#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৮
সারেং বাড়ির সকালটা শুরু হলো আর পাঁচ দশটা দিনের মতোই। সূর্যের মুখ দেখতেই বাড়ির সব কয়টা জানালার কাঠের কপাটগুলো খুললো প্রতিদিনের নিয়মে, বাসি ঘর, উঠানে ঝাঁট পড়ল। গরুর গোয়াল থেকে বালতি ভরা দুধ রান্না ঘরে এলো, মাটির উনুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তবে ভাঙা বিয়ে বাড়ির কোন লক্ষণ খুব একটা দেখা গেলো না। শুধু দেখা গেলো প্যানডেল, লাইট খুলে নেওয়ার লোকগুলোর বেশ তোড়জোড়।তোড়জোড়ের অবশ্য যথাযথ কারণও আছে। কেননা তাদের উপরে জয়তুন আরার হুকুম জারি হয়েছে, সূর্য মধ্য গগনে যাওয়ার আগে পুরো বাড়ি খালি হওয়া চাই। খালি মানে একদম খালি। তাই তারাও জান প্রাণ লাগিয়ে খোলার তোড়জোড় করছে।
আম্বিয়া বাড়ির লম্বা টানা টানা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা’ই কিছুক্ষণ দেখলো। তার শ্যামলা গায়ে আজ সাদা কাপড়, কালো পাড়। সে অবশ্য কড়া রং পড়েনা বললেই চলে। সেই পাড়ের আঁচল লম্বা করে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। তার সাথে দোল খাচ্ছে কোমর সমান লম্বা চুল। সকাল সকাল গোসল করার বাতিক আছে তার। পুরো বাড়ির মানুষের’ই জানা। তাই কারো তেমন মাথা ব্যথাও নেই।
অবশ্য আশ্রিতা তো আশ্রিতা’ই। তাকে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা থাকার কথাও না। জন্ম দিয়েছিল যারা তাদের’ই কখনো ছিলো না, আর কার থাকবে।
আম্বিয়া মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে ঘুরে বাড়ির ভেতরে এলো।সে জানে যতোক্ষণ সে এখানে থাকবে, জয়তুন আরার পোষা সব লোকদের নজর তার উপরেই থাকবে। এটা অবশ্য নতুন না, যখন থেকে তারা এসেছে তখন থেকেই। তাদের ধারণা, কাজের লোক ইশারা দিলেই রাতের আধারে দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে এরা কি জানে, আম্বিয়া আশ্রিতা হতে পারে, কাজের লোক হতে পারে তবে সস্তা না। কিন্তু সস্তা একটা গর্ভে তার জন্ম। নিজের চোখেই কতো দেখেছে। দেখেছে বলেই তার গা ঘিন ঘিন করে। আর যখন করে তখনি বালতির পর বালতি পানি সে শরীরে ঢালে। যদি ঘিন ঘিনটা একটু কমে।
ভেতরে এসে আম্বিয়া কাজের এক মহিলাকে উঠানে চেয়ার সাজাতে বললো। জয়তুন আরা তার রং দেখানো শুরু করেছে। কনের চাচা আর গ্রামের গণ্যমান্য কিছু লোককে ডেকে পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো এসেও পড়বে। শুধু যে তারা আসবে তা না। তাদের দেখাদেখি গ্রামের মানুষের ঢল নামবে। আম্বিয়া জানে! এই সব আর নতুন কি। গাঁও গ্রামে এগুলো চলে মুখরোচক হিসেবে।
সে কাজের লোককে বলে জয়তুন আরার রুমের দিকে গেলো। এই বাড়ির সাংসারিক যতোকাজ তাকেই দেখতে হয়। অবশ্য জয়তুন আরার ইশারায়। সে হলো এই বাড়ির দাবার গুটি। জয়তুন আরা যেভাবে খুশি, যেখানে খুশি মনের মতো নিশ্চিন্তে চালান করেন।
জয়তুন আরা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। তার বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। তবে বলতে গেলে আজ কিছুটা দেরি’ই হয়েছে। বিয়ে বাড়ি, বয়স হয়েছে, তার মধ্যে নানান ঝামেলা। এই বুড়ো শরীর কি আর সয়। তাই ঝিমিয়ে গেছে! অথচ এক সময় রাতের পর রাত জেগেছে আবার ফজরের আযান পড়তেই কাজে দৌড়ে লেগেছে।
অবশ্য না লেগে উপায় কি? এখনের মতো কি আর এতো দাসী বান্দি ছিল ? পুরো সংসারের দায়িত্ব বাড়ির বউদের উপরেই থাকতো। আর থাকতো বলেই সকাল থেকে সন্ধ্যা হতো কাজের পেঁছনে দৌড়াতে দৌড়াতে।
সে উঠতেই আম্বিয়া ধরে সকালের সব কাজ করালো। হাত, মুখ পরিষ্কার করে চেয়ারে বসালো। বসতেই জয়তুন বললো, — বাড়ির খবর কি?
আম্বিয়া বাসি খাট ঝাড়ছে। ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, — কি আর খবর থাকবে? এই বাড়িতে কোন নিয়ম কানুন আছে। যার যখন মন চায় তাই করে। এরশাদ ভাই এলো মাঝ রাতে। এখনো দরজা খুলে নি। ছোট চাচা প্রতিদিনের মতো সকালেই বেরিয়েছে। বীণা উঠে বই হাতে পুরো বাড়ি ঘুরতে। বলি মেয়ে মাইষের এতো পড়ে লিখে লাভ কি? সেই তো চুলার ঘরেই পচে মরতে হবে। অযথা রাতের ঘুম হারাম করে চোখের নিচে কালি। কতো বলি মুখে একটু হলুদ, চন্দন মাখ তা না, বই খাতায় ডুবে পড়ে থাকে।
— আর শাহবাজ?
— সে এখনো ফেরে নি। ফারহাদ ভাইয়ের সাথে নাকি হাতাপাই হয়েছে। একজন আরেকজনের নাক মুখ ফাটিয়ে শেষ। একটা কালমুখি ঠিক করেছিলে। বাড়িতে পা না রেখেই ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে।
জয়তুন হাসলো! আম্বিয়া সেই হাসি দেখলো। দেখে অবশ্য ভাবান্তর হলো না। খিকখিক করে হাসার ক্ষেত্রে এই বুড়ির জুড়ি নেই।
— এই কালমুখি’ই এই বাড়ির বউ হবে। দুনিয়ার যেই প্রান্তেই থাক, আলাউদ্দিন বলছে।
আম্বিয়া অবাক হয়ে তাকালো। আলাউদ্দিন ফকিরের মুখ ভার। যেটা বলেন সেটা ফলে। যেহেতু বলছে তার মানে হবে। যে ভাবেই হোক হবে। সে মুখটা অন্ধকার করেই বললো,– তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো, তোমার ছোট নাতি কালমুখিকে নিয়েই ফিরবে। আর ফিরলে আবার পায়ে ধরে বড় নাতির গলায় ঝুলাইয়া দিও।
জয়তুন আবারো খিকখিক করে হাসলো। তখনি বীণা দৌড়ে এলো। দৌড়ে আসার অনেক আগেই জয়তুন, আম্বিয়া বুঝলো বীণা এই দিকেই আসছে। বোঝার অবশ্য কারণ আছে। এই মেয়ের পায়ে রুপার মোটা পা ঝাপ। হাঁটলেই পুরো বাড়ি ঝমঝম করে। জয়তুনের খুবই ভালো লাগে। এক সময় এই পা ঝাপের তার খুবই শখ ছিলো। কতো জোড়া যে ছিলো হিসেব নেই। এখনো আছে তবে শখ, বয়স কোনটাই নেই। অবশ্য এখন থেকে না। যখন তার স্বামী তাকে ফেলে দ্বিতীয় বউকে ঘরের উঠানে আনলো। সেই দিন থেকে। সেই দিন থেকে জয়তুন গায়ে আর কোন গহনা তুলেনি। এমনকি নাকের নাকফুলও না। শুধু যে গহনা তা না, স্বামীর সাথে কখনো আর এক রুমে থাকেনি। কতো রাত গেছে দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত পাড় করেছে। জয়তুনের মন গলে নি। না কখনো গলবে। সে ঘৃণা করে, মনের, দেহের প্রতিটা কোণা থেকে। করে বলেই যেই দিন তার সমকক্ষ এই বাড়িতে পা রেখেছে, তখনি সে তার কাছে মারা গেছে। আর বিধবা রা কি গায়ে গহনা পরে। পরে না! জয়তুনও আর পরেনি। সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বীণা পরে। পরবে না কেন? সারেং বাড়ির একমাত্র মেয়ে সে।
বীণা দৌড়ে এসেই বললো, — কালাম ভাই বশির কাকারে ধরে আনছে।
জয়তুন তার মতোই বললো, — আনলে আনছে তাতে তোর এতো মাথার বেদনা কি?
বীণা উত্তর দিলো না। তার এ সব ভালো লাগে না। তবে আয়না বুবুকে তার খুব পছন্দ হয়েছিল। এমন একটা মিষ্টি ভাবি’ই তো সে চায়। কতো কিছু ভেবেছিল। তবে সব আশায় গুড়েবালি।
জয়তুন বীণার ভারী মুখ দেখলো! দেখে হাসলো! নরম মেয়েদের কপালে ভোগান্তি বেশি । এই মেয়ের কপালে যে কি আছে, আল্লাহ’ই জানে।
সে হেসেই বললো, – বাসি মাথার বেনি নিয়ে উড়ছিস কেন? জানিস না বাড়ির অমঙ্গল হয়। যা বাসি বেনি খুলে মাথা নতুন করে বানা।
বীণা মুখ বাঁকালো! যত্তো সব আজগুবি কথা। বলেই যেমন এসেছিল তেমনি দৌড়ে গেলো। তার দৌড়ে যাওয়ার কারণ আছে। কালাম ভাই এসে জানালো, ফরহাদ ভাই নাকি পড়াতে আসবে। ধুর! সাত সকালে এই জ্বালা আর ভালো লাগে না। তার মধ্যে বিয়ের ঝামেলায় একটা পড়াও ঠিকমতো পড়ে রাখেনি।
পৃথিলা সকালে বারান্দায় মোড়া পেতে বসলো। সাবিহা রান্নার আয়োজন করছে। মাটির চুলা, তবুও কি সুন্দর করে সব গুছিয়ে করছে। তাদের সামনেই উঠানে তার মেয়ে জুঁই। একগাদা ছোট ছোট মাটির হাড়ি পাতিল নিয়ে বসেছে। মায়ের মতো সেও গাছ, লতা- পাতা দিয়ে রান্নার আয়োজন করছে।
সাবিহার গায়ের রং কালো, বাবার বাড়ির অবস্থা কিছুটা বলতে গেলে টানাপোড়েন। চার মেয়েকে নিয়ে সাবিহার বাবার চিন্তার শেষ ছিল না। তবে সেই চিন্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার বন্ধু জাফর। বিয়ের সম্বন্ধ নাকি নিয়েছিলের তিনিই। যাকে পৃথিলা নতুন করে চিনলো সারেং বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে। তারা আর অমত করেনি।
করার অবশ্য কারণও নেই। ইমরান ভালো ছেলে। সারেং বাড়ির সব হিসেব টিসেব সে’ই দেখে। আগে বৃদ্ধ বাবা ছিলো। সে বছর দুয়েক আগে গত হয়েছে। এখন এই তিন রুমের আধপাকা ঘর, লম্বা খোলা বারান্দা। বারান্দায় এক কোণে বাবুই পাখির বাসার মতো ছোট্ট খাবার ঘর। সামনে এক চিলতে উঠান। উঠানের পাশে লাউয়ের মাচা, মুরগির খোয়ার। এই যে বাড়ির বাকি বেড়ার পাশ ঘেষেঁ গাধা ফুলের বাগান। আর বাতাসে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। পৃথিলার সব কিছু এত্তো ভালো লাগছে। লাগছে বলেই তার কাছে মনে হয় সাবিহা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।
অবশ্য পৃথিবীর সব সুখ একপাক্ষিক। যা একজনের কাছে সুখ তা আরেক জনের হয়তো চোখেই পড়ে না। কেননা সাবিহা তার সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে যতবার’ই গিয়েছে, ততবার’ই চোখ কপালে তুলে বলতো,” তোর তো রাজ কপালরে পৃথিলা। ইশ কত আরাম আয়েশের জীবন। ”
অথচ তার কাছে সেটা কখনো তেমন কিছু মনে হয়নি। তার কাছে বিশেষ মনে হচ্ছে এই যে স্নিগ্ধ বাতাস, পাখির গান, এই যে ইট বিছানো চিকন সুরু রাস্তা। আর এই যে সামনে বসা সাধারণ দেখতে অসাধারণ মেয়েটা সাবিহা।
পৃথিলা ভাবতে ভাবতেই জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর পাঁচ দশটা মেয়ের মতোই তার শৈশব গেছে। কখনো মনে হয়নি যাদের মাঝে সে বড় হচ্ছে আসলে সে তাদের কেউ না। আর যাদের কেউ তাদের সে চেনা তো দূরের কথা, নাম পর্যন্ত জানে না।
এই জানার রহস্য একজন’ই খুলতে পারে। তার মা! আচ্ছা, মা কি এখনো তার উপরে রেগে আছে? বিয়ের পরে একবার গিয়েছিল। মা দরজা খুলেনি। তার ছোট বোন মিথিলা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেকি কান্না। সে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে এসেছিল। আর কখনো যাওয়া হয়নি। এখন গেলে কি দরজা খুলবে?
তখনি হইচই শোনা গেলো। হৈচৈ হচ্ছে সারেং বাড়ির উঠান থেকে। এই বাড়িটা দক্ষিণ দিকের কোণার সাইডে। তার মধ্যে আশে পাশে গাছগাছালিতে ভরপুর। এখান থেকে বলতে গেলে ঐ বাড়ির কিছুই দেখা যায় না। তবে বিশাল উঁচু বাড়িটা দেখা যায়। সামনে টানা বারান্দাটা দেখা যায়। বারান্দায় কেউ দাঁড়ালে সেটাও দেখা যায়। এই যে যখন সে এখানে এসে বসেছে, তখন সাদা পাঞ্জাবি গায়ে এক লোককে দেখলো। বয়স কত এখান থেকে অনুমান করতে পারলো না । তবে মাঝারি বয়সের মনে হলো। সে যেমন কৌতুহল নিয়ে তাকালো, সেই লোকটাও তাকালো। পৃথিলা সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে তবে পৃথিলার মনে হয়েছে লোকটা নেয়নি। বরং যতক্ষণ ছিল দৃষ্টি তার উপরেই ছিল।
তার কিছুক্ষণ পরে এক মেয়েকে দেখলো। কোন কিছু নিয়ে সে এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে যাচ্ছে। বয়স মনে হয় খুব একটা বেশি হবে না। ফড়িংয়ের মতো কতোক্ষণ বিনা কারণে উড়াউড়ি করে দৌড়ে চলে গেলো।
সাবিহা রান্না রেখে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলো। পৃথিলাও যাবে কি না বুঝতে পারছে না। তবে ঝামেলা গুরুতর বোঝা যাচ্ছে। উঠানের কিছু দেখা না গেলেও, এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আলাদা যে রাস্তা। সেটা সাবিহাদের বারান্দা বরারর। অবশ্য বাঁশের বেড়ার আড়ালে। আড়াল হলেও মানুষের আসা যাওয়া বোঝা যায়। এই যে যেমন পৃথিলা ঠিক বুঝতে পারছে। দলে দলে মানুষ সারেং বাড়ির উঠানের দিকে যাচ্ছে।
পৃথিলা যাবে না, যাবে না করেও এগিয়ে গেলো। উঠানে দুনিয়ার মানুষ। সেই মানুজনদের ভীড়ে সারেং বাড়ির নিচের খোলা বারান্দায় এক বৃদ্ধা সাদা থান পরে বসে আছে। তার গায়ে ব্লাউজ নেই। তবে মুড়িয়ে এমন ভাবে মাথায় কাপড় দেওয়া। দেখতে ভালো লাগছে। তাছাড়া থলথলে ঝুলে পড়া ধবধবে সাদা চামড়া, এতোটাই সাদা যে তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি গড়নের এক মেয়ে, অবশ্য মহিলাও বলা যায়। তবে বয়সটা পৃথিলা ঠিক অনুমান করতে পারলো না। তবে মেয়েটার গায়ে আটপৌরে সাদা শাড়ি। শাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না। ভালো না মানে শালীন না। একটু যেন দৃষ্টিকটু। দাঁড়িয়েও আছে কেমন কোমর বাঁকিয়ে। না চাইতেও দৃষ্টিতে অন্য রকম চোখে পড়ছে।
আর তাদের পায়ের কাছে এক লোক বসে আছে। শুকনো, হাড় জিরজিরে। গায়ে মিলিন গেঞ্জি, রঙ জ্বলা মলিন লুঙ্গি। সে হাত জোর করে মিনতি করে বলছে, — আম্মা ছোট মানুষ। ভুল করছে। মাফ করে দেন।
জয়তুন পান চিবুতে চিবুতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তার মুখে পান। কিছুক্ষণ চিবিয়ে
থু করে সাইডেই ফেললো। ফেলে বললো, — মাফ তো করলাম’ই আর কতো? আমি কিছু বলতাছি বলেন? আপনেরাই বলেন। বলেই উঠানে বসা তার ডেকে আনা গাঁয়ের লোকদের দিকে তাকিয়ে বললো।
গাঁয়ের লোকদের তেমন ভাবান্তর হলো না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে জয়তুন আরার সাথেই তারা একমত। তাছাড়া মেয়ে মানুষের এতো সাহস’ই থাকবে কেন? আজ এর বিহিত না হলে গ্রামের অন্য মেয়েদেরও তো চোখ ফুটে যাবে না এমন গ্যারান্টি কি?
জয়তুন আগের মতোই বললো, — মেয়েগো পাখা, পাখা হওয়ার আগেই কাঁটতে হয়। সেটা তুমি পারো নাই। তাই যতটুকু দোষ তোমার ভাস্তির ততটুকু তোমার। তবে সবই ভাগ্য! কি আর করার। জয়তুনের আবার দিল বড়। তা না হলে এখনো এখানে আস্ত বসে থাকতে না। তাই যাও উঠানের মাঝ বরাবরে গিয়ে বসো। মাথা নেড়া করা বড় কথা না। বড় কথা হতো যদি নেড়া মাথায় কালি মেখে জুতোর মালা গলায় দিয়ে পুরো গ্রামে কয়েক চক্কর কাটাতাম। সেটা করছি বলো? সামান্য নেড়া করছি। আজকে করবো কালকে’ই দেখবা জায়গার জিনিস জায়গায় ফিরে এসেছে। তোমাদের জন্য যে আমাদের সম্মান গেলো। সেটা কি আর ফিরে আসবে ?
বশির বলতে গেলে পায়ে পড়ে গেলো। গিয়ে বললো, — মাফ করেন আম্মা। এবারের মতো করেন। নাদান মাইয়া। বুঝ জ্ঞান তো ওতো হয় নাই। তারে আমি খুঁজে আনুম। তারপর আপনি যা চাইবেন তাই হবে।
জয়তুন সাথে সাথেই পা সরিয়ে নিলো। বিরক্ত মুখে বললো, “– ইশরে দিলি তো পাটারে ময়লা করে। আমি এখন এই সাত সকালে যাবো গোসল করতে? সর, সর হারামজাদা। কুত্তার পেটে ঘি হজম হয়না। তোদের পেটে হইবো কেমনে। আমার বাড়ির বউ হইলে, রাজ রানী হইয়া থাকতো।
বশির সরে বসলো! বসে বললো, — আপনে মুখ দিয়ে বলছেন। বিয়ে হোক আর না হোক, সে আপনের বাড়ির বউ। আমারে শুধু আরেক বার সুযোগ দেন।
— বারো ঘাটে ঘুরে আসা মাইয়া সারেং বাড়ির বউ হইবো। এতো সোজা?
— সে তার খালার কাছে গেছে আম্মা। আর কোথাও না। আপনে পারলে খোঁজ নিয়ে দেখেন। আমার আয়না এখনো আয়নার মতোই স্বচ্ছ।
— তোদের আয়না স্বচ্ছ হোক ঘোলা। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। অপরাধ করছো শাস্তি হবেই। একেবারে তো আর ছেড়ে দিতে পারি না। ছাড়লে সারেং বাড়ির কি আর মান থাকবো? তাই যাও বাবা বশির, উঠানে যাও। গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সমাধা করো। করে বিদেয় হও। মিঠা রোদ উঠছে। সেখানে কিছুক্ষণ জলচৌকিতে বসবো।
পৃথিলা অবাক চোখে সব তাকিয়ে দেখলো। হচ্ছে কি এখানে? এতো মানুষ কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। যেন যা হচ্ছে সব ঠিক। কেমন মানুষ এরা?
সে এগিয়ে যেতে গেলো। সাবিহা বললো, — কোথায় যাচ্ছিস?
— ওখানে?
— কেন?
— যা হচ্ছে অন্যায়! তাছাড়া মেয়েটা নির্দোষ, যা করেছে তার বড় নাতি।
— কোন দরকার নেই, তুই আয়।
পৃথিলা শুনলো না, এগিয়ে যেতে যেতে বললো, – আমি শুধু কথা বলবো। কথা বলা কখনো অন্যায় হয় না। অন্যায় হয়, অন্যায় দেখেও মুখ বুঝে থাকা।
পৃথিলা উঠানে পা রাখতেই জয়তুন তাকালো। অবশ্য শুধু সে না, উঠানে বসা প্রত্যেকটা মানুষ’ই পৃথিলার দিকে তাকালো। তাকানোর অবশ্য কারণ আছে। একতো গ্রামে নতুন মুখ, দ্বিতীয় এমন ভরা মজলিসে গ্রামের কোন মেয়ে বউ না ডাকা পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় না। তাদের সব আয়োজন ঘরের কোণা কাঞ্চি থেকে উঁকিঝুঁকি পর্যন্ত’ই।
পৃথিলার এতো এতো দৃষ্টিতে একটু অস্বস্তি হলো তবে থমকালো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই জয়তুন আরার সামনে দাঁড়ালো। সে অবশ্য খেয়াল করেনি, সে দাঁড়াতেই আরো দু’জোড়া পা এই ভরা মজলিসে উপস্থিত হলো। সেই দু’জোড়ার এক জোড়া ছায়ার মতো ঠিক তার পেছনে আর এক জোড়া সারেং বাড়ির সাদা চুনকাম করা বিশাল বাড়ির লম্বা কাঠের দরজায় গোড়ায়। যার চোখে মুখে ভেঙে যাওয়া কাঁচা ঘুমের রেশ। রেশ নিয়েই ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, সারেং বাড়ির উঠানে সারেং বাড়ির মাথা জয়তুন আরা বেগমের সামনে সারেং বাড়ির একমাত্র রক্তকে।
চলবে……