ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০২

0
16

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_০২

“আমি তোমার সাথে রুম ডেট করতে চাই, মেহেরিশ। বেড পার্টনার হিসেবে তোমার পারফরম্যান্স কেমন তা চেক করতে চাই। আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে আর আমি তোমাকে এখনো ঠিকভাবে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। প্লিজ সোনা, রাজি হয়ে যাও। তোমার হটনেস দেখে নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়।” (ইংরেজি বাক্য)
থিওর কথা শেষ হতে না হতেই মেহরিশ চোখ গরম করে তাকাল থির দিকে। থিও সে গরম চোখের চাহনী দেখে হাসল। হেসে মেহরিশের গালে হাত রেখে বলল,
“আমি জানি তোমাদের বাঙালি মেয়েদের বিয়ের আগে এসব নিয়ে একটু প্রবলেম আছে, তবে ভয় পেও না। আমি সব ধরনের প্রটেকশনের ব্যবস্থা ক…।”(ইংরেজি বাক্য)
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই থিওর গালে সজোরে থাপ্পড় পড়ল। তাও একটা না পরপর দুটো। আচমকা আঘাতে থিওকে বেশ ভীতিগ্রস্ত দেখাল। মেহরিশের চোখ দিয়ে একাধারে পড়ছে, অন্যদিকে সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন আগুনের ন্যায় জ্বলছে। মেহরিশ থিওর কলার দুই হাতে শক্ত করে খাবলে ধরল। চেঁচিয়ে বলা শুরু করল,
“আমি রাস্তার মেয়ে না যে তুমি আমাকে ইউজ করতে চাইবে। তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক এখন, এই মুহূর্তে শেষ।”
বলেই হাতের রিংটা খুলে থিওর মুখে ছুঁড়ে মারল। থিও ইতোমধ্যে অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। মেহরিশের এমন রুপ এক বছরে কোনোদিন দেখেনি। মেহরিশদের বাড়ির নিচে গাড়িটা থামানো ছিল। মেহরিশের মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো। হাত পা গুলো থরথর করে কাঁপছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে৷ কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে৷ তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। এলোমেলোহীন ভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। থিও এখনো থ মেরে বসে আছে৷ কি হয়ে গেল সব কিছু মাথার উপর দিয়ে গেল। পরক্ষণেই ভাবল মেহরিশ বাঙালি মেয়ে বলে হয়তো এই প্রস্তাবটা মেনে নিতে পারেনি। থিও মনে মনে বেশ অনুতপ্ত হলো। নিজের উপর রাগ উঠল বেশ। নিজের চুল দুইহাতে খাবলে ধরল। থিও মেহরিশকে প্রচন্ড রকমে ভালোবাসে। এ দেশের কালচার রক্তে মিশে যাওয়ায় হয়তো নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলেছে। থিও আজ অব্দি কোনো মেয়েকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেনি। মেহরিশ থিওর জীবনের প্রথম নারী যাকে সে এতটা ভালোবেসেছে। এখন যদি থিওর একটা কথায় মেহরিশ সম্পর্ক ভেঙে দেয় তাহলে____ভেবেই থিওর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। মেহরিশের পিছু পিছু যাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে পা নামিয়েও উঠিয়ে নিল। লজ্জায় আর মেহরিশের মুখোমুখি হতে মন সায় দিল না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলল নিজ গন্তব্যে।


মেহরিশ বাড়ি ফিরে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। মেহনূর মেহরিশের রুমের দরজার বাড়ি অবাক পানে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরিশের মুখশ্রী দেখে কিছুটা অবাক হলো। কী হয়েছে ওর? প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল না। এখন ডেকে দেখবে কি না তা ভাবতে শুরু করল। দুই দুইটা বছর মেহরিশকে এমন অগোছালো দেখতে দেখতে মেহনূরের নিজেকে আজকাল পাগল মনে হয়। কবে ঠিক হবে সব? কবে? একদিকে সায়র, অন্যদিকে মেহরিশ। দুটো মানুষ সব হারিয়ে এখন দিশাহীন পথের পথিক। মেহরিশের স্মৃতি নেই আজ দুই বছর। মেয়েটা স্বামী, সন্তান হারিয়েছে, সব হারিয়েছে কিন্তু তা সে জানেই না। কী অদ্ভুত বিধির খেলা! মেহনূরের দু চোখ বেয়ে অশ্রু পড়া শুরু করল। চোখের পানিটুকু কোনোমতে মুছে নিয়ে সায়রের নাম্বারে ফোন দিল। দুইবার রিং হওয়ার সাথে সাথে সায়র রিসিভ করেই চিন্তিত বাক্যে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“মেহরিশ ঠিক আছে? কাঁদছিল কেন? এনিথিং রং, মেহনূর?”
মেহনূর শান্ত বাক্যে উত্তর দিল,
“আপনি জানলেন কিভাবে, সায়র ভাই?”
সায়র সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে বলো?”
মেহনূর বলল,
“জানিনা। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ঢুকে আমাকে কোনোরকম কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।”
সায়র এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলা শুরু করল,
“মেহনূর তুমি প্লিজ দরজা খোলার চেষ্টা করো। মেহরিশকে এক মিনিটের জন্য এই মুহূর্তে একা ছাড়বে না। একবার যদিও কিছু ভেবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বা উত্তেজিত হয়ে উঠে তখন কিন্তু আমরা মেহরিশকে চিরদিনের জন্য হারাব। প্লিজ ডু সামথিং। ”
মেহনূরের টনক নড়ল। তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দরজায় হালকা বাড়ি মা রতে মা রতে ডেকে উঠল,
“আপু! আপু! দরজা খোলো। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ইটস ইমার্জেন্সি।”
ওপাশ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে মেহনূরের বুকটা কেপে উঠল। এবার একটু ভয়ার্ত স্বরে ডাকার জন্য তৈরি হতেই দরজা খোলার শব্দ পেল। মিনিটের মাথায় মেহরিশ দরজা খুলে দিয়ে চুপচাপ গিয়ে পুনরায় বিছানায় বসে পড়ল। মেহনূর গলা ঝেড়ে চুপচাপ গিয়ে বসল মেহরিশের পাশে৷ আলতো করে হাত রাখল মেহরিশের কাঁধে৷ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে, আপু? সব ঠিক আছে? থিও ভাইয়া এলো না যে…?”
মেহরিশ সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজাসাপটা প্রশ্ন করল,
“আমি কি আমার অতিত ভুলে গেছি, মেহনূর? কিন্ত কিভাবে ভুলে গেলাম? কি হয়েছিল আমার সাথে? এক্সিডেন্ট? আমার পেটের কাটা দাগটা কিসের? কোনো সার্জারীর চিহ্ন এটা। কিসের সার্জারী? কবে হয়েছিল? আমার মায়ের মৃত্যুর কথা মনে নেই কেন? আমার কেন মনে হয় সায়র আমার খুব কাছের কেউ? কেন আমি সায়রকে দেখলে দূর্বল হয়ে পড়ি? কেন সায়রকে কষ্টপেতে দেখলে আমার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়? কেন? কেন? আমার মাথায় এত কেন জমা হয়ে আছে? আমি এতসবের উত্তর পাচ্ছি না কেন? আমার নিজেকে পাগল মনে হয় কেন? আমি কি পাগল মেহনূর? জানিস আমি না গত কয়েকদিন ধরে স্বপ্নে একটা ছোট্ট প্রিন্সেস মেয়েকে দেখি। ও আমার স্বপ্নে আসে। আমাকে মা বলে ডাকে। আমাকে ছুঁয়ে দেখে। আবার দূরে চলে যায়। আমি ওকে ছুঁতে পারিনা। ও কে? আমার কেউ হয়? আমি তো ওকে কখনো বাস্তবে দেখিনি, তাহলে ও আমার স্বপ্নে আসে কেন? উফফ! আর পারছিনা। আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে মেহু। আমার সব আছে তবুও আমি সুখী হতে পারছিনা কেন? আমি তো থিওকে ভালোবাসি, তাহলে ওর ছোঁয়ায় আমার অস্বস্তির মতো দমবন্ধকর অনুভূতি হয় কেন? কেন? কেন? কেন?”
বলেই চিৎকার করে উঠে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানিটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুঁড়ে মারল। মেহরিশের আচমকা ব্যবহারে মেহনূর ভয় পেয়ে গেল। এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে মেহরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কান্নারত বাক্যে বলা শুরু করল,
“আপু, তুমি একটু শান্ত হও। প্লিজ উত্তেজিত হইওনা। একটু শান্ত হও। আমার কথা শুনো। আমি সব বলব তোমাকে।”
মেহরিশ শান্ত হতে পারল না। মেহনূরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
“কি বলবি তুই আমাকে? আর কত শান্তনা দিয়ে রাখবি আমাকে। আমি তোদের কাউকে বিশ্বাস করিনা। আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমাকে পেতেই হবে। আমি খুঁজে বের করব। এক্ষুনি বের করব।আজ। এই মুহূর্তে।”
বলতে বলতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দরজার সামনে সায়রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সায়রের চোখ দুটো ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশের বুক ফেটে এই ভূবনে বৃষ্টি জল পড়বে। সায়রকে দেখে মেহরিশের ক্ষতের আঘাত তরতর করে বাড়ল। সায়রকে বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে। মেহরিশের কি হলো কে জানে? সায়রকে দেখে ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। মন বলছে, এই মানুষটাকেই তো চাচ্ছিলাম। আমার তো এই মানুষটাকেই দরকার। মেহরিশ কি ভেবে দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়ল সায়রের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে। সায়র, মেহনূর দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায়। সায়র নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সব কল্পনা মনে হচ্ছে। দুই দুইটা বছর ধরে যে যন্ত্রণা বুকে চেপে বেঁচে আছে সে যন্ত্রণার অবসান ঘটল বুঝি….?

#চলবে