#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৫
নবকুঞ্জের বসার ঘরে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। সবাই কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে দরজার দিকে। কিছুক্ষণ আগে তাওসিফ ফয়জাল হাসানকে কল করেছিলো। তাদের কথোপকথন,
“আসসালামু আলাইকুম বাবা।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কখন আসবে?”
“আমি আসছি বাবা। একটা সাহায্য করতে হবে বাবা।”
“হ্যাঁ, বলো না।”
তাওসিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলো,
“বাবা বাড়ির সবাইকে একটু একসাথে করবেন? প্লিজ। আমার কিছু কথা বলার আছে।”
ফয়জাল হাসান একটু ভয় পেলেন। হাজার হোক মেয়ের বাবা তিনি। তার মেয়ে কি কিছু করেছে। তিনি দুর্বল কন্ঠে জানতে চায়,
“কি কথা বাবা?”
“একটু সিরিয়াস ব্যাপার। প্লিজ সাহায্য করুন।”
তাওসিফের কথা অনুযায়ী সবায় অপেক্ষা করছে। সবার মনে ভয়। সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে অধরা। কি এমন কথা আছে যে সবার সামনে বলতে হবে? অরুমিতা এসে অধরারা হাতের উপর নিজের হাত রাখলো। সাহস দিলো বোনকে। এরমাঝে তুবা হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“শ্বশুরবাড়ি যেতে না যেতেই কি আকাম ঘটিয়েছে কে জানে।”
বলেই মুখ বাঁকালো। অধরার নিজেকে অসহায় লাগলো খুব। খুব করে অভিযোগ করে বলে বলতে ইচ্ছে হলো,
“আমার সাথেই কেন এসব হয়? কেন?”
অধরা মুখ খুললো না। নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু সময় পর পর তাকাতে লাগলো দরজার দিকে। অবশেষে এসে পৌঁছালো তাওসিফ। তাওসিফের সাথে আবিরকে দেখে সবায় অবাক হলেও অধরা এবার একটু স্বস্তি পেলো। নিশ্চয়ই আবির আবার তাওসিফকে অনুসরণ করছিলো। সেজন্য হয়তো তাওসিফ বাড়ির সকলকে একত্রিত হতে বলেছে। তাওসিফ আবিরকে সাথে নিয়ে ভিতরে এলো। ফারুক হাসান মনেমনে কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। তার ছেলে কেন তাওসিফের সাথে? সাপ আর নেউল কি একসাথে থাকে? তিনি গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“কিসের জন্য সবায়কে এখানে আসতে বলেছো? সবারই নিজস্ব কাজ আছে। যা বলবে জলদি বলো। সময় নষ্ট করো না।”
তাওসিফ হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
“আমি কিছু বলবো না তো চাচা সাহেব। যা বলার আবির বলবে।”
তাওসিফ এই বলে আবিরের দিকে তাকালো। মায়মুনা ভয়ে সিটিয়ে উঠলো। কি বলবে আবির? তাওসিফ তার বাঁকা হাসি ঠোঁটে রেখে হিসহিসিয়ে আবিরে কানের কাছে বলল,
“শুরু করো শালাবাবু। আর হ্যাঁ, এদিক সেদিক করেছো তো তুমি শেষ। আর যদি ভাবো এবার বেঁচে হেলে তুমি ভুলেও আমার কাছে ধরা দেবে না তাহলে শোন, তোমার ঘরে যে ড্রাগস আছে সেগুলো পুলিশ এনে তাদের দেখাবো। পুলিশের থেকেও পালিয়ে থাকবে?”
আবির এবার আরো ভয় পেয়ে গেলো। বুঝলো তাওসিফের কথা না শুনলে তার বিদপ আরো বাড়বে। সে তাই উল্টা পাল্টা কিছু করারা চিন্তা বাদ দিলো। সে বুঝলো তাওসিফ কোমড় বেঁধেই তার পিছনে লেগেছে। মনে মনে আবির আওড়ালো, এই লোক অনেক সেয়ানা। তাওসিফ এবার তাড়া দিলো। বলল,
“কি ব্যাপার শালাবাবু শুরু করো।”
আবির বড় করে শ্বাস নিলো। তারপর মাথা নিচু করে বলল,
“পাঁচ বছর আগে আসফিন আমার সাথে কিছুই করেনি, আমি নিজেই আসফিনের ঘরে গিয়েছিলাম। আসফিন ছবি আঁকায় মগ্ন ছিলো৷ সেই সুযোগে দরজা আমি বন্ধ করেছি।”
অধরা চমকে তাকালো আবিরের দিকে। কি হচ্ছে এসব? আবির নিজ থেকে তার অপরাধ স্বীকার করছে! অধরা সরু চোখে তাকালো তাওসিফের দিকে। এই লোক নিশ্চয়ই কিছু করেছে। কিন্তু তাওসিফ ভুলেও অধরার দিকে তাকালো না। নবনী আনজুম গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“ছিহ! নিজের চাচাতো বোনের সাথে কিভাবে এমন করতে পারলে তুমি আবির?”
আবির দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,
“তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন নয় দাদুনি। আসফিনের ঘরে আমি ওর ক্ষতি করতে যাইনি। আমি কখনো আমার কোন বোনের দিকে খারাপ নজর দেইনি।”
ফয়জাল হাসান গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“তাহলে? কেন গিয়েছিলে? বলো।”
ফারুক হাসানের প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে এসব? তার নিজের ছেলে সব বলে দিচ্ছে? তিনি এবার বলে উঠলো,
“কি আবির? কিসব বলছো তুমি?”
তাওসিফের দিকে ফিরলেন তিনি। হিসহিসিয়ে বলল,
“তুমি, তুমি নিশ্চয়ই আবিরকে ভয় দেখিয়েছো। ভয় দেখিয়ে মিথ্যা বলাচ্ছো ওকে দিয়ে। তাই না?”
তাওসিফ কিছু বলার পূর্বেই অহি এগিয়ে এলো। ফারুক হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন নাটক করছো বাবা? আর কত? ভাইয়া যখন সত্যিটা বলছে তখন কেন বাঁধা দিচ্ছ?”
বাবার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অহি বলে উঠলো,
“ভাইয়া যা বলছে সব সত্যি। ভাইয়া আসফিনের ঘরে গিয়েছিলো মায়ের কথায়। মা পরিকল্পনা করেছিলো আসফিনকে সবার চোখে খারাপ বানানোর। তারপর আসফিনকে বাড়ির কেউ আর সহ্য করতে পারবে না। ফলে আসফিনের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে পারবে।”
আবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সবায় অবাক হয়ে শুনছে সব কথা। তাওসিফ আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তারপর বলো শালাবাবু। কেবল তো শুরু।”
আবির একে একে সব অপরাধ স্বীকার করে নিলো। আয়মান সাহেবের কাছ থেকে দলিল চাওয়া, তাওসিফকে ফলো করা, অধরার ব্যাংক একাউন্ট লুট করতে চাওয়া; সব বলে দিলো সে। নবনী আনজুম চোখ বন্ধ করে শুনলেন সব। তার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার ছেলে এতো নিচে নেমে গেছে। ফয়জাল হাসান দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছেন। তার ইচ্ছে করছে এখনি বড় ভাইয়ের গ*লা টিপে ধরতে। সামান্য সম্পত্তির জন্য কি করে করতে পারলো এতোকিছু? এদিকে মায়মুনা ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। তিনি শুধু ভাবছেন এরপর কি হবে। এরমাঝে বৃদ্ধ নবনী আনজুম হুংকার দিয়ে উঠলো,
“এতো লোভ তোমার ফারুক? এতো? এই শিখিয়েছি আমি তোমাকে? তুমি আমার ছেলে? ছিহ! সম্পত্তি চাও তাই না? আমি এখন এই মুহুর্তে বলছি তুমি বেরিয়ে যাও নবকুঞ্জ থেকে। তোমার নামে থাকা সকল সম্পত্তি আমি নিয়ে নিব, সব আসফিনের নামে করে দিব।”
ফারুক হাসান চমকে তাকালো নবনী আনজুমের দিকে। যাই করুক না কেন, সে মা ভক্ত ছেলে। মায়ের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখে এবং মায়ের এমন কঠিন সিদ্ধান্ত শুনে বুকে ব্যথা অনুভব করলেন তুমি। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। তার আগেই লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। আবির, অণিতা ও অহি দৌড়ে এলো। অহি মৃদু চিৎকার দিলো বাবা বলে। নবনী আনজুম কঠোর হলেন। ফিরেও তাকালেন না। বড়ো ছেলেকে আদেশ দিলেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ফখরুল হাসান হাসপাতালে ছুটলেন। মায়মুনা ও আবির যেতো চেয়েছিলো। নবনী আনজুম নিষেধ করেছেন। যাওয়ার অনুমতি পেলো শুধু অণিতা।
নবনী আনজুম আবিরের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন,
“বলো আবির, কি শাস্তি দিব তোমাকে?”
আবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। নবনী আনজুম ক্ষেপে গেলেন,
“কথা বলছো না কেন? বাচ্চা তুমি? কেন বাবা-মায়ের অন্যায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্য করলে?”
আবির নিশ্চুপ। এবার তাওসিফ বলল,
“দাদুনি, আপনি আবিরকে কি শাস্তি দিবেন তা আপনার ইচ্ছে। তবে আগে ও সুস্থ হোক। আবিরকে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন দাদুনি। আবির ড্রাগ এডিক্টেড।”
আবির চুপ থাকলো। কোন প্রতিবাদ করলো না। পুলিশে না দিয়ে তাকে রিহ্যাবে পাঠাচ্ছে এই অনেক। দাদুনি সহ বাড়ির সবায় চমকালো। অহি কথা বলতেও ভুলে গেলো। মায়মুনা ডুকরে কেঁদে উঠলো। দাদুনি তাওসিফের কথা মেনে নিলো। ব্যবস্থা নিতে বলল দ্রুত। এবার তিনি মায়মুনার দিকে ফিরলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“নিজেরও দু’টো মেয়ে আছে তোমার। একবার আসফিনের জায়গায় নিজের মেয়েদের বসিয়ে দেখতে পারতে।”
মায়মুনা হাঁটু মুড়ে বসে পরলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দেন আম্মা। অনেক পাপা করছি। আল্লাহ সেই শাস্তি দিচ্ছে আম্মা। স্বামী হাসপাতালে, ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিন আম্মা।”
নবনী আনজুম বলে উঠলো,
“আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে কি হবে? যার সাথে এতো অন্যায় করলে তার কাছে ক্ষমা চাও।”
মায়মুনা তাকালো অধরার দিকে। হাত জোর করে বলল,
“মারে, ক্ষমা করে দাও। অনেক অন্যায় করছি তোমার সাথে।”
অধরা নিস্পৃহ ভাবে তাকিয়ে রইলো। কিছু বললো না। মায়মুনা বারবার ক্ষমা চেতে লাগলো। এবার তার সাথে যোগ দিলো আবির ও অহিও। অধরা তবুও চুপ। কিছু সময় সবার দিকে তাকিয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো সে। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। কিচ্ছুটি বললো না।
ধীরে ধীরে ড্রয়িং রুম খালি হয়ে গেলো। মায়মুনা এখনো একই ভাবে বসে আছে। বুঝতে পারছে বা স্বামীর কাছে যেতে পারবে নাকি পারবে না। নবনী আনজুম বসে ছিলেন। তাওসিফ নিজেও বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বউ তো ঘরের দরজা আঁটকে দিয়েছে। কই যাবে সে? নবনী আনজুম এবার বললেন,
“যাও দাদুভাই, ঘরে যাও। মেয়েটার মন খারাপ হয়ে গেছে। তুমি যাও। লক করলেই দরজা খুলবে।”
তাওসিফ মুচকি হেসে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
———————————
ফারুক হাসানের অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইজড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ফখরুল হাসান ফোন করে মাত্রই খবর জানিয়েছে। মায়মুনা এবার চলে গেলো হাসপাতালে। আবির আর অহিও গেছে একটু আগে। নবনী আনজুম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের ঘরেও আর গেলেন না। বসে রইলেন সোফায়। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সুন্দর, সাজানো পরিবারটার ভাঙন স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি। তার বুক ভারি হলো। মনে হলো মা হিসেবে ব্যর্থ সে।
———————————-
তাওসিফ চোরের মতো মুখ করে বসে আছে। অধরা দাঁড়িয়ে আছে সমানে। সরু চোখে সে আর একবার পরোখ করলো তাওসিফকে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে ফের জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো, কথা বলছেন না কেন? বলুন কি করেছেন আবির ভাইয়াকে? সে গরগর করে সব বলে দিলো কি করে?”
তাওসিফ শুকনো হাসি দিয়ে বলল,
“কিছু করিনি সত্যি?”
“বিশ্বাস করতে বলছেন?”
তাওসিফ নিজের পকেট থেকে পুরোনো সেই টেপ রেকর্ডারটি বের করে আয়মান সাহেব ও ফারুক হাসানের কথোপকথন শুনালো। তারপর বলল,
“আবিরকে বলেছি নিজেই সব স্বীকার করতে। নাহয় এটা পুলিশের হাতে তুলে দিব। তাই নিজেই স্বীকার করতে রাজি হলো।”
অধরা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“এটা আপনি কোথায় পেলেন?”
তাওসিফ মুচকি হেসে অধরার হাত টেনে তার পাশে বসালো। অধরার হাত নিজের হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল,
“তোমাদের পারিবারিক উকিল যে আয়মান সাহেব তা আমি জানতাম। তুমি যেদিন জানালে যে তোমার সাথে যা ঘটেছে সব সম্পত্তির জন্য তখনই সন্দেহ ছিলো আয়মান সাহেবের কাছ থেকে কাগজ হাতিয়ে নিতে চাইবে তোমার চাচা। তাই আয়মান সাহেবকে বলেছিলাম ফারুক হাসান এলে যেন কথা গুলো রেকর্ড করে রাখে।”
অধরা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি এতদূর অবধি ভেবেছেন?”
তাওসিফ মুচকি হাসলো। উত্তর দিলো না। অধরার হাতটা একটু উঁচু করে তাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অধরা আকস্মিক ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো। তাওসিফ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো অধরার দিকে। অসহায় কন্ঠে বলল,
“তুমি এতো লজ্জা পাও কেন? হুয়াই?”
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৬
ফারুক হাসানের ডান পাশ পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাকে বাসায় আনা হয়েছে। মায়মুনার দিন রাত কাটে তার সেবা যত্ন করতে। একটু অবসর পেলেই তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে চোখের পানি ফেলেন। অসহায় কন্ঠে আল্লাহকে ডেকে বলেন,
“আল্লাহ অনেক পাপ করছি। কিন্তু তুমি তো মহান। ক্ষমা করে দাও। লোকটাকে সুস্থ করো।”
ছেলের জন্যও মন পোরে তার। ছেলেটা কখন অন্ধকার জগতে পা দিলো? মা হয়েও কিছু টের পেলেন না তিনি! এই আফসোস, দুঃখ, হতাশা কাকে দেখাবেন তিনি? কে বুঝবে?
নবনী আনজুম এক প্রকার ঘরবন্দী করে ফেলেছেন নিজেকে। কিছু ভালো লাগে না তার। প্রথম কয়েকদিন অসুস্থ ছেলেটাকে চোখের দেখাও দেখননি। কিন্তু মন কতক্ষণ মানে? হাজার হোক মা তো তিনি। এখন রোজ একবেলা করে গিয়ে দেখে আসে। অশ্রু টলমল করে তার চোখে।
অধরা পরেরদিনই শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেছে। নবকুঞ্জের জন্য তার মায়া হয় না কখনো। মায়া হয় শুধু দাদুনির জন্য। আর বাবা? তার মন চাইলেই সে অফিসে চলে যায়। বাবার কেবিনে বসে বাবার সাথে গল্প করে। এই তো বেশ যাচ্ছে তার জীবন।
————————-
তাওসিফের ফুপু আজ নিজের বাড়ি চলে যাবে। অধরার ভীষণ মন খারাপ। এই ক’টাদিনে মানুষটা অনেক বেশি আপন হয়ে গেছে। কত গল্প করেছে। অধরার মন খারাপ দেখে ফুপু হাসলেন। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবে মন খারাপ করলে হবে? নিজের বাড়ি যেতে হবে না আমার?”
অধরা মুখ গোমড়া করে বলল,
“আবার কবে আসবেন?”
“আমি তো থেকে গেলাম। তুমি কবে আমার বাড়ি আসবে তাই বলো।”
“আপনার ভাইপো নিয়ে গেলেই যাব।”
ফুপু এবার তাওসিফের কান টেনে ধরলো। বলল,
“কবে নিয়ে যাবি বল?”
তাওসিফ মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো,
“নিয়ে যাব, নিয়ে যাব। ছুটি পেলেই নিয়ে যাব। কান ছাড়ো ফুপি। বউয়ের সামনে বেইজ্জতি করে দিচ্ছ।”
ফুপু কান ছাড়লো ঠিকই তবে হাসতে হাসতে বলল,
“তোর আবার ইজ্জত আছে নাকি যে বেইজ্জতি হবি?”
অধরা, তরু-লতা সবাই হেসে উঠলো ফুপুর কথা শুনে।
——————————-
সময়ে চলছে আপন গতিতে। অধরার দিন কাটছে পরম সুখে। তাইফা তাকে মেয়েদের মতো করে আগলে রাখে। একটা মা পেয়ে যাওয়ার আনন্দে অধরা স্রষ্টার দরবারে লাখো বার শুকরিয়া জানায়। তাইফা তাকে কোন কাজে ঠিকমতো হাত দিতেও দেয় না৷ এইতো গতকাল সকালের ঘটনা। তাইফা একা একা রান্নাঘর সামলাচ্ছিলো। অধরা এগিয়ে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,
“আমি ভাজিটা দেখি মা। তুমি বাকিটা সামলাও।”
তাইফা চোখ রাঙিয়ে বলল,
“মোটেও না। তুই কিছুতে হাত দিবিনা। যখন সময় হবে তখন সব নিজেকে করতে হবে। এখন করতে হবে কেন?”
অধরা হাসে। একটা মানুষ এতো দারুণ হবে কেন? তাদের সম্পর্কটা কয়েকদিনের মাঝেই তুই-তুমিতে নেমে এসেছে। তরু-লতাকে ঠিক যতখানি আগলে রাখেন তিনি, অধরাকেও রাখেন। অধরা দোয়া করে, এই মানুষটাকে আল্লাহ যেন কখনো তার থেকে কেড়ে না নেয়।
সাকালের নাস্তার পর তাইফা দুপুরের রান্না বসিয়েছে। কাজের মেয়েটা ঘর গোছাচ্ছে। অধরা রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাইফা হাসে। মেয়েটা এতো আদূরে। তাইফা কাছে ডেকে বলল,
“এখানে ঘুরঘুর না করে ঘরে একজন তোর অপেক্ষায় বসে আছে। তার কাছে বরং যা।”
অধরা মুখ ফুলিয়ে বলে,
“তার কাছে সারাদিন থাকি।”
তাইফা হাসে। বলে,
“ও বাবা, তাই?”
অধরা হেসে ফেলে তাইফার কথা বলার ধরণ দেখে। তাইফা নিজেও হাসে। কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে,
“ছেলেটা সময় দে। বোঝার চেষ্টা কর।”
অধরা হেসে বলল,
“তুমি একটু বুঝিয়ে দাও তোমার ছেলে কেমন।”
তাইফা তরকারি নাড়েন। দৃষ্টি স্থির রেখে আনমনে বলেন,
“আমি মা, আমি ও কে বুঝি তা ঠিক। তবে তার প্রেমিক সত্তাটিকে তো তোর বুঝতে হবে। আমি বুঝালে নাহয় বুঝবি, অনুভব করবি কি করে?”
অধরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ির মুখের দিকে। তাইফা এখনো আনমনা। কিছুটা হেঁয়ালি করে বলে উঠে,
“তোর জন্য ওর ভালোবাসা অন্যরকম। তুই একটু চেষ্টা করলেই বুঝে যাবি।”
তাইফা এবার চোখ তুলা তাকায় অধরার দিকে। কেমন রহস্য করে হাসে। অধরা সেই রহস্য বুঝতে পারে না। উঠে যায় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার ঘরের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। একটু উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তাওসিফ তার কাপড় গুছিয়ে রাখছে। অধরার থমথমে মুখে ফুটে উঠে হাসির রেখা। ঘরে প্রবেশ করে বলে,
“আপনি কেন এসব করছেন? আমি করি দেন।”
তাওসিফ হেসে বলে,
“বউয়ের কাজে সাহায্য করতে হয়।”
অধরা মুখ গোমড়া করে বসে। অসহায় কন্ঠে বলে,
“সাহায্য না ছাই! মা একটা কাজে হাত দিতে দেয় না। ঘরে যা টুকটাক করবো সব আপনি করে দেন। সারাদিন বসে বসে খাই আমি। কয়দিন পর একদম ফুলে যাব। তখন আর আপনার মোটা বউ ভালো লাগবে না। হু!”
তাওসিফ হা করে তাকিয়ে থাকলো কতখন। পরক্ষনেই হু হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে অধরার পাশে বসলো। অধরাকে জ্বালানোর জন্য বলে উঠলো,
“এখন তোমাকে ভালো লাগে কখনো বলেছি?”
অধরা থমকে যায়। অদ্ভুত চোখে তাকায় তাওসিফের দিকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে বলে,
“ভালো লাগে না বলছেন?”
তাওসিফ হাসলো। অধরাকে জ্বালাতে তার ভালো লাগছে। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো সে। মৃদু কন্ঠে বলল,
“বলতেই পারি।”
অধরার কি হলো কে জানে। আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আস্তে করে উঠে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। তাওসিফ ডাকলো। কিন্তু সে পিছেও ফিরে তাকালো না। তাওসিফ মুচকি হাসলো। থামালো না আর।
অধরা মন খারাপ করে ছাদে চলে গেলো। তরু-লতা ছাদেই ছিলো। তাকের বিল্লুকে নিয়ে খেলছে। বিল্লুর নাম সিম্বা। এমন অদ্ভুত নাম রাখার কারণ অবশ্য জানা যায়নি। যাইহোক। সিম্বাকে গোসল করাচ্ছিলো দুই বোন মিলে। অধরাকে দেখেই তরু চিৎকার করে উঠলো,
“ভাবি! সেই কখন বলে এলাম তোমাকে দ্রুত ছাদে আসতে। এতক্ষণে হলো আসার সময়?”
অধরার একটু একা থাকতে ইচ্ছে হলো। তাওসিফে বলা ছোট কথাটাতেই তর মন খারাপ হয়েছে। অথচ সে জানে তাওসিফ মজা করেছে। তবুও বোকা মন বলে চলছে কেন করবে এমন মজা? এটা কি মজা করারা মতো ব্যাপার? তবে তরুর উচ্ছ্বাস দেখে সে এগিয়ে এলো তার দুই নদনদীর পাশে। হেসে বলল,
“কি হচ্ছে এখানে?”
সিম্বা অধরাকে দেখেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মিউমিউ আওয়াজ করতে লাগলো। অধরা হেসে সিম্বাকে আদর করে দিলো। লতা হেসে বলল,
“সিম্বাকে তোমার নামে করে দেওয়া হলো ভাবি। সে এখন তোমাকে বেশি ভালোবাসে।”
অধরা হাসলো। তরু বলে উঠলো,
“ভাবি, তেঁতুল ভর্তা খাব। তুমি আর লতা থাকো। আমি এক্ষুনি সব নিয়ে আসছি।”
লতা ছাদের সাথে বেড়ে উঠা আম গাছটার দিকে তাকালো। আম ঝুলে আছে। সে মাথা নেড়ে বলল,,
“সাথে আম মাখা।”
অধরা নিজেও আম গাছের দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে বলল,
“হাত দিয়ে পারতে পারবো তো?”
লতা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“চলো চেষ্টা করে দেখি।”
অধরা একদম ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করলো আম ধরতে। প্রথমে পারলো না। আর একটু এগিয়ে গিয়ে আবার চেষ্টা করলো। এবার সক্ষম হলো। তরু-লতা হাততালি দিয়ে ইয়াহু বলে চিৎকার করে উঠলো। অধরা নিজেও আনন্দে মেতে উঠলো ওদের সাথে। ছাদে বসে আম মাখা ও তেঁতুল ভর্তার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। তারপর হাসি মজায় মেতে তিনজন আয়েশ করে খেলো সেসব। কতো গল্প হলো। তিনটে মেয়ের হাসির রিনরিন আওয়াজে মুখরিত হলো তরুলতা!
এতো হাসি মজার মাঝে অধরার হঠাৎ অরুমিতার কথা মনে পড়লো। ছোট বোনের সাথে এমনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু এক ঝড় এসে পুরো জীবন টাকে লন্ডভন্ড করে দিলো। অধরা আর স্বাভাবিক হলো না। মিশলো না কারো সাথে। তার বোনটাও কেমন বড়ো হয়ে গেলো। এতো বুঝদার হলো! তাদের অবশ্যই দারুণ একটা বন্ড আছে। একে অপরকে তারা সহজেই বুঝে যায়, আগলে রাখে; তবে গোপনে। তাদেরও অনেক কথা হয়; নীরবে। এভাবে প্রাণ খুলে কথা বলা হয় না। অধরার খিব শখ হলো একদিন অরুমিতার সাথে এভাবে মন খুলে কথা বলতে!
#চলবে…?