#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১১
আবদুল আজিজের পাটের আড়ত মিঠাপুকুর বাজারের একেবারে মধ্যিখানে। আগে অবশ্য এমন ছিল না। ছিল এক সাইডে। তখন ছিল ছোট্ট বাজার। গ্রামের মানুষ টুকটাক নিজের হাতে সবজি, গাছের ফলটল নিয়ে বসত। সেই বাজারে এক, দুই করে দোকান বসতে লাগলো। বসতে বসতে আজ সদর বাজারকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর তার পাটের আড়ত হয়ে গেছে একেবারে মধ্যিখানে।
আর এই মধ্যিখানের আড়তে’ই বসে আবদুল আজিজ তার যাবতীয় কাজকারবার করে, সাথে মানুষের হালচালও দেখে। সেই দেখা আর কাজ কারবারের জন্য আজিজ যখন আজ এসে বসলো তখন সকালের নরম কোমল রোদ রুক্ষ হতে শুরু করেছে। অবশ্য বলতে গেলে প্রতিদিনই এমন সময়ে তিনি আড়তে আসেন। নামাজ পড়ে কখনোও তিনি আবার বিছানায় গা এলান না। জমি জমা যা আছে সেগুলে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখেন। দেখতে তার ভালো লাগে। এই জমি জমা তার সন্তানের মতোই প্রিয়। তাই দেখতে দেখতে কিছুটা বেলা এমনিতেই গড়িয়ে যায়। তাই এদিকটা আসতে একটু দেরি হয়। দেরি হলেও অবশ্য সমস্যা নেই। বিশ্বস্ত লোক আছে। তারাই সব কিছু সামলে নেয়।
না নিয়ে উপায় কি? বড় ছেলে তার কাঁধের ভার তুলে নেয়নি। শহরে পড়তে গেছে, লেখাপড়া করে, সেখানে চাকরি নিয়ে সেখানেই বিয়ে করে বউ নিয়ে বসে গেছে। শহুরে বউ, গ্রামে এসে থাকতে পারে না। বছরে এক দু’বার আসে। কোন রকম থাকে, থেকে উড়াল দেয়। নাতি নাতনীও হয়েছে একেকজন লাট সাহেব। গ্রামে এসে তারা চোখ, নাক, মুখ কুঁচকায়। তাই ছোট ছেলেকে বলতে গেলে সে ধরেই রেখেছে। পড়ালেখা শেষ হতে না হতেই নিয়ে এসেছে। তবে ছেলেটা রগচটা। নিজের মেজাজ ছাড়া কাউকে দেখতে পারে কি না সন্দেহ। তবে বাপের নেওটা।
এটা তাকে খুব শান্তি দেয়। তবে মতিগতি বুঝে না। তাই ঘরে খুঁটি গাড়ার জন্য দু’দুবার বিয়ে ঠিক করলো। সেই বিয়ে নিয়ে তার মাথা ব্যথাও নেই। মেয়ের বাপেরা বসিয়ে রাখবে কতোদিন। কিছুদিন দেখে নিজের রাস্তা নিজেরাই দেখে।
তবে যেমনি থাক, এই ছেলেটা তার খুব প্রিয়। এই ছেলেটার মাঝে সে নিজেকে দেখে। যুবা কালে কিছুটা সে এই রকম’ই ছিল।
আজিজ তার পরনের ভাঁজ ভাঙা নতুন সাদা লুঙ্গি গুছিয়ে আসনে পা গুটিয়ে বসলো। গায়ে তার সাদা পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবি ছড়িয়ে বসতেই আক্কাস দৌড়ে হুক্কা নিয়ে এলো। আক্কাস তাদের বাড়ির বারো মাসের কামলা। তার ছায়া সঙ্গীও বটে।
আজিজ হুক্কা হাতে নিয়ে আয়েশ করে কয়েকটা টান দিতেই দেখলো বশির এগিয়ে আসছে। তার মাথায় এই গরমেও পেঁচানো মাফলার । শুকনো পাট কাঠির মতো শরীর। সেই শরীরের মলিন লুঙি, মলিন গেঞ্জির সাথে বড়ই আজিব লাগছে।
আর এই আজিব মাথায় কাহিনী সে কিছুটা অনুমান করতে পারছে। এলাকার গণ্যমান্য লোক সে। বাসায় শালিস বসাবে তাকে জানাবে না, তা হয় নাকি? তবে জোছনা ফুপুর মৃত্যুর পরে আজিজ একবার’ই সেই বাড়িতে গিয়েছিল। সারেং বাড়ির ছেলে, ছেলের বউদের মৃত্যুর খবর পেয়ে। হাজার হলেও আত্মীয়, না গেলে সমাজে মুখ থাকে না। তাই যাওয়া, এর পরে আর পা রাখেনি। তবে জাফরের সাথে তার সম্পর্ক ভালো। ভালো বলতে বেশ ভালো। অবশ্য হবেই না কেন? তার প্রিয় জোছনা ফুপুর ছেলে । এই ছেলের মুখের কথায় হাসতে হাসতে জীবনটা না দিয়ে দেয়।
জোছনা ফুপু তার দাদা, দাদির শেষ বয়সের সন্তান। শেষ মানে অনেকটা পরের’ই। কেননা তার আর তার ফুপুর বয়সের ফারাক তিন বছরের। সেই সময়তো এতো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ছিল না। বউ, শাশুড়ি এক সাথে পোয়াতির গাঁও গ্রামে দুনিয়ার নজির আছে। তাই সে আর জোসনা ফুপু বলতে গেলে এক সাথেই বড় হয়েছে। দেখতে ছিল কালো, খাটো তার মধ্যে শেষ বয়সের সন্তান। বড় হয়েছে হেলে ফেলে। তাই সারেং বাড়ি থেকে যখন দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব এলো। কেউ আর কোন অমত করেনি। বরং দিতে পারলেই যেন বাঁচে।
জোছনা ফুপু তার শুধু ফুপু ছিল না। ছিল তার খেলার সাথী, তার শৈশবের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না সব কিছুর ভাগীদার । সেই জোছনা ফুপুর অকাল মৃত্যু তার মানতে কিছুটা কষ্ট’ই হয়েছে। তাই সেই কষ্ট থেকে হোক আর যাই হোক। সারেং বাড়িতে পা রাখতে তার ইচ্ছে করে না। ঐ যে সাদা চুনকাম করা বিশাল বাড়িটা, সেটা তার কাছে মনে হয় জোছনা ফুপুর কবর। যেই কবরটা তার গুঁড়িয়ে বাতাসে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
বশির এগিয়ে এসেই সালাম দিলো। আজিজ সালাম নিলো। নিয়ে হুক্কা সাইডে রাখলো। রাখতেই বশির বললো, — মহাজন সাব, এতিম মাইয়া আমার। তারে বাঁচান।
আজিজ স্বাভাবিক ভাবেই বশিরের দিকে তাকালো। সব ঘটানাই তার কানে এসেছে। কানে এসেছে তার প্রিয় ছেলের কীর্তিও। মাঝ রাতে বাড়ি ফিরেছে। নাক মুখ ফাটিয়ে।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — আয়নার খোঁজ পেয়েছো?
— জ্বে মহাজন, বড়ই বিপদ তার।
— এতো চিন্তা জোর করার সময় মনে ছিল না?
— জোর করলাম কোথায় মহাজন! কখনো শুনছেন মাইয়ারা হাইসা হাইসা বিয়ের জন্য রাজি হয়। ভালো সম্বন্ধ। আমরা বুঝামুনা? তাছাড়া মাইয়া তো ভালো ভাবেই রাজি হইছিল। তার নাতি মাথা নষ্ট করছে।
— তার নাতি যা’ই করুক, কলঙ্ক তো তার গায়ে ছিটাফোঁটাও লাগবে না।
— এইডা তো এই হতভাগী বুঝে নাই। বুঝবো কেমনে, আসল দিন দুনিয়াতো তো কখনো দেখে নাই।
— সেই টা কি আর সমাজ বুঝবো।
বশির লুঙ্গি গুটিয়ে আজিজের পায়ের কাছে বসে পড়ল। বসে নিরুপায় হয়ে বললো, — বুঝবো না মহাজন সাব। কেউ বুঝবো না। মাইয়া ডারে বাঁচান। কালি ঘাট থেকে খবর আইছে। গ্রামের মানুষজন ধরছে। সারেং বাড়ির ছোট নাতির সাথে। আমি যেমন জানি, আপনেও তেমন জানেন। সে কোন পাপ করে নাই। শুধু একটা ভুল কইরা ফেলছে। নাদান মাইয়া, এইটুকু একটু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন।
— আমার ক্ষমায় হইবো টা কি? শুনলাম জয়তুন আরা আবার ঘোষনা দিসে, সে আর আয়নারে বউ করতে চায় না।
— আপনে চাইলে সব হইবো। কিছু একটা করেন। মাইয়ার মরণ ছায়া উপায় থাকবো না।
আজিজ আর কিছু বললো না। হাত বাড়িয়ে আবার হুক্কা টেনে নিলো। নিয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা নিশ্চুপ টান দিলো। তারপর চোখ খুলে বললো, — চলো যাই। দেখি কি করা যায়। এতিম মেয়ে, ছোট বেলা থেকে বাড়িতে আইলো গেলো। কি মায়া করে ডাকতো মহাজন চাচা । চুপচাপ বসতেও তো গায়ে লাগে। আহারে! মায়ের মতো আগুনের রুপ পাইছে, কপালডাও পাইছে মায়ের মতো।
জাফররা যখন কালি ঘাট পৌঁছালো সূর্য তখন মধ্য গগনে। এই গ্রামের ঘাটের পাশেই বড় এক কালি মন্দির। সেই মন্দিরের জন্যই নাম হয়েছে কালি ঘাট। নামে কালি ঘাট হলেও হিন্দু, মুসলিম মিলেমিশে’ই বসবাস।
জাফরের সাথে এসেছে ফরহাদ। এরশাদ’ই পাঠালো! সে অতি দরকার ছাড়া তাদের আশপাশের গ্রাম ছাড়া খুব একটা বেরোয় না। আর বের হলেও সেটা রাতে। ছোট চাচা শান্ত শিষ্ট মানুষ। কি থেকে কি হয়। তাদের লোক তো যাবেই তবে ফরহাদ গেলে সে নিশ্চিন্ত।
আর বন্ধুর শান্তি বলে কথা, ফরহাদ না এসে কোথায় যায়। তবে আজকে তার মেজাজ ভালো। ভালো বলতে ফুরফুরে। এই ফুরফুরে মেজাজে সেই গৃহস্থ বাড়ির উঠানে পা রাখতেই দেখলো শাহবাজ চেয়ারে বসে আছে, দু’হাত সামনে টাইট করে বাঁধা। ইশ! সে একটু আশাহত’ই হলো। ভেবেছিল গাছের সাথে গরুর মতো বাঁধা।
আশাহত হলেও শাহবাজের রাগে আগুনে থমথমে মুখখানি ফুরফুরে মেজাজে ভাটা পড়তে দিলো না। তবে অবাক হয়ে ঠিক তাকালো। কেননা তার পায়ের কাছেই তার দুই চেলা। একটার গালে হাত, কি হয়েছে কে জানে? গাল ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আরেকটার চিন্তায় চোখ মুখ শুকিয়ে আমের ফলসি । আর তাদের এই চেহেরা দেখেই ফরহাদ ঠোঁট টিপে হাসলো।
তার এই হাসি আর কেউ খেয়াল না করলেও শাহবাজ ঠিক করলো। করলো বলেই কটমটিয়ে তাকালো। তার তাকানোতে ফরহাদের তো কলিজাটা একেবারে ঠান্ডা শীতল বরফ হয়ে গেলো। সেই ঠান্ডা শীতল বরফের কলিজা নিয়ে হেসে ভ্রু নাচানো। সেই নাচানোর অর্থ, — দেখলি বড় ভাই ছাড়া উপায় নাই।
শাহবাজ আলাদা করে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মুখ আগের মতোই থমথমে। গর্তে পড়লে হাতি, চমচিকেও মারে লাথি। তার আজ সময় খারাপ। মনে মনে বলেই সে বাড়ির একটা রুমের দিকে তাকালো।দরজা, আঁচলে মুখ চেপে দাঁড়ানো মহিলাদের ভিড়ে কিছু দেখা যায় না অবশ্য। তবে সে জানে সেখানেই আয়নামতি কে রাখা হয়েছে। আর হয়েছে বলেই আগুন চোখে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ের জন্যই তো সব। একবার এই মুসিবত কাটুক। জয়তুন আরা ছেড়ে দিলেও এই শাহবাজ তো ছাড়বে না। সব সুদে আসলে শোধ নেবে। ভালো ভাবেই নেবে। শাহবাজ কারো ধার দেনা বাকি রাখে না।
আয়না বসে আছে হতবিহ্বল হয়ে। কি হচ্ছে, কি হবে, কোন কিছু নিয়েই আর তার মাথা ব্যথা নেই। খিদে, ক্লান্তি, ঘুম, ভয়। সব মিলেই সে বসে আছে নির্জীব ভাবে। ভেতরে আর কোন অনুভূতি বাকিই নেই। কেননা, ভোর রাত থেকে এই পর্যন্ত যা যা শুনেছে , তার মনে হলো মরে গেলে বেঁচে যেতো সে। এতো খারাপ কথা মেয়ে হয়ে কোন মেয়েকে বলা যায়, তার জানা ছিল না। এমনকি এক বৃদ্ধ মহিলা এক ফাঁকে ঠাস করে গালে একটা লাগিয়েও দিয়েছে। তার ফর্সা গালে এই থাপ্পড়ের দাগ এখনো ফুঁটে আছে। অথচ তাদের কথা কেউ একটা বার শোনার প্রয়োজন মনে করেনি। তারা আঙুল তুলছে, তারাই প্রশ্ন করছে, আবার তারাই সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই বলছে। তাদের মাথায় একটা বার কেন আসছে না, খারাপ কিছু করার হলে এই অচেনা গ্রামের বাড়িতে তারা আসবে কেন? দুনিয়ায় জায়গার অভাব আছে।
আয়না আর ভাবতে পারলো না। চোখ বন্ধ করলো আর মনে মনে ঠিক করলো। গ্রামে ফিরে যাবে না সে। এখান থেকে কোন ভাবে বের হওয়ার সুযোগ পেলেই ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
মহিউদ্দিন এই গ্রামের মহাজন। গ্রামের মানুষ তাকে সকালে খবর দিয়ে এনেছে। গোবর মাথার মানুষজন। ধরেই হুলুস্থুল পাকিয়ে ফেলেছে। এদের ধারণা না থাকলেও সারেং বাড়ির নাম তার জানা। অবশ্য সেই ভাবে কখনোও পরিচয় হয়নি। তবে গ্রামের মাথাদের নাম, ডাক কখনোও গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। মুখে মুখে কয়েক গ্রাম অনায়াসেই ছড়িয়ে যায়। যায় বলেই মুখ চেনা না থাকলেই তাদের নাম ঠিক জানা।
তাই এসেই এই ছেলেকে গাছ থেকে ছাড়িয়ে চেয়ারে বসিয়েছে। তবে মাথা খুব গরম। অবশ্য নাম ডাক ওয়ালা বাড়ির ছেলে পেলে মানুষ হবে এটা বড়ই বিরল। তবে এটার মতো পাগলা কিসিমের আর দেখেনি। কথার আগেই হাত চলে এর। তাই সম্মানে চেয়ারে বসালেও হাত খোলার ঝুঁকি নেয়নি। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছে এখন তাদের ছেলে তারা’ই এসে বিহিত করুক।
তবে এভাবে আসবে মহিউদ্দিন ভাবতে পারে নি। দুনিয়ার লোক নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস তাদের ছেলের গায়ে কেউ হাত তুলে নি। বরং এই ছেলেই কয়েকটাকে শুইয়ে ফেলেছে, দুইটাকে গাছের সাথে বাড়ি মেরে মাথা হা করে ফেলেছে। এলাকার লোক তো শুধু ধরে গাছের সাথে বেঁধেছে। এমন পাগলা ষাঁড় না বেঁধে উপায় আছে?
মহিউদ্দিন মনে মনে নিজেকে সামলে জাফরের উদ্দেশ্য বললো, — দেখেন ভাই সাহেব। আপনাদের সাথে আমাদের কোন ব্যক্তিগত রেষারেষি নাই। আপনাদের ছোট বা অসম্মানও করছি না। তবে দেখে শুনে পাপ তো মেনেও নিতে পারি না।
শাহবাজ ফুসে উঠলো! চিঁবিয়ে বললো, — তুই দেখছিস পাপ করতে?
মহিউদ্দিন নিজের রাগ দমালো। সারেং বাড়ির ছেলে থাক, সে নিজেও তো ফেলনা না। এই গ্রামের মহাজন সে। তাকে তুই তোকারি। না তার পছন্দ হচ্ছে না।
জাফর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি করবে এই ছেলেকে নিয়ে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই এগিয়ে গেলো। গিয়ে হাতের বাঁধন খুললো। খুলে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, — একটা কথাও না। যদি বলিস আমি কিন্তু চলে যাবো।
শাহবাজ রাগ নিয়েই বললো, — যাও নিষেধ করছে কে?
জাফর মৃদু ধমকে বললো — শাহবাজ..
শাহবাজ আর কিছু বললো না। রাগ নিয়ে’ই মুখে কুলুপ এঁটে বসলো। জাফর নিজের চেয়ারে এসে বসলো। বসে বললো, — মেয়েটার সাথে আমাদের বড় ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। একটু ভুল বোঝাবুঝিতে মেয়েটা রাগ করে চলে এসেছে। আমরা সবাই তাকে খুঁজছিলাম। শাহবাজও তাই করছিল আর কিছু না।
মহিউদ্দিন মনে মনে হাসলো! হেসে একবার শাহবাজের দিকে তাকালো। তুই, তোকারি না? তারপর চোখ ফিরিয়ে বললো, — হয়তো আপনাদের কথা ঠিক। তবে আমাদেরও যে বেঠিক তা তো না। কোনটা খোঁজা কোনটা অন্য কিছু, এতটুকু বোঝার বুদ্ধি নিশ্চয়’ই আল্লাহ দিছে। মহাজন তো এমনি এমনি হই নাই। তাছাড়া এই যে এতো গুলা মানুষ, সবাই তো আর চোখে ঘোলা দেখবে না। তাই এমনও হতে পারে বড় ভাইয়ের ঠিক করা মেয়ের সাথে ছোট ভাইয়ের পিরিত ছিল। রাগ করে চলে আসা না, নিজেরা’ই বুদ্ধি করে পালিয়েছে। তা না হলে অন্ধকারে গলা জড়াজড়ি করার কারণ তো দেখি না।
জাফর হতবাক হলো! শাহবাজ দাঁতে দাঁত পিষলো। ফরহাদ হাসলো! হেসে বললো, — সবই ঠিক, তবে এতো জায়গা থাকতে এ বাড়িতে এসে জড়াজড়ির কারণটা মাথায় ঠেকছে না। যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন। আসলে আমার আবার বুদ্ধিকম। খোলামেলা করে না বললে বুঝি না।
— কেন ছিল সেটা তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো।
— সেটা করা যায়। তবে সমস্যা হলো আপনেরা তো মানবেন না।
— কেন মানবো না?
— চোখের দেখা কি কেউ, মুখের কথা দিয়ে আড়াল করা যায়। তাই যা বলার আপনেরাই বলেন। আগে শুনি, তারপর দেখি কি করা যায়।
মহিউদ্দিন ভ্রু কুঁচকে তাঁকালো। এই ছেলেকে সুবিধার লাগছে না। তার ভ্রু কুঁচকে তাকানোর মাঝেই ফরহাদ আগের মতোই বললো, — বলেন মহাজন সাব, আপনারা কি কি দেখছেন? আমরাও একটুশুনি। না শুনে বুঝবো কিভাবে? আর দয়া করে একটু খোলামেলা করেই বলবেন। আগেই বলছি। আমি একটু কম বুঝি। তা জড়াজড়ি করে ছিল, কেমন জড়াজড়ি?
গ্রামের মানুষেরা ফুসে উঠলো! কেমন বেয়াদব মার্কা কথা বার্তা। ফরহাদ তাদের দেখে বললো, — ছেলে আমাদের মেয়ে আমাদের। যা করার আমরা করবো। এখন যদি এর মধ্যে এতো ফুসাফুসি করেন তাহলে তো সমস্যা।
মহিউদ্দিন তেজ নিয়ে বললো, – ডর দেখাও নাকি মিয়া?
ফরহাদ কানে হাত দিয়ে জিভ কাটলো। কেটে বললো, — কি যে কন চাচা। কোন দরকার এসব করার। তাছাড়া আমিতো এটাই বুঝতে পারছি না। আপনাদের’ই এসব করার দরকার কি? এমন তো না মেয়ে আপনাদের গ্রামের। সম্মানে হাত দিছে। এখন জান প্রাণ ছেড়ে সম্মান বাঁচাইতে হইবো।
— তাই বইলা পাপ মাইনা নিবো?
— মানার দরকার নাই। মেয়ে রাইখা দেন। পছন্দ মতো ছেলে দেইখা বিয়াশাদি দিয়া দেন। পাপ মোচনও হলো, এতিমের পাশে দাঁড়ানোও হলো।
— পাপ করবা তোমরা মোচন করবো আমরা? এটা কেমন কথা?
— তাও কথা। আচ্ছা ঠিক আছে। আমরাই করছি। আমাদের ছেলে মেয়ে পাপ করছে। আমরা নিয়া যাই। তারপর যা করার করবো। আপানের এর মধ্যে তো কোন কাজ নাই। তবে আপনারা কষ্ট করলেন, আমাদের ভাই কিছুটা বেয়াদবি করছে। সেটা সমস্যা না। ছোট মানুষ ভুল করতেই পারে। সে আপনার হাত ধরে নিজের ভুল স্বীকার করবে। দরকার পড়লে মাফও চাইবে। তাবে মহাজন সাব। ঝামেলা এখানেই শেষ করেন। কি দরকার পরের জন্য নিজের মধ্যে রেষারেষির দাগ টানার। পরে দেখা যাবে আম দুধে মিলে গেছে, আঠি নিয়ে ঝামেলা।
মহিউদ্দিন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসলো। এই ছেলে কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে ভালো করেই বুঝল। জোর করে কিছু করলে, এখন তারা করতে বাধ্য তবে পরে?
কোথাকার কোন ছেলে মেয়ে, কি দরকার অযথা ঝামেলার। তাই সে গলা খাঁকারি দিলো, দিয়ে বললো, – কথা তুমি খারাপ বলো নাই। তোমাদের মেয়ে, তোমাদের ছেলে তাই তোমরা তোমাদের গ্রামে নিয়ে বিহিত করো। তবে আমাদের সাথে বেয়াদবির জন্য ক্ষমা চাইবে। আর কয়েক জনকে যে আহত করছে এর ভরপাই দেবে।
ফরহাদ আগের মতোই হাসলো! তখনি ভরা মজলিসে আজিজ এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বললো, — সবই ঠিক আছে, তবে আমাদের মেয়ের কথাও যে একটু ভাবতে হবে মহাজন সাব।
সবাই অবাক হয়েই আজিজের দিকে তাকালো। সবাই অবাক হয়ে তাকালেও, ফরহাদ হলো বিরক্ত। কেননা তার বাপের পাশে’ই আয়নার চাচা। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এখন কি হবে। জাফর অবশ্য এতো কিছু ভাবলো না। বরং সে হেসেই এগিয়ে গেলো। সম্পর্কে ভাই হলেও তাদের মাঝে বয়সের তফাত আছে অনেক । তফাত থাকলেও মনের দিক থেকে অনেক কাছে। হাজার হলেও মায়ের রক্ত। সেই রক্তের টানতো থাকবেই।
জাফর যেতেই আজিজ বললো, — মেয়েটারে এই আসর থেকে এভাবে নিয়ো না জাফর। মরা ছাড়া উপায় থাকবে না। মেয়ে মানুষ বাপের বাড়ির চৌকাঠ পেরুয় স্বামীর হাত ধরে, আর স্বামীর বাড়ির চৌকাঠ পেরুয় খাটিয়ায় শুয়ে। আর যারা এর দু’য়ের বাইরে গিয়ে চৌকাঠ পেরুয়। তার স্থান হয় সমাজের নিচু স্থানে। অবুঝ মেয়ে, ভুল করছে। তার জীবনটা গুছিয়ে দাও জাফর।
জাফর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর শাহবাজের দিকে তাকালো। শাহবাজ তাদের কথা না শুনলেও তাকিয়ে আছে কঠিন চোখে। ফরহাদ মাথা নেড়ে বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে এগিয়ে শাহবাজের কাঁধ জড়িয়ে কৌতুকের সুরে বললো, — শাদি মুবারক ছোট ভাই।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১২
আয়নার কানে বিয়ের খবর এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। তবে তার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। মনে মনে তার অন্য চিন্তা। এই বাড়ির পাশেই রেল স্টেশন। কোন ভাবে একবার বের হতে পারলেই হলো। ব্যস, সব সমাধান। এর মধ্যে বিয়ে হলো, না হলো, কার সাথে হলো এই নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা হলো মহিলারা কেউ একা ছাড়ছে না। মৌমাছির মতো জেঁকে ঘিরে আছে। অবশ্য এখন ঘর খালি। আজিজ চাচা এসেছে, এসেছে তার লোভী চাচাও। তারা’ই কিছুক্ষণের জন্য ঘরটা খালি করতে বলেছে।
খালি হলেও সবাই এদিক ওদিক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। দেওয়ার অবশ্য কারণ আছে। তার চাচা তাকে দেখেই মাথা চাপড়ে বিলাপ শুরু করেছে। লোভী থাক, খারাপ থাক, নিজের রক্ত না থাক, বুকে আগলে বড় করেছে। সেই মেয়ের হাল দেখে ভেঙে চুরে বিলাপ আপনা আপনি’ই হয়ত বেরিয়ে এসেছে।
আজিজ কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ। চুপচাপ বসলেও তার দৃষ্টি আয়নার উপরে। আয়নার হাবভাব সে সবই খেয়াল করলো। সিধেসাদা গ্রামের মেয়ে। প্যাচ বোঝার মতো বয়স বা বুদ্ধি দু’টোর একটাও হয়নি। হয়নি বলেই আজিজ হাসলো! এই হাসি অবশ্য কারো চোখে পড়ার কথা না। এই হাসি নিজের, একান্তই নিজের। তাই হেসেই আক্কাসকে বললো, — আমি আয়নার সাথে একটু একা কথা বলবো। ঘর, আশ- পাশ খালি কর।
বশির চোখের পানি নিয়েই আজিজের দিকে তাকালো! তাকাতেই আজিজ বললো, — আয়নার বিয়ে হবে, আজ এক্ষুণি’ই হবে। শুধু বিশ্বাস রাখ বশির। তোর ভাতিজি হবে সারেং বাড়ির একমাত্র কর্ত্রী। আজিজ কখনো মিথ্যা আশ্বাস দেয় না।
বশির স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, সাথে লোভী মন আবার চকচক করে উঠল। তার আয়না হবে সারেং বাড়ির কর্ত্রী! তিন ধানের ক্ষেত আর এমন কি? তাদের দুনিয়া’ই তো ঘুরে যাইবো। সে চোখের পানি মুছে নিশ্চিন্তেই বেরিয়ে গেলো। মহাজন যেহেতু বলছে, আর কোন চিন্তা নাই।
বেরিয়ে গেলো আক্কাসও। বেরিয়েই উঁকিঝুঁকি মারা মহিলাদের সাইড করলো। করতেই আজিজ কোমল সুরে ডাকলো, — আয়না..
দুমড়ানো মুচড়ানো ধুলোবালি মাখা শাড়ি, এলোমেলো চুল, কোন রকম ঝুলে থাকা গহনা, আর ক্লান্ত বিধ্বস্ত মুখে আয়না বসে ছিল নির্জীব ভাবে। দৃষ্টি ঘরের মাটির মেঝের দিকে, এক পলকে। এই কোমল ডাকে আয়না একটু কেঁপে উঠল, তবে সেই পর্যন্ত’ই। না তাকালো, না উত্তর দিলো।
আজিজ উঠল! দাঁড়ালো ঠিক আয়নার সামনে। দাঁড়িয়ে বললো, — তোর জানতে ইচ্ছে করেনা , তোর বাবা – মায়ের সাথে কি হয়েছে?
আয়নার নির্জীব মুখের ভ্রু দু’টো একটু কুঁচকালো! সাদা ফ্যাকাশে মুখটা একটু যেন জীবন্ত হলো। আজিজ দেখলো, দেখে হাটু ভেঙে আয়নার সামনে বসলো। বসে আগের মতোই বললো, — তোর কি জানতে ইচ্ছে করে না, একই ভাবে দু’ দুটো মানুষ কি করে গায়েব হলো ? কেন হলো?
আয়না চোখ তুলে আজিজের দিকে তাকালো! তাকাতেই ক্লান্ত চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর হলো। সেই টইটম্বুর চোখের দিকে তাকিয়ে আজিজ বললো, — সারেং বাড়ি শক্ত খোলসে ঢাকা। বাহির থেকে যতোই আঘাত করো, সেটা ভাঙা সম্ভব না। ভাঙতে হলে ভেতর থেকে ছিদ্র করতে হবে। আর ছিদ্র করতে হলে ভেতরে যেতে হবে।
আয়নার গাল গড়িয়ে পানি পড়ল! আজিজ আয়নার মাথায় হাত রাখলো। রেখে বললো, — যাবি আয়না?
শাহবাজ বিয়ের কথা শুনলো শান্ত ভাবেই। শুনে শান্ত চোখেই জাফরের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — শুধু তুমি বলে শুনলাম। আর কেউ আসুক, জিন্দা দাফন দেবো।
— তাহলে আয়নার কথা ভুলে যা। আমি নিজে তাকে তার খালার কাছে দিয়ে আসবো।
শাহবাজ তার মতোই বললো — না।
জাফর বিরক্ত হলো, বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো — মাথা খারাপ হয়েছে তোর। তুই বুঝতে পারছিস কি করেছিস তুই। মেয়েটার মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।
— আমার কিছু আসে যায় না।
জাফর হাল ছাড়ল! কি করবে এই ছেলেকে নিয়ে। মরে যাবে তবে নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়বে না। তখনি উঠানে আয়না এসে দাঁড়ালো। তার হাতে দিয়াশলাই । সেটা ঘষে আগুন জ্বালিয়ে নির্জীব কণ্ঠে কোন রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — আমি সারেং বাড়ির বড় বউ হতে চাইনি। আমার আর সারেং বাড়ির ছোট নাতীর সম্পর্ক ছিল। তাই পালিয়েছিলাম। এখন সবার ভয়ে পাল্টি মারছে। বিয়ে করলে দাদিকে মুখ দেখাবে কি করে। তাই আমার আর কোন উপায় নেই। এক উপায় মুত্যু। তাই আপনাদের সাক্ষী রেখেই মৃত্যুকে আপন করে নিলাম। বলেই লাল বেনারসি শাড়ির আঁচলে আগুন ধরিয়ে দিল।
শাহবাজ হতম্ভব হয়ে গেলো! তার ধারণারও বাইরে ছিল আয়না এমন কিছু বলবে। হতম্ভব হলো ফরহাদও। আর কেউ না জানুক সে তো সব জানে। ভাগিয়ে আনলোও তো সে নিজে। জাফর আঁতকে উঠলো। এলাকার মানুষ দৌড়ে গিয়ে’ই সাথে সাথে আগুন নেভালো। নেভাতেই রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। এতিম, গরিব ঘরের মাইয়া, যা মন চায় তাই করবো। হাত ধরে ঘর থেকে বের করে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া। ফাজলামি নাকি? ক্ষমতা থাক তাদের নিজের কাছে, তারা আর কাউকে মানবে না। এই ছেলেকে উচিত শিক্ষা দেবে। দ্বিতীয় বার কোন মেয়ের জীবন নিয়ে যেন ছিনিমিনি না খেলতে পারে।
এবার অবশ্য শাহবাজ এতোটুকুও ক্ষেপলো না। হতম্ভব ভাব কাটিয়ে উঠল সাথে সাথেই। নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে আয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো! তারপর একটু হাসলো! তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে সোজা বললো, — বিয়ের ব্যবস্থা করেন ছোট চাচা। শাহবাজের কলিজা সম্পর্কে এর ধারণা নেই। যদি থাকতো ভয়, পাল্টি মারার মতো অপবাদ গায়ে দিতো না।
শাহবাজের বলতে দেরি বিয়ের ব্যবস্থা করতে দেরি হলো না। যেন এলাকার মানুষ এই অপেক্ষায়’ই ছিল। এলাকার মসজিদের ইমামকে সাথে সাথেই হাজির করা হলো। বিয়ের কার্যক্রম সব শাহবাজ নিজেই এগিয়ে করলো, করে কোন ভনিতা ছাড়া কবুল বললো, তেমনি পোড়া আঁচল গায়ে জড়িয়ে পোড়া কপালি আয়নাও কবুল বললো খুব স্বাভাবিক ভাবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই সবাই মোনাজাত ধরলো। ধরে শেষ হতে খুব একটা সময় গেলো না। শাহবাজ এগিয়ে গিয়ে আয়নার গালে ঠ্যাটিয়ে একটা লাগালো।
সবাই বলতে গেলে আঁতকে উঠলো। ভরা মজলিশে এমন কেউ করতে পারে, তাদের ধারণাও ছিল না। আয়নাকে বসানো হয়েছিল উঠানের এক কোণে চেয়ারে, মহিলাদের পাশে। দু’দিনের এতো এতো ধকলের পরে এই থাপ্পড় হজম করা তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। সাথে সাথেই উল্টে পড়ল। পড়ে আর কোন হেলদোল হলো না। মহিলারা এগিয়ে গিয়ে ধরতেই দেখলো জ্ঞান হারিয়েছে।
শাহবাজ নির্বিকার, নির্বিকার ভাবে’ই বললো, — আমার বউ যা খুশি তাই করবো, কারো কিছু বলার আছে?
সবাই হতম্ভব! বশির শুধু বিলাপ দিয়ে কেঁদে উঠল। তার মেয়েকে জিন্দা রাখবে না গো, জিন্দা রাখবে না। আল্লাহ! কোন পাপের শাস্তি দিতাছো?
জাফর অন্য রকম। মারপিট তো ভালোই কখনোও উঁচু গলায় কথা বলে না। তবে আজ এগিয়ে গিয়ে ঠাস করেই এক থাপ্পড় শাহবাজের গালে মারলো। শাহবাজের তাও তেমন কোন পরির্বতন হলো না। সে আগুন চোখে আয়নার দিকে আরো একবার তাকালো। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই যেতে যেতে বললো, — পিরিতের বউ আমার, সাবধানে নিয়ে আইসো ছোট চাচা।
জাফর চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো! ফেলে আয়নার চাচার সামনে গিয়ে বললো, — আমি নিজে এই মেয়ের দায়িত্ব নিলাম। আমি থাকতে আর একটা ফুলের টোকাও এই মেয়ের গায়ে পড়বে না।
আজিজ হাসলো! হেসে এগিয়ে কাঁধ জড়িয়ে বললো, — এই তো আমার ভাইয়ের মতো কথা।
______
বসন্ত যে বিদায় নিচ্ছে এই শেষ বিকেলে রোদ’ই তার তেজে ভালোভাবেই জানান দিচ্ছে। সন্ধ্যা নামো নামো করছে তবুও চারিদিকে কেমন গুমোট একটা ভাব। পৃথিলা জুঁইয়ের হাত ছেড়ে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছলো। মুছে আগের মতোই ছোট্ট চিকন হাতটা মুঠো করলো। মেয়েটা তার মতোই শান্ত। এই যে চুপচাপ কি সুন্দর হাঁটছে।
মিঠাপুকুর গ্রামটা আর পাঁচ দশটা গ্রামের মতোই। নদীর এই সাইডে হওয়ার সব কিছু থেকে একটু পিছিয়ে । কিছু কিছু জায়গায় ইট বিছানো রাস্তা হলেও, বেশিভাগই মেঠো পথ। মেঠো পথের এক সাইডে বসত বাড়ি। আরেক সাইডে ফসলের জমি। সেই জমির সাইড ঘেঁষে রাস্তায় পৃথিলা ধীরে ধীরে হাঁটছে। তার এক হাতের মুঠোয় জুঁই আরেক হাতের মুঠোয় মাটির একটা কালো কলসি। সাবিহাও সাইডে।
সাইডে থাকলেও তার দু’হাতে মাটির হাড়ি। তারা বেরিয়েছিল একটু হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতেই এক কুমোর বাড়ি পড়ল। পৃথিলাকে টেনে নিলো দেখাতে। হিন্দু বাড়ি, কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে উঠান। উঠানের মাঝ বরাবর তুলসি তলা, সীমানা ঘেঁষে জবা, বেলী ফুলের গাছ। পৃথিলা ঘুরে ঘুরে দেখলো। দেখতে দেখতেই এই মেয়ে হাড়ি পাতিল কিনে একাকার। সেগুলোই এখন দু- হাতে ঝাপটে ধরে নিচ্ছে। নিতে গিয়ে নাজেহাল। তাই সে নিজেই এই কলসি টেনে নিলো। মেয়েটা পারেও বটে। সেই আগের মতোই আছে, কি করে না করে তার কোন হদিস নেই।
— এমন থম মেরে আছিস কেন?
পৃথিলার দৃষ্টি ছিল ফসলের ক্ষেতে। সেখানে দৃষ্টি রেখেই ধীরে ধীরে হাঁটছিল। সূর্যটা ডিমের কসুমের মতো নরম কোমল হয়ে নিচে নেমে এসেছে। ধানের ক্ষেতের ওপারে রং তুলির আঁকা ছবির মতো লাগছে। তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে সাবিহার দিকে তাকিয়ে বললো, — আমিতো সব সময়’ই এমন।
— উঁহু। আগে কথা কম বলতি তবে এমন ছিলি না।
— বয়সও তো আগের মতো নেই।
— আমি কি বদলেছি?
— সবাই কি আর এক রকম হয়।
— তা ঠিক, এই যে দেখ আগেও কালির পাতিল ছিলাম, এখনো আছি। তার সাথে যোগ হয়েছে মাংস। চলতি ফিরতি আস্ত এক ধানের বস্তা।
পৃথিলা হালকা হাসলো! হেসে বললো, — এটা বস্তা না সুখ।
— বলেছে তোকে।
পৃথিলা আবারো হালকা হাসলো! হাসতেই খেয়াল করলো, আজ সারা দিন তারেকের কথা মনে পড়েনি।
সাবিহা নিচু হয়ে রাস্তায় হাড়িগুলো রাখলো। রেখে আঁচল ভালো ভাবে টেনে বললো, — মাথায় আঁচল তোল পৃথি। গাল ফেটে তো রক্ত বের হবে।
পৃথিলা টানলো না। শুধু আঁচল টেনে আরেকটু গায়ে জড়ালো। এক হাতে কলসি, আরেক হাতে জুঁই। একটু ঢিলে হয়েছিল। তাছাড়া ঘোমটায় সাবিহাকে বউ বউ লাগছে। যেটা সে আর কখনোও লাগতে চায় না।
সে আঁচল টেনেই আবার ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকালো। তাকিয়ে আবার ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো। তার গায়ে জলপাই রঙের তাঁতের শাড়ি। মাথায় সাধারণ হাত খোঁপা। অধিকাংশ সময় তার এভাবেই কাটে। সাজ সজ্জায় আগে থেকেই আনাড়ি। সাধারণ কাজল টানতে গেলেও ছড়িয়ে ফেলে। তারেক খুব আফসোস করতো। তার চোখ নাকি অসম্ভব সুন্দর। কোণাটা কেমন যেন বাঁকা। যেন হরিণের চোখ।
তাই প্রায়’ই খুব আফসোস করে বলতো, — তুমি মেয়ে নামের কলঙ্ক পৃথি। এতো মায়াবি একটা মুখ, একটু গোছাতেও পারো না।
আসলেই সে মেয়ে নামের কলঙ্ক। কলঙ্ক না হলে তার জীবন এমন হয়। তখনি শিস বাজলো। পৃথিলা ফিরে তাকালো। এক বিশাল পাকুড় গাছের নিচে এক দল ছেলে গোল হয়ে বসে আছে। কি করছে কে জানে। সে ফিরে তাকাতেই সবাই খিকখিক করে হাসলো।
পৃথিলা দাঁড়িয়ে গেলো। অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না। সাবিহা বলতে গেলে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে এলো। যেতে যেতেও পৃথিলা আবার তাকালো। এতোক্ষণ কি করছে না বুঝলেও একজনের সাইডে কালো কাচের ঔষুদের বোতল দেখলো।
পৃথিলা ঘাড় ফিরিয়ে বললো, — এভাবে নিয়ে এলি কেন?
— ওরা ভালো ছেলে না। নেশা টেশা করে। তুই তো দেবি মহারানি। কি না কি বলে ফেলিস।
— এলাকার মানুষেরা কিছু বলে না?
— এই সব, সব এলাকায়’ই থাকে। এতো বলে লাভ কি? তাছাড়া এখন তোকে চিনছে না বলে শিস বাজিয়েছে, যখন চিনবে আর করবে না। আমি এরশাদ ভাইকে বলে দেবো।
— তাকে বলতে হবে কেন?
সাবিহা হাসলো! হেসে বললো, — বললে সমস্যা কি?
পৃথিলা সেই কথার উত্তর দিলো না, কথা ঘুরিয়ে বললো, — তুই আগেই কি চাকরির ব্যাপারে কথা বলেছিলি?
— না তো! আমি কি জানতাম তুই আসবি?
— তাহলে জাফর মানে ওনি এই ভাবে বললেন কেন?
সাবিহা থতমতো খেয়ে গেলো! সাথে সাথে’ই নিজেকে সামলে বললো, — আরে সকালে তো ইমরান গিয়েছিল। হয়ত সে বলেছে। তাছাড়া তখন পরিস্থিতি এমন ছিল তাই হয়ত একটু বাড়িয়ে বলেছে।
— আমার পরিস্থিতিতে তাদের কি?
সাবিহা ফ্যাকাশে মুখে বললো, — জাফর চাচা এমনি। নরম মনের মানুষ। ভেবেছে আমার বান্ধবী। আমাকেও তো খুব স্নেহ করে।
— তুই বন্ধুর মেয়ে, সেটা তো করবেই। তবে আমি কে?
সাবিহা অসহায় ভাবে ঢোক গিললো! মিথ্যা সে খুব একটা বলতে পারে না। বলতে গেলেও ধরা খায়। এখনো ঠিক খাবে। আল্লাহ রক্ষা করো।
পৃথিলা আর কিছু বললো না! তবে কিছু একটা ঠিক নেই। কি নেই, সে ধরতে পারছে না।
পৃথিলা চুপচাপ কিছুক্ষণ সাবিহার দিকে তাকিয়ে রইল।তারপর ঘুরতেই চমকে উঠল! কথা বলতে বলতে একটা মোড়ে এসেছে খেয়াল করেনি। সেই মোড় থেকেই কয়েকজন লোক এক সাথে বেরিয়েছে। আরেকটু হলে ধাক্কা খেতো। সেই ধাক্কা থেকে বাঁচতে এতোটাই চমকেছে যে হাত থেকে কলসি ছুটে গেছে।
সাবিহা হা হয়ে গেলো। হা হয়েই বললো, — এতোদূর থেকে টেনে আনাই বিফলে গেলো রে পৃথি।
পৃথিলা নিজেও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে মোড় থেকে আসা মানুষগুলোও। শুধু তাকিয়ে না, তারা থতমতো খেয়ে গেছে । তারাও খেয়াল করেনি। আর তাদের পেছন থেকেই এরশাদ উঁকি দিলো । সে পেছনে ছিল। একটা লোকের সাথে কথা বলছিল। শব্দ শুনে উঁকি দিয়েই থমকালো। না থমকে উপায় কি? ভাঙা কলসি তার সামনে চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী।
আর এই শেষ বিকেলের কোমল নরম আলোয় এরশাদ শুধু বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রমণী দেখলো না। দেখলো বিস্ময় মাখা অসম্ভব সুন্দর দু’টো চোখ। আর সেই চোখে তার সর্বনাশ।
তখনি এক ছেলে দৌড়ে এলো! এসে হাপাতে হাপাতে বললো, — শাহবাজ ভাই বিয়ে করছে। আয়নামতি কে। ছোট চাচা, ফরহাদ ভাই বউ নিয়ে বাড়িতে আইছে।
এরশাদ অবাক হলো না। তবে পৃথিলা অবাক হয়ে বললো, — এটা কি সেই নৌকার মেয়েটা?
— হ্যাঁ।
— আপনি তাকে ট্রেনে তুলেন নি?
— তুলেছি ।
— তো?
এরশাদ হাসলো! হেসে তার সাথের লোককে ইশারা দিলো সাবিহার হাতে হাড়ি গুলো নিতে। ইশারা দিয়ে বললো, — দুনিয়ার সব খন্ডানো যায় তবে ভাগ্য না। তার ভাগ্যে সারেং বাড়ির বউ হওয়া লেখা ছিল। তাই যে ভাবেই হোক হয়েছে, বা এমনও হতে পারে অন্য কাউকে তার সঠিক জায়গায় আনার জন্য তার ভাগ্য ঘুরে ফিরে গেছে।
পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো! এরশাদ সেই কুঁচকে যাওয়া চোখের দিকে আবারো তাকালো। তাকিয়ে’ই বাড়ির দিকে রওনা দিলো। জয়তুন আরা আগুন লাগিয়ে দেবে।
নিশ্চুপ সারেং বাড়ি সন্ধ্যার আগে আগে আবার জাঁকজমক হয়ে উঠল। উঠার কারণ সারেং বাড়ির ছোট নাতি বিয়ে করেছে। অন্য কোন মেয়েকে না, বড় ভাইয়ের পালিয়ে যাওয়া বউকে। সেই বউকে’ই সারেং বাড়ির ছোট ছেলে সসম্মানে বাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। ছোট নাতির খবর নেই। বউয়ের অবস্থাও খারাপ। গরুর গাড়ির এক কোণে বলতে গেলে মরার মতো পড়ে আছে।
সেই পড়ে থাকা বউকে এক ঝলক দেখার জন্যই সারেং বাড়ির উঠানে এলাকার লোক জমাট বেঁধে গেলো। জয়তুন বসার ঘর থেকেই হুঙ্কার ছাড়লো। মাগরিবের আযান কানে আসার আগে আমার উঠান ফাঁকা চাই।
কালাম দৌড়ে গেলো! শুধু সে না, দৌড়ে বেরুলো সারেং বাড়িতে থাকা প্রতিটা মানুষও। শুধু বেরোলো না জয়তুন আরা। সে বসার ঘর থেকে জাফরের উদ্দেশ্য বললো, — এই মেয়েকে আমি ঘরে তুলবো না। যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যা, তবে সারেং বাড়িতে না।
জাফর বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে তার শান্ত কণ্ঠে’ই বললো, — সারেং বাড়ির বউ সারেং বাড়ির সম্মান। যেভাবেই হোক বিয়ে হয়েছে। আর হয়েছে বলেই সে এই বাড়ির অংশ। আর আমি থাকতে সারেং বাড়ির কোন অংশ পথে ঘাটে থাকবে না।
— তাহলে তুইও বেরিয়ে যা।
জাফর হাসলো! হিসেব অনুযায়ী পুরো সারেং বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী সে। সে হেসেই গরুর গাড়ির দিকে এগুলো। আয়না পড়ে আছে এক দিকে, ফরহাদ বসে আছে সামনের দিকে। তার নিজের অবস্থাও খারাপ। জ্বর আসবে কি না কে জানে? চোখে মুখে ঘোলা দেখছে। আরে জ্বালারে! একটায় বিয়ে করবে না, আরেকটায় আয়নামতি কোথায়, আয়নামতি কোথায় বলে বলে চোখ, নাক, মুখ ফাটিয়ে এখন বিয়ে করে গায়েব। আর এইদিকে এই আপদকে টানা ছেঁচড়া করতে করতে তার জীবন বরবাদ। ছ্যাহ্!
সে বিরক্ত মুখেই গাড়িয়াল কে ধমকে বললো, — যা বেটা মহাজনের বাড়ির দিকে যা।
গাড়িয়াল অবশ্য গাড়ি বেরও করতে পারলো না। তখনি এরশাদ এলো। এরশাদ সাথে সাথে পৃথিলাও এলো। পৃথিলাকে দেখে ফরহাদের চান্দি আরো গরম হলো। এই আপদ দেখি এখনো এরশাদের পেছন পেছন ঘুরছে। দেখতো! সূর্য এক দিকে উঠে আরেক দিকে ডুবে গেছে। আর এরা এখনো চম্বুকের মতো লেগে আছে। হাহ্! কপাল, সবই কপাল।
চলবে……