#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৮
বৈশাখের শেষ দিক। সূর্য আপনমনে ছড়িয়ে দিচ্ছে তেজ। এই খাঁ খাঁ রোদ্দুরের মাঝে তপ্ত ছাদে এসে দাঁড়ালো অধরা। পানির লাইন ছেড়ে দিয়ে পাইপ দিয়ে ছাদের গাছ গুলোর পানি দিতে লেগে পরলো। কাজ শেষ করে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। সিম্বা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। মিউমিউ করে ডেকে উঠতেই অধরার নজর গেলো সেদিকে। আলগোছে কোলে তুলে নিলো তাকে। আদুরে স্বরে বলল,
“ভর দুপুরে তোকে ছাদে আসতে কে বলেছে? সারাদিন কেন আমার পিছু পরে থাকিস?”
সিম্বা আবারো আদুরে কন্ঠে ডেকে উঠলো। অধরা মুচকি হেসে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তার লোমশ শরীরে।
তপ্ত দুপুরে কোথাও কেউ নেই। তরুলতার ছাদ থেকে দূরের রাস্তাটা দেখা যায়। সারাদিনের ব্যস্ত রাস্তা টাও এখন কেমন ঝিমিয়ে আছে। কোথাও মানুষের সাড়া নেই, নেই পাখির ডাক। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে অধরার হঠাৎ বাবার কথা মনে পরলো। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“তোমায় কতোদিন দেখি না বাবা!”
অধরারা ধ্যান ভাঙে সিম্বার ডাকে। গরম লাগছে বোধহয় ওর। অধরা দ্রুত ছাদ থেকে নেমে আসে সিম্বাকে কোলে নিয়ে।
————————-
অধরা রেডি হয়ে বের হয়। এখনো তিনটা বাজেনি। এগিয়ে যায় শাশুড়ির ঘরের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে ডাকে,
“মা।”
“ভিতরে আয়।”
তাইফার আওয়াজ ভেসে আসে। অধরা মুচকি হেসে ঘরে ঢোকে। তাইফা দেখে ছেলের বউকে। হেসে বলে,
“কোথাও যাচ্ছিস?”
“বাবার কাছে যাব একটু।”
তাইফা কখনো নিষেধ করে না। আজও করলো না। হেসে বলল,
“যা। সাবধানে যাবি। কেমন?”
অধরা মাথা নাড়ে। বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। তাইফা হাসেন। তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস কথাটা সে বলেনি। বলেও না। মেয়েটার যতক্ষণ ইচ্ছে থাকুক বাবার সাথে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলবে কেন সে?
কোনদিকে না তাকিয়ে অধরা সোজা চলে গেলো বাবার কেবিনের দিকে। এই কেবিনে ঢুকতে তার কারো পারমিশন লাগে না। তবুও সে আলতো স্বরে ডাকে,
“বাবা, আসবো?”
কাজে ব্যস্ত থাকা ফয়জাল হাসান কিছুটা চমকে উঠে। ঠোঁটের কোণে ফুটো ওঠে হাসির রেখা। মৃদুস্বরে বলে,
“আসো মা। তোমার কেন পারমিশন লাগবে?”
অধরা মুচকি হেসে বাবার সামনের চেয়ারে বসে। বলে,
“এটা তোমার কাজের যায়গা। অবশ্যই পারমিশন নিয়ে আসতে হবে।”
ফয়জাল হাসান হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলায়। আদুরে স্বরে বলে,
“আমার মা ভালো আছে?”
“ভীষণ ভালো আছে বাবা।”
কথা বলতে গিয়ে অধরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ফয়জাল হাসান বুঝে যান মেয়েটা সত্যি ভালো আছে। তিনি হাসেন। প্রাপ্তির হাসি, সুখের হাসি। মেয়ে ভালো আছে; বাবারা তো এতেই সুখী হয়। অধরা কিছুটা অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“তুমি অফিসে আসোনি কেন বাবা? আমি দুইদিন এসে ফিরে চলে গেছি।”
ফয়জাল হাসান বলে,
“তুবা অসুস্থ। একটু ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করতে হলো।”
“কি হয়েছে ওনার?”
“বিপিডি।”
অধরা একটু চমকে যায়। তবে বুঝতে দেয় না। শুধু বলে,
“ওহ।”
ফয়জাল হাসান এ ব্যাপারে আর কথা বলে না। বাবা-মেয়ে মেতে উঠে অন্য গল্পে। নিজেদের আনন্দে!
————————-
সামনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। কিছু কাগজপত্র জমা দিতে আজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আসতে হয়েছে অধরারা। তাওসিফের আজ ছুটি ছিলো। তাই সে বাইকে করে নিয়ে এসেছে। অধরা কাগজপত্র জমা দিয়ে বের হবে এমন সময় পিছন থেকে চারটি মেয়ে ডেকে উঠলো তাকে। মেয়ে গুলো তার ডিপার্টমেন্টেই পড়ে। তবে কখনো কথা হয়নি আগে। অধরা তো কারো সাথেই কথা বলে না বলতে গেলে। ক্লাসে আসে হাতেগোনা দুই, চার দিন। হঠাৎ তাকে ডাকাতে কিছুটা চমকে গেছে গেছে। সে পিছে ফিরে তাকালো। মেয়ে গুলো তার পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি যার বাইকে করে এলে সে তোমার কে হয়?”
দ্বিতীয় মেয়েটা বলে উঠলো,
“তোমার ভাই নাকি?”
একটা মেয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাওসিফকে দেখে বলল,
“তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে যে এখনো।”
অধরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাওসিফকে একবার দেখলো। সে কিছু বলার আগেই সবচেয়ে আগ্রহী মেয়েটা বলে উঠলো,
“নাম কি তোমার ভাইয়ের? ফোন নাম্বার অথবা ফেসবুক আইডি দিতে পারবে? প্লিজ।”
তার বান্ধবীরা মজা করে বলল,
“কেন রে? ওর ভাবি হবি নাকি?”
অধরা বেশ অবাক হলো। তার হঠাৎ দম ফাটানো হাসি পেয়ে গেলো। বহু কষ্টে সে হাসি আটকিয়ে রাখলো। মনে মনে ভাবলো, কি মেয়েরে বাবা! আমার ভাই হয় নাকি হয়না বলার সুযোগ ও দিচ্ছে না। এদিকে মেয়ে গুলো পুরো শিওর যে মেয়ে অন্য মেয়ের সাথেই কথা বলে না তার প্রেমিক বলে কিছু নিশ্চয়ই থাকবে না। অধরা নিজেকে স্বাভাবিক করে ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ওখানে বাইক নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে তার কথা বলছো? সে আমার ভাই নয়। আমার হাসবেন্ড। নাম তাওসিফ আবরার। ফেসবুক আইডিও এই নামেই। খুঁজে নিও।”
অধরা আর দাঁড়ালো না। কথা শেষ করে সাবলীল ভাবে হেঁটে বাইকের কাছে এগিয়ে গেলো। মেয়েগুলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। অধরা বাইকের কাছে আসতেই তাওসিফ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“কাজ শেষ?”
“হুম।”
“যাই তাহলে?”
অধরা বিনাবাক্যে উঠে বসলো বাইকে। মেয়েগুলো তখনো তাকিয়ে আছে। অধরা সরাসরি তাকালো না আর তাদের দিকে। ফিক করে হেসে আড়চোখে একবার দেখলো। তাওসিফ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার, হাসছো যে?”
অধরা হাসি থামিয়ে ফেললো। আলতো স্বরে বলল,
“এমনি!”
—————————-
রাত দশটা পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে। অধরা ঘরে ফিরলে কেবল। ঘরে ফিরলো? তাওসিফ আনমনে হাসলো। সে বাড়িতেই ছিলো। শুধু তাওসিফের রুমে ছিলো না। তাওসিফ কিছু বললো না। তবে কিয়ৎকাল পর পর আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখতো লাগলো তার নীরবতার রাণীকে। অধরা আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়ে বেণুনি গাঁথলো। হুট করে তাওসিফের দিকে ফিরে বলল,
“শুনুন।”
তাওসিফ কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটা সরিয়ে রাখলো। দুই গালে হাত রেখে বড়ো মনোযোগী হয়ে বলল,
“বলুন।”
অধরা হেসে ফেললো। চোখ পাকিয়ে বলল,
“সব সময় দুষ্টমি আপনার।”
“আচ্ছা আচ্ছা আমি সিরিয়াস। আপনি বলুন।”
“কাল শুক্রবার। আপনার অফিস ছুটি?”
“হুম।”
তাওসিফ গম্ভীর স্বরে বলল। তার ভাবখানা এমন যে সে এখন সবচেয়ে মনোযোগী শ্রোতা। অধরার হাসি পাচ্ছে তার কাহিনি দেখে। তবে না হেসে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“আমায় কাল একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন?”
তাওসিফের চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করে উঠলো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা স্পষ্ট হলো। সে একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“কোথায় যাবেন?”
অধরা আরো আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো,
“যেখানে আপনার পাশে বসে অনেক অনেক কথা বলা যায়।”
“এতো কথা মনে?”
“অনেক।”
তাওসিফ হাসলো। কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,
“এখন বলো।”
“উহু, এখন বলা যাবে না।”
তাওসিফের এই আহ্লাদী রমণীকে ভীষণ ভালো লাগছে। মেয়েটা আগে কখনো এতো আহ্লাদ করেছে তার সাথে? মোটেও না। তবে আজ এতো? তাওসিফ হাসে। সে তো চায় মেয়েটার পুরো ভরসার জায়গা সে হোক। মেয়েটা সব আবদার তার কাছে করুক। তাওসিফ হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে,
“আচ্ছা না বললেন। এখন আসুন ঘুমান। কাল নিয়ে যাব আপনাকে।”
অধরা উঠে আসে। নিশ্চুপ শুয়ে পরো তাওসিফের পাশে। তাওসিফ আলো নিভিয়ে অন্ধকারের মাঝেও তাকিয়ে থাকে পাশের রমণীর দিকে। মুগ্ধ চোখে!
————————–
জুম্মার পরপরই অধরাকে নিয়ে বের হয় তাওসিফ। গন্তব্য ভাটিয়ারী। আরো স্পষ্ট করে বলতে হলে সানসেট পয়েন্ট। চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি। পাহাড়ের নজর কাড়া সৌন্দর্য, স্বচ্ছ হ্রদের পানি আর সানসেট পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখা। তাওসিফ অধরার কথা অনুযায়ী জায়গা ঠিক করেছে। সবুজ ঘাসের মাঝে বসে পাহাড়ের হাতছানিতে অধরা তার সব কথা তাওসিফকে বলুক। তাওসিফ আজ আবার মনোযোগী শ্রোতা হবে।
ঘন্টা দুয়েক পর তার পৌঁছে গেলো কাঙ্খিত স্থানে। অধরা অবাক হয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করলো। কিছুসময় বাদেই জুতা জোড়া খুলে হাতে নিলো সে। নরম ঘাসের উপর পা দিয়ে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগছে। তারপর তারা ঘাসের উপর বসলো। তাওসিফ নীল আকাশের দিকে তাকালো। হেসে বলল,
“তারপর আপনার কথা বলুন। শুনি।”
অধরা নিজেও তাকালো আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ নিজেও তাকালো। চোখে চোখ রেখে অধরা ফের গতকাল রাতের মতো আহ্লাদী হলো। কন্ঠে একরাশ আহ্লাদ ধেলে বলল,
“আমায় গল্প শুনাবেন?”
তাওসিফ বেশ অবাক হলো। বলল,
“কিসের গল্প?”
“আপনার প্রেমে পড়ার গল্প।”
তাওসিফ অধরার দিকে গাঢ় চোখে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে হাসে। চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার তিন বছর আগে সপ্তদশী অধরার কথা মনে পড়ে। ভীষণ ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া চেহারাটা চোখে ভাসে। অধরা ফের বলে,
“শুনাবেন না?”
“শুনাবো। কিন্তু বিনিময়ে কি পাব?”
অধরা হাসে। কেমন অন্যরকম করে। ফিসফিস করে বলে,
“যা চাবেন তাই!”
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩৯
অতীত,
প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশেই চট্টগ্রাম কলেজ। তাওসিফ সেদিন একটা ফুটবল ম্যাচ খেলতে এসেছিলো প্যারেড গ্রাউন্ডে। খেলা শেষে বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে হেঁটে হেঁটে সামনে এগোচ্ছিলো। চট্টগ্রাম কলেজের সামনে এক পুরোনো বন্ধুকে দেখে বাকি বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে সেই বন্ধুর কাছে ছুটে যায় তাওসিফ। কুশল বিনিময় শেষে জানতে পারে বন্ধু তার ছোট বোনকে নিতে এসেছে। তাওসি দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই সেই বন্ধুর ছোট বোন চলে এলো। সেই বন্ধু হুট করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তার বোনকে জিজ্ঞেস করলো,
“ওটা আসফিন না? আঁখির কাজিন?”
“হুম।”
“একা যে?”
“ও কারো সাথে কথা বলে না ভাইয়া। আরাব ভাইয়ার সাথেও না।”
তাওসিফ ওদের ইঙ্গিত অনুযায়ী তাকায়। ছোট্ট একটা মেয়ে। দেখে কেউ বলবে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে! মুখে হাসি নেই। চোখেও কেমন ভয়। তাওসিফের অভিজ্ঞ চোখ আরো বুঝে নিলো মেয়েটার থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে পিছে পিছে হাঁটা ছেলেটা আরাব। সে মেয়েটার জন্য বিশেষ কেউ। এবং তাওসিফ সবচেয়ে ভালো করে যা বুঝতে পারলো তা হলো, তাওসিফ আবরারের হৃদয় থমকে গেছে। এক সপ্তদশীর ভীত নজরে!
তাওসিফ থামে। অধরা হেসে উঠে খিলখিল করে। তাওসিফ মুগ্ধ হয়ে তাকায়। হাসি থামিয়ে অধরা বলে উঠে,
“প্রথম দেখায় থমকে গেলেন? তাও ভীতু একটা মেয়েকে দেখে?”
“হুম।”
অধরা হাসে। চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“চ্যাহ! আপনার চয়েস ভালো নাহ!”
এবার তাওসিফ হেসে উঠে। অধরা তাড়া দিয়ে বলে,
“তারপর? মেয়েটা কোথায় পেলেন আবার?”
তাওসিফ হেসে শুরু করে,
“রাহাত কে চিন? তোমার ব্যাচমেট ছিলো।”
অধরা স্মৃতির পাতায় হাতড়ে বেরায়। রাহাত! রাহাত! কে এটা? অধরা খুঁজে পায় না। শুধু রাহাত কেন? তার স্মৃতির পাতা শূন্য। কোন স্মরণীয় ঘটনা নেই সেখানে। অধরা আলতো স্বরে বলল,
“নাহ!”
তাওসিফ জানতো উত্তরটা। তাই সে বলল,
“রাহাত আমার পরিচিত। অন্য এক বন্ধুর ভাই। রাহাতকে বললাম তোমার সম্পর্কে সব ইনফরমেশন চাই। রাহাত তোমার বাসার ঠিকানাও এনে দিলো। এরপর আর কি জানবে বলো? আমি হয়ে গেলাম তোমার ছায়া সঙ্গী। তোমার তো কৌতুহল নেই। যদি চারদিকে নজর রাখতে তাহলে যখনই তুমি পিছু ফিরে তাকাতে দেখতে কেউ একজন সব সময় তোমার সঙ্গী হয়ে আছে।”
অধরা থমকে যায়। কথা বলে না। তাওসিফ হেসে বলে,
“আরাব তোমাকে ভালোবাসে কখন থেকে জানো?”
অধরা তাওসিফের দিকে তাকায় না। অবাকও হয় না এমন প্রশ্নে। যে তাকে এতো সদর্পনে অনুসরণ করেছে সে নিশ্চয়ই সব জানে। অধরা বলে,
“এইচএসসির আগে আগে জেনেছি।”
“আগাতে ইচ্ছে হয়নি? মানুষ যখন একা থাকে সঙ্গ চায়।”
“উহু! কেন যেন হয়নি। হয়তো আরাব না হয়ে বাইরের কেউ আগ্রহ দেখালে আগানোর ইচ্ছে হতো। যেখানে আমার বাড়িটায় অসহ্য লাগতো সেখানে ওই বাড়িতেই মায়া জন্মাতে বোধহয় মন সায় দেয়নি।”
তাওসিফ হাসে। দুজনেই চুপ করে বসে থাকে ঘাসের উপর। কথা বলে না আর। কথা গুলো যেন ফুরিয়ে গেছে। নীরবতা গ্রাস করে নিয়েছে সব শব্দ গুলোকে।
————————–
তাইফা ঘরের কাজ করছে। তরু-লতা কলেজে গেছে। সে আর তাইফা ব্যতীত কেউ নেই বাসায়। অধরা ডাইনিং টেবিল থেকে একটা আপেল নিয়ে চেয়ারে বসে পরলো। তাইফা কাজ করতে করতপ জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু হয়েছে।”
“উহু।”
অধরা আনমনা হয়ে বসে থাকে। কি যেন ভাবে। তাইফা আর ঘাটালো তাকে। মন খারাপ বোধহয়। যখন মন ভালো হবে এমনিই সব বলবে। তাইফা ফের নিজের কাজে মন দেয়। অধরা আপেলে কামড় দিয়ে হুট করে প্রশ্ন করলো,
“আমাকে আরো আগে থেকে চিনতে মা?”
তাইফা চমকালো না৷ তবে হাত থেমে গেলো। কাজ রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অধরার দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, চিনতাম।”
“তাই আমাকে না দেখেই বিয়ের কথা ঠিক করে ফেলেছিলে?”
“হুম।”
“ছেলের পছন্দের উপর এতো বিশ্বাস তোমার?”
তাইফা হাসে। বলে,
“সংসার করবে ছেলে। আমি তো না। তবে আমার কেন আবার আলাদা করে পছন্দ হতে হবে? আর তুই দেখতে ভীষণ মিষ্টি। অপছন্দ করবো কি করে?”
অধরা হাসে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
“তুমি এতো ভালো কেন মা?”
তাইফা বলতে চায়, সব মায়েরা ভালো হয়। কিন্তু বলতে পারে না। চুপ করে থাকে। মেয়েটা মায়ের আদর পায়নি যে! তাইতো শাশুড়ির একটু আদরে কেমন গলে যায়!
—————————-
তরুলতায় আজ চলছে বিশাল আয়োজন। কখনো কাজে হাত না দেওয়া তরু-লতাও কাজে বসেছে। সবাই কাজ করছে মনের আনন্দে। চুলায় পায়েস বসিয়েছে অধরা। অনবরত নেড়ে চলছে সে। তরু-লতা ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত। আবার ঘর সাজাতে হবে। কত কাজ। অধরা নিজেও তাড়াহুড়ো করছে। তাইফা রান্নাঘরে এসে বলল,
“পায়েস হলো?”
“হয়েছে মা।”
“তাহলে এবার তুই যা। বাকিটা আমি সামলে নিব। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নে। কেমন?”
অধরা মাথা নাড়ে। পায়েসের হাড়ি নামিয়ে এগিয়ে যায়। আবার পিছে ফিরে বলে,
“মা? শাড়ি পরবো?”
তাইফা খুশিমনে রাজি হয়ে যায়। অধরা নিজের ঘরে যায়। আরো একবার গোসল শেষ করে গাঢ় লাল রঙের শাড়ি বেছে নেয়। পরে ফেলে দ্রুত। শখ করে আলতা লাগায় পায়ে। নুপুর পরে, কানে, গলায় গহনা পরে। তারপর একটু সাজে। গাঢ় কাজলে রাঙায় চোখ দুটো। ভেজা চুল গুলে ছেড়ে দিয়ে রাখে। শেষ! এইটুকুই যথেষ্ট। নিজেকেই নিজে বলে অধরা। তারপর হসে বের হয় ঘর থেকে। ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রাখে খাবার। কেক নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই তরু-লতা চেঁচিয়ে উঠে।
“ভাবি! মারাত্মক লাগছে তোমাকে।”
“ভাইয়া আজকে শেষ!”
অধরা হাসে। কিছু বলে না। সব কিছু তৈরি করে অপেক্ষা করে তারা।
অফিস থেকে ফিরে নিদিষ্ট যায়গায় বাইক পার্ক করে তাওসিফ। পুরো বাড়ি অন্ধকার। তাওসিফ আশেপাশের বাড়ি গুলোর দিকে তাকালো। বিদ্যুৎ আছে। তাহলে তাদের বাড়ি এমন ভূতুড়ে হয়ে আছে কেন? বাড়িতে কি কেউ নেই? তাকে না বলে গেলো কোথায় সব!
তাওসিফ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে দরজার দিকে। লক করা নেই। অনায়াসে বাড়িতে প্রবেশ করে সে। এক পা এক পা করে এগুচ্ছে। এবার ডেকে উঠলো,
“অধরা! অধরা! কোথায় তুমি?”
কোন সাড়াশব্দ নেই। তাওসিফ আরো কিছুটা এগিয়ে আসে,
“মা, তরু! লতা। কোথায় তোরা?”
চারদিকে নীরবতা। কোন আওয়াজ নেই। তাওসিফ হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে চলে এলো। সাথে সাথে আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো তরুলতা। সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো কিছু মানুষ,
“হ্যাপি বার্থডে!”
তাওসিফ প্রথমে ভড়কে গেলো। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর হুট করে আলো জ্বলবার কারণে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। তারপর পিটপিট করে তাকালো। হাসিমুখে সবায়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বলল,
“এরকম কেউ করে? চমকে গেছি আমি!”
তরু দুষ্ট হেসে বলে,
“চমক এখনো বাকি আছে ভাইয়া।”
তাওসিফ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। ভাবখানা এমন আর কি চমক দিবি? তরু-লতা এতক্ষণ আড়াল করে রেখেছিলো অধরাকে। দু’জন দুই দিকে সরে গেলো। অধরা হাসিমুখে বলে উঠলো,
“শুভ জন্মদিন।”
তাওসিফ কথা বলতেও যেন ভুলে গেলো। এই মেয়েটা কি তাকে মেরে দিবে? কেন সে শাড়ি পরবে। তাও লাল শাড়ি! মেয়েটা জানে তাকে কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে। আবার সেজেছ। উফপপ! তাওসিফ আজ শেষ!
এক দৃষ্টিতে তাওসিফকে অধরার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো তাওসিফের বাবা-মা। তরু ফের ফিচেল কন্ঠে বলল,
“কি ভাইয়া? চমকেছো?”
তাওসিফের ধ্যান ভাঙলো। কিছু বললো না সে। তাইফা ছেলেকে বলল,
“আয়, কেকটা কাট।”
তাওসিফ কেক কেটে একে একে সকলকে খাইয়ে দিলো। তারপর ঘরে গেলো ফ্রেস হতে। ততক্ষণে রাতের খাবার টেবিলে সাজাতে লাগলো বাকিরা। রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে ঘরে এলো অধরা। তাওসিফ যেন এতক্ষণ এই অপেক্ষাতেই ছিলো। তাওসিফ হুট করে এসে দাঁড়ালো অধরার সামনে। অধরা ভড়কালো। বলল,
“কি হলো?”
তাওসিফ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো তাকে। মায়াময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার গিফট কই?”
অধরা ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এগিয়ে এলো তাওসিফের দিকে। তাওসিফকে অবাক করে দিয়ে তাওসিফের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো। দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাওসিফের গলা। নিজের পাতলা ঠোঁট দুটো ছুঁইয়ে দিলো তাওসিফের কপালে। পরক্ষণেই আলতো স্বরে বলল,
“ভালোবাসি।”
তাওসিফ থমকে যায়। শুকনো ঢোক গিলে অনবরত। বহু কষ্টে বলে,
“কিহহহ”
অধরা হাসে। তাওসিফের নাকে নাক ঘঁষে বলে,
“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি তাওসিফ আবরার।”
তাওসিফের শ্বাস রোধ হয়ে আসে। মুহুর্তেই দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অধরাকে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয়। অধরা হাসে। কি ভাগ্যবতী সে! তার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনেই লোকটা কাঁদছে। তাওসিফ আজ যেন পাগল হয়ে গেছে। সে অধরাকে বাহুবন্ধনী থেকে আর ছাড়ছে না। অধরা হেসে বলে,
“পালিয়ে যাব না তো!”
তাওসিফ বলে,
“তাও বুকে থাকো প্লিজ। তুমি জানো কতো শান্তি লাগছে আমারা! এতো দেরি কেন করলে প্রেমে পড়তে বলোতো?”
অধরা তাওসিফের বুকে মুখ গুঁজে হাসে। উত্তর দেয় না। তাওসিফ উত্তর শ
চায়ও না। সে শুধু আজ সারারাত তার পুতুলটাকে বুকের মাঝে জাপ্টে ধরে রাখতে চায়!
#চলবে…?