#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_শেষ
“আমাকে একটু ভালোবাসবেন? আমাকে আপনি একটু যত্ন করবেন? আমাকে একটু স্বান্তনা দিবেন? আমি যে আপনার উপর বড্ড দূর্বল হয়ে পড়ছি, সায়র। আমাকে এই অন্ধকার থেকে আপনি ছাড়া অন্য কেউ বের করতে পারবে না।”
সায়র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহনূরের মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। চোখে মুখে আনন্দ ছেয়ে আছে। সায়রের চোখেও আনন্দ ফুটে উঠল। মেহরিশকে বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আলতো করে হাত রাখল মেহরিশের গালে। নরম বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“আমাকে মনে পড়েছে তোমার?”
মেহরিশ অসহায় সুরে জবাবে বলল,
“না, সায়র। আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি কেন সব ভুলে গেছি? কেন? কেন?”
সায়র ঠান্ডা মাথায় ঠিক করল আজ একটা রিস্ক নিয়েই ছাড়বে। মেহরিশকে নিয়ে বসালো খাটের উপর। ঠান্ডা মাথায় বলা শুরু করল,
বছর দুই আগে,
মির্জা বাড়িতে আগুন নিভে যাওয়ার পর দুটি মৃ°ত দেহ পাওয়া গেছিল। একটা লা°শ নীলিমা বেগমের শনাক্ত করার করা গেলেও, অন্যটি কার তা জানা যায়নি। সবাই ভেবেছে নিয়েছিল ওটাই মেহরিশ। যদি এটা মেহরিশের লা°শ হয় তবে আনায়া কোথায়? সাবিরের খোঁজ লাগানো শুরু হলো। পুলিশ, র্যাব, এমনকি একটা সিক্রেট তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। সকলের প্রচেষ্টায় সাবির সাহেবকে নিউইয়র্কে পালানোর সময় এয়ারপোর্ট থেকে জব্দ করা হলো। আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তার সব অন্যায়ের জবান বন্দি নেওয়া হলো। কিন্তু আদালতে নেওয়ার সময় সাবির সাহেব কিডন্যাপ হোন এবন্দ তার ২৪ঘন্টা পর সাবির সাহেবের ক্ষত-বিক্ষত দেহ ৩০০ফিট থেকে উদ্ধার করা হয়। কে বা কারা এই খু°ন করেছে তার হদিস এখনো মেলেনি। লা°শের পাশে এক চিঠির দেওয়া ঠিকানা থেকে সব শেষে খুঁজে পাওয়া গেল অচেনা এক মেহরিশকে যাকে মাথায় গুলি করা হয়েছিল। যে মেয়েটা তার সব সুন্দর, মুহূর্ত, স্মৃতি সব হারিয়ে ফেলেছে। মেহরিশকে খুঁজে পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি আনায়াকে। সায়র সম্পূর্ণ বাংলাদেশের কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি। ফোর্স লাগিয়ে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু আনায়ার খোজ পাওয়া যায়নি। মেহরিশকে বাচিয়ে রাখতে ডাঃ যত দ্রুত সম্ভব মেহরিশকে নিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার কথা বললে আবির সাহেব নিজের সব ক্ষত ভুলে দুই মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দিলেন নিউইয়র্কে। সায়র মেয়ে, স্ত্রী হারিয়ে একাকী এক জীবন উপহার পেল। এই দুই বছরে দুই হাজার বার সানায়া চেষ্টা করেছে সায়রের জীবনে নতুন কাউকে ঢুকানোর। সায়রের মাও বোধহয় কিছু কমতি রাখে নি। কিন্তু সায়র নিজের সিদ্ধান্তে অটল। চোখের সামনে মেহরিশকে অন্য পুরুষকে ছুঁতে দেখেও ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করেছে শুধুমাত্র একটু ভালো দিনের আশায়। কখনো মেহরিশের স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা অব্দি করেনি। সায়রের সৌন্দর্য, শরীর সব ধুকে ধুকে শেষ হয়েছে তবুও নিজের শক্তি, অধিকার বুঝে নেয়নি। ”
এইটুকু সায়র হাঁফ ছাড়ল। পুনরায় সায়র আর মেহনূর ভাগাভাগি করে অতীতের সব কিছু মেহরিশকে বলল। সবটা মেহরিশ শুনলে কিছু বলার আগেই জ্ঞান হারাল। সায়র দ্রুত মেহরিশকে হসপিটালে নেওয়া চেষ্টা করল। মেহরিশকে হসপিটালে এডমিট করেই ঠান্ডা মাথায় আগে মুন্নাকে কল করল। মুন্না ফোনের ওপাশ থেকে জানাল আনায়ার খবর পাওয়া গেছে। আনায়ার আসল পরিচয় খুঁজে আনায়াকে যত দ্রুত সম্ভব সায়রদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার জন্য আদেশ করল।
২৪ঘন্টা পর মেহরিশের জ্ঞান ফিরল। ডাঃ জানাল মেহরিশের পূর্ব স্মৃতি মনে পড়েছে। তবে রিস্ক এখনো কাটেনি। গভীর কোনো আঘাতে এবার সে জ্ঞান হারালে একেবারে কোমায় চলে যাবে। জ্ঞান ফিরতেই মেহরিশ সায়রের নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। সায়র কেবিনে ঢুকতেই মেহরিশ শব্দ করে কান্না করে ফেলল। বাচ্চাদের মতো দুটি হাত বাড়িয়ে দিলো। সায়র ছুটে গিয়ে মেহরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। পাগলের মতো চুমু খেতে শুরু করল মুখশ্রীতে। মেহরিশ কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“আমাকে ক্ষমা করুন, সায়র৷ আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি। বলতে পারিনি নিজের মনের কথা। আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি, সায়র।”
সায়র উত্তরে বলে উঠল,
“আমি জানি, আমার ভালোবাসা মিথ্যা না। আপনি আমার মানে৷ আমার থাকবে এই বিশ্বাস আমার ছিল।”
“আমার আনায়া! আনায়া! আনায়া কোথায়?”
সায়র থেমে গেল। ঠান্ডা কন্ঠে বুঝিয়ে বলল,
“আনায়া এই মুহূর্তে বাংলাদেশ।”
মেহরিশ আঁতঙ্কিত বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“কেন? আমার আনায়া কেন আমাকে ছেড়ে দূরে?”
সায়র আর মেহনূর সবটা ঠান্ডা মাথায় জানাল মেহরিশ। মেহরিশ নিজেকে সামলে বাংলাদেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল।
–
–
–
মাঝে কেটে গেছে প্রায় ১৫দিন। সায়র, মেহরিশ, আবির সাহেব, মেহনূর সবাই মিলে বাংলাদেশে ফিরেছেন। মেহরিশ বাংলাদেশে ল্যান্ড করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই সায়রকে অধৈর্য বাক্যে বলে উঠল,
“আমি আগে আনায়ার কাছে যাব। আনায়া কোথায়?”
সায়র মুন্নার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই মুন্নার দেখা মিলল। মুন্নার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গাড়ি চলতে শুরু করল। মুন্না এই ১৫দিনে আনায়ার পরিচয় থেকে শুরু করে সব কিছু ক্লিয়ার করে রেখেছিল। কুইন প্লাজা নামক এক রাজকীয় বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। মুন্না গার্ডদের পরিচয় দিতেই গার্ডরা ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। অনুমতি মেহরিশ সবার আগে দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই দেখল মেহরিশের বয়সী এক মেয়ে ও একজন ছেলে আর একটা ছোট্ট বাচ্চা সেখানে উপস্থিত। তিনজনে মিলে ছোটাছুটি খেলছে আর বাচ্চাটা খিলখিল করে হাসছে। আনায়াকে বছর দুই পর দেখে মেহরিশ ঘুরে পড়ে যেতে নিলে সায়র এসে ধরে নিল৷ ইশারায় বুঝাল,
“এই আমাদের মেয়ে। আমাদের আনায়া।”
মেহরিশ কান্না চেপে কান্নারত বাক্যে ডেকে উঠল,
“আনায়া! আমার মা! আমার আনায়া।”
বাচ্চাটা থেমে গেল।কিছুক্ষন মেহরিশের দিকে তাকিয়ে থেকে পেছাতে লাগল। পেছাতে পেছাতে রিন্তাহার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। ভয়ার্ত বাক্যে বলল,
“মাম্মা, কুলে।”
রিন্তাহা আনায়াকে কোলে তুলে নিল। মেহরিশ এতক্ষণে রিন্তাহার দিকে খেয়াল করল। চমকে উঠল। আকাশ থেকে পড়ল দুজনেই। এতক্ষণে সেখানে সায়র, মেহনূরসহ, আবির সাহেব সবাই উপস্থিত হয়েছেন। সবাই রিন্তাহা দেখে আকাশ থেকে পড়েছে। মেহরিশ অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,
“সু.সু.সুহা আপু…?”
রিন্তাহার চোখের কোনে অশ্রু জমল। কোনো কথা না বলে আনায়াকে রুয়াশের কোলে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসল মেহরিশের দিকে। মেহরিশ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। সুহা! সুহা আপু কি করে আসবে? এই মেয়ের সাথে সুহা আপুর এত মিল হলো কিভাবে? সুহা আপু তো অনেক বছর আগে মা°রা গিয়েছিল তাহলে..? মস্তিষ্ক প্রশ্নে জর্জরিত। আবির সাহেব থমকে প্রশ্ন করলেন,
“তুই আমার সুহা? নাকি অন্য কেউ?”
রিন্তাহা তখন কান্নারত বাক্যে জবাব দিল,
“আমি তোমারই সুহা, বাবাই।”
উপস্থিত সবার মাঝে আরেক ঝড় বয়ে গেল। মেহরিশ অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি বেঁচে আছো?”
রিন্তাহা ঠান্ডা মাথায় বলে উঠল,
“রাখে আল্লাহ মা রে কে? নীলিমা মির্জা আর সাবির মির্জার পরকিয়ার বলি হয়েছিলাম আমি আর আমার মা। সেদিনের এক্সিডেন্টে মা°কে বাঁচানো যায়নি। আমিও বেঁচে থাকতাম না যদি এই মানুষটা (রুয়াশ) না থাকত।”
মেহরিশের মাথায় এবার সর্বপ্রথম প্রশ্ন আসল,
“এক্সিডেন্ট! কিসের এক্সিডেন্ট? আমি তো জানতাম আমার জন্য তুমি ছাদ থেকে পড়ে মা°রা গিয়েছিলে।”
রিন্তাহা হাসল। বলল,
“নিশ্চয়ই এসব তোকে নীলিমা বেগম শুনিয়েছে।”
মেহরিশ হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। পুরো পরিবারের মধ্যে এবার বোঝা পড়ার লড়াই হলো। যে যার অবস্থান থেকে লড়াইয়ে জিতল। মান- অভিমানের পালা শেষ হলো। রিন্তাহা মেহরিশের কোলে আনায়াকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোর পরিকে ওই জানোয়ারের হাত থেকে আমিই বাঁচিয়েছিলাম। তোর খোঁজ নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। তাই তোর পরিকে আমি দুই হাতে যত্ন করে রেখেছিলাম। নে এবার তোর আমানত তোকে ফিরিয়ে দিলাম।”
মেহরিশের আনায়াকে কোলে নিয়ে অজস্র চুমুতে আনায়াকে ভরিয়ে দিল। সায়রও তাই। সবাই মিলে আনায়াকে ঘিরে ধরতেই আনায়া কান্না শুরু করে দিল। রিন্তাহার কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে রইল। রিন্তাহা কোলে নিতেই আনায়ার কান্না থেমে গেল। তা দেখে মেহরিশ অবশ্য শান্তিও পেল। মনে মনে ভাবল,
“মেয়েটা প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট পেয়ে বড় হয়েছে, আর কি চাই?”
মেহরিশ রিন্তাহার গাল টেনে ধরে বলে উঠল,
“দশ মাস পেটে রাখলাম আমি, আর বড় হয়েছে মাম্মাকে পছন্দ হয়ে গেল? দিস ইজ নট ফেয়ার, মা।”
মেহরিশের কথাই সবাই একসাথে হেসে উঠল। সায়র সেই হাসি দ্বিগুণ করতে মিনমিনিয়ে মেহরিশকে বলল,
“তাহলে এবার আনায়ার জন্য একটা ভাই আনা যেতেই পারে কি বলো?”
মেহরিশ লজ্জায় লাল হয়ে সায়রকে কনুই দিয়ে পেটে গুঁতো দিলো। সায়র কথাটা মিনমিনিয়ে বললেও সবাই শুনতে পেয়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল।
#সমাপ্ত