ধূপছায়া পর্ব-১৭+১৮

0
4

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_১৭

পূর্ব আকাশে আজ সূর্য উঁকি দিয়েছে আর পাঁচ দশটা দিনের মতোই। মিঠাপুকুর গ্রামের সময়ের ঘড়ি টিক টিক করে চলছে নিজ ছন্দে। সেই ছন্দে ছন্দ পতন হয়েছে একমাত্র সারেং বাড়িতে। সকালে উঠেই খোয়ার থেকে চারটা রাতা মুরগি জবাই হয়েছে, বড় হাড়িতে গরুর দুধের পায়েশ রান্না হচ্ছে। সোনামগুর চালের গন্ধে বাড়ি মো-মো করছে। এলাকার সবচেয়ে নামকরা মিষ্টির দোকান থেকে আনা হয়েছে কাঁচা রসগোল্লা আর নরমপাকের সন্দেশ। আর সবচেয়ে বড় কথা, উঠানে পাতা হয়েছে চন্দন কাঠের কারুকাজ করা পিঁড়ি। এই পিঁড়িতে পা রেখে’ই জয়তুন সারেং বাড়িতে পা রেখেছে, রেখেছে জোছনা, বড় বউ, মরিময়। আর আজ রাখবে সারেং বাড়ির প্রথম নাত বউ।

তাইতো সারেং বাড়ির বাতাসে আজ বলতে গেলে কিছুটা উৎসবের আমেজ। বিশাল বাড়িটার কোণে কোণে যেন ভিন্নতার সুর গলা ছেড়ে গাইছে। শেষবার এমন গেয়েছিল জাফরের বিয়ের পরে। তারপরে আর এই বাড়িটা সুখের ছন্দ দেখেনি।

তাই সুযোগ যখন ভাগ্য নিতে নিতে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে, জয়তুন ফিরিয়ে দেবে কেন? তাছাড়া তার আবার একটাই নীতি। যে তাকে দু’হাত ভরে দেবে, সেও তাকে মন উজার করে দেবে। তাই তো যে আয়নামতিকে ঘরে তুলবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল, আজ তার জন্যই নিজ আদেশে সব আয়োজন করেছে। করবে’ই না কেন? তার নাতির সামনে যে এই মেয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যস, জয়তুনের মনটা তো সেইখানেই গলে গেছে।

তাই বসে বসেই সব আদেশ নির্দেশ দিচ্ছে। আম্বিয়া নেই, কাজের লোক আছে। তবে আম্বিয়া না থাকলে জয়তুনের সব আন্ধার লাগে। অবশ্য সাবিহা সকাল থেকে যতটা পারে সাহায্য করছে। মেয়েটা ভালো। শহরের মেয়ে হয়েও কোনো অহংকার নেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শ্বশুরের বেশ সেবা যত্ন করেছে। আজকাল বউদের তো আবার শ্বশুর শাশুড়ি চোক্ষের বিষ। তবে এই মেয়েটার অনেক গুণ। বাড়ির যে কোনো বিপদে-আপদে দরকারে নিজের মতো ছুটে আসে।

তাই আজও এসেছে, এসে নিজের মতো সব গুছিয়ে নিচ্ছে। আর এদিকে আজ পান ছেচার দায়িত্ব পড়েছে বীণার উপরে। সে খুশি মনেই করছে। বাড়ির এই খুশি খুশি আমেজ তার ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই খুশিতে দু’ডানা মেলে উড়ছে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু সেই ইচ্ছেতে ছেদ পড়ল ফরহাদকে দেখে। সব সময়ের মতো চোখ, মুখ অন্ধকার করে এগিয়ে আসছে। বীণার ছোট্ট মাথায় একটা জিনিস’ই আসে না। একটা মানুষ কেমন করে, সব সময় এমন বিরক্ত থাকতে পারে। আজ পর্যন্ত একটু মন থেকে যেই হাসি, সেই হাসির রেশ এই মুখে একবারের জন্যও দেখি নি। কোন দুশমনি এই দুনিয়ার সাথে একমাত্র আল্লাহ’ই জানে।

বীণা পানের পাতা জয়তুনের সাইডে রেখে উঠে দাঁড়ালো। পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়া তার ধাতে নেই। বরং নিজের ইচ্ছায়, নিজের খুশিতেই পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে আয়না বুবুরা আসবে। ভাইয়ের বউদের নিয়ে তার খুব শখ, আহ্লাদ। এতো বড় বাড়িতে বলতে গেলে একা একা থাকে। আম্বিয়া বুবু, দাদি অবশ্য আছে, তবে তারা বেশিভাগ সময়’ই নিজেদের কাজ নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তো তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই সাবিহা ভাবির সাথে তার আবার খুব ভাব। তার কাছ থেকে সে কতকিছু শেখে। কেননা গ্রামের মেয়েদের জীবন খুব’ই ছোট। একটু জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে শ্বশুর বাড়ি। আর শ্বশুর বাড়ি সেটা রসুই ঘর আর উঠান পর্যন্ত’ই।

তাই তার আজকে পড়ার একদম ইচ্ছে নেই। তবে এই গরমে মহারাজা বাড়ি পর্যন্ত এসেছে, এখন যদি নিষেধ করে, তবে দাদির সামনেই না দু’টো লাগিয়ে দেয়। এই লোক কাউকে গোনায় ধরে না। আর তাদের বাড়ির মানুষের এমন ভাব থাকবে, আরে এটাই তো আসল স্যারের গুণ, তার মধ্যে বড় ভাই। এই মাইর কোন ব্যাপার’ই না।

তাই কিছুটা বিষন্ন মুখেই বীণা নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। আর যেতেই ঝমঝম শব্দ যেন পুরো রুমে সুরের মতো বাজলো।

আর বাজলো বলেই ফরহাদের অন্ধকার মুখ আরো একধাপ কালো হলো। এ গু-গোবর পায়ে দেওয়ার কোন মানে আছে। নিজে হাঁটবে আবার গ্রামসুদ্ধ জানিয়ে জানিয়ে, যত্তোসব ফালতু কারবার।

জয়তুন আরা ফরহাদের কালো মুখ দেখে খিক খিক করে হাসল। এই রকম মুখভঙ্গি’ই ভালো। মাস্টার মানুষ দেখে যদি মাস্টার’ই মনে না হয়, তো কিসের মাস্টার। মাস্টার এমন হবে দেখেই পুলাপনের হাগা মুতা লেগে যাবে। তবে আগেরটা ছিল মিনমিনা শয়তান—এসেই মিচকা এক হাসি দিয়ে গলে গলে পড়ত। যেন পড়াতে আসে না, জামাই শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে। হারামজাদার, হারামজাদা। জয়তুনের নাতনীর দিকে কু- নজর, পা দিয়ে ঠুকাঠুকি। দিছে জন্মের মতো পা ভেঙে। এখন যা, যতো খুশি ঠুকাঠুকি কর। বলেই হাত ইশারায় ফরহাদকে ডাকল। তার মুখ ভর্তি পান।

ফরহাদ ইশারা দেখলো, তবে এই সাত সকালে বুড়ির কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। এখান থেকে যাবে আবার স্কুলে। সেখানেও আবার কু কু করতে থাকা ছেলে মেয়ে। ধুর! তাই দেখেও না দেখার ভান করে স্বাভাবিক ভাবে রুমে দিকে যেতে গেলো।

জয়তুন তার স্বভার মতো থু করে ঘরের মধ্যেই পিক ফেললো! ফেলে বললো, — ঐ ফরহাইদা! চোখের মাথা খাইছোস। ডাকি দেখোস না?

ফরহাদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বিরক্ত দমালো। খাটাইশা বুড়ি! বলেই ঘুরে বললো, — না দেখলে তো বেঁচেই যেতাম। জানি সেটাতো সম্ভব না। তাই দেখেও না দেখান ভান করে সময় নষ্ট করার কারণ তো দেখি না।

— এদিকে আয়।

ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো, — কেন?

— এদিকে আইলে কি আমি তরে খাইয়া ফালামু নি ?

— দাঁতের যে হাল, হারিকেন দিয়ে খুঁজলেও তো দুই একটা মারি ছাড়া কিছু’ই পাওয়া যাবে না। ভাত খায় গিলে গিলে আবার ফরহাদ। এতো সোজা?

— তুই আইবি ? না হলে আমার নাত বউ বন্ধুর লগে জুট্টি ধইরা ভাগাইছোস। চুল যে এখনো মাথায় আছে, সেটা তোর ভাগ্য।

জয়তুনের হুমকিতে ফরহাদের তেমন ভাবান্তর হলো না। তবে বিরক্তমুখেই এগিয়ে এলো। জয়তুন হেসে বললো, — বয়।

ফরহাদ বসলো! বসতেই জয়তুন বললো, — তোদের আগে ছোট ভাই বউ নিয়া আইতেছে। চোখে মুখে আগুন নিয়ে ঘুরোস। এতো আগুন আসে কোথা থেকে, লজ্জার তো ছিটেফোঁটাও দেখি না ।

ফরহাদ মনে মনে বিরক্তের শ্বাস ফেললো। শুরু হয়ে গেছে জয়তুনের জয়তুন গিরি। সে শ্বাস ফেলেই বললো, — যেটা নাই সেটা না দেখার’ই কথা ?

— তা ঠিক! সেটা যে নাই আমি ভালো করেই জানি। বড় হইলি তো আমার সামনে’ই। কতো আমার সামনেই লুঙ্গি খুলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিস। লাজের বয়সেই লাজ ছিল না, এখন আইবো কোথা থেকে।

ফরহাদ কিছুক্ষণ বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, — এটাও একদম ঠিক! তো? এখনো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। পড়বো?

— আমার সামনে পইড়া লাভ কি? বিয়ে কইরা বউয়ের সামনে পড়। দুই বন্ধুর তো সেই মুরোদ নাই। তোর বাপ মায়ে করে ডা কি? খালি জমি, জমি, জমি। এতো জমি খাইবো ডা ক্যারা। বড় পোলা শহরে ফুরুৎ, ছোট ডার কোন দোষ কে জানে? মাইয়া মানুষ দেখলেই ছ্যাত কইরা উঠে। তোর মায় করে ডা কি? আলাউদ্দিনের কাছে একটু আইতে পারে না। আমার মন কয় তোর ঘাড়ে বদমাইশ পরী বসে আছে।

— বসে থাক, দাঁড়ায়ে থাক, আপনার সমস্যা কি?

— বাপের তো ভদ্রতা ডানবাম দিয়া বাইয়া ছাইয়া পড়ে। তুই এমন বেয়াদব হইছোস ক্যা?

— সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।

— কি কইবার চাস?

— আমিতো কিছুই চাই না, কেন ডাকছেন সেটা বলেন?

— তোর বাপ নাকি হাসপাতালে গেছিল।এরশাদ রে বললো আমার সাথে নাকি জুরুরি আলাপ আছে। বাড়িত আসবার চায়। কাহিনী ডা কি? ফুপুরে মাটি দিয়া তো জীবনেও আর সারেং বাড়ি পা রাখে নাই। এখন কোন দরকার পড়ল।

— আমি জানি না।

— তা জানবি ক্যা। শুধু আছে আদার লাহান তেজ। তবে আমি আগেই কইতাছি। জমি জমার ব্যাপার হইলে আমি কিছু করতে পারবো না।

— কিসের জমি?

— ওমা তুই জানোস না?

— না।

— আমাগো ইটের ভাটার সাথে এক দাগের জায়গা চেয়ারম্যানের। সেখানে তোর বাপেরও তো আছে। চেয়ারম্যান এখন চায়। আমি ভাই কোন জায়গা টায়গা বেচবো না। জায়গা জমি বেচে পুড়া কপাইলারা। আমি পুড়া কপাইলা নি?

— না বেচলে নাই। সমস্যা কি?

— চেয়ারম্যান আর তোর বাপেতো আবার এক পেট। তাই ভাই আগেই কইলাম ইষ্টি ইষ্টির জায়গায়, জমি জমির জায়গায়।

ফরহাদ মাথা ঘামালো না। জমি টমি নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। নে ভাবলেশহীন ভাবে বললো, — আর কিছু?

— কি আর কিছু?

ফরহাদ উত্তর দিলো না। সে উঠলো! তার উঠা দেখে জয়তুন বললো, — দুপুরে কিন্তু এখানে খেয়ে যাবি।

ফরহাদ তারও উত্তর দিলো। সোজা এলো বীণার রুমে। এই রুমে পা রাখার সাথে সাথে তার মেজাজ গরম হয়। চারিদিকে শুধু রং আর রং, ঝকঝকে, চকমকে। এমনকি দেয়াল ভরা রং বেরংয়ের এটা ঐটা। মাথা ধরে যায় টাস করে। আর আজতো আগে থেকেই গরম, তাই বসতে বসতে মাথায় এক থাপ্পড় লাগালো। লাগিয়ে বললো, — বিজ্ঞান বই বের করেছিস কেন? আজ বৃহস্পতিবার। বলেছিনা এই দিনে ইলেকটিভ ইংলিশ আর জ্যামিতি করবি।

আজ বৃহস্পতিবার না, বুধবার। তবুও বীণা টু শব্দ করলো না। করলেও ওটা ধরে আরো কয়েকটা পড়বে। তাই চুপচাপ গণিত বই টেনে নিলো।

ফরহাদ বসলো, বসতে বসতে স্বাভাবিক ভাবে বললো, — পরীক্ষা যদি সত্যিই দিতে চাস, ছোট চাচারে জাপটে ধর গিয়া। এই বুড়ির উপরে এরশাদ, শাহবাজ কেউ যাবে না। আমার বাপ যদি একবার পা রাখে, ঠিক জয়তুনের মাথায় ঘন্টা বাজিয়ে’ই বাড়িতে ফিরবে । তাই পড়ার লেখার জন্য কেউ যদি জয়তুনের বিরুদ্ধে যায় সেটা ছোট চাচা।

বীণা আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। মাথার থাপ্পড় এখনো হজম হয়নি। গত এক বছরে মাথায় যে পরিমাণ থাপ্পড়, খাতার বাড়ি খেয়েছে, তার ধারণা যে কোন সময় তার সব স্মৃতি টৃতি সব মুছে শেষ। সে মাথায় হাত বুলিয়ে’ই হা করে তাকালো। বলছে টা কি? পরীক্ষা, ঘন্টা? আবার জিজ্ঞেস করাও যাবে না। করলেই শুরু করবে বাড়ি। ধুর!

আয়নার আজ শরীরটা ভালো। মাথায় যন্ত্রনা নেই। তবে মাথাটা হালকা ভার। তাই ধীরে ধীরে নিজেই উঠে দাঁড়ালো। বাড়ির ফেরার তোড়জোড় চলছে। এখুনি বেরুবে সবাই।

আম্বিয়া পাশেই, তবে এগিয়ে ধরলো না। সে বলতে গেলে আছে নামের। টুকটাক এগিয়ে দেওয়া ছাড়া তেমন কোন হাবভাবও নেই। আয়না অবশ্য এদের কাছ থেকে কিছুই আশা করে না। বরং কিছু করলেই ভয় করে।

আজকে সকালটা একটু অন্যরকম। আয়নার কেন জানি মনে হলো। কেন, কে জানে? তবে পাশের কেবিনে শাহবাজের কণ্ঠ বা পায়ের আওয়াজ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। হয়ত আশে পাশেই আছে। কোন কারণে হাসপাতালে আছে কে জানে? দিব্যি এ মাথা থেকে ঐ মাথা আয়না, প্রায় সময়’ই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘুরতে দেখেছে। ক্যানোলাতো কালকেই খুলে শেষ। তাই নার্স গেছে হাতে সুই দিতে। কি কারণে কে জানে, সেই নার্সকে দিয়েছে এক ধকম। নার্স গেলো বকতে বকতে। ঔষুধও মনে হয় না একটাও ঠিক মতো নিয়েছে। দুইটা চেলা আছে। সম্ভবতো তাদের নাম, একটার মান্না, আরেকটার হাবির। কিছুক্ষণ পর পর এটা ঐইটা দৌড়ে আনছে। আম্বিয়া ইনি একবার গিয়েছিল। তাকেও দিয়েছে এক ধমক। সেই যে ধমক খেয়ে এসে মুখ ফুলিয়েছে আর ওমুখো হয়নি। তার সাথেও আর খুব একটা কথা বলেনি।

তখনি এরশাদ এসে দরজায় টোকা দিলো। দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, — আর কোন সমস্যা আছে?

আয়না চোখ তুলে তাকালো না। সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষ খারাপ। নিজ নিজ জায়গায় থেকে খারাপ। সে শুধু দু’পাশে মাথা নাড়লো।

এরশাদ দেখলো, দেখে আম্বিয়ার দিকে তাঁকালো। সে বা আম্বিয়া কেউ কারো সাথে অতি দরকার ছাড়া কথা বলে না। না বলার কারণ আছে। আর আছে বলেই এরশাদ ফিরে তাকায় না। সে তাকিয়ে বললো — জিনিসপত্র সব ভ্যানে নিয়ে যা।

আম্বিয়া আর দাঁড়ালো না। একবার আয়না, একবার এরশাদের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। এরশাদ অবশ্য এগুলো না। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়েই বললো, — মিথ্যা বলেছো কেন?

আয়না আঁচল মুঠো করে ধরলো। তার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট।

— যা জিজ্ঞেস করছি সুন্দর মতো উত্তর দাও। তা না হলে সন্দেহের উপরে যেই থাপ্পড় তোমার চাচার কানে মেরেছি। সেটা সত্যি মনে হবে। আর হলে এর ফল কারো জন্যই ভালো হবে না।

— আজিজ চাচার কথায়।

এরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — মানে?

— তিনি বলেছিলেন মিথ্যা না বললে বিয়ে হবে না। আর বিয়ে না হলে আমি আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। আমি তো ভালোই বড় বাবাও পারবে না।

এরশাদ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, — বিয়েটা তুমি নিজের ইচ্ছায় করেছো?

— হ্যাঁ।
— এর আগে বা পরে আর কিছু নেই তো?
— না।
— মন থেকে এই বিয়েটা মানতে পারবে?
— হ্যাঁ।
— বেশ, তবে একটা কথা মাথায় রেখো। সারেং বাড়ি ততক্ষণ’ই তোমার যতোক্ষণ তুমি সারেং বাড়ির।

আয়না আর কিছু বললো না। এরশাদও আর কিছু বললো না। সে বেরিয়ে এলো, বেরুতে বেরুতে দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো শাহবাজের দিকে একবার তাকালো। তাকিয়ে যেতে যেতে বললো, — আমার কাজ আছে, চেয়ারম্যান মনে হয় কোন ঝামেলা পাকাবে। বউ নিয়ে সোজা বাড়ি যা।

শাহবাজ সোজা হয়ে দাঁড়ালো, দাঁড়িয়ে কেবিনের দিকে তাকালো। আয়নাকে শুনিয়ে’ই বললো, — একবার যে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে, সে হাজার বারও পারে ভাই।

এরশাদ যেতে যেতেই শুনলো। তবে আর কিছু বললো না। আয়নাও বললো না। সে ধীরে ধীরে বেরুলো। শাহবাজ এক গাল হেসে বললো, — যেতে পারবেন পিরিতের বউ, নাকি কোলে করে নিতে হবে?

শাহবাজ ভেবেছিল আয়না কিছু বলবে না। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে আস্তে করে নরম সুরে বললো, — পারবো।

সামান্য ছোট্ট একটা শব্দ, তবুও শুনে শাহবাজের শরীরে আগুন জ্বলে উঠল। এমন ঢং, যেন দুধ ও চেনে না, ঘোল চেনে না। এইসব ঢংয়ে শাহবাজ ভুলে না। তাই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। আয়না সেই বেরিয়ে যাওয়া দেখলো। দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে বাইরে এলো। এসে অবাক হলো। কেউ নেই! আম্বিয়া উনিও নেই। একটা ভ্যানে, ভ্যান চালকের জায়গায় শাহবাজ বসে আছে। তাকে দেখে হেসে বললো, — আসেন পিরিতের বউ। শ্বশুর বাড়ি পিরিতের স্বামী আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

আয়না ঢোক গিললো। তার চোখে মুখে আবারো ভয় স্পষ্ট দেখা গেলো। না ভ্যানে উঠার জন্য না, গ্রামের মেয়ে, ছোট থেকে বড় হলো এই ভ্যানে চড়ে চড়ে । তবে ঐ যে সারেং বাড়ির নাতি বসা। যতো ভয় তো তাকে।

তবুও ধীরে ধীরে এগিয়ে উঠে বসলো। বসে একেবারে মাঝে চলে এলো। ভালো ভাবে যে তাকে নেবে না ঠিক জানে।

হলোও তাই! তার বসতে দেরি প্যাডেল দিতে দেরি হয়নি। আয়না খিঁচে বসে রইল। সদরের রাস্তা পাকা সেখানে সমস্যা না হলেও গ্রামের রাস্তায় এসে আয়নার অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। এবড়ো থেবড়ো রাস্থা, তার মধ্যে মাথায় ঝাঁকুনি। তার মনে হলো সে সত্যিই উড়ে পড়ে যাবে। তাই বাঁচতেই ফট করে পেছন থেকে শাহবাজের গেঞ্জি মুঠো করে ধরলো। ধরতেই ভ্যান ফট করে থেমে গেল। আয়না চোখ, মুখ খিঁচে বললো, — আমি যেতে পারবো না। একদম না! মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে।

শাহাবাজ না ফিরলো, না কিছু বললো। তবে ঝাড়া মেরে গেঞ্জি থেকে হাত ঠিক ছাড়ালো। ছাড়িয়ে ভ্যান থেকে নেমে সোজা হেঁটে চলে গেলো।

আয়না অবাক নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই যাওয়া দেখলো। এই রাস্তা ঘাট তার সবই পরিচিত। ইচ্ছে করলে সেও নেমে যেতে পারে। তবে নামলো না। ভ্যানে শুয়ে চোখ বন্ধ করল । মাথায় সত্যিই যন্ত্রনা হচ্ছে।

কতোক্ষণ রইল কে জানে, তার তন্দ্রা ছুটলো হালকা দুলুনিতে। সে টেনে চোখ খুলে দেখলো, শাহবাজের দুই চেলা দুই পাশে। একটা হেঁটে হেঁটে আস্তে করে পেছন থেকে ভ্যান ঠেলছে, আরেকটা সামনে দিকে হেঁটে হেঁটে’ই ধীরে ধীরে ভ্যানটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

চলবে…..

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ১৮

জাফর হাঁটছিল ধীরে ধীরে, মাটির পথ ধরে। তাদের স্কুলটা পড়েছে প্রায় সদরের কাছাকাছি। কাছাকাছি হওয়ার কারণ অবশ্য একটাই। শুধু মিঠাপুকুর না, যেন আশে পাশে যতো গ্রাম আছে সব জায়গা থেকেই ছেলে মেয়েরা পড়তে পারে।

এই স্কুলটা করেছিল তার বাবা। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েদের পড়াশোনাটা আরেকটু সহজ হোক। অবশ্য সত্যি বলতে শুধু যে এই একটাই কারণ তা না। তিনি চেয়েছিলেন এমন কিছু হোক যাতে সারেং বাড়ির মানুষ না থাকলেও নামটা যেন থাকে। আর স্কুল এমন একটা ব্যবসা যেখানে টাকা, নাম দুটোই হয়। বাবার চিন্তা বিফলে যায়নি। তাদের গ্রামে হাইস্কুল ছিল না। যেটা ছিল সেটা আরো দূরে। তাই অল্পতেই উঠতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

তার পাশেই পৃথিলা। চুপচাপ, শান্ত আর কি ময়াময় একটা মুখ। জাফরের তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে ভয়ে খুব একটা চোখ ফেরায় না। মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি। বেশি আবেগ দেখালেই দুইয়ে দুইয়ে চার করতে সময় লাগবে না।

তবে বলতেই হবে, মেয়েটা হয়েছে একদম অন্যরকম। ভেতরের কোন আভাস কাউকে বুঝতে দেয় না। নিজের চার পাশে শক্ত একটা খোলস যেন তৈরি করে রেখেছে। সেটা ডিঙিয়ে তাকে পড়া এতো সহজ না।

জাফর চোখ ফিরিয়ে সামনের রাস্তায় নিলো। তার গায়ে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। দু’হাত পেছনে মুড়ে বুক টান টান করে ধীরে ধীরে হাঁটছে। না চাইতেও সারেং বাড়ির একটা অহম ঠিক যেন ফুঁটে উঠে।

পৃথিলা অবশ্য হাঁটছে স্বাভাবিক ভাবে। সে সব সময়’ই এমন । সাধারণ, খুব সাধারণ। গায়ে রুপালি পাড়ের কালো কাপড়। মাথায় সাধারণ হাত খোঁপা। আঁচলটা ঘুরিয়ে চাঁদরের মতে গায়ে খুব গুছিয়ে নেওয়া। যাকে প্রথম দেখায়’ই মনে হয় খুব সাধারণ, তবে যতো কাছে ততো বোঝা যায় আসলে কতোটা অসাধারণ।

আজকে রোদের তেজ নেই, আকাশটা মেঘলা। আর মেঘলা বলেই চারিদিকের আবহাওয়া গুমোট। এই বছরের প্রথম বৃষ্টি মাটির বুকে মিশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই নেওয়ায় কতো আয়োজন। অথচ মিশে’ই নিঃশেষ সে।

জাফর রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে’ই বললো, — তোমার কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?

পৃথিলার হালকা হাসলো! তারা যাচ্ছে স্কুলে। সকাল থেকে সাবিহা সারেং বাড়িতে। বউ আসবে নানান আয়োজন চলছে। সে চুপচাপ বসায় ছিল। তখনি বীণা মেয়েটা দৌড়ে এসে বললো, — সাবিহা ভাবি আপনাকে তৈরি হতে বলেছে, ছোট চাচা স্কুলে নিয়ে যাবে।

পৃথিলা অবাক হয়নি। সাবিহা নিশ্চয়’ই গিয়ে কিছু বলেছে। এই মেয়েটাও না। তারা চাকরি দেবে আবার নিজে নিয়ে পরিচয়ও করিয়ে দেবে। আজকাল এতো দায় কার থাকে। অথচ এই পাগল মেয়েটার সেই ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। এই পাগল মেয়েটার ঋণ এই জীবনে শোধ হওয়ার নয়। সে হেসেই বললো, — বলবো না হচ্ছে না। হচ্ছে, হাঁটার অভ্যাস নেই। তবে ভালোও লাগছে।

জাফরও হাসলো! সে ইচ্ছে করেই ভ্যান নেয়নি। মেয়েটার আশে পাশে থাকতে তার ভালো লাগে। শান্ত ভাবে যখন কথা বলে, মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে। ভ্যান নিলেতো দু’মিনিটে পৌঁছে দিতো। তবে এই যে সময় এটা পেতো কোথায়। মেয়েটার পাশে আসতেও তো তার বাহানা লাগে। তাই বের হতেই বললো, — তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই, যদি ধীরে ধীরে হেঁটে যাই সমস্যা হবে? মেয়েটাও সাথে সাথে হালকা হেসে বলেছে” কোন সমস্যা নেই চলুন “।

সেই চলায় ধীরে ধীরে প্রায়’ই এসে গেছে। জাফর হেসেই বললো, — চলো ঐ গাছটার নিচে একটু দাঁড়াই। পৃথিলা বিনা বাক্য এগিয়ে গেলো। যেতেই একটা ভ্যান প্রায় বাতাসের গতিতে তাদের পেছন সাইড দিয়ে গেলো। পৃথিলা জাফর দু’জনেই হতম্ভব হয়ে ফিরে তাকালো। তারা এতোক্ষণ সেখানেই ছিল। যদি সাইড না হতো। উড়ে ধ্যান ক্ষেতে গিয়ে ঠিক পড়ত।

জাফর হতম্ভব ভাবেই বললো, — ভ্যানে শাহবাজ ছিল না?

পৃথিলার হাসি পেয়ে গেলো। অবশ্য হাসলো না। এখানে এসেছে পর থেকে একেক আজব কিসিমের মানুষ দেখছে সে। একজন বিনা কারণে আগুনের তেজ, রাগ, বিরক্তি চান্দিতে নিয়ে ঘুরছে, আরেকজন পানির মতো শান্ত, নির্বিকার চিত্তে ন্যাড়া মাথা নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব কাজ করছে। আর এই জন, এটাকে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলবে পৃথিলা জানে না। সে হাসি দমিয়ে বললো, — হুম।

জাফর আগের মতোই বললো, — মেয়েটাতো পড়ে যাবে। তার মধ্যে অসুস্থ। কোন আক্কোলে এমন ভাবে নিচ্ছে। তাছাড়া আর মানুষজন কই। এই পাগলের সাথে এই মেয়েকে একা ছেড়েছে কে? তাড়াতাড়ি আসতো, স্কুলে তোমাকে পরে নিচ্ছি। মেয়েটাকে তো মেরে ফেলবে। বলেই জাফর এগুতে গেলো।

পৃথিলা জাফরের হাতটা আলতো করে টেনে ধরলো! ধরে বললো, — আপনি আমার বাবার বয়সী। তাই সবার মতো ছোট চাচা’ই বলছি। এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তাদেরকে তাদের মতো ছাড়ুন। আপনারা ছেড়ে দিলেই, তারা নিজেদের কে আঁকড়ে ধরার, বোঝার চেষ্টা করবে।

জাফর কেঁপে উঠল! কেঁপে হাতের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে ক্ষেতের দিকে তাকালো। তার চোখে পানি চলে এসেছে।

পৃথিলা হাত ছেড়ে বললো, — কোন সমস্যা?

জাফর তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবির হাতার চোখ মুছল। মুছে বললো, — চোখে কি জানি পড়ল মা। হয়ত পোকা টোকা হবে। ধানের ক্ষেত থেকে উড়ে এসেছে।

— আল্লাহ! তাই নাকি? কই দেখি।

জাফর অবশ্য ফিরলো না। পানি ফেরাতে পারছে না। তাই সামনের দিকে এগুতে এগুতে বললো, — ঠিক হয়ে গেছে। সমস্যা নেই। তুমি আসো মা। এই মেঘ আসবে না। কেটে গেলে রোদের তাপে হাঁটতে পারবে না।

পৃথিলা অবাক হয়েই কিছুক্ষণ হনহনিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। বলছে সমস্যা নেই। আবার দু’হাতে ঘষে ঘষে অনবরত চোখ মুছে যাচ্ছে। আশ্চর্য!

মিঠাপুকুর হাই স্কুলটা দু-তলা। মাখন রঙে বড় একটা মাঠের মাঝামাঝি মাথা উঁচু করে স্কুলটা দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই বিশাল একটা বট গাছ। তার মোটা শিকড় গুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।

এখনো স্কুলের ঘন্টা পড়েনি। তাই সেই শিকড়, মাঠ, বারান্দা জুড়ে নীল সাদা রঙের স্কুল ড্রেসে ছেলে মেয়েরা হুটোপুঁটি খাচ্ছে।

সেই ছেলে মেয়েদের মাঝে হেডমাস্টারের রুম থেকে পৃথিলা আর জাফর বের হলো। তার মুখটা কিছুটা শুকনো। অবশ্য নিজেকে সে সাথে সাথে’ই সামলে নিয়েছে। তবুও আকাশের বৃষ্টি আর চোখের কান্না। দুটোর একবার হলে রেশ কিছুসময় তো থাকবেই।

পৃথিলা সেই শুকনো মুখটা নিশ্চুপ দেখলো। অবশ্য আর কিছু’ই জিজ্ঞেস করেনি। সারেং বাড়ির গল্প সাবিহার মুখে শুনেছে। হয়ত স্ত্রীর অকাল মৃত্যু, সন্তানাদি নেই। তার হাহাকার হয়তো লোকটার ভেতরে জমাট বেঁধে আছে । আছে বলেই সবাইকে সমান ভাবে ভালোবাসতে পারে, স্নেহ করতে পারে। তাইতো যেমন নিজের ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের স্নেহ করেন, তেমনি অন্যদেরও করেন। তাই যেমন তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে তেমনি করছে আয়নাকে নিয়ে। কিছু মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ হয় সাগরের মতো বিশাল। সেখান থেকে পানি যতোই তুলে নাও, শেষ হবার নয়।

তাই পৃথিলা স্বাভাবিক ভাবেই চোখ ফিরিয়ে হেডমাস্টারের দিকে তাকালো। হেডমাস্টার তাদের সাথেই বের হয়েছে। হাসি খুশি ছোট খাটো মানুষ। সে হেসেই বললো, — আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না জাফর ভাই। আপনি বলেছেন সেটাই যথেষ্ট। তাছাড়া একজন মহিলা শিক্ষকের খুব প্রয়োজন ছিল। অজোপাড়া গায়ে পড়াতে আসতে চায় কে? আর গ্রামের মেয়েরা কোন রকম মাধ্যমিক। তার মধ্যেই শেষ। একজন মহিলা শিক্ষক থাকলে মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।

জাফর হালকা হাসলো! হেসে বললো, — তাই তো ধরে বেঁধে নিয়ে আসলাম। যদি আবার মন উলটে যায়।

পৃথিলাও হাসলো! সব কিছু এতো সহজ হবে সে ভাবেনি। অথচ দু’দিন আগেও নিজেকে নিঃস্ব ছাড়া কিছু মনে হয়নি।

হেডমাস্টার পৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — তাহলে ম্যাডাম পৃথিলা। দেখা হচ্ছে তাহলে। আশা করি আমাদের স্কুলটা খারাপ লাগবে না।

— অবশ্যই স্যার। এতো সুন্দর স্কুল খারাপ লাগার প্রশ্ন’ই আসে না।

হেডমাস্টার বিদায় নিয়ে নিজের জায়গায় গেলেন। স্কুলের ঘন্টা পড়ছে। সব ছেলে মেয়েরা দৌড়ে নিজের ক্লাসরুমে যাচ্ছে। পৃথিলা সেই দিকে তাকিয়ে বললো, –বীণা এই স্কুলেই পড়ে?

— হ্যাঁ! এবার সে মাধ্যমিক দেবে। বিয়ের ঝামেলায় স্কুল পড়া সব লাটে উঠে আছে। আমাদের ফরহাদও তো এখানে। বীণাকে বাড়িতেও পড়াচ্ছে।

পৃথিলা অবাক হলো! অবাক হয়ে বললো, — উনি শিক্ষকতার পেশায় আছেন নাকি?

জাফর এবার হেসে ফেললো! প্রাণ খোলা হাসি। পৃথিলা কেন অবাক হয়েছে না বোঝার কিছু নেই। তাই হেসে বললো, — ও খুব ভালো ছেলে। এমনি উপরে যাই থাক। মানুষ হিসেবে যদি বলো, আমি ওকে একশোতে নব্বই দেবো। বাকি দশ কাটবো ওর রাগ আর বিরক্তির জন্য।

পৃথিলাও হাসলো! এমন একজন এমন পেশায়, বিস্ময়ের’ই বিষয়। তারা স্কুল থেকে বেরুতেই এরশাদকে দেখলো। এখানে না অবশ্য, একটু দূরে রাস্তার ওপারে। কিছুলোকের সাথে দাঁড়িয়ে। হাতে সিগারেট। লোকগুলো কিছু বলছে, সে শান্ত ভাবে শুধু শুনছে। দৃষ্টি মাটির দিকে। তারা এগিয়ে গেলো।

এগিয়ে যেতেই সেই মাটিতে এরশাদের ছায়ার পাশে একটা নারীর ছায়া পড়ল। পড়তেই এরশাদ চোখ তুলে তাকালো। আর তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো। কালো কাপড়ের মাঝে রোদে গরমে ঘেমে লালচে একটা মুখ। সেই মুখের মাঝে অসম্ভব সুন্দর দুটো চোখ। এই মেয়েকে কেউ কি বলেছে, তার চোখ দেখে যে কেউ প্রেমে পড়বে। আর পড়বে বলেই ভুল মানুষের হাত টা অতি সহজেই ধরে ফেলেছে।

আর ধরেছে বলে এরশাদ সবার চোখের আড়ালে তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট হাতেই মুঠো করে ফেললো। হাত জ্বললো, তার সাথে এরশাদের অনেক কিছু’ই যেন জ্বলে পুড়ে শেষ হলো। অবশ্য মুখ তার আগের মতোই শান্ত। শান্ত ভাবেই সব সময়ের মতো সুন্দর করে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো! সেই হাসি সুন্দর, মার্জিত, কিছুই না বোঝার সরলতার হাসি।

আয়না ভ্যান থেকে একেবারে পা রাখলো চন্দন কাঠের পিঁড়িতে। জড়োসড়ো হয়ে। জড়োসড়ো হওয়ার কারণ জয়তুন আরা তার ঠিক সামনে। শেষ বার দেখেছিল অনেকটা আগে। কতো বয়স মনে নেই। তখন দেখেই ভয়ংকর চাঁদের বুড়ি মনে হয়েছিল আর এখন এক কথায় রাক্ষুসী ডায়নি বুড়ি।

তার বড় মা বলতো, — মানুষের ভেতর যেমন, বাহিরও ধীরে ধীরে তেমন হয়ে যায়। সেটা যেমন’ই থাক। কালা কি আর ধলা। অনেক সময় দেখবা কালো মানুষরেও লাগে পদ্ম ফুলের সুন্দর, মনে হয় নূরের একটা আলো বাইর হচ্ছে। দেখলেই মনে প্রশান্তির বাতাস বইয়া যায়। আসলে তার ভেতর পবিত্র। আর পবিত্র বলেই তার চেহেরায়ও পবিত্রা বিরাজ করে। আবার অনেককে দেখবা দেখতে খুব সুন্দর, গোছানো, পরিপার্টি। তবে চেহেরায় মায়া নাই। দেখলেই গা ছমছম করে, ভেতরে অন্য রকম আতঙ্ক লাগে। আসলে তার ভেতর ময়লা, পাপ। আমরা চোখের দেখায় বুঝি না, তবে এই যে ভেতরের আত্মা তা ঠিক অনুমান করতে পারে। আর পারে বলেই এমন লাগে।

আয়নার মনে হয় এই জয়তুন আরার ক্ষেত্রেও তা ঠিক। গায়ের রং তার ধপধবে ফর্সা, বয়স হয়েছে চমড়ার ভাঁজতো থাকবেই। তবে চুল পরিপার্টি করে তেল দিয়ে গোছানো। ফর্সা মুখে সাদা – সোনালি মিশেলের চুলগুলো রোদে চিকচিক করছে। গায়ে সাদা গরদের কাপড়। সেই কাপড়ও যে যত্নের তা দেখেই স্পষ্ট। হাত, পা, শরীর বয়সে দূর্বল হলেও কোথাও তাদের দাদির মতো রুক্ষতা নেই। দেখেই বোঝা যায় নরম, কোমল। মাটির স্পর্শ পায় না বললেই চলে।

তবুও দেখে আয়নার গলা শুকিয়ে এলো। ভেতর রিতিমতো কাঁপছে। অথচ ঐ যে শহুরে আপাটা। কোন পরিচয় নেই, চোখের দেখা নেই। তবুও এক ঝলক দেখলেই মনে কি শান্তি। আয়নার মনে হয় এই আপার ভেতর টা পবিত্র। আর পবিত্র বলেই এমন।

বলেই আয়না আড়চোখে আশে পাশে একবার তাকালো। বউয়ের কথা শুনে আশ পাশ থেকে মেয়ে বউরা দৌড়ে এসেছে। সেই দিন জয়তুন আরা ধমকে তাড়িয়ে দিলেও আজ হাসি মুখেই সবার সাথে কথা বলছে। পানের বাটা এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এতো মানুষের মাঝে আয়না সেই স্বস্তির মুখটা খুঁজে পেলো না। পেলো না বলেই তার ভয়ের সাথে মনটাও খারাপ হলো। অবশ্য এই খারাপ লাগা কারো চোখে পড়ল না। সবার চোখে পড়ল আয়নার চোখ ধাঁধানো রুপ। সেইদিন ছিল ক্লান্ত বিধ্বস্ত, আজ চেহেরায় চাঁদের কলঙ্কের মতো রক্ত জমাট বাঁধা নেই। যেটুকু আছে সেটা অস্পষ্ট। মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ মুখ কিছুটা শুকনো থাকলেও তাতে রুপের ঝিলিকে কমতি নেই।

এক এক করে সবাই নতুন বউয়ের মুখে মিষ্টি ছোঁয়ালো। বরণ করলো। করতেই জয়তুন হাঁক ছেড়ে বললো, — ঐ, শাহবাজ কই রে। বউ কি হাঁইটা ঘরে যাইবো নি?

শাহবাজের টিকিও কেউ খুঁজে পেলো। পেলো না বলেই আয়না মনে মনে হাফ ছাড়লো। তার হাফ অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এই বড় জোড় ঘন্টা খানেক। ততক্ষণে আয়না বসার ঘরে আরাম করে বসেছে। মাথায় ঘোমটা। অনেকেই আসছে যাচ্ছে।

তখনি তার আরামকে বেরাম করে সারেং বাড়ির বসার ঘরে দুই বস্তা কাগজের ফুল নিয়ে কালাম এলো। জয়তুন ভ্রু কুঁচকে বললো, — এগুলো কি রে কালাইমা?

তখনি শাহবাজ ভেতরে এলো। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে একগাল হেসে বললো, — বুবুজান রাতা মুরগি জবাই, সবচেয়ে বড় দোকানের মিষ্টি আনলে শুধু হবে। আসল কাজ’ই তো করো নাই। পিরিতের বউ আমার, আমাকে বিয়ে ছাড়া উপায় নাই। সে কি শাহবাজের বুকে সাদামাটা ঘরে আইবো নি? তাইতো এই আয়োজন। তার জন্য এইটুকু’ই যদি না করতে পারি, তো বুবু করলাম টা কি?

জয়তুন যেন খুব মজা পেল। খিক খিক করে হেসে বললো, — দূর হ হারাজাদা। লাজ লজ্জায় বালায় নাই।

— ওতো বালায় টালাই নিয়ে ভাবার সময় নাই। বলেই কালামের দিকে তাকিয়ে বললো, — যা ভাই সুন্দর করে বাসর টাসর সাজা। জীবনের প্রথ্ম বিয়া, প্রথ্ম বউ, প্রথ্ম বাসর ঘর। কোন কমতি যেন না থাকে।

কালাম সব সময়ের মতো নির্বিকার চিত্তে উপরে গেলো। শাহবাজ হাত পা ছড়িয়ে ঠিক আয়নার সামনে বসলো। বসে বললো, — মাথার যন্ত্রনা কমেছে বিবিজান? কমলে বলবেন। আমি নিজ দায়িত্বে আবার বাড়ানোর চেষ্টা করবো। শাহবাজকে বিয়ে ছাড়া তো আপনার উপায় ছিল না। সেই উপায়ের ঝালতো একটু সহ্য করতেই হবে, তাইনা?

আয়না উত্তর দিলো না। তার গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। আর একটা জিনিস ঠিক বুঝলো, — মিথ্যা বলে বিয়ের জন্য, এ তাকে জানে মারবে না তবে তিলতিলে শাস্তি ঠিক দেবে।

আর দেবে বলেই সে ঢোক গিললো। আয়না অবশ্য জানে না। তার ভেতরের সব আতঙ্ক চোখে মুখে স্পষ্ট বিরাজমান। আর বিরাজমান বলেই শাহবাজ হাসলো। দু’ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসা। আর হেসে’ই আয়নার চোখে চোখ রেখেই, চোখ মারলো।

চলবে…..