ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-১৬+১৭

0
124

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ষোল

“জীবনে বাঁচতে হলে কি দ্বিতীয় বার বিয়ে করা খুব দরকার, সায়র?”
ছাদের কার্নিশের কোনে ষ্টীলের দোলনায় পাশাপাশি বসে আছে দুজন। সায়র বিয়ের প্রস্তাব দিতেই মেহরিশ নাকোজ করে দেয়। এখন মেহরিশ বিয়ে নিয়ে ভাবছে না। কিন্তু সায়র নাছোড়বান্দা। ও কালকের মধ্যেই মেহরিশকে বিয়ে করবে। হোক মেহরিশের সম্মতিতে অথবা অসম্মতিতে। ওদের দুজনকে এক প্রকার জোর করেই আলাদা কথা বলতে পাঠায় নিলুফা বেগম। ছাদে এসে কিছুক্ষণ নিরবে বসে ছিল। নিরবতা ভেঙে মেহরিশ উপরোক্ত প্রশ্নটি করল। মেহরিশের প্রশ্নে সায়র হালকা হেসে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“মেহরিশ, আপনি বাঁচবেন কয়দিন?”
মেহরিশ ভড়কে গেল। মজার ছলে প্রশ্ন করছে? অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“মজা করছেন?”
সায়র আগের ন্যায় জবাব দিল,
“আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি মজা করার মুডে আছি?”
মেহরিশ এবার সামান্যই বিরক্তির স্বরে বলল,
“তাহলে এই প্রশ্ন করছেন যে? আপনি নিজে কী জানেন আপনি কয়দিন বাঁঁচবেন?”
সায়র হেসেই জবাবে বলে উঠল,
“আমার এই প্রশ্নের উত্তর শুধু আপনি বা আমি কেন, পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে না। আমরা মানুষ। আমাদের সৃষ্টি করেছে যিনি তিনিই জানেন আমরা কতদিন, সময়, ঘন্টা, সেকেন্ড এই পৃথিবীতে থাকব। আমাদের হায়াত, মউত তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।”
মেহরিশ এবার শান্ত সুরে প্রশ্ন করল,
“তাহলে এই প্রশ্ন করলেন কেন?”
সায়র ঠান্ডা মাথায়, নরম সুরে বলতে লাগল,
“তুমি তোমার ২৫বছরের যৌবন, জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে হেসে খেলে। আচ্ছা, তুমি একবার মেয়েকে বড় করতে যেয়ে সঙ্গীর অভাব কি সত্যিই ফিল করবে না? মেয়ের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য যখন সারাদিন একা লড়াই করবে, দিন শেষে একটু হলেও সঙ্গীর অভাব ফিল করবে। কারোর কাঁধে মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বন্ধ করার জন্য ছটফট করবে। কারোর বুকের বা-পাশে শুয়ে থেকে রাত কাটাতে মন আনচান করবে। তখন বুঝবে জীবনে সুখে থাকার জন্য একজন লাইফ পার্টনার ভীষণ দরকার। মেহরিশ, শুধুমাত্র শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য একজন সঙ্গীর দরকার পড়ে না। মানসিক শান্তির জন্য একজন সঙ্গী থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আচ্ছা, তাও বাদ দাও। ধরো, তুমি ৮০ বছর বাঁচলে। তোমার মেয়ে বড় হলো। বিয়ে হলো। সংসার হলো। তখন সে তার সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটাবে। সেই ব্যস্ততার মাঝে তুমি হয়ে যাবে একা। বৃদ্ধ বয়সে তোমার একাকিত্ব নিবারনের জন্য একজন সাথী দরকার। মনের কথা খুলে বলার জন্য সই দরকার। চোখের চশমাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আলাদা একটা হাত দরকার। লাঠি হাতে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একজন পথপ্রদর্শক দরকার। মেহরিশ, তোমার শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য, আমি তোমার মানসিক চাহিদা মেটানোর সাথী হতে চাই। একবার আমার হাতটা ধরে দেখো, যেদিন দেহ থেকে রুহ আলাদা হয়ে যাবে সেদিন ছাড়ব। তার এক সেকেন্ড আগে অব্দি ছাড়ব না। প্রমিস।”
মেহরিশ চুপচাপ কথা গুলো শুনল। মনে আলাদা একটা ভালো লাগা বয়ে গেল। কী সুন্দর কথা বলে ছেলেটা! একটা কথাও ফেলে দেওয়ার মতো না। মেহরিশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়াল। সায়র ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে কি ডিসিশন নিলে? বিয়ে করবে নাকি না?”
মেহরিশ ছোট্ট করে জবাব দিল,
“ভেবে জানাব।”
সায়র এবার উঠে দাঁড়াল। বাঁকা হেসে হুট করেই মেহরিশের কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। আচমকা টান খাওয়ায় মেহরিশ ঘাবড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাত দুটো গিয়ে আটকায় সায়রের শার্টে। শার্টটা দুই হাতে শক্ত করে খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মেহরিশ ভয় পাওয়া চেহারাপানে তাকিয়ে সায়র মুচকি হাসল। এক হাতে মেহরিশের কোমরে রাখল। অন্য হাত রাখল মেহরিশের ঘাড়ে। প্রথমবার সায়রের স্পর্শ পেয়ে মেহরিশ কেঁপে উঠল। হৃদযন্ত্র ধপধপ শব্দ করে বাজতে লাগল। পা থেকে মাথা অব্দি শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রতঙ্গে কম্পন সৃষ্টি হলো। ঠোঁট দুটোও সামান্য মাত্রায় কাঁপছে৷ সায়রের ইচ্ছে করছে মেহরিশের ঠোঁট দুটো নিজের করে নিতে। কিন্তু এখন এই মারাত্মক ইচ্ছাটাকে যেভাবেই হোক দমিয়ে রাখতে হবে। মেহরিশের মুখে সায়রের নিঃশ্বাস পড়তেই ফট করে চোখ মেলে তাকাল। সায়রের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় নুড়ে গেল। নিজেকে সায়রের এত কাছে দেখে ভীষন থেকে ভীষণতম অবাক হলো। সরে আসতে চাইলে সায়র আরো কাছে টেনে নিল। মেহরিশের কণ্ঠে স্বর নেই৷ কোনো শব্দ উচ্চারণ হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে আসছস৷ শুকনো গলায় আমতা আমতা করে বলল,
“সায়র, ক.ক.কি করছেন?”
সায়র হেসে মেহরিশের গালের সাইডে এবার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে স্পর্শ করতে লাগল। মেহরিশ অনুভূতিতে নড়ে উঠল কিঞ্চিৎ। সায়র মেহরিশের আরো কাছাকাছি চলে এলো। মেহরিশের কানের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আজ কিছু করলে বাসর রাতের জন্য কি রাখব? আমার তো এখুনি বাসর সেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে।”
সায়র কথা বলাতে মেহরিশ কানে সায়রের ঠোঁটের নরম স্পর্শ পেয়ে কাঁপলো খানিক। তবে সায়রের কথা শুনে রাগও হলো বটে। রেগে জিজ্ঞেস করল,
“কাল বাসর মানে? আমি কি বিয়েতে মত দিয়েছি? বলেছি আপনাকে বিয়ে করব?”
সায়র হেসে জবাবে বলল,
“আপনি রাজি থাকলেও কাল বিয়ে, না থাকলেও কাল বিয়ে।”
মেহরিশের কপাল কুঁচকে আসল। নাকও কিঞ্চিৎ ফুলে উঠল। কঠিন বাক্যে বলল,
“জোর করে বিয়ে করবেন?”
সায়র হাসল। বলল,
“সোজা আঙ্গুলে কাজ না হলে, আঙ্গুল বাঁকাতে হয় ডার্লিং।”
মেহরিশ দাঁত কটমট করে, চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ফোসফোস করতে করতে বলল,
“সায়র, মুখ সামলে কথা বলুন। আপনাকে এতদিন আমি ভদ্র ভাবতাম। এখন তো দেখছি আপনি ভীষণ অভদ্র।”
সায়র দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে পুরুষ মানুষ একটু আধটু অভদ্র হয়, জানেন না?”
মেহরিশ ছিটকে এবার সরে আসল সায়রের কাছ থেকে। রাগী স্বরে বলল,
“অসভ্য, অভদ্র, গায়ে পড়া স্বভাবের ছেলেদের আমার একদম পছন্দ না, সায়র।”
সায়র হাসি বিনিময় করে বলে উঠল,
“গায়ে পড়া স্বভাবের হলে এখুনি বাসর সেরে ফেলতাম। যেমন পোষাক পড়েছেন তাতে আমি সায়র কেন, পৃথিবীর যেকোনো পুরুষের পক্ষে নিজের পুরুষাঙ্গকে সামলাতে কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। আপনার টাইট ফিট টপসের গলা এতই বড় যে, আপনার বুকের নরম অংশ দুটো স্পষ্ট চোখে ভাসছে৷ যেখানে না চাইতেও আমার চোখ আটকে যাচ্ছে। মেহরিশ, আপনি একজনের মা। একজনের কন্যা। এবং একজনের হবুর স্ত্রী। দয়া করে নিজের লজ্জাস্থান সামলে চলুন। পোষাকের ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন হোন। আশা করি, নেক্সট টাইম আপনি নিজের ব্যাপারে সর্তক হবেন।”
বলে সোজা ছাদ থেকে নেমে আসল। মেহরিশ নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল সায়রের বলা কথাগুলো সত্য। কিছুটা লজ্জাও পেলেও বটে। কিছুক্ষণ নিজে নিজে লজ্জায় হাসফাস করে নিচে নেমে আসল।


“গুড মর্নিং, সায়রের ডার্লিং। কাইন্ডলি, ঘুম থেকে জেগে উঠুন। এখন, এই মুহূর্তে আপনার বিয়ে।”
ঘুমের মধ্যে কথাটা মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ নড়েচড়ে পাশ ফিরে পুনরায় শুয়ে পড়ল। ভেবেছে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখছে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই পুনরায় কেউ কানের কাছে বলে উঠল,
“আপনাকে এক মিনিট টাইম দেওয়া হলো, ঘুম থেকে উঠে বসুন। নয়তো, আপনাকে মর্নিং কিস দিয়ে ঘুম থেকে তোলা হবে।”
এবার মেহরিশ তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল। মুহূর্তেই দু চোখের ঘুম উবে গেল। ঘুম ঘুম দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল সায়র সাদা রঙের পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছে। মেহরিশ একবার নিজের দিকে তাকাল। মেহরিশের গায়ে সাদা রঙের নাইট ড্রেস। সায়রকে দেখে মেহরিশ বালিশের পাশ থেকে স্কাফটা নিয়ে গলায় ঝুলালো। ঘুমন্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“সকাল সকাল মজা করার মতো মানুষ খুঁজে পাননি?”
সায়র হেসে জবাবে বলল,
“আমার মজার করার মানুষ তো শুধুমাত্র আপনি, মেহরিশ।”
মেহরিশ আবার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
“প্লিজ, জান।”
সায়র মেহরিশকে শুতে না দিয়ে ধরে রেখে বলে উঠল,
“বলেন, জান।”
মেহরিশ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলল,
“মানে রুমের থেকে জেতে বলছি।”
“যাবো না। কিছুক্ষণ পর এটা আমারো রুম হয়ে যাবে।”
মেহরিশ প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ঘড়ির দিকে নজর দিয়ে দেখল বেলা ১১টা বাজে। রাতে আনায়া কান্না করছিল, ঘুমাতে দেয়নি একদম। ভোরের দিকে আনায়াকে নীলুফা বেগমের কাছে দিয়ে এসে ঘুমিয়েছিল। এখন ইচ্ছে করছে সায়রের গ° লা টি°পে দিতে। মেহরিশ কিছু বলবে তখনি রুমে নীলুফা বেগম, আনায়া, মেহনূরসহ আরেকজন স্যুটফুট পড়া লোক ঢুকল রুমে। তাদের দেখে মেহরিশ কিছুটা ভড়কাল। কিন্তু সায়র আরাম করে আসন পেতে বসল। মেহরিশ ঘুমন্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“উনি কে, মা?”
মেহনূর হাসতে হাসতে বলল,
“পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই সেই মেয়ে যে, কিনা নাইট ড্রেস পড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে।”
কথাটা মেহরিশের কানে যেতেই মেহরিশ খাট থেকে লাফিয়ে নামতে যেতে পায়ে পা লেগে ধুম করে নিচে পড়ে গেল। সায়রসহ বাকি সবাই হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল। মেহরিশ শুধু অসহায় চোখে সবার দিকে বলে উঠল,
“আল্লাহ! আমাকে এ কোন দুনিয়ায় পাঠালে?”

#চলবে

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সতেরো

“নাইট ড্রেস পড়ে বিয়ের করব? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন, সায়র? তা ছাড়া এ বিয়েতে আমি রাজি নই। আপনি কি আমাকে জোর করে বিয়ে করবেন?”
সায়র আগের ন্যায় হেসে জবাব দিল,
“আমার জানা মতে, শাড়ি পড়েই বিয়ে করতে হবে এমন কোনো আইন নেই। আর থাকলেও সেটা আমি মানিনা। আর বিয়েটা যেহেতু আজ তাই শাড়ি-টাড়ি ম্যানেজ করা আমার জন্য খুব কঠিন। এখন নাইট ড্রেস পড়েই বিয়েটা সেরে নেই। তারপর না হয় লাল শাড়ি পড়িয়ে, নাচতে নাচতে আপনাকে বউ সাজিয়ে ঘরে তুলব। ওকে? অল ডান?”
মেহরিশ বিরক্তিতে চেঁচিয়ে বলল,
“নো, নট ডান। কি ভেবেছেন আপনি? সবকিছু ফান? বিয়েটা ছেলেখেলা? বললেন আর বিয়ে হয়ে গেল? আমার পরিবার, আপনার পরিবার কেউই উপস্থিত নেই। সবথেকে বড় কথা আমি নিজেও প্রস্তুত নই। তাহলে কিসের বিয়ে বিয়ে নাটক শুরু করলেন? ”
সায়র মেহরিশের কথায় কান না দিয়ে কাজির উদ্দেশ্যে বলল,
“কোথায় সাইন করতে হবে, শহিদ সাহেব?”
শহিদ সাহেব একটু কেশে বলে উঠল,
“কাবিন কত করবেন?”
সায়র বলল,
“আমার শাশুড়ী যত বলবে ততই হবে।”
নীলুফা বেগম একবার মেহরিশের দিকে তাকাতেই দেখল, মেহরিশ আগেই তার দিকে অগ্নীশ্বর চোখে তাকিয়ে আছে। তা দেখে নীলুফা বেগম মেঁকি হেসে বললেন,
“লিখেন, লক্ষ খানেক। আমার জামাই বাবাজীবন কি আর আমার মেয়েকে ছেড়ে দিবে নাকি যে কাবিন কোটি টাকার করতে হবে।”
সায়র হেসে বলে উঠল,
“জিও, শাশুড়ী আম্মা। আপনাকে আমার থুক্কু আমাদের পক্ষ একজন নাতি গিফট করা হবে। তবে একটু সময় লাগবে। এই ধরুন ১বছর। মানে ডাউনলোড করতে এইটুকু টাইম তো লাগবেই বলেন?”
নীলুফা বেগম জিভে কামড় দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলেন। মেহনূর চিৎকার করে উঠল। আর মেহরিশের অটোমেটিক কাশি শুরু হয়ে গেল। শহিদ সাহেবও হাসছেন। সায়র শুধু আনায়াকে গালে চুমু খেয়ে বলে উঠল,
“আম্মাজান, আপনার তো একটা খেলার সাথী দরকার তাই না বলেন?”
আনায়াও সাথে হুহু করতে লাগল। মেহরিশ এবার সায়রের পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“আপনাকে আমি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ মনে করতাম। এখন দেখছি আপনি প্রচন্ড অস*ভ্য, অ*ভদ্র একজন।”
সায়র মেহরিশের গা ঘেঁষে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“আমি অভ°দ্র না হলে আপনি মা হবেন কি করে, জান?”
মেহরিশ পারছেনা এবার কান্না করে দিতে৷ বিরক্ত হয়ে খাট থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সায়র আটকে ফেলল। শক্ত বাক্যে হেসেই বলল,
“বিয়ে শেষ না হওয়া অব্দি কোথাও যাওয়া যাবে না।”
মেহরিশ জবাবে শক্ত হয়ে বলল,
“আমি এখন বিয়ে করতে পারব না, সায়র। আমার হাত ছাড়ুন।”
সায়র বলে উঠল,
“বিয়ে আপনাকে আজ, এক্ষুনি করতে হবে, মেহরিশ।”
বলেই শহিদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
“কাবিন ১০লক্ষ ১০টাকা লিখুন, শহিদ সাহেব।”
শহিদ সাহেব লিখলেন। সাথে আরো কিছু লিখলেন। বিয়ের সমস্ত বিধিমালা শেষ করে রেজিস্ট্রি খাতাটা সায়রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“এখানটায় সাইন করে দিন।”
সায়র একদম দেরি করল ন। সাথে সাথে সাইন করে, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠল। এবার মেহরিশের দিকে খাতাটা এগিয়ে দেওয়া হলো। মেহরিশের বুক কাঁপছে। একদিন ভুল মানুষকে ভালোবেসে, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো এক কাজি অফিসে এভাবেই তো বিয়েটা করেছিল। কই বছর খানেকও তো সংসার করতে পারল না। আজ আবারো সময়ের খরস্রোতে জীবনে এনে দাঁড় করালো সেই মুহূর্তে। মেহরিশের এখন কি করা উচিত? সায়রকে মেহরিশ পছন্দ করে। কিন্তু এখনো ভালোবেসে উঠতে পারেনি। মেহরিশ চায়না এখনি বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হতে। তাহলে কি করা উচিত? চোখের কোনে অশ্রু জমছে। একবার মেহনূর আর নীলুফা বেগমের দিকে তাকাল। তারা দুজনেই চোখের ইশারায় ভরসা দিল। মেহরিশের চোখ এই মুহূর্তে বাবা নামক মানুষটাকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মানুষটা তো কাল রাতেই শহরের বাইরে গেল কাজে। আর আজ সায়র এমন করছে। এর মানেটা কী? সায়রের পরিবারের সবাই মানবে তো? মেহরিশ আকাশ কুসুম ভেবে আনায়ার দিকে তাকাল। আনায়া সায়রের বুকে নিশ্চুপ হয়ে আছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে যাবে। সায়রও খুব যত্নে আনায়াকে আগলে রেখেছে। মেহরিশ এবার দোটানায় পড়ে গেল। আনমনে বলে উঠল,
“ডিভোর্সের এখনো তিন মাস হয়নি, সায়র। তাহলে আমরা বিয়ে করব কিভাবে?”
সায়র থমকাল। শান্ত স্বরে জবাবে বলল,
“আমি আইন ও ধর্ম দুটো বিষয়ই অবগত, মেহরিশ। তবে আমি নিরুপায়। আমার আপনাকে বিয়ে করাটা এই মুহূর্তে জরুরি। আমার হাতে আজকের দিনটাই সময় আছে। আমরা শুধু রেজিস্ট্রি করে রাখব। আমাদের বিয়েটা এখন শুধু এই চার দেয়ালের মাঝেই বন্দি থাকবে। চার দেয়াল আর চারজন মানুষ ব্যতিত কেউ জানবে না। শহিদ সাহেব ঠিক আছে?”
শহিদ সাহেব হাসলেন। বললেন,
“জ্বি, স্যার।”
মেহরিশ মানতে পারছে না। কি হচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। সায়র কথাটা শেষ করে মনে মনে বলে উঠল,
“যেখানে আনায়া আর আপনার জীবনের প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে আপনাদের জন্য সায়র সব নিয়ম ভাঙতে পারে, মেহরিশ।”
মেহরিশ কলম হাতে বসে আছে নিস্তব্ধ হয়ে। সাইন করার জন্য মন, মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না। সায়র বিরক্ত হল। বলল,
“মেহরিশ, সাইন করুন।”
“আমি এখন বিয়েটা করতে পারব না, সায়র। প্লিজ জোর করবেন না। কাজি সাহেব আপনি এখন আসতে পারেন।”
সায়র কথার পৃষ্ঠে সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
“আপনি সাইন করবেন কি না?”
মেহরিশও জোর খাটিয়ে উত্তর দিল,
“না। আমি সাইন করব না।”
সায়র আবারো প্রশ্ন করল,
“শেষ বার বলছি মেহরিশ, সাইন করে দিন। আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু করতে বাধ্য করবেন না।”
মেহরিশ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনি যা খুশি করুন, তবুও আমি সাইন করব না।”
সায়র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবার আড়ালে এক হাত রাখল মেহরিশের কোমরে। মেহরিশ কাঁপল। চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল মুহূর্তেই। গলার জোরটা নিমিশেই হাওয়া হয়ে গেল। সায়রের দিকে তাকাতেই সায়র দাঁত কেলিয়ে হাসল। মেহরিশের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“মেহরিশ, আপনি কি এই মুহূর্তে চুমু চান নাকি আমার হাতের অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া চান?”
মেহরিশ ঘাবড়াল। রোবটের মতো হয়ে বসে রইল। নড়চড় করতে ভুলে গেল। ঢোক গিলল কয়েকবার। সায়র পুনরায় বলল,
“মেহরিশ, সাইন করুন। আমাকে নির্লজ্জ হতে বাধ্য করবেন না। আপনার ঠোঁট দুটো আমাকে ভয়ংকর ভাবে ডাকছে।”
বলেই হাত দিয়ে মেহরিশের কোমরে খানিকটা চাপ প্রয়োগ করতেই মেহরিশ নড়ে উঠল। নীলুফা বেগম আর মেহনূরের চোখ এড়ালো না দৃশ্যটা। উনারা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে৷ মেহরিশ তবুও সাইন করছে না দেখে সায়র আর একটু ঘেঁষে বসল। বলল,
“কোথায় চুমু খাবেন ঠোঁটে নাকি বু…।”
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই মেহরিশ তড়িঘড়ি করে সাইন করে ফেলল। সবাই মিলে এবার একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। হাসির রোল পড়ে গেল রুম জুড়ে। একে একে সবাই ওদের স্পেস দিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেহনূর বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওদের কংগ্রেস করতে ভুলল না। সাথে সায়রকে বলল,
“এখন কিন্তু সকাল ১০টা। রাত ১০টার জন্য না হয় নিজেকে প্রিপেইড করুন, দুলাভাইইইই।”
কথাটা শেষ হতেই সায়র হেসে মেহনূরের বাহুতে চাপড় মে°রে বলল,
“এই না হলে আমার শালি? আমাকে সাবধান করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ শালি সাহেবা।”
মেহরিশের ধমকি খেয়ে মেহনূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। মেহনূর চলে যেতেই মেহরিশ খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। রাগে ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখা জিনিসপত্র গুলো এলোমেলো করে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। সায়র থামাল না। ভড়কালো না। আনায়া ঘুমিয়ে যাওয়ায় আনায়াকে ঠিক করে শুইয়ে দিল৷ তারপর নিজেও খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। মেহরিশের পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অনুভূতি গুলো দারুন মিষ্টি হয়।”
মেহরিশ পাশ ফিরে সায়রের বুকে দুইহাত রাখল। মুহূর্তেই সায়রকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আপনার উপর আমার ঘৃণা হচ্ছে, সায়র। আপনি নামক পুরুষ আজ থেকে আমার এক আকাশসম ঘৃণায় বাঁচবেন।”
সায়র তবুও হাসল। পুনরায় এগিয়ে আসল মেহরিশের কাছে। মেহরিশ দূরে সরে যেতেই সায়র দুইহাত ধরে ফেলল। মেহরিশ ছোটাছুটি করতে লাগল। সায়র ছাড়ল না। ফুঁ দিয়ে মেহরিশের মুখশ্রীতে পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিল। হেসে বলে উঠল,
“আপনার ভালোবাসায় না হোক ঘৃণায় বাঁচতে পারাটাও আমার এ জীবনে পরম পাওয়া হয়ে থাকবে, মেহরিশ।”

#চলবে