ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-১৮

0
341

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ১৮
#_আরজু_আরমানী

‘ আপনার প্রথম দেখাতেই বলে দেয়া উচিত ছিলো।’

‘ সেটা সম্ভব হতো না। তাই বলতে পারিনি।’

বাবা বলছেন তিনি আমাকে সাদের সাথে বিয়ে দিতে চান। এটা আমার কাছে একটা অবাক করার মতো বিষয় ছিলো। আমার বাবা, সাদের মা, এমনকি সবাই রাজি। সাদ নিজেও রাজি। বাবার মুখ চেয়ে আমিও সম্মতি দিয়েছি। তবে আমার সাদের কাছে কিছু জানার আছে। আমাদের বিয়ের আয়োজন চলছে। দুপুরের পর আমাদের বিয়ে। আমি সাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে সাদ দাঁড়িয়ে। সে আমাকে ভালোবাসে এটা তার আগেই আমাকে বলা উচিত ছিলো। তিনি তা বলেন নি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি বললেন,

‘ যখন থেকে ভালোবাসা বোঝার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই মা তোমার নাম করে এসেছে। তিনি বলতেন, ‘ সাদ তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে তাকে ঠকানো যাবেনা । আমি কতবার তোমাকে দেখতে চেয়েছি। কিন্তু কখনোই দেখতে পারিনি। হঠাৎ মা যেদিন তোমাকে দেখালেন সেদিন আমি নিজেই তোমার মায়ায় জড়িয়ে গেছি। সেদিনের পর থেকে তোমাকে দূর থেকে দেখতাম। তোমার স্কুলের সামনের দোকানে বসে থাকতাম। ‘

আমি সাদের কথা শুনে বললাম,

‘ আমি যদি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলতাম তখন কি করতেন আপনি?’

‘ আমার ভালোবাসা তোমাকে অন্য কারো হতে দিতোনা। তুমি শুধু আমার।’

আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি হাসলেন। দুপুরের তীর্যক রোদটা এসে তার মুখে লেপ্টে আছে। শুনশান নীরবতা। সাদ বসে পরলেন আমার হাত ধরে। আমি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি বললেন,

” রাত্রি আমি ন্যাকামি করতে পারিনা। আমার সোজা কথা আমি তোমাকে খুশি দেখতে চাই। সেটা তুমি আমার সাথে থেকে হোক বা অন্য কারো সাথে। তুমি খুশি থাকো।’

‘ওই চাঁদ মুখে
যেনো লাগেনা গ্রহন।
জোসনায় ভরে থাক
সারাটি জনম।’

সাদের গানের গলাও অনেক সুন্দর। তিনি গানটা আমাকে উদ্দেশ্য করে গাইছেন। এর মধ্যে নেহা এসে বললো,

” আপু তোমাকে আম্মু ডাকছে।”

নেহাকে দেখে সাদ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালেন। কলার ঠিক করতে করতে চিলেকোঠার ঘরটায় চলে গেলেন। আমি খালামনির সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি আমার গালে আলতো হাত ছুঁয়ে বললেন,

‘ তোর বিয়েতে দেয়ার জন্য তোর মা একটা বক্স রেখে গেছে। আমাকে বলে গেছে সেটা যেনো তোকেই দেয়া হয়। আমি এতোদিন সেই দায় নিয়ে ছিলাম। সেটা এখন তোকে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করলাম।’

আমার হাতে একটা স্বর্নালী রংয়ের বক্স। এটার উপর হাত রেখেছি। মাকে ছোয়ার চেষ্টা করছি। এই বক্সটা খুবই পাতলা। জানিনা এর ভেতরে কি আছে তবে এটা আমার মায়ের সেটা জেনে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। মায়ের প্রতিটা জিনিসই খুব শখের হয় মেয়েদের। আমি খালাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এর ভিতরে কি আছে?’

‘ সেটা তোমার মা জানে। আমি কখনো এটা খুলে দেখিনি।”

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। আমি একটা হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছি। এটাও নাকি আমার মায়ের । মায়ের যেদিন বাসর ছিলো সেদিন তিনি এই শাড়িটা পরেছিলেন। আজো সেই নতুন ভাঁজ। একটা মা মা গন্ধ। সাদ সাদা পাঞ্জাবি পরেছেন। এই ঘরটায় তাজা ফুলের গন্ধে ভরে উঠেছে। সাজানো ছিমছাম। আমি দক্ষিণ -পূর্ব দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে আছি। ফুরফুরে বাতাস আসছে। দোপট্টা খুলে রেখেছি। বাবা চলে গেছেন সন্ধ্যার অনেকটা পরে। আমার মন শুধু আকুপাকু করছে কখন সাদ ঘুমিয়ে যাবেন আর আমি আমার মায়ের দেয়া বক্সটা খুলবো। সাদ এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমরা দু’ জনেই চুপ। জানালার পাশে মাধবীলতার ফাঁকফোকড় দিয়ে চাঁদটা একটু একটু উঁকি দিচ্ছে।

‘ তোমাকে সাদামাটাই ভালো লাগে।’

অনেকক্ষণ পর সাদ কথা বললেন। আজ তার সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগছে। এমনকি তার পাশে দাঁড়াতেও লজ্জা লাগছে। আগে তো কখনো এমন হয়নি। আমি অকপটে তার সাথে কথা বলতাম। এটা আবার কেমন অনুভূতি? আজ নতুন বউ বলে এমন লাগছে। আচ্ছা প্রত্যেক নব বিবাহিত নারীদের কি এমন লজ্জা লাগে? সাদ তো আমার পরিচিত। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সাদ আবার বললো,

” সাদামাটাভাবেই তোমাকে দেখতে ভালো লাগে।’

‘ রঙচটা কখন লেগেছে?’

‘ তোমার ত্যাড়া কথা আর গেলো না।’ তিনি ফোস ফোস করতে করতে কথাটা বললেন। তাতে আমার কি? আমি কি তাকে বিয়ে করেছি বলে ভয় পাবো নাকি? না না এটাতো হবেনা। না রাত্রি না। কোনোভাবেই ভয় পাওয় যাবেনা। সাদ আবার চুপ করে আছেন। এইবার শুরুটা আমি করলাম,

‘ আপনাকেও দারুন লাগছে। ‘

তার মুখে এখনো সেই চমৎকার হাসি। তিনি জানালায় হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাকে একবার দেখে আবার বাহিরে চোখ রাখলাম। সাদ ঘড়ি দেখে বললো,

‘ ছাদে যাবে।’

চাঁদনী রাতে ছাদে যাওয়ার মজাই আলাদা। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলাম। সাদের পিছন পিছন হেঁটে ছাদে এসে দাড়ালাম। আবার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আমার হাতটা রেলিঙের উপর রাখা। তিনি আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

‘ ছেড়ে যেওনা।’

এই ‘ ছেড়ে যেওনা ‘ কথাটার মধ্যে একটা গাঢ় অনুভূতি জড়ানো ছিলো। তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেননা সেটা আমি জানি। তবে এতোটা মুখচোরা তা জানতাম না। তার অনুভূতি আমি বুঝতে পারি। আমি তার হাতে হাত রেখে হেসে হেসে বললাম,

‘ ছেড়ে যাওয়ার এই যুগে আপনি নাহয় থেকে যান। ‘

তিনি এইবার আমার হাত ছেড়ে আমার কপালে চুমু দিলেন। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। আমি জানি তিনি নিজেও এখন চোখ বন্ধ করে আছেন। কিন্ত না তিনি দিব্যি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মুখে হাসি। সে এক প্রশান্তির হাসি। আমি এইবেলা তার গাঁ ঘেষে দাড়িয়েছি। তিনি আকাশ পানে মুখ করে বললেন,

‘ সেই সন্ধ্যায় আকাশে মেঘের ঘনঘটা ছিলো। মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি মেঘগুলো বৃষ্টি হয়েধরার বুকে নেমে আসবে। আমি জানতাম তুমি রোজ এই পথে যাও। আজো যাবে। তুমি আসলে তবে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। দু’ হাত প্রসারিত করে হাঁটছিলে। চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে চিপচিপে হয়ে ছিলো। আমি দূর থেকে তোমাকে দেখছিলাম। তোমার কাছে যাওয়ার কোনো অধিকার ছিলোনা আমার। মনের মধ্যে তখন একটা গান বাজতে ছিলো।’

‘ কি গান?’ সাদ কথা শেষ না করতেই আমি প্রশ্নটা করলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি ভ্রু নাড়াতেই তিনি গান গাইতে শুরু করলেন,

”ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে”
” তোমার দেখা আমার সঙ্গে ”
” মুখোমুখি আমরা দুজন”
” মাঝখানে হাজারো বারন।’

হ্যাঁ। বারন ছিলো সেদিন। সত্যিই ছিলো। তিনি আমার মুখোমুখি থাকা সত্বেও হাজারো বারন। অদৃশ্য সে বারন। বৃষ্টি ভেজা সেই সন্ধ্যায় আমি সাদকে দেখেছিলাম তবে তাকে তা কখনো বলিনি। তিনি জানতে পারেননি আমি তাকে দেখেছি। তিনি সেদিন ফোন হাতে আমাকে দেখছিলেন। আমিও আড়চোখে তাকে দেখেছি। আমার মুখে কোনে হাসি দেখে সাদ বললেন,

” বৃষ্টিভেজা ভালোবাসা আমার।”

” রাগী, বদমেজাজী প্রেম আমার।”

দুজনেই ফিক করে হেসে ফেললাম। আমার মন এখনো পরে আছে সেই বক্সের রহস্য খোজার জন্য। ফেলুদা বইতে বাক্স রহস্যের মতো এখন সাসপেন্স রয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর এতোদিন পর, তার রেখে যাওয়া জিনিস আমি ছুঁয়ে দেখবো। এটা সত্যিই আনন্দের। সাদ কি ঘুমাবেন না? আবহাওয়া ঠান্ডা হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসের তোড়ে রাশি রাশি মেঘ এসে জমা হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি হবে। এতো গরমের মধ্যেও শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সাদ বললো,

‘ চলো। বৃষ্টি হবে।’

চলবে…….