#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৫
সকাল দশটা বাজতেই অধরা তৈরি হতে শুরু করলো। সাড়ে দশটা নাগাদ সে সম্পূর্ণ তৈরি। নিজেকে বারকয়েক আরশিতে দেখলো। হুম, সব ঠিকঠাক। অধরা মুচকি হাসলো। সাজগোজ নিয়ে খুব বেশি সচেতন নয় অধরা। তবে আজ সচেতনতা অবলম্বন করলো। প্রথমবার হবু শাশুড়ির সামনে যাচ্ছে বলেই এতো সচেতনতা। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব অবশ্য তার শ্বশুর-শাশুরিই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু অধরা বাড়ি ছিলো না। মেয়ে দেখার প্রসঙ্গ আসলে অধরার হবু শাশুড়ি মা বলেছিলেন, সংসার যে করবে সে দেখলেই হবে। এই বলে তাওসিফের নাম্বার দিয়ে, অধরার নাম্বার নিয়ে গিয়েছিলো। এরপরের গল্প তো জানা। তাওসিফ অধরা দেখা করলো। কথা বললো। ভাঙতে চাওয়া বিয়েতে একটুও ফাটল না ধরে তৈরি হলো আরো মজবুত সম্পর্ক। সব কিছু ভেবে অধরা হাসলো। মনে মনে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ।” শেষবারের মতো আয়নাতে নিজেকে দেখে ঘর থেকে বের হলো অধরা।
বাবার সাথে গাড়িতে পৌঁছালো সান মার। গতকাল রাতে তাওসিফ বলে দিয়েছিল ঠিকানা। গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পেলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাওসিফ ও তার মা। অধরাকে দেখে তাওসিফ ভ্রূঁ নাচালো। অধরা মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। তাওসিফের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
তাইফা অধরার মুখ দুহাতে আগলে নিলেন। মুচকি হেসে বলল,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কিন্তু আমাকে তো আন্টি বলা যাবে না। কি ডাকবে বলো।”
অধরা কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো তাইফার মুখের দিকে। অধরার মনে হলো চারদিকে কেমন মা মা গন্ধ। অধরা মায়া মায়া চোখে তাকালো তার দিকে। আনমনে বলে উঠলো,
“মা!”
তাইফা ভীষণ খুশি হলো। এগিয়ে এসে অধরার কপালে চুমু দিলো। হেসে বলল,
“মনে থাকে যেন।”
অধরা মাথা নাড়িয়ে জানালো তার মনে থাকবে। তাইফা হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
“আমার মেয়ে ছবি থেকে অনেক বেশি সুন্দর। মাশাল্লাহ।”
বলে তার চোখ থেকে কাজল নিয়ে অধরার কানের পিছে লাগিয়ে দিলো। এই একটু আদর, অধরার কান্না পেয়ে গেলো। কিন্তু কাঁদলো না। তাওসিফ ওদিকে ফয়জাল হাসানের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তারপর একসাথে মার্কেটে ঢুকে গেলো তারা।
রঙ-বেরঙের লেহেঙ্গা। ডিজাইন কত রকমের। তাইফা হাতে নিচ্ছেন আবার সরাচ্ছেন। কোনোটা বেশি ভালো লাগলে অধরার গায়ে ধরছেন। ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিয়ে দেখছেন কেমন লাগছে দেখতে। পরক্ষণেই সরিয়ে ফেলছেন। অধরা শুধু মানুষটাকে দেখছে। কত ধৈর্য নিয়ে এক একটা লেহেঙ্গা দেখছে। কখনো তার জন্য তার মা এতো আদর নিয়ে কোন জামা কেনেনি। বেশিরভাগ সময় বাবা কিনে এনেছে কিংবা আপা। অধরার আজ নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হলো। ছলছল করে উঠলো চোখ দুটো। অধরা তার বাবার দিকে চোখ ফিরালো। ফয়জাল হাসান মেয়ের মনের ভাব বুঝলেন। তিনি মুচকি হাসলেন। ইশারায় মেয়েকে বুঝালো এখন থেকে এই মানুষটা তার মা। অধরা আবার তাকালো তাইফার দিকে। তাওসিফ তখন পাশে এসে আলতো করে হাত ধরলো অধরার। অধরা তাকালো। তাওসিফ মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। যেন বুঝালো, হ্যাঁ এটা তোমার মা।
অনেক দেখাদেখির পর তাইফা লালচে খয়েরী রঙের একটি লেহেঙ্গা হাতে নিলেন। ভীষণ সুন্দর দেখতে। অধরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এটা দেখো তো আম্মু। পছন্দ হয়? তোমায় মানাচ্ছে বেশ।”
অধরা মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে নিয়ে নেই।”
তাইফা হাসলেন। অধরারা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এবার এলেন শাড়ির দোকানে। হলুদের শাড়ি পছন্দ করতে বেশি সময় লাগলো না। কিন্তু তাইফা আরো একগাদা শাড়ি নিয়ে বসলেন। দেখে দেখে পছন্দ করলেন প্রায় বারোটা। সব গুলো কিনলেনও। অধরা শুধু অবাক হয়ে দেখলো। এরপর থ্রিপিসও কিনলেন অনেক গুলো। অধরা এবার অবাক হয়ে বলল,
“এতগুলো কার জন্য মা?”
তাইফা অধরারা দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন তোমার। আমাদের বাড়ি এসে পরবে এগুলো।”
অধরা চোখ বড়ো বড়ো করে বলে উঠলো,
“এইসব আমার?”
“হুম”
বলে তাইফা আবার নতুন কিছু দেখতে লাগলেন। অধরা মাথায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো তার হবু শ্বাশুড়ির দিকে। কিছু বলল না৷ দারুণ মানুষটির মন খারাপ হবে এমন কোন কাজ করতে ইচ্ছে হলো না অধরারা।
——————————
“ভাই এসব পাসওয়ার্ড হ্যাক করা এতো সহজ না। হবে না। বাদ দেন।”
“আরে শুরু থেকে কেউ ব্যবহার করে না। চেষ্টা করে দেখ।”
“আরে ভাই কথা বোঝেন না? এতো সহজ হইলে তো মানুষের ব্যাংকের টাকা দিয়ে বড়োলোক হয়ে যাইতাম।”
বিরক্তবোধ করলেন ফারুক হাসান। বিরক্তি স্বরে বলল,
“আরে বলতেসি খোলার পর থেকে কেউ ব্যবহার করে নাই। একটা বার চেষ্টা করে দেখ। হলে হবে না হলে নাই।”
ছেলেটা এবার চেষ্টা করলো। মিনিট দশেক পর ফারুক হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একাউন্টে সব ধরনের প্রাইভেসি সেইট করা। কোনভাবে এটা হ্যাক করতে পারবেন না। এরচেয়ে একটা ভালো কথা বলি, এই একাউন্টের টেনশন মাথা থেকে সরান।”
ফারুক হাসান কিছুটা চমকে উঠলো। বলল,
“সব ধরনের প্রাইভেসি সেইট করা মানে?”
“মানে ভয়েস রিকগনিশন সহ সব সেইট করে রাখা। কোন না কোনভাবে ধরা পড়বেনই। তাই বললাম বাদ দেন।”
ফারুক হাসান বুঝলেন অধরা নিজের একাউন্টের দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছে। ভাবতেই গা জ্বলে গেলো তার। এই টুকু একটা মেয়ে তার সাথে খেললো? তার সব পরিকল্পনা নিমেষে নিঃশেষ করে দিলো? ফারুক হাসান রাগে অন্ধ হয়ে গেলো। হিসহিস করতে লাগলেন তিনি। মনে মনে আওড়ালেন,
“এতো সহজে জিতবে না তুমি আসফিন। কোথায় পাচ্ছো এতো সাহস? হু? সব সাহস হাওয়ায় উড়িয়ে দিব আমি। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি। ধ্বংস করে দিব তোমায়!”
বাঁকা হাসলেন ফারুক হাসান। বিরবির করে বললেন,
“তোমার বাবা আর দাদুনি কতদিন আর রক্ষা করবে তোমাকে?”
সশব্দে হেসে উঠলো ফারুক হাসান। না জানি মনে মনে নতুন কি পরিকল্পনা করলো। অধরা আসফিন প্রস্তুত? নতুন প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করার জন্য?
—————————–
কেনাকাটা আজকের জন্য অনেকটা শেষ। আগামীকাল আবার আসবে অধরা ও তার শাশুড়ি। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই ঠিক হলো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিবে সবায়। একটা টেবিলে গিয়ে বসলো সবায়। অধরা বসলো তাইফার পাশে। মেনু কার্ড হাতে নিয়ে তিনি অধরার দিকে ফিরলেন। বললেন,
“আম্মু, কি খাবে বলো দেখি।”
অধরা মুচকি হেসে বলল,
“আপনি অর্ডার দিন মা।”
“না না তুমি দাও। তুমি কোনটা পছন্দ করো বলো। সেটায় আজকে সবায় মিলে খাবে।”
অধরা মেনুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমি তো ডিসিশন নিতে পারি না।”
হেসে ফেললো সবায়। তাওসিফ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তাকে বলতে না দিয়ে তাইফা বলে উঠলো,
“এখন থেকে নিতে হবে। বলো দেখি কি খাবে।”
অধরা কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর মিনমিন করে বলল,
“ফ্রাইড রাইস, চিকেন।”
তাইফা খুশি হলেন। হেসে বললেন,
“এইতো পেরেছো। গুড। তুমি কি চাও সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। সবায় সবসময় তোমাকে বুঝবে না। নিজেকে ভালো রাখতে তাই সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে বুঝেছো?”
অধরা মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে বুঝেছে।
——————————
বরাবরের মতো দুপুরে নিস্তব্ধ নবকুঞ্জ। চারদিকে ভালো করে নজর রেখে অধরার ঘরের সামনে এসে পৌঁছাল ফারুক হাসান ও মায়মুনা। আজ অধরা ঘরে লক করে যায়নি। সেই সুযোগ নেওয়ায় তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আরো একবার আশেপাশে ভালো করে খেয়াল করে অধরার ঘরে ঢুকে পরলো তারা। এরপর শুরু হলো চিরুনি তল্লাশি। অধরার ঘরের সকল জিনিসপত্র উলোটপালোট করা হলো। টেবিলের ড্রয়ার, আলমারি, বিছানার নিচ কিছুই রক্ষা পেলো না। ঘরের সকল আসবাব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তারা পেলো না কাঙ্খিত জিনিস। বিরক্ত হলো ফারুক হাসান। ঘরে না থাকলে থাকবে কোথায়? মায়মুনা চিন্তিত স্বরে বলল,
“ঘরেই তো থাকার কথা। নাহয় গতকাল লক করে রেখেছিলো কেন ঘর!”
ফারুক হাসান চিন্তিত স্বরে বলল,
“আজ তো লক করেনি। তাহলে কি কাগজপত্র সাথে করে নিয়ে গেছে?”
মায়মুনা কপাল কুঁচকে বলল,
“কি সব বলো। কাগজ কি সাথে করে নিয়ে ঘোরাঘুরি করার জিনিস?”
“তাহলে কোথায়?”
“আছে হয়তো কোথাও। আর একবার চেক করি চলো।”
আবার ঘাটাঘাটি করলো তারা। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। কিছুই পেলো। উল্টো দেখা গেলো অধরার পুরো ঘর বিগড়ে গেছে। এমন ভাবে বিগড়েছে যে ঠিক করার উপায় নেই। ঠিক করার মতো হাতে সময় নেই। তাই ঘর ওভাবে রেখে বেরিয়ে এলো তারা।
————————–
বাড়ি এসে নিজের ঘরের দিকে গেলো অধরা। ঘররে দরজা খুলে একপলক দেখলো ঘরের অবস্থা। আবার সিঁড়ির সামনে ফিরে এলো সে। জোরে জোরে ডাকতে লাগলো,
“বাবা, বাবা। বাবা।”
ফয়জাল হাসান সবে ঘরে ঢুকে ছিলেন। মেয়ের গলার স্বর শুনে দ্রুত বের হয়ে এলেন ঘরে থেকে। বেরিয়ে এলো বাড়ির প্রায় সবায়। অধরা বহুদিন এভাবে চিৎকার করে না। আজ হঠাৎ চিৎকার করার কারণ জানতেই সবার ভির। ফয়জাল হাসান মেয়ের কাছে এসে বললেন,
“কি হয়েছে মা? কোন সমস্যা?”
“আমার ঘরের অবস্থা দেখো বাবা। মনেহয় ঝড় হয়েছে ঘরের মাঝে। জিজ্ঞেস করো সবায়কে। কে ঢুকেছিলো আমার ঘরে?”
ফয়জাল হাসান মেয়ের ঘরে উঁকি দিলেন। ঘরের অবস্থা দেখে নিজেই আঁতকে উঠলেন। এ কি অবস্থা। ওদিকে বাড়ির সবাই কানাকানি করছে কে ঢুকলো অধরার ঘরে? ফয়জাল হাসান গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কে ঢুকেছিল আসফিনের ঘরে?”
কেউ সাড়া দিলো না। অধরার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। বলল,
“আমি কিন্তু এখনো ঘরে ঢুকিনি। ঘরের প্রত্যেকটা জিনিসে আঙ্গুলের ছাপ আছে।”
তুবা নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ঢুকেছিল হয়তো বাচ্চারা কেউ। একটু উল্টোপাল্টা করেছে। এখন ভয়ে বলছে না। সেটা নিয়ে এতো ঢং করার কি আছে। ঘরে কি গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছো?”
অধরা কাঠকাঠ কন্ঠে জবাব দিলো,
“অবশ্যই আমার ঘরে গুপ্তধন আছে। সেটার উপরে নজর পরেছে চিলের। আর বাচ্চাদের কথা? ওরা কেউ আমার ঘরে ঢোকে না, সেটা সবায় খুব ভালো করে জানেন।”
চুপ হয়ে গেলো তুবা। আর কোন কথা বলল না। অধরা সবার দিকে একপলক তাকালো। তারপর সরাসরি ফারুক হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“নেক্সট টাইম ফলাফল ভয়াবহ হবে আগেই বলে দিলাম। সো বি কেয়ারফুল।”
ফারুক হাসান চমকে তাকালো অধরার দিকে। অধরা তাকিয়েই ছিলো তার দিকে। হিসহিসিয়ে বলল,
“ওয়ার্নিং দিলাম।”
আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো অধরা। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো সবায় হতভম্ব হয়ে। আর আতঙ্কিত হলো কেউ!
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৬
এখন সন্ধ্যাবেলা। দুপুরে বাসায় ফিরে বিধ্বস্ত ঘর কিছুটা স্বাভাবিক পর্য়ায়ে নিয়ে এসে সবে গোসল করে বের হলো অধরা। বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে ঘরে এসে বসলো। নিচ থেকে বাচ্চাদের চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। এখন নবকুঞ্জের নাস্তার সময়। সবায় নিচে আছে নিশ্চয়ই। অধরা কি যেন ভাবলো। ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ঘরের দরজা খুলে বের হলো সে। সিঁড়ির কাছে গিয়ে সশব্দে ডেকে উঠলো,
“অরুমিতা।”
অরুমিতা নিহা ও নীরবের সাথে খেলছিলো। অরুমিতা! শব্দটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো সে। বুকে ধুকপুক ধুকপুক শব্দ হতে লাগলো। মনে হলো একটা ঢিল কেউ পুকুরে ছুঁড়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ঢেউ। ঢেউয়ের কেন্দ্রবিন্দু হলো অরুমিতা। তবে জলতরঙ্গের মতো ঢেউ ছড়িয়ে পরলো আশেপাশেও। ডাইনিং টেবিলে বসা আরো কয়েক জোড়া চোখ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অধরার দিকে। অরুমিতা বোনের দিকে তাকালো। কিন্তু কোন জবাব দিতে পারলো না। তার চোখ টলমল করছে। কতোদিন! কতোদিন পর তার আপুই তাকে ডাকলো। অরুমিতা তাকাতেই অধরা বলে উঠলো,
“আমার ঘরে আসো।”
কথাটা শেষ করে অধরা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। আরাব এতক্ষণ একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো অধরার দিকে। ভেজা চুল, চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পরা পানি! কি স্নিগ্ধ লাগছিলো মেয়েটাকে। আরাবের সাধের নারী! হাহ! আর দশদিন পর সে অন্যের হয়ে যাবে। আরাব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। নিজের উপর বড়ো অভিমান হয় তার।
অরুমিতা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। বোনের ঘরের সামনে এসে থেমে যায় তার পা। শুকনো ঢোক গিলে কয়েকটা। বহুদিন পর বোনকে শোনানোর উদ্দেশ্যে ডেকে উঠে,
“আপুই।”
“ভেতরে আসো।”
অধরার কন্ঠস্বর সাথে সাথে এসে বারি খায় অরুমিতার কানে। অরুমিতা ঘরে ঢোকে। অধরা বিছানায় বসে ফোন চালাচ্ছিলো। অরুমিতা দাঁড়িয়ে থাকে এক কোণে। কোন কথা বলে না। অধরা ফোন রেখে চোখ তুলে তাকায়। বলে,
“বসো। দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
অরুমিতা চুপ করে বোনের পাশে বসে। অধরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ছোট বোনের দিকে। অরুমিতা সরাসরি তাকাচ্ছে না তার দিকে। আড়চোখে দেখছে। অধরার হাসি পেলো কিন্তু হাসলে না। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সে। বোনকে নিয়ে কত শখ ছিলো তার। বোনকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড বানাতে চেয়েছিলো। অথচ আজ তাদের কি ভীষণ দূরত্ব। অধরা উঠে দাঁড়ালো। আলমারিতে তুলে রাখা শপিং ব্যাগ গুলো থেকে সাদা রঙের একটা ব্যাগ বের করে নিয়ে এসে অরুমিতার হাতে দিলো। মুখে বলল,
“বের করে দেখো।”
অরুমিতা ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ভীষণ সুন্দর একটা ড্রেস বের করলো। খয়েরী রঙের। অরুমিতা বোনের দিকে তাকালো। অধরা বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”
অরুমিতা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“অনেক। ধন্যবাদ আপুই।”
অধরা হালকা হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমার উপর অনেক রাগ তাই না? নাকি অভিমান? কত দূরত্ব আমাদের মাঝে। অন্যদের মতো না। সব আমার জন্য।”
অরুমিতা চুপ। অধরা হাসলো। বলল,
“ছোট হয়েও তুমি বড়দের মতো আপুইকে আগলে রাখেছো। অথচ আপুই তোমাকে কাছে ডাকিনি। মন খারাপ হয়নি?”
অরুমিতা কিছুটা চমকে উঠলো। অধরারা দিকে তাকালো চোখ বড়ো বড়ো করে। অধরা হেসে বলল,
“কি ভেবেছো, কেউ আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখবে, আর আমি জানবো না?”
অরুমিতা এতক্ষণ পর হাসলো। হেসে বলল,
“আমার ঘরে যে হুটহাট চকলেট, চিপস পাওয়া যেতো সেগুলো কে রাখতো আমিও জানি।”
অধরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অরুমিতার দিকে। অরুমিতাও তাকালো। দুজন একসাথে ফিক করে হেসে দিলো।
—————————–
তাইফা খুশি মনে জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখছে। তরু-লতা তার পাশে ঘুরঘুর করছে আর কতক্ষণ পর পর বলে উঠছে,
“বলো না মা, ভাবির সাথে কি কি কথা বললে? ভাবি কেমন? মিশুক? আমাদের কথা জিজ্ঞেস করেছে? বলো না।”
তাইফা মেয়েদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাইফা কতোগুলো শপিং ব্যাগ হাতে ছেলের রুমের দিকে যাবে তখনই তার পিছু নিলো তরু-লতা। জিজ্ঞেস করলো,
“এর মধ্যে কি আছে মা?”
“তোদের ভাবির জন্য কেনা শাড়ি আর থ্রিপিস।”
“আমরা গুছিয়ে রাখি মা?”
তাইফা মেয়েদের দিকে ভ্রূঁ বাঁকিয়ে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বলল,
“না, লাগবে না। আমিই করে নিব।”
তরু লতারর দিকে তাকিয়ে বলল,
“বুঝলি লতা, এখন আমাদের আর কেউ পাত্তা দিবে না। ভাবি হবে সবার মধ্যমণি।”
আতাউর রহমান বসেছিলেন চেয়ারে। তিনি মেয়ের কথায় ফিরে তাকালেন। হেসে বলল,
“কে কাকে পাত্তা দিচ্ছে না?”
লতা অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমাদের আর কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। বাড়িতে নতুন মানুষ আসছে যে।”
আতাউর রহমান হেসে বললেন,
“নতুন মানুষ আসলে তাকে নিয়ে তোমরাই ব্যস্ত থাকবে। অন্যকারো পাত্তা খুঁজবে না।”
তাইফা এতোসব কথার ধার ধারলো না। ছেলের ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে একপাশে সাজিয়ে রাখতে লাগলো সদ্য কিনে আনা কাপড়-চোপড়।
———————————
রাতের খাবার হাতে নিয়ে মেয়ের ঘরে এলেন ফয়জাল হাসান। অধরাকে বাবাকে দেখে হাসলো। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বলে উঠলো,
“সব সময় একদম সঠিক টাইমে কিভাবে খাবার নিয়ে আসো আব্বু?”
ফয়জাল হাসান হেসে বলল,
“আমার মেয়ের কখন ক্ষুধা লাগে আমি জানি তো।”
অধরা হাসলো। পরক্ষণেই মুখ ভার করে বলল,
“তোমায় ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই আমার দমবন্ধ লাগে আব্বু।”
ফায়জাল হাসান হেসে বললেন,
“মেয়েদের তো যেতেই হয় মা।”
অধরা কোন কথা বলল না। ফয়জাল হাসান বললেন,
“বোনের সাথে সব ঠিক হয়ে গেলো?”
“আমাদের সব ঠিকই ছিলো আব্বু। শুধু তোমরা দেখতে পেতে না।”
ফয়জাল হাসান হেসে বলল,
“তাই নাকি?”
“জি আব্বু।”
ফয়জাল হাসান মেয়ের মুখে আবারো ভাত তুলে দিয়ে বলল,
“তোমার ঘরে আজ কে এসেছিলো তুমি জানো?”
অধরা হাসলো। উত্তর দিলো না বাবার প্রশ্নের। ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হলো? কথা বলছো না কেন?”
“তোমার কেন মনে হলো আমি জানি?”
“তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে তুমি জানো।”
অধরা হাসলো। ফয়জাল হাসান বলল,
“বাবার থেকে কথা লুকানো শিখে গেছো?”
“না বাবা। বলবো। এখন না। আগে প্রমাণ সংগ্রহ করি।”
ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
বাবা মেয়ে দুইজন দু’জনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। অধরারা বোনটা বেজে উঠলো তখনই। অধরা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। ফয়জাল হাসানের চোখ বেখেয়ালি ভাবে ফোনের স্ক্রিনের দিকে চলে গিয়েছিলো। তিনি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলেন। অধরা ফোন কেটে বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো তার বাবা হাসছে। অধরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“হাসছো কেন আব্বু? হাসির কি হলো?”
ফয়জাল হাসান বহু কষ্টে হাসি আটকিয়ে বলে উঠলো,
“হাসছি? আমি? কখন হাসলাম। তুমি নিশ্চয়ই ভুল দেখেছো।”
“না, তুমি হেসেছো।”
“একদম না। কোন কারণ ছাড়া হাসবো কেন আমি?”
অধরা মুখ ফুলালো। সে স্পষ্ট দেখেছে বাবা হাসতে আর এখন কিনা বাবা অস্বীকার কারছে? সে মুখ ফুলিয়ে বলল,
“মিথ্যে বলবে না আব্বু।”
ফয়জাল হাসান এবার আর হাসি আটকিয়ে রাখতে পারলো না। মেয়ের ফোলা মুখ দেখে হেসে ফেললেন। অধরা মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। ফয়জাল হাসান হাসি থামিয়ে বলল,
“সরি, মা। আর হাসবো না। ”
“হেসেছো কেন?”
ফয়জাল হাসান মৃদু হাসলো। মৃদু স্বরে বলল,
“মেয়ের সুখ দেখে একটু হেসেছি। হু?”
অধরা বাবার কথা বুঝলো, কিছুটা লজ্জা পেলো। নিজেও হেসে ফেললো।
——————————–
“মেয়েটা হুট করে এতো পরিবতন হলো কি করে? কেমন তেজী স্বরে কথা বলে, কাউকে পাত্তা দেয় না। এমন তো ছিলো না আগে। সব সময় গা বাঁচিয়ে চলা মেয়েটার এমন রূপ কি করে হলো?”
“ওই যে ওর বাপ আর তোমার মা, তারাই তো আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলছে তাকে। আর তোমার বাপ তো নিজের পুরো সম্পত্তি পারেনি তাকে দিয়ে যেতে।”
মায়মুনা রাগী স্বরে কথাটা বলল। আবির কিছুটা ভবুক হয়ে বলল,
“আমার কিন্তু সেটা মনে হয় না। চাচা আর দাদুনি সব সময় ওর পাশে ছিলো কিন্তু এতো সাহস ও দেখাতো না। এখন ওর নতুন সাহস ওর হবু বর। ভীষণ মিল তো। সেদিন দেখলাম একসাথে ঘুরছে। মাঝে মাঝেই তো যায়।”
ফারুক হাসান ভাবলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“হু, তোমার কথায় যুক্তি আছে।”
তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। বললেন,
“তাহলে পরবর্তী পরিকল্পনা কি বুঝতে পারছো? ওই মেয়েকে ভাঙতে হলে আগে ওই ছেলেকে দেখে নিতে হবে।”
হাসলো ফারুক হাসান। সেই সাথে হাসলে আবির ও মায়মুনা। কে জানে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা কি!
#চলবে…?