ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-১৪+১৫

0
188

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ

মাঝ রাতে দরজার সামনে বছর খানেকের বাচ্চা মেয়ে আনায়াকে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাকের শেষ সীমানায়। সায়র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি করে সম্ভব! মেহনূর আর নিলুফা বেগমও দৌড়ে এসেছে কান্নার শব্দে। তাদের পিছু পিছু দৌড়ে আসলেন আবির সাহেব। ছোট্ট আনায়াকে এখানে দেখে চমকে উঠলেন। বিস্ময়ে চোখের পাতা পড়ছে না। মেহরিশ আর অপেক্ষা করতে পারলো না। ছুটে গিয়ে আনায়াকে কোলে তুলে নিল। বুকের মধ্যে চেপে ধরে কান্না করে উঠল। অজস্র চুমুতে আনায়ার মুখশ্রী ভরিয়ে দিল। আশ্চর্যজনক ভাবে আনায়ার কান্না থেমে গেল। আনায়া এখন হাসছে। মায়ের কোল বুঝি সন্তান খুব ভালোভাবে চিনে। সায়র এই সুন্দর দৃশ্যটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। মেহরিশের খুশির কান্না দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই তো এতগুলো খারাপ মোমেন্টের সাথে যুদ্ধ করল। নিলুফা বেগম আর মেহনূরও এবার ছুটে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। আনায়াকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল মুহূর্তেই। সায়র একবার আবির সাহেবের দিকে তাকাল। তিনি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনোরকম রিয়েক্ট করছেন না। চোখে-মুখে কোনো ভয়, খুশি বা দুঃখের ছাপ নেই। একদম স্বাভাবিক সবকিছু। মেহরিশ আনায়াকে নিয়ে এবার সায়রের দিকে ছুটে আসল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,
“সায়র! সায়র! দেখুন আমার আনায়া! আমার আনায়াকে আমি ফিরে পেয়েছি।”
সায়র কোনোরকম কথা বলল না। শুধু ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। হাত বাড়াতেই আনায়াকে হামাগুড়ি দিয়ে সায়রের কোলে চলে আসল। একদম বুকের সাথে লেপ্টে রইল। সায়রের মনে হচ্ছে ওর দেহ আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আবার কতদিন পর বুকটা ভরপুর লাগছে। এই মুহূর্তটার জন্য সায়র সারাজীবন লড়াই করে যেতে পারবে।।রক্তের টান না থাকা সত্ত্বেও কারোর জন্য আত্মার এতটা টান থাকতে পারে সায়র আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারেনি। আবির সাহেব এবার মুখ খুললেন। আনায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কান্নারত বাক্যে বলে উঠলেন,
“আমার নানুমনি! আমার নানুমনি কই দেখি?”
সায়রের কেমন আশ্চর্য লাগল। তার কণ্ঠে একটুও মায়া, মমতা, স্নেহ খুঁজে পেলো না। তবুও আনায়াকে তার কোলে দিয়ে একটু সরে আসল। ফোন বের করে মুন্নাকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিল। সারা বাড়িতে ইতোমধ্যে লাইট জ্বলজ্বল করছে। সবাই আনায়াকে ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেহনূর নিশ্চুপে এসে দাঁড়াল সায়রের পাশে। আলতো বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“সায়র ভাই! কী বুঝলেন?”
সায়র ভাবুক স্বরে জবাব দিল,
“বুঝতে পারছিনা ঠিক। তবে আড়ালে কিছুটা একটা খেলা চলছে। কিন্তু সেই খেলাটা কি এটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”
মেহনূর বলল,
“ভাইয়া, যত দ্রুত সম্ভব আপুকে নিয়ে নিউইয়র্ক ফিরে যাব। আপু অনেক কিছু সহ্য করেছে। আর কোনো দুঃখ আমার বোনকে ছুঁতে না পারুক।”
সায়র একা একা কিছুক্ষণ ভাবল। অতঃপর মেহরিশের উদ্দেশ্যে বলল,
“মেহরিশ আনায়াকে নিয়ে আপনি ঘরে যান। খেতে দিন দ্রুত।”
মেহরিশ শুনল। দ্রুত পায়ে চলে গেল ঘরে। মেহরিশের পিছু পিছু মেহনূর আর নিলুফা বেগমও চলল৷ সায়র নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। কয়েকপা গিয়ে আড়ালে সরে গেল। নজর দিল আবির সাহেবের দিকে। আবির সাহেব ফোন বের করে বাইরের ছুটে গেলেন। সায়রও অপেক্ষা করলেন না৷ ধীর পায়ে আবির সাহেবের পিছু নিল। আবির সাহেব বাড়ির এক কোনে এসে কাউকে ফোন করল। আবির সাহেবের থেকে কয়েক হাত দূরে আড়ালে দাঁড়াল সায়র। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কেউ ফোন রিসিভ করতেই আবির সাহেব গর্জে উঠে বললেন,
“বাস্টার্ডের বাচ্চা! বাচ্চাটা কোথায়?”
ওপাশ থেকে কি উত্তর আসল সায়র ঠিক শুনল না। আবির সাহেব পুনরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
“কু*ত্তার বাচ্চা! বাচ্চাটা যদি তোদের কাছে হয় তাহলে মেহরিশের কোলে কে? আমাকে কি তোদের ছাগল মনে হয়? একটা সামান্য বাচ্চাকে তোরা সামলে রাখতে পারস না৷ তোদের সব কয়টার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
বলেই তিনি ফোন কাটতে না কাটতেই পেছন থেকে কানে ভেসে আসল,
“কিন্তু আমি তো দেখতে পারছি আপনার সময় ঘনিয়ে আসছে, মিস্টার আবির সিকদার।”
আবির সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। ভয় পেয়ে দুইপা পিছিয়ে গেলেন। ভয়ার্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করলেন,
“সা.সা.সা. সায়র! তুমি!”
সায়র কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। কিছু বলতে পারল না। সায়রের পেছন থেকে এবার মেয়েলী স্বরে একজন অসহায় বাক্যে উচ্চারণ করল,
“বাবা! তুমি! আমি ঠিক দেখছি?”
সায়রও এবার চমকাল। পেছন ঘুরে দেখল মেহনূর দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে সে কি করুন অবস্থা! অশ্রু ঝরছে দু নয়নে। আবির সাহেবের এবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। চোখ দুটো মারবেল আকার ধারণ করল। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। কণ্ঠস্বর দিয়ে এবার শব্দ বের হচ্ছে না। সায়র মেহনূরের উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি! এখানে?”
মেহনূর কান্না চেপে রাখতে পারল না। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। ছুটে এসে ঝাপটে ধরল আবির সাহেবকে। কান্নারত বাক্যে বলতে লাগল,
“বাবা! ও বাবা! আমি স্বপ্ন দেখছি? বলো? বাবা, তুমি একটু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো তো। প্লিজ, বাবা। আমার খুব ভয় করছে। আমাদের সাজানো গুছানো পরিবারটা ভেঙে পড়েছে, বাবা। প্লিজ আমাকে একটু আঁকড়ে ধরো। আমার ঘুম ভাঙিয়ে দাও। আমি এসব সহ্য করতে পারছি না। আমি তোমার ফেরেশতার রুপ দেখেছি, সেই আমি তোমার ফেরাউনের মতো রুপ সহ্য করতে পারব না, বাবা।”
বলেই হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠল। আবির সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু। সায়রও নিশ্চুপে দাঁড়ানো। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত খুঁজে পাচ্ছে না। মেহরিশ আর আনায়াকে বাঁচানোর উপায় খুঁজছে। পুরো পরিবারটাকে আবার জোড়া লাগানোর পথ খুঁজছে। মেহনূর হঠাৎ কান্না থামিয়ে দিল। এক ঝটকায় সরে আসল আবির সাহেবের কাছ থেকে। চোখের পানিগুলো মুছে নিয়ে আবির সাহেবের দিকে অগ্নীশ্বর চাহনী নিক্ষেপ করল। কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“তুমি যা করছ তা খুব ভয়ংকর। আপুর কলিজায় হাত দিয়েছো বাবা বলে তোমাকে ছেড়ে দিবে না এইটুকু জেনে রাখো। শেষটা খুব করুন হবে দেখে নিও।”
বলেই মেহনূর কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে গেল। আর কিছু শোনা বা দেখার শক্তি নেই ওর। মেহনূর চলে যেতেই আবির সাহেব রাগে সায়রের উপর হামলে পড়ল। সায়রের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“এসব হয়েছে তোর জন্য। তুই আমার সাজানো গুটি সব এলোমেলো করে দিয়েছিস। কি ভেবেছিস সবাই সবটা জেনে গেলে আমি থেমে যাব? একদম না। মেহরিশের ধ্বংস অনিবার্য।”
সায়র হাসল। হেচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল,
“কার ধ্বংস কোথায়, কিভাবে লেখা থাকে এটা একমাত্র উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না। তাই একটু অপেক্ষা করেন। খেলা তো সবে মাত্র শুরু। শুরুটা আপনি করেছেন শেষ না হয় আমরা করব।”
বলেই আর এক মিনিট দাঁড়াল না। বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।


“আমাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে কেন? আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ। কতবছর আমি একটু বের হতে পারি না। পৃথিবীটাকে দেখি না। আলো, বাতাসের সংস্পর্শে যেতে পারি না। আমার সন্তান, স্ত্রী, পরিবারের কাউকে দেখি না৷ আমি আর এই বন্দি জীবন নিতে পারছি না। আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ। কোন অপরাধে আমার জীবনের এতগুলো দিন নষ্ট করলে তোমরা? কোন অপরাধে?
বলতে বলতে একটা লোক কেঁদে উঠল। চুল দাঁড়িতে একাকার অবস্থা মুখশ্রী। জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো পড়েছে রুমে। হাত -পা শিকলে বন্দি। বলতে গেলে পুরো শরীর শিকলে বন্দি। লোকটা নিজেও জানেনা কোন অপরাধের শাস্তি হিসেবে এতগুলো বছর ধরে তিনি এখানে বন্দি। লোকটা ক্লান্ত হয়ে বিরবির করে বলে উঠল,
“আমি আবির সিকদার। যে কিনা একসময় শত শত মানুষের আহার যোগান দিয়েছে, সময়ের লীলাখেলায় আজ সে নিজেই খাবারের জন্য হাহাকার করে…”

#চলবে

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো

“আপনি আমার বাবা নন, তাহলে কে আপনি?”
মেহনূর প্রশ্নটা করতেই আবির সাহেব চমকে উঠলেন। মেহনূর কি তবে সবটা জেনে গেল? সব সত্যি জানলেও তো এই সত্যিটা জানার কথা না। তাহলে? সব প্রশ্ন ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সামলে কান্নারত বাক্যে বলে উঠলেন,
“এসব কি বলছিস, ম? আমি মানছি আমি একটা ভুল করেছি। অপরাধ করেছি। কিন্তু তার পেছনে কারণ ছিল। তুই বা তোরা অর্ধেক সত্যি জেনেছিস বাকি অর্ধেক সত্যি জানার চেষ্টা করিস নি। আমাকে ভুল বুঝলি রে, মা। এতটাই ভুল বুঝলি যে এখন আমাকে বাবা বলে অস্বীকার করছিস?”
মেহনূর একটু দমে গেল। কেন যেন আবির সাহেবকে ভুল বুঝতে ওর মন চাইছে না। কিন্তু কাল রাতে নিজের কানে যা শুনেছে তারপর আবির সাহেবকে বিশ্বাস করাও ঠিক হবে না। মেহনূর এবার আগের ন্যায় শক্ত বাক্যে বলল,
“দেখুন, আমাকে আর বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার ভোলাভালা চেহারায় ভুলব না। আর সবথেকে বড় কথা হলো, আপু এখনো আপনার আসল চেহারাটা দেখেনি। এখনো জানেনা যে তার কলিজায় তারই বাবা হাত দিয়েছে। তাহলে আপু ভুলে যাবে আপনি কে? আপু যে কি ভয়ংকর হতে পারে ভুলে গেছেন?”
আবির সাহেব নিজেকে বহু কষ্টে সামলে রেখেছেন। ইচ্ছে করছে মেহনূরকে এক্ষুনি শুট করে দিতে। কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না এই মেয়েটাকে। কিন্তু এখন রাগের বশে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। সায়র সবটা জানে। মেহনূরের কিছু হলে সায়র নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দিবে না। আবির সাহেব এবার মেহনূরের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বলতে লাগলেন,
“মা! মা রে, আমার কথাটা একবার শোন। আমি আনায়াকে এয়ারপোর্ট থেকে কিডন্যাপ করিনি। আমি তো আনায়াকে পেয়েছি কিডন্যাপ হওয়ার পরের দিন। আনায়ার সেফটির জন্য আনায়াকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আনায়াকে লুকিয়ে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তোদের কাছে সবটা প্রমাণসহ ক্লিয়ার করব। শুধু আমাকে একটু টাইম দে, মা।”
মেহনূর সাথে সাথে আগের ন্যায় বলল,
“ আগামী ২৪ঘন্টা আপনাকে টাইম দিলাম। এর মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করে দেখান, মিস্টার আবির সিকদার।”
বলেই মেহনূর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। পেছন ঘুরে আবির সাহেবের মুখোমুখি হয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আমার আসল, বাবা?”
আবির সাহেন থতমত খেয়ে জবাব দিলেন,
“কোনো সন্দেহ আছে তোর? তাহলে চল এক্ষুনি হসপিটালে চল। ডি.এন.এ টেস্ট করে সন্দেহ দূর করে নিস।”
মেহনূর কিছুটা অবাক হলো বটে। আবির সাহেব নিজের থেকে ডি.এন.এ টেস্টের কথা বলছে? মেহনূর সায়রকে না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে না তাই কিছুটা সময় নিয়ে জবাব দিল,
“যদি তোমাকে আর আমাদের রক্তকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ডি.এন.এ টেস্টের প্রয়োজন হয় তাহলে সময় মতো তুমি ঠিক জেনে যাবে, বাবা।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহনূর চলে যেতেই আবির সাহেবের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটল। মনে মনে বলে উঠল,
“আমি কে___এটা জানার জন্য তোমাকে আরেকবার জন্ম নিতে হবে, মা।”


সায়র নিলুফা বেগমের মুখোমুখি বসে আছে। নিলুফা বেগম চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“এনিথিং রং, সায়র? হঠাৎ এভাবে বাড়ির বাইরে ডাকলে যে?”
সায়র ইতস্তত হয়ে জবাব দিল,
“আন্টি, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল।”
নিলুফা বেগম হেসে বললেন,
“তা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে বুঝি? করো। তোমার যা ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করো। নো প্রবলেম।”
সায়র সৌজন্যমূলক হেসে বলল,
“কিছুটা পারসোনাল।”
নিলুফা বেগম বললেন,
“তুমি প্রশ্ন করো। উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব আমার। যদি আমার মনে হয় যে, প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তাহলে চুপ থাকব।”
সায়র কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রথম প্রশ্ন করল,
“আংকেলের কোনো টুইন ব্রাদার আছে?”
নিলুফা বেগমের হাসিটা মিলিয়ে গেল। শান্ত স্বরে জবাব দিলেন,
“ছিল। তবে এখন নেই।”
সায়রের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। পরক্ষণেই আবার প্রশ্ন করল,
“নেই কেন?”
নিলুফা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন,
“সে অনেক ইতিহাস। শুধু জেনে রাখো, সাবির মা°রা গেছে। অন্য প্রশ্নে যাও।”
সায়র আর সাহস করে এই বিষয়ক প্রশ্ন করতে পারল না। গলা ঝেরে আবার প্রশ্ন করল,
“আংকেল আর সাবির সাহেবের মাঝে কি কোনো অমিল আছে যা দ্বারা তাদের আলাদা ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?”
নিলুফা বেগম একটু ভেবে জবাবে বললেন,
“ওরা দুজন আইডেন্টিক্যাল টুইনস। ওদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে অমিলের কিছু নেই। বিয়ের প্রথম প্রথম আমি নিজেই এলোমেলো করে ফেলতাম। নিজের বরকেও চিনতাম না আর ভাসুরকেও চিনতাম না।”
বলেই হাসলেন একটু। পরক্ষণেই খুব উত্তেজিত বাক্যে বলে উঠলেন,
“ তবে একটা জিনিস আছে___তিল। হ্যাঁ, আবিরের একটা তিল আ…।”
এইটুকু বলে আবার থেমে গেলেন। বলতে দ্বিধাবোধে ভুগতে শুরু করলেন। কথাটা সায়রকে কিভাবে বলা যায়? ন্যারো মাইন্ডের শুনাবে না? নিলুফা বেগম কে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখে সায়র জিজ্ঞেস করল,
“আন্টি, আপনি ফ্রী মাইন্ডে বলতে পারস।”
নিলুফা বেগম ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে বলে উঠলেন,
“আবির সাহেবের তল পেটের একটু নিচে একটা দাগ আছে, জন্মদাগও বলা যায়।”
সায়র বুঝল। এবার সায়র সোজাসাপটা বলে উঠল,
“আন্টি আমি কালই মেহরিশকে বিয়ে করতে চাই। আপনি মেহরিশকে রাজি করাবেন। বাকি সব ব্যবস্থা আমি করে নিব। আপাতত বাড়ির কয়েকজন বাদে আর কেউ বিয়ের কথা জানবে না। সোজা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হবে। অনুষ্ঠান না হয় আমেরিকা ফিরে যেয়ে হবে।”
নিলুফা বেগম হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সায়রের সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেল। অবাকপানে জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবা, কালকে বিয়ে? কিভাবে সম্ভব? মেহরিশ কিছুতেই রাজি হবে না।”
সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“রাজি করাবেন। কিভাবে রাজি করবেন এটা আপনার ব্যাপার শাশুড়ী মা। এখন আসি। বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে তো। আপনি সাবধানে বাড়ি পৌঁছে যাবেন।”
বলেই সায়র উঠে দাঁড়ালো। বুকে ঝুলানো সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে, পকেটে হাত ঢুকালো। অতঃপর শিস বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে গেল। নিলুফা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। কিভাবে রাজি করাবে মেহরিশকে?


“ভাইয়া, বাবা তো ডি.এন.এ টেস্ট করাতে রাজি হয়ে গেল। কি করব?”
সায়র হেসে জবাব দিল,
“রাজি তো হবেই।”
বলেই থামল। তারপর বলল,
“এখন আর ডি.এন.এ টেস্ট করাতে হবে না। এখন বোনের বিয়ের তোরজোর শুরু করো। তার আগে চলো আমার ডার্লিং এর সাথে দেখা করে আসি।”
মেহনূর হেসে ফেলল। সায়রের এই রোমান্টিক রুপটা মেহনূর খুব এনজয় করে৷ তাই সায়রকে সাথে নিয়ে চলল মেহরিশের রুমে। মেহরিশ আনায়াকে গোসল করিয়ে জামা কাপড় পড়াচ্ছিল। এর মধ্যেই সায়র আর মেহনূর রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করেই সায়র বিছানায় গিয়ে আনায়াকে কোলে তুলে নিল। আনায়াও সায়রকে দেখে গালে চুমু দিয়ে আধো আধো ভাঙা স্বরে বলতে লাগল,
“বা বাহ। বা বাহ।”
সায়রও সাথে তাল মিলিয়ে বলতে লাগল,
“আমার এঞ্জেল। আমার মা, কি করছে?”
আনায়া আবার বলে উঠল,
“বা বাহ।”
আনায়ার বয়স ১০মাস। মোটামুটি এখন সব ধরনের শব্দ আওড়াতে পারে। মেহরিশ কপাল কুঁচকে আনায়াকে বলে উঠল,
“বাবাহ কি? বলো যে, আংকেল?”
সায়র বাঁধ সেজে বলল,
“নো, মাম্মা। বলো যে, বাবা, বাবা।”
মেহরিশ সায়রকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“এই ব্যাডা বাবা কি? আপনি কি ওর বাবা?”
সায়র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে আমার বিয়ে হলেই আমি আনায়ার বাবা হয়ে যাবো, ডার্লিং। সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না কেন, সোনা?”
‘ডার্লিং’ ‘সোনা’ শব্দ দুটো মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ কেশে উঠল। এই লোকটা হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? মেহরিশকে কি চমকে দিয়ে মে°রে ফেলার চেষ্টা করছে নাকি?

#চলবে