#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১২
নিশুতি রাত। থেমে গেছে কোলাহল। চারপাশে শুনশান নীরবতা। বাক্সে বন্দি কষ্ট গুলো এবার ছটফট শুরু করে। বাইরে বের হওয়ার তীব্র তাড়না তাদের। উপায় নেই, বক্স খুলে দিতে হয়। বেড়িয়ে আসে পাহাড়সম কষ্ট। চেপে বাসে বুকে। বুক ভারি হয়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সহ্যসীমা অতিক্রম হলে নয়ন বেয়ে নামে অশ্রুর ঢল। আটকায় কে এবার তাদের? নিস্তব্ধ রাতের গায়ে আঁচড় কাটে করো আত্মচিৎকার!
অধরা বিছানায় উঠে বসে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে। ঘড়ির কাটা দুইয়ের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। ঘুম আসে না। রাত বাড়ার সাথে সাথে কষ্ট গুলো আরও তীব্র হয়। কি অদ্ভুত ক্ষমতা রাতের! কষ্ট গুলোকে না চাইতেও সামনে এনে দেয়। দুই দিনে ঘটা প্রতিটি ঘটনা চোখের সামনে ভাসে অধরার। মায়ের বলা প্রতিটি শব্দ কানে ধিমতালে বেজে উঠে। চোখের সামনের পৃথিবীটা ঘুরে উঠে। বুকটা হাহাকার করে উঠে। অধরার কিশোরী আবেগ চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে। নিজেকে থামাতে খামছে ধরে চুল তবুও বাঁধ মানে না কান্নারা। সহ্য ক্ষমতা বোধহয় হারিয়ে যায়। অধরা নিজের গায়ের কাঁথাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচে। একই ভাবে ফেলো দেয় কোলবালিশ, বালিশ সব। তবুও জেদ কমে না। সহ্য হয় না। খামছে ধরে বিছানার চাদর। তবুও যখন কান্না থামলো না। তখন নিজের উপর বিরক্ত হয়ে যায় সে। বিছানা থেকে নেমে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বিছানার চাদরটিও। দুই পা ভাজ করে বসে পরে নিচে। মাথাটা এলিয়ে দেয় শূন্য বিছানায়। ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিস গুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বন্ধ করে ফেলে চোখ। ক্লান্ত শরীর আর দুইদিন ধরে অনবরত কান্নাকাটি করতে করতে দুর্বল হয়ে গেছে সে। ঘুমিয়ে পড়তে সময় লাগে না তাই।
এতক্ষণ ধরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়ের প্রতিটি কার্যক্রম সূক্ষ্ম ভাবে পরোখ করছিলেন ফয়জাল হাসান। মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পেরে ধীরে পায়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। বিছানার চাদরটা তুলে মেলে দিলেন বিছানায়। বালিশ গুলো তুলে দিলেন। তারপর মেয়েকে সর্দপণে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আবার ঘোলাটে হয়ে গেলো তার চোখ। তিনি রক্তলাল চোখে কান্না আটকালেন। ফিসফিস করে বললেন,
“বাবা সরি মা, খুব সরি! বাবা সবসময় তোমাকে হাসিখুশি দেখতে চেয়েছি। তোমাকে সুখী দেখতে চেয়ে কখন যে তোমার বিশ্বাস ভেঙে ফেলেছি খেয়াল করিনি। বাবা সরি মা। বাবা লাভ’স ইউ।”
বিছানা ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন তিনি। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
——————
অধরা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,
“এরপরের দিন গুলো ছিলো ঘোরলাগা। ঘর থেকে বের হতাম না আমি। আপা ঘরে খাবার এনে জোর করে খাইয়ে দিতো। না নিজে বাইরে যেতাম আর না আমার ঘরে কাউকে সহ্য করতে পারতাম। আমার সবচেয়ে আদরের ছোট বোনটাকেও অসহ্য লাগতো। প্রথম প্রথম দরজা খুলে রাখতাম কিন্তু একটা সময় সবার বারবার আসা, দেখে যাওয়া ভালো লাগতো না। তখন দরজা বন্ধ করে দিতাম। অসহ্য লাগতো সব কিছু। নিজেকে পুরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলাম পুরো পৃথিবী থেকে। ট্যাব ছিলো আমার। ওটায় কল করতো বাবা, আপা। সেটাও সহ্য হলো না। বন্ধ করে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখলাম। নিজের ঘরের অবস্থা ছিলো আরো ভয়বহ। যখনই মাথার মাঝে যন্ত্রণা হতো নিজের শখের রঙ, তুলি সব ভেঙে একাকার করে ফেলতাম। বাইরে দরজার সামনে তখন বাবা, আপা, আঁখি আপা, দাদি, সেঝ চাচি আতঙ্কিত হয়ে ডাকতো আমাকে জবাব দিতাম না। কিছুটা শান্ত হলে ধীর কন্ঠে বলতাম, ‘যাও এখান থেকে। ঠিক আছি আমি।’ এটাও বলতাম বিরক্ত হয়ে। নাহয় ডাকতেই থাকতো। সোজা বংলায় বলতে গেলো মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিলাম আমি, মানসিক ভারসাম্যহীন যাকে বলে।”
অধরা থামলো। তখনের পানির বোতলটা এখনো তার হাতে। আবার গলা ভেজালো সে। গলাটা টনটন করছে। কান্না আটকানোর কারণে এমন হচ্ছে। বুঝতে পারলো অধরা।
তাওসিফ অধরাকে দেখছে। সে শুকনো ঢোক গিলছে। অধরার এই বিভৎস অতীত সে জানতে চায় না। সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু তবুও সে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে শুনছে। কারণ সে জানে অধরা কখনো কারো সামনে নিজেকে এভাবে প্রকাশ করে না। আজ যেহেতু করছে তবে করুক। কষ্ট গুলো উগড়ে দিয়ে মেয়েটা যদি একটু ভালো থাকে তবে থাকুক। অধরাকে একটু ভালো রাখতে তাওসিফ সব করতে রাজি। সব!
অধরা পানির বোতল টা পাশে রখলো। এতক্ষণ পা নিচে ঝুলিয়ে বসে ছিলো। এবার জুতা খুলে পা উপরে তুলে আসন পেতে বসলো সে। তাওসিফের দিকে তাকালো। তাওসিফ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মিলে গেলো দৃষ্টি। অধরা কিঞ্চিৎ হাসলো। বলতে শুরু করলো ফের,
ঘরবন্দী জীবন ভালোয় চলছিলো। ঘরবন্দী অধরা এক নতুন নেশায় মেতেছিলো কষ্ট ভুলেতে, যে খবর জানতো না কেউ। সেসব ঘটনার প্রায় দশদিন পর আরহাম বাড়ি ফিরলো। সে এতোদিন হলে ছিলো, পরীক্ষা চলছিলো তার। বাড়িতে ঘটা কোন ঘটনা সম্পর্কে সে অবহিত নয়। সে বরাবরের ন্যায় বাড়িতে প্রবেশ করে ছোট তিন বোনকে আদুরে স্বরে ডেকে উঠলো,
“আসফি, অরু, নিহা জলদি আয়। চকলেট নিয়ে যা।”
অরুমিতা আর নিহা ছুটে এলেও আজ দোতলা থেকে ছুটে নামলো না অধরা আসফিন। উঁকি দিয়ে বললো না ভাইয়া ওটা কিন্তু আমি নিব। আরহাম সিড়ির দিকে তাকালো। না অধরা নেই। ছোট দু’জনকে তাদের ভাগেরটা দিয়ে আবার ডেকে উঠলো,
“আসফি, এই আসফি। কই তুই?”
অধরার খবর নেই। তানিশা নিচে নেমে এলো। বলল,
“তুই এলি? উপরে যা ফ্রেস হয়ে নে। আমি খাবার দেই।”
আরহাম অবাক হয়ে বলে,
“আসফিন কই আপা? এতেবার তো ডাকা লাগে না। তুই খাবার দে আমি ও কে চকলেট দিয়ে আসি।”
তানিশা ভাঙা গলায় বলে,
“আরহাম শোন।”
আরহাম পিছনে ঘুরে তাকায়। তানিশা ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আসফিনের ঘরের দরজা বন্ধ। কেউ ডাকলেও খুলছে না।”
বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো আরামের মুখ। অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
তানিশা থামে আস্তে আস্তে বলে সব। আরহাম সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু না বলে ছুটে যায় দোতলায়। আদুরে কন্ঠে ডেকে উঠে,
“আসফি, এই আসফি। ভাইয়া চকলেট এনেছি। নিবি না?”
অধরা তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। বারবার দরজার ঠকঠক শব্দ শুনে চোখমুখ কুঁচকে তাকালো। ঘুমের প্রভাবে কন্ঠস্বরটা চেনা অচেনার দ্বন্দ্বে পরে রইলো। উঠবে না উঠবে না করেও শেষমেশ বিরক্ত হয়ে দরজা খুললো। দরজার ওপাশের ব্যক্তিটার দিকে তাকালোও না। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি চাই?”
আরহাম অবাক হতে চেয়েও হতে পারলো না। বুঝলো বোনোর মনের অবস্থা ভালো নেই। অধরার দিকে ভালো করে তাকাতেই আরহাম অবাক হয়ে গেলো।।অধরা রীতিমতো ঘুমে ঢলছে, অথচ দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস তার কোন কালে ছিলো না। আরহাম বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে,
“ঘুম পেয়েছে তোর? রাতে ঘুমাসনি?”
অধরার বিরক্ত লাগছে। এবার কিছুটা চিল্লিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, ঘুম পাচ্ছে। প্লিজ বের হও। ঘুমাবো আমি।”
অধরার চোখ দুটো নিভু নিভু। এখন ঘুমের দেশে হারিয়ে যাবে এমন অবস্থা। আরাহাম ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘরের দিকে তাকালো। ভয়ংকর অবস্থা ঘরের। দেখলে মনে হবে টর্নেডো বয়ে গেছে ঘরের উপর দিয়ে। আরহামের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো বেড সাইডের উপরে আলগোছে পড়ে থাকা ঔষধের পাতাটির দিকে। সে হেঁটে গিয়ে হাতে নিলো পাতাটি। একবার অধরার দিকে তাকালো। মৃদুস্বরে বলল,
“তুই খেয়েছিস সব গুলো?”
অধরা নিভু নিভু চোখ দুটো একটু মিললো। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে পারলো না। বিছানায় গিয়ে ধপ করে শুয়ে পরলো সে। আরহাম ঔষধের পাতাটির নজর বোলালো আর একবার। আটটি বরি নেই। আরহাম ঘরের আশেপাশে নজর বুলিয়ে আরো এক পাতা ঔষধ পেলো। সেগুলো পকেটে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। আসার আগে একবার বোনের দিকে চাইলো। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আরহাম টেবিলের উপর বোনের প্রিয় কিটকেট চকলেটও রেখে এসেছে।
——————
বিকালে ফয়জাল হাসান বাড়ি ফিরলেন। আরহাম বাড়ির কারো সমানে কিছু বলল না। সন্ধ্যার নাস্তার পর চাচার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে বলল,
“ছোট চাচা, আসবো?”
ফয়জাল হাসান ভিতর থেকে বললেন,
“আরহাম, আয়।”
আরহাম ভিতরে প্রবেশ করে চুপ থাকলো। ফয়জাল হাসান বলে উঠলেন,
“কিছু বলবি আব্বু?”
আরহাম পকেট থেকে ঘুমের ঔষধ গুলো বের করে চাচার সামনে রাখলো। মৃদুস্বরে বলল,
“আসফির ঘরে থেকে পেয়েছি।”
ফয়জাল হাসান চমকে গেলেন। বন্ধ দরজার ওপারে থাকা মেয়েটার খেয়াল চাইলেও রাখা যাচ্ছে না। তিনি কি করবেন বুঝতে পারলেন না। আনমনে বলে উঠলেন,
“এগুলো কোথায় পেলো?”
“দাদুনির ঔষধ এগুলো চাচা। সবার আড়ালে নিজের ঘরে নিয়ে গেছে।”
ফয়জাল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি কি করবেন বুঝে উঠতে পারে না। বুঝতে পারে না বলে আরো বেশি অসহায় লাগে। আরহাম বুঝলো চাচার মনের অবস্থা। সে ধীর পায়ে বের হয়ে গেলো চাচার রুম থেকে।
—————
অধরা থামে। তার মনে পড়ে যায় সেদিন সন্ধ্যার কথা। ঘুম ভেঙে গেলে বেড সাইডের উপর নিজের প্রিয় চকলেট দেখতে পায়। ভ্রূ কুঁচকে ভাবতে বসে কিভাবে আসলো। পরক্ষণেই দৃষ্টি যায় দরজার দিকে। দরজা আলতো করে চাপিয়ে দেওয়া। কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে পড়ে বড় ভাইয়া এসেছিলো। মন খারাপের মাঝেও একটু ভালোলাগা কাজ করে। বড় ভাইয়া চকলেট আনতে ভোলেনি!
চকলেট খেয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকে। এরমাঝে তানিশা এসে খাবার খাইয়ে দেয়। আঁখি এসে দেখে যায়। কথা বলার চেষ্টা করে। অধরা নীরব হয়ে থাকে। সবায় চলে যেতেই দরজা আটকে দেয় সে। কষ্ট গুলো ফের বাঁধন ভাঙে। অধরা ঘুমানোর জন্য ঔষধ খুঁজতে থাকে। ঔষধ না পেয়ে পগলের মতো শুরু করে দেয় সে। সে দৃশ্য হালকা হালকা চোখে ভাসে তার। পুরোপুরি মনে করতে পারে না৷ শুধু মনে পরে নিজের মাথা নিজেই দেয়ালে ঠুকেছিলো সেদিন। তারপর কি হয়েছিলো? অধরার জানা নেই।
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৩
ঘন্টা খানিক সময় পেরিয়ে গেছে। স্বপ্ন উদ্যানে লেগেছে বিকেলের আমেজ। অধরা যখন এসেছিলো তখন বেশ ফাঁকা ছিলো আশপাশ। এখন লোকে লোকারণ্য। প্রতিটি বেঞ্চ দখল করেছে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধুমহল কিংবা অবসর কাটাতে আশা মানুষ। কেউবা বসে আছে একা। কেউ করছে অপেক্ষা। এখানে সেখানে বসেছে ঝালমুড়ি, ভেলপুরি আর বাদামের ভাসমান দোকান। দোকানগুলোর সামনে ভির। কেউবা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেতেছে গল্পে। এ যেন ব্যস্ত শহরের মাঝে এক টুকরো প্রশান্তির নীর। যেখানে ব্যস্ততা ভুলে সবায় নিজেকে নিয়ে মেতেছে। অধরাকে অনেকক্ষণ যাবত চুপ থাকতে দেখে এবার তাওসিফ বলল,
“তারপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরলে কি করে?”
অধরা নড়েচড়ে বসলো। মৃদু হেসে বলল,
“আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না?”
তাওসিফ হেসে বলল,
“না হচ্ছি না বরং আগ্রহ অনুভব করছি পুরোটুকু শুনতে।”
কিয়ৎকাল নীরব থেকে অধরা তাই পুনরায় বলতে শুরু করলো,
গেস্ট রুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছে স্বয়ং ফয়জাল হাসান। তার সাথে আছে তানিশা, আরহাম এবং আঁখি। একটু আগে আলোচনা করেছে তারা। আলোচনার মূল বিষয় অধরাকে কিভাবে কিছুটা স্বাভাবিক করা যায়। অনেক ভাবনা চিন্তা শেষে আঁখি বলে উঠলো,
“ছোট চাচা, আসফিন বই পছন্দ করে খুব। আর পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস ও। তুমি বরং স্কুলে গিয়ে ওর বই গুলো আনো। নতুন বই পেয়ে পড়তে বসবে ও। এতে সময় কাটবে।”
আরহাম সম্মতি দিয়ে বলল,
“সাথে কয়েকটা গল্পের বই। আসফি প্রায় রাত জেগে গল্পের বই পড়ে। বই এর মাঝে ডুবে থাকলে ওর মন খারাপ কিছুটা কমবে।”
ফয়জাল হাসান আর তানিশাও হ্যাঁ বলল। ঠিক হলো আগামীকাল অধরার স্কুল থেকে বই নিয়ে আসবে ফয়জাল হাসান। অন্যদিকে আরহাম ও আঁখি কিনে আনবে গল্পের বই।
পরের দিন সকালে অফিসে না গিয়ে অধরার স্কুলে গেলেন তিনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার পরিচিত। সব সময় ক্লাসে প্রথম হওয়ায় শিক্ষকরা অধরাকে একনামে চেনে। ফয়জাল হাসান তাই খুব সহজেই অধরার শ্রেণি শিক্ষকের কাছে গেলেন এবং অধরার বই দিতে বললেন। মিসেস আফিয়া জানতে চাইলো কেন অধরা স্কুলে আসছে না৷ ফয়জাল হাসান জানালেন অধরা অসুস্থ। সুস্থ হলেই স্কুলে আসবে। এরপর ফয়জাল হাসান মেয়ের বই নিয়ে বেরিয়ে এলেন স্কুল থেকে।
এদিকে গল্পের বই কিনতে বের হয়েছে আঁখি ও আরহাম। প্রথমে যাবে আন্দরকিল্লা। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা হলো বইয়ের আরৎ। নতুন, পুরোনো, একাডেমিক, নন-একাডেমিক সব রকম বই পাওয়া যায় এখানে। তবে নতুন লেখকদের বই সেভাবে পাওয়া যায় না। গতকাল রাতে বসে অধরার পছন্দ অনুযায়ী বইয়ের লিস্ট করেছে আঁখি ও তানিশা। আঁখি আরহামকে বলল,
“ভাইয়া আগে আন্দরকিল্লা যাই। ওখানে বেশিরভাগ বই পেয়ে যাব। যেগুলো পাব না সেগুলো বাতিঘর থেকে নিয়ে যাব নাহয়।”
“আচ্ছা চল।”
দু’জনে মিলে আন্দরকিল্লা গেলো। ঘুরে ঘুরে দেখলো এক একটা দোকান। আঁখি দেখে শুনে লিস্ট দেখে দেখে বই কিনলো। অপেক্ষা, পার্থিব, মা, সারেং বৌ, হীরা মানিক জ্বলে, ইন্দুবালা ভাতের হোটেল সহ আরো কিছু বই কিনলো তারা।
বই কেনা শেষ করে আঁখি বলল,
“ভাইয়া, ওনাদেরকে একটা বক্স দিতে বলো। রেপিং করে আসফির টেবিলে রাখবো। কিছুটা সারপ্রাইজ দেওয়ার মতো।”
আরহাম বলল,
“বাহ! ভালো আইডিয়া। আমিও ভবাছিলাম এটা। বক্স খুলে বই দেখে ভীষণ খুশি হবে আসফিন।”
দুই ভাই-বোন দু’জনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। এবার দেখা যাক, আসফিন সত্যিই খুশি হয় কিনা। তাদের পরিকল্পনা কাজে দেয় কিনা।
সারারাত না ঘুমিয়ে অধরা ঘুমিয়েছে ভোরের দিকে। উঠলো তাই এগারোটার পর। তানিশা এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে। এরপর কি আর করবে! কিছু করার নেই, ঘুমের ঔষধ নেই। অধরা বিরক্ত হয়ে গেলো। সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। করলোও তাই। আরেক দফা নিজের ঘরের জিনিস ছুঁড়লো এদিক সেদিক। শেষে ক্লান্ত হয়ে বসে রইলো। আজ শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে তার। পুরো শরীর ঝিমঝিম করছে। ঘন্টা দু’য়েক আলগোছে বসে থাকার পর আবার চোখ লেগে এলো তার।
আঁখি চুপিচুপি এসে দেখে গেলো অধরা ঘুমাচ্ছে। সে গেস্ট রুমে গিয়ে সবায়কে জানালো সেটা। আরহাম আর ফয়জাল হাসান রেপিং করা গল্পের বইয়েড বক্স আর অধরার একাডেমিক বই গুলে নিয়ে ধীর পায়ে এলো তার ঘরে। পড়ার টেবিলে রাখলো সেসব। তারপর একই ভাবে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
অধরা পুনরায় যখন চোখ খুললো তখন বাজে চারটা। অধরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে উঠে বসলো। শরীরের ঝিমঝিম ভাব কমেনি বরং বেরেছে। এরকম হচ্ছে কেন? অধরা বুঝতে পারলো না। ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই টেবিলে লাল রঙের কাগজ দিয়ে রেপিং করা বক্সটায় নজর আটকালে তার। অজান্তেই মুখ ফুটে বের হলো এটা কি? এগিয়ে গেলো সে বক্সটার দিকে। পাশেই দেখতে পেলো নবম ও দশম শ্রেণির একাডেমি বই গুলো। এতোদিন পর অধরা একটু উত্তেজিত বোধ করলো। দ্রুত বইয়ের বাঁধন খুললো। তারাপর একটা একটা করে বই গুলো ছড়াতে লাগলো পুরো টেবিলে। অধরা বাংলা বইটা খুললো। নাকের কাছে এনে বড় করে শ্বাস নিলো। আহা! নতুন বইয়ের গন্ধটা এতো সুন্দর। অধরার মন ভরে গেলো। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো আনন্দে।
ঠোঁটে হাসি নিয়ে অধরা এবার খুব সাবধানে রেপিং কাগজটা খুললো। বেরিয়ে এলো বক্সটা। এবার বক্সটাও খুললো সে। এরমাঝেও বই! অধরা বিস্মিত হলো। এবার বই গুলো বের করলো একটা একটা করে। মোট দশটা বই। অধরা ছুঁয়ে দেখলো বই গুলো। এখনি বই নিয়ে বসতে ইচ্ছে হলো কিন্তু! অধরা নিজের ঘরের দিকে তাকালো। কি অবস্থা! এই জঙ্গলের মাঝে বসে বই পড়া যায় না। অধরা ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে বিছানা, পড়ার টেবিল সহ অন্যসব জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখলো। কিন্তু ওর ঘরে ঝাড়ু নেই। ঝাড়ু দিবে কি করে? অনেকদিন পর অধরা ঘরের বাইরে পা রাখলো। সোজা চলে গেলো আঁখির রুমে। অধরাকে নিজের রুমে দেখে আঁখি তো পুরো চমকে গেলো। তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলল,
“কি হয়েছে আসফি? কিছু লাগবে? বল আপাকে।”
অধরা মৃদুস্বরে বলল,
“ঝাড়ুটা দাও।”
আঁখি আর কোন প্রশ্ন না করে ঝাড়ুটা হাতে দিলো তার। সে আসলে কোন প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। অধরা যদি রেগে যায়। তাই বিনাবাক্যে ঝাড়ু দিয়ে দিলো তার হাতে। অধরাও আর কোন কিছু না বলে ঝাড়ু হাতে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজা আটকিয়ে দিলো সাথে সাথেই।
অধরা নিজের ঘরে এসে প্রথমে ঝাড়ু দিলো পুরো ঘরে। ময়লা গুলো তুলে ফেললো একটা পলিথিনে। এরপর বালতিতে করে পানি এনে নিজের একটা পুরনো জামা ভিজিয়ে রঙের দাগ উঠাতে লাগলো। পুরো ঘর পরিষ্কার করতে করতে রাত নয়টা বেজে গেলো। অধরা অবাক হয়ে দেখলো তাও কাজ শেষ হয়নি। অধরা নিজেকে বলল, আজকের জন্য যথেষ্ট। সে গোসল করে নিলো রাতেয়। এরপর ঘরে এসে বসতেই বুঝলো তার খিদে পেয়েছে। কিন্তু কি খাবে? ভাবতে গিয়ে মনে পড়লো গতদিন বড় ভাইয়া চকলেট দিয়ে গিয়েছিলো। ঘুমের ঔষধ খুঁজে না পাওয়ার রাগ করে খায়নি ওটা। সপ চকলেট নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। অনেকদিন পর নিজের প্রিয় বন্ধু চাঁদকে দেখতে দেখতে চকলেট খেলো সে।
পরের দিন অধরা সকাল সাকল উঠতে চাইলেও কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। সাতটা বাজে। অধরা গতদিনের মতো আজও কাজে লেগে গেলো। সকাল দশটা নাগাত পুরো ঘর বারান্দা সহ পরিষ্কার করে ফেললো সে। নিজের প্রিয় রঙ-তুলি এবং আরো কিছু প্রিয় জিনিসের এমন বেহাল দশা দেখে একটু খারাপ-ই লাগলো তার। কিন্তু কি আর করারা। ময়লা ভর্তি পলিথিনটা দরজার একপাশে রাখলো সে। যাতে বড় আপা তাকে খাবার খাইয়ে যাওয়ার সময় নিয়ে যায়। এসব ভাবতেই তানিশা দরজার সামনে এসে ডাকলো,
“বাবুন, বাবুন! দরজা খোল।”
অধরা দরজা খুলে দিলো। তানিশা ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো। যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া শহরের নতুন রূপ যেন। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ঘর কে পরিষ্কার করলো?”
অধরা চুপ করে থাকলো। কথা বলল না। তার কথা বলতে ভালো লাগছে না। তানিশা আর প্রশ্ন করলো না। এক লোকমা ভাত মুখে পুরে দিয়ে বলল,
“কথা বলবি না কারো সাথে? একা একা থাকবি সব সময় এভাবে?”
অধরা এবারও নীরব। তানিশা আর ঘাটালো না। একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। আজ ঘরে ঠিক করেছে কাল কথাও বলবে। কিন্তু জোর করে হিতে বিপরীত করার দরকার নেই। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো অধরা। তানিশা বের হয়ে যাওয়ার সময় মুখে ফুটে বলল,
“ময়লার পলিথিনটা নিয়ে যাও।”
তানিশা অবাক হয়ে তাকালো অধরার দিকে। মেয়েটা বোধহয় প্রথম আপা শব্দটি ছাড়া কোন বাক্য উচ্চারণ করলো। তার উপরও রাগ মেয়েটার? কিন্তু কেন? তানিশা উত্তর পেলো না তার।
#চলবে…?