ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০৪

0
396

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চার
“আমার সন্তানের বাবা, আমাকে নাকি টাকার জন্য ভালোবেসেছিল! আমি যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলাম সেই মানুষটাকে আমাকে টাকার জন্য ভালোবেসে! শুনেছেন সায়র? আজকে আমার চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে যে, ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে দিয়েছে ভয়ানক যন্ত্রণা।”
বলেই মেহরিশ হা হা করে হেসে উঠল। সায়রের বুকে আনায়া ঘুমাচ্ছে। মেহরিশ হাসছে। আশ্চর্য জনক ভাবে মেয়েটার চোখে কোনো জল নেই। কেন? শুকিয়ে গেছে হয়তো। এতটা যন্ত্রণা নিয়েও কেউ হাসতে পারে সায়রের জানা ছিল না। মেহরিশ পুনরায় বলে উঠল,
“সায়র, শুনছেন?”
সায়র শান্ত বাক্যে জবাব দিল,
“শুনছি মেহরিশ।”
মেহরিশ আগের ন্যায় শান্ত বাক্যে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা সায়র, রাস্তার একটা কু°কুর যখন ম°রে যায় তখন কি কেউ কান্না করে? তাহলে কেন ভাবছেন, আমি কান্না করব? আহিল একটা নর্দমার কীট। ওই নোংরা কীটটার জন্য আমি যদি কান্না করি তাহলে আমার চোখের জল আমাকে অভিশাপ দিবে। আমার এই মুহূর্তে কী করতে মন চাচ্ছে জানেন?”
সায়র ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করল,
“কী?”
মেহরিশ হালকা হেসে জবাব দিল,
“ধারালো ছু°ড়ি দিয়ে আহিলের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে।”
বলেই শব্দ করে আবার হেসে ফেলল। সায়র শব্দ করল না। উত্তর দিল না। অবাক হলো না। নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছে। কিছু সময় দুজনের মাঝে নিরবতায় কেটে গেল। সায়রের মাথার মধ্যে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু এই মুহূর্তে করা উচিত হবে না ভেবে চুপ রইল। সারা রাস্তা দুজনের মাঝেই নিরবতায় কাটলো। মেহরিশদের বাড়ির সামনে আসতেই গাড়ি থামল। মেহরিশ সায়রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠল,
“আনায়াকে দিন।”
সায়র খুব যত্ন করে আলগোছে আনায়াকে বুক থেকে সরিয়ে মেহরিশের কোলে দেওয়ার আগে কপালে চুমু খেতে ভুলল না৷ মেহরিশ আনায়াকে নিয়ে কিছু না বলে নেমে গেল। নেমে কয়েক পা এগিয়ে থেমে গেল। সায়রের মুখটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। সামান্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য নয় কী ও? ভালো না বাসুক, বন্ধু তো করুক। আজ প্রায় ছয় মাস হতে চললো ওদের পরিচয় কিন্তু সম্পর্কের কোনো নাম নেই। তবুও সায়রের কোনো অভিযোগ নেই। চুপচাপ থেকে যায় মেহরিশের পাশে। সায়র দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিতেই কানে আসল,
“আমাকে ভালোবাসবেন না, সায়র। আমি আপনার ভালোবাসায় সায় দিতে পারব না। আমার আপনাকে শুধুমাত্র বন্ধু হিসেবে দরকার। জীবন সঙ্গী হিসেবে না। আর হ্যাঁ, আমার পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আসি। ভালো থাকবেন।”
বলেই হনহন করে চলে গেল। সায়র অসহায় চোখে মেহরিশের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুচকি হাসল। মনে মনে বলে উঠল,
“বাসবেন মেহরিশ৷ একদিন খুব ভালোবাসবেন। আমি আপনার ভালোবাসা অর্জন করে নিব। একটা স্নিগ্ধ, সুন্দর সকাল। আমার বুকের বা পাশে আপনি, আর ডান পাশে আনায়া। আপনি মুচকি হেসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলবেন ‘ভালোবাসি’। ব্যস! জীবনে এইটুকু পূর্ণতা, শান্তি না পাওয়া অব্দি আমি আপনার পিছু ছাড়ছি না। আপনার জীবনের শুরুতে হয়তো আমি নেই, কিন্তু শেষে থাকতে চাই।”



কলিং বেল বাজতেই নিলুফা বেগম এসে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলে মেহরিশের বুকে আনায়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মুখে হাসি টেনে বললেন,
“আমার নানুমনি ঘুমিয়ে পড়েছে তো। দেখি দে তো, আমার কোলে দে। কতক্ষণ কোলে নেই না।”
বলেই আনায়াকে মেহরিশের থেকে কোলে তুলে নিতে নিতে বললেন,
“কি দরকার আনায়াকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার? এখন প্রচন্ড শীত পড়েছে। মেয়েটার ঠান্ডা লেগে যাবে তো। কাল থেকে একদম ওকে নিয়ে বের হবি না বলে দিলাম।”
মেহরিশ প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। দরজা আটকে চুপচাপ এসে সোফায় বসে পড়ল। মাথার টুপিটা খুলে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখের কোনের অবাধ্য জলকে যতই আটকানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, জল কী আর নিয়ম মানার বেড়াজালে আটকে থাকে? কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেতেই মেহরিশ হকচকিয়ে উঠল। মাথা উঁচু করে দেখল আবির সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা নামক বিশ্বস্ত পুরুষটাকে এই মুহূর্তে খুব দরকার ছিল। মেহরিশ অশ্রুসিক্ত চোখে আবির সাহেবের দিকে তাকাতেই, আবির সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন,
“নো, নো, মাই প্রিন্সেস। ডোন্ট ক্রাই।”
বলেই মেহরিশের পাশে বসলেন। মেহরিশকে যত্ন করে বুকে আগলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
“তুমি তো জানো, মা। তোমার চোখের পানি আমার বড় শত্রু। কেন কাঁদছো, মা? কী হয়েছে? আমাকে বলো। আমি আছি তো।”
মেহরিশ ফুঁপিয়ে উঠল। বলতে শুরু করল,
“বাবা, জীবনের প্রথম ভালোবাসা, যত্ন, মায়া, আবেগ সব কেন ভুল পাত্রে দান করলাম? একটা ভুল আমার সারা জীবনের কান্না হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবা। কী করলে অতীত ভুলে যাবো, বাবা?”
আবির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার বুকের ভেতর কতটা যন্ত্রণা জমে আছে তা সে টের প্রতি মুহূর্তে টের পায়। কিন্তু কি করার আছে? মেয়েটাকে সব বিষাক্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই তো এখানে নিয়ে আসা। যেন সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে পারে। কিন্তু দুই বছর হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েটা এখনো স্বাভাবিক হতে পারলো না। এই দোষ কাকে দিবে? ভাগ্যকে নাকি মেহরিশকে? মেহরিশের এই অবস্থা জন্য কী ও নিজেই দায়ী? আবির সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তা ঠান্ডা মাথায় বলে উঠলেন,
“মা, অতীত ভুলতে নেই। মনে রাখতে হয়। স্মৃতিতে গেঁথে রাখতে হয়। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের প্রতিটা পথ সাবধানে চলতে হয়৷ অতীতে যা হয়েছে সব তোর ভাগ্যে ছিল৷ ভাগ্য তোমার হাতে নেই, মা। কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমার হাতে আছে৷ ভাগ্য কখনো সিদ্ধান্ত নেয় না। তোমার সিদ্ধান্তই তোমার ভাগ্যকে পরিবর্তন করে দিবে। তাই জীবনকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তটা কাজে লাগাও। সময় কখনো বসে থাকবে না। সময় থাকতেই সময়কে কাজে লাগাও৷ সব ভুলে এগিয়ে যাও সামনে। ভুল মানুষের জন্য অশ্রুপাত না করে, সঠিক মানুষের খোঁজ করো। জীবন তোমাকে দ্বিতীয় বার ঠকাবে না, দেখে নিও৷ এখন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তোমার উপর। শুধু মনে রেখো সবরকম পরিস্থিতিতে, সবসময় আমি তোমার পাশে আছি।”
কথাগুলো বলেই তিনি উঠে চলে গেলেন। মেহরিশ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। ভাবছে জীবনকে কী দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়া যায়? বাবা নামক পুরুষটাকে দেখলে ভালোবাসার স্বাদ জন্মায়। আর আহিল নামক পুরুষকে দেখলে ভালোবাসার স্বাদ ম°রে যায়। মেহরিশ কিছুক্ষণ একা একা ভেবে দৃঢ় স্বরে বলে উঠল,
“মিস্টার আহিল, আমি চাই একদিন আপনি আমার অভাবে অনুভব করেন। খুব করে আমাকে চাইবেন কিন্তু পাবেন না। আমার মতো করেই চিৎকার করে কাঁদেন। কাউকে ভালোবেসে একদম একা হয়ে যান। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যন্ত্রণায় আপনি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবেন। ভালোবাসা চাইবেন, কিন্তু পাবেন না। আমার মতো করে আপনাকে কেউ ভালো বাসবে না দেখে নিয়েন। ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবেন কিন্তু পাবেন না। আপনাকে এতকিছুর অভাব অনুভব করানোর জন্য হলেও, আমার জীবনকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন।”
বলেই মুচকি হাসল। সায়রের কথা মাথায় রেখে মিটমিট করে হেসে মনে মনে বলে উঠল,
“আমার জীবনে আপনাকে দরকার, সায়র। কিন্তু এত সহজে তো আমি আপনার ভালোবাসায় সাড়া দিব না। আমিও দেখি আপনি আমার জন্য কতটা অপেক্ষা করতে পারেন। ধৈর্য ধরতে পারেন। আপনাকে জলন্ত আগুনে পুড়িয়ে আমি খাটি সোনা যাচাই করে নিব।”

#চলবে