#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৯
পৃথিলা ডানে বামে সামনে কোথাও তাকিয়ে দেখেনি। দেখেনি বলেই তার পেঁছনে বা সামনে কে এসেছে সে খেয়াল করেনি। তার দৃষ্টি জয়তুন আরার উপরে। সেখানে দৃষ্টি রেখে’ই তার স্বভাব মতো শান্ত, নরম স্বরে সালাম দিলো।
জয়তুন পৃথিলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলালো। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও, গাঁও গ্রামে একে বলে হোলদেটে ফর্সা। বয়স যতো বাড়ে এই রুপের ঝলক দিন দিন ততো খোলে। অবশ্য জয়তুন এই মেয়ের বয়স অনুমান করতে পারল না। পনেরোর পরে মেয়েদের বয়স ঠিক ধরা যায় না। তবে গায়ে সুন্দর মার্জিত কাপড়। এতোটাই মার্জিত যে শরীরের ভাঁজ তো দূরের কথা, কোন বাড়তি অংশও কারো নজরে পড়বে না। মাথায় কাপড় নেই অবশ্য, তবে গুছিয়ে হাত খোঁপা করা।
এই মেয়ে গাঁয়ের না! জয়তুন সাথে সাথেই বুঝল। চোখ, মুখ শান্ত। সেটা থাকতে’ই পারে! তবে এই শান্ত রুপের মাঝে অন্য কিছু একটা আছে। গাঁয়ের মেয়েদের মাঝে সেটা থাকে না।
আর থাকে না বলেই সে নিজেও শান্ত ভাবে চোখ বুলালো! মুখে সালাম না নিলেও মাথা হালকা নাড়ালো। নেড়ে আম্বিয়ার দিকে তাকালো। যার অর্থ, ” কোথাকার আকাশ ফুঁড়ে এর আবার আমদানি হলো?
আম্বিয়া জয়তুনের না বলা কথার অর্থ ভালো ভাবেই বুঝলো! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এর সাথে, না বুঝে উপায় কি। তাই আরেকটু আরাম করে দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে বললো — কাল রাতে তোমার বড় নাতি নিজে এই আপদ ঘাড়ে করে নিয়ে এসেছে। তারেই জিগাও কাহিনী কি? বিয়ে তো এতকাল করতে চায় নি। একটায় যাও রাজি হলো, কনে উড়ালপঙ্খী! উড়ে উড়ে কোথায় কোন ঘোল পাকাচ্ছে কে জানে। সেই পঙ্খীর তার খবরও নাই, তবে আন্ধার রাতে আরেকজন নিয়ে হাজির।
— আম্বিয়া..
আম্বিয়া একটু অবাক হয়েই জাফরের দিকে তাকালো। সে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটার ঠিক পেছনে। ছোট চাচা শান্ত-শিষ্ট মানুষ। মেয়ের মতোই সব সময় স্নেহ করে এসেছে। তবে আজকের কণ্ঠ ভিন্ন। না ধমকে উঠেনি তবে কণ্ঠে রাগের আভাস আম্বিয়া যেনো ঠিক পেলো।
জাফর এগিয়ে এলো! দাঁড়ালো পৃথিলার ঠিক পাশে। দাঁড়িয়ে পৃথিলার মুখের দিকে একবার তাকালো। পৃথিলা নিজেও এক পলকে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে যে কেউ ছিল সে জানে না। তাই হঠাৎ কথার আওয়াজে বলতে গেলে সে একটু চমকে উঠেছে।
জাফর সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে আম্বিয়ার দিকে তাকিলো! উষ্ম সুরে বললো, — মুখ সামলে আম্বিয়া। আমাদের স্কুলের শিক্ষিকা সে। আমি নিজে তাকে অনুরোধ করে এখানে এনেছি। তাই অসম্মান হবে, এমন কাজ তো দূরে শব্দও যেন মুখে না আসে।
পৃথিলা অবাক হলো। তাকে কেউ অনুরোধ করে আনেনি। সাবিহা শুধু বলেছিল আর সে নিজে থেকে এসেছে। সে ভালো করে খেয়াল করে তাকালো। এই লোকটাই সকালে বারান্দায় ছিল।
জয়তুন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শিক্ষক, সম্মান সবই ঠিক আছে। তবে কোন কিছু একটা ঠিক নেই। কি নেই সে ধরতে পারলো না। আম্বিয়া নিজেও হতম্বভ,তবে সবার সামনে এভাবে বলায় একটু গায়েও লাগলো। সেই লাগা অবশ্য কাউকে বুঝতে দিলো না। বরং ঢং করে বললো, — ওরে বাবা! তাই নাকি? বুঝতে পারি নাই গো ছোট চাচা। বলেই পৃথিলার দিকে তাকালো, তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললো, ” আসসালামু আলাইকুম মেডামজি। মুখ্য সুক্ষ মেয়েছেলে আমি। দোষ ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। ”
পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেললো। এই মেয়ে যে চুড়ান্ত অসভ্য তার আর বুঝতে বাকি রইল না। সে আম্বিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে জয়তুন আরার দিকে তাকিয়ে আগের মতোই নরম সুরে বললো, — আপনি বড়, সম্মানিত মানুষ। হয়তো এদের কিছুটা ভুল আছে। তবে ক্ষমা মহৎ গুণ। এই গুণে কেউ অসম্মানিত হয় না। আপনার সারেং বাড়িও হবে না। তাই দয়া করে মাফ করে দিন।
— মাফ তো করলাম’ই আর কতো?
— মাফ করলে তার মধ্যে শাস্তি আসে না। তিনি বয়স্ক মানুষ। যেতে দিন! তাছাড়া জোর করে কোন কিছু ভালো বয়ে আনে না। একবার ভাবুন! মেয়েটার সাথে যদি জোর না হতো। এতো কিছু হতোই না। না এই লোকটা এমন বিপদে পড়ত, না আপনার বাড়ির সম্মানে কোন আঁচ পড়ত। আমরা মানুষ! কেউ’ই ভুলের ঊর্ধ্বে না। আমি নিজেও না, তেমনি আপনিও না। তবে যেহেতু আপনি বড় আপনার উচিত আরো সহনশীল, ক্ষমাশীল হওয়া।
এতো ভারী ভারী শব্দে জয়তুন ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো! এই বাড়ির ছেলে পেলেদের মধ্যে লেখা পড়া করেছে বলতে গেলে জাফর’ই। তারপরে এরশাদ। না জাফরের মতো ওতো না। কলেজ পাশ করেছে। তবে এর উপরে পড়তে হলে শহরে যেতে হতো। সে যায়নি! বরং নিজ ইচ্ছায় সংসারের হাল ধরেছে। জাফরের চেয়ে দশ গুন ভালো ভাবেই ধরেছে। আর শাহবাজ! এটা তো মারামারি করেই কূল পায় না। পড়া লেখা করবে কবে?
তাই সে ভ্রু বাঁকিয়েই বললো, — কি উচিত, না উচিত এখন তোমার কাছ থেকে শেখা লাগবো?
— না! আমি শুধু বলছি। আপনি বড়, আমার চেয়ে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, জানার ক্ষমতা সব কিছুই আপনার বেশি। তাই বলছি, একটু বিবেচনা করুন। সমাজ, মানুষ হিসেবে না। অন্তত নারী হিসেবে একবার ভাবুন। একটু ভাবলেই মেয়েটার অবস্থানটা একটু হলেও বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন জোর করে কখনোও কোন কিছু ভালো বয়ে আনে না।
— তোমার বিয়ে হয়েছে?
পৃথিলা থমকালো! তবে সাথে সাথে’ই নিজেকে সামলে নিলো। সে বাস্তবতা জানে, বুঝে। যেখানে’ই যাক এই প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে। এটাই সত্য! আর এই সত্যর জন্য সব সময় আঙুল তার দিকেই উঠবে। মেয়ে বলে কথা। স্বামীর ঘর করোনি, মানে তোমার আর কোন যোগ্যতা নেই, বড় গলায় কথা বলার অধিকার নেই। বরং এই ক্ষত ধরেই তাকে ক্ষত বিক্ষত করে সবাই নিচের দিকে টেনে নেবে।
নিক! সেও দেখতে চায় এক ভুল তাকে কতোটা ক্ষত, বিক্ষত করতে পারে, কতোটা নিচে টেনে নিতে পারে। সে নিজ ইচ্ছায় ভুল করেছে, তাই সব শাস্তিও মাথা পেতে নেবে।
পৃথিলা নিজেকে সামলে নিলো। নিয়ে কিছু বলবে তখনি জাফর বললো, — আম্মা বাদ দেন। বলে পৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — আমার মেয়ের বয়সী তুমি। তাই তুমি করেই বলছি। ঘরে যাও। এসব ঝামেলায় পড়ার তো কোন দরকার নেই। এসব গ্রামে অহরহ’ই হয়। দু’দিন পরে সব ঠিক হয়ে যায়।
— আপনি?
ছোট্ট একটা প্রশ্ন! তাও জাফরের বুক কেঁপে উঠল, গলা ধরে এলো! নিজেকে কোন রকম সামলে বললো, — আমি জাফর! এরশাদের ছোট চাচা।
পৃথিলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল! মুখ না চিনলেও বুঝতে পারলো কে? তবে কোন কারণে লোকটা তাকে সেইভ রাখতে চাইছে। কেন? সে জাফরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বললো, — আহরহ হলেই সব সময় হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
তারপর চোখ ফিরিয়ে জয়তুন আরার দিকে তাকিয়ে আগের মতোই শান্ত তবে দৃঢ় ভাবে বললো, — হ্যাঁ, আমার বিয়ে হয়েছে।
— তো জামাই কই তোমার? ভদ্র বাড়ির বউরা তো এভাবে একা একা কোথায়ও চলে আসে না।
— আমরা এক সাথে নেই।
জয়তুন মুখ বাঁকিয়ে হাসলো! হাসলো আম্বিয়াও। তাদের হাসির মধ্যে জয়তুন বললো, — দেখেছো জোর না করার ফয়দা। যদি তোমার বাপ, মা সঠিক সময়ে করতো। তা না হলে এতো কিছু হতোই না। একবার ভাবো, যদি সঠিক সময়ে জোর করতো, তাহলে আজ এখানে দাঁড়াতেই না। মন দিয়ে স্বামীর সংসার করতে। অবশ্য চাপায় যাদের এতো জোর, সেই মেয়েদের সংসার হবে না সেটা জানা কথাই। তাই বাপু! নিজের রাস্তা মাপো। আমাদের গ্রামের বিষয়ে নাক গলানোর কোন দরকার নেই। মাস্টারি করতে আইছো তাই চুপচাপ করো।
পৃথিলা নিশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল! তার দুনিয়া ছিল ছোট। এই ছোট দুনিয়ায় এমন নোংরা বাস্তবতার মুখগুলো তার কখনোও দেখা হয়নি। সে ঢোক গিলে বললো — এগুলো অন্যায়।
— তোমার কাছ থেকে আমার ন্যায় অন্যায় শিখতে হবে না।
— আমি আপনাকে শেখাচ্ছিও না। তবে শাস্তি হলে দুজনের’ই হওয়া উচিত।
জয়তুন ভ্রু কুঁচতে তাকালো। পৃথিলা আগের মতোই চোখে চোখ রেখে বললো, — মেয়েটা পালিয়ে যায়নি। সে কিন্তু বিয়ের জন্য ঠিক প্রস্তুতি’ই নিয়েছিল। আপনার বড় নাতি নিজে এই মেয়েকে রেলে তুলেছে। আমি যেই নৌকায় এসেছি এই মেয়ে সেই নৌকায় ছিলো। ফরহাদ নামের এক লোকও ছিল। বিশ্বাস না হলে তাকেও আনতে পারেন। আপনার বাড়ির সম্মানে আঁচ আনার জন্য যদি এই লোকটার শাস্তি হয়, মেয়েটার হয় তাহলে আপনার নাতিরও হওয়া উচিত। অপরাধ যেহেতু সমান। শাস্তিও সমান।
আয়নার চাচা যেন অথৈই সাগরে ডুবতে ডুবতে তীর খুঁজে পেলো। পেতেই মাথা নাড়িয়ে বললো, — একদম ঠিক, আম্মা। আমি আগেই কইছি আমার আয়না নির্দোষ। সে কি দুনিয়া চিনে? আপনাগো সামনেই তো বড় হইলো। কখনো কোন দোষ পাইছেন? বলেন আপনারেই বলেন। বলেই বশির গ্রামের মুরব্বিদের দিকে তাকালো।
সবাই একটু থতোমতো’ই হয়ে আছে। আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের কোন মজলিসে এমন বিরল ঘটনা তো ঘটেনি। তার মধ্যে যেখানে স্বয়ং জয়তুন আরা বসা। তারা থতমতো ভাবেই জয়তুর আরার দিকে তাকালো। তার নাতির কারবার সে নিজেই সামাল দিক। পরে কি থেকে কি করবে, পেছনে পড়ে যাবে। আর যার একবার পেছনে এই বুড়ি লাগে, পথের ফকির করে ছাড়ে।
জয়তুন ভ্রু কুঁচকে এরশাদের দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — কি কয় এই মাস্টারনি?
পৃথিলা আবারো একটু চমকালো! চমকে এরশাদের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ সে খেয়াল করেনি। এরশাদ এখন দাঁড়িয়ে আছে স্বাভাবিক ভাবেই। চোখে মুখে ঘুমের রেশ নেই। সে সরল মুখে মাথা চুলকে হালকা হাসলো। এক চোট মাথা চুলকে বললো, — কথা একবারে সত্য। আয়নামতিকে আমি রেলে তুলেছি।
জাফর ঠোঁট টিপে হাসলো! যেমন দাদি, তেমন তার নাতি। তবে জয়তুন আগুন চোখে কিছুক্ষণ এরশাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চোখ ফিরিয়ে গাঁয়ের মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললো, — শাস্তি শাস্তি’ই! সারেং বাড়ির সম্মান নিয়ে যে টান দিবো। সে যে’ই হোক, জয়তুন তারে ছাড় দেবে না। বলেই কালামের দিকে তাকিয়ে বললো, — এই দুইডারে মাথা ন্যাড়া করবি। এক্ষুনি করবি। আর ঐ কালমুখিরে খুঁজে বের কর। যেহেতু আমার নাতির ইশারায় পালিয়েছে। তাই তারে এই জয়তুন মাফ করলো। তবে এই বাড়ির বউ সে কখনোও হবে না। বলেই জয়তুন ভেতরে চলে গেলো। যেতে যেতে একবার পৃথিলার দিকে তাকালো।
পৃথিলার অবশ্য সেই দিকে খেয়াল নেই। তার সব ধ্যান এরশাদের দিকে। কেননা তার তাকানোর মাঝেই লোকটা বিনা বাক্য সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসলো। বসতেই মোটা কালো মতো এক লোক খুর হাতে এগিয়ে এলো। আর খুব স্বাভাবিক ভাবে তার সব চুল চোখের পলকে কেটে ফেলা হলো। আল্লাহ! কোথায় এসেছে সে?
এরশাদ গোসল করে আর নিজের রুমে গেলো না। তার গলায় গামছা, খালি গা, নিচে লুঙ্গি। গামছা দিয়ে ন্যাড়া মাথা ঘষতে ঘষতেই চাচার রুমে এলো। তাদের সবার রুম’ই দ্বিতীয় তলায়। বলতে গেলে সারেং বাড়ির জীবিত তিন পুরুষের রুম’ই দ্বিতীয় তলায়। বাকি সবার’ই নিচে। বীণার অবশ্য খুব শখ তার রুম উপরে হবে। তবে দাদির এক কথা, সে নিচে সব মেয়ে মানুষের কারবারও নিচে।
জাফর দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের জানালার পাশে। দৃষ্টি তার নিচে। তার হাতে সাদা একটা কাগজ। কাগজটা কিসের এরশাদ জানে। সে নিজেই কাল রাতে যখন ছোট চাচার সামনে ধরলো। সে বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল। কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা হাতে নিতেই পড়ে যেতে নিলো। এরশাদ সামলালো। সামলে ধরে নিজেই খাটে বসালো। বসিয়ে বললো, — যাকে এক সময় দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করে খুঁজেছো। ভাগ্য নিজে তাকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছে।
জাফর কিছু বলতে পারেনি। এরশাদও আর কিছু বলে নি। শেষ রাত ছিলো! নিজের রুমে চলে গিয়েছে। ছোট চাচার এই কাহিনী শুনেছে সে বলতে গেলে অনেকটা আগে। চাচা একদিন রুমে ডেকে এনে বললো, — তোমার ছোট চাচি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কই। জসিম ভাই লেখাপড়া করেনি। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, আমি যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হই। বাবা মারা গেলেন। তার শেষ ইচ্ছে বলো আর নিজের। লেখাপড়াটা করেছিলাম মন দিয়েই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয় নি। সেখানে পরিচয় হয় শায়লার সাথে। সেই পরিচয় থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে বিয়ে। ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে বাড়িতে সব জানাবো।
তবে সেই সুযোগ আমি পাইনি। তোমাদের ছোট চাচি আম্মার বোনের মেয়ে। যৌতুকের জন্য বিয়ে ভেঙেছিল তার। যেই দিন ভেঙেছিল সেই দিন’ই আম্মা আমাকে চিঠি পাঠালেন। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন আমি বাড়িতে আসি। খবর পেয়েই আমি দৌড়ে এলাম। আসতেই আম্মা আমার হাত নিজের মাথায় রেখে বললেন, — যদি একদিনের জন্যও আমারে নিজের মা মনে করোস তবে এই মূহুর্তে আমার বোনঝিরে বিয়ে করবি।
আমি হতম্ভব! কি করবো, কি বলবো দিশে পাই না। তবুও কোন রকম আস্তে করে আম্মাকে বললাম, — আমার বউ আছে আম্মা। আমি বিয়ে করেছি।
আম্মা অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারেনি। তবে নিজেকে সামলে বলেছে, — যেই বিয়ে গুরুজন নেই, সেই বিয়ে আবার বিয়ে কি? ওই সব নষ্টা মেয়ে ছেলের কথা ভুলে যাও। আর যদি ভুলতে না পারো। তাহলে আম্মাকে ভুলে যাও। তোমার আম্মা, তার বোনকে কথা দিয়েছে। সেই কথা যদি আজ খেলাফ হয়। তবে কথা দিচ্ছি কাল সকালের সূর্যের মুখ জয়তুন দেখবে না।
ব্যস, আটকে গেলো। কেননা এই আম্মার সাথে তার নাড়ী ছেঁড়া সম্পর্ক নেই, তবে আত্মার আছে, দয়ার আছে, ঋণের আছে। আর এই ঋণের বোঝা এতোই যে, অস্বীকার করলে, দুনিয়া আঙুল তুলে বলতো। নিজের মা হলে এমন করতো? সৎ মা তো, এজন্য বুক কেঁপে উঠেনি। এজন্যই বলে সৎ, সৎ’ই হয়। যতোই বুকে আগলে ধরো, সৎ কখনো আপন হয় না।
আপন হতে, ঋণের বোঝা কমাতে, কাপুরুষের কাতারে চলে গেলাম অনায়াসেই। এই বিয়ের পরে শায়লার সাথে যোগাযোগ করার সাহস আমার হয়নি। তবে তার খোঁজে শায়লা ঠিক এসেছিল। এই মিঠাপুকুর গ্রামে পা রাখতেই তার সাথে হওয়া অন্যায়ের খবরটা সে ঠিক পেয়েছিল।
সে চাইলেই সারেং বাড়িতে পা রাখতে পারতো, চাইলেই সারেং বাড়ির মান সম্মান কে ধূলোয় মেশাতে পারতো । হাজার প্রমাণ তার কাছে আছে। তবে সেই রকম কিছুই করেনি। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা চিঠি তার নামে রেখে গিয়েছিল। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, — “অভিশাপ কখনো দিতে হয় না, আমিও দেবো না। উপরে যিনি আছেন, তার উপরে ছাড়লাম। তবে কসম করে বলছি, আমাকে আমার প্রাপ্ত পরিচয় তুমি দিতে পারোনি। আমি আমার সন্তানের কাছে তোমার পরিচয়ও দেবো না, মরে গেলেও না। ”
সেই চিঠি পেয়েই জাফর দৌড়ে গেলো। দৌড়ে গেলেই বুঝি সব পাওয়া যায়। যায় না! শায়লা হারিয়ে গিয়েছিল। সেই হারানোর বছর খানেক পরে তার নামে একটা চিঠি এসেছিল। সাদা, শুভ্র কাগজ, সেই কাগজের উপরে সুন্দর মোটা করে একটা শব্দ লেখা তালাকনামা। সেই তালাকনামার ওজন একমাত্র জাফর জানে। হয়ত উপর ওয়ালাও জানে। জানে বলেই সারেং বাড়ি ধ্বংশ তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। কেননা গ্রাম গঞ্জে ডাকাতি খুবই সাধারণ ব্যাপার। অহরহ’ই হচ্ছে। তবে সারেং বাড়িতে ডাকাতেরা এসেছিল আজরাইল হয়ে। সেই আজরাইলদের সাথে কোন দুশমনি ছিল জাফর জানে না। তবে তারা সারেং বাড়িকে এক রাতে ধুমড়ে মুচড়ে ফেলেছিলো।
এরশাদ সেই দিন বলতে গেলে কিছুটা থমকেই গিয়েছিল। ছোট চাচাকে সব সময় দেখে এসেছে শান্ত, চুপচাপ। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরে সব কাজ নিজ দক্ষতায় করেছে। সে বড় হওয়ার পরে সব ঠেলে তার ঘাড়ে ফেলে বলেছে, ” – আর পারছি নারে এরশাদ। আমাকে এবার মুক্তি দে।
সে সত্যিই মুক্তি নিয়েছিল। কোন কিছুতেই সে আর নেই। নিজের মতো থাকে, খায়, ঘুমায়। সেই মানুষটার ভেতরে এমন ক্ষত আছে বোঝা যায় না।
দাদিকে কে ছোট চাচা, চাচি বা তার সন্তানের ব্যাপারে আর কখনো কিছুই বলেনি। দাদিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। তবে ছোট চাচা জানতো! এই বিয়েকে বিয়ে না মানলেও তার আম্মা সারেং বাড়ির শেষ রক্তের জন্য দুনিয়া ভেঙে চূড়ে ফেলতো। ছোট চাচির সাথে অন্যায় তো করেছে’ই, আর কতো? সেই অন্যায়ের পাপের বোঝা আর বাড়াতে চায়নি। তাই তার শাস্তি সে মাথা পেতে নিয়েছে। তবে বাবা তো, একবারের জন্যও চেয়েছিল সন্তানের মুখটা দেখতে। তবে তার খোঁজ সে পায়নি। ততদিনে অনেকটা বছর কেটে গেছে। এরশাদ মাত্রই সব কারবার বুঝে শুনে নিচ্ছে। তবে ছোট চাচা থামেনি, নিজে যেমন সাধ্য মতো খুঁজেছিল। তেমন তাকেও তখন অনুরোধ করে বলেছিল, — তোর তো অনেক চেনা জেনা। দেখিসতো একটু খুঁজে।
এরশাদ খুঁজেছে! সাধ্য মতো নিজ দায়িত্বেই অনেক খোঁজ খবর করার চেষ্টা করেছে। তবে নিজে থেকে হারানো মানুষকে কি সহজে পাওয়া যায়। যায় না!
তবে উপরে যিনি আছেন তার ইচ্ছে বোঝা বড়ই দায়। সব খোঁজা টোঁজা যখন সমাপ্তি হয়ে গেছে। তখনি ছোট চাচার বন্ধু মানে সাবিহার বাবার চিঠি এসে হাজির। চিঠিতে লেখা ছিল, ” মেয়েকে চোখের দেখা যদি দেখতে চাও চলে এসো। তবে তাদের দুনিয়ায় ভুলেও স্পর্শ করতে যেও না। মেয়েটা শেষ হয়ে যাবে। ”
ছোট চাচা, ইমদাদুল চাচা, শায়লা চাচি তারা ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুধু বন্ধু না, তাদের বিয়ের একমাত্র সাক্ষী। সেই সাক্ষী কাছেই স্মৃতি হিসেবে বিয়ের কিছু সাদা কালো ছবি তার কাছে ছিল। সাবিহা সেই ছবি তাদের পারিবারিক অ্যালবামে দেখেছে হাজার বার। তাই বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে বান্ধবীর মাকে চিনতে একটু সময়ও তার লাগেনি। আর লাগেনি বলেই বাসায় ফিরেই বাবাকে জানিয়েছে।
জাফর চাচা দৌড়ে গেলেন। দূর থেকেই দেখেছেন। এক দিন, দুদিন, কতোদিন এরশাদ জানে না। তার জানার কথাও না। সে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবে ঐ কয়দিন’ই জাফর চাচাকে সে হাসতে দেখেছে। হেসে হেসেই চোখে পানি নিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলতো, — মেয়েটা কার মতো হয়েছে বলতো? একদম চুপচাপ, শান্ত। কি মায়া করা চোখ । দেখলেই বুকটা মুচড়ে উঠে।
তবে সেই হাসি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। শায়লা চাচি ধরে ফেলেছিল! ধরে অনেকটা দিন পরেই আরেকটা চিঠি ছোট চাচার নামে এসেছিল। সেখানে শুধু লেখা ছিল,– ” আমাকে বাধ্য করোনা জাফর। কেননা আমি চাই না। সে জানুক তার গায়ে একজন কাপুরুষের রক্ত। ”
ছোট চাচা আর যায়নি। তার জীবন চলেই গেছে। সে চেয়েছে মেয়েটা ভালো থাকুক। তবে ভালো থাকা চাইলেই হয় না। এই যে চার আঙুলের কপাল। এখানে থাকতে হয়। আর না থাকলে, কারো সাধ্য নেই ধরে, বেঁধে সুখের সাগরে ভাসার।
চলবে……