ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০৩

0
615

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তিন
“আমি গর্ভবতী জানা স্বত্তেও আমার মুখের উপর ডিভোর্স পেপার ছুড়ে গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে আমেরিকা চলে এসেছিলেন, মিস্টার আহিল। আমি বেঁচে আছি নাকি ম°রে গেছি একবারো জানার চেষ্টা করেননি। অথচ আপনি ছাড়া আমার তখন কেউ ছিলো না। আপনার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সবকিছু ভুলে গেছেন নিশ্চয়ই? ভুলে যাওয়ারেই কথা। পুরুষের নাকের যদি একবার পরনারীর ঘ্রাণ যায় তাহলে ঘরে বিশ্ব সুন্দরী থাকলে সে পরনারীর পেছনেই ছুটবে৷ এতকিছুর পরেও এখন আপনি নিজেকে আমার স্বামী বলে দাবী করছেন? পাশে গার্লফ্রেন্ড রেখে কিসের ভিত্তিতে এই দাবী করছেন, মিস্টার আহিল?”
মেহরিশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলতেই আহিল চোখ তুলে তাকাল মেহরিশের দিকে। সাথে সাথে উত্তর দিল,
“ডিভোর্স পেপার দিয়েছিলাম, ডিভোর্স না।”
সায়র এবার মুখ খুলল। কঠিন বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“ডিভোর্স, বিয়ে অথবা সম্পর্কে কোনো ফান করার বিষয় নয়, মিস্টার আহিল। আমার জানা মতে, আপনি শিক্ষিত। শিক্ষিত হয়ে অশিক্ষিতের মতো ডিভোর্সের মতো একটা বিষয় নিয়ে হেয়ালি পনা করছেন কিভাবে? আপনি ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়েই তো মেহরিশকে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, তখন মেহরিশ প্রেগন্যান্ট থাকায় ডিভোর্স হয়নি কিন্তু বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর তো ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যাবে। তাই নয় কী মেহরিশ?”
সায়রের মাথা থেকে এই বিষয়টা একদম বেরিয়ে গিয়েছিল। যখনি মনে পড়েছে তখনি মেহরিশের পিছু পিছু ছুটে এসেছিল। আর এসেই ঝামেলায় ফেঁসে গেল। তবে যাই হোক সায়র মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেই নিয়েছে মেহরিশকে কিছুতেই একা ছেড়ে যাবে না। আজ থেকে মেহরিশকে আর একা ছাড়বে না। ছায়া হয়ে মেহরিশ আর আনায়াকে আগলে রাখবে। সোহাগে, যত্নে বুকের ভেতর রাখবে। মেহরিশ ভালো না বাসুক, সায়র তো ভালোবাসে। তাতেই চলবে। সায়রের ভাবনার মাঝেই আহিল বলে উঠল,
“কিন্তু ডিভোর্স পেপারে যদি সাইন না করা হয় তাহলে কি ডিভোর্স হবে, মিস্টার সায়র?”
সায়র চমকে তাকাল আহিলের দিকে। আহিলের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে একবার নজর দিল মেহরিশের দিকে। মেহরিশ নিশ্চুপ দৃষ্টিতে একবার সায়রের দিকে তাকাল। সায়র সে চোখে স্পষ্ট অসহায়ত্ব দেখতে পেলো। তার মানে আহিল সত্যি বলছে! নাহ! এটা মানতে সায়রের বুক ফেটে যাচ্ছে। সায়র তবুও আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,
“সাইন করেননি মানে?”
আহিল এবার শান্ত বাক্যে শুধাল,
“আমি জানতাম মেহরিশ প্রেগন্যান্ট, সেই অবস্থায় আমাদের ডিভোর্স হবে না। তাই ডিভোর্স পেপার মেহরিশকে দিয়ে বলেছিলাম, বাচ্চা জন্মের পর সাইন করে কোর্টে জমা দিয়ে দিতে। যে কোনো এক পক্ষ সাইন দিলেই তো ডিভোর্স হয়ে যায়, তাই আমার সাইনের দরকার ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্ত কিছুদিন আগে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মেহরিশ আমাদের ডিভোর্স লেটার জমা করেনি। এমনকি আমাদের লইয়ারের সাথেও কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। তাহলে আমাদের ডিভোর্স হলো কি করে?”
সায়র যেন মাঝ সমুদ্রে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও শান্ত দৃষ্টিতে মেহরিশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেহরিশ।”
সায়রের করুন কণ্ঠের ডাক শুনে মেহরিশ ছলছল চোখে তাকাল সায়রের দিকে। সায়র পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“আপনি সাইন করেছিলেন, মেহরিশ? যদি করে থাকেন তাহলে কোর্টে জমা করেননি কেন? তারমানে কি আপনি সাইন করেননি? কেন করেননি, মেহরিশ?”
সায়রের কণ্ঠস্বর কাঁপছে। এক মুহূর্তের জন্য মেহরিশকে নিয়ে ভাবনাগুলো সব ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। মেহরিশ কী চায়? কি হয়েছিল অতীতে? মেহরিশ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিল,
“হ্যাঁ, আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করিনি।”
কথাটা সায়রের কুর্নকুহরে পৌঁছাতেই সায়র এক পা পিছিয়ে গেল। অবাক পানে তাকিয়ে রইল মেহরিশের দিকে। আনায়াকে বুকে ধরে রাখা হাতটা আলগা হয়ে এলো। পরক্ষণেই আবার আনায়াকে যত্ন করে বুকে ধরে রাখল। আহিলের মুখে হাসি ফুটল। হাস্যজ্বল বাক্যে বলা শুরু করল,
“আমি মাস দুই আগে বাংলাদেশেও গিয়েছিলাম কিন্তু মেহরিশের কোনো খোঁজ পাইনি। মেহরিশের বাবার বাড়ি গিয়ে জানতে পারি মেহরিশ ফ্যামিলি সহ আমেরিকা চলে এসেছে। এই দুই মাস এশহরেও কম খোঁজ করিনি। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি। পাইনি।”
বলেই আহিল কথাগুলো বলে থামতেই মেহরিশ চোখ তুলে তাকাল আহিলের দিকে। ঠোঁটে কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে জিজ্ঞেস করল,
“হঠাৎ কেন খোঁজ করেছিলে? যার হাত ধরে চলে এসেছলে সে কোথায়? আমাকে কেন দরকার পড়ল হঠাৎ?”
আহিল ফিক করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“আমি কি বলেছি আমার তোমাকে দরকার? তোমাকে আমার কখনোই দরকার ছিলো না। দরকার ছিলো তোমার টাকা। কিন্তু বাল তুমি এমন এক আধ পাগল যে টাকা পয়সা বা গয়না কিছু না নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু আমেরিকা চলে আসার পর চিন্তা করলাম, যতই হোক তোমার গর্ভের সন্তান তো আমারও সন্তান। এটা অস্বীকার করা যায় না। তোমাকে আমার দরকার নেই, কিন্তু আমার সন্তানকে আমার দরকার। ও আমার রক্ত। আমার রাজকন্যা। আমার রাজকন্যাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার তোমার নেই, মেহরিশ।”
আহিলের হাস্যজ্বল বাক্যের কথাগুলো মেহরিশের কানে পৌঁছাতেই মেহরিশের মনে হলো মেহরিশ জীবনে দ্বিতীয় বার ধাক্কা খেলো। এ ধাক্কাটা ছিল বড়সড় ধাক্কা৷ একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে, ভুলের উপর সংসার পেতেছিল, মেহরিশ? এতদিন ভাবতো যে আহিলের ভালোবাসা পরনারীর মোহে পড়ে পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ অথচ আজ এতগুলো বছর পর জানলো মানুষটা কখনো মেহরিশকে ভালোই বাসেনি। মেহরিশ দুই পা পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলেই সায়র ধরে ফেলল। বাহু আঁকড়ে শক্ত করে ধরে রাখল। ভরসা দিয়ে বলে উঠল,
“ভয় পাবেন না। আমি পাশে থাকতে আপনাকে পড়ে যেতে দিব না।”
আহিল বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
“তোমাদের ড্রামা অন্য কোথাও গিয়ে করো। এমনিতেই অনেকক্ষণ যাবৎ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মেয়েকে আমাকে দিয়ে দাও, মেহরিশ।”
মেহরিশ আঁতকে উঠল। ভয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
“না। কোনোদিন না। আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের কাছ থেকে আমাকে কেউ দূরে সরাতে পারবে না।”
আহিল হেসে বলল,
“আইন বলে কিছু আছে জানো তো? সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুল বাঁকাতে হয়।”
সায়র বাঁকা হাসল। আহিলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আইন আমাকে শিখাতে আসবনে না, মিস্টার আহিল। কারণ আমি একজন লইয়ার। আপনি কিসের ভিত্তিতে এইটুকু মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন? আপনি কী জানেন না, ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়ে ‘এডোলেসেন্স ’ হওয়া অব্দি মায়ের জিম্মায় থাকবে। বাবা আইনগত গার্ডিয়ান হলেও সন্তানের জিম্মাদার একমাত্র মা। তাই আপনি পৃথিবীর যেকোনো আদালতে গেলেও রায় একই থাকবে। সো, এসব সস্তার হুমকি অন্য কোথাও গিয়ে দেখাবেন। যতদিন আমি মেহরিশ আর আনায়ার পাশে আছি ততদিন কেউ ওদের ছুঁয়েও দেখতে পারবে না। আর হ্যাঁ, যত শিঘ্রই সম্ভব আপনার আর মেহরিশের ডিভোর্সের ব্যাপারটা আমি কনফার্ম করব। গুড বায়, মিষ্টার আহিল। দেখা হবে খুব শিঘ্রই, হয়তো কোর্টে।”
বলেই মেহরিশের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মেহরিশ থেমে গেল। সায়রের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল আহিলের দিকে। আহিলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে, সজোরে থা’প্পড় বসিয়ে দিল আহিলের গালে। আহিল গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠতেই, মেহরিশ হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবে রাস্তার কুকুররা ঘেউ ঘেউ৷ মানুষ না।”
বলেই মেহরিশ পার্স থেকে কয়েকটা ডলার নোট বের করে আহিলের মুখে ছুড়ে মে°রে বলে উঠল,
“নে তোকে ভিক্ষা দিয়ে গেলাম। এই ভিক্ষার জন্যই তো আমাকে ব্যবহার করেছিলে। আরো লাগলে বলিস। আমি আবার খুব দয়ালু মানুষ কিনা? ছোটলোক, ভিখারিদের হেল্প করার জন্য আমার মন কাঁদে খুব। নেক্সট কখনো আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ালে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না, মাইন্ড ইট। শালা কু°°ত্তার বা°চ্চা।”
বলেই মেহরিশ সায়র হাত শক্ত করে ধরে চলে আসল। সায়র শুধু তাকিয়ে মেহরিশের ভয়ংকর রুপটা দেখল। নারী যেমন প্রয়োজনে জল হতে পারে, তেমনি আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে আগুন হয়ে জ্বলে উঠতে পারে। মেহরিশের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ পানে তাকিয়ে সায়র হেসে ফেলল। মনে মনে বলে উঠল,
“এভাবে রাগবেন না, মেহরিশ। আমার বুকের বা পাশে থাকা যন্ত্রটা বেহায়া হয়ে উঠে।”

#চলবে