#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আঠারো
“যাকে ভালোবাসেন তাকে এভাবে অপমান করতে পারলেন, সায়র?”
সায়র বিধ্বস্ত স্বরে জবাবে বলল,
“অপমান! আমি আপনাকে অপমান করেছিস, মেহরিশ? কিভাবে?”
মেহরিশ ছোটাছুটি থামিয়ে দিল। অশ্রুসিক্ত নয়ন রাখল সায়রের নয়নে। বলল,
“আমাকে স্বাভাবিক হতে না দিয়ে, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছেন আপনি। আপনি একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ।”
সায়র শুধু নিষ্প্রাণ হাসল৷ শান্ত স্বরে বলল,
“ব্যক্তিত্ব মানুষের সম্পূর্ণ আবরণ বহন করে না। ব্যক্তি নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করবে, অনুরুপভাবে ব্যক্তিত্বও সেভাবেই প্রকাশ হবে। তাই মানুষকে জাজ করার আগে মস্তিষ্ককে
মিনিট খানেক সময় দিও।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। নিষ্প্রাণ বাক্যে বলে উঠল,
“এতটা ভুল বুঝবেন না, মেহরিশ। সত্যিটা সামনে আসলে নিজেকে সামলাতে পারবেন না।”
বলেই বেরিয়ে গেল। সায়র চলে যেতেই মেহরিশ ধপ করে নিচে বসে পড়ল। সায়র কি বলে গেল? কোন সত্যি? এমন কি আছে যা মেহরিশের অজানা? সায়রের হঠাৎ বিয়ে করার পেছনে কারণ কি? আনায়া নিখোঁজের পর হঠাৎ মাঝরাতে দরজার বাইরে কি করে আসল? সবপ্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। মেহরিশ কী কোনোদিন সুখের মুখ দেখবে না? মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। চিৎকার করে উঠল। দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। কী বিষাক্ত যন্ত্রণা! মুহূর্তেই মন, মস্তিষ্ক দুটোই ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে উঠল।
–
–
“স্যার, মেহরিশ বিয়ে করেছে।”
কথাটা আবির সাহেবের কানে যেতেই তিনি বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন,
“হোয়াট? মেহরিশ বিয়ে করেছে? কি বলছো তুমি?”
ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে লোকটা পুনরায় বলে উঠল,
“জ্বি, স্যার। মেহরিশ সায়র নামে এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। ছেলেটা বোধহয় আপনাদের পরিচিত কেউ।”
আবির সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভুল শুনছেন? নাকি ভুল ইনফরমেশন দিচ্ছে? মেহরিশ ওর বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলবে___এটা কি আদৌ সম্ভব? আবির সাহেব কল কেটে দিলেন। ধপ করে বসে পড়লেন। সায়রের উপর রাগে ফেটে পড়লেন। চিৎকার করে উঠে ফোন ছুঁড়ে মা°রলেন দেয়ালে। বাজখাঁই স্বরে বলে উঠলেন,
“আমি কাউকে ছাড়ব না। মেহরিশের মৃ°ত্যু আমার হাতেই লেখা আছে। সবাইকে দেখে নিব আমি।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
–
–
আবির সাহেব তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় অন্ধকারে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন৷ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এক ফোঁটা পানির জন্য ভেতরের সবকিছু শুকিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। করুন স্বরে বলে উঠলেন,
“পানি! পানি! আমাকে একটু পানি দাও। কেউ একটু পানি দাও।”
আর বলতে পারলেন না। গলা আরো শুকিয়ে আসতে লাগল। আবির সাহেবের মনে হচ্ছে এক্ষুনি বোধহয় তার দম বেরিয়ে যাবে৷ কিন্তু পানি না পেলে সে হয়তো সত্যি সত্যি মা°রা যাবে। তাই পুনরায় বলতে লাগল,
“প.প.প.প.পানি! কেউ একটু পানি দ…।”
আর বলতে পারলেন না। তার আগেই দরজা খোলার শব্দ কানে ভেসে আসল। কোনোমতে উপরে তাকিয়ে দেখলেন কেউ ভেতরে প্রবেশ করছে। আবির সাহেব অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না কে এসেছে? তবুও তাকিয়ে থাকলেন সেখানে। ব্যক্তিটি অন্ধকারের মাঝেই আবির সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কোনো শব্দ করছে না । আবির সাহেব ভয়ার্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করলেন,
“ক.ক.ক.কে এখানে?”
কোনো উত্তর আসল না। আবির সাহেবের ভয় বাড়ল। তবুও উত্তরের আশায় বসে রইলেন। মিনিট খানেক পর আলো জ্বলে উঠল। বেশ অনেক মাস পর এমন ঝমকাল আলোর দেখা পাওয়ায় আবির সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চেয়ে থাকতে পারছেন না। আলো চোখে বসছে। আচ্ছা সে কি অন্ধ হয়ে গেছেন? নাকি অন্ধকারে থাকতে থাকতে আলোর স্বাধ নিতে ভুলে গেছেন? খুব কষ্টে আস্তে আস্তে চোখ খুললেন। সামনে থাকা ব্যক্তিটি মুখ এখনো অস্পষ্ট। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর ব্যক্তিটির মুখ স্পষ্ট হলো। বহু পরিচিত ব্যক্তিটিকে দেখে মুখে হাসি ফুটল। সোনার খনি পাওয়ার মতো খুশি মুখশ্রীতে ফুটে উঠল। আবেগে জর্জরিত স্বরে বলতে লাগলেন,
“স.স.সাবির! সাবির ভাই! ভাই! তুই? তুই এসেছিস? আমি সত্যি দেখছি? নাকি স্বপ্ন দেখছি?”
সাবির সাহেব হালকা হেসে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ, ভাই! সত্যি! আমি এসেছি।”
আবির সাহেবের হাসিটা আরো প্রস্তর হলো। তৃষ্ণা বোধহয় মুহূর্তেই উবে গেল। হাসতে হাসতে বলে বলতে লাগলেন,
“ আমাকে নিতে এসেছিস? সত্যি! আমি জানি তুই আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না। জানতাম তো, আমাকে তুই এখান থেকে একদিন ঠিক বের করে নিয়ে যাবি। আমার এতদিনের অপেক্ষা বুঝি শেষ হলো। আমি আবার বাইরের আলো বাতাস দেখতে পারব। আমার প্রাণ ভোমরাগুলোর দেখা পাব। আমার ব্যবসা, আমার বাড়ি, আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে! সবাইকে দেখতে পারব। আল্লাহ! আল্লাহ বুঝি আমাকে এই দিনের জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
খুশিতে আবির সাহেব খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছেন। সাবির সাহেব এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
“ভাই, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বোকামি। তোমাকে আমি এখানে নিয়ে যেতে নয়, বরং দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে এসেছি।”
–
–
নীলুফা বেগম ছটফট করছেন৷ ড্রয়িং রুমের এ মাথা থেকে ওমাথা হেঁটে বেড়াচ্ছেন। একবার বসছেন তো আরেকবার উঠছেন। এক হাতে কফির মগ, অন্য হাতে মোবাইল। কাউকে কল দিচ্ছেন কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হচ্ছে না। তার চেহারায় ভয়ংকর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পারছে মেহরিশ। বিয়ের পর মাঝে কেটে গেছে দুইদিন। সায়র এইদুইদিন এই বাসায় ফিরেনি। নিজেদের বাসায় থাকছে। মেহরিশও রাগ, অভিমান, ক্ষোভে খোঁজ নেয়নি। আজ সকাল থেকে উঠে নীলুফা বেগমকে এমন ছটফট করতে দেখছে। কিছুক্ষন খেয়াল করে এবার প্রশ্ন করেই বসল,
“কী হয়েছে, মা? এনিথিং রং?”
নীলুফা বেগম গোমড়া মুখে বলে উঠলেন,
“আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে রে, মা। মনে হচ্ছে কোনো বিপদ আসতে চলেছে আমাদের পরিবারের উপর। তোর বাবাও সকাল থেকে ফোন ধরছে না। মানুষটা দূরে আছে। ঠিক আছে কিনা জানাবে তো।”
মেহরিশ সাথে সাথে বলে উঠল,
“মা, বাবা ঠিক আছে। চিন্তা করো না। হয়তো ব্যস্ত আছে তাই ফোন ধরছে না। পরে ব্যাক করে নিবে দেখো। আর তা ছাড়া বাবার সাথে তো, আরিফ আছে। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে কফিটা শেষ করো। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷”
মেহরিশের কথা শুনেও নীলুফা বেগম শান্ত হতে পারলেন না। নিশ্চুপে এসে মেহরিশের পাশে বসলেন। শান্ত বাক্যে বলে উঠলেন,
“জানিস, আমার এই ফিলিংশটা বহু বছর আগে যেদিন আবিরের এক্সিডেন্ট হলো সেদিন হয়েছিল। আজ আবার এতগুলো বছর এমন ফিলিংশ হচ্ছে। তাই ভয় হচ্ছে।”
মেহরিশ এবার একটু অবাক হলো। অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“বাবার, এক্সিডেন্ট! কবে হয়েছিল, মা? আমি কোথায় ছিলাম? আমি জানিনা কেন? আমার মনে নেই কেন?”
নীলুফা বেগম থমকে গেলেন। মুখ ফস্কে কথাটা বের হয়ে গেছে। তাই কথা এড়াতে বলে উঠলেন,
“আরে ধুর কি বলতে কি বললাম ঠিক নেই৷ তুই বস আমি একটু রান্নাঘর থেকে আসছি।”
বলেই উঠে চলে গেলেন। মেহরিশের মনে খটকা লাগা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে।
–
–
নীলুফা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। নিজে নিজে বলে উঠলেন,
“যে সত্যের মুখোমুখি আমি হয়েছে, সে তিক্ত সত্যটা তোরা জানার চেষ্টার করিস না, মা। সহ্য করতে পারবি না। আমি এক ভুলের সাথে নিজের জীবন বেঁধেছি, যে ভুল আমাকে ঘুন পোকার মতো খেয়ে ফেলছে তিলে তিলে।”
–
–
“সায়র, আবির সাহেবের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে জীবিত নয় মৃ°ত।”
কথাটা সায়রের কানে যেতেই সায়র স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে কি শেষ রক্ষ হলো না?
#চলবে
#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনিশ
অপরিচিত একটা মেয়ে মেহরিশের স্বামী নামক পুরুষটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে__দৃশ্যটা দেকে মেহরিশ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। ভুল দেখেছে ভেবে চোখ দুটো খানিক সময়ের জন্য বন্ধ করল। পুনরায় খুলে সে একই দৃশ্য দেখল। মেহরিশের মাথা ঘুরতে শুরু করল। এই মানুষটাই তো সপ্তাহ খানেক আগে মেহরিশকে জোর করে, ভালোবাসার দাবি নিয়ে বিয়ে করেছিল। আর সেই মানুষটাই কীনা এখন…! ভাবতে পারছে না মেহরিশ। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। সায়র কি তবে ছলনা মত্ত হলো? নাকি মেহরিশের রেগে বলা কথাগুলোকে সত্যি ভেবে দূরত্ব বাড়াতে চাইছে? সেই যে বিয়ের দিন বাসা থেকে বের হয়ে এখন অব্দি কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। তাহলে বিয়েটা করেছিল কেন? কেন? মেহরিশকে শেষ বার চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে? নাকি এটা সায়রের কোনো প্লান? কিছু ভাবতে পারছে না মেহরিশ। এদিকে সায়রের পাশে অন্য মেয়েকেও সহ্য করতে পারছেনা। রাগ যেন মাথা নেড়ে উঠছে। মস্তিষ্ক জমে উঠেছে রাগে। মনে চাচ্ছে এক্ষুনি ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে সরিয়ে ফেলতে। মেহনূর পাশে দাঁড়ানো। মেহরিশের থমকানো মুখখানা দেখে ভয় পেল। তবুও জিজ্ঞেস করল,
“আপু! ঠিক আছিস?”
বলে আনায়াকে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে তুলে নিল। মেহরিশ এখনো থমকে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজরে চেয়ে আছে সামনে থাকা ব্যক্তি দুটোর দিকে। মেহনূরের কেন যেন ভয় হচ্ছে। মেহরিশ কোনো রেসপন্স করছে না কেন? এটা কি কোনোরকমে ঝড়ের আগের পূর্বাভাস? মেহনূর এবার মেহরিশকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“আপু! এই আপু!”
মেহরিশের এবার হুঁশ ফিরে আসল। হকচকিয়ে উঠল। ছোট্ট করে বলল,
“হুঁ।”
মেহনূর সাবধনতার সাথে জিজ্ঞেস করল,
“ঠিক আছো?”
মেহরিশ ঠোঁটে হাসি টানার চেষ্টা করল। বলল,
“ইয়েস, আ’ম অল রাইট।”
বলেই সামনে এগিয়ে গেল। মেহনূরও পিছু পিছু এগিয়ে গেল। মেহনূরের মুখে স্পষ্ট কৌতুহল। মেহরিশ কি করবে তা দেখার পালা। মেহরিশ গিয়ে সায়রের মুখোমুখি দাঁড়াতেই সায়রের চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটাকে দ্রুত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“মেহরিশ! আপনি? এখানে?”
মেহরিশ হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করল,
“জ্বি, আমি। এনি প্রবলেম, মিস্টার সায়র?”
সায়র হাসার চেষ্টা করল। বলল,
“নো। নো প্রবলেম।”
বলেই সায়রের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠল,
“মেহরিশ, সি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড তৃণা।”
তৃণা এবার হাসি মুখে মেহরিশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যালো, মেহরিশ। নাইস টু মিট ইউ।”
মেহরিশ তৃণার সাথে হ্যান্ডশেক না করে, সায়র আর তৃণার মাঝে এসে দাঁড়ালো। সায়রের বাহু জড়িয়ে ধরে তৃণার উদ্দেশ্যে বলল,
“এক্সকিউজ মি, প্লিজ সাইড।”
বলেই সায়রের উদ্দেশ্যে বলল,
“চলুন।”
সায়র অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মনে হলো আকাশ থেকে পড়ল। মেহরিশের এই আচরণের স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে মেহরিশ প্রচন্ড জেলাস। সায়র মেহনূর দুজন দুজনের দিকে তাকাল। মেহনূর ঠোঁট চেপে হাসতেই সায়র চোখ মারল। তৃণাও মুচকি হাসছে। সায়র এবার কিছু না বোঝার ভান করে বলে উঠল,
“কোথায় যাব?”
মেহরিশ চোখ গরম করে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমার সাথে চলুন।”
সায়র মেহরিশের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“মেহরিশ, ছাড়ুন। মানুষ দেখছে। আমার লজ্জা লাগছে।”
মেহরিশের রাগ যেন এবার তরতর করে বাড়ল। রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
“আমি হাত ধরেছি বলে লজ্জা লাগছে? আর অন্য একটা মেয়েকে রাস্তার মাঝে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা লাগেনি?”
সায়র উত্তর দেওয়ার আগেই তৃণা এবার উত্তরে বলল,
“এক্সকিউজ মি! অন্য মেয়ে কাকে বলছো? আমি ওর বেস্ট ফ…।”
তৃণা কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। তার আগেই মেহরিশ বাঘিনীর ন্যায় তাকাল তৃণার দিকে। রাগে চিৎকার বলে উঠল,
“আর আমি ওয়াইফ হই। শুনেছো? আমি সায়রের স্ত্রী হই।”
বলেই থেমে গেল। মেহরিশের উচ্চবাক্যে কথা শুনে আশেপাশের কয়েকজন তাকাল এদিকে। সায়র আর মেহনূরও কিছুটা ভড়কে গেল। মেহরিশ এবার কণ্ঠস্বর খানিক নিচু করে বলে উঠল,
“আই থিংক, আমি থাকতে সায়রের লাইফে কোনো বেস্ট ফ্রেন্ডের দরকার পড়বে না। সো, কিপ ডিসটেন্স ফ্রম মাই হাবি। ওকে? আন্ডারস্ট্যান্ড? আই থিংক ইউ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলেই সায়রের হাত ধরে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করল। সায়রও এবার আর আটকালো না। অবাক হয়ে মেহরিশকে দেখতে দেখতে হাঁটছে। কিছু দূর গিয়ে পেছনে ফিরল। মুখে বড়োসড়ো হাসি টেনে মেহনূর আর তৃণার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। হাতের ইশারায় বুঝালো,
“অল ডান। মিশন সাকসেস।”
মেহনূর তৃণাকে থ্যাংকস বলে দ্রুত হাঁটা ধরল মেহরিশ আর সায়রের পিছু পিছু।
–
–
“আমার আবির কোথায়, সাবির?”
সাবির সাহেব পেছন ঘুরে তাকালেন। নীলুফা বেগমকে দেখে বাঁকা হাসলেন। বললেন,
“নিলু যে, পাশে এসে বসো। সপ্তাহ খানেক পর মাত্র বাড়ি ফিরলাম। কোথায় আমার সেবা করবে তা না করে এসব ভুলভাল প্রশ্ন করছো কেন?”
নীলুফা বেগম সাবির সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললেন,
“নিলু! নিলু ডাকটা শুধু আবিরের মুখেই মানায়। যে কেউ এসে আবিরের জায়গা ধকল করলেই আবির হওয়া যায় না। আবির হতে গেলে যোগ্যতা লাগে। সবার কি আর সে যোগ্যতা আছে?”
সাবির সাহেব হেসে ফেললেন। জবাবে বললেন,
“যোগ্যতা না থাকলে কি আর এত বছর শত্রুর সাথে সংসার করতে?”
নীলুফা বেগমের মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালেন সাবির সাহেবের দিকে। অসহায় বাক্যে অনুনয় করে বললেন,
“আমার আবিরকে একবার চোখের দেখা দেখতে দিবে, প্লিজ।”
সাবির সাহেব আগের ন্যায় বলে উঠলেন,
“তা তো সম্ভব না, মাই সুইট লেডি। আবির তো আর বেঁচে নেই।”
কথাটা নীলুফা বেগমের কানে যেতেই নীলুফা বেগম চিৎকার করে উঠলেন। শরীর ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল তার। কাঁপাকাঁপি বাক্যে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“মজা করছো তুমি?”
সাবির সাহেব জবাব দিলেন,
“সাবিরের ডিকশনারিতে ‘মজা’ শব্দটা মিসিং।”
নীলুফা বেগমের মাথা ঘুরতে লাগল। যে ভয়ে সে এতবছর সব অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নিয়েছিলেন, আজ সেই ভয়ের কাছেই কি তবে হেরে গেলেন?
–
–
সারারাস্তা মেহরিশ নিজে ড্রাইভিং করে এসেছে। মেহনূর পেছনের সীটে আনায়াকে নিয়ে বসেছে। সায়র মেহরিশের পাশে বসে ছিল। সারারাস্তা আর মেহরিশ কোনোরকম কথা বলেনি। মেহরিশদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই মেহরিশ আগে গাড়ি থেকে নামল। সায়র বসে বসে শুধু মেহরিশের কান্ড দেখছে আর মনে মনে মজা নিচ্ছে। মেহরিশ নিজে নেমে আসল সায়রের কাছে দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“নামুন।”
সায়র না নেমে বলে উঠল,
“আমি আপনাদের বাসায় যাব না, মেহরিশ।”
মেহরিশ আর কিছু না বলে আগের ন্যায় সায়রের হাত ধরে নামাল। সায়রের হাত ধরে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। নিজের রুমে নিয়ে আসল। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেলল। সায়র এবার নড়েচড়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল,
“কি করতে চাইছেন, মেহরিশ?”
মেহরিশ হালকা হাসল। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“যা আপনি করতে চান।”
সায়রের প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। তবুও হাসি আটকে মাসুম বাচ্চার মতো প্রশ্ন করল,
“আমি আবার কি করতে চাই?”
মেহরিশ সায়রের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সায়রও বাংলা সিনেমার নায়কের মতো ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে পেছাতে লাগল। পেছাতে পেছাতে বিছানায় বসে পড়ল। মেহরিশ সায়রের কাছে এসে এক হাতে সায়রের কলার চেপে ধরল। সায়রের ঠোঁটের আশেপাশে অন্যহাতে স্পর্শ করতে করতে বলে উঠল,
“বাসর করতে চান না?”
সায়র হালকা কেশে গলা ঝেরে নিল। আমতা আমতা করে বলে মনে,
“আপনি তো আমাকে স্বামী হিসেবে মানেন না। তাহলে বাসর করব কিভাবে?”
মেহরিশ ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“কেন? বিয়েটা যেমন জোর খাটিয়ে করেছেন, বাসরও তেমন জোর খাটিয়ে করবেন।”
সায়র সাথে সাথে জিভে কামড় দিয়ে বলে উঠল,
“ছিহ! কি বলেন? নাউজুবিল্লাহ! আমি কি বাংলা সিনেমার ডিপজল নাকি যে, জোর করে লজ্জাহরন করব?”
মেহরিশ এবার রেগে সায়রকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। অতঃপর সায়রের বুকের উপর উঠে বসল। দুই হাতে সায়রের গাল চেপে ধরে দাঁত কটমট করতে করতে বলল,
“তাহলে অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলি কেন, শালা?”
সায়র অসহায়ের কতো বলে উঠল,
“শালা না জামাই।”
মেহরিশ বাঘিনীয় ন্যায় উচ্চবাক্যে বলে উঠল,
“তোর জামাইয়ের গুষ্টি কিলাই। আগে বল অন্য মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলি কেন?”
সায়র আগের ন্যায় উত্তর দিল,
“আপনি তো আর আমাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেন না। তাই যখন তৃণা জড়িয়ে ধরল আবেগে আপনাকে ভেবে আর ছাড়তে পারিনি।”
মেহরিশ এবার সায়রের ঠোঁট টেনে ধরল। বলল,
“আর একবার ওই মেয়ের নাম মুখে একদম মুখ টেনে ছিড়ে ফেলব।”
সায়র বেচারা পড়েছে বিপাকে। ঘুমন্ত বাঘিনী জেগে উঠেছে। সায়র বেশ মজা নিচ্ছে মেহরিশের কান্ডে। মেহরিশ এবার জোর খাটিয়ে বলে উঠল,
“আমি মানি বা না মানি, আপনি আমার স্বামী। আর আমার হয়েই থাকতে হবে বাকি জীবন। আমাকে ভুলে গিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তা করলে, সেদিন আপনার জীবনের শেষ দিন হবে। মাইন্ড ইট।”
বলেই নেমে পড়ল সায়রের বুক থেকে। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। মেহরিশ চলে যেতেই সায়র উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলতে লাগল,
“আপনাকে ভুলে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই, মেহরিশ। আপনি আমার দেহের ভালোবাসা না,আপনি আমার রুহের ভালোবাসা৷ দেহের ভালোবাসা তো ম’রে গেলে ফুরিয়ে যাবে। তখন দেহ মাটিতে মিশে পঁচে গলে যাবে। কিন্তু রুহ? সে তো থাকবে। দেখবে। আর আপনাকেই ভালোবাসবে। আপনাকে ভালোবাসার সাধ্য আছে, ছেড়ে যাওয়ার নয়।”
–
–
“আংকেল, কেমন আছে?”
“জ্ঞান ফিরেনি। তাই এখনো কিছু বলতে পারছি না।”
“ডাক্তার কি বলল?”
“গুলি দুটো বের করা হয়েছে। এখনো রিস্ক আছে। যে কোনো মুহূর্তে কোমায় চলে যেতে পারেন।”
সায়র এবার থমকে গেল। থেমে থেমে বলল,
“আংকেলের শেষ ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য হলেও আংকেলকে বাঁচতে হবে।”
#চলবে