#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৫১(অন্তিম পর্ব)
অধরা আজ নবকুঞ্জ থেকে চলে যাবে। দুপুরের পর বের হওয়ার কথা। সেই হিসেবে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। তুবার মন কিছুটা খারাপ। কথা না হোক, কয়েকদিন মেয়েটা অন্তত চোখের সামনে ছিলো। অরুমিতা পারছে না কান্না করতে। দুপুরের খাবার টেবিলে হরেক পদের খাবার পরিবেশন করা হলো। খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো তারা। তাওসিফ জানালো সাড়ে তিনটার দিকে বের হবে।
অবশেষে যাওয়ার সময় হলো। নবকুঞ্জের প্রায় সকলে বেরিয়ে এলো। অরুমিতার কোলে অরোরা। অধরা ও তাওসিফ সবার থেকে বিদায় নিলো। অরোরাকে কোলে নিতে যেতেই অরুমিতা বলল,
“আবার কবে আসবে আপাই?”
“আসবো। তুই আসিস ও বাড়িতে।”
অরুমিতা ঘাড় কাত করে সায় জানালো। অধরা অরোরাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
——————-
তরুলতায় আজ খুশির ধুম। প্রায় এক সপ্তাহ পরে যেন প্রাণ ফিরে পেলো বাড়িটা। তরু-লতার অলস সময় আজ নেই। তারা ব্যস্ত কাজে। তাদের ছোট সোনা যে বাড়ি ফিরবে আজ। তাইফা রান্নাঘরে ব্যস্ত। ছেলের বউকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। আজও তার রান্না বাহারি আয়োজন দেখলে মনে হবে না ছেলের বউ বাপের বাড়ি থেকে নাইওর করে ফিরছে বরং মনে হবে মেয়ে শশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসছে। তাওসিফের ফুফুও এসেছেন আজ। ভাইপোর মেয়েকে দেখতে। রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে তারা।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই তাইফা সব কাজ ফেলে ছুটলেন সেদিকে। তরু-লতা তার আগে ছুটে বেরিয়েছে। গাড়ি থেকে অধরা বের হওয়ার আগে অরোরাকে কোলে তুলে নিয়েছে তরু। লতা অনবরত বলে যাচ্ছে, “আমাকে দে একটু।” কিন্তু তরু সে কথা শুনছে না। তাইফা বের হয়ে আসতেই অধরা তার কাছে গেলো। অধরাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করলেন তিনি। তারপর তরুর থেকে অরোরাকে নিলেন। ওই বাড়ির সকল খবরা-খবর নিতে নিতে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো তারা।
—————–
তুবা ভেবেছিলো অন্তত চলে যাওয়ার আগে মেয়েটা তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু নাহ! নিজের মেয়ের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে না জানি আরো কতো অপেক্ষা করতে হবে তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। মনটা অল্পস্বল্প নয় খুব বেশিই খারাপ। অধরা কথা বললে তিনি হুটহাট ফোন দিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু মেয়ে যেখানে তার সাথে কথায় বলে না, সেখানে কি করে সে ফোন দিবে? একরাশ মন খারাপ নিয়ে তিনি অধরার ঘরের দিকে গেলেন। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে বলে।
বিছানা ঝাড়ু দিতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখ গেলো টেবিলের উপর একটা কাগজের দিকে। তুবা এগিয়ে গেলো। একটা চিরকুট। তিনি হাতে নিয়ে পড়লেন,
“ক্ষমা মহৎ গুণ৷ কিন্তু ক্ষমা করা খুব কঠিন। আমি যদি আপনাকে এখন বলতাম, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তাহলে সেটা মিথ্যা হতো। কয়েক বছরের জমানো অভিযোগ, অভিমান এতো সহজে কমার নয়। তবে আমি চাই খুব দ্রুত সেই অভিমান কমে যাক। সেদিন আমি আপনার কাছে ফিরবো। আপনার কোলে মাথা রেখে আপনাকে ডাকবো!”
তুবার বারবার পড়লো। তবুও মন ভরলো না। এক সময় হু হু করে কেঁদে দিলো। তবুও শান্তি। তুবা বিরবির করে বলল,
“আমি অপেক্ষা করবো সোনা। খিব শীঘ্রই তোমার সব অভিমান কমে যাক। অন্তত ম*রার আগে তোমার মুখে একবার আম্মু ডাকটা শুনতে পাই!”
——————–
রাতের শেষ প্রহর। অধরার ঘুমটা ভেঙে গেলো আচমকা। নিজের আগের জীবনের ভয়াবহ সব স্মৃতি ভেসে উঠছে স্বপ্নের পাতায়। একপাশ ওপাশ করলো সে অনেকক্ষণ। কিন্তু দুই চোখের পাতায় আর ঘুম নামলো না। ঘুমেরা যেন ছুটি নিয়েছে। সূর্য উঠার কিছুক্ষণ আগে নিজে বিছানা থেকে উঠলো অধরা। তারপর ধীরে ধীরে তাওসিফকে ডাকলো। তাওসিফ চোখে মেলো তাকালো। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ থাকতে ইশারা করলো অধরা। মেয়েকে রেখো খুব ধীরে দুইজন বিছানা থেকে নামলো। তারপর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। অধরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ থাকে তাওসিফ। যেন নীরবতার মাঝেই কথা চলছে তাদের। আরো কিছুক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর পূব আকাশে দেখা গেলো সূর্য্যি মামাকে। অধরা দু’চোখ মেলে দেখে আঁধার কেটে আলো ফুটে উঠার দৃশ্য। মনে মনে সে ভাবে তার জীবনেও এমন আঁধার ছিলো। ঘোর কালো অন্ধকার! সেই অন্ধকারে আলো হয়ে এসেছিলো তাওসিফ। অধরা এবার তাওসিফের দিকে তাকালো। সাথে সাথে চোখাচোখি হলো তাদের। তাওসিফ অধরাকেই দেখছিলো। অধরা এগিয়ে আসে। দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে তাওসিফের গলা। তাওসিফ কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে নেয়। অধরা হাসে। তাওসিফের নাকে নাক ঘষে বলে,
“আমার অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে এসেছিলে তুমি। হয়েছিলে মন ভালো করার গল্প, আমার ঠোঁটের হাসি। আমার আঁধার আকাশে সূর্য হয়ে আসাট জন্য ভালোবাসি। তুমি আমার দ্যুলোকে নব ঊষা!”
তাওসিফ মুচকি হেসে টুপ করে চুমু খায় অধরার ঠোঁটে। অধরা হাসে। তাওসিফ ফিসফিস করে বলে,
“আমার প্রেমহীন জীবনে ভয়ংকর প্রেম হিসেবে ধরা দেওয়ার জন্য তোমাকেও ভালোবাসি।”
অধরা ঠোঁট ছোঁয়ায় তাওসিফের কপালে। এরমাঝে কেঁদে উঠে অরোরা। দুইজন একসাথে ছুটে যায় মেয়ের কাছে। অধরা কোলে তুলে নেয় মেয়েকে। কিছুক্ষণের মাঝেই শান্ত হয়ে যায় অরোরা। তাওসিফ ফিসফিস করে বলে,
“দেখেছো মেয়ের কি জেলাস? তার মায়ের সাথে একটু প্রেমও করতে দেয় না।”
অধরা ফিক করে হেসে ফেলে তাওসিফের কথায়।
——————
অরুমিতার ছোট জীবনটা আনন্দের সহিত চলছে। জীবনে না পাওয়ার হিসেব তার নেই। একটা বিশাল পরিবারে আদরে আদরে বড়ো হয়েছে সে। বয়ঃসন্ধির সময় বুঝলো তার মনে বাড়ির এক জনের জন্য কি অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সে এটাও জানতো যার জন্য তার মন কেমন করে তার মনে নিজের বড়ো বোনের বাস! সে জানতো কোনকালে আরাবকে পাওয়া হবে না তার। তবুও এই অনুভূতি থেকে মুক্তি মিলেনি তার। তবে নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হয় অরুমিতা। যাকে পাবেনা জানতো সেই তারই বউ হয়ে গেছে কোন যুদ্ধ ছাড়া। এতো সহজে পেয়ে যাবে কখনো চিন্তাও করেনি সে। অরুমিতা মৃদু হাসে। এরমধ্যে শোনা যায় চেনা স্বর,
“অরু, ঘরে আয়।”
নিজের ঘর থেকে ছুটে বের হয় অরুমিতা। তবে থেমে যেতে হয়। আঁখি তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করার মতো করে বলে,
“হে খোদা! আমারে কি চোখে পড়ে না। এইটুকু বাচ্চা বরের ডাকে ছুটে যাচ্ছে আর আমার কিনা বরই নাই!”
অরুমিতা হেসে বলে,
“বর খুঁজে নাও আপা।”
ঘরের সামনে গিয়ে ফের দাঁড়িয়ে যায় অরুমিতা। আরাব কিছু একটা খুঁজছে। পিছনে না তাকিয়েই সে বলে,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভিতরে আয়।”
অরুমিতা ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে। আরাব তাকায়। আলতো স্বরে বলে,
“ঘরটা তোর। সব সময় অনুমতি নিয়ে আসতে হবে না। কতোবার বলবো।”
অরুমিতা চুপ করে তাকিয়ে থাকে আরাবের দিকে। তারপর বলে,
“কি খুঁজছো? আমাকে বলো।”
“সাদা শার্টটা পাচ্ছি না।”
ঠোঁট উল্টিয়ে বলে আরাব। অধরা আরাবকে পাশ কাটিয়ে আলমারির সামনে যায়। নিমেষেই খুঁজে বের করে। তারপর আরাবের হাতে দেয়। আরব অবাক হয়ে পেলে,
“এতে তাড়াতাড়ি কিভাবে পেলি?”
অধরা অগোছালো আলমারিটা ফের গুছিয়ে নেয়। কিছু বলে না। আরাব শার্টটা চেয়ারের সাথে রেখে অরুমিতার কাছে আসে। তারপর হুট করে জড়িয়ে ধরে। অরুমিতা শিউরে উঠে। দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। কিছুক্ষণ নিজের বুকে অরুমিতাকে চেপে রেখে আরাব ফিসফিস করে বলে,
“আমার উদাস সময়ের চিন্তার কারণ তুই। হুট করে এসে জীবনের মানে পাল্টে দেওয়া মানুষ তুই। আর কখনো কাউকে ভালোবাসবো না করেও তোকে এতো ভালোবাসলাম কি করে বলতো? জাদু জানিস তুই?”
অরুমিতার ছোট শরীরটা কেঁপে উঠলো। চোখ ফেটে গড়িয়ে পরলো জল। ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। অরুমিতা আরো শক্ত করে জাপটে ধরে আরাবকে। আরাব হাসে ঠোঁট ছোঁয়ায় প্রেয়সীর মাথায়৷ ফের বলে,
“ভালোবাসি।”
অরুমিতা কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দেয়,
“আমিও ভালোবাসি। অনেক বেশি।”
(সমাপ্ত)