দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-২৭+২৮

0
3

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৭

পরিকল্পনা মাফিক কারো ক্ষতি করতে চাইলে তার সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে হয়। তাওসিফকে নিয়ে তৈরি করা পরিকল্পনা খুব সিম্পল। অনেকটা বাংলা সিনেমার দৃশ্যের মতো। ভারা করা গুন্ডা দিয়ে তাওসিফ কে গুলে নিয়ে অধরাকে ভয় দেখানো হবে। খুবই সহজ কাজ কিন্তু সমস্যা হলো তাওসিফ সম্পর্কে কোন ইনফরমেশন ফারুক হাসানের কাছে নেই; নেই তাওসিফের কোন ছবিও। তাই তাদের প্রথম লক্ষ্য এখন তাওসিফ সম্পর্কে জানা। সেই উদ্দেশ্যে আবির একদিন তাওসিফ কে অনুসরণ করেছে। সেদিন বন্ধুদের সাথে স্টেডিয়ামের পাশের প্রাচীরে বসে আড্ডা শেষে বাসায় ফিরছিলো তখনই আবির তাকে অনুসরণ করা শুরু করে। আবিরের ধারণা ছিলো তাওসিফ তাকে চিনে না। কিন্তু বেচারা কি আর জানতো তার জম তাওসিফ বহু আগে থেকে তাকে চিনে। সে বেশ দূর থেকে তাওসিফের পিছনে পিছনে চলতে লাগলো। তাওসিফ আঁড়চোখে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারলো তাকে কে অনুসরণ করছে। তাওসিফ চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। মাঝে মাঝে শিসও বাজাতে লাগলো। আবির বেশ দূরত্ব রেখে চলছে তাওসিফের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে। তাওসিফ বাঁকা হাসলো। তাদের বাড়ি থেকে বেশ আগে একটা গলি আছে, সেই গলির মাঝে আবার আরো কতগুলো গলি আছে। তাওসিফ ফট করে ঢুকে গেলো সেই গলি ময় রাস্তায়। আবিরও পিছু পিছু গেলো। রাস্তাটিয় যেমন গলির সংখ্যা অধিক, তেমনি মানুষের ভিরও লেগে থাকে সব সময়। বিকেলে তো আরো বেশি। রাস্তায় বাচ্চারা খেলা করে, রাস্তার ধারের দোকান থেকে সবজি কিনতে ব্যস্ত হয়ে পরে কতশত মানুষ। এমন ভিরের মাঝে কাউকে অনুসরণ করা প্রায় অসম্ভব। আবির বেশ কিছু সময় তাওসিফকে নজরে রাখলেও হারিয়ে ফেললো খুব দ্রুত। তাওসিফ কয়েকটা গলি পার হয়ে পিছনে তাকালো। আবিরকে দেখতে না পেয়ে হেসে ফেললো। তারপর শিস বাজাতে বাজাতে পা চালালো বাড়ির দিকে। এদিকে আবির খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। শেষে না পেয়ে ফিরে গেলো সে।

আবার একদিন, তাওসিফ তাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা দোকানের সামনে বেঞ্চে উল্টো দিকে বসে চা খাচ্ছে। এমন সময় শুনতে পেলো কেউ দোকানদারকে জিজ্ঞেস করছে,

“ভাই তাওসিফ আবরারের বাড়িটা কোন দিকে।”

দোকানদার দ্রুত তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, মাথ নাড়িয়ে না বুঝালো সে। দোকানদার কিছুটা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল,

“এই শহরে কে কাকে চেনে ভাই?”

আবির হতাস হলো। যা ভেবেছিল তাই। সত্যিই তো! এই শহরে কে কাকে চিনে? কার খবর কে রাখে। হতাশাগ্রস্ত আবির জানলোও না তার শিকার ছিল একদম তার সামনে।
———————–

মেঘলা আকাশ। বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে থিমতালে উড়ছে অধরার ওড়না। সময়টা বিকেল। অধরা-তাওসিফের বিয়ে আর চারদিন পর। আজকের পর তাদের দেখা হবে একদম বিয়ের দিন। তাওসিফই আজ অধরাকে নিয়ে বের হয়েছে। আজ তারা এসেছে নতুন ব্রিজ বলে খ্যাত ব্রিজের দিকে। এদিকে জনমানব নেই বললেই চলে। ব্রিজের উপর দিয়ে ছুটে চলছে বাস, ট্রাক, সিএনজি কিংআা মোটরসাইকেল। অধরা দাঁড়িয়ে পরলো। তাকালো নিচে নদীর দিকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলো,

“জায়গাটা তো সুন্দর খুব।”

তাওসিফ হালকা হাসলো। সে জানে অধরা প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাইতো সে অধরাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে আসে বারবার। তাওসিফ কিছু বলছে না দেখে অধরা তার দিকে ফিরলো। অবাক হয়ে বলল,

“আপনার আবার কি হলো? কথা বলছেন না যে?”

“কিছু হয়নি ম্যাডাম।”

অধরা ভ্রূঁ কিছুটা উঁচু করে তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলল,

“তোমার চাচাতো ভাই আমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে কেন বলোতো?”

অধরা অবাক কন্ঠে বলল,

“আমার চাচাতো ভাই? কে?”

“আবির!”

“আপনাকে খুঁজছে?”

অধরার কন্ঠে বিস্ময়। সে বিশ্বাস ই করতে পারছে না। আবির কেন তাওসিফ কি খুঁজবে? কি চাই তার? তাও আবার তাওসিফের থেকে। অধরা অবাক হয়েই বলল,

“আপনি কিভাবে জানলেন আপনাকে খুঁজছে?”

“একদিন আমাকে অনুসরণ করেছে। বেচারাকে গলির মধ্যে ঘুরপাক খাইয়েছি। আর একদিন আমার সামনেই এক দোকানদারকে আমাদের বাড়ির খোঁজ জিজ্ঞেস করেছে।”

“আপনাকে দেখতে পায়নি?”

“উহু, উল্টো দিক হয়ে বসে ছিলাম।”

“কিন্তু কেন?”

অধরার বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে মানতেই পারছে না আবির তাওসিফ এমন হন্ন হয়ে খুঁজছে। তাওসিফ কিয়ৎকাল ভেবে বলল,

“এখনো বুঝতে পারছি না।”

অধরা ভাবনায় মশগুল হয়। তাওসিফ বলে উঠে,

“সামনে বিয়ে বলে কোন ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না। নাহয় শালাকে বুঝিয়ে দিতাম তার দুলাভাই কি জিনিস।”

অধরা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ হাসলো। নিমেষেই অধরার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। অধরা থমকে গেলো। দ্রুত দৃষ্টি ঘোরালো অন্যদিকে। অবচেতন মনে খুকখুক করে কেশে উঠলো।
——————————-

“বাবা কোন ভাবে তাওসিফ মানে অধরার হবু বরের খবর নিতে পারছি না। কি করবো?”

“তুমি ও কে অনুসরণ করছিলে না?”

“হ্যাঁ”

“হারিয়ে ফেললে কি করে?”

“মানুষের মাঝে…”

“হু।”

ফারুক হাসান চুপ করেন। ভাবতে থাকেন তিনি। তার কেন যেন মনে হয় তাওসিফ ছেলেটা বিশাল ধুরন্ধর। তার সব পরিকল্পনা ছেলেটা বুঝে ফেলেছে। তিনি ভাবেন। কিন্তু কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। হার মেনে যাবেন তিনি? এতই সহজে? ফারুক হাসান পরবর্তী সিদ্ধান্ত কি নিবেন বুঝতে পারছেন না।

মায়মুনা ছেলে-স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো তার মনে কু ডাকছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে তার ছেলেটার সামনে বিপদ, খুব বড় বিপদ। আর এই বিপদের জন্য দায়ী তিনি নিজেই।
———————————–

মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কারো কাছ থেকে কোন পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি ফয়জাল হাসান। নিজের মন মাফিক সকল ব্যবস্থা করছেন তিনি। বিশাল বাড়িটাকে সাজিয়ে মনের মতো করে। চারদিকে কত রঙের আলো। ঝলমল করছে নবকুঞ্জ। বাড়িতে মেহমানও হয়েছে অনেক। অন্যান্য আয়োজনও করা হয়েছে বিশাল আাকারে। তুবা সেসব দেখে রাগে গিজগিজ করছে। তার কেন যেন সহ্যই হচ্ছে না এসব। তিনি ঘুরেফিরে কিছুক্ষণ দেখে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলো। ফয়জাল হাসান দেখলেন কিন্তু মোটেও পাত্তা দিলেন না।

অধরা এ বাড়ির মানুষদের সাথে যেমন বেশি কথা বলে না। তেমনই বলে না আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। আজ পুরো বাড়ি মেহমানে ভরপুর। তার বড় ফুপুর সাথে এক দূর সম্পর্কের ফুপু সহ বেশ কয়েকজন তার ঘরে ঢুকলো। অধরা তখন ল্যপটপে মুখ গুঁজে ছিলো। তার ফুপু ঘরে ঢুকেই মৃদু স্বরে ডাকলো,

“আসফিন, আম্মু।”

অধরা চোখ তুলে তাকালো। ফুপুকে দেখে মুচকি হাসলে। মুখে বলল,

“ভিতরে আসো ফুপু। কখন এলে?”

ফুপু কিছুটা অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,

“এসেছি সেই কখন। তুমি তো কিছুই খেয়াল করো না।”

অধরা হাসলে। হেসে বলল,

“একটু কাজ করছিলাম।”

তিনি কথা বাড়ালেন না। এগিয়ে গেলেন ভাইজির দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম আদরে। কিন্তু তার সেই দূর সম্পর্কের ফুপু হুট করে বলে উঠলো,

“তোমার অহি, অণিতা, আঁখি আপুর বিয়ে না দিয়ে তোমার বিয়ে দিচ্ছে কেন? হ্যাঁ?”

তার প্রশ্নে স্পষ্ট বাজে ইঙ্গিত। অধরার চোখে মুখে ফুটে উঠলো ক্রোধ। তবে নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে অধরা মুচকি হেসে বলল,

“অণিতাপু এই বাড়িরই বউ। আপনি জানেন না বোধহয়।”

আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে কথা অন্যদিকে ঘুরে গেছে কিন্তু সেই মহিলা কথা ঘুরালো না। বরং বলল,

“অহি, আঁখির তো বিয়ে হয়নি।”

এবাট আর নিজেকে সামলাতে পারলো না অধরা। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন সোজাসুজি বলেন।”

মহিলা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। তবুও সাহস করে বললেন,

“কিছু ঝামেলা না হইলে তো আর এই বাড়ির মেয়েদের এত সহজে বিয়ে দেওয়া হয় না। বাড়ির বড় মেয়েও তো প্রেম করে বিয়ে করছে।”

অধরা বিরক্ত হয়। তার আপাকে নিয়ে কেন কথা বলবে? আপার পছন্দ হয়েছে, বাসায় জানিয়েছে, পরিবার কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে। এতে দোষ কই? অধরা শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“আমিও আমার বহু জামাইয়ের সাথে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে প্রেম করি। আপনার কোন সমস্যা? সমস্যা থাকুক আর না থাকুক আমার কিছু যায় আসে না। আপনি এখন আমার ঘরে থেকে আসুন।”

মহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয় রইলো অধরার দিকে। অধরা পাত্তাও দিলো না। নিজের কাজে মন দিলো। অধরার ফুপু মিটমিট করে হাসতে লাগলো। মহিলা বাইরে চলে গেলো। অধরার ফুপু বলে উঠলো,

“পনেরো বছর ধরে প্রেম করো?”

অধরা ফুপুর দিকে তাকিয়ে হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,

“করতে পারলে তো ভালোই হতো ফুপু।”

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৮

ড্রয়ারের তালা খুলে সেখান থেকে একটা টেপ রেকর্ডার বের করলো আয়মান সাহেব। বেশ পুরোনো ধাঁচের। নিজেই একবার চোখ বুলিয়ে নিলো হাতে থাকা ছোট যন্ত্রটির দিকে। পরক্ষনেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে উঠলো,

“তুমি কিভাবে বুঝতে পারলে অধরার জমিজমার উপর কারো নজর পরেছে।”

“আন্দাজ করেছিলাম চাচা।”

“তুমি বলেই আমি টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে ছিলাম। তবুও মনে মনে বলছিলাম যে যদি সন্দেহজনক কিছু না পাই তোমাকে দু, চারটে কথা শুনিয়ে দিব। আসলে ওদের বাড়ির সাথে পুরনো সম্পর্ক। ভাবতেই পারিনি এমন কিছু হবে। নাহিদ হাসান আমার বন্ধু। সে ছিলো ভীষণ ভালো মানুষ।”

“জি চাচা বুঝতে পেরেছি।”

তাওসিফ আরমান সাহেবের হাত থেকে টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে যত্ন করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। আয়মান সাহেব মাথা নাড়িয়ে বললেন,

“পরসু তো তোমাদের বিয়ে। সাবধানে থেকো বাবা। বহু বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত আছি। কত খবর শুনি। সামান্য জমির জন্য খু*ন পর্যন্ত হয়। নিজে সাবধানে থেকো, মেয়েটাকেও সাবধানে রেখো।”

তাওসিফ মৃদু হেসে বলল,

“দোয়া করবেন চাচা। আর বিয়েতে আসবেন কিন্তু। আজ তাহলে আসি।”

বিদায় জানিয়ে আয়মান সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তাওসিফ। বাইকে বসে বাঁকা হাসলো। মনে মনে বলে উঠলো,

“ফারুক হাসান! বয়সে আপনি অনেক বড়, কিন্তু শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।”
——————————-

নবকুঞ্জ আজ সেজেছে নতুন রূপে, বহুদিন পরে। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ। বাচ্চাদের হৈ হই রব। বয়স্করা মেতেছে গল্প গুজবে। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে সবার। একসাথে হয়ে তাই আজ আর ফুরসত নেই কারো। নিজেদের মনের কথা এক একজন উগড়ে দিচ্ছে অনায়াসে। নবনী আনজুম তার বোন সহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে গল্পে মেতেছেন। আজ তিনি অনেক খুশি। অবশেষে! অবশেষে এই বাড়ি থেকে মুক্তি মিলবে তার অতি আদরের নাতনির। তার খুশির কারণ শুধুই এটা।

অধরাকে তৈরি করে দিচ্ছে আঁখি, তানিশা সহ আরো কতোগুলো মেয়ে। অধরা নীরব দর্শক। শুধু নিদর্শনয় অনুযায়ী কাজ করছে। তার খেয়াল নেই আপাতত সাজগোজে। সে ভাবছে। বিয়েতে কোন ঝামেলা হবে না তো? অধরার ভাবনার মাঝে তানিশা বলে উঠলো,

“একদম পারফেক্ট। দেখি বাবুন তাকা তো।”

অধরা চোখ তুলে তাকালো বড় আপার দিকে। হাসলো আলতো করে। তানিশার মন ভরে গেলো। তার বাচ্চাটা কত বড় হয়ে গেছে। তানিশা নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে অধরাকে। হলুদ শাড়িতে কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। হালকা সাজ, ফুলের গহনা, চোখ ভর্তি কাজল। কি মায়াময় লাগছে দেখতে। তানিশা বিরবির করে উচ্চারণ করলো,

“মাশাআল্লাহ, কারো নজর না লাগুক।”

নিজের চোখের কাজল লাগিয়ে দিলো অধরার কানে। কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলে উঠলো,

“আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি কেন বাবুন? আর একটু ছোট থাকতি।”

তানিশার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো। কান্না লুকাতে এদিক সেদিক তাকালো তানিশা। ডান হাতে আলতো করে চোখের জ্বল মুছে নিলো। অধরা হাসলে। মৃদুস্বরে বলল,

“আমি বড় হয়নি মোটেও আপা। তুমিই বড় ভাবছো।”

তানিশা হাসলে। হাসলো অধরারও। সবায় মিলে অধরাকে নিয়ে চলল নবকুঞ্জের ছাদে। হলুদ অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন করা হয়েছে সেখানেয়।

নবকুঞ্জের সামনের বিশাল বাগানের এক কোণে বসে আছে আরাব। একটু আগে সে ছাদে ছিলো। এক নজর দেখতে চেয়েছিলো তার পাখিকে। দেখে নিয়েছে। আর থাকতে পারেনি ছাদে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ অনবরত তীর ছুঁড়ছে। এতো ব্যথা। আরাবের সহ্য হচ্ছে না। বাগানের এই কোণে বসে সে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কান্না আটকানোর প্রয়াস। আরাব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। কান্না আসে কই? চোখ জ্বলে, বুক জ্বলে। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কান্না আসলে বোধহয় একটু ভালো লাগতো। আরাব পা দুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। তখনই তার কাঁধে হাত রাখলো কেউ। আরাব র্নিলিপ্ত চোখে তাকালো। আঁখি দাঁড়িয়ে আছে। আঁখির চোখ দুটো ছলছল করছে। আরাব বোনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। পারলো না। বরং হাসিটা কান্নারূপে চোখ বেয়ে টপে করে ঝড়ে পরলো। আঁখির চোখ দিয়ে জল গড়ালো। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলো না আরাব। হু হু করে কেঁদে ফেললো। আঁখি থামালো না। কাঁদুক। তাও যদি মনটা একটু হালকা হয়।

অধরাকে একে এলে হলুদ লাগাচ্ছে সবায়। এর ফাঁকে অধরা ছাদের আশেপাশে তাকালে। আঁখি আপা নেই। নেই আরাবও। অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তানিশা পাশেই ছিলো। অধরাকে বারবার কাউকে খুঁজতে দেখে জানতে চাইলো,

“কাকে খুঁজছিস বাবুন? ছোট চাচাকে?”

“না, আঁখি আপাকে দেখছি না যে আপা।”

তানিশা তাকালো আশেপাশে। আঁখি নেই। আবার অধরার দিকে ফিরে বলে উঠলো,

“আমি খুঁজে দেখছি।”

তানিশা চলে গেলো। অধরা কেমন করে যেন হাসলো। মনে মনে বলল,

“তুমি খুঁজে পাবে না আপা। আমি জানি আঁখি আপা কোথায়।”
——————————

“রাহাতের বাচ্চা, খবরদার সামনে আগাবি না। হাত থেকে ফেল ওগুলো। আমার আশেপাশে আসবি না তুই।”

রাহাত দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাসতে বললো,

“আজকে তোকে হলুদ ভূও বানিয়েই ছাড়বো মামা। নো ছাড়াছাড়ি।”

“মাইর খাবি রাহাত। সর সামনে থেকে।”

তানিম হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল,

“এমন করতেছিস কেন মামা। আজকে তোর গায়ে হলুদ। রাহাত তো তোরে একটু হলুদ ই লাগাতে চাইছে। বেচারার মনের আশা পূরণ করতে দে।”

তাওসিফ দাঁড়িয়ে গেলো। তানিমের দিকে দাঁত কটমট করে বলল,

“ওর হাতে কতগুলো হলুদ বাটা দেখছোস তুই? এটাকে একটু মনে হচ্ছে তোর? বাসায় অবস্থানরত সবায় মিলে যতটা হলুদ মাখাবে তার চেয়ে বেশি হলুদ ওর হাতে।”

রাহাত যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। তাওসিফ তানিমের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলো সবে, তখনই রাহাত হাত ভর্তি হলুদ লেপ্টে দিলো তাওসিফের পুরো মুখে। শুধু হলুদ মাখিয়েই ক্ষান্ত হলো না। তাওসিফের তিন বন্ধু বেদম হাসিতে ফেটে পরলো। হাসতে হাসতে তুষারের চোখে পানি চলে এসেছে। তাওসিফ কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,

“তোদের তিনজন কেও আমি দেখে নিব। শ্লা! পুরা মুখ হলুদ দিয়া ভরায় দিছোস।”

রাহাত হাসতে হাসতে বলল,

“ভাবিরে তো হলুদ মাখায়তে পারবো না। তাই ভাবির টাও তোকে দিয়ে পূরণ করলাম। ভালো করছি না দোস্ত?”

তাওসিফ মেকি হাসি দিয়ে বলল,

“অনেক ভালো করছোস। সামনে তোরও বিয়া মাথায় রাখিও বন্ধু।”
———————————-

“কি করবা কিছু ভাবছো?”

“নাহ।”

মায়মুনা বিরক্ত হলো। বিরক্তি নিয়েই বলল,

“কালকে বিয়ে ওই মেয়ের। এরপর আর পাবা তুমি ও রে?”

ফারুক হাসান আরো বেশি বিরক্ত হলেন এবার। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলেন। নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলো,

“তাহলে কি করবো? উঠিয়ে নিয়ে যাব মেয়েটাকে? সেদিন সাবার সামনে কিভাবে হুমকি দিলো মনে নেই। এখন ওর কিছু হলে আমাকে সন্দেহ করবে না?”

মায়মুনা থতমত খেয়ে গেলো। এভাবে তো চিন্তা করেননি। কিন্তু তার মন যুক্তি মানলো না। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলল,

“তাহলে? তাহলে কি করবো আমরা!”

ফারুক হাসান চুপ করে থাকলেন। কোন জবাব দিলেন না। কিন্তু চুপ থাকতে পারলো না মায়মুনা। ফের বলে উঠলো,

“ওই রিসোর্টটা আর আমাদের হবে না? ওই মেয়েটারই থাকবে।”

মন খারাপ করে আবারো বলে উঠলেন,

“পাঁচ বছর ধরে এতো পরিকল্পনা করে কি লাভ হলো। কিচ্ছু হলো না। সব বৃথা।”

ফারুক হাসান বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করলেন। পরক্ষণেই বেশ জোরে ধমক দিয়ে বললেন,

“চুপ! একদম চুপ। আর একটাও কথা বলবে না।”

স্বামীর ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেলো মায়মুনা। কিন্তু তার মনে চলছে দহন। কিছু হারিয়ে ফেলার।
————————–

“আসফিনকে হলুদ লাগাবি আয়।”

আরাব তাকালো আঁখির দিকে। কান্না থেমেছে অনেক আগে। তবে বুকের মাঝে চলা দহন থামছে না। ধীর কন্ঠে বলল,

“আমি পারবো না আপা।”

আঁখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“পারবি না বললেই হলো? ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু তুই। কথা তো বলিস না কতদিন! মেয়েটার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ে একটু পাশে থাক। আমি জানি তোর কষ্ট হবে, তাও থাক। তোর পাখির জন্য।”

আরাব ছলছল চোখে তাকালো নিজের বোনের দিকে। চোখ নামিয়ে হাসলো। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে বলল,

“ব্ল্যাকমেইল করছিস আপা? আমার পাখির জন্য! ও আমার পাখি আর হলো না আপা।”

আঁখি চুপ। আরাব উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুললো মিথ্যে হাসির জাল। মৃদু স্বরে বলল,

“চল।”

আঁখি কিছু না বলে সামনে পা বাড়ালো। পিছে পিছে আসছে আরাব। যার মুখে হাসি আর বুকে হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ!

#চলবে….?