#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৫০
রাত বাড়ছে। চারদিক নীরব। কোলাহল নেই। অরুমিতা কপালের উপর পরে থাকা চুল গুলো কানে গুঁজে দিলো আরাব। আলতো স্বরে বলল,
“ঘুম পায়নি?”
“পেয়েছে।”
“ঘরে গিয়ে ঘুম দে।”
অরুমিতা তড়িৎ নেমে এলো আরাবের কোল থেকে। দ্রুত আরাবের বিছানায় উঠে ছোট বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আমি এখানে ঘুমাবো।”
আরাব হেসে বলল,
“আচ্ছা ঘুমা।”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“উহু। পড়া বাকি আছে। কাল পরীক্ষা।”
আর কথা বাড়ায় না কেউ। আরাব বই খুলে বসে। অরুমিতা বিছানায় শুয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার ব্যক্তিগত পুরুষের দিকে। কিয়ৎকাল পর আরাব বই থেকল মুখ সরিয়ে ঘুরে তাকালো অরুমিতার দিকে। সাথে সাথে চার চোখ এক হলো। আরাব মৃদুস্বরে বলল,
“কি দেখিস?”
“তোমাকে।”
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে পড়বো কি করে?”
“তোমার কাজ পড়া, তুমি পড়বে। আমার কাজ তোমাকে দেখা, আমি দেখবো।”
“ঘুমিয়ে পর।”
অরুমিতা মাথা নাড়ায়। আরাব উঠে আসে। বসে বিছানার একপাশে। অরুমিতার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“চোখ বন্ধ।”
অরুমিতার কি যে শান্তি লাগছে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নেয় সে। তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে।
অরুমিতা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে আরাব। নিভিয়ে দেয় ঘরের বাতি। কাঁথাটা জড়িয়ে দেয় তার বধূর শরীরে। তারপর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তে বসে। অরু ঘুমাক, শান্তিতে। একতরফা ভালোবাসা মানুষকে বড্ড জ্বালায়, ঘুমোতে দেয় না। আজ অরু সব ভুলে ঘুমাক!
——————–
চাঁদের আলো ঠিকরে পরছে যেন। অধরার ঘরের বাতি এখনো নেভেনি। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে রাখছে সে। তাওসিফ সবে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। অধরার দিকে তাকিয়ে সে আনমনে হাসলো। কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,
“ব্যাপার কি? আজ বউয়ের মন এতো ভালো।”
অধরা চোখ তুলে তাকালো তাওসিফের দিকে। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
“তুমি চাচ্ছ মন খারাপ হোক?”
“সেটা কখন বললাম। মন ভালোর কারণ কি বউ?”
“জানো না তুমি?”
“এতটুকুতেই এতো খুশি?”
“এটা এতেটুুকু? তুমি জানো আমি সব সময় চাইতাম আরাব কাউকে ভালোবাসুক নতুন করে। অবশেষে! আমার কি যে খুশি লাগছে!”
তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,
“সেই খুশিতে বরকে একটু চুমু টুমুও তো খেতে পারো।”
অধরা হাসলো। অন্য সময় হয়তো তাওসিফকে অসভ্য বলে সরিয়ে দিতো। আজ তেমন কিছু করলো না। উঠে দাঁড়ালো ঠিক তাওসিফের সামনে। তাওসিফের সম্মোহনী চোখে কিয়ৎকাল তাকিয়ে থেকে নিজের পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো তাওসিফের পুরু ঠোঁটের ভাঁজে!
——————-
চোখে রোদ পরায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো অরুমিতা। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখলো অধরা বসে আছে সামনের চেয়ারে। অরুমিতা চোখ খুলতেই অধরা বলল,
“গুড মার্নিং।”
“গুড মর্নিং আপুই। কয়টা বাজে?”
উঠে বসে বলে অরুমিতা। অধরা মুচকি হেসে বলে,
“দশটা বাজে।”
“কিহহহ! এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি? কেউ ডাকেনি কেন? ওহ গড! আমার স্কুল?”
“তোমার বর বলে গিয়েছে তোমাকে যেন না ডাকা হয়।”
অরুমিতা ভ্রূঁ কুঁচকে ফেললো। বর? তারপর তার মনে পরে গেলো গতকাল রাতের কথা। দ্রুত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। সে তো আরাব ভাইয়ার ঘরে। এবার প্রশ্ন করলো,
“আরাব ভাইয়া কোথায়?”
অধরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
“ভাইয়া? কার ভাইয়া?”
অরুমিতা জিব কাটে। বলে,
“ওইতো হলো আরকি!”
“ভার্সিটিতে গেছে। আজ পরীক্ষা আছে ওর।’
” সারারাত না ঘুমিয়ে কীভাবে পরীক্ষা দিবে?”
অধরা অবাক হয়ে বলল,
“ঘুমায়নি?”
“না পড়েছে। আমাকে ঘুমাতে বলে পড়তে বসেছিলো। শেষরাতের দিকে জাগনা পেয়েছিলাম তখনও দেখালাম পড়ছে।”
“ভার্সিটিতে উঠলে এই অবস্থায় হয়! সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগের দিন সব পড়তে বসে। চিন্তা করো না। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আপুই নাস্তা দিচ্ছি তোমাকে।”
“ওকে।”
—————
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরই চলে যাবে অধরা। বাড়ির সকলের মন খারাপ। নবনী আনজুমের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে অধরা। প্রিয় নাতনির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আলতো স্বরে বললেন,
“আজকেই চলে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“আবার কবে আসবে?”
“খুব তাড়াতাড়ি।”
নবনী আনজুম চুপ থাকলেন। আর কি বলবেন ভেবে পেলো না। এরমাঝে অণিতা ডাকলো। অধরা দাদুনির সাথে আরো কিছু সময় কাটিয়ে চলে গেলো।
অরুমিতা অরোরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। তার মন খারাপ। আপুই কেন চলে যাবে এতো তাড়াতাড়ি। অরোরা সেনাও চলে যাবে। ছোট হাত-পা গুলো নিয়ে আর খেলা হবে না ভাবলেই তো দম আটকে আসছে। অধরা গিয়ে বসলো তার পাশে। অরুমিতা বলল,
“আর কয়েকটাদিন থাকো আপুই।”
অধরা মুচকি হেসে বলল,
“নিজের সংসার রেখে কতোদিন বাইরে থাকবো আর।”
অরুমিতা মুখ গোমড়া করে বলল,
“ইশ! বাবার বাড়ি বুঝি বাইরে হলো? আমি শশুর বাড়িই যাব না। হু!”
সবাই হেসে উঠলো তার কথা শুনে। আঁখি মুখ গোমড়া করে বলল,
“তুই তো শশুড় বাড়িতেই আছিস বাপ!”
অরুমিতা কিছু বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেলো। লজ্জাও পেলো। ইশ! তার তে মনেই ছিলো না সে বাড়ির মেয়ে আবার বউও! অহি বলল,
“বড়ো বোনদের আগে বিয়ে করে কাজটা ঠিক করলি না অরু!”
আঁখি হতাশ কন্ঠে বলল,
“আমাদের কেউ দেখতে পায় না রে। আমাদের যে বিয়ের বয়স হচ্ছে সেটা যেন কারো চোখেই পরে না।”
আঁখি আর অহি দুঃখে কাতর হয়ে গেলো। এমন হাসি, আড্ডা আনন্দে দুপুর হতে চললো প্রায়।
——————–
পরীক্ষা শেষ করে বের হলো আরাব। স্মরণ চত্বরের পাশেই তার বন্ধুরা বসে আছে। আরাব ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তূর্য। আরাব তার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। কাব্য আরাবকে দেখেই বলে উঠলো,
“কি রে মামা! কালকে আসলি না ক্যান?”
“কাজ ছিলো।”
আরাবের সরল উত্তর। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এলো একটা মেয়ে। তানিয়া। এসে দাঁড়ালো একদম আরাবের পাশে। আরাব বিনাবাক্য সেখান থেকে সরে এসে আকাশের পাশে বসলো। তানিয়া কিছুটা রেগে বলল,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড আরাব! আর কতোদিন? কেন একসেপ্ট করছিস না প্রপোজ? অধরার জন্য? তুই কি এখনো আশা করিস ও তোর হবে? বিয়ে করে ফেলেছে ও, বাচ্চাও হয়েছে! যে মেয়েটা কোনদিন তোকে বোঝেনি তার জন্য তুই নিজের জীবন আটকে রাখবি? সমস্যা কি তোর আরাব!”
আরাব স্থির চোখে তাকালো তানিয়ার দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বা ভালোবাসার মানুষ হওয়ার আগে বোন হয় ও আমার। সো অধরাকে নিয়ে কিছু বলার আগে হাজারবার ভাববি। আজকে বলছিস শেষ! নেক্সট কখনো বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
তানিয়া কিছুটা নয়ম স্বরে বলল,
“তুই নিজেকে ঠিক কর। আর কতোদিন এভাবে। তুই এমন মন মরা হয়ে থাকলে তো অধরাকে দোষ দিতে ইচ্ছে হয়।”
“আমার মন একদম ভালো আছে। পুরা ফুরফুরা। আমাকে নিয়ে তোর এতো না ভাবলেও চলবে। যার ভাবার সে ভাবলেই হবে।”
কাব্য অবাক হয়ে বলল,
“যার ভাবার মানে? কে সে দোস্ত!”
পকেট থেকে ফোন বের করে শান্ত স্বরে আরাব বলল,
“আমার বউ।”
বন্ধুরা ভাবলে আরাব মজা করছে। তাই আকাশ মজা করে বলল,
“বউ টা কোন দেশে আছে মামা? পৃথিবীতে আছে তো? নাকি এখমো ল্যান্ড করে নাই।”
আরাব এক পলক তাকালো ওর দিকে। তারপর হেসে বলল,
“আমার বাড়িতেই আছে দোস্ত। বিয়ে করে ফেলেছি।”
আরাব কখনো বিয়ে প্রেম নিয়ে মজা করে না। এমন ছেলে ও নয়। তাই হুট করে ওর মুখ থেকে এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো সবায়। তূর্য বিস্ময়ে বলে উঠলো,
“সিরিয়াসলি? কবে? ভাবি কে? পরিচয় করায় দিলি না! ডিরেক্ট বিয়ে?”
আরাব আলতো হেসে বলল,
“ইয়েশ, সিরিয়াসলি। গতকাল রাতে বিয়ে করেছি। কোন প্লান ছাড়া। আমার বউ অরুমিতা আরমিন, অধরা আসফিনের ছোট বোন। আমার বাড়িতে তোরা সাবাই গেছিস। সো ভাবিকে আলাদা করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছু নাই।”
পাঁচ জোড়া চোখ হতভম্ব হয়ে দেখছে আরাবকে। কতো সহজে কথা গুলো বলে ফেললো ছেলেটা। অথচ ওর বন্ধুরা বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। তানিয়া এতক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকলেও এবার বলল,
“মজা করছিস কেন আরাব? অরু অনেক ছোট!”
আরাব উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“জানি ছোট। বাট মজা করছি না। এটা মজা করার মতো কোন ব্যাপার না। বিশ্বাস না হলে বাড়ি চলে আসিস।”
তারপর সবার উদ্দেশ্য বলল,
“থাক তোরা। আমি যাই।”
কাব্য বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি যাবি?”
আরাব হাসতে হাসতে বলল,
“বাড়িতে বউ আছে মামা। বাচ্চা বউ আমার। সামলাতে হবে যে।”
আরাব চলে গেলো। তানিয়া এখনো বিশ্বাস করছে না। ও কাব্য কে বলল,
“আমি ওদের বাড়িতে যাব! এগুলো কি ধরনের মজা।”
আকাশ, আরাবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সে বলল,
“দেখ তানিয়া। আরাব মজা করার মতো ছেলে না তাও বিয়ে নিয়ে। যা সত্যি তাই বলেছে ও। মেনে নে না।”
——————
আরাব বাড়ি ফিরে দেখলো তার টেবিল থেকে শুরু করে পুরো ঘর গোছানো। পুরো ঘরের দিকে একবার নজর বুলালে সে। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো তার বধূর ঘরের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
“অরু।”
অরুমিতা অরোরাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো। আরাবের ডাক শুনে প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠলো তার। মৃদু স্বরে বলল,
“ভিতরে আসো।”
আরাব ভিতরে আসলে। অরোরাকে কোলে নিয়ে বলল,
“তুই আমার ঘর গুছিয়েছিস?”
“তোমার ঘর?”
অরুমিতা প্রশ্ন করে। আরাব ঠোঁট কামড়ে হাসে। অরোরাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে অরুমিতার চোখের দিকে তাকায়। কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
“তোর আর আমার ঘর।”
অরুমিতা মুচকি হেসে বলে,
“অতো কিছু আমি খেয়াল করতে পারি না। আপাই আজ শিখিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ আপাই করেছে। কিছুকিছু আমি। তবে এরপর থেকে আমিই পারবো।”
আরাব মেয়েটার উচ্ছাস, আবেগ দেখে। এক হাত বাড়িয়ে গাল টেনে বলল,
“লাগবে না কাজ শেখা। পড়াশোনা কর ঠিক করে। পরে এমনি পারবি সব।”
“বরের কাজ করতে অন্যরকম আনন্দ হয়। ও তুমি বুঝবে না।”
ফট করে বলে ফেলে অরুমিতা। আরাব তাকায়। বলে,
“আবার বল।”
অরুমিতা মুখ লুকায়। আরাব এগিয়ে এসে বসে ওর পাশে। বলে,
“আমি কে হই তোর?”
অরুমিতা চুপ। আরাব বলে,
“বল।”
অরুমিতা উঠে দাঁড়ায়। ঢোক গিলে বলে,
“বর হও তুমি আমার।”
বলেই দৌঁড়ে বের হয়ে যায় ঘরে থেকে। আরাব মুচকি হাসে। কোলে থাকা অরোরার গালে চুমু দিয়ে বলে,
“দেখেছো মামা, তোমার খালামণি কি দুষ্ট!”
#চলবে…?