#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৩
পৃথিলা পানি খেয়ে কাঠের বেঞ্চে’ই কিছুক্ষণ বসলো। কুলি লোকটা কৌতুহল নিয়ে তাকে দেখছে। অবশ্য এটা স্বাভাবিক। এমন অভাবনীয় সাহসের কাজ হয়ত কোন মেয়েকে তারা করতে দেখেনি। তাদের কাছে মেয়ে মানুষের অস্তিত্ব হয়তো রান্না ঘর আর উঠান পেরিয়ে পুকুরের ঘাট পর্যন্ত।
পৃথিলার শরীরের কাঁপুনি কিছুটা কমেছে। অবশ্য পেট মুড়িয়ে আসছে। খালি পেটে পানি, পেটের আর দোষ দিয়ে লাভ কি ? তখনি কুলি লোকটা তাড়া দিয়ে বললো,
— মা জননী! তাড়াতাড়ি উঠো। ঘাটে সারেং বাড়ির নৌকা দেখা যায়।
পৃথিলার এক ধ্যানে বসে ছিল। তার দৃষ্টি ছিলো ঐ যে রেল লাইন, অনেকটা দূরে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গেছে সেখানে। সে ধ্যান ভাঙতেই বললো — জ্বি?
লোকটা সুটকেস মাথায় তুলতে তুলতে বললো, — সারেং বাড়ি তো নদীর ওপারে। রাস্তা দিয়ে যাইতে গেলে দুনিয়ার ঘোরনা। তাছাড়া গাড়ি টাড়ি তো এতো রাতে পাইবা না। গরুর মহিষের গাড়ি। সব গোয়ালে চলে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটা ভ্যান আছে। রাত হলে তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল।
— কেন?
— হাবিজাবি খায় গো মা জননী। এই হাবিজাবিতে গ্রামডা একেবারে শেষ হইয়া গেলো। খেয়ে একেক জন একেক জায়গায় পড়ে থাকে। তাছাড়া চক পাথরের রাস্থা, রাত তো কম না। তাই ওই দিকে তোমার না যাওয়াই ঠিক হইবো। আর নৌকায় গেলে এই বড়জোর পনেরো বিশ মিনিট। তাদের ঘাটতো এই সামনেই। বলেই লোকটা এগিয়ে গেলো।
পৃথিলাও উঠলো, আধ খাওয়া পানির বোতলটা হ্যান্ডব্যাগ রেখে, লোকটার পেছনে এগিয়ে গেলো। অন্ধকারে তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ। সেই চাঁদের আলোতে লোকটা কি সুন্দর হেঁটে যাচ্ছে। পরিচিত গন্ডি এমনি। লোকটা অভ্যস্ত, সে নয় বলেই পারছে না।
পৃথিলার বেড়ে ওঠার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। তার বাবা পুলিশের চাকরিতে আছেন। নির্দিষ্ট সময় পর এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে। ছেলে বেলা থেকে বড় হতে হতে কতো পরিচিত মুখ অচেনা হয়েছে তার হিসেব নেই।
তখন তারা খুলনায়। সে সবে মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছে। তখন তারেকের সাথে পরিচয়। সেই পরিচয় কখন যে ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রুপ নিলো, তারা বুঝতেই পারেনি। বাবা, মা জানতে পারলেন। তার অতি চালাক মা তাকে না কিছু বললেন, না কিছু বুঝতে দিলেন। তবে বাবাকে ঠিক অন্য জায়গায় ট্রান্সফারের জন্য বললেন। কিছুটা সময় অবশ্য লাগলো। তবে ঠিক হয়ে গেলো।
আগে কথা ছিল বাবার যদি হঠাৎ ট্রান্সফার হয়, সে হলে উঠবে, পড়ালেখা শেষ করে একেবারে যাবে। তবে তাকেও নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে সে অবাক হয়েছিল। তবে কিছু বলে নি। মা তাকে নিয়ে সব সময়’ই একটু অন্য রকম। কখনোও একা ছাড়েনি, কোথাও একা যেতে দেয়নি। এমনকি অচেনা মানুষের সাথে তার সব সময় খুব একটা মেশাও ছিল বারণ। তাই তার কাছে স্বাভাবিক’ই লাগলো। ভাবলো মা এবারো তাকে একা ছাড়বে না। তাই চুপচাপই খুলনা থেকে চলে এলো ঢাকায়।
অথচ কোন কারণে এই ঢাকায় মা কখনো আসতে চায়নি। অথচ তার নানু বাড়ি, দাদা বাড়ি থেকে শুরু করে সব আত্মীয় স্বজন’ই ঢাকায়।
ঢাকায় এসে তাকে আবার নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি করানো হলো। মা জানে না। তারেকের সাথে তার যোগাযোগ কিন্তু ঠিক রইলো। তাদের সামনা সামনি প্রেমের চেয়ে, এই যে কথা জমিয়ে জমিয়ে চিঠি লেখা। সপ্তাহে একদিন লুকিয়ে দোকান থেকে ল্যান্ড লাইনে কথা বলা। সেই প্রেমের চেয়ে এই প্রেম যেন তাদের আরো গভীরে টেনে নিয়েছিল।
এখানেও বছর এক গেলো খুবই ভালো ভাবে। কয়েকজন বন্ধু বান্ধবও জুটে গেলো। এদের সাথে কেমন করে একটা বছর কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। তবে সমস্যা হলো বছর খানেক পরে। তার মা একদিন খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন, — তোমার বাবার বন্ধুর এক ছেলে। খুবই ভালো। আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা তোমার বিয়ের ব্যাপারে ভাবছি।
পৃথিলা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আর তাকে আরো অবাক করে বললেন। ছেলে বাহিরে সেটেল। বিয়ে করে বউ নিয়ে ফিরবে। আমরা তোমার পাসপোর্ট থেকে যাবতীয় সব কিছু করার জন্য দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু বিয়েটা বাকি।
পৃথিলা অবাক হয়েই বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা হাসলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন, — বাবা, মায়েরা কখনো ছেলে মেয়েদের খারাপ চায় না পৃথি মামনি। শুধু বিশ্বাস রাখো।
সে বিশ্বাস রাখেনি বরং দৃঢ় কন্ঠে বলেছিল, — আমি একজনকে ভালোবাসি বাবা। যদি বিয়ে করতে হয়, আমি তাকেই করবো।
তার বাবা কোন রিয়্যাক্ট করেনি শুধু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। তবে তার মা এগিয়ে ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল।
পৃথিলা মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো। স্টেশনে আলো থাকলেও ঘাট টা একেবারেই অন্ধকার। গাছ গাছালি আছে তাই চাঁদের আলোয় তেমন আলোকিত হয়নি। তবুও পৃথিলা আবছায় আলোয় একটা নৌকা দেখলো। অবশ্য একে নৌকা বলে কিনা সে তাও জানে না। কেননা নৌকাটা খুবই বড়। সে এত বড় নৌকা কখনো দেখে নি।
সে ধীরে ধীরে এগুলো! ঢালু জায়গা। অন্ধকারে পড়ে টড়ে না গেলেই হয়। তখনি মুখের উপরে চর্চের আলো পড়ল। পৃথিলা চোখ মুখ কুঁচকে হাতের পাঁচ আঙুল ছড়িয়ে চোখটা আড়াল করলো। করতেই কেউ ধমকে বললো — কে ওখানে?
কুলি লোকটা বললো, — ফরহাদ বাবা, আমি কুদ্দুস। সাথে সারেং বাড়ির কুটুম। রাত তো মেলা। তার মধ্যে মাইয়া। তাই তোমাগো নৌকা দেইখা ঘাটে নিয়া আইলাম।
অন্ধকার ভেদ করে ফরহাদ এগিয়ে এলো। টর্চের আলোটা সাইড করা হয়েছে। এতক্ষণ কিছু না দেখলেও সুন্দর, উঁচা লম্বা এক ছেলেকে পৃথিলা দেখলো। যে ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে নৌকাে মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিলার দিকে তাঁকিয়ে বললো, — কে আপনি?
পৃথিলাও নিজের কোমলতা বজায় রেখে উল্টো প্রশ্ন করলো, — আপনি কে?
লোকটার মনে হয় অকারণে বিরক্ত হওয়ার বাতিক আছে। আসলে সে জানতে চেয়েছে সারেং বাড়ির সে কে? কেননা, পরিচয় দিলেই চিনবে। এমন তো সে কেউ না। অথচ লোকটা বিরক্ত চোখে মুখে উপচে পড়ছে। সেই উপচে পড়া বিরক্ত নিয়ে তাকে আর তার প্রশ্ন কে পুরো উপেক্ষা করে কুলি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, — কুদ্দুস কাকা। ঘাট থেকে একে নিয়ে বিদায় হন। বিয়ে শেষ, কুটুম কাটুমোর কাহিনীও শেষ। জুরুরি কাজ আছে। ঘাট ফাঁকা করেন।
কুদ্দুস কি করবে দিশে পায় না। এই রাত বিরাতে বোঝা তো ঘাড়ে নেয় নি সে, নিয়েছে আস্ত এক ঝামেলা। কি করবে সে?
পৃথিলা একটু এগিয়ে এলো, এসে বললো, – আসলে পরিচয় দেওয়ার মতো আমি কেউ না। তবে একটা চিঠি আছে। আপনি কি একটু দেখবেন।
ফরহাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অন্ধকারে তেমন চোখ, মুখ বোঝা না গেলেও, সে ঠিক বুঝলো এই মেয়ে গ্রামের কেউ না। সে তাকিয়ে’ই বললো, — দিন।
পৃথিলা হ্যান্ড ব্যাগের সাইড থেকে চিঠি বের করে এগিয়ে ধরলো। তাদের মাঝে দূরত্ব অনেক। ঢালু জায়গা, পৃথিলা খুব একটা এগুতে পারেনি।
ফরহাদ নিজেই নৌকা থেকে এক কদম নামলো। নামতেই তার পা পড়ল কাদায়। সে বিরক্ত মুখেই ঝট করে কাগজটা টেনে নিলো। মেয়েদের দেখলেই তার চড়াতে ইচ্ছে করে। সব আপদের গুষ্টি। এই রাত বিরাতের একে একা ছাড়ছে কে? এদিকে আরেকটাকে এখনো ঘাড় থেকে নামাতে’ই পারেনি। জয়তুন বুড়ির সব লোক পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। এতো ঝামেলা হবে জানলে আগে হাত ধুয়ে বসে থাকতো। এখন ঘাড়ে নিয়ে রাত বিরাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে এক হাতেই টর্চ ধরে এক ঝাঁকিতে চিঠির সব ভাজ খুললো। খুলতেই দেখলো চিঠিতে একটা শব্দ’ই লেখা। শায়লা!
ফরহাদের বিরক্ত যেন এবার আকাশ ছুঁলো। তাই প্রায় ধমকে বললো, — ফাজলামি করেন?
পৃথিলা বলতে গেলে ধাক্কার মতো খেলো। তার এই জীবনে এমন কর্কশ ভাষায় কেউ কিছু বলেছে বলে মনে পড়ে না। সে নিজেকে সামলে বললো, — ভদ্র ভাবে কথা বলুন। যদি নৌকায় না নিতে চান। সমস্যা নেই! আমি চলে যাচ্ছি। বলেই কুলি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, — চলে আসুন চাচা।
তখনি অন্ধকার ভেদ করে সুন্দর মার্জিত শান্ত একটা কন্ঠ ভেসে এলো, — ঠিঠিতে কি লেখা ফরহাদ?
পৃথিলা ফিরে তাকালো। নৌকাটায় এতোক্ষণ ছিল অন্ধকার। একটা লোক, মনে হয় মাঝি। ছোট একটা হারিকেন জ্বালালো। টিমটিম হারিকেনের আলোতে একটা লোককে দেখলো। সম্ভবতো গায়ের রং শ্যামলা বা কালো । অন্ধকারে খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে জ্বলজ্বল করা চোখ ঠিক দেখলো। নিশুতি রাতে হিস্রপশুদের চোখ এমন জ্বলজ্বল করে। এই লোকটার এমন করছে কেন কে জানে। কই এই বেয়াদব লোকটার তো করছে না। অবশ্য চোখ আর কণ্ঠ কেন জানি পৃথিলা মেলাতে পারলো না। চোখ দেখে মনে হচ্ছে আগুন আর কন্ঠ মনে হচ্ছে শীতল পানি। এমন হওয়ার কারণ কি?
পৃথিলা চোখ ফিরিয়ে নিলো। লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে চোখ ফিরিয়ে আবার ফরহাদ নামের লোকটার দিকে তাকালো। তার বিরক্ত চোখ মুখ ছাড়িয়ে গেছে। আশ্চর্য! এতো বিরক্তের হলোটা কি? একটা মেয়ে কি সাহায্য চাইতে পারে না।
তার তাকানোকে আবার পুরো উপেক্ষা করে ফরহাদ ওই লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — নে দেখ!
লোকটা একটু এগিয়ে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলো। নিয়ে চোখ রাখলো। এই আবছায়া আলো অন্ধকারেও পৃথিলা লোকটার চোখে মুখে বিস্ময় দেখলো। আশ্চর্য! কি লেখা চিঠিতে। চিঠিটা দিয়েছে সাবিহার বাবা। সাবিহাই তার বান্ধবী, যার এই গ্রামে বিয়ে হয়েছে। সাবিহা তাদের বাড়িতে গেলেও তার কখনো যাওয়া হয়নি। না যাওয়ার কারণ আছে। ঐ যে বললাম তার মা তার সব ব্যাপারেই ছিল একটু অন্য রকম। তাই কখনো যাওয়া হয়নি। এই চাকরির জন্যই গিয়েছিল। গিয়ে রিতিমতো সে বিস্ময় হয়েছে। কেননা সাবিহার বাবা, মা তাকে দেখেছে প্রথম বার। তবুও খুব’ই স্নেহ করলেন। সুন্দর করে ঠিকানা দিলেন। তার সাথে দিলেন এই ঠিঠি। দিয়ে কোমল সুরে বললেন, — “যদি সারেং বাড়ির ছেলে, নাতি এমন কাওকে দেখো তবে এই চিঠিটা দিও। কোন সমস্যা হবে না। তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে। ” পৃথিলা তাই প্রথমে’ই জিজ্ঞেস করেছে আপনি কে? অথচ এই এক প্রশ্নে এই লোকের গায়ে ফোসকা পড়ে গেছে।
সে সেই বিস্ময় নিয়েই পৃথিলার দিকে তাকালো। তাকিয়ে আগের মতোই সুন্দর শান্ত ভাবে বললো, — চাচা, সুটকেস নৌকায় তুলেন। তারপর ফরহাদ নামক লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, — সুন্দর করে তক্তা ফেল ফরহাদ। নৌকার উঠতে যেন কোন সমস্যা না হয়।
ফরহাদ নামক লোকটা কটমটিয়ে তাকালো। আদেশ পছন্দ হয়নি দেখেই বোঝা গেলো। তার কটমটানো চাউনির বিপরীতে লোকটা সরল, সুন্দর, মন ভোলানো একটা হাসি দিয়ে বললো, — আমাদের কাজ দু’মিনিট পরে হলেও এখন আর সমস্যা নেই। তারপর পৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — আমি এরশাদ। সারেং বাড়ির বড় নাতি। আপনি উঠে আসুন। আর ধীরে ধীরে। কাদা পানিতে ঘাট খুব পিচ্ছিল।
______
জয়তুন বেগম পান নিয়ে মুখে পুরলেন। দাঁত নেই তার। আম্বিয়া পান ছেচে ভর্তা করলে সেখান থেকে নিয়েই একটু একটু পুরেন। আজও আম্বিয়া তার পায়ের পাশে পা ছড়িয়ে বসেই পান ভর্তা করছে। জয়তুন সেই পা ছড়িয়ে বসা আম্বিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আম্বিয়ার শরীরের বাঁধ ভালো। কাপড় পরে কোমরের ভাঁজ আর পিঠ দেখিয়ে। হাঁটবেও হেলে দুলে। বুকের কাপড় দেখা যায় বেশিভাগই সাইডে গাড়াগাড়ি খাচ্ছে। বসত ভিটায় এক পাল ছেলে পেলের বাড়িতে এমন কুক্ষণে শরীরের বাঁধের মেয়ে মানুষ রাখতে নেই। জয়তুন জানে, তবে মেয়েটা ভালো আর তার বিশ্বস্ত। সেই ছোট বেলা মায়ের হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল। এখন বয়স প্রায় ত্রিশ ছুঁইছুঁই। দেখে অবশ্য বোঝা যায় না। কাজ কামের শরীর, এই শরীরে মেদ জমে না।
জাফর মায়ের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করলো। তার মায়ের দাঁত পড়তে পারে, চুল সাদা পাটের গাছি হতে পারে, চামড়া ঝুলে ভাঁজ পড়তে পারে তবে মুখ, চোখ আর ব্রেইন সেটা এখনো আগের মতোই চলে। চলে বলেই কর্তী ছাড়া এই সারেং বাড়ির সংসার এখনো ঠিক গতিতে চলছে।
জাফরের মা জয়তুন তার আপন মা না। সৎ মা! তার ঘরে কোন সন্তানাদি নেই। নেই বলেই তার বাবা তার মাকে বিয়ে করেন। করেও বিশেষ কোন লাভ হয়নি। বছর ঘুরে নতুন বছর আসে তবুও বংশের বাতি জ্বলে না। তার বাবা হাল ছাড়লেন। তিনি ধরেই নিলেন তার বংশ আর আগাবে না।
জয়তুন আরা এক সন্তার দত্তক আনলেন। সেই দত্তক পুত্রের নাম জসিম। দত্তক থাক আর যাই থাক। বাড়ির প্রথম সন্তান সে। সবার মাথার মুকুট হয়ে রইলেন। সেই থাকার মাঝে অনেক দিন পরে জাদুর মতো হঠাৎ করে জাফরের মা, মা হতে চললেন।
জসিমের বয়স ততদিনে পনেরোর ঘরে। স্বাভাবিক সবার ধ্যান তখন জাফরের মায়ের দিকে গেলো। হাজার হলেও রক্ত। আসল রক্ত! তবে জয়তুন মুখ ফেরালেন না। তিনি জসিমকে আগের মতোই আগলে রাখলেন। আর ঘোষনা দিলেন, — সারেং বাড়ির বড় পুত্র সে। এটা যে অস্বীকার করবে, তার সাথে জয়তুনের ইহো জীবনের সম্পর্ক শেষ হবে।”
জাফরের বাবা সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করুক আর যাই করুক। জয়তুন উপরে তিনি কথা বলতেন না। এবারো বললেন না। তবে নিজের সন্তান তো নিজের’ই। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর যত্নে কোন কমতি রাখলেন না। আর এই যত্নেই যেই বউ কখনোও মাথা তুলে কিছু করেনি, বলেনি। কয়েক দিনেই তার আচরণ বদলে গেলো। বংশের আসল বাতি তার গর্ভে চাট্টি খানি কথা তো আর না। সবচেয়ে বেশি বদলালো জসিমের উপরে।
সেই ঘরেরই জাফরকে জন্ম। আর তাকে জন্ম দিতে গিয়েই তার মা মৃত্যু বরণ করেন। জাফরের মা সন্তান আসার খুশিতে, অহমে দত্তক পুত্র জসিমকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেও, তার মৃত্যুর পরে জয়তুন কিন্তু করলেন না। তিনি জসিমের মতো জাফরকেও বুকে আগলে নিলেন। জসিম, জাফর তারা কখনোও বুঝেনি এই যে পাগলের মতো দেখতে থুরথুরে বুড়িটা। এটা তাদের সৎ মা। বরং বাবার মৃত্যুর পরে এই বাড়িটার উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটায়’ই গেছে। তিনি তার দু’সন্তানকে বুকে নিয়ে শক্ত হাতে তা পার করেছেন।
জয়তুন পান চিবুতেই চিবুতেই জাফরের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — আমাদের বাড়ির সম্মান নিয়ে যেই মেয়ে খেলছে। তাকে খুঁজে বের করবি জাফর। যেমনি হোক করবি। আমিও দেখতে চাই তার শরীরে ভাঁজ কত? আমার নাতি যে ভাঁজ গুনতে পারে নাই। যেই ভাঁজ আমিতো আর কারো রে গুনতে দেবো না। আর মেয়ের চাচারে চিপড়ে রস বের করবি। হারামদাজা! লেদা একটা মাইয়া, তারে দেখে রাখতে পারে না। জমির জন্য তো ঠিক কচলা কচলি। জমি ওর পেছন দিয়া মুচড়ে মুচড়ে ঢুকাবি, বদমাইশের বদমাইশ।
— তাদের দোষ দিয়ে কি লাভ ? মাথা তো আপনি’ই নষ্ট করেছেন। কোন দরকার জমির লোভ দেখিয়ে বাড়ির বউ আনার। তাছাড়া এরশাদও রাজি না। এভাবে জোর করে এনে অশান্তির কোন দরকার আছে।
— দরকার তুমি বুঝবা কি? সন্যাস হয়ে তো বসে আছো। বউ থাকতে বাপে করছে দুই বিয়া। এদিকে বউ নাই তাও যতো ঢং। তাও গুণের বউ হইলে কথা। বংশের বাতি তো দিবার মুরোদ ছিল না।
— আমার নিজেরও দুই বিয়ে আম্মা। আপনি না মানলেও সত্য সত্যই। তাছাড়া আপনার বোনের মেয়ে, বিয়েও তো আপনি করিয়েছিলেন।
— ইশ! কতো বড় গলা। দুই বিয়ে! দুই বিয়ে করেও তো একটা বাতি দিবার পারলি না। আবার বড় গলায় কথা।
জাফর উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে করে চোখ ফিরিয়ে নিলো। জয়তুন দেখে বললো, — চোখটা বন্ধ করি তারপর দেখবি সারেং বাড়ি কেমনে ভাইসা যায়।
— কারো জন্য কিছুই থেমে থাকে না আম্মা।
— জয়তুনের জন্য থামবো। তাইতো দ্বিতীয় জয়তুনরে খুঁজি। তবে আল্লাহ বানাইছে এক পিছ। তাইতো বড় জ্বালা।
— তাই বলে এভাবে বিয়ে ঠিক না। বলেই জাফর মনে মনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে নিজেও এই রকম ভূক্তভোগী। আর এই দোষেই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা সে হারিয়েছে।
জাফরের কথায় জয়তুনের মধ্যে কোন হাবভাব হলো না। জাফর সব সময়’ই এমন। বাপের রুপ পাইছে। তাদের বাপ ছিলো এমন। নীতিবান! আরে এতো নীতি দিয়া দুনিয়া চলে নাকি?
সে আঙুলের ডগা দিয়ে আরেকটু পান নিয়ে মুখে পুরলো। তার নীতির আবার ধার ভিন্ন। নিজের জন্য যেটা ভালো। সেটাই আসল নীতি। সেই নীতির জন্য সব জায়েজ। তাইতো তিনি বিশ্বাস করেন, মেয়ে বিয়াবে উঁচুতে , ছেলে বিয়াবে নিচে। জমি টমির লোভ কিছু না। জমি দিয়ে আনা মানে হাতের মুঠোয় আনা। চোখ তোলার সাহস কখনো করে না। তবে এই মেয়ে আনার আরেকটা কারণ আছে। কারণটা আলাউদ্দিন! আলাউদ্দিনের কোন আনোখি ক্ষমতা আছে কি না, সে জানে না। তবে মাঝে মাঝে কিছু কথা একেবারে মিলে যায়। সেই মিলে যাওয়া থেকেই বলেছিলো, — এরশাদ কে কখনো বিয়ে দেবে না সখি। তার বউ সারেং বাড়ির জন্য ঘোর অমাবস্যা।
অমাবস্যা হলে হোক! জয়তুন কারো রে গোনায় ধরে নি। তাই বিয়ের আয়োজন করেছিল। তবে সেই মা** আমার এরশাদকে দেখেই ফিট খাইয়া শেষ। কইতরীর কইতরী! ঢং দেখে আর বাঁচি না। বেটা মাইনষের আবার চেহেরা কি? বেটা মাইনষের দেখবি গতর। আর আমার এরশাদের গতর থেকে আলো বের হয়, আলো। চিকচিক করা আলো। খাঁটি সোনা সে! তোর কপাল খারাপ তাই তা দেখার আগেই ফিট।
তবে অনেক দিন পরে আলাউদ্দিন এই মেয়ের কথা নিজে থেকে’ই এসে বলল। বললো, — এই মেয়ে সোনা কপালী! যেই ঘরে যাইবো ঘর আলো হইবো। এরশাদের জন্য এই মেয়ে একবারে ঠিক। তাই সে আর ডানে বামে দেখলো না। এই মেয়েকে তো তার চাই’ই চাই। আলাউদ্দিনের বাণী বলে কথা।
তাই জয়তুন শুনে সাথে সাথে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠালো। জমি টমির লোভ দেখিয়ে বিয়ের কথা পাকা করলো। সেই পাকার মধ্যে আলাউদ্দিন এসে তাড়া দিয়ে বললো, — যতো তাড়াতাড়ি পারো এই মেয়েকে ঘরে আনো। পারলে আজ’ই আনো।
সে ভাই আগা মাথা বুঝলো না। তবে বিয়ে টেনে আজকের মধ্যে ঠিক’ই এনেছিল। আর দেখো কপাল! এই মেয়ে নাকি সোনা কপালী। তোর সোনা কপালে থু, মনে মনে বলেই জয়তুন থুক করেই পানের পিক ঘরের মধ্যেই ফেললো । এটা তিনি প্রায়’ই করেন। তার বদ্ধ ধারণা এই বাড়িই কুফা। পুরোনো হিন্দুদের বাড়ির। মুক্তি যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দুরা বাড়ি ঘর কম দামে বিক্রি করে চলে গেছে। তার স্বামী কিনে রেখেছেন। যার কাছ থেকে রেখেছিলেন, সে ছিলো স্বর্ণ ব্যবসায়ী। বাড়িটাও করেছিলেন দেখার মতো। এখনো অবশ্য দেখার মতোই আছে। তবে তার ধারণা কোন পিশাচ রয়ে গেছে। তারাই সারেং বাড়ির পেছনে লেগে আছে।
কেননা এই বংশে লেগে আছে কুফা। তার ঘরে সন্তান নাদি নাই। জাফর হইছে জাদুর মতো। হইলে কি, জাফরের ঘর ছিল শূণ্য। আর বড় ছেলে, আল্লাহ তার ঘরে তিন সন্তান দিছে। দিলে কি হবে। আসল রক্ত তো নাই। কপাল, সবই কপাল।
সে থু ফেলেই বললো, — এরশাদ কই?
— স্টেশনের দিকে গেলো। কি নাকি কাজ আছে।
জয়তুন ভ্রু কুঁচকে বললো, — এত রাতে কি কাজ?
— আমি জানি না আম্মা।
জয়তুন কথা বাড়ালো না। নাতি নাতনী তার প্রিয়! শুধু প্রিয় না। তার নীতি হলো যে দু’হাত ভরে দেবে, সেও দু’হাত ভরে তাকে দেবে। আর এরশাদ, সে তার জন্য পুরো জীবনটা বাজি রেখেছে। আর এই যে শাহবাজ, দাদির মুখের এক একটা কথার জন্য সে দুনিয়া উল্টে ফেলতে পারে। এখনো ফেলবে, সে জানে এই মাইয়া আকাশ ফুঁড়ে উড়ে গেলেও, শাহবাজ যে কোন উপায়ে তার সামনে ঠিক হাজির করবে।
চলবে……