#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব
৪মাসের গর্ভবতী মেহরিশের মুখে ডিভোর্স পেপার ছুড়ে মেরে গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিল, আহিল। যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল মেহরিশ। ভালোবাসা আর বিশ্বাসের মর্যাদা স্বরুপ বাজে ভাবে ঠকে যাওয়ার ঘটনাটা খুব হাস্যজ্বল স্বরে ব্যাখা করছে মেহরিশ। কোলে থাকা ছোট্ট আনায়া হাত পা নেড়ে খেলতে ব্যস্ত। সায়র আশ্চর্য হয়ে দেখছিল মেহরিশকে। কী কঠিন মনের জোর মেয়েটার! হয়তো মনকে শক্ত করেছে বলেই আজ মেয়েটা সুন্দর ভাবে বাঁচতে পারছে। একা চলতে পারছে। যে সমাজে একজন নারী একা চলতে পারেনা, সেখানে মেহরিশ ডিভোর্সি সাথে সিঙ্গেল মাদার হয়ে বেশ প্রফুল্লচিত্তে বসবাস করছে। সায়র উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল,
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই আস্কিং অ্যা কুয়েশ্চন? ”
মেহরিশ হেসে জবাব দিল,
“অফকোর্স, ইউ ক্যান।”
সায়র একটু নড়েচড়ে বসল। শান্ত বাক্যে প্রশ্ন করল,
“আনায়াকে নিয়ে একা পথ চলতে কোনো প্রবলেম হচ্ছে না?”
মেহরিশ হাসল। স্নিগ্ধ সে হাসি। মেয়েটা ভাঙা মন নিয়ে এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে? মেহরিশ হেসেই জবাবে বেশ প্রফুল্ল হয়ে বলা শুরু করল,
“নারীকে দূর্বল ভাববেন না, মিস্টার সায়র। নারী পারেনা এমন কোনো কাজ নেই। নারী শখের পুরুষের জন্য নরম মাটির ন্যায় হতে পারে। আবার সেই নারী নিজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে জলন্ত আগুনে পুড়ে নিজেকে শক্ত লোহার ন্যায় গড়তে পারে? আর রইল প্রবলেমের কথা? আচ্ছা বলুন তো, প্রবলেম কোন মানুষের জীবনে নেই? বিল গেটস থেকে শুরু করে প্রিন্সেস ডায়ানা অব্দি যেখানে ভালোবেসে ঠকেছে, সেখানে আমি মেহরিশ ঠকে যাওয়াটা কী খুব বিস্ময়কর কিছু? বিল গেটস, প্রিন্সেস ডায়ান এদের জীবন কি থেমে আছে? তাহলে আমার জীবন কেন থামবে? আমি শুধু এগিয়ে যাব। পেছনে ফিরে তাকালে মানুষ দূর্বল হয়ে যায়। তাই যখন থেকে বুঝেছি আর পেছনে তাকানো যাবেনা, তখন থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছি। আমি কেন একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষের জন্য আফসোস করব? বরং নিজের ব্যক্তিত্ব এমনভাবে গড়ব যেন, যে আমাকে ছেড়ে গেছে সে আফসোস করবে। অল ওকে?”
সায়র হেসে ফেলল। মেয়েটার ব্যক্তিত্ব আসলেই খুব স্ট্রং। এত গুছিয়ে কথা বলে কিভাবে? কোনো আফসোস নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই, অভিযোগ নেই আছে শুধু বুক ভরা অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সায়র অন্যমনস্ক থাকতে দেখে মেহরিশ প্রশ্ন করল,
“ মিস্টার, সায়র? শুনছেন?”
সায়র নড়েচড়ে বসল। হেসে বলে উঠল,
“আই লাইক ইউর পারসোনালিটি, মেহরিশ।”
মেহরিশ হাসল। কোলে থাকা আনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“জানেন, আমি খুব দূর্বলচিত্তের মেয়ে ছিলাম। যাকে ধমক দেওয়ার আগেই তার চোখে পানি চলে আসত। আমার সাথে কেউ অন্যায় করছে যেনেও আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম না। সবসময় একা থাকার চেষ্টা করতাম। কারোর সাথে প্রয়োজনের অধিক কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজতাম। আর বেশি লোকসমাগম দেখলে তো আমার গায়ে জ্বর চলে আসতো…।”
এইটুকু বলে ফিক করে হেসে ফেলল। পুনরায় বলা শুরু করল,
“বাড়ির থেকে একা একা কোথাও যেতে পারতাম না। ইভেন কলেজ, ভার্সিটি অব্দি না। এতটাই ভীতু ছিলাম। কোনো ছেলে আমার পাশে দিয়ে গেলেও আমার আত্মা কেঁপে উঠত। অবশ্য, আমার এই ভীতু সত্তার পেছনে এক ভয়ংকর কারণ ছিল।”
সায়র প্রশ্ন করতে যেয়েও থেমে গেল। মনে মনে ভাবল,
“প্রশ্নটা ব্যক্তিগত হয়ে যাবে না তো? যদি মেহরিশ মাইন্ড করে?”
আকাশ কুসুম ভেবে দমে গেল। মেহরিশ তা খেয়াল করে বলে উঠল,
“অতীতের কথাটা না হয় আজ থাকুক। পরে কোনো এক সময় শেয়ার করব। অতীতের সেই নরম, ভীতু আমিটার জীবনে আহিলের আগমন ছিল বসন্তের মিষ্টি হাওয়ার মতো। ভার্সিটির প্রথম দিন আমাদের সবাইকে সিনিয়রা ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। আমার জীবনের প্রথম ফুল নিয়েছিলাম আহিলের হাত থেকে। প্রথম দেখায় ছেলেটার প্রতি অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। যে আমি ছেলেদের ছায়াকেও ভয় পেতাম, সেই আমি হঠাৎ করে আহিলকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আহিলের হাসিটা আমার বার বার মুগ্ধ করে। হাসির প্রেমে পড়েই ফেঁসে গিয়েছিলাম।”
পুনরায় শব্দ করে হাসল মেহরিশ। সায়র অবাক পানে তাকিয়ে দেখছে শুধু। মেয়েটা কী দুর্দান্ত! বুকের ভেতর কষ্ট চেপে ঠোঁটের কোনে কী মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে রেখেছে! সায়র হুট করেই প্রশ্ন করল,
“মেহরিশ, একটা প্রশ্ন মনে পড়ল। করব?”
“অবশ্যই। প্লিজ, করুন।”
সায়র একটু থেমে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি বললেন, আপনি যখন চার মাসের ছিলেন তখন আপনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে আহিল আমেরিকা চলে আসে। কিন্ত প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তো ডিভোর্স হয় না। তাহলে কী আপনি এখনো আহিলের স্ত্রী?”
মেহরিশের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে জবাবে বলল,
“হ্যাঁ।”
সায়রের বুকটা ধক করে উঠল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। চোখ দুটোয় অসহায়ত্ব ভেসে উঠল। পুনরায় কম্পিত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“এখন যদি আহিল ফিরে আসে তাহলে আপনি তাকে মেনে নিবেন?”
মেহরিশ এক নজর তাকাল সায়রের দিকে। পরক্ষণেই হেসে জবাবে বলল,
“মিষ্টার সায়র, আমি জীবন্ত গোলাপ ফুল। আমার কাছে ঘেষলেও কাটার আঘাতে রক্তাক্ত হতে হবে। আমি যেমন দেখতে সুন্দর, ঠিক তেমনি ভয়ংকর। ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত পারি৷ আবার ঘৃণার প্রতীকও বয়ে বেড়াতে পারি। জীবনকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়া অবশ্যই উচিত। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়া কখনোই উচিত না। বুঝলেন?”
সায়রের মুখে হুট করে হাসি ফুটল। মুচকি হাসতে হাসতে বলল,
“আপনি খুব শক্ত মনের অধিকারী, মেহরিশ। দ্বিতীয় বার জীবন সঙ্গীকে চুজ করতে ভুল করবেন না, আশা করি।”
মেহরিশ হেসে বলল,
“মানুষ পঁচা শামুকে একবার পা কা*টে, মিষ্টার সায়র। আর হ্যাঁ, দ্বিতীয় বার আমার জীবনে কেউ আসবে না। কেউ না। পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করিনা, আমি জানি সবাই এক না। তবে পুরুষ শব্দটা আমার কাছে এখন অতীতের মতো আতঙ্কের।”
বলেই উঠে দাঁড়াল। আনায়াকে বুকে আগলে নিয়ে বলল,
“আজ আসি, মিস্টার সায়র। ভালো লাগছে না। একদিন বাসায় চলে আসবেন সব গল্প হবে। দাওয়াত রইল। আসবেন কিন্তু।”
সায়র আমতা আমতা করে বলল,
“আমি পৌঁছে দেই?”
মেহরিশ বাঁধা দিয়ে বলে উঠল,
“ধন্যবাদ। তবে আমি একা একা চলতে পারি।”
“না, মানে। আনায়াকে নিয়ে ড্রাইভ করতে প্রবলেম হবে না?”
মেহরিশ হাসল। দৃঢ় বাক্যে শুধাল,
“আমি অভ্যস্ত।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করল। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই বহু পরিচিত মুখখানা দেখে মেহরিশের পা থেমে গেল। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এতদিন পর মানুষটাকে দেখে মেহরিশের বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। কেন আসল মানুষটা? কেন? জীবনের সব সুখ তো নিয়ে চলে এসেছিল। তাহলে আজ আবার কোন সুখ কেড়ে নিতে এসেছে? কথাগুলো ভেবে আনায়াকে আরো শক্ত করে বুকের ভেতর আগলে রাখল। শেষ সুখটা মেহরিশ কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না। কিছুতেই না…
#চলবে