#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৮
সকাল আটটা। অরোরা সবে ঘুম থেকে উঠলো। মেয়ে উঠেনি বলে অধরা বাইরে যায়নি। অরোরা উঠতেই অধরা ভেজা কাপড় দিয়ে তার চোখমুখ মুছে দিলো। জামা পাল্টিয়ে তৈরি হয়ে নিলো। এখনি নিচে যাবে। তার আগেই অরুমিতা রুমে এলো। অরোরাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। অধরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপুই, নিচে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে।”
অরুমিতা নিচে চলে গেলো অরোরাকে নিয়ে। অধরা ঘর থেকে বের হয়ে কি ভাবলো কে জানে, নিচে না গিয়ে সে গিয়ে দাঁড়ালো মেঝ চাচার ঘরের সামনে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা গেলো মায়মুনা ফারুক হাসানকে বালিশে হেলান দিয়ে বসতে সাহায্য করছে। অধরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো। ফারুক হাসান এখনো নিজে উঠে বসতে পারে না, হাঁটাচলা করতে পারে না। অধরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভিতরে আসবো?”
মায়মুনা চমকে উঠে। অধরাকে দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। আলতো স্বরে বলে,
“আসো।”
অধরা ভিতরে আসে। চাচির মাঝের অপরাধ বোধ টের পায় সে। কত ছোট সে, অথচ চাচি তার সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে কতখানি ছোট হয়ে গেছে তার মন, কে জানে। অধরা এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসে। ফারুক হাসান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অধরার দিকে। অধরা নিজেই কথা শুরু করলো,
“ভালো আছেন চাচা?”
“হ্যাঁ, মা! এই তো আছি।”
এতটুকু বলতেই ফারুক হাসানের চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি ছলচ্ছল চোখ নিয়ে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস মা, পাপের শাস্তি পাচ্ছি। তুই ক্ষমা করলে একটু বোধহয় শান্তি পাব।”
অধরা চাচার হাতে হাত রাখে। নিজের অজান্তে বলে,
“আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি চাচা।”
কথাটা বলে ফেলার পর চমকে উঠে অধরা। সে বলল কথাটা? কিভাবে? এতদিন চেয়েও যেটা বলতে পারেনি আজ কি করে বলে ফেললো? অধরা সামলে নেয় নিজেকে। উঠে দাঁড়ায়। চাচির দিকে তাকিয়ে বলে,
“চাচাকে খাওয়ান। আমি নিচে যাচ্ছি।”
অধরা নিচে নেমে আসে। পুরো কাজিন মহল ডাইনিং টেবিলে বসা। অধরা অবাক হয়। অরুমিতা স্কুলে যায়নি, তুবাও জোর করেনি। নীহা, নীরবও যায়নি। অহি আর আঁখি আপার আজ ভার্সিটিতে তেমন কোন কাজ নেই। আরহাম ভাইয়া ইচ্ছে করে অফিস যায়নি। আবির খেতে বসেছে। সে অফিসে যাবে। আবির ছোট একটা কোম্পানিতে চাকুরী পেয়েছে। দাদুনির কড়া আদেশে নিজেদের অফিসে বসতে দেওয়া হয়নি তাকে। অরোরা অধরার ছোট ফুপির কাছে। মাসফিয়া আর নীরব ওর সাথে কথা বলছে। অধরা চেয়ার টেনে বসলো। অণিতা খাবার বেড়ে দিলো তাকে। দুই টুকরো রুটি মুখে দিয়ে অধরা হঠাৎ ডেকে উঠলো,
“আবির ভাইয়া।”
আবির মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো। অধরার ডাকে চমকে তাকালো সে। এক পলক তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেললো। ডাইনিং এ বসা বাকি সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খাওয়া বাদ দিয়ে সবায় বিস্মিত নয়নে দেখছে অধরাকে। অধরার কোন ভাবান্তর হলো না। আবির নিচু স্বরে বলল,
“বলো।”
আরো একটা রুটি মুখে পুরে অধরা বলল,
“পনেরো বিশ দিন আগে একদিন বাইরে গিয়েছিলাম। তোমাকে স্টেডিয়ামের ওখানে একটা মেয়ের সাথে দেখেছি, আদুরে একটা মেয়ে। পছন্দ করো?”
আবির এবার তাস্কি খেয়ে গেছে। হচ্ছে কি এসব তার সাথে? এতোদিন পর ভাইয়া ডাক! আবার পছন্দ জিজ্ঞেস! আবির বিস্ময় নিয়ে তাকালো অধরার দিকে। অধরা পাত্তা দিলো না সেসবে। বলল,
“পছন্দ হলে বাসায় বলে ফেলো, বিয়ের বয়স হয়েছে তোমার। টুক করে বিয়ে করে ফেলো।”
আবির এবার কেশে উঠলো। বাকিরাও হতভম্ব হয়ে বসে আছে। অধরা ফের বলল,
“বিয়ে করে ফেলো। তুমি বিয়ে করছো না বলে বেচারা অহি আপা বিয়ে করতে পারছে না।”
অহি এবার সম্মতি দিয়ে বলে উঠলো,
“একদম মনের কথা বললি বোন।”
আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্লিজ ভাইয়া বিবাহ করে ফেলো।”
আঁখি আফসোসের স্বরে বলল,
“আমার জন্য কেউ ভাবে না। আমি তো ভেসে এসেছি।”
আরাব বললল,
“প্লিজ আপা তুই বিয়ে করে ফেল। তুই বিয়ে করলেই আমি করে ফেলবো।”
আরহাম কিছু বলবে বলে মুখ খুলেছে এমন সময় অধরা বলে উঠলো,
“বড়ো ভাইয়া, যা মুখে এনেছো টুক করে গিলে ফেলো। যদি বলে ফেলো, টেবিলের সকল সরঞ্জাম অণিপু তোমার মাথায় ফেলবে দেখো।”
অণিতা হেসে উঠলো। সেইসাথে সবায়। তানিশা হেসে বলল,
“একদম। শুধু টেবিলের টা কেন? দরকার হলে আমি অণিতাকে রান্নাঘর থেকে ছু ড়ি, কাঁচি, খুন্তি সব এনে দিব।”
আরহাম অসহায় কন্ঠে বলল,
“আশ্চর্য! তুই আমার বোন?”
তানিশা ভেঙচি কেটে বলল,
“তোরও বোন, অণিতারও বোন।”
এভাবে চলতে লাগলো ভাই-বোনের আনন্দ উৎসব। আজ কতোগুলো বছর পর নবকুঞ্জের ডাইনিং হলে হাসির জোয়ার হলো। প্রতিটা ইট যেন খিলখিল করে হেসে উঠছে। বাড়ির বউরা আজ অবাক নয়নে দেখছে। একেই বোধহয় বাড়ি বলে, সুখের সংসার বলে। বাচ্চাদের হাসির শব্দে ফুল ফুটছে। নবনী আনজুম চোখ মুছেন। বারবার টেবিলের দিকে তাকান। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরা বাচ্চা গুলোকে দেখে। মনে পরে যায় মৃত স্বামীর কথা। তিনি বলেছিলেন,
“আসফিনের চেহার অন্যরকম কিছু একটা আছে জানো তো! ও হাসলে পুরো নবকুঞ্জ হাসে, প্রাণ ফিরে পায়। আর ওর মন খারাপ পুরো নবকুঞ্জের মন খারাপের গল্প হয়ে যায়।”
আজ যেন তার বাস্তব প্রমাণ পেলো। শুধু আসফিন চেয়েছে বলে আর নবকুঞ্জে খুশির হাট বসেছে। আসফিন সত্যি অনন্য!
উপরের ঘরে অধরার ফোন বাজছে। অরুমিতা বলল,
“আমি নিয়ে আসি আপুই”
অধরার খাওয়া প্রায় শেষ। সে বলল,
“আনতে হবে না। আমি ঘরে যাচ্ছি। মা কল দিয়েছে বোধহয়।”
দূরে দাঁড়িয়ে থকা তুবার কানে কথাটা গেলো। মেয়ের মুখে স্পষ্ট মা ডাক শুনে তার বুকের মাঝে কেমন করে উঠলো। দুর্ভাগ্য তার! সে সম্পর্কে মা হয়েও মেয়েটার মা হয়ে উঠতে পারিনি। অথচ সে কেউ ছিলো না, সে কেমন মা হয়ে উঠেছে অধরারা। কোন জড়তা ছাড়া অধরা তাকে মা ডাকে। তুবার ভাবনার মাঝে অধরা উঠে দাঁড়ালো, অরোরাকে কোলে নিয়ে উঠে গেলো দোতালায়।
ঘরে এসে ফোন চেক করলো অধরা। তার ধারণা ঠিক। তাইফা কল করেছে। অধরা কল ব্যাক করলো। রিসিভ হলো প্রায় সাথে সাথে। স্ক্রিনে শাশুড়ির চেহারা ভেসে উঠতেই সালাম দিলো অধরা। পুত্র বধূর খোঁজ খবর নেওয়া শেষ করেই নাতনিকে আদুরে স্বরে ডাকতে লাগলেন তিনি। কোথা থেকে যেন ছুটে এলো তরু-লতা। আম্মু, আম্মু বলতে লাগলো বারবার। অবুঝ অরোরা চেয়ে থাকলো স্ক্রিনের দিকে। তরু অসহায় কন্ঠে বলল,
“কবে আসবে ভাবি? মিস করছি তো।”
অধরা অভিমানী স্বরে বলল,
“আমাকে? নাকি তোমার ভাইঝি কে।”
“দু’জনকেই।”
অধরা হেসে বলল,
“যদিও মিথ্যা কথা তবুও বিশ্বাস করলাম যাও।”
আরো বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটলো অধরা। অরোরাকে দুই হাত দিয়ে উঠিয়ে বলল,
“আম্মা! আমার আম্মা! বাবা মিস করছেন?”
অরোরা মায়ের মুখের দিকে তাকি অস্পষ্ট আওয়াজ করলো। অধরা হাসলো। বলল,
“বাবার লাঞ্চ ব্রেকে আমরা বাবাকে কল করবো আম্মা। এখন বাবা কাজ করছে যে।”
বলেই মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। টপাটপ চুমু গেলো অনেক গুলো।
——————–
বিকেল বেলা। আরাব একটু বের হবে। ব্যাংকে কিছু কাজ আছে। হাতঘড়ি হাতে নিয়ে নিচে নামলো সে। অরুমিতা তখন সবে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে তার ব্যাগ। আরাব নিচে নামতেই তুবা বলে উঠলো,
“কোথায় যাচ্ছ আরাব?”
“একটু ব্যাংকে যাব চাচি।”
“চকবাজার হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“অরুকে একটু কষ্ট করে চকবাজার নামিয়ে দিয়ো বাবা।”
কথাটা বলে তাকালো অরুমিতার দিকে। বলল,
“অরু তোর ভাইয়ার সাথে যা আজকে। বাড়ির গাড়িটা চালু হচ্ছে না আজ।”
আরাব দ্বিমত করার সুযোগ পেলো না। সে বেরিয়ে গেলো। অরুমিতাও তার পিছু পিছু গেলো।
পাশাপাশি বসে আছে তারা দুজন। আজও যেতে হবে চট্টেশরী রোড হয়ে। নীরব সেই রাস্তা পার হওয়ার কথা ভাবতেই অরুমিতার মনে পরে গেলো সেদিনের কথা। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। মৃদু বাতাস আসছে। উড়ছে তার ছোট চুল গুলো। ওড়নাটাও উড়ে চলছে। আরাব আঁড়চোখে কয়েকবার তাকালো অরুমিতার দিকে। মেয়েটার মুখে হাসি নেই। কেমন যেন মলিন। আরাব বলে উঠলো,
“মন খারাপ তোর?”
“নাহ তো।”
“মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন?”
“তুমি এতোসব খেয়ালও করো?”
আরাব থতমত খেয়ে গেলো। অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“ওমন চুপচাপ তুই কোনকালে থাকিস না!”
অরুমিতা হাসলো। তবে আর কিছু বলল না। আরাব আবার বলল,
“কি হলো?”
“কিছু হয়নি।”
চুপ করে থাকলো অরুমিতা। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অরুমিতা চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাথাটা ঠেকিয়ে দিলো সিটো। হঠাৎ গেয়ে উঠলো,
“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥
জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥”
আরাব ব্রেক চাপলো। থেমে গেলো গাড়ি। চোখে মেলে তাকালো অরুমিতা। আরাবের দিকে না তাকিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বের হলো। চুপচাপ ঢুকে গেলো সমানের বিল্ডিং টায়। আরাব কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। নাহ! অরুমিতা তাকালো না। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো আরাব। সে কি চেয়েছিলো অরু তাকাক? কিন্তু কেনো?
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৯
ব্যাংকে কাজ শেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাওয়ার কথা। বন্ধুরা ফোন দিচ্ছে অনবরত। আরাব ব্যাংক থেকে বের হয়ে সময় দেখলো। অরুমিতার ছুটি হবে আর একটু পর। আরাব কি যেন ভাবলো আনমনে। ফোনটা তখনই আবার বেজে উঠলো। আরাব তাকালো ফোনের দিকে। তার বন্ধুরা কল করছে। আরাব রিসিভ করলো না। তার মস্তিষ্কে আপাতত একটা লাইন ঘুরছে, “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম…” কি ছিলো অরুর কন্ঠে? কে জান! আরাব কোনভাবেই সেই সুর মাথা থেকে বের করতে পারছে না। সে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আনমনে চলাতে শুরু করলো। আবার কল এসেছে। আরাব রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে তার বন্ধু আকাশ বলে উঠলো,
“শ্লা! কই তুই? কখন আসবি?”
আরাব ধীর কন্ঠে বলল,
“সরি দোস্ত, আজকে একটু কাজ আছে। আসতে পারবো না।”
আকাশ আরো কিছু গালি দিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই কল কাটলো আরাব। গাড়ি ছুটলো চকবাজারের দিকে। আরাবের মনে অন্য রকম এক শান্তি। এতক্ষণ এই শান্তি ছিলো না।
গুলজার মোর থেকে একটু সামনে এগিয়ে আরাব দেখলো অরুমিতা দাঁড়িয়ে আছে একা। হাতে ফোন। গোলাপি ওড়নাটা উড়ছে। আশেপাশে কতো মানুষ অথচ মেয়েটা অসহায় হয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে। আরাব গাড়িটা ঠিক তার পাশে এনে থামালো। অরুমিতা কিছুটা চমকে উঠলো। তাকালো গাড়ির দিকে। আরাব জানালা দিয়ে হাত বের করে বলল,
“গাড়িতে উঠ।”
অরুমিতা অবাক হলো। এগিয়ে এলো। অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এখানে? বন্ধুদের সাথে যাওনি?”
“গাড়িতে উঠে বস।”
অরুমিতা গাড়িতে উঠে বসলো। তাকালো আরাবের দিকে। আবার প্রশ্ন করলো,
“এতো তাড়াতাড়ি এলে যে?”
“বাড়ির গাড়ি নষ্ট হয়েছে। কে নিতে আসবে তোকে?”
“এতো কিছু ভাবো তুমি?”
অরুমিতার কন্ঠে আহ্লাদ। আরাব এক পলক তাকালো। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিলো। অরুমিতা হেসে বলল,
“বাবা নিতে আসতো আমাকে।”
“চাচাকে ফোন করে আসতে না কর।”
অরুমিতা মুচকি হেসে কল লাগালো বাবাকে। তার চোখেমুখে উপচে পরছে খুশি। আরাব চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো একবার। তারপর গাড়ি চালানো শুরু করলো। অরুমিতা তার বাবাকে আসতে মানা করে খুশিমনে তাকিয়ে আছে আরাবের দিকে। আরাবের অস্বস্তি হচ্ছে। সে খুকখুক করে কেশে বলল,
“যাওয়ার সময় বো*ম হয়ে ছিলি, এখন এতো খুশি?”
অরুমিতা হেসে বলল,
“ও তুমি বুঝবে না।”
আরাব ভ্রূঁ কুঁচকে তাকালো একবার৷ বিরবির করে বলল,
“বেশি বড়ো হয়ে গেছিস না?”
আরাবের কথা শুনতে পায়নি অরুমিতা। তবুও দ্বিতীয় বার আর জিজ্ঞেস করলো না। সে জানে আরাব জবাব দিবে না। ফলে ঝগড়া লেগে যাবে হয়তো। অরুমিতা আপাতত মন খারাপ করতে চায় না। আরাব বন্ধুদের সাথে দেখা করতে না গিয়ে তাকে নিতে এসেছে, এতটুকুতেই খুশি সে। এই খুশিটুকু ধরে রাখতে চায়। আরাবের সাথে এখন কথা বাড়ালে আরাব হয়তো ভয়ংকর সেই শব্দ গুলো বলবে, আবেগ কমা। যা অরুমিতা চাচ্ছে না। আজ তাওসিফ ভাইয়া আসবে বাড়িতে। এতক্ষণে বোধহয় চলেও এসেছে। কালই ফিরে যাবে আপুই আর অরোরাকে নিয়ে। এই কারণে অরুমিতার মন খারাপ। নতুন করে মন খারাপ করার আর ইচ্ছে নেই। তাই চুপ থাকে সে। আরাব নিজেও চুপ থাকে। নীরবে চট্টেশ্বরী রোড দিয়ে চলে গাড়ি।
গাড়ি নবকুঞ্জের সামনে থামতেই ছুটে বাড়ির ভিতর চলে যায় অরুমিতা। আরাব ভ্রূঁ বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজেও যায় বাড়ির দিকে।
তাওসিফ চলে এসেছে। বাড়িতে রান্নার ধুম লেগেছে। কি রান্না হবে, কি হবে না এই নিয়ে চলছে বাকবিতন্ডা। তুবা, তহুরা, মায়মুনা, আয়েশা সবাই ব্যস্ত রান্নাঘরে। ড্রয়িং রুমে অরোরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে তাওসিফ। কথা বলছে দাদুনির সাথে। অরুমিতা ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে অরোরাকে কোলে নিলো। মুখ ভার করে বলল,
“আর কয়েকদিন থাকেন ভাইয়া।”
তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,
“তুমি চলো আমাদের বাড়িতে।”
অরুমিতা মনমরা হয়ে বসে রইলো। সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে এলো আয়েশা। কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে হাজির হলো তুবা। সাবাই একসাথে বসে নুডলস, পিঁয়াজু আর মুড়িমাখা খেলো। বাড়ির কর্তারা ততক্ষণে ফিরে এসেছে। একসাথে চায়ের আসরে বসলো তারা। ছোটরা হয়ে গেলো আলাদা। জমিয়ে চলছে আড্ডা। এই জমজমাট পরিবেশে আরাব নেই। অরুমিতা কিছুক্ষণ পর চুপিচুপি উঠে গেলো আসর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো উপরে, প্রিয় পুরুষের খোঁজে।
————————-
ছাদের রেলিং পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে আছে আরাব। দৃষ্টি সম্মুখে। কোনদিকে অবশ্য তাকিয়ে নেই। উদাস দৃষ্টি। জীবনের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত সে। অরুমিতার অনুভূতি সে বোঝে। তবুও ভয় হয়। যদি ওর আবেগ হয়? দিনশেষে যদি কেটে যায় সে আবেগ! তখন? তখন আরাবের কি হবে? আরো একটা ধাক্কা কি করে সহ্য করবে আরাব। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না সে। হঠাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি টের পায় সে। মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। অরুমিতা চিল্লানোর আগেয় নেমে আসে রেলিং থেকে। জিজ্ঞেস করে,
“এখানে কি করিস?”
প্রশ্নটা করা বেমানান। জানে আরাব। তাকে খুঁজতে খুঁজতেই ছাদে চলে এসেছে অরুমিতা। নাহয় সন্ধ্যা বেলায় ছাদে সে কস্মিনকালেও আসবে না। আরাব প্রশ্নটা করলে যাতে এর উত্তর দিতে গিয়ে অরুমিতা ভুলে যায় আরাব এতক্ষণ রেলিং এ বসে ছিলো। অরুমিতার উচ্চতা ভীতি আছে। কিন্তু অরুমিতা ভুললো না। প্রয়োজন মনে করলো না আরাবের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“তুমি এতক্ষণ রেলিং এ বসে ছিলে?”
আরাব সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলে,
“নিচে সবাই মজা করছে। তুই ছাদে এসেছিস কেনো?”
অরুমিতা আরাবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমাকে খুঁজতে।”
আরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সম্মুখে তাকায়। আকাশে আজ বিশাল বড়ো চাঁদ। আরাব আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেরালো। মৃদুস্বরে বলল,
“ভালোবাসিস অরু?”
অরুমিতার চোখ ছলছল করে উঠলো। কি যেন একটা ছিলো আরাবের কন্ঠে। সে মৃদুস্বরে বলল,
“হু।”
“আবেগ এটা তোর। আবেগ যখন কেটে যাবে তখন আমাকে আর ভালো লাগবে না।”
“কখনো কাটবে না।”
“এতো শিওর।”
“অবশ্যই।”
“আমি কিছু চাইলে দিবি?”
“হ্যাঁ।”
“ভয়ংকর কিছু কিন্তু। ধরে নে তোর জীবন উলোটপালোট হয়ে যাবে।”
অরুমিতা কিছুটা ভয় পায়। কিশোরী মনে খেলে যায় হাজারটা অশুভ চিন্তা। তবুও আরাবের উপর থেকে বিশ্বাসের চাদর সরাতে পারে না। শক্তি সঞ্চয় করে উত্তর দেয়,
“দিব।”
আরাব দৃঢ় কন্ঠস্বরের রমণীর দিকে তাকায়। কি যেন দেখে অরুমিতার চোখে। তারপর আর এক মিনিটও দাঁড়ায় না ছাদে। অরুমিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে দ্রুত নামতে থাকে।
নিচে এসে আরাব দাঁড়ায় বাড়ির কর্তাদের সমানে। ডেকে উঠে,
“বাবা।”
ফখরুল হাসান ছেলের দিকে তাকালেন। তাকালেন বাকিরাও। ছেলের হাতের মুঠোয় থাকা অরুমিতার হাত দেখে অবাক হলেন খুব। অপরদিকে ফয়জাল হাসানের বুক ধক করে উঠলো। আবার কি হলো? কি করেছে তার মেয়ে। আরাবের চোখমুখ শক্ত। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে। কাজিন মহল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সাবায় চুপ। বাড়ির বধূরাও এসে দাঁড়িয়েছে। ফখরুল হাসান আলতো স্বরে বললেন,
“বলো আব্বু।”
আরাব একটু সময় নিলো উত্তর দিতে। গম্ভীর স্বরে বলল,
“আমি অরুকে বিয়ে করতে চাই। এই মুহূর্তে!”
চমকে উঠে সবায়। কি হচ্ছে এসব। অরুমিতা নিজেও বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। ফখরুল হাসান অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি বলছো এসব?”
আরাব চুপ। কোন কথা বলে না। এবার তাদের বড়ো চাচা ফজলুল হাসান বললেন,
“তুমি বিয়ে করতে চাইলেই তো হবে না৷ অরুর কি এখন বিয়ের বয়স হয়েছে? আর ও কি চায়?”
আরাব অরুমিতার দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয়,
“বিয়ে করতে চেয়েছি সংসার নয়। জাস্ট আকদ করে রাখবেন৷ ও যেমন ছিলো তেমন থাকবে। আমি আমার মতো। ও বড়ো হলে সংসারের কথা আসবে। আর অরু কি চায় সেটা ওর থেকেই শুনেনিন।”
ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি চাও তুমি আম্মু। র্নিভয়ে বলো।”
অরুমিতা মাথা নিচু করে ফেললো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলতো স্বরে বলল,
“আমি আরাব ভাইয়াকে ভালোবাসি বাবা।”
আর কিছু বলতে পারলো না অরুমিতা। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো তার। যা বোঝার বুঝে গেলো পুরো পরিবার। ফখরুল হাসান ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফয়জাল? বেয়াই হতে অসুবিধা আছে তোর?”
ফয়জাল হাসান মাথা নেড়ে না জানালো। মুখে বলল,
“মেয়ে খুশি থাকলেই আমি খুশি ভাই।”
অরুমিতার হাত-পা কাঁপছে। এতোকিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তার কল্পনাতেও ছিলো না৷ খুশিতে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ওদিকে অধরা হা করে তাকিয়ে আছে আরাব আর অরুমিতার দিকে। বাকিদেরও সেম অবস্থা। সবার মনে একই প্রশ্ন,
“কি হচ্ছে এসব?”
আরাব আবার দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আকদে্র ব্যবস্থা করেন বাবা।”
ফখরুল হাসান উঠে গেলেন। কল করলেন পরিচিত এক কাজীকে। হুজুর সহ আসতে বললেন বাড়িতে। আরাব আর দাঁড়ালো। না নিজের ঘরে যেতে গিয়ে থেমে গেলো। অধরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“অধু, ওকে একটা শাড়ি পরিয়ে দিবি?”
অধরা খুশিতে কেঁদে দিবে এমন অবস্থা। সে চোখের পানি মুছে বলল,
“অবশ্যই দিব। আজকে তুই তোর বউয়ের দিক থেকে চোখ সরাতে পারবি না। দেখ কেমন সাজাই।”
আরাব মুচকি হেসে উপরে উঠে গেলো। বোনেরা অরুমিতাকে নিয়ে গেলো সাজাতে। আরহাম আর আবির গেলো আরাবের কাছে। নিচে রইলো বাড়ির বড়োরা। তারা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলো কি হচ্ছে বোঝার জন্য। বুঝে আসতেই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়প গেলো। কতো কাজ বাকি যে!
অরুমিতাকে খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পরিয়ে দিলো অধরা। হালকা সাজ আর হালকা কিছু গহনা পরিয়ে দিলো। এতটুকুতেই কি মিষ্টি দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। অধরা অপলক তাকিয়ে রইলো। তুবা এলেন কিছুক্ষণ পর। অরুমিতার কপালে চুমু দিলেন। তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তারপর চলে গেলো।।অধরার মনের মাঝে কেমন করলো।
নিদিষ্ট সময়ে কাজী এসে পৌঁছাল। অরুমিতাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো। বসানো হলো সোফায়। কিছুক্ষণ পর আরাবকেও অরুমিতার পাশে বসালো আরহাম। আরাবের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।
সকল নিয়ম নীতি শেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অরুমিতাকে কবুল বলতে বলা হলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কবুল বলল সে। আরাব দৃঢ় কন্ঠে কোনরূপ জড়তা ছাড়া কবুল বলে দিলো।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে খাবার পরিবেশন করা হলো। তাওসিফ আসা উপলক্ষে অনেক পদের খাবার রান্না হয়েছে আজ। তাওসিফ, আরাব, কাজী সহ বাড়ির কর্তারা খেতে বসলো। আয়েশা ড্রয়িং রুমে খাবার নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিলো অরুমিতাকে। মৃদুস্বরে বলল,
“আমার ছেলের বউ হয়ে গেলি যে। এখন থেকে আর চাচি ডাকবি না।”
অরুমিতা অসহায় কন্ঠে বলল,
“কি ডাকবো তাহলে?”
আয়েশা হেসে বলল,
“মা, আম্মু, মামণি! কতো কিছু ডাকা যায়।”
অরুমিতা মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, তোমাকে মামণি ডাকবো।”
খবার শেষ করতেই আরাব কে ডাকলো অধরা। দু’জন চলে গেলো ছাদে। অধরা আরাবের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাহিনি কি বল।”
আরাব হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
“আমি যেমন হুট করে তোর জন্য ফিল করতাম। সেম ফিলটা অরু আমার জন্য করে। অরুর অনুভূতি খুব জোড়ালো। আমি আবেগ, আবেগ বলে বেশ কয়েকবার দমিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু ওর চোখ যেন স্পষ্ট করে বলে আবেগ নয়, সত্যি তোমাকে চাই। আমি বোকা, অনুভূতি প্রকাশ করিনি। কিন্তু অরু করেছে। আমি চাইনি আমার মতো কষ্ট ওর হোক। তাই নিজের করে নিলাম। তুই বলবি বিয়েই কেন? ওর বয়সটা আবেগের। যদি সত্যি আবেগ হয়? যদি পরে মায়া কেটে যায়? তখন? কি করবো আমি? বিয়ে পবিত্র বন্ধন। আল্লাহ রহমত করবে। আর বাড়ির সবায় যখন জানে, ওর কোন জড়তা থাকবে না। যখন ইচ্ছে আমার কাছে আসবে। মন অন্যদিকে ঘুরবে না ইন শাহ আল্লাহ।”
অধরা মুচকি হেসে বলল,
“ভালোবাসিস?”
“ভালোবাসি কিনা জানি না রে অধু। তবে আমি ওর জন্য কিছু একটা অনুভব করি। নাহয় এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিতাম না। ভালেবাসাটাও খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। দেখিস!”
“কষ্ট দিবি না আমার বোনকে। খবরদার।”
মুচকি হেসে আরাব বলল,
“দিবোনা। প্রমিজ।”
———————
আরাব নিজের ঘরে। টেবিলে বই খুলে রাখা। খাতায় দ্রুত গতিতে কিছু লিখছে সে। গত দুই দিন পড়া হয়নি তার। সারাক্ষণ কিসব চিন্তা করেছে। আজকে সব চিন্তা থেকে মুক্তি হয়েছে তার। মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সে। এরমাঝে তার ঘরের বাইরে শোরগোল শোনা গেলো। সে বুঝলো তার কাজিন মহল তার সদ্য বিবাহিত বউ কে নিয়ে এসেছে। আরাব চোখ তুলে তাকালো দরজার দিকে। অধরা অরুমিতাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“টাটা দোস্ত।”
তারপর সবাই নিচে চলে গেলো। উল্টা পাল্টা মজা করলো না তারা কেউ।
অরুমিতা চুপচাপ বসলো বিছানায়। আরাব খাতায় লেখা শেষ করে তার দিকে তাকালো। চুপ করে তাকিয়ে রইলো। অরুমিতা অস্বস্তিতে এদিক সেদিক তাকালো। তারপর নিজেই বলে উঠলো,
“আমাকে শাড়িতে সুন্দর লাগছে না?”
আরাব মুচকি হেসে বলল,
“হুম।”
অরুমিতা চুপ হয়ে যায়। এরপর কি বলবে? বুঝতে পারে না। আরাব হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে। অরুমিতা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। আরাব টুপ করে চুমু খায় তার কপালে। আবার বসে নিজের জায়গায়। অরুমিতা চোখ বন্ধ করেই বসে রইলো। আরাব হেসে বলল,
“চোখ খোল।”
“তুমি অন্যদিকে তাকাও আগে।”
“সিরিয়াসলি?”
আরাব হেসে উঠে। অরুমিতা অসহায় কন্ঠে বলে,
“তোমার লজ্জা শরম নেই বলে কি আমারও নেই?”
আরাব ঠোঁট কামড়ে হাসে। মৃদুস্বরে বলে,
“ওরে আমার লজ্জাবতী বউরে।”
অরুমিতা শিউরে উঠে। বউ! কি সুন্দর শোনালো। সে এখন থেকে আরাবের বউ! সারাজীবনের জন্য। অরুমিতার কি যে হলো। উঠে এসে বসলো আরাবের কোলে। আরাবের বুকে মুখ লুকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো!
আরাব বুঝে গেলো এই কান্নার মানে। নিষেধ করলো না মোটেও। বরং আরে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো অরুমিতাকে নিজের সাথে।
#চলবে…?