#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪
নভেম্বর প্রায় শেষের দিকে। দুপুরের তেজহীন রোদ বিকালে বিলীন হতেই শীত অনুভূত হয়। শীত হওয়াতে ভালো হলো অধরার। হাতের তালুর ব্যান্ডেজ খুলে ফেলল। জ্যাকেট গায়ে জড়াতেই কনুই এর দিকের ব্যান্ডেজ অদৃশ্য হলো। জ্যাকেটের উপর ওড়না পেচিয়ে নিলো গলায়। হাত দু’টো পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। শেষ! সে রেডি!
নিচে নামতেই মেঝ চাচি মায়মুনার সামনে পরলো সে। মায়মুনা ভ্রূ কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই জোরে বলে উঠলো,
“বেহায়া মেয়ে। শরম-লজ্জা কিছু যদি থাকে! মা*রের দাগ শুকাতে না শুকাতে আজ আবার ঢেঙ ঢেঙ করে বের হচ্ছে।”
বলেই মুখ বাঁকালেন তিনি। মিসেস তুবা চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে দিরাজ স্বরে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“জামালখান।”
“ওখানে কি কাজ?”
অধরা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। তার চেহারায় কোন অনুভূতির ছাপ নেই। মনের মাঝে কি চলছে স্বয়ং সে ছাড়া আর কেউ জানে না। গতকাল সে যে তাওসিফের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সেটা বাড়ির বড়রা কেউ জানে না; নবনী আনজুম ছাড়া। তাই আজ সে অনায়াসে বলতে পারে যে তাওসিফের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কিন্তু কি ভেবে যেন মন সায় দিলো না। সে কিছু বলবে তার আগেই অপর একটি স্বর ভেসে এলো ডাইনিং টেবিলের পাশ থেকে। অরুমিতা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে নির্বিকার স্বরে বলল,
“জামালখানে বাতিঘর আম্মু! আপুই এর বই পছন্দ সেটাও কি তোমারা ভুলে গেছো?”
অরুমিতার কন্ঠে তাচ্ছিল্যের আভাস। মিসেস তুবা দুই মেয়ের দিকে একবার একবার করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। মায়মুনাও চলে গেলো তার পিছনে। অধরা দৃষ্টি সম্মুখে রেখে মৃদু হাসলো। পিছ ফিরে বোনের দিকে চাইলো না। অরুমিতাও হাসলো। তার হাসিও অধরা দেখলো না। বের হয়ে যাওয়ার আগে একবার ভাবলো ছোট বোনটার দিকে তাকাবে কিন্তু তাকালো না।
স্বপ্ন উদ্যান! সেই একই বেঞ্চে মানুষটা বসে আছে। অধরা ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ঠিক গতকালের জায়গায় বসলো। দৃষ্টি তার আজও নিচের দিকে। কিছু সময় নিচে তাকিয়ে সে সরাসরি তাওসিফের চোখে চোখ রাখলো। তাওসিফের চোখে মুগ্ধতা। অধরা ভেবে পেলো তাকে এতো মুগ্ধ হয়ে দেখার কি আছে? দেখতে সে আহামরি সুন্দর নয়৷ গায়ের রঙ দুধে আলতা নয় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। তবে এই লোক এতো মুগ্ধ হয়ে দেখে কি? অধরা আর না ভেবে দৃষ্টি অন্যত্র সরালো। তাওসিফ তার চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করতে ব্যস্ত। আর অধরা নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। কিয়ৎকাল পরেই ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো তার,
অতীত,
নবকুঞ্জের দোতলায় নিজের ঘরে ছবি আঁকছিল অধরা। ষোড়শী কন্যার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা রঙতুলি আর রঙ। কার্পেটের উপর পা ছড়িয়ে বসে সামনের সাদা কাগজটিকে রাঙানোতেয় তার ধ্যান। নবম শ্রেণির ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে কাল। আবারও প্রথম স্থান অধিকার করেছে অধরা। গতকাল বিকেলেই বাবা এনে দিয়েছে নতুন রঙ। তাই তো আজ তার এতো ব্যস্ততা। নতুন রঙে নতুন ছবি আঁকার। ছবির ধ্যানে থাকা মেয়েটা খেয়াল করলো না তার রুমে কখন ঢুকেছে মেঝ চাচার বড় ছেলে আবির। আবির আলতো করে ডাকলো,
“অধরা।”
কাগজে তুলি দিয়ে আর একটা আঁচর কেটে অধরা চোখ তুলে চাইলো। আবিরকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“আরে ভাইয়া তুমি! কখন এলে? আমি খেয়ালই করি নি।”
অবুঝ অধরা শুধু আবিরের আসা নয় দরজাটা যে ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাও খেয়াল করেনি। আবির এগিয়ে এলো তার দিকে। অধরা এতসব না ভেবে বলল,
“খাটে বসো ভাইয়া।”
পরক্ষণেই ছবিটা সামনে এনে বলল,
“কেমন হচ্ছে ভাইয়া?”
আবির খাটে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অধরার দিকে। বেগুনি রঙের একটা শর্ট টপসের সাথে কালো প্লাজু পরনে। চোখে নে*শা লাগলো তার। আর দেরি করলো না নিজের কার্য হাসিলের। হামলে পড়লো অধরার উপর। অধরা প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কি হচ্ছে বুঝতে তার সময় লাগলো পাক্কা দুই মিনিট। বুঝবে কি করে? সে তো তার ভাইদের সম্মান করে। এমন কিছু কল্পনাতেও আনেনি কখনো। কিন্তু সব কি আমাদের ভাবনা মতো হয়। যতক্ষণে বুঝতে পারলো চিৎকার করে উঠলো অধরা। অতি উত্তেজনায় আবির ভুলে গিয়েছিল অধরার মুখ চেপে ধরতে। অধরা চিৎকার করতেই সে সজোরে মুখ চেপে ধরলো। তখনই শোনা গেলো দরজার সামনে মায়মুনার আহাজারি।,
“আবির, ও আবির! আব্বা? তোর চিৎকার শুনলাম যে, এই ঘরে কেন তুই? দরজা আটকানো কেন? ও আব্বা? দরজা খোল।”
তার আহাজারিতে বাড়ির সকল সদস্য অধরার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। সবার চোখে উৎকন্ঠা! কি হলো আবার। সময়টা বিকাল হওয়ায় বেশির ভাগ বাচ্চারা ছিল ছাদে। বড়রা নিচে। যার দারুণ অধরার চিৎকারটা তারা শোনেনি। ময়মুনার অভিনয়ে ধরেই নিয়েছে চিৎকারটা ছিল আবিরের।
ওদিকে ঘরের মাঝে আবির অধরার মুখ চেপে ধরে নিজেই নিজের গায়ে আঁচর কাটলো। চোখেমুখে স্পষ্ট কান্না ধারণ করে অধরাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা খুলল। ধুরমুর করে ঘরে ঢুকতে চাইলো সবাই মায়মুনা সামনে থাকায় সে আগে ঢুকলো, ছেলের মুখ আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হলো বাপ? অধরা অবাক হয়ে দেখলো আবির কান্না করছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মা অধরা হঠাৎ আমাকে ওর ঘরে ডাকলো, তারপর… তারপর আমার শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো, আমি আটকাতে যেতেই জোর করতে লাগলো। দেখো আমার হাত।”
বলেই নিজেই নিজেকে করা আঘাত গুলো দেখালো, কিছু আঘাত অবশ্য অধরারও করা। নিজেকে বাঁচতে মানুষ তো আঘাত করবেই। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
অধরা হত-বিহবল হয়ে দেখতে লাগলো আবিরের কান্ড। সে প্রতিবাদ করতে চাইলো। নিজের মায়ের দিকে এগোতে চাইলো। কিন্তু তার আগেয় নিজের গালে সপাটে চড় পড়লো। অধরা হতভম্ব হয়ে তাকালো মায়ের দিকে। অস্ফুটে স্বরে উচ্চারণ করলো,
“আম্মু!”
একের পর এক থাপ্প*ড় পরতে লাগলো অধরার গালে।স্তব্ধ হয়ে মায়ের মুখের দিলে তাকিয়ে থাকলো সে। অধরা কিছু বলতেও যেন ভুলে গেলো। তার মা একবারও তার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাইলো না? মায়েরা নাকি সন্তানের মুখ দেখেই অনেক কিছু বুঝতে পারে, তার মা বুঝলো না? অধরা ভিতরে ভিতরে মরে গেলো। প্রতিবাদ করার একটু শক্তি পেলো না। সাত নাম্বার থা*প্পড়ে দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো অধরা। অশ্রাব্য গালি গুলো আর কানে ঢুকলো না। মা তাকে বারংবার যে বে*শ্যা উপাধি দিচ্ছিলো সেই ভয়াবহ শব্দটা আর কানে এলো না। ষোড়শী কন্যার এলোমেলো দেহটা লেপ্টে রইলো কার্পেটে। মেয়েদের ছুঁয়ে দিলেই নাকি ছেলেদের দোষ দেওয়া হয়, অথচ অধরা দেখলো তাকে কি বাজে ভাবে ফাঁসিয়ে দিলো একটা ছেলে। সে আরো অবাক হলো বাড়ির মানুষদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে। তারা কিভাবে ভাবলো সে ছোট একটা মেয়ে হয়ে! আর ভাবতে পারলো না অধরা।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলো অধরা। মাথাটা ভার। ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ব্যাথায় টনটন করছে গাল। আবেগি মেয়েটা হু হু করে কেঁদে ফেললো। ছুটে গিয়ে আবিরকে প্রশ্ন করতে মন চাইলো,
“কেন করলে ভাইয়া এমন? কেন? কি অপরাধ আমার?”
কিন্তু পারলো না। কিছু পরেই খাবার নিয়ে ঘরে এলো সেঝ চাচি আর আঁখি আপা। দু লোকমা মুখে দিতেই মায়মুনা আর তুবা এলো ঘরে। তুবা ঝট করে টেনে নিলো খাবারের প্লেট। আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত বড় অপরাধের পরও সেধে ভাত খাওয়াচ্ছো সেঝ! আক্কেল জ্ঞান লোপ পেয়েছে?”
আয়েশা কিছু বলতে চাইলো, সুযোগ দিলো না। অধরা কয়েকবার ডাকলো, আম্মু আম্মু বলে। ফিরেও তাকালো না তুবা। বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। অধরা হু হু করে কেঁদে উঠে বলতে লাগলো,
“বিশ্বাস করো সেঝ আপা, বিশ্বাস করো সেঝমা, আমি কিছু করিনি। আবির ভাইয়া, ভাইয়া ঘরে এসে…..”
আর কিছু বলতে পারলো না অধরা। দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। আঁখি আগলে নিলো বোনকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে বলছিলাম আম্মা, নিশ্চয়ই আবির কিছু করছে। আসফিন এমন না আম্মা। চাচিরে বুঝাও।”
আয়েশা অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে বের হলেন ঘর থেকে। আঁখি বোনকে আগলে বসে রইলো। কান্না থামছেই না অধরার।
——————
ফয়জাল হাসান, নবকুঞ্জের ছোট কর্তা, অধরার বাবা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন তিনি ও তার বড় তিন ভাই। বিকেলে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর কাহিনি এখনো তিনি জানেনা না। তিনি ভীষণ ক্লান্ত। ফ্রেস হয়ে নাস্তার টেবিলে যেতে হবে। নাস্তা করে একটু শোবেন এই ভাবতে ভাবতে ফ্রেস হয়ে বের হলেন তিনি। নাস্তা করার জন্য ঘর থেকে বের হবেন ঠিক সেই মুহূর্তে তার ছোট মেয়েটা ছুটে ঘরে এলো। জাপ্টে ধরলো তাকে। তিনি খেয়াল করলেন মেয়েটা কাঁদছে। তিনি অবাক হলেন। দ্রুত কোলে তুলে নিলেন মেয়েকে। আদুরে স্বরে বললেন,
“কি হয়েছে মা? কে বকেছে আমার সোনা কে?”
অরুমিতার কান্না বাড়লো। হু হু করে কাঁদছে সে। কান্নার তোপে ছোট্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এবার ভড়কে গেলেন ফয়জাল হাসান। মেয়ে এভাবে কাঁদছে কেন? তিনি মেয়েকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। আদুরে স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিলেন পিঠে। আলতো স্বরে বলল,
“মা, কি হয়েছে? বাবা কে বলো। না বললে তো বুঝবো না মা।”
অরুমিতা এবার কান্না থামানোর অপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কান্না থামছেই না। বোন ভক্ত মেয়েটা বড়সড় আঘাত পেয়েছে। বোনের গালে পরা প্রতিটি থাপ্প*ড় যেন তার গালে দিয়েছে কেউ। বহু কষ্টে কান্না কিছুটা কমলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
“মা আপুইকে মেরেছে। অ…অনেক গুলো। আপুই এর ঠোঁট দিয়ে রক্ত বের হয়। পচা পচা কথা বলে বকা দিয়েছে।”
কথাটা বলতেই যেন বিকালের দৃশ্য অরুমিতার চোখের সামনে ভাসলো, সেই সাথে ভাসলো বোনের নিথর দেহটা। অরুমিতা ফের হু হু করে কেঁদে উঠলো। ফয়জাল হাসান মেয়েকে বুকে চাপিয়ে নিয়ে বলল,
“কাঁদে না মা। বাবা সব ঠিক করে দিব। সব!”
#চলবে…?