#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৯_১০
নিচতলা থেকে দোতালা। সিড়ি বেশি নয়। তবুও তানিশার মনে হয় অনেক গুলো সিড়ি। বিরক্ত হয় সে। শেষ হচ্ছে না কেন? বুক ভার হয়ে আসে। অস্থির লাগে। এই বুঝি দেখবে বাচ্চাটার খুব অসুখ। খুব কষ্ট হচ্ছে? বোকা তানিশা! যার হৃদয়ে অসুখ বেধেছে তার কি শারীরিক কষ্ট হয়? তানিশা ছুটে ঘরে ঢোকে। অনুমতি নেওয়ার বালাই নেই তার। এই ঘরে ঢুকতে তার অনুমতি লাগে না। ঘরে ঢুকতেই বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠলো তানিশার। ঘরে অধরা নেই। তানিশা ধীর কন্ঠে ডাকলো,
“আসফি, আসফি। কোথায় তুই?”
কোন সাড়া নেই। ঘর জুড়ে অসহনীয় নীরবতা। তানিশার বুক কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ফের ডাকলো,
“আসফিন, এই আসফি।”
এবারও সাড়া নেই। তানিশার গলা কেঁপে উঠলো। ভাঙা গলায় ডাকলো এবার,
“বাবুন, কই তুই?”
এক ধ্যানে বারান্দায় বসে থাকা অধরার কানে বাবুন শব্দটা অস্পষ্ট ভাবে পৌছালো। অধরা নড়েচড়ে বসলো। ভাবলো মনের ভুল। কিন্তু তখনই শোনা গেলো তানিশার স্বর,
“চাচা, আসফিন কোথায়?”
“ঘরেয় তো ছিলো, আসফিন!”
অধরা বুঝে গেলো তার আপা এসেছে। আপা! অধরার বুকে শীতল বাতাস বয়ে গেলো। বারান্দা থেকে ছুটে এলো সে। সাপটে ধরলো তার আপা কে। বুক ডোবালো বোনের উষ্ণ বুকে। তানিশা বোনের মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে লাগলো। আপার স্নেহ পেয়ে কান্নারা বাঁধ ভেঙে গেলো। হু হু করে কেঁদে ফেললো অধরা। ফয়জাল হাসান হাতের প্লেটটি টেবিলে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
তানিশা আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“বাবুন, কাঁদে না। কি হয়েছে সোনা। এভাবে কেউ কাঁদে। কাঁদে না বাবুন। আপা আছি তো।”
অধরার কান্নার গতি কমে। আপা আছে তো কথাটা কি সুন্দর। কানে বাজে তার। কথাটা কি তুবার বলা উচিত ছিলো না? সে যদি একবার বলতো,”আসফিন কাঁদে না, মা আছে তো”, তবে কি অধরার নিজেকে এতোটা অসহায় মনে হতো? কখনো না। কিন্তু তার মা সেটা কখনো বলেনি, না আজ আর না কাল। অধরা আস্তে আস্তে চুপ হয়ে যায়। তানিশা ওকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়। দু’হাতে মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে বাবুন? আপা কে বল।”
অধরার ফের কান্না পায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকায়। তানিশা অপেক্ষা করে। সময় দেয়। অধরা শান্ত হয়ে গেলে একে একে সব বলে। তানিশা শোনে, বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে যায়। একেকজন মানুষের ব্যবহার শুনে ওর মনে হয় ও নবকুঞ্জে নয় অন্য কোথাও চলে এসেছে। এমন শান্তিময় বাড়ির মানুষদের এ কি রূপ? ভালো মানুষের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো এমন ভয়ংকর চেহারা? তানিশা বুঝতে পারে না, বুঝে উঠতে পারে না। শুধু জানে তার বাবুন নিষ্পাপ।
——————-
সদর দরজার পর সরু রাস্তাটি গিয়ে ঠেকেছে বাড়ির সম্মুখে। রাস্তা দুই ধারে বাগান। খালি জায়গাও আছে। বাচ্চারা খেলা করে। ফয়জাল হাসান রাস্তার এককোণে দাঁড়িয়ে কল করলেন নবনী আনজুমের নাম্বারে। তখন দুপুর হবে হবে ভাব। নবনী আনজুম তার বোনের সাথে গল্প করছিলেন। ছেলের ফোন পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সরে এলেন দূরে। কল রিসিভ করে সবে তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করবেন ভালো-মন্দ খবর তার আগে ছেলে অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো,
“আম্মা, কবে বাড়ি আসবে?”
নবনী আনজুম অবাক হলেন যতটা তার চেয়েও বেশি চিন্তায় পড়লেন। ছোট ছেলে তার, আদরের অনেক। তিনি আলতো স্বরে বললেন,
“কি হয়েছে আব্বা?”
“কিছু হয় নাই আম্মা।”
ভাঙা গলায় বললেন ফয়জাল হাসান। নবনী আনজুম বুঝে গেলেন গুরুতর কিছু হয়েছে। তার ছেলে এতো সহজে ভেঙে পড়ে না। এমন অস্থির হয় না। তিনি ছেলেকে আর জোর করলেন না। মৃদুস্বরে বললেন,
“আমি আসছি আব্বা। তুমি কি বাড়িতে?”
ফয়জাল হাসান মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,
“হু।”
নবনী আনজুম কথা বাড়ালেন না। কল কাটলেন। তড়িঘড়ি ব্যাগ গোছাতে লেগে পড়লেন। ও বাড়ির সবাই মন খারাপ করলো এভাবে চলে আসবেন শুনে। নবনী আনজুম পাত্তা দিলেন না। তার এখন বাড়ি ফিরতে হবে। মনে যে কু ডাকছে তার!
মেয়ের কান্না দেখে ভেঙে পড়েছেন ফয়জাল হাসান৷ কান্নার সুর যেন তার কানে ভাসছে। মেয়েটা এভাবে কাঁদলে তার বুক কাঁপে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাইতো মা’কে কল দেওয়া।
——————-
ভরদুপুরে বাড়ি ফিরলেন নবনী আনজুম। বাড়ির গৃহিণীরা তখন যে যার ঘরে থাকে। তাই শাশুড়ির আগমনের সংবাদ জানলো না কেউ। নবনী আনজুম বুদ্ধিমান। তিনি কোনরূপ শব্দ না করে চলে গেলেন অধরার ঘরে। তিনি তার ছেলেকে চেনেন। তার ছেলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার নাম “অধরা আসফিন”। ছেলের কন্ঠের অস্থিরতা, অসহায়ত্ব কাকে কেন্দ্র করে তিনি বুঝে গিয়েছেন। তাই দেরি না করে ছুটে গেলেন তার প্রিয় নাতনির রুমে। ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন তানিশার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে অধরা। তিনি ধীর পায়ে হেঁটে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। তানিশা তাকে দেখে চমকে গেলো৷ নবনী আনজুম চমকালেন না। তিনি গোপনে হাসলেন। তিনি জানতেন আসফিনের কিছু হলে কেউ না আসুক এই মেয়েটা আসবে। সে তো শুধু আসফিনের বোন নয় বরং আরো বেশি কিছু। তিনি ধীর কন্ঠে শুধালেন,
” কখন এসেছো?”
“এগারোটার দিকে দাদুনি। তুমি কখন এলে?”
“মাত্রই।”
বলে তিনি হাত বাড়িয়ে অধরার কপাল৷ ছুঁয়ে দেখলেন। জ্বর নেই। তবে জ্বর আসবে। তিনি ভ্রূ কুঁচকালেন। তানিশার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“আসফিন কেঁদেছে? কেন?”
কথাটা বলতেই তার চোখ গেলো আসফিনের গালে। কালচে হয়ে আছে। পাঁচ আঙুলের ছাপ এখনে স্পষ্ট। নবীন আনজুমের চোখ দুটো লাল হয়ে গেলো। তিনি এবার কিছুটা চেচিয়ে বললেন,
“আসফিনের গালে দাগ কেন? কে মেরেছে? উত্তর দাও তানিশা। চুপ করে থাকবে না।”
তানিশা দিরাজ স্বর শুনে কিছটা কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে ফেললো সে। কি বলবে? কোথা থেকে শুরু করবে? কিছু মাথায় আসছে না। আর সব শোনার পর দাদুনি কি রিয়েক্ট করবে কে জানে! নবনী আনজুম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরোখ করলেন তানিশাকে। বুঝলেন যা হয়েছে তা বলতে ভয় পাচ্ছে তানিশা। তিনি কন্ঠে নমনীয়তা এনে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে তানিশা। শুরু থেকে শেষ সব বলো আমাকে।”
তানিশা এবার আর চুপ থাকতে পারলো না। দাদুনিকে বলে দেওয়াটায় উচিত মনে করলো সে। তাই কিছুটা দ্বিধা নিয়ে হলেও আগা থেকে গোড়া সব বর্ণনা করলো। সব শুনে নবনী আনজুমের চেহারা শক্ত হয়ে এলো। তানিশা বুঝতে চেষ্টা করলো দাদুনির মনে কি চলছে কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। দাদুনি ঐ প্রসঙ্গে কোন কথা বললেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন,
“ফয়জাল কোথায়?”
“ছাদে বোধহয় দাদুনি।”
নবনী আনজুম আর কিছু বললেন না। না ঘর থেকে বের হলেন। বসে রইলেন সেখানেয়। কিছুক্ষণ পর পর সস্নেহে হাত রাখলেন নাতনির গায়ে।
——————
বিকাল হতেই নিচ থেকে শোনা গেলো ধীর কন্ঠে কথা বলার আওয়াজ। গৃহিণীদের রান্না শুরুর প্রস্তুতি পর্ব। অন্যান্য দিন নবকুঞ্জে হৈ হুল্লোড় হয়। তবে আজ শান্ত সব। ছোট থেকে শুরু করে সবাই কালকের ঘটনার সাক্ষী। কেউ কিছু বুঝুক আর না বুঝুক অধরাকে মারতে তারা দেখেছে, শুনেছে ছোট চাচার ভয়ংকর আওয়াজ। আজ তাই হৈচৈ করার সাহস হচ্ছে না তাদের।
নবনী আনজুম ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে নামছেন। পড়নে তার ঘিয়া রঙের শাড়ি। চলনে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। সিড়ির শেষ অংশ থেকে রান্নাঘর স্পষ্ট দেখা যায়। প্রথমে চোখ পড়লো মায়মুনার। শাশুড়িকে উপর থেকে নামতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন তিনি। বুঝতে পারলেন তার ছক কষায় ভুল আছে নয়তো ভুল হয়ে গেছে। ছোট দেবরকেই টলাতে পারেননি তিনি এখন আবার শাশুড়ি! মায়মুনাকে একদৃষ্টিতে সিড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একে একে বাকিরাও তাকালো সেদিকে। তহুরা থতমত খেয়ে গেলেন। তুবা শুকনো ঢোক গিললো। আয়েশা র্নিলিপ্ত। ফৌজিয়া ছুটে বের হলো,
“আম্মা, কখন এলে।”
“দুপুরে।”
শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন তিনি। অতঃপর ছেলের বউদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি হলো? তাকিয়ে আছো কেন?”
তার আভিজাত্যে ভরপুর দিরাজ কন্ঠস্বর শুনে হুস ফিরলো তাদের। দ্রুত যে যার কাজে মন দিলো। নবনী আনজুম চেয়ার টেনে বসলেন। এখনো তিনি কিছু বলছেন না। ফৌজিয়া মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে, অনেক কিছু বলার আছে তার। নবনী আনজুম মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ আলতে ভাবে মাথা নাড়লেন। ফৌজিয়া কি বুঝলো কে জানে, খুশিমনে রসুইঘরে ফিরে গেলো সে।
————————-
অধরা থামে। এলোমেলো দৃষ্টি মেলে তাকায়। তাওসিফ অধরার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো তাওসিফ। মুখে বলল,
“একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি।”
তাওসিফ চলে গেলো। অধরা দম নিলো। তার জীবনের পুরো গল্পটা সে প্রথমবার কাউকে সবিস্তারে বর্ণনা করছে। আগে কখনো কাউকে এতোটা বলেনি, আসলে বলার প্রয়োজন হয়নি। অণিতা, আঁখি, অহি, তোষা কারো বিয়ে হয়নি এখনো। খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসতো বড় মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়েটাকে কেন? বিয়ের কথাবার্তা থেমে যেত ওখানেই। বাঙালি মন! ধরেই নিতো মেয়ের দোষ আছে কিছু, নাহয় বড়দের রেখে কেউ ছোটকে বিয়ে দেয়? তবে বেশ কিছু পরিবার এগিয়ে গিয়েছিলো। ও বাড়িতে অধরার অবস্থাটা শোনার পরই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। অধরাকে এতোবড় গল্পটা বলতে হয়নি কাউকে। কিন্তু এই ছেলেটাকে সে বলছে। বলতে হচ্ছে। আগের বিয়ে গুলো যেটুকুতে ভেঙেছে এটা ভাঙেনি। তাওসিফ আবরার নামের ছেলেটা তার গতদিনের কথা গুলোয় কোন পাত্তায় দেয়নি। তাই তো তাকে সম্পূর্ণ সত্যিটা বলতে হচ্ছে। পুরো গল্প শোনা শেষ হলে ছেলেটার রিয়াকশন কি হবে কে জানে?
তাওসিফ ফিরে এলো কিছু সময়ের মাঝেই। হাতে তার একটি পানির বোতল। বেঞ্চে বসে অধরার দিকে এগিয়ে দিলো বোতলটা। অধরা অবাক হলো। পানি আনতে গিয়েছিলো ছেলেটা। তার জন্য? অধরা হাত বাড়িয়ে পানিটা নিলো। ছিপি খুলে কিছুটা পানি পান করলো। আবার ছিপি লাগিয়ে আলতো স্বরে বলল,
“ধন্যবাদ।”
তাওসিফ মুচকি হাসলো। ধন্যবাদের বিপরীতে কিছু বললো না। বরং মৃদুস্বরে বলল,
“তারপর কি হলো বলো।”
অধরা দৈবাৎ তাওসিফের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নেয়। গলাটা আবার শুকিয়ে আসে তার। এতক্ষণ সে যতটুকু বলেছে সেটা নিয়ে তার যতটা দুঃখ, পরের গল্পটা তার থেকে হাজার গুণ বেশি কষ্টের। পরের গল্পটুকু অধরাকে থমকে দিয়েছিলো, স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। এখনো সেদিনের কথা ভাবলে অধরার হৃৎপিণ্ডটা অসহনীয় গতিতে ছুটতে থাকে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো অধরার। তাওসিফ বুঝলো পরের অংশটুকু আরো বেশি কষ্টের। সে কিছু বললো না। অধরাকে শান্ত হওয়ার সময় দিলো। নিজেও ভাবতে চেষ্টা করলো কি এমন হয়েছিলো যে অধরার বলতে এতো কষ্ট হচ্ছে। নবনী আনজুম কি বাকি সবার মতো ভুল বুঝেছিলো তাকে? অধরা আরো একবার গলা ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করলো,
সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরলো নবনী আনজুমের বড় তিন ছেলে। মা’কে বাড়িতে দেখে অবাক হলো তারা। কিছুটা বিচলিত বোধ করলো ফারুক হাসান। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। মায়মুনা চোখের ইশারায় বুঝালো সে কিছু জানে না, কেন হঠাৎ কিছু না জানিয়ে ফিরে এলেন নবনী আনজুম। নবনী আনজুম দ্রুত ফ্রেস হয়ে নিচে নামতে বললেন তাদের।যে যার ঘরে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার নেমে এলো। নবনী আনজুম সোফায় বসে আছেন। তিনি দিরাজ স্বরে চার ছেলেকে আদেশ দিলেন তার সামনের সোফায় বসতে। চারজন কোনরূপ দ্বিরুক্তি ছাড়া বসে পড়লো।
চার বধূ এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফৌজিয়া নীরবে নিয়ে ঘরে। বাইরে আসেনি। অরুমিতা আর নিহাকেও নিয়ে গেছে। বাকি বাচ্চারা নিচেই ছিলো। নবনী আনজুম আঁখিকে বললো তানিশাকে আর অধরাকে নিচে নিয়ে আসতে। আঁখি ছুটে গেলো। কিছুক্ষণ পর তানিশা অধরাকে নিয়ে নামলো। নবনী আনজুমের সোফার ডানপাশে দাঁড়ালো তারা। আবির আর অহি দাঁড়িয়ে আছে বাম পাশে। অণিতা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। সামনে এগিয়ে আসছে না সে। আঁখি দাঁড়ালো তানিশার পাশে। আরাব আর তোষা দাঁড়িয়ে আছে কাছেয়। নবনী আনজুম তার চার ছেলের দিকে আঙুল তুলে বললেন,
“তোমরা চারজন আমার ছেলে?”
বিস্ফোরিত নয়নে মায়ের দিকে তাকালো তারা। এটা কেমন প্রশ্ন। ভরকে গেলো রুমের সবায়। নবনী আনজুম এবার অধরার দিকে ফিরলেন। বললেন,
“ওর গালে কালচে দাগ দেখতে পাচ্ছো তোমরা?”
ফয়জাল হাসান মেয়ের গালের ওই দাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। বাকি তিনজন অবাক হয়ে তাকালেন। গতকাল ওভাবে খেয়াল করেনি তারা মেয়েটাকে। একি হাল গালের! ফখরুল হাসান তো আনমনে বলে উঠলো,
“কি করে হলো এমন?”
নবনী আনজুম এবার দিরাজ স্বরে ডাকলেন,
“আসফিন।”
অধরার টনক নড়ে উঠলো। সেইসাথে মৃদু ভাবে কেঁপে উঠলো ছোট্ট শরীর টা। কোনমতে ঢোক গিলে বলল,
“জি…জি দাদুনি।”
“গালে এমন দাগ কি করে হলো? বলো।”
অধরা চমকে সমানে তাকালো। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেললো। তুবা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শুধু সে নয়, বলতে গেলো সবাই। নবনী আনজুম এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলে না। আজ কেন এভাবে বলছে? অধরা নীরব দেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন নবনী আনজুম,
“কি হলো? কথা বলছো না কেন?”
শেষের বাক্যটায় ছিলো স্পষ্ট ধমক। অধরা কেঁপে উঠলো। চোখ না তুলে ধীর কন্ঠে বলল,
“আম্মু মেরেছে।”
নবনী আনজুম এবার সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তুবার দিকে। ওই চোখে কি ছিলো কে জানে তুবা কেঁপে উঠলো কিছুটা। নবনী আনজুম কিছু বলার পূর্বেই সে দ্রুত বলে উঠলো,
“অপরাধ করেছে বলে মেরেছি। ও কি করেছে শুনুন আগে।”
তুবার কথা শেষ হতেই আগুন ঘি ঢালার অভিপ্রায়ে তহুরা বলে উঠলো,
“সেটায় তো। অপরাধ করলে মা হয়ে শাসন করবে না?”
নবনী আনজুম প্রশ্নাক্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কি করেছে আসফিন?”
মায়মুনা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার সাহস পেলো। তুবা, তহুরা তার পক্ষে কথা বলেছে বলেই সাহস পেয়ে যাওয়া। সে মুখ বাকিয়ে বলল,
“ওই ন*ষ্টা মেয়ে…..”
কথা সমাপ্ত করতে পারলেন না তিনি। ফয়জাল হাসান হুংকার দিয়ে উঠলেন,
“খবরদার আমার মেয়েকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবেন না।”
ফয়জাল হাসানের হুংকারে কেঁপে উঠলো উপস্থিত সবায়। অধরা চমকে তাকালো বাবার দিকে। নবনী আনজুম কিছুটা অবাক হলেও খুশি হলেন। ফয়জাল হাসানের হুংকার শেষ হতে না হতেই চিল্লিয়ে উঠলেন ফারুক হাসান,
“আস্তে কথা বলো, বড় ভাবি হয় তোমার। বড়দের সম্মান দিতে হয় ভুলে গেছো বোধহয়।”
“মিথ্যাবাদীদের আবার কিসের সম্মান!”
ফয়জাল হাসানের র্নিলিপ্ত স্বর৷ ফারুক হাসান ফের বললেন,
“তুমি জানো ও মিথ্যা বলছে? তোমার মেয়ে মিথ্যা বলতে পারে না?”
মেয়ের দিকে আঙুল যেতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন ফয়জাল হাসান,
“না, পারে না।”
ফারুক হাসান তেজী স্বরে বললেন,
“মেয়ের দোষ ঢাকতে নাটক করছো। ন*ষ্টা মেয়ে তোমার।”
ফয়জাল হাসান দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
“মুখে আনতে চাইনি, কিন্তু বাধ্য করলেন আপনি। জানো*য়ার পয়দা করেছেন আপনি। যে ঘরে নিজের দুইটা বোন থাকতেও অন্য মেয়েকে সম্মান দিতে শেখেনি।”
ফয়জাল হাসানের কথাটায় কার উপর কি প্রভাব ফেললো কে জানে তবে অণিতার বুকে গিয়ে লাগলো কথাটা। ঘৃণ্য দৃষ্টিতে সে একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। সে বুদ্ধিমান। খুব ভালো করে বুঝে গেছে কাজটা তার ভাইয়ের। আর ভাইকে বাঁচাতেয় মায়ের সব নাটক। কিন্তু অণিতার জানাতেও যে ভুল ছিল। হাহ!
ফারুক হাসান ফের কিছু বলার আগে তুবা বলে উঠলো,
“নিজের মেয়ের দোষ ঢাকতে অন্যের সন্তানকে গালি দিচ্ছ কেন?”
এমনিতেই মেজাজ খারাপ ছিলো ফয়জাল হাসানের। এবার যেন বাঁধ ভাঙলো ধৈর্যের। রাজ্যের রাগ এসে হানা দিলো তার মস্তিষ্কে। হিতাহিত জ্ঞান ভুলে গেলেন তিনি। রাগে অন্ধ হয়ে চিৎকার করে বললেন,
“বাচ্চাটা রাখতে চাওনি বলেই কি ওর উপর একটুও মায়া নাই তোমার? চাও আর না চাও নয়টা মাস তো পেটে রাখছো, জন্ম দিছো তাও দরদ হয় না একটুও? একটুও ভালোবাসো না?”
অনেক গুলো বিস্মিত দৃষ্টি পরোখ করতেই থেমে গেলেন ফয়জাল হাসান। এলোমেলো দৃষ্টি মেলে তাকালেন। শুকনো ঢোক গিলে তাকালেন মেয়ের দিকে। এতক্ষণ র্নিলিপ্ত থাকা অধরা অবাকে চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। ছোট শরীরটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে কি? নাকি ফয়জাল হাসানের চোখের ভুল। অধরা যেন তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। শরীরের শক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবুও সবটুকু শক্তি সঞ্চার করে কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করলো,
“আমি আনএক্সসেপ্টেড চাইল্ড!”
ফয়জাল হাসানের শ্বাসক্রিয়া বেগতিক। হৃৎপিণ্ড ছুটছে দ্রুত। গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও মেয়েকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে চাইলো তার আগেই তুবা হিংস্র ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ আনএক্সসেপ্টেড। চাইনি তোমাকে। এর্বাসন করতে স্বামীর পারমিশন লাগে বলে করতে পারিনি, তোমার বাবা করতে দেয়নি। নষ্ট করার জন্য ঔষধ খেতে চেয়েছি তাও পারিনি তোমার বাপের জন্য। তবুও কম চেষ্টা করিনি। কৈ মাছের প্রাণ নিয়ে এসেছো, মরবে কি করে।”
অধরা মায়ের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে শুনলো সব কথা। ধীর কন্ঠে বলল,
“তুমি এজন্য আমাকে দেখতে পারো না আম্মু?”
“হ্যাঁ পারি না। সহ্য হয় না তোমাকে আমার। তোমাকে দেখলেই মনে পড়ে তোমার জন্য আমার ক্যারিয়ার পুরো ধ্বংস হয়ে গেছে। সব স্বপ্ন মাটিতে মিশে গেছে। খু*ন করে ফেলতে ইচ্ছে হয় তোমাকে।”
মুখ ঝাপটা দিলো তুবা, পরক্ষণেই বলে উঠলো,
“জন্মের আগ থেকে জ্বালাচ্ছো আমাকে, আর কত জ্বালাবে। রেহায় দাও এবার!”
থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে সবার মাঝে। অধরার চাহনিতে অবিশ্বাস। বাবার দিকে তাকালো সে। ফয়জাল হাসান নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। অধরা কেমন করে যেন একটু হাসলো। শরীরের শক্তি ফুরিয়ে এলো তার। গা ছেড়ে দিলো অনায়াসে। তানিশা শক্ত করে ধরে ফেললো তাকে। অস্ফুটে স্বরে ডাকলো,
“আসফিন!”
অধরা নেতানো কন্ঠে বলল,
“পানি খাব আপা।”
আঁখি ছুটে গেলো পানি আনতে। সবার দৃষ্টি অধরার দিকে। অধরার সেদিকে খেয়াল নেই। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন? এখানে কি অক্সিজেনের স্বল্পতা নাকি? অধরার তো শ্বাসকষ্ট নেই। তবে শ্বাস নিতে পারছে না কেন। মৃদু বাতাসে ফেসে এলো একটা ভারী স্বর,”যার বুকে চেপে আছে পাহাড়সম কষ্ট, সে শ্বাস নেয় কি করে?” অধরা আবার হাসে, কার কন্ঠস্বর এটা? কে বুঝলো তার অনেক কষ্ট হচ্ছে?
#চলবে…?