#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ১৫
ঘড়ির কাঁটা তখন একটা ছুঁইছুঁই। চারদিকে তখন নিস্তব্ধ ঘুমেরা ছনের, টিনের, ইটের ঘরের কোণে কোণে নিজ দায়িত্বে বিরাজ করছে, সেই নিস্তব্ধতার চাদর ভেদ করে মিঠাপুকুর সদর হাসপাতালে পরপর কয়েকটি ভ্যান ঢুকলো। একটার পর একটা। আর ঢুকতেই জয়তুন আরার লোকেদের মধ্যে কয়েকজন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গেলো ভেতরে । তারা যেতেই নামলো এরশাদ। ভাইয়ের মাথাটা পুরো রাস্তা শক্ত করে বুকে চেপে বসে ছিল। ছিল বলেই গায়ে ঘিরে রঙে শার্টটা রক্তে মেখে একাকার। মুখ থমথমে, চোয়াল শক্ত। সেই শক্ত চোয়ালে ঝলসে যাওয়া মুখটা যেন আরো শান্ত, গভীর, অন্য রকম ভয়ংকর।
এরশাদ ভেতরে গেলো না। সে দাঁড়িয়ে রইল, ছোট ভাইকে শুইয়ে রাখা ভ্যানের সাথেই। শাহবাজের জ্ঞান নেই! অর্ধেক রাস্তা কোনরকম ছিল। মোটা কাঠের বাড়ি। আরেকটা পড়লে এইটুকুও থাকতো না। বড় ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলেছে, — আমার ভাগের বাড়ি এই ফাজিল মেয়েটা নিয়েছে ভাই। আমার যদি কিছু হয়, তুমি নিজ দায়িত্বে একে ইটের চুলায় দেবে। শাহবাজের সাথে ঢং। এতো বড় সাহস?
এরশাদ নিশ্চুপ শুনেছে। ছোট ভাইয়ের কথায় তার ধ্যান ছিল না। তার সব ধ্যান তখন কাপড় দিয়ে চেপে রাখা শাহবাজের মাথায়। ভিজে কেমন চিপচিপে হয়ে যাচ্ছে।
তখনি স্ট্রেচার নিয়ে দৌড়ে এলো হাসপাতালের লোকেরা। শাহবাজকে তুলে নিয়েই আয়নার ভ্যানের দিকে গেলো। সেই ভ্যানে পৃথিলা, আম্বিয়া। আম্বিয়া স্বাভাবিক থাকলেও পৃথিলা থমকে আছে। তার জলপাই রঙের শাড়িও পুরো রক্তে মাখামাখি।
আয়নার চিৎকার শুনেই তারা ছুটে বেরিয়েছে। সারেং বাড়ি বিশাল উঠান নিয়ে, ইমরানের ঘরটাই বরং কাছে, তাই তারাই আগে এসেছে। আর এসেই স্তব্ধ! মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে কী থেকে কী হয়ে গেল!
পৃথিলা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তবে দৌড়ে গিয়েই শাড়ির আঁচল দিয়ে আয়নার মাথাটা চেপে ধরেছে। তখনো আয়নার জ্ঞান আছে। ধরতেই নিভু নিভু চোখে তার দিকে তাকালো, কাঁপা হাতে পৃথিলার হাতের উপরে হাতটা রাখলো হালকাভাবে। অস্পষ্ট কণ্ঠে কিছু একটা বললো, পৃথিলা বুঝতে পারল না ঠিক, কিন্তু অনেক অনেক দিন পরে তার চোখ দুটো পানিতে ভিজলো। এই তো, এই তো কিছুক্ষণ আগেই এই মুখে তুলে ভাত খাওয়ালো। সেই অশ্রুসজল চোখেই পাশে পড়ে থাকা শাহবাজের দিকে তাকালো। রাতের আধো আলো আধো অন্ধাকারে খুব কিছু বোঝা যায় না, তবে ধূসর মাটিতে কালো বর্ণের কিছু উপরে তার মাথাটা পড়ে আছে। আর এই কালো বর্ণ কিসের তার বুঝতে অসুবিধা হলে না।
ইমরান ভাই, সাবিহা তখন শাহবাজকে ধরেছে। তারও জ্ঞান আছে কি নেই পৃথিলা বুঝতে পারলো না। তবে তার মনে হলো এই আধো আলো, আধো অন্ধকারেও যেন এক দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে। এর মধ্যেই সারেং বাড়ির লোকজন দৌড়ে এলো।
এত পাহারা, এত মানুষ, এতটা সতর্কতার মাঝে কার এমন সাহস হলো? কারোই কোন ধারণা হলো না। ধারণা করার সময়ও অবশ্য কেউ পায়নি। তাদের লোকেরা দৌড়ে কোথা থেকে ভ্যান আনলো পৃথিলা জানে না। তবে ভ্যান আসতেই হাসপাতালের জন্য বেরিয়েছে।
মফস্বল গ্রামের হাসপাতাল। যতোই সদরে থাক চিকিৎসার অবস্থা বড়ই করুন। তার মধ্যে এতো রাত ভালো ডাক্তার নার্স কিছুই নেই। তবে যেই ডিউটি ডাক্তার ছিল সে’ই সারেং বাড়ির কথা শুনে দৌড়ে বেরুলো। সাথে সাথে জুরুরি বিভাগে তাদের নেওয়া হলো।
নিস্তব্ধ রাতে, নিস্তব্ধ হাসপাতালের করিডোরে সবাই নিস্তব্ধতার চাদরে মুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রইল পৃথিলাও। এখানে সে কেউ না। কোন অধিকারও নেই। কেন আছে, নিজেও জানে না। তবে ভ্যানে যখন আয়নাকে তোলা হলো, সে নিজেও উঠে বসলো। আয়নার মাথাটা নিজের কোলে নিলো। ভেবেছিল কেউ কিছু বলবে। তবে সেই রকম কিছুই হলো না। জাফর লোকটা শুধু এগিয়ে ধরা গলায় বললো, — চেপে শক্ত হয়ে বসো মা, মাটির এবড়ো থেবড়ো রাস্তা, তাল সামলাতে পারবে না।
ফরহাদ যখন হাসপাতালে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাটা দুইটার ঘরে। মধ্য রাত হলেও গ্রামের অনেকের ঘরেই এই খবর পৌঁচ্ছে গেছে আনায়াসেই। তাদের ঘরেও তেমন, আর পৌঁছুতেই ঘুম থেকেই তার মা টেনে তুলে বললো, — সারেং বাড়িতে হামলা হইছে। শাহবাজ আর আয়নার উপরে। তাদের সদরে নেওয়া হইছে।
এক জ্বর তার মধ্যে আকস্মিক ঘুম থেকে টেনে তোলায় ফরহাদ প্রথমে বুঝতে পারলো না। আর যখন বুঝল ধড়ফড়িয়ে উঠল। উঠে ঘরের গেঞ্জির উপরেই কোনরকম প্যান্টটা পরে দৌড়ে বেরুলো।
হাসপাতালে পৌঁছেই ফরহাদ এরশাদকে খুঁজলো। সে করিডোরে নেই। জাফরের দিকে তাকাতেই বললো, — বাহিরে।
ফরহাদ এগিয়ে গেলো। হাসপাতালের এক সাইডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে সিগারেটের আগুন উঠানামা করছে।
ফরহাদ এগিয়ে গেলো। গিয়ে নিশ্চুপ পাশে দাঁড়ালো। এরশাদের তেমন ভাবান্তর হলো না, তবে নিজের আধ খাওয়া সিগারেট ফরহাদের দিকে এগিয়ে দিলো।
ফরহাদ নিলো স্বাভাবিক ভাবেই। নিয়ে টান দিয়ে বললো, — কিভাবে হলো?
— সম্ভবতো ইমরানের ঘরের কোণা দিয়ে এসেছে। এই সাইডে তো আমাদের দুনিয়ার লোক। ওদের সাইডটাই নিশ্চুপ।
— দুই বাড়ির রাস্তাটা আটকে দিলেই তো পারিস।
— বীণা, সাবিহাদের ওখানে আসা যাওয়া করে। তাছাড়া ইমরানের সাথেও অনেক কাজটাজ থাকে। বন্ধ করলে এক মল্লুক ঘুরে সদর দরজা দিয়ে আসতে হবে।
— ওদের অবস্থা কি?
— কিছু হবে না।
ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো! এরশাদ ফরহাদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে আবার টান দিয়ে বললো, — মারার জন্য এই আক্রমন হয়নি। হলে কেউ এতো রিস্ক নিয়ে কাঠের টুকরো নিয়ে আসে না। লোহার হাতিয়ার বা অন্য কিছু। যেন এক বাড়িতেই কাজ খতম।
— তাহলে?
এরশাদ উত্তর দিলো না। সিগারেটের শেষ অংশ পায়ে পিষলো।
তখনি আয়নার চাচার হাউকাউ শোনা গেলো। খবর পেয়ে সেও দৌড়ে এসেছে। আর এসে সব দোষ সারেং বাড়ির লোকদের দিচ্ছে। জাফরের সামনে গিয়ে গলা চড়ে একচোট চোটপাটও করলো। করবে না কেন? পাঁচ জনের সামনে দায়িত্ব নিছে। কেমন দায়িত্ব নিলো? কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তার ভাতিজি মরার সাথে লড়ছে।
এরশাদ এগিয়ে গেলো। গিয়ে অবশ্য ডানে বামে কোন দিকেই গেলো না। সোজা গেলো আয়নার চাচার সামনে। গিয়েই কান বরাবর একটা মারলো।
আয়নার চাচা শুকনো মানুষ। উলটে পৃথিলার পায়ের কাছে পড়লো। পৃথিলা হতম্ভব! অন্তত এই মানুষটার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করেনি। সারেং বাড়ির এতো মানুষের মাঝে একমাত্র এই লোকটাকে’ই কেন জানি অন্য রকম মনে হয়েছিল।
তার হতম্ভব কে আরো বাড়িয়ে এরশাদ এগিয়ে আয়নার চাচার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। বসে বললো, — মেয়ের জন্য প্রস্তাব কি গেছে বাড়িতে , কলিজা গলা পর্যন্ত উঠে গেছে। সারেং বাড়ির মানুষের সামনে আঙুল নাচিয়ে গলা চড়ে কথা বলিস। এতো সাহস! শুধু আয়নার চাচা বলে এখনো বেঁচে আছিস। তা না হলে হাওয়ায় মিশে যেতি। এখন ওঠ! ওঠে সোজা নাক বরাবর হাঁটা ধরবি। আয়না নামের কাউকে চিনতি একেবারে ভুলে যাবি। আয়না এখন সারেং বাড়ির বউ। মরবে, বাঁচবে, যা হবে সব সারেং বাড়ির মানুষ দেখবে। আর একবার যদি এই মুখ এরশাদ দেখে। তোর কমস, এবার চুল যাবে না, সোজা মাথা।
বশির কাঁপতে কাঁপতে উঠল। এরশাদের এই রুপ আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি। বরং ভদ্র নম্রের খেতাব তার আছে। তবে আজ কি হলো? সে হন্তদন্ত হয়ে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই দিক বেদিক না দেখেই দৌড়ে গেলো। পৃথিলা এখনোও হতম্ভব। সেই হতম্ভব মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই এরশাদ উঠে দাঁড়ালো।
পৃথিলা নিজেও এখানে বাহিরের। যেখানে আয়নার চাচাকে স্পষ্ট ভাবে বলা হলো। সেখানে সে কে? পৃথিলা উঠে দাঁড়ালো। বাইরে ভ্যানগুলো এখনো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। কাউকে বললেই নিয়ে যাবে। সে ঘুরে বাইরে যাবে তখনি এরশাদ শান্ত ভাবে বললো, — আপনাকে কিছু বলা হয়নি।
পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকালো। সেই ভ্রু কুঁচানো চোখের দিকে তাকিয়ে এরশাদ আগের মতোই বললো, — এক সাথে এসেছি, ইনশাআল্লাহ আমার ভাই, ভাইয়ে বউকে নিয়ে একসাথেই ফিরে যাবো।
পৃথিলা সোজা দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে বললো, — এইসব কে করেছে?
— আমি জানি না।
— কেন করেছে?
— বলতে পারছি না।
— কিসের ক্ষমতা দেখান আপনার? নিজেদের মানুষকেই দেখে রাখতে পারছেন না। অহংকার, জেদ, ক্ষমতা কখনোও ভালো কিছু বয়ে আনে না। এই যে আজ যা হলো, হয়ত আপনাদের কোন কর্মকান্ডের’ই অংশ। আর আপনাদের অংশে নির্দোষ মেয়েটা ফেসে গেছে।
এরশাদ কিছু বললো না। বাকি জীবনে এই মুখের উপরে কিছু বলতে পারবে বলে মনেও হয় না। তার অবস্থা তার দাদার মতোই হবে। উঠতে বললে উঠো, বসতে বললে বসো।
পৃথিলা চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিতে নিতে বললো, — লোকটা আপনার বাবার বয়সী ছিল। হয়ত সে ভুল, তবে হাতটা না ওঠালেও চলতো।
এরশাদ এবারো কিছু বললো না। তাবে এক নার্স এসে বললো, — মেয়েটার জন্য রক্ত লাগবে। রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ।
জাফর,পৃথিলা দু’জনে এক এক সাথেই বললো, — আমার এ পজেটিভ। জাফর অবাক হয়নি, নিজের মেয়ে, মিল থাকা স্বাভাবিক। পৃথিলা ও অবাক হয়নি। এই পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের রক্ত এ পজেটিভ।
বরং সে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — আপনি বসুন! আপনি বয়স্ক মানুষ। তাই আমি দিচ্ছি। বলেই এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গেলো এরশাদও। ডাক্তার কে দেখে জিজ্ঞেস করলো, — আমার ভাইয়ের কি অবস্থা?
— আঘাত ভালোই। তবে অন্ধকারে বাড়িটা হয়তো যে ভাবে দিতে চেয়েছিল সে ভাবে দিতে পারেনি। তাই আপাতত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে আপনার ভাইয়ের চেয়ে মেয়েটার টা বেশি গুরুতর।
— সমস্যা হবে নাতো কোন?
— আপাতত দেখছি না। জ্ঞান ফিরুক তারপর বাকিটুকু বোঝা যাবে।
জয়তুন আরা বসে আছেন পাথর হয়ে। ঐ যে সারেং বাড়ির খোলা লম্বা টানা বারান্দা, চুপচাপ সেখানে। তার পাশেই সাবিহা, বীণা। ইমরানও সাথে গেছে। তাই সাবিহা এক হাতে মেয়ে, আরেক হাতে বীণাকে ঝাপটে ধরেই বসে আছে। মেয়েটার শরীর থরথর করে কাঁপছে। জ্ঞান হওয়ার পরে তো আর এমন কিছু দেখে নি। শুধু দেখেছে সারেং বাড়ির ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা এই প্রথম ধুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখলো।
জয়তুন আরা কাঁদেন না। শেষ বার তার চোখ ভিজেছিল তার বড় ছেলের লাশটার মুখে হাত বুলিয়ে। নিজের পেটের সন্তান না, তবে এই সন্তানটা তার কলিজা ছিল, বুকের ধন ছিল। এই হাতের উপরেই বড় করেছে। করেছে বলেই বিশাল এক পাপ করতেও তার হাত একবার কাঁপেনি। কাঁপা তো দূর আজ পর্যন্ত একবারের জন্য আফসোসও আসেনি। সেই জসিমের গলাটা তার চোখের সামনে কাটা হয়েছিল। আহা যন্ত্রণা! আহা ছটফট! সেই ছটফটের কষ্টটা যেন জয়তুন অনেক অনেক দিন পরে আবার পেলো। আর পেলো বলেই। অনেক অনেক দিন পরে তার চোখের কোণাটা আবার ভিজে উঠল।
সেই ভেজা চোখের পাতার ভেসে উঠল অনেক দিন আগের একটা রাত। সেই রাতটা ছিলো আষাঢ় মাসের এক ঘন বর্ষার রাত। সন্ধ্যা থেকে অবিরাম বৃষ্টি । রাত হতে হতে সেই বৃষ্টির প্রকোপ যেন বাড়লো, আরো বাড়লো।
জাফর সেইদিন বাড়ি ছিল না। তখন সে দু’এক দিন পরপর’ই শহরে দৌড়ে যায়। কেন যায় জয়তুন আরা জানে। তার প্রথম স্ত্রী শায়লা কে খুঁজতে। জয়তুন অবশ্য সব জেনেও আর কখনো কিছু বলেনি। কেননা খোঁজ সে নিজেও করেছে। অবশ্য ছেলের ঘর বসানোর জন্য না, চিরদিনের জন্য মিটিয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু আফসোস! জাফর যেমন খোঁজ পায়নি, সে নিজেও পায়নি। তাই হাল ছেড়েছে।
তখনতো তো আর এই বাড়িটা এখনের মতো ছিল না। চারিদিক ছিল খোলা। বাড়ির মানুষজন ছাড়া তেমন কোন মানুষজনও নেই। যার যার রুমে সে সে সুখ নিদ্রায় ব্যস্ত। সেই ব্যস্তটা জয়তুনের ছুটলো একটা শব্দে। জয়তুন ধড়ফড়িয়ে উঠলো। নিচে আম্বিয়া মা, আম্বিয়া আর সে ছাড়া কেউ থাকে না। সবাই উপরে। তাই এই ঝড় বৃষ্টির রাতে শব্দটা তার কানেই আগে এসেছে।
শব্দটা এসেছে বাড়ির পেছন থেকে। পেছনে ছোট একটা কাঠের দরজা আছে। আগে যখন হিন্দু বাড়ি ছিল তখন মহিলারা এটা দিয়ে নদীর ঘাটে আসা যাওয়া করতো। সেটা যে ভাঙা হচ্ছে বোঝার বাকি রইল না। সে দৌড়ে আম্বিয়ার মার রুমে যেতে চাইল। অবশ্য যাওয়ার সুযোগ পেলো না। তার আগেই লাল গামছা মুখে বাঁধা একদল লোক পুরো নিচের ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। আধো আলো, আধো অন্ধকারে হারিকেনের আলোয় জয়তুন কাউকেই চিনলো না। এমন ভাবে মুখ বাঁধা চেনার কথাও না।
শব্দ আম্বিয়ার মায়ের কানেও গেছে। গেলেও তার কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে ছোট আম্বিয়াকে খাবার ঘরের গলি দিয়ে উপরে পাঠালো। ছোট খাটো আম্বিয়া অন্ধকারে কারো নজরে পড়লো না। তবে আম্বিয়ার মা ঠিক পড়ল। আর সারেং বাড়িতে সেই দিন রাতে প্রথম রক্তের ফোঁটাটা আম্বিয়ার মায়ের’ই পড়ল।
জয়তুন নিষ্পলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকে সম্মানেই বসানো হয়েছে চেয়ারে। আর এই সম্মান কেন জয়তুনের বোঝার বাকি রইল না। আম্বিয়ার মতো সহজ মৃত্যু তাকে যে দেওয়া হবে না, সে ভালো করেই বুঝলো।
ততক্ষণে উপরের সবাই জেগে উঠেছে। জসিম কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। এক দিকে মা আরেক দিকে সন্তান, স্ত্রী। বীণার বয়স তখন মাস ছয় এক। তার জন্ম একটু দেরিতেই। আর ইচ্ছে ছিল না। তবে আল্লাহ ঘর আলো করে দিয়েছে।
সেই ঘুমন্ত আলোকে এরশাদের কোলে আর শাহবাজ, আম্বিয়ার ছোট হাতটা দুটো দিয়ে বলেছিলো। সোজা ছাদে যাবি, ছাদের ঘরে যেই চোবাচ্চাটা আটকে দেওয়া হয়েছে, সেটার ভেতরে বসে থাকবি। যা’ই হয়ে যাক বের হবি না।
এরশাদ দৌড়ে গিয়েছিল। এই তুমুল বৃষ্টিতে ছোট ছোট ভাই বোনকে নিয়ে সেই চৌ-বাচ্চা ভেতরে গিয়ে’ই পালিয়েছিল। তবে মা, চাচির আর্তনাদ শুনে থাকতে পারেনি। ছোট ভাইয়ের কোলে ছোট্ট বোনকে দিয়ে দৌড়ে নিচে এসেছিল। আর আসতেই দেখেছিল নিজের বাবার – মায়ের খন্ডিত মাথাকে। নিজের মা সমান ছোট চাচির লাশ টা দেখেছিল বিবস্ত্র অবস্থায় একদল হায়নাদের মাঝে। ব্যস! বিশ বছরের যুবকের শরীরে যেন সেই আষাঢ়ের রাতে আজরাইল ভর করেছিল। করেছিল বলেই আজরাইরের রুপ দেখে প্রতিটা হায়নার বুক কেঁপে উঠেছিল।
জয়তুন আরা শুধু দেখেছিল হাতে তাদের বাড়ির ঐ যে বড় বড় রুই কাতলা কাটার বঁটিটা আর জ্বলজ্বল করা দুটো চোখ। যেই চোখে আগুন, যেই আগুন স্পষ্ট করে বলছে, আজ নিজে মরবে, না হয় এদের মারবে।
একেক পর কোপ পড়েছিল একেক জনের গায়ে। সে সামনে পিছনে কিছুই দেখেনি। যে সামনে এসেছে তাকেই এলোপাথাড়ি কোপ। সেইদির সারেং বাড়ির ঘরে একের পর এক লাশ পড়েছিল। বাকি ছিল মাত্র তিন চারজন। এরশাদের মরার ভয় ছিল না, তবে তাদের ছিল। আর বুঝেছিল, একে বাগে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব না।
তাছাড়া বৃষ্টির তেজ কমে আসছিল, রাতও শেষের দিকে। গাঁও গ্রামের মানুষদের কাছে সন্ধ্যা মাঝরাত হলেও ভোর হয় সূর্য ওঠার আগে। তাই তারাও বুঝেছিল, আশেপাশের মানুষ ঠিকই সজাগ হয়ে যাবে।
ব্যস, যাওয়ার আগে এক কেরোসিন তেলের হারিকেন জয়তুনের মুখ বরাবর মারল। জয়তুন তখন নিস্তেজ, রক্তে ভেসে যাওয়া নদীর মাঝে বসে আছে চুপচাপ। সে সরেনি, কিন্তু এরশাদ ধাক্কা দিয়ে ঠিকই সরিয়েছিল। আর সরতেই হারিকেনটা লেগেছিল তার মুখে। লাগতেই কাচটা ভেঙে চৌচির।
কেরোসিনের ছিটায় সেই ভাঙা কাচে আগুন লাগতে সময় লাগেনি। আর লাগতেই সারেং বাড়ির ইটের প্রতিটা কোণা এরশাদের আর্তনাদে কেঁপে উঠেছিল।
উঠেছিল জয়তুনও। কিভাবে টেনে উঠান পর্যন্ত নিয়েছিল, তার জানা নেই। শুধু মনে আছে, পাগলের মতো উঠানের কাদা পানি সব এরশাদের মুখে চেপে ধরছে। সেই ধরায় তার ছটফট কমে না। বাড়ে, আরো বাড়ে, বাড়তে বাড়তে এক সময় একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয় । নিস্তেজ হতে হতে গায়ে হায়েনাদের রক্তগুলো টিপ টিপ পানিতে ধুয়ে মুছে উঠানের কাদায় মাখামাখি হয়। জয়তুন দেখে, নিশ্চুপ দেখে। দেখতে দেখতেই নরম কোমল সূর্যটা পূর্ব আকাশে উঁকি দেয়।
এই যে অনেক অনেক দিন পরে আজ যেমন দিচ্ছে। জয়তুন তার বৃদ্ধ হাতে চোখের পানি মুছে ধীরে ধীরে উঠানের ঠিক সেই জায়গাটায় এসে দাঁড়াল, যেখানে অনেক অনেক দিন আগে তারা দুটো মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে ছিল। যেখানে দাঁড়িয়েই ঐ যে মেঘের শেষে সূর্যটা উঁকি দিতে দেখেছিল।
সেখানে দাঁড়িয়েই আজ চোখ বন্ধ করল। করতেই আলাউদ্দিনের অনেক দিন আগের একটা কথা তার কানে বাজতে লাগল — কেন করলে এই পাপ সখী।
দুনিয়াতে সব মোছা যায়, তবে পাপ না। সেটা ঘুরে ফিরে আসবেই। তুমি বিন্দু পরিমাণ করবে, সেটা অথৈ সাগর হয়ে ফিরে আসবে । এই ফেরার শেষ নেই। পিড়ির পর পিড়ি চলে, চলতেই থাকে। আর তুমি তো করলে মহাপাপ। এই মহা পাপের ভার সইতে পারবে তো?
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৬
ভোরের কোমল রোদ চোখে পড়তেই আয়না, ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো। মাথা, চোখের পাতা ভারি, অসম্ভব ভারি। শাহবাজের চেয়ে তার মাথার আঘাত বেশি, তাই হয়ত দুর্বলতাও বেশি। বেশি হলেও জ্ঞান ফেরার দিকে সে’ই রইল আগে।
আগে হলোও তার গোলগাল মুখটাতে এক রাজ্যের ক্লান্তি, শুকনো, মলিন, বিষাদে ঘেরা। সেই বিষাদ ঘেরা ভারি চোখ দুটো টেনে সামনে তাকাল, আর তাকিয়েই শুকনো ফ্যাকাশে ঠোঁট দু’টো মেলে হালকা হাসল। বিষাদ মাখা মুখে সেই হাসিটা ঠিক যেন ভোরের অন্ধকারে সোনালি সকালের মিষ্টি রোদের মতো আলতো, উজ্জ্বল, কোমল। যেন জানত, চোখ খুলে এই মুখটাই দেখবে।
এই মুখটার মানুষটা তার চেনা না, জানা না। ব্যস, ঘন্টা দু’য়েকের পরিচয়। তবুও কেন জানি দেখলেই ভরসা লাগে। ভেতর নির্ভার লাগে। মনে হয় আশে পাশে থাকলে, কোন ক্ষতি হবে না। মাথায় যখন আলতো করে হাত রাখে, মনে হয় কতো দিনের চেনা। আসলে দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই। এখানে না এলে হয়ত এজন্মে দেখাই হতো না। তবে যখন শান্ত ভাবে কিছু বলে, কণ্ঠে কি থাকে কে জানে? অন্য রকম একটা শান্তি, ভরসা আপনা আপনি’ই জেগে উঠে। তাই যখন কাল জ্ঞান হারানোর আগে এই মুখটা দেখলো। তখনি মনে হলো আর ভয় নেই।
সারা রাত কেউ ঘুমায়নি। আম্বিয়া পাশে খালি বেড পেয়েই শরীর এলিয়ে দিয়েছে, তাঁর ঘুমের গভীর নিশ্বাস ধীরে ধীরে ভেসে আসছে। পৃথিলা বসে আছে আয়নার বিছানার পাশে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবে আজ আর এদের ছাড়বে না , সারাদিন দেখবে। মাথায় আঘাত, অন্য কোন সমস্যা যদি হয়, তখনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে আপাতত কোন ভয় নেই। তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি সবাই ফিরে যাবে। অপেক্ষাটা ছিল শুধু জ্ঞান ফেরার।
পৃথিলা আয়নার মুখের হাসিটুকু দেখলো শান্ত চোখে। সিধেসাদা সরল প্রকৃতির মেয়ে। ভালো মন্দ বোঝার জ্ঞান এখনো হয়নি বা নেই। অনেকেই বৃদ্ধ বয়সেও ছোট বাচ্চাদের মতো সরল হয়। দিন দুনিয়ার প্যাচ এরা ধরতে পারে না। একটু আদর, কোমল, ভরসা দেখালেই ভুলে যায়। যেমন এই মেয়েটির কাছে সে এখন সবচেয়ে ভরসার একজন। এতো এতো অচেনা মানুষের মাঝে তাকেই হয়ত সবচেয়ে কাছের ভাবছে।
অথচ সে নিজেও ভাগ্যের চাকায় পিষে গুড়োগুড়ো হওয়াদের মধ্যেই একজন। অবশ্য এই মেয়ের মতো এতো সরল না। চাইলেই তাকে কেউ ভাঙতে পারবে না। তবে এই মেয়েকে চাইলেই ভাঙা তো ভালোই ইশারায় পুতুলের মতো নাচাতেও পারবে। তাই শান্ত চোখে দেখেই বললো, — তুমি কিছু কাল বলেছিলে আমায়। আমি বুঝতে পারেনি। কি বলেছিলে?
আয়নার মুখের ঝিলিকটুকু মলিন হলো। হতেই চোখ নামিয়ে নিলো। আসলে ভেবেছিল সে কাল’ই মারা যাবে। ভয়ে কি বললো, না বললো।
পৃথিলা সেই মলিন মুখটা দেখলো, তাই এই বিষয়ে কিছু আর জিজ্ঞেস করলো না। কথা ঘুরিয়ে বললো, — মাথায় যন্ত্রনা আছে?
আয়না আস্তে করে দু পাশে মাথা নাড়ালো। পৃথিলা উঠলো! কাপড়ে রক্ত শুকিয়ে চট হয়ে আছে। সেই কাপড় ভালো করে গায়ে জড়ালো। জড়াতে জড়াতে বললো, — ” আমি একটু পরে চলে যাবো। ” আম্বিয়াকে দেখিয়ে বললো, — উনি হয়ত থাকবেন। কোন সমস্যা হলে তাকে বলো।
আয়না আস্তে করে মাথা কাত করলো। পৃথিলা দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলো। এসে বললো, — আমি জানি বলার মতো কোন সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই। তবুও আমি কি কিছু বলতে পারি?
আয়না আবারো মাথা কাত করলো। করতেই পৃথিলা বললো, — বিয়েটা তুমি করতে চাওনি। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, চাপে পড়ে করা স্বাভাবিক। তবে মিথ্যা বলে গায়ে আগুন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। জয়তুন আরা তোমাকে মাফ করেছিল। সেখান থেকে গ্রামে ফিরলেই তুমি হয়ত আগের মতো না হলেও, তবে আস্তে আস্তে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতে। তবে তুমি নিজে এই রাস্তা ঠিক করেছো। কেন করেছো জানতে চাইবো না। চাওয়ার জন্য যেই অধিকার প্রয়োজন সেটা আমার নেই। তবে তুমি হয়ত খেয়াল করোনি আমার ঘরের জানালা খোলা ছিল। আমি ভেতরে গিয়ে আবার জানালার পাশেই বসে ছিলাম। না আমি সেই ভাবে কিছু দেখনি, অন্ধকারে দেখার কথা না, তবে কিছুটা বোঝা যায়। অবশ্য তখন আমি কিছুই বুঝিনি তাছাড়া সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো।
তবে কি জানো? অন্ধকারে চলমান কোন কিছুতে অনুমান করে নির্দিষ্ট জায়গায় বাড়ি মারা যায় না। গেলেও বড়জোর সেটা গায়ে লাগবে। গায়ে কাঠের বাড়ি এমন আর কি? তাই স্থির হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আর ঠিক তখনি তুমি হোঁচটা খেয়েছো।
আয়নার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। পৃথিলা দেখলো দেখে স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। একটু নিচু হয়ে ব্যান্ডেজের সাইড দিয়ে বেরিয়ে আসা চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, — আমি জানি না সঠিক কি? ভালো কি? তবে যে যেই পরিস্থিতিতে থাকে, সে’ই একমাত্র ভালো জানে। তাই তোমার’টা তুমিই ভালো বলতে পারবে। তবে আয়না, অন্যায় সব সময় অন্যায়’ই হয়। কারণ যাই থাক, অন্যায়কে সেই কারণ কখনও ন্যায় করতে পারে না।
আয়নার গাল গড়িয়ে চোখের পানি পড়ল। পৃথিলা যত্ন করে সেই চোখের পানি মুছে বললো, — আসি, ভালো থেকো।
বলেই পৃথিলা বেরুনোর জন্য এগুলো। তখনি আজিজ এসে দরজায় দাঁড়ালো। মেয়েটার খবর রাতেই ফাতেমার কাছে পেয়েছে। তবে বুড়ো শরীরে আর কতো সয়। তাই সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই ছুঁটে আসলো। কপাল, সবই কপাল। কুফা বাড়ি কি আর গ্রামের মানুষ সাধে বলে। একটার পর একটা লেগেই থাকে। ফকির বাবারে তো কোলে নিয়া বসে আছে। ঝাড় ফুঁক করে দোষ টোষ কাটাবে তা না, বসে বসে মানুষকে খোঁচানো আর খিক খিক করে হাসা।
মনের বিরক্ত মনে চেপে, পৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — ও, তা তুমিই সেই মাস্টার। জাফরের মুখে শুনলাম। ভালো আছো?
পৃথিলা মাথা নাড়ালো! স্কুলের এখনো টিকিটাও দেখেনি, অথচ মাস্টার মাস্টার নামে পুরো গ্রামে ঢোল পড়ে যাচ্ছে। আশ্চার্য! সে নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, — জ্বি ভালো! আপনি?
— আমি এই গ্রামের মহাজন। আরেক পরিচয় যদি জানতে চাও তাহলে জাফরের মামাতো ভাই। আরো আরেকটা যদি জানতে চাও, তাহলে ঐ যে হাসপাতালের বাহিরে হাত পা ছড়িয়ে কুঁচানো গেঞ্জি গায়ে, যেই ছেলে বসে বসে ঝিমোচ্ছে তার জন্মদাতা পিতা।
পৃথিলা হালকা হাসলো! যেমন বাপ তেমন ছেলে। এসেছে পর থেকে তাকে দেখেই এমন ভাব করছে, যেন পৃথিলা কাউকে খুন টুন করে ফেলেছে। শুধু প্রমাণের অভাবে চোখের সামনে এমন ঘুরতে দিচ্ছে। তা না হলে নগদে শুলে চড়াতো। সে হেসে আর কিছুই বললো না। বলার মতো অবশ্য কিছু নেই ও। তাই নিজের মতো বেরিয়ে জাফরের দিকে এগিয়ে গেলো। তারা সবাই এক সাথেই ফিরবে।
আজিজ এগিয়ে গেলো। একবার আম্বিয়ার দিকে তাকালো। তার ঘুমে যে বেশ গাঢ় দেখেই বুঝলো। বুঝে কোমল সুরে বললো,, — ভালো আছিসরে মা।
আয়না মলিন মুখে মাথা হালকা নাড়ালো! আজিজ সেই মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বড় একটা দীর্যশ্বাস ফেললো! ফেলে বসতে বসতে বললো, — তোর চাচা মধ্য রাতে গিয়ে পায়ে পড়ে কাঁদলো। বেচারা খবর শুনেই দৌড়ে এসেছিল। জন্ম না দিক, বুকে আগলে তো রেখেছে। দেখা তো দূর, বড় নাতি কান বরাবর এমন একটা দিছে, সেই কানের পর্দা শেষ। দিয়ে একেবারে গলা ধাক্কা। তোর নাম মুখে নিলেই নাকি গর্দান শেষ। জালিম সব জালিম। এরা নিজেদের ছাড়া কাউকে চেনে না। বাপের বয়সী, তারে এমন মাইরডা দিতে পারলো?
চাচার কথা শুনেই আয়না ফুঁপিয়ে উঠল। আজিজ সে ফুঁপিয়ে উঠা দেখে হাসলো। অবশ্য এই হাসি আগের মতোই নিজের। চোখে মুখে এক সাগর দুঃখ। দুঃখ নিয়েই বললো, — কাঁদলে কিছু হয় নারে মা। যদি হতো তোর উপরে বাবার ছায়াটা না হয় গেছে, মায়েরটা ঠিক থাকতো। কই কারো দয়া হয়েছে?
আয়না কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়লো! তার চোখ, মুখ লাল। সেই লাল চোখে আজিজের দিকে তাকালো। আজির পরম মমতায় আয়নার মাথায় হাত রাখলো। রেখে বললো, — তাহলে তুই দয়াটা কেন করলি মা। কোন দরকার ছিল বাড়িটা নিজের মাথায় নেওয়ার? আমিতো যা করছি সব তোর জন্য। তাহলে বল কোন জন্মের শত্রুতা আমার?
শাহবাজের জ্ঞান ফিরলো একটু দেরিতে। ঘড়ির কাটা তখন সাতটার ঘরে। সদর, তাই সকাল হতে না হতেই কোলাহল শুরু হয়েছে প্রতিদিনের নিয়মে। সেই নিয়ম কানে পৌঁছাতেই ফট করে চোখ মেলে তাকালো । তাকাতে দেরি ঝট করে উঠে বসতে দেরি হলো না এতোটুকুও। আর বসেই দু’মিনিট ঝিম মেরে চোখ বন্ধ করে রইল। এই বসা এমনি না, ঘটে যাওয়া সব ঘটনা এক এক করে মনে করলো।
করতেই একটু হাসলো! মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ক্যানোলা। এতো বড় আঘাতের কোন রেশ তার চোখে মুখে দেখা গেলো না। বরং চোখ খুলে নিজেই হাতের ক্যানোলা টেনে খুললো। খুলতে খুলতে বললো, — কাহিনী কি?
এরশাদ সাইডেই বসা, ভাইয়ের কর্মকান্ডে তার মধ্যে তেমন ভাবান্তর হলো না। নির্বিকার চিত্তে বললো, — আমি কিভাবে জানবো, কোথায় কোথায় কোন অকাজ করে রেখেছিস কে জানে?
— এই বিয়ে ছাড়া বর্তমানে অন্য কোন অকাজ আমি করিনি।
— না করলে তো ভালোই।
— তা ঠিক! তবে কোন চিন্তা করো না। শাহবাজ ঠিক বের করে ফেলবে। আর একবার হাতে পাই। কথায় আছে না, হাতের বদলে হাত, চোখের বদলে চোখ। আমিও বাড়ির বদলে বাড়ি’ই দেবো। তবে একটু যত্ন করে। সে দিয়েছে কাঠ দিয়ে আর আমি দেবো লোহার রড দিয়ে।
— এটা আমার উপরে ছেড়ে দে।
— কেন? মাথা তেমার ফাঁটছে?
— এটা শুধু মাথার কাহিনী না?
— তো, কোন কাহিনী? যে শাহবাজের মাথা ফাঁটালেই শুভ যাত্রা হবে।
এরশাদ উত্তর দিলো না, শাহবাজ উত্তরের আশাও করলো না। সে নিজের মতো উঠলো! উঠে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগুলো।
এরশাদ দেখে বললো, — আজকে থাকতে হবে।
শাহবাজ নিজের মতো বেরুতে বেরুতে বললো, — থাকতে হলো থাকো নিষেধ করেছে কে? বলেই বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে অবশ্য বেশিদূর যেতে পারলো না। তার পাশের কেবিনেই আয়না। দরজার সামনে দিয়ে যেতে গিয়েও থামলো। থেমে ঘাড় কাত করে তাকালো।
আয়না অবশ্য বুঝতে পারলো না। এক মাথা ভার চোখ ভার, তার মধ্যে কেঁদেছে। মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে। হচ্ছে বলেই চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে শুয়ে আছে। ফর্সা মুখে হালকা গোলাপি পাতলা ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপছে।
শাহবাজ বেশ কিছুক্ষণ এক ধ্যানেই তাকিয়ে রইল। এরশাদ তার পেছন দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে যেতে যেতে বললো, — তোর দুই চেলা, কালাম আর আম্বিয়া রইল। চুপচাপ জায়গা মতো গিয়ে বস । আমরা সবাই এখন ফিরছি, আবার বিকেলে আসবো।
এরশাদের কণ্ঠ শুনেই আয়না চোখ খুললো। খুলতেই চোখের সামনে শাহবাজের মুখটা দেখলো। দেখে’ই একটা ঢোক গিললো। গিলে আস্তে করে অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
শাহবাজ তখনি ট্রেনে সেই রাতের মতো দু’আঙুলে একটা চুটকি বাজালো। আয়না সাথে সাথে আবার তাকালো। এবার অবশ্য চোখ ফেরানোর আর সাহস হলো না। তবে চোখে মুখের করুন দশা স্পষ্ট ফুটে রইল। আর রইল বলেই শাহবাজ ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে এরশাদের উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে বললো, — কোন দরকার নেই আসার। শাহবাজের সব কাজের জন্য শাহবাজ একাই যথেষ্ট।
সদর পেরিয়ে ভ্যান গুলো যখন মেঠো পথ গলিয়ে ধান ক্ষেতের পাশ ঘেঁষে আঁকা বাঁকা পথে নিজ ছন্দে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও সকালে রোদটা কোমল, নরম। সূর্য তার তেজ এখনোও পুরোপুরি তুলেনি। তার সাথে গাছগাছালির ছায়া, বাতাসে ধানের গন্ধের সাথে অচেনা একটা নীরব সুর ।
সেই সুরের ছন্দে গা ভাসিয়ে পৃথিলা বসেছে সাইডে পা ঝুলিয়ে। কোন কারণে মনটা আজ ফুরফুরে লাগছে। অনেক অনেক দিন পরেই লাগছে। অবশ্য হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। নাকি এই যে স্নিগ্ধ কোমল প্রকৃতির রুপ, এই রুপের প্রভাবে। হয়তো! প্রকৃতির একটা প্রভাব না চাইতেও মানুষের উপরে থাকে। থাকে বলেই ঝুম বৃষ্টি দেখলেই ময়ূরের মতো পেখম মেলতে ইচ্ছে করে, চাঁদের জোছনা দেখলে গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করে। বিষন্ন বিকেলে কোন কারণ ছাড়াই মন উদাস হয়ে বসে।
তখনি এক ঝাঁকি লাগলো। পৃথিলা কিছুটা আঁতকে উঠলো। তার চেয়েও আঁতকে উঠল জাফর। পৃথিলার কেন জানি হাসি পেয়ে গেলো। এই মানুষটা বসেছে তার পাশে’ই, প্রথমে অবশ্য কথা ছিল না। কথা ছিল ইমরান ভাইয়ের সাথে এক ভ্যানে যাবে।
তবে যখন এই ভাবে পা ঝুলিয়ে বসলো, এই মানুষটা সাথে সাথে এগিয়ে চিন্তিত সুরে বললো, ” তাল সামলাতে পারবে না মা, পা তুলে বসো।
এই মানুষটা কোন কারণে তাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। মা ডাকটা ডাকেও যেন কেমন করে। পৃথিলার অস্বস্তি হয়। অবশ্য কোন কারণ নেই। তার এই ছোট্ট জীবনে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে এমন সম্বন্ধ পেয়েছে। তবুও, এই মানুষটার ডাকে কিছু একটা আছে। তবে ধরতে পারে না। অবশ্য সেটা বুঝতে দেয় না, তাই তখনও দেয়নি। সে হালকা হেসে বলেছে, — সমস্যা নেই।
মানুষটা তাও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। তাই পৃথিলার ভ্যানে’ই উঠে বসেছে। এমন ভাব, পড়ার আগেই যেন ধরতে পারে।
সে নিজের হাসি দমিয়ে বলল,– আপনার ছেলে মেয়ে নেই?
জাফর পৃথিলার দিকে নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর শান্ত ভাবে বললো, — না নেই।
— আমি দুঃখিত! আমি অনুমতি না নিয়েই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেলেছি।
জাফর হাসলো! হেসে একটু আরাম করে বসলো। মেয়েটা এমন ভাবে বসেছে, তার ভয় করছে। ভ্যানওয়ালাকে অবশ্য বলেছে সময় লাগুক, তবে আস্তে আস্তে যা। তবুও রাস্তা তো ভালো না। তাও ভালো এখনোও মেঘ বৃষ্টি শুরু হয়নি। তখন অবস্থা যা হয় বলার মতো না। চেয়ারম্যান, মেম্বাররা ধীরে ধীরে ইটের ব্যবস্থা করছে, তবুও গ্রামের রাস্তা তো গ্রামের’ই।
সে বসেই বললো, — দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। এটা সামান্য কৌতূহল। একটা জায়গায় তুমি এসেছো, থাকছো, আশে পাশে মানুষের ব্যাপারে কৌতূহল হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
জাফরের সহজ ভাবে কথা বলায় পৃথিলার ভালো লাগলো। তাই হালকা হেসে বললো, — আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
— অবশ্যই পারো! একটা কেন? তোমার যা যা কৌতূহল আছে সব জিজ্ঞেস করে ফেলো তো । এমনিতেই দুটো মানুষ চুপচাপ বসে যাচ্ছিলাম ভালো লাগছিল না। তার আগে তুমি আরেকটু পিছিয়ে বসো তো মা। আমার ভয় করছে।
পৃথিলা এবার হেসেই ফেললো! না খিলখিল হাসি না, মার্জিত মাপা হাসি। তবুও সেই হাসি যেন এই কোমল আলোতে আলাদা আলো ছড়াল তার চোখে মুখে। আর এই আলোতেই ঠিক তাদের সামনের ভ্যান থেকে এরশাদের যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।
ফরহাদ হাত পা ছড়িয়ে ভ্যানে শুয়ে আছে। লম্বা মানুষ পা দুটো ঝুলছে। সেও পৃথিলার হাসি দেখলো। অবশ্য তার চোখে মুগ্ধতা নেই। সে চোখ মুখ কুঁচকে বললো, — এই আবার হাসতেও জানে?
এরশাদের দৃষ্টি পৃথিলার উপরেই। কেন জানি তাকালে চোখ সরাতে পারে না । কিছু একটা অদৃশ্য টান তাকে আটকে রাখে। তাই চোখ রেখে বললো, — সেটা তুইও জানিস না।
ফরহাদ গাল চুলকে আবার সোজা হয়ে শুলো। শুতে শুতে বললো, — তোর অতি গুণধর, বিদ্যাধর বোনের জন্য একে রেখে ফেল। দেখেই বুঝা যায় বিদ্যার জাহাজ। দুই জাহাজের বনিবনা খুব ভালো হবে। আমার দ্বারা আর হচ্ছে না।
— মাত্রই তো এলো। দেখা যাক কি হয়।
— তোর কি হবে জানি না। তবে এই কচুরমুখি সাথের আমার প্রতিদিন দেখা হবে। এটা ভেবে’ই তো আমার চুলকানি হচ্ছে।
এরশাদ বিস্ময় চোখে ফরহাদের দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — কচুরমুখি?
— হ্যাঁ!
এরশাদ হেসে ফেললো ! তখনি পৃথিলাদের ভ্যান এক ঝাঁকুনি খেলো। এবড়ো থেবড়ো রাস্তা, তারমধ্যে ভ্যানওয়ালাও দিয়েছে এক টান। পৃথিলা জাফর তো ভালোই, এরশাদের নিজেই আঁতকে উঠলো। উঠতে’ই হাসি হাসি মুখটা চোখের পলকে অন্ধকার হলো। আর হতেই ভ্যানওয়ালাকে এক ধমক দিলো।
শুনশান রাস্তায় এই ধমকটা বজ্রপাতের মতো সবার কানে বাজলো। আর বাজলো বলেই শুধু ভ্যানওয়ালা তো ভালোই, বাকি সবাইও চমকে উঠল।
চলবে…..