#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_০১
জনমানব পূর্ণ একটা রেস্তোরাঁয় নিজের স্ত্রী অন্য এক ছেলের সাথে গভীর চুম্বনে আবদ্ধ___দৃশ্যটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে একজন স্বামীর কাছে? সায়রের দৃষ্টি কিছু দূরে বসে থাকা দুজন কপোত-কপোতীর দিকে। যারা কিনা এই মুহূর্তে গভীর চুম্বনে ব্যস্ত৷ সায়র দুই হাতে চেয়ার শক্ত করে খাবলে ধরে রেখেছে। চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে উঠেছে। শরীর বেগতিক কাঁপছে। কী নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর! সায়র সহ্য করতে পারছে না। বুক চিড়ে আর্তনাদ ভেসে আসছে। নিউইয়র্ক শহরে এসব খোলামেলা চুম্বনের দৃশ্য এখানে উপস্থিত সকলের কাছে স্বাভাবিক হলেও সায়রের কাছে বিষের কাটা হয়ে বিঁধছে। সায়রের চোখ দুটো বন্ধ করতেই এক ফোটা অশ্রুকনা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে মুখে হাসি টানল। ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে গেল মেহরিশদের দিকে। মেহরিশের সামনে গিয়ে হাস্যজ্বল বাক্যে বলে উঠল,
“হ্যালো, ডিয়ার। হাউ আর ইউ?”
মেহরিশ আচমকা থিওকে ছেড়ে দিল৷ নিজেও বেশ অপ্রস্তুত ছিল বিষয়টা নিয়ে। যেহেতু থিও মেহরিশের বাগদত্তা তাই বারণ করতেও পারছিল না। সায়রকে দেখে কেন যেন বড্ড অগোছালো লাগছিল। আজকাল সায়রকে দেখলে মেহরিশ বড্ড দূর্বল হয়ে পড়ে। সায়রের শূন্য চোখপানে তাকিয়ে মেহরিশ উত্তর দিল,
“ফাইন। ইউ?”
সায়র হেসে জবাব দিল,
“অলসো ফাইন।”
সায়র এবার থিওর দিকে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
”বেস্ট উইশ ফর ইউর নিউ লাইফ, থিও।”
থিও বেশ হাস্যজ্বল, বন্ধুত্বপূর্ণ একজন পুরুষ। সায়রের শুভকামনা গ্রহন করল সায়রকে জড়িয়ে ধরে। ধন্যবাদ জানাতেও ভুলল না। মেহরিশের দৃষ্টি নিচের দিকে। সায়র কিছুক্ষণ ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়িয়ে এলো।
–
–
গাড়িতে উঠে বসে সায়র সীটে মাথা হেলিয়ে দিল। দুইহাতে মুখ চেপে ধরল। ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠল। জীবন থেকে খুশিটা দুই বছর আগে সেই যে হারিয়ে গেল আর ফিরে পেল না। দুইটা বছর সায়র বেঁচে আছে। একা। জীবন্ত লাশ হয়ে। ভালোবাসা মানুষটাকেও পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলল। যাকে ঘিরে পৃথিবী বানাতে চাইল, বুকের ছোট্ট রাজপ্রাসাদে রাজা রানী আর ছোট্ট রাজকুমারীকে নিয়ে বসবাসের স্বপ্ন দেখল সেই রাজপ্রাসাদ আজ শূন্য। সায়র কাঁদছে৷ নীরবে, নিশ্চুপে। সারাদিন মিথ্যে হাসি মুখে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে আজ সায়র বড্ড ক্লান্ত। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের হয়ে যেতে দেখতে হচ্ছে। এ যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।
–
–
“বাবা, তোমার খাবার।”
আবির সাহেব কিছু ফাইল ঘাটছিলেন। আনমনে বলে উঠলেন,
“আমি খাব না রে, মা। নিয়ে যা।”
মেহনূর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। নড়ল না। শান্ত বাক্যে বলল,
“বাবা, কত কাল না খেয়ে থাকবে?”
আবির সাহেব এবার থামলেন। থমথমে দৃষ্টিতে তাকালেন মেহনূরের দিকে। মেহনূর মুখে হাসি টেনে বসল আবির সাহেবের পাশে। আবির সাহেব হাঁফ ছাড়লেন। মেহনূরের মাথায় হাত বুলালেন আলতো করে। মেহনূর পরম যত্নে আবির সাহেবকে জড়িয়ে ধরল। বলে উঠল,
“বাবা, আমাদের জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে গেল কেন?”
আবির সাহেব ছোট্ট করে জবাবে বলল,
“পাপ! একজনের পাপের ভাগীদার সবাইকে হতে হয়।”
মেহনূর এবার শান্ত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“মা কেন আমাদের সাথে এভাবে ছলনা করল? কেন, বাবা? তুমি কি মাকে কম ভালোবাসতে তবুও কেন মা আমাদের এত বাজে ভাবে ঠকাল?”
আবির সাহেব আর উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ রইলেন। বাকি জীবনটা এভাবেই ধুকে ধুকে কেটে যাবে।
–
–
মেহরিশ আর থিও একসাথে গাড়িতে উঠে বসল। মেহরিশকে আনমনা দেখে থিও প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে, ডার্লিং?” (ইংরেজি বাক্য)
মেহরিশ মুখে হাসি টেনে বলল,
“কিছু না তো।”
থিও সান্তনা বাক্যে মেহরিশের কাছে আসতে চাইলে মেহরিশ বাঁধা দিল। থিও একটু অপমানিত বোধ করল বটে। তবুও কিছু বলল না। গাড়ি চলতে শুরু করল। মেহরিশ দৃষ্টি দিল জানালার বাইরে। মেহরিশের মনে কতশত প্রশ্ন জমে আছে। কিন্তু সেগুলোর উত্তর জানা নেই। সব অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। সে যে করে হোক।
–
–
ছোট্ট একটা বাচ্চা পরি পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তার পিছু পিছু ছুটছে তিনজন মেড। যারা কিনা বাচ্চা পরিটার দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত। তিনজনের মধ্যে একজন যার নাম কাকন হুট করে থেমে গেল। বিরক্তিভরা স্বরে বলে উঠল,
“এইটুকু মাইয়ার লগে দৌড়াইয়া পারন যায় না। বাবা গো বাবা! মাইয়া নাকি যেন ইঞ্জিলের হাত পা। এইডারে কইত্তে টুকাইয়া আনছিল ম্যাডাম। আমি জানলে আবার অইহানে ফালাইয়া রা…।”
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই পুরো বাড়ি কোনো একজনের উচ্চবাক্যে কেঁপে উঠল। কাকনও ভয়ে জুবুথুবু হয়ে কেঁপে উঠল। বাচ্চাটাও থেমে গেল। ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে দিতেই বাকি দুজন ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার মধ্যেই এক জোড়া স্নেহের হাত এসে তড়িঘড়ি করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল,
“আমার সোনা, আমার পরি। কান্না করে কেন? মাম্মা আছে তো। এই যে, মাম্মা। দেখো, দেখো…।”
হুট করে বাচ্চাটার কান্না মুখ হাসিতে ভরে উঠল। মা নামক মানুষটার বুকে লেগে থাকল চুপটি করে। বাচ্চাটাকে শান্ত করে বাকি দুজনকে বাচ্চাটাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ করতেই ওরা চলে গেল। পুরো ড্রয়িংরুমে এখন সামনা-সামনি দুজন মেয়ে দাঁড়ানো। যারা কিনা বয়সেও হয়তো সমবয়সী বা খানিক ছোট বড় হবে। কাকনের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা বেশ কড়া বাক্যে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“আমি রোজকে কুড়িয়ে এনেছি এই কথা বলার সাহস তোর কি করে হয়, কাঁকন?”
কাঁকন ভয়ে কেঁপে কেঁপে জবাব দিল,
“রিন্তাহা আপা, আমার অনেক বড় অপরাধ হইয়া গেছে। আমারে মাফ কইরা দেন। আর কুনুদিন এই কতাখানা মুখে উচ্চারণও করুম না।”
রিন্তাহা কানে নিল না সেকথা। পুনরায় ধমকে বলে উঠল,
“আমি তোকে কুড়িয়ে এনেছিলাম রাস্তার পাশ থেকে, রোজকে না___ কথাটা ভুলে যাস না। রোজ আমার কলিজা। ওর দিকে হাত বাড়ানোর কথা চিন্তা করলেও নিজের জন্য আগে কবর খুঁড়ে নিস। নেক্সট টাইম রোজকে নিয়ে কিছু বলার আগে আমার বাবার শেষ পরিনতির কথা ভেবে নিস।”
রিন্তাহা চলে যেতেই কাকন ওড়না দিয়ে ঘামগুলো মুছে নিল। রিন্তাহা রেগে গেলে ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে তা কেবল এই বাড়িতে বসবাসরত মানুষরা জানে। রিন্তাহা এবার রোজের রুমে এসে বাকি দুজনকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য হুকুম করতেই ওরা বেড়িয়ে গেল। রিন্তাহা রোজকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মাম্মা, তোমার মুখে হাসি নেই কেন? মুখটা ভার লাগছে কেন? মন ভালো নেই বুঝি?”
রোজ আধো আধো স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে চকেত কিনে দাও, মাম্মা।”
রিন্তাহা হাসিমুখে বলল,
“আমার মা চাইলে আমি পুরো পৃথিবীটাকে এনে দিতে রাজি, চকলেট তো খুব তুচ্ছ বস্তু।”
রোজ এই কঠিন শব্দগুলো বুঝল না। তবুও বায়নার স্বরে বলল,
“ঘুরতে যাব।”
রিন্তাহা প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাবে, মা?”
রোজ গালে হাত দিয়ে বড়দের মতো করে ভাবল কিছুসময়। পরক্ষনেই বলল,
“ঘোড়া দেখতে যাব। পাখি দেখব। বিড়াল দেখব। আইসকিরিম খাব। বাবাল কাছে যাব।”
রিন্তাহা হেসে জবাবে বলল,
“জোর হুকুম রাজকুমারী…। ”
–
–
নিউইয়র্ক সময় রাত ১২টা। সায়র সবেমাত্র বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠবে তখনি ফোনটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতে ওপাশ থেকে বলে উঠল,
“সায়র, আনায়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। আনায়া বেঁচে আছে।”
#চলবে