#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ১৭
#_আরজু_আরমানী
ধরায় ফাগুন এসেছে। চারদিকে ফাগুনের ফুল ফুটেছে। ইলেকট্রনিক্সের দোকানগুলোতে ফাগুনের গান বাজছে। প্রকৃতিতে ফাগুনের দক্ষিণা বাতাস বইছে। এমন একটা মধুর সময়ে রায়হান রেদোয়ান এবং মীরার দেখা হয়। সে বছর ‘ ফাগুনী সাংস্কৃতিক ক্লাবের ‘ নতুন উদ্ভোদন হয়। রায়হান ছিলো সেখানের প্রধান। মীরা সেখানে আসে নৃত্যের টিচার হয়ে। তার বয়সটা চঞ্চলতার। রায়হান ছিলো সেদিক দিয়ে এগিয়ে। বয়ঃসন্ধি পেরিয়েছে। মোটামুটি সুপুরুষ সে। এই নাচের মাধ্যমে দুজনের পরিচয়। দুজনেরই দুজনকে ভালো লাগে। তবে কেউই তাদের ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সময় এগিয়েছে। দুজনেই কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে যায়। সেখানে আবার দেখা। এই দেখাকে তারা পরিনয়ে রুপ দেয়। নবীন বরনের দিন রায়হান মীরাকে প্রপোজ করে। মীরা তক্ষুনি কোনো উত্তর না দিয়ে তার ঠিক দু’দিন পর এসে বলে,
‘ শোন তুমি কি আমায় বিয়ে করতে পারবে?’
আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে রায়হান তো ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তার মাথায়ই ধরেনা যে, এটা কেমন প্রশ্ন হলো? টানা দুটো দিন মানুষটার কোনো খোঁজ নেই, আজ হঠাৎ এসে বলে, ‘ তুমি আমায় বিয়ে করতে পারবে?’ এটা কোনো কথা হলো? সে তার ফ্যামিলিকে ম্যানেজ কিভাবে করবে? বাবা – মাকে রাজী কিভাবে করাবে? সে মাত্র পড়াশোনা করছে। এটা সম্ভব না। সে তখন মীরাকে বলে,
‘ আমরা কি একটু সময় নিতে পারিনা?’
‘ যেদিন সময় শেষ হবে সেদিনই আমাকে দেখার দ্বিতীয় সুযোগ পাবে এর আগে নয়।’
এটা ছিলো মীরার অভিমানের বানী। এরপর দু’ সপ্তাহ কেটে গেলো মীরার কোনো দেখা নেই। না সে ক্লাসে আসে, না তাকে অন্য কোথাও পাওয়া যায়। রায়হান তার বাড়িতে খোঁজ করতে পারেনি ভদ্রতার খাতিরে। মীরাও ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসে ছিলোনা। সে মুখোশের আড়ালে এসে ক্লাস, ক্যাম্পাস সব জায়গায় ঘুরতো আর রায়হানের ওই পাগল পাগল অবস্থা দেখতো। রায়হান তো পুরাই দেবদাস হয়ে গেছে। সে একদিন একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে,
‘ মীরা কি ক্যাম্পাসে এসেছে?’
‘ হ্যাঁ। ওতো লাইব্রেরীতে আছে।’
রায়হান লাইব্রেরীতে গিয়ে মীরাকে খোঁজে কিন্তু মীরা তার নাগালের বাইরে। রায়হান হতাশ হয়ে যেই লাইব্রেরী থেকে বের হবে তখন কেউ মীরাকে ডাকলো আর সাথে সাথে মীরাও সেই ডাকে সারা দিলো । রায়হান তখন সোজা মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মীরা তো অবাক। তবুও সে কিছু না জানার ভান করে বললো,
‘ কি ব্যাপার সামনে এসে কেনো দাঁড়ালেন? ‘
‘ মীরা তুমি কি আমাকে আজ এক্ষুনি বিয়ে করতে পারবে?’
এইবেলা মীরা নিস্তব্ধতা বজায় রাখলো। রাতের নিস্তব্ধতার আবিলতায় প্রকৃতি যেমন থমথমে মীরাকে এখন ঠিক সেরকম লাগছে। সে ভাবতেই পারছেনা রায়হান ব্যাপারটা এতো সহজে মেনে নেবে। তার পরিবারকে রাজী করিয়ে ফেলেছে। মীরার উত্তরের অপেক্ষা করেনি রায়হান। মীরার হাত ধরে লাইব্রেরী থেকে বাইরে নিয়ে এলো রায়হান।মীরা চুপ। আধা ঘন্টা পর তাদের বিয়ে পড়ানো শুরু হলে, মীরাকে কবুল বলতে বললে সে কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই কবুল বলে দেয়।
____________
ওরা দুজনে একটা মাটির ঢিবির উপর বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রায়হান চোখ ফিরিয়ে মীরার দিকে তাকালো। মীরাকে দেখতে নতুন বউদের মতো লাগছেনা। মীরা সালোয়ার কামিজ পরে আছে। তার মুখে কোনো প্রসাধনী নেই। চুল আচড়ানো নয়। এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। নতুন বউরা লাল বেনারসি পরবে, মুখে প্রসাধনী লাগাবে, ভারী ভারী গহনা পরবে। রায়হান কিছুক্ষণ পর মীরাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুমি নিশ্চুপ কেনো মীরা?’
মীরা এখনো নিরব। সে কপালের ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো কানের পিছনে নিতে নিতে বললো,
‘ তোমাকে বিয়ে করে ভালোই হলো। আর পড়াশোনা করবোনা। এবার আদা-জল খেয়ে সংসার করবো।’
‘ তুমি চাইলেও এই মুহুর্তে বাসায় জানানো সম্ভব নয় মীরা। তোমাকে হারাতে পারবোনা বলেই বিয়ে করে ফেলেছি।’
‘জানো রায়হান, আমার কোনোদিন সংসার হবেনা।’ অনেকক্ষণ চুপ থেকে কথাটা বলরো মীরা। রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ না না এটা তোমার ভুল ভাবনা। আমার পড়াশোনা শেষ হলে একটা চাকরি জুটিয়ে নিবো। তারপর তুমি আমার বাড়িতে আসতে পারবে।’
মীরা বসা থেকে উঠে দাড়ালো। বেঁধে রাখা চুলগুলো খুলে দিলো। দক্ষিনা হাওয়ায় উড়তে লাগলো চুলগুলো। মীরার মুখে ক্ষীন হাসি। রায়হান বারংবার এই মন মাতানো হাসিতে ঘায়েল হয়। মীরা ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,
‘ বাবা যখন মারা যায় তখন থেকে আমি একলা ছিলাম। মা অন্য কারো সাথে বিয়ে করে নিয়েছিলেন। মায়ের কোনো খোঁজ পাইনি। বড় আপার বিয়ে হয়ে গেছে। চাচার বাড়িতে থেকে জীবনের এতোটা পথ হেঁটেছি। আর নয়। এখানেই ইতি টানতে চাই। জীবনের বাকিটা পথ তোমার সাথে হাঁটতে চাই।’
‘ কিন্তু এখন তোমাকে বাসায় নিতে পারবো না।’
‘ সময় নাও। এখনি চাকরির জন্য এপ্লাই করো। আমি এখন বড় আপার বাসায় আছি।’
ওইদিনের পর প্রায় দেড় বছর পর একটা ক্লিনিকে রাত্রির জন্ম হয়। সেদিন রাতে রায়হান তার বাবা-মাকে মীরার কথা জানিয়েছে। কিন্তু তা জেনে রায়হানের বাবা মা বলেন,
‘ মীরাকে নিয়ে এ বাড়িতে তোমার ঠাঁই হবেনা রায়হান। তুমি কখনো তাকে এ বাড়িতে আনবেনা। সে তোমার বউ তুমি তাকে কিভাবে রাখবে সেটা তোমার ব্যাপার আমার নয়।’
এ কথা মীরা জানতেই সে বলে ওঠে,
‘ নীড়হারা পাখিরা কখনো নীর পায়না। আমি যদি মারা যাই তবে তুমি রাত্রিকে ও বাড়িতে নিয়ে যেয়ো। ও যেনো ঘরছাড়া না হয়।’
সময় এগিয়ে গিয়েছে আরো দুই বছর। রাত্রি তখন হাঁটতে পারে। মা, বাবা বলতে পারে। অন্য সব বাচ্চার তুলনায় সে একটু দেরীতেই কথা বলেছে। একটা ঝড়ের সন্ধ্যায় মীরা অনবরত কল করে যাচ্ছে রায়হানকে। রায়হান সেদিন তার মেয়ে এবং স্ত্রীকে বাড়িতে আনার জন্য তার বাবার সাথে রেগে রেগে কথা বলছিলো। ফোনের দিকে তার খেয়াল ছিলোনা। রাত নয়টার পর রায়হান ফোন করে জানতে পারে মীরাকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে। সে হসপিটালে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মস্তিষ্কে ইন্টারনাল হেমোরেজের কারনে মীরার মৃত্যু হয়। মীরা নেই। রায়হানের পুরো পৃথিবী এখন একাকিত্বে ভরপুর। সে পাগলপ্রায়। উসকোখুসকো চুল। জামা কাপড়ের কোনো হাল নেই। পাগলের মতো বাসায় যায় ড্রয়িংরুমে পরে থাকে। রায়হানের মা এসব দেখে আর সহ্য করতে পারেনি। নিজের সন্তানের কষ্ট কোনো মা সহ্য করতে পারেনা। সে রায়হানের বাবাকে অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখায়। ধীরে ধীরে রায়হানের মধ্যের সমস্ত সমস্যা দূর হয়। সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। রাত্রিকে তার আগেই রায়হানের মা নিয়ে আসে তাদের বাড়িতে। নিজের মেয়েকে পেয়ে মীরাকে ভুলে যায় রায়হান।
_______
রাত্রি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তখন রায়হানের বাবা-মা রায়হানকে আবার বিয়ে করতে বাধ্য করে তাহিরাকে। রায়হান তাহিরাকে বিয়ে করলেও তাহিরার প্রতি তার কোনো দ্বায়িত্ব ছিলোনা। সে তাহিরাকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে ট্রিট করেনি। সকালে রাত্রিকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওয়ানা হতো। ওকে স্কুলে দিয়ে সে অফিসে চলে যেতো। রাত্রির স্কুল ছুটি হলে তাকে নিয়ে নিজের অফিসে রাখতো। মেয়ের জন্য আলাদা একটা রুম নিয়েছে সে। রাতে বাসায় ফিরলেও সে রাত্রির সঙ্গে থাকতো। এসব তাহিরার সহ্য হতোনা। সে সতীনের মেয়েকে ঘৃনা করতো। রাত্রি তার চোখের বিষ ছিলো। এভাবে আরো দুটো বছর কাটলো। হঠাৎ একদিন তাহিরা এসে রায়হানের বাবাকে বললো,
‘ বাবা আপনার ছেলে অন্য একটা মেয়ের সাথে আছে। সে আমায় ডিভোর্স দিবে।’
তার কান্নাকাটি দেখে রায়হানের বাবা রায়হানকে অনেক মন্দ কথা শুনায়। এতে রায়হান আরো ক্ষিপ্ত হয়ে সত্যি সত্যি অফিসের একজন কলিগের সাথে সম্পর্কে আগায়। সে ভুলে যায় মীরার সেই ভালোবাসার কথা। মীরা নামে আর কোনো মানুষ তার জীবনে থাকেনা। সে ক্ষনে ক্ষনে একটু একটু করে রাত্রিকেও ভুলতে থাকে। এই সম্পর্ক একদিন তাহিরার কাছে উন্মোচিত হয়। সে পুরো পরিবারের কাছ এসব দেখিয়ে বেড়ায়। সেদিন থেকেই রায়হান তাহিরার সংস্পর্শে আসতে শুরু করে। তাহিরা অতি নিপুনতার সাথে রাত্রি আর তার বাবার মধ্যেকার দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। রাত্রির প্রতি তার আর কোনো ভালোবাসা থাকেনা। সে তখন আর নিয়ম করে রাত্রির সাথে কথা বলেনা। এসব দেখতে দেখতে একটা সময় প্রচন্ড বিরক্ত হয় রায়হানের বাবা মা। তারা তাহিরার মুখোশের আড়ালের চেহারাটা দেখে ফেলে। যা তাদের অনেক কষ্ট দেয়। তারা রাত্রির ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের বাড়িটা লিখে দেয় ওর নামে। আর সমস্ত সম্পত্তি দান করে যায়। এটা রাত্রি ব্যাতিত সবাই জানে। ওই বাড়ি হাতানোর জন্য তারা অনেকেই রাত্রির সাথে খাতির করতে আসে। কিন্তু প্রতিবারই সে বেঁচে যেতো। নেহার আম্মুর কথা শুনে আমি বলে বলে উঠলাম,
‘ আপনি এতো কিছু জানেন কি করে?’
নেহার মা হাসলেন। তারপর আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ রায়হান আর কতো চুপ থাকবে? এবার নিজেকে প্রকাশ করো।’
বাবা আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘ শিখা আপা তোমার মায়ের বড় বোন। সে সম্পর্কে তোমার খালা হয়।’
আমি এবার আরো অবাক হলাম। মিস শিখা তবে আমার খালা। আমার সম্পর্কে তিনি সব জানেন। হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় এলো। আমি সেটা মিস শিখাকেই জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আমার মায়ের কোনো ছবি আছে কি?’
‘ আয়নার সামনে যাও। নিজেকে দেখো। তোমার বাবা মীরার চেহারাই তোমাকে দিয়েছে।’ মিস শিখার কথা শুনে আমি ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। সাদের দিকে তাকালাম। তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মায়ের জীবনের কথা শুনে আমার এখন ভীষন কান্না পাচ্ছে। বাবাকে তখন বললাম,
‘ বাবা বাসায় যাবো।’
সমস্ত কিছুর অবসান করলেন বাবা।তিনি বললেন,
‘ আমি তোমাকে বিয়ে দিতে চাই।’
চলবে………