দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-৩৬+৩৭

0
5

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৬

ফারুক হাসানের ডান পাশ পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাকে বাসায় আনা হয়েছে। মায়মুনার দিন রাত কাটে তার সেবা যত্ন করতে। একটু অবসর পেলেই তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে চোখের পানি ফেলেন। অসহায় কন্ঠে আল্লাহকে ডেকে বলেন,

“আল্লাহ অনেক পাপ করছি। কিন্তু তুমি তো মহান। ক্ষমা করে দাও। লোকটাকে সুস্থ করো।”

ছেলের জন্যও মন পোরে তার। ছেলেটা কখন অন্ধকার জগতে পা দিলো? মা হয়েও কিছু টের পেলেন না তিনি! এই আফসোস, দুঃখ, হতাশা কাকে দেখাবেন তিনি? কে বুঝবে?

নবনী আনজুম এক প্রকার ঘরবন্দী করে ফেলেছেন নিজেকে। কিছু ভালো লাগে না তার। প্রথম কয়েকদিন অসুস্থ ছেলেটাকে চোখের দেখাও দেখননি। কিন্তু মন কতক্ষণ মানে? হাজার হোক মা তো তিনি। এখন রোজ একবেলা করে গিয়ে দেখে আসে। অশ্রু টলমল করে তার চোখে।

অধরা পরেরদিনই শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেছে। নবকুঞ্জের জন্য তার মায়া হয় না কখনো। মায়া হয় শুধু দাদুনির জন্য। আর বাবা? তার মন চাইলেই সে অফিসে চলে যায়। বাবার কেবিনে বসে বাবার সাথে গল্প করে। এই তো বেশ যাচ্ছে তার জীবন।
————————-

তাওসিফের ফুপু আজ নিজের বাড়ি চলে যাবে। অধরার ভীষণ মন খারাপ। এই ক’টাদিনে মানুষটা অনেক বেশি আপন হয়ে গেছে। কত গল্প করেছে। অধরার মন খারাপ দেখে ফুপু হাসলেন। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“এভাবে মন খারাপ করলে হবে? নিজের বাড়ি যেতে হবে না আমার?”

অধরা মুখ গোমড়া করে বলল,

“আবার কবে আসবেন?”

“আমি তো থেকে গেলাম। তুমি কবে আমার বাড়ি আসবে তাই বলো।”

“আপনার ভাইপো নিয়ে গেলেই যাব।”

ফুপু এবার তাওসিফের কান টেনে ধরলো। বলল,

“কবে নিয়ে যাবি বল?”

তাওসিফ মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো,

“নিয়ে যাব, নিয়ে যাব। ছুটি পেলেই নিয়ে যাব। কান ছাড়ো ফুপি। বউয়ের সামনে বেইজ্জতি করে দিচ্ছ।”

ফুপু কান ছাড়লো ঠিকই তবে হাসতে হাসতে বলল,

“তোর আবার ইজ্জত আছে নাকি যে বেইজ্জতি হবি?”

অধরা, তরু-লতা সবাই হেসে উঠলো ফুপুর কথা শুনে।
——————————-

সময়ে চলছে আপন গতিতে। অধরার দিন কাটছে পরম সুখে। তাইফা তাকে মেয়েদের মতো করে আগলে রাখে। একটা মা পেয়ে যাওয়ার আনন্দে অধরা স্রষ্টার দরবারে লাখো বার শুকরিয়া জানায়। তাইফা তাকে কোন কাজে ঠিকমতো হাত দিতেও দেয় না৷ এইতো গতকাল সকালের ঘটনা। তাইফা একা একা রান্নাঘর সামলাচ্ছিলো। অধরা এগিয়ে গেলো। মিষ্টি হেসে বলল,

“আমি ভাজিটা দেখি মা। তুমি বাকিটা সামলাও।”

তাইফা চোখ রাঙিয়ে বলল,

“মোটেও না। তুই কিছুতে হাত দিবিনা। যখন সময় হবে তখন সব নিজেকে করতে হবে। এখন করতে হবে কেন?”

অধরা হাসে। একটা মানুষ এতো দারুণ হবে কেন? তাদের সম্পর্কটা কয়েকদিনের মাঝেই তুই-তুমিতে নেমে এসেছে। তরু-লতাকে ঠিক যতখানি আগলে রাখেন তিনি, অধরাকেও রাখেন। অধরা দোয়া করে, এই মানুষটাকে আল্লাহ যেন কখনো তার থেকে কেড়ে না নেয়।

সাকালের নাস্তার পর তাইফা দুপুরের রান্না বসিয়েছে। কাজের মেয়েটা ঘর গোছাচ্ছে। অধরা রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাইফা হাসে। মেয়েটা এতো আদূরে। তাইফা কাছে ডেকে বলল,

“এখানে ঘুরঘুর না করে ঘরে একজন তোর অপেক্ষায় বসে আছে। তার কাছে বরং যা।”

অধরা মুখ ফুলিয়ে বলে,

“তার কাছে সারাদিন থাকি।”

তাইফা হাসে। বলে,

“ও বাবা, তাই?”

অধরা হেসে ফেলে তাইফার কথা বলার ধরণ দেখে। তাইফা নিজেও হাসে। কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে,

“ছেলেটা সময় দে। বোঝার চেষ্টা কর।”

অধরা হেসে বলল,

“তুমি একটু বুঝিয়ে দাও তোমার ছেলে কেমন।”

তাইফা তরকারি নাড়েন। দৃষ্টি স্থির রেখে আনমনে বলেন,

“আমি মা, আমি ও কে বুঝি তা ঠিক। তবে তার প্রেমিক সত্তাটিকে তো তোর বুঝতে হবে। আমি বুঝালে নাহয় বুঝবি, অনুভব করবি কি করে?”

অধরা নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ির মুখের দিকে। তাইফা এখনো আনমনা। কিছুটা হেঁয়ালি করে বলে উঠে,

“তোর জন্য ওর ভালোবাসা অন্যরকম। তুই একটু চেষ্টা করলেই বুঝে যাবি।”

তাইফা এবার চোখ তুলা তাকায় অধরার দিকে। কেমন রহস্য করে হাসে। অধরা সেই রহস্য বুঝতে পারে না। উঠে যায় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার ঘরের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। একটু উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তাওসিফ তার কাপড় গুছিয়ে রাখছে। অধরার থমথমে মুখে ফুটে উঠে হাসির রেখা। ঘরে প্রবেশ করে বলে,

“আপনি কেন এসব করছেন? আমি করি দেন।”

তাওসিফ হেসে বলে,

“বউয়ের কাজে সাহায্য করতে হয়।”

অধরা মুখ গোমড়া করে বসে। অসহায় কন্ঠে বলে,

“সাহায্য না ছাই! মা একটা কাজে হাত দিতে দেয় না। ঘরে যা টুকটাক করবো সব আপনি করে দেন। সারাদিন বসে বসে খাই আমি। কয়দিন পর একদম ফুলে যাব। তখন আর আপনার মোটা বউ ভালো লাগবে না। হু!”

তাওসিফ হা করে তাকিয়ে থাকলো কতখন। পরক্ষনেই হু হা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে অধরার পাশে বসলো। অধরাকে জ্বালানোর জন্য বলে উঠলো,

“এখন তোমাকে ভালো লাগে কখনো বলেছি?”

অধরা থমকে যায়। অদ্ভুত চোখে তাকায় তাওসিফের দিকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে বলে,

“ভালো লাগে না বলছেন?”

তাওসিফ হাসলো। অধরাকে জ্বালাতে তার ভালো লাগছে। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো সে। মৃদু কন্ঠে বলল,

“বলতেই পারি।”

অধরার কি হলো কে জানে। আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আস্তে করে উঠে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। তাওসিফ ডাকলো। কিন্তু সে পিছেও ফিরে তাকালো না। তাওসিফ মুচকি হাসলো। থামালো না আর।

অধরা মন খারাপ করে ছাদে চলে গেলো। তরু-লতা ছাদেই ছিলো। তাকের বিল্লুকে নিয়ে খেলছে। বিল্লুর নাম সিম্বা। এমন অদ্ভুত নাম রাখার কারণ অবশ্য জানা যায়নি। যাইহোক। সিম্বাকে গোসল করাচ্ছিলো দুই বোন মিলে। অধরাকে দেখেই তরু চিৎকার করে উঠলো,

“ভাবি! সেই কখন বলে এলাম তোমাকে দ্রুত ছাদে আসতে। এতক্ষণে হলো আসার সময়?”

অধরার একটু একা থাকতে ইচ্ছে হলো। তাওসিফে বলা ছোট কথাটাতেই তর মন খারাপ হয়েছে। অথচ সে জানে তাওসিফ মজা করেছে। তবুও বোকা মন বলে চলছে কেন করবে এমন মজা? এটা কি মজা করারা মতো ব্যাপার? তবে তরুর উচ্ছ্বাস দেখে সে এগিয়ে এলো তার দুই নদনদীর পাশে। হেসে বলল,

“কি হচ্ছে এখানে?”

সিম্বা অধরাকে দেখেই তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মিউমিউ আওয়াজ করতে লাগলো। অধরা হেসে সিম্বাকে আদর করে দিলো। লতা হেসে বলল,

“সিম্বাকে তোমার নামে করে দেওয়া হলো ভাবি। সে এখন তোমাকে বেশি ভালোবাসে।”

অধরা হাসলো। তরু বলে উঠলো,

“ভাবি, তেঁতুল ভর্তা খাব। তুমি আর লতা থাকো। আমি এক্ষুনি সব নিয়ে আসছি।”

লতা ছাদের সাথে বেড়ে উঠা আম গাছটার দিকে তাকালো। আম ঝুলে আছে। সে মাথা নেড়ে বলল,,

“সাথে আম মাখা।”

অধরা নিজেও আম গাছের দিকে তাকালো। কিছু একটা ভেবে বলল,

“হাত দিয়ে পারতে পারবো তো?”

লতা মাথা নাড়িয়ে বলল,

“চলো চেষ্টা করে দেখি।”

অধরা একদম ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করলো আম ধরতে। প্রথমে পারলো না। আর একটু এগিয়ে গিয়ে আবার চেষ্টা করলো। এবার সক্ষম হলো। তরু-লতা হাততালি দিয়ে ইয়াহু বলে চিৎকার করে উঠলো। অধরা নিজেও আনন্দে মেতে উঠলো ওদের সাথে। ছাদে বসে আম মাখা ও তেঁতুল ভর্তার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হলো। তারপর হাসি মজায় মেতে তিনজন আয়েশ করে খেলো সেসব। কতো গল্প হলো। তিনটে মেয়ের হাসির রিনরিন আওয়াজে মুখরিত হলো তরুলতা!

এতো হাসি মজার মাঝে অধরার হঠাৎ অরুমিতার কথা মনে পড়লো। ছোট বোনের সাথে এমনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু এক ঝড় এসে পুরো জীবন টাকে লন্ডভন্ড করে দিলো। অধরা আর স্বাভাবিক হলো না। মিশলো না কারো সাথে। তার বোনটাও কেমন বড়ো হয়ে গেলো। এতো বুঝদার হলো! তাদের অবশ্যই দারুণ একটা বন্ড আছে। একে অপরকে তারা সহজেই বুঝে যায়, আগলে রাখে; তবে গোপনে। তাদেরও অনেক কথা হয়; নীরবে। এভাবে প্রাণ খুলে কথা বলা হয় না। অধরার খিব শখ হলো একদিন অরুমিতার সাথে এভাবে মন খুলে কথা বলতে!

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহাসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৭

আজ শুক্রবার। রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানির সুবাস ছড়িয়ে গেছে পুরো বাড়ি জুড়ে। ছাদ থেকেও পাওয়া গেলো সেই সুবাস। তরু চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে বলে উঠলো,

“বিরিয়ানি আর গরুর মাংস। ভাবির পছন্দের রোস্ট। সব কিছুর গন্ধ পাচ্ছি।”

লতা টিটকারি করে বলল,

“গন্ধ তো তুই পাবিই, রাক্ষস যে তুই।”

তরু গায়ে মাখলো না লতার কথা। বরং অধরার হাত ধরে বলল,

“ভাবি, চলো নিচে যাই। বাবা-ভাইয়া এতক্ষণে মসজিদে চলে গেছে। মা একা নিচে।”

“হ্যাঁ, চলো।”

তিনজন একসাথে নিচে নেমে এলো। অধরা রান্নাঘরের সামনে গিয়ে আলতো স্বরে ডাকলো,

“মা।”

তাইফা হেসে তাকালো। ভ্রূঁ নাচিয়ে বলল,

“কি ব্যাপার? কি চাই?”

অধরা হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলল,

“কাজ চাই। সালাদ আমি করি মা? প্লিজ। না করো না।”

তাইফা কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

“আচ্ছা কর। কিন্তু সাবধানে।”

অধরা মাথা নেড়ে ফ্রিজ থেকে শসা, গাজর আর টমেটো বের করলো। ভালো করে ধুয়ে বসে গেলো সালাদ বানাতে।

সকালে অভিমান করে ঘরে থেকে বের হওয়ার পর এই এখন ঘরে ঢুকলো অধরা। বিছানার উপর ফেলে রাখা ভেজা তোয়ালে নেড়ে দিলো বারান্দায়। ঘরটা গুছিয়ে চলে গেলো গোসলে। গোসল শেষ করে নামাজ পরে নিলো। তারপর আবার গেলো শাশুড়িকে টেবিল সাজাতে সাহায্য করতে। বাবা-ছেলে মসজিদ থেকে ফেরার আগেই টেবিল সাজিয়ে ফেললো তারা। এবার শুধু তারা ফিরলেই একসাথে সবায় খেয়ে নিবে।
—————————–

তাওসিফ ঘরে এসে দেখলো ঘর খালি। বুঝে নিলো কোথায় তার বধূ। পা বাড়ালো বারান্দার দিকে। অধরা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চুপ করে। তাওসিফ গিয়ে দাঁড়ায় তার পাশে। অধরা বুঝতে পারে তার উপস্থিতি কিন্তু ফিরে তাকায় না। তাওসিফ কিয়ৎকাল চুপ থাকার পর বলে উঠলো,

“মন খারাপ?”

“নাহ!”

“তবে?”

“কিছু না।”

তাওসিফ চুপ থাকে। বারান্দার গ্রীল ভেদ করে তার দৃষ্টি যায় বাগানের জাম গাছটির দিকে। সবে সবুজ রঙের গুটি গুটি জাম ধরেছে। দূর থেকে বেশ সুন্দর দেখায়। জাম গাছের উঁচু ডাল টায় বসে আছে একটা পাখি। আর উপরে চক্রাকারে ঘুরছে তার সঙ্গী। দৃশ্যটা সুন্দর। তাওসিফ গভীর চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। দৃষ্টি সেদিকে স্থির রেখে বলল,

“তোমার সম্পর্কে আমি কিছু জানতে চাইনি বিয়ের আগে। কেন বলতে পারো?”

অধরা এহেন প্রশ্ন শুনে তাওসিফের দিকে তাকালো। তাওসিফের ধ্যান তখনো পাখি দুটির দিকে। অধরা কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল,

“নাহ, কেন জানতে চাননি?”

তাওসিফের দৃষ্টির পরিবর্তন হয় না। কেন যেন সে তাকায় না অধরার দিকে।

“জানার প্রয়োজন হয়নি তাই! আমি সব জানতাম।”

অধরা চমকে উঠে। সব জানতো মানে? কি জানতো তাওসিফ? আর কিভাবে জানতো? বিস্মিত কন্ঠে অধরা বলে,

“কিভাবে জানতেন?”

অধরারা গলার স্বর কিছুটা কেঁপে উঠলো। তাওসিফ এবার কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরের মালিকের দিকে চোখ তুলে তাকালো। র্নিলিপ্ত কন্ঠে বলল,

“কোন মানুষকে তিন বছর ধরে অনুসরণ করলে মোটামুটি সব জানা যায়। আর সে যদি হয় হৃদয়েশ্বরী তাহলে আরো বেশিই জানা যায়।”

অধরা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে তাওসিফের দিকে। কি যেন বলতে চায়। ঠোঁট কেঁপে উঠে তিরতির করে, কন্ঠনালীতেও কাঁপন ধরে কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না। চোখের কোণে জল জমে। অধরা তাকিয়ে থাকে। তাওসিফ হাসে। কিছুটা এগিয়ে আসে। মাথা নিচে করে মুখটা নিয়ে আসে অধরার কান বরাবর। ফিসফিসিয়ে বলে,

“সকালে মজা করেছি ম্যাম। অভিমান কে এবার অন্তত সরিয়ে ফেলুন। আপনি এমন গম্ভীর হয়ে কথা বললে আমার বুকের মাঝে ব্যথা হয়।”

তাওসিফ মুচকি হেসে চলে গেলো বারান্দা থেকে। অধরা একটু একা থাকুক। তাওসিফের কথার ভাবার্থ বুঝুক। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে গেছে। একটু সময় সে একা থাকুক।
————————-

নবকুঞ্জের ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিলো অরুমিতা আর নীহা। একইসাথে দুই জনের দুটো প্রিয় শো শুরু হওয়ায় রিমোট নিয়ে ঝগড়া লেগে গেলো তাদের। অরুমিতা বলল,

“আমি আগে রিমোট নিয়েছি নীহা। আমি দেখবো।”

নীহা মানতে নারাজ,

“আমি দেখবো।”

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া চললো। তাদের ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ তুবা এসে কোন কথাবার্তা ছাড়া এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো অরুমিতাকে। হিংস্র কন্ঠে বলতে লাগলো,

“একটা গেছে এখন আবার তুই শুরু করছিস? আমার শান্তি ভালো লাগে না তোদের? এতো চেঁচামেচি কেন? রিমোট চাইছে দিয়ে দিবি? ঝগড়া করবি কেন?”

অরুমিতা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার মায়ের দিকে। কি হচ্ছে যেন বুঝতেই পারলো না। সে শুধু ভাবতে লাগলো তাকে মারলো? তাও তুবা? মানে তার মা? তবে অরুমিতা তো অধরা নয়। সে চিৎকার করে বলে উঠলো,

“মারছো কেন আমাকে? কি করেছি আমি? কেন আমাকেই রিমোট দিতে হবে? আমার পছন্দের মূল্য নেই?”

ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে ভির লেগে গেছে। তুবা আরো রেগে অরুমিতার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে তাকে আটকে রাখে আয়েশা ও তহুরা। অরুমিতা হিসহিস করতে থাকে। ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকায় তুবার দিকে। এই মুহুর্তে মা নামক মানুষটিকে মোটেও সহ্য হচ্ছে না তার।

তুবার হিংস্রাত্মক আচরণ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। অরুমিতাকেও যেন আজকাল সহ্য করতে পারে না সে। শুধু অরুমিতা নয় হুটহাট যে কারো উপর চটে যায়। মারতে চায়। তার অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দিন দিন। তাই তাকে নিয়ে শহরের নামকরা সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে এসেছেন ফয়জাল হাসান। তাকে সব খুলে বললেন তিনি। মনোযোগ সহকারে সব শুনলেন সাইকোলজিস্ট আলিফ আরমান।

আলিফ আরমান বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করলেন তুবাকে। তুবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। অবশেষে তিনি ফয়জাল হাসানকে জানালেন তুবা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (বিপিডি) এ আক্রান্ত। বিপিডি একটি জটিল মানসিক সমস্যা যা ব্যক্তির আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সম্পর্ক পরিচালনা এবং আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে। বিপিডির প্রভাবে ব্যক্তি সজজেই বিরক্ত, ক্রুদ্ধ ও হতাশ হয়ে পরে। হঠাৎ কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসে বলে মনে হলেও পরক্ষণেই তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ডাক্তার আরো জানালো বিপিডির চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদি এবং ধৈর্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। ফয়জাল হাসান সম্মতি জানালেন এই দীর্ঘ চিকিৎসার জন্য!
——————————

নবনী আনজুম বসেছেন আজ আরহাম ও অণিতার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। ফারুক হাসান চলতে পারে না। সে তাই উপস্থিত নেই সভায়। অবশ্য উপস্থিত হওয়ার দরকারও নেই। বিয়ে হয়ে গেছে আরো বছর খানেক আগে। এখন শুধু ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করা বাকি। অণিতা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোনায়। তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অহি। আরহাম অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মায়মুনা জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারার দিকে আজকাল তাকানো যায় না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। স্বামী-ছেলের টেনশনে আর সারাক্ষণ স্বামীর সেবা করতে করতে এই অবস্থা তার। তবুও তার কোন অভিযোগ নেই। কাদের নামে অভিযোগ করবে? যারা এতো অন্যায়ের পরও থাকতে দিচ্ছে, খেতে দিচ্ছে, তার দুই মেয়ের সব দায়িত্ব পালন করছে তাদের নামে? কিভাবে?

নবনী আনজুম তার তিন ছেলেকে গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন,

“আরহাম ও অণিতার বিয়ের আয়োজন করো। আয়োজনে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। অণিতা তোমাদের ভাইঝি সেটা মাথায় রেখো। বাবা-মায়ের দোষের ভার যেন কোন ভাবে তার দিকে না আসে।”

ফখরুল হাসান মৃদুস্বরে বলল,

“আপনি কোন চিন্তা করবেন না আম্মা। কোন কমতি হবে না।”

মায়মুনা কিছুটা অসহায় কন্ঠে বলল,

“আম্মা, অণিতার বিয়েতে কি আবির কে আনতে পারবো না?”

নবনী আনজুম গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। কেউ কোন কথা বলল না। নবনী আনজুম উঠে দাঁড়ালেন। আঁখি ছুটে এসে তাকে ধরলো। ইদানীং হাঁটু ব্যথা বেড়েছে তার। হাঁটতে কষ্ট হয়। নবনী আনজুম যেতে যেতে বলল,

“কতৃপক্ষের থেকে আগে শোন তোমার ছেলে কতটা সুস্থ হলো। ঘুরতে যায়নি তোমার ছেলে যে চাইলেই আসতে পারবে!”

মায়মুনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আসলেই তো। চাইলেই তো তার ছেলেটা আসতে পারবে না। পরিপূর্ণ সুস্থ না হলে কেন আসতে দেবে তাকে?

#চলবে…?