগ্ধতা মানেয় অধরা। বাক্যটা অদ্ভুত হয়ে গেলো তাই না? তাওসিফ আনমনে হাসলো, তবে নিঃশব্দে। মোহগ্রস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“আচ্ছা, জানাও।”

অধরা লম্বা শ্বাস নিলো। মনে হলো বিশাল বক্তব্য দেওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে। তাওসিফ অধরাকে দেখতে ব্যস্ত তবে অধরা কি বলতে চায় তাও মনোযোগ সহকারে শুনবে। অধরা শুরু করলো,

“আমাদের যৌথ পরিবার। বাবারা চার ভাই আর ছোট ফুপি মিলে এক বাড়িতে থাকেন। বড় তিন ফুপির বাচ্চাদের বাদ দিলে এই বাড়িতে আমরা মোট বারো জন কাজিন। আমি ছোট দিক দিয়ে চতুর্থ । আমার পরে আমার বোন আর ছোট ফুপির মেয়ে আর ছেলে। আমাদের বাড়িতে আমি বাদে আমার বাকি এগারো ভাই-বোন কিন্তু অনেক আদরের। আমি ওই বাড়িতে সাধারণত অদৃশ্য মানব। আর যখন দৃশ্যমান হই তখন খুব বাঝে ভাবে। এই ধরুন ডাইনিং এ খেতে বসেছি, হুট করে কারো হাত থেকে কোন বাটি পরে গেলো, কিংবা কোন এক্সিডেন্ট ঘটলো; সাথে সাথে চোখ যাবে আমার দিবে। কেউ একজন ঠুস করে বলে দিবে অপয়াটার জন্যই এমন হলো। এই অপয়াকে কে ডাকে খাবরা টেবিলে। আবার ধরুণ সবে বাড়িতে ঢুকেছি, কোন কারণে দেরি হয়েছে একটু। বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে হবে, ন*ষ্টা মেয়ে ন*ষ্টামি করে আসলো। এরকম প্রতিটি ব্যাপারে আমার দোষ।”

একটুকু বলে অধরা উ*ম্মাদের মতো একটু হাসলো। আবার গম্ভীর হয়ে গেলো সাথে সাথেই। পুনরায় বলতে লাগলো

“এমন অপয়া, ন*ষ্টা মেয়ের জামাই হয়ে ও বাড়িতে আপনার জামাই আদর হবে আশা করাও পাপ। সে যাইহোক, বুঝতেই পারছেন অপয়া বলে কথা; তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বিদায় করার জন্য বিয়ে দিয় দিচ্ছে। ও বাড়িতে আমার থেকে বড়, বিবাহযোগ্য মেয়ে কিন্তু আরও আছে।”

আবার হাসলো অধরা। তাওসিফের দৃষ্টি অধরাতে। সে জবাব দিলো না কোন কথার কিংবা দৃষ্টি সারালো না অধরা থেকে। অধরা কিয়ৎকাল তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তাওসিফের মনোভাব। তবে বুঝতে পরলো না কিছু। তাওসিফের শান্ত মুখশ্রী দেখে ভেবে নিলো তাওসিফ বোধহয় অবাক হয়ে গেছে, হতবিহ্বল হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। অধরা হাসলো। ফের বলে উঠলো,

“আপনার আগেও বেশ কয়েকজন আমাকে দেখতে এসেছে এতটুকু শুনে কেউ আর বিয়ে করার আগ্রহ দেখায়নি।”

তাওসিফ চুপ থাকলো। অধরা কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো তার। তবুও বলল,

“আমাকে অপয়া, ন*ষ্টা বলার কারণ জানতে চাইবেন না?”

তাওসিফ তড়িৎ উত্তর দিলো,

“নাহ!”

অধরা অবাক হলো। সুধলো,

“কেন?”

তাওসিফ এতক্ষণে অধরা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে চাইলো। সেভাবেই উত্তর দিলো,

“আমি জানতে চাই না।”

অধরা হাসলো। বেশ শব্দ করে। পরক্ষণেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,

“যা রটে তার কিছুটা হলেও তো ঘটে। মাইন্ড ইট তাওসিফ আবরার!”

তাওসিফ না জানার ভান করে বলল,

“মানে?”

অধরা হাসলো। উত্তর দিলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। তারপর বলে উঠলো,

“আমি উঠি, হ্যাঁ? আপনার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”

তাওসিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অধরা উঠে গেলো। হাঁটতে লাগলো আনমনে। তার হাঁটার মাঝেও উ*ম্মাদ ভাব। তাওসিফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অধরার যাওয়ার পানে।

অধরাকে উঠতে দেখেই বন্ধুরা ছুটে এলো তাওসিফের পাশে। রাহাত তাওসিফের পাশে বসলো। তানিম আর তুষার বসলো অধরা এতক্ষণ যেখানে বসে ছিল সেখানে। তাওসিফ ওদের দিকে তাকালো না। তার দৃষ্টি এখনো রাস্তায়। যদিও অধরাকে আর দেখা যাচ্ছে না। রাহাত ওর পিঠে চাপর মেরে বলল,

“কিরে মামা! প্রেম হয়ে গেলো?”

তাওসিফ আনমনে জবাব দিলো,

“উহু, উল্টা সব পেচিয়ে গেলো।”

রাহাত ফাজলামো মুড থেকে বের হয়ে সিরিয়াস মুডে এলো। বলল,

“কি হইছে তাওসিফ? এনি পরবলেম?”

তাওসিফের ধ্যান ভাঙলো। বন্ধুদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,

“না কিছু না। চল যাই।”

বন্ধুরা ঘাটলো না আর। বুঝলো সমস্যা গুরুতর। সময় হলে নিজেই বলবে।

অধরা রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। ওই দিনের স্মৃতি মনে পড়লেই তার হাসফাস লাগে। দম বন্ধ হয়ে যায়। অথচ ওই স্মৃতিই তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে পড়ে মিসেস তুবার রাগী মুখশ্রী। একের পর এক থা*প্পড়। কয়টা থা*প্পড় দিয়েছিল ওইদিন? গুণেগুণে সাতটা। প্রথম থা*প্পড়েই ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছিল অধরার। তার পরের প্রতিটা থা*প্পড়ের কথা আর নাই বলি! ওটায় শেষ ছিল না, আরও….
না! আর ভাবতে পারলো না অধরা। মস্তিষ্ক শূণ্য হতে লাগলো। অধরাদের বাড়ি গোলপাহাড় মোরে। জামালখান থেকে রিক্সা নিয়ে চকবাজার হয়ে যাওয়া যায়। অথচ অধরা হাঁটছে উল্টো পথে। হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন উদ্যানের শেষ বেঞ্চটিতে এসে বসলো অধরা। জামালখান মোর থেকে বেশ দূরেই এটি। এই রাস্তা ধরে সে ইস্পাহানি মোরে পৌঁছাতে পারবে, সেখান থেকে বাড়ি যাওয়া যাবে। কিন্তু ইচ্ছে হলো না। বসে রইলো চুপচাপ। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু হলো।

বাইক নিয়ে এসেছিল তাওসিফরা। বাতিঘরের সামনে পার্কিংলটে বাইক পার্ক করা ছিলো। বন্ধুরা মিলে স্টেডিয়ামে যাবে এখন। বাকি বন্ধুরা অপেক্ষা করছে ওখানে। বাইক ছুটে চলছে। তাওসিফ কৌতূহল বশত রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকালো। তখনই চোখে পড়লো স্বপ্ন উদ্যানের শেষ বেঞ্চটিতে একলা বসে থাকা রমণীর দিকে। উদাসীন হয়ে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখে তাওসিফের ইচ্ছে হলো ছুটে তার কাছে যেতে, মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে বলতে ইচ্ছে হলো,

“কাঁদছো কেন? দুঃখ কেন তোমায় ছুঁয়ে দিলো? ভালোবাসা যেখানে বেরিবাঁধ সেখায় দুঃখ প্রবেশ করে কি করে?”

কিন্তু বলা হলো না। মেয়েটাকে একলা রেখে চলে আসতে হলো। বলার অধিকার যে নেই। তবে অধিকার সে পেয়ে যাবে খুব দ্রুত। বেখেয়ালি মেয়েটাকে দুঃখ পেতে দিবে না আর। তাওসিফের ঠোঁটে খেলে গেলো এক চিলতে হাসি।

সন্ধ্যা নামার একটু আগে নবকুঞ্জের গেটের সামনে এলো অধরা। গেটের দারওয়ান বহু পুরোনো। বৃদ্ধ জালালউদ্দিন অধরাকে দেখেই গেট খুলে দিলো। অধরা মিষ্টি করে সালাম দিলো,

“আসসালামু আলাইকুম চাচা।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম মা। কেমন আছো?”

অধরা হাসলো। প্রাণহীন হাসি। জালালউদ্দিন অসহায় চোখে চাইলো সে হাসির দিকে। এরপর মাথা নামিয়ে নিলো। কেন সে মেয়েটাকে এই প্রশ্ন করে? মেয়েটা বেঁচে আছে এই অনেক। পাঁচ বছর ধরে যতসব সহ্য করছে মেয়েটা অন্য কেউ হলে নির্ঘাত আত্মহ*ত্যার পথ বেছে নিতো। অধরা নবকুঞ্জে প্রবেশ করলো। বাড়ির নামটা তার দাদির দেওয়া। দাদি খুব শৌখিন মানুষ। অধরা হাঁটতে হাঁটতে আনমনে ভাবতে চাইলো সে কেমন আছে? উত্তর এলো না কোন। সে জানে না সে কেমন আছে। অথচ কি অনায়াসে সে দাবি করে সে নিজেকে খুব ভালো করে চিনে! হাস্যকর। অধরা মিথ্যা বলে না। তাই সে কেমন আছে এই প্রশ্নের উত্তর গত পাঁচ বছর ধরে সে কাউকে দেয়া না। কারণ সে জানে না। সত্যিই জানে কেমন আছে সে! আর যা সে নিজেই জানে না তার উত্তর কিভাবে দেয়?

#চলবে…?