ধূপছায়া পর্ব-১৯+২০

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_১৯

মিঠাপুকুরের নীল আকাশে, কালো মেঘ সারাদিন শিমুলের তুলোর মতো উড়াউড়ি করলেও, কিছু রোদ তখনও ঝলমল করছিল। তবে মেঘ মনের বিষাদ নিয়ে জমাট বাঁধলো সূর্য ডোবার পরে। তাই তো হঠাৎ করেই সন্ধ্যার পরে এক ঝুম বৃষ্টি মিঠাপুকুরের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আকাশে তখনো কিছু তারার মেলা, লুকানোর সুযোগ পায়নি। আবহাওয়া আগের মতোই গুমোট, মাটি খরখরে। সেই খরখরে বুকে বড় বড় ফোঁটার এক পসলা বৃষ্টি ঝুম ঝুম করে মাখিয়ে দিয়ে গেলো। আর মাখতেই পুরো মিঠা পুকুর গ্রামটা অন্ধকারে তলিয়ে গেলো।

একটু ছুতো পেলেই বিদ্যুৎ গায়েব। অথচ দেখো মাটিটাও ভিজেনি। আম্বিয়া গজ গজ করতে করতে হারিকেল জ্বালালো। জয়তুন ততক্ষণে মশারির ভেতরে। সেখান থেকেই বললো, — সবার খানাপিনা শেষ?

এরশাদ ভাই, শাহবাজ কেউ ফিরেনি। দুপুরে খেয়ে বেরুলো আর খবর নেই। বাকি সবার শেষ। ছোট চাচা ভাত খায়নি। শুধু একগ্লাস গরম দুধ খেলো।

— ক্যা, শরীর ভালো না ?

— তা আমি কি করে জানবো? সে কি কাওকে কিছু বলে? আগে তো রুম থেকেও বের হতো না। এখন কারণে অকারণে ঘুরাঘুরি।

জয়তুন কিছু বললো না। হিসেব এখনো বাকি। বাকিটা শোধ হোক। তারপরে আবার নতুন করে কথা। সে উঠে বসলো। কোমর বাঁকা হয়েছে পুরোপুরি সোজা হতে পারে না। সেভাবে বসে বললো, — নয়া বউ কই?

— এখনো বীণার রুমে। সই পেয়েছে তোমার নাতনী। গুটুর গুটুর করে এক দিনেই পেটের সব কথা শেষ। এমন ননদ কপাল জুড়ে মেলে। কাপড় টাপড় তো কিছু নেই। বাড়ি ভরা বেরং কাপড়। গেছে বৈশাখে লাল পাড়ের একটা শাড়ি দিলেনা বীণাকে? সেটাই ভাবিকে হাত, মুখ ধুয়ে গুছিয়ে দিয়েছে পরে। মেয়েটাই আসলেই সুন্দর বুঝেছো। গা থেকে যেন আলো বের হচ্ছে।

— এরশাদের বেলায় তো দেখতেই পারোস নাই। তখন ছিল কালমুখি আর আজ আবার এতো গুণ। ভালো! এক মুখে’ই মধু, বিষ। হজম করিস কেমনে?

— যেভাবে তুমি করো। কাল পর্যন্ত তো চোক্ষের বালি ছিল। আজ তাকেই আদর সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছো।

— সেটা তো আমার নাতির জন্য। তোর কিসের ঠেকা?

আম্বিয়া উত্তর দিল না। ছাদ থেকে বিকেলে কাপড় তুলেছে সেগুলো গুছিয়ে আলনায় রাখলো। জয়তুন সেই দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসলো। সারেং বাড়ির প্রতিটি ইটের কোণার খোঁজ তার কাছে আছে। সে হেসেই বললো, — আমার গহনার বাক্সগুলো আন।

আম্বিয়া আলমারি খুলে এক এক করে মশারির ভেতরে এগিয়ে দিলো। এই বাড়ির প্রতিটা কোণার খোঁজ যদি জায়তুনের কাছে থাকে তার কাছে আছে প্রতিটা কোণার মায়া, যত্ন, আদর, আগলে রাখা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই হাতেই তো সব করেছে। অথচ এই বাড়ির সে কিছু না। এই যে নয়া বউ। পা রেখেছে সবে। তবে যে ক্ষমতা সারেং বাড়িতে এই মেয়ের আছে তার ধূলিকনার সমানও নেই। আশ্রিতা, কাজের লোক সে। তাদের মতো মেয়ের স্বপ্ন দেখতে নেই, ভালোবাসতে নেই। কেউ হাত ধরে কোণায় টেনে নিলে গদগদ করতে করতে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে। তার মাকে’ই কত নিজের চোখে দেখেছে। অথচ তার শরীর ভরা দিয়ে রেখেছে ঘেন্না। কাজের মানুষ, কাজ করে যাবে তা না। অবশ্য জয়তুন বিয়ের সময়ে ঠিক পাত্র জোগাড় করেছিল।

যে জয়তুনকে করবে, তাকে তার প্রাপ্য দিতে সে কখনোও কার্পণ্য করে না। আম্বিয়া নিজেই বিয়ে করে নি। এই ঘর, এই সংসারের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে তার মায়া। না থাক অধিকার। মায়া কি আর এতো কিছু বোঝে?

জয়তুন সব টেনে নিজের কাছে নিলো। কতো গহনা! অথচ পড়ার মানুষ নেই। সে দেখতে দেখতে বললো – নয়া বউর যা যা লাগে সব আনার ব্যবস্থা কর।

— আমি করবো কেন? যার বউ সে করুক। বাসরের ব্যবস্থা করতে পারে। কাপড়, চুড়ি, আলতার করতে পারবে না কেন?

জয়তুন হাসলো! তার নাতি এরা। সে ভালো করেই জানে কি চলছে। সে হেসে কিছু গহনা আলাদা করে বললো, — এগুলো নয়া বউ গায়ে দিয়ে দে। সারেং বাড়ির বউরা কখনো খালি গায়ে থাকে না।

আম্বিয়া বাকি বাক্সগুলো সুন্দর করে আগের মতো তুলে রাখলো। সব সময় সে’ই রাখে। এই বাড়ি সংসারের চাবি সব তার হাতেই। তবুও কখনো লোভ করেনি। অবশ্য সবার লোভ কি শাড়ি গহনা হয়? হয় না। কাজের লোক, আশ্রিতা। থাকবে টাকা, গহনার লোভ। অথচ সে করেছিল বামুন হয়ে চাঁদের। ঝলসে তো যাবেই। সে রেখে বাকি গহনাগুলো হাতে নিতে নিতে বললো, — ও হ্যাঁ বিয়ের সময় যেই গহনা দিয়েছিলে সেগুলো সাবিহা দিয়ে গেছে। সেই দিন রাতে খুলে তাদের কাছে রেখেছিল। কয়েকটার অবস্থা তো বেহাল। বউ সেজে কোন কুস্তিগিরি খেলেছে তোমার নাতির সাথে কে জানে? গ্রাম শুদ্ধ মানুষ বুঝি চোখে ঘোল খাবে?

— কুস্তিগিরি করুক, যাই করুক। তোর কি? গহনা তুলে রাখ। নতুন করে গড়ানো যাবে। বলেই জয়তুন আবার শুলো। শুতে শুতে বললো, রাত তো মেলা, নয়া বউরে শাহবাজের রুমে দিয়ে আয়।

— অন্ধকারে ভয় পাবে না। পুরো দু’তলা খালি। ছোট চাচা এক কোণে। শাহবাজ আসুক তারপরে না হয় যেত।

— যা বলছি তাই কর। রাত বিরাতে সাত গ্রাম ঘুরছে তখন ভয় করে নাই। এখন যতো ঢং। তাছাড়া যতোই বাসর ঘর সাজিয়ে পাতিয়ে রাখুক। লাথি দিয়ে ঘর থেকে না বের করলেই হলো।

আম্বিয়া আর কিছু বললো না। একহাতে গহনা আরেক হাতে হারিকেন তুলে বীণার রুমের দিকে গেলো। তার আর বীণার রুম পাশাপাশি। ছোট বেলা দাদি সাথে ঘুমাতো। এই কিছুদিন হলো নিজের রুম নিয়েছে। রাত করে পড়ে। দাদিতো সন্ধ্যা হতে না হতেই বিছানায়।

দোতলার মাঝামাঝিতে শাহবাজের ঘর। দু’তলায় তিন তিনটা মানুষের বসবাস হলেও তিনজনে তিন প্রান্তের বাসিন্দা। এককোণে জাফরের, আরেক কোণে এরশাদের। এরশাদের রুমটা একেবারে শেষ মাথায়। তেমন বড় না, বরং বাড়ির সবচেয়ে ছোট’ই। পুরো রুমে একটা জানালা, তার মধ্যে একেবারে শেষের। আলো বাতাসও কম, দেখতেও সাধারণ। সেই সাধারণ রুমটা সে নিজের ইচ্ছায় নিয়েছে, নিজের মতো থাকে।

শাহবাজের অবশ্য সেই রকম কোন ধাত নেই। তার এসে পটাং করে শুয়ে রাতটুকু কাটালেই হলো। দরজা – তো ভালোই আম্বিয়া, বীণা মনে করে যদি জালানা না লাগায় বা না খোলে। সেই জানালা দু’তিন দিনেও সে আর না লাগাবে না খুলবে। এমনিই এসে পড়ে পড়ে ঘুমাবে।

একসময় এই ঘরটা ছিল তাদের বাবা, মায়ের। তাই চওড়া দরজা, কাঠের সিলিং, দেয়ালের গা বেয়ে পুরনো কাঠের আলমারি। জানালার ফাঁকে ফাঁকে ঘন পর্দা। চারিদিকে কি সুন্দর কারুকাজ। এখন অবশ্য আগের মতো ওতো গোছানো নেই। তবুও সবচেয়ে সুন্দর রুমটা যেন এটাই। আর এই ঘরেই আয়না পা রাখলো মনে মনে এক সাগর আতঙ্ক নিয়ে। এই যে এতো সুন্দর রুম, এতো সুন্দর সুন্দর আসবারপত্র। সে তো কখনো দেখেনি। তাদের বাড়িতে ছিল কাঠের একটা চৌকি তাতে বিছানো থাকতো চটের বস্তার উপরে কয়েকটা ছেঁড়া কাঁথা। আসবার বলতে তাদের কিছু ছিল না। ছিলো ঝং ধরা কয়েকটা ট্রাঙ্ক আর বাঁশের তৈরি আলনা। আর এই যে এতো কিছু, গায়ে নতুন শাড়ি, গা ভর্তি গহনা। এগুলো তাকে বিমোহিত করলো না। বরং গায়ে জোঁক পেঁচানো দেখলে যেই অনুভূতি হয়, আয়নারও ঠিক সেই রকম হলো।

আম্বিয়া হারিকেনটা জানালার পাশে রেখে পেছন ফিরে তাকালো। আয়না জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে খাটের পাশে। চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম এমন ভয় সব মেয়েদের চোখে মুখেই থাকে। আম্বিয়ার বিয়ে না হোক, বয়সতো কম না। এমন কত দেখলো। দু’দিন যেতে না যেতেই এই ভয় মুচকি হাসিতে পরিণিত হয়। অবশ্য বলতেই হবে কালাম বাসর ঘরটা সাজিয়েছে সুন্দর করে। লাল, সবুজ কাগজের ফুল তার মধ্যে চিকচিক জড়ি। পালঙ্ক টা দেখতে ভালো লাগছে। আর সেই কাগজের লাল, সবুজ ফুলের পাশে লাল শাড়ি, হাতে, নাকে, গলায় গহনা পরা মেয়েটার মাথায় ব্যান্ডেস, কোন সাজসজ্জা না থাকলেও যেন চোখ ফেরানো দায়।

আম্বিয়া তাকিয়েই নির্বিকার গলায় বললো — শুয়ে পড়ো। এই বাড়ির নাতিরা কখন ফিরে তার কোন হদিস নেই।

আয়না একটু এগিয়ে খাটের কোণা ঘেঁষে আস্তে করে বসলো। এতো বড় বাড়ি। ভেতরে বসবাস হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন মানুষের। বিদ্যুৎ যেতেই কেমন গা ছমছম করছে। অথচ তাদের বাড়ির ছোট্ট টিনের ঘরে ফিসফিস করে কথা বললেও এই রুম থেকে ঐ রুমে সব শোনা যায়। আর এখানে গলা চেপে ধরলেও কেউ বোঝার নেই। সে আস্তে কোমল করে বললো, — আমি একা থাকব?

— তো? আমি কি বসে বসে এখন পাহারা দেবো? সূর্য উঠতেই তো আবার দুনিয়ার কাজ! তার মধ্যে যে আসুক দরজা খুলতে হয় তার। সন্ধ্যার পরে সে ছাড়া দরজার কপাটে কারো হাত রাখা নিষেধ। এরশাদ ভাইয়ের নিষেদ। কড়া করে নিষেধ।যদি কেউ ঢোকে সেটা আম্বিয়া নেবে, যদি কেউ বের হয় আম্বিয়া দরজা দেবে। আর এর মধ্যে যদি কারো কিছু হয়, এরশাদ ভাই হেসে হেসে তার গলায় ছুরি চালিয়ে দেবে।

আয়না আর টু শব্দ করলো না। করে কোন লাভ। এখানে সে কেউ না। আম্বিয়াও বললো না, দরজা টেনে চলে গেল। যেতেই আয়নার বুক ধক করে উঠল। হারিকেনের হলুদ আলোয় ঘরটা আরও বেশি অচেনা আর বিশাল মনে হলো। তবে সে না নড়লো, না খাটে উঠে শুলো। যেভাবে বসে ছিল, সেই ভাবেই বসে রইল। বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গেলো বুঝতেই পারলো না। সেই ঘুমের মাঝে আয়না স্বপ্ন দেখলো, — একটা ছোট্ট নৌকায় বসে আছে। গায়ে সেই দিনের বিয়ের বেনারসি, সেই সাজ, সেই গহনা। নৌকায় কোন মাঝি নেই। সে ভয়ে আশে পাশে তাকালো। পানি আর পানি। কোন কূল- কিনারা নেই। তখনি এক বাতাসে ছোট্ট নৌকাটা উলটে ফেললো। আর ফেলতেই আয়না ঝট করে চোখ খুলে সোজা হয়ে গেলো।

খুলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার অবশ্য সময় পেলো না। দরজায় হেলান দিয়ে শাহবাজ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সাদা ঘোলা একটা কাচের বোতল। সেখান থেকেই এক ঢোক গলায় ঢাললো।

আয়না ঘুম, স্বপ্ন, আকস্মিক ঘটনায় কোন হালচাল দেখাতে পারলো না। শুধু হা করে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল।

শাহবাজ হাসলো! অবশ্য হাসির চেয়ে দু’ঠোঁট ভেঁটকানো বললে বেশি ভালো হবে। সেই ভয়ংকর ভেঁটকানো ঠোঁট দু’টো আরো ভেঁটকিয়ে বললো, — মাথার যন্ত্রনা কমেছে বউ?

আয়না উত্তর দিলো না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল। তবে হাঁটুর উপরে রাখা হাত দু’টো ঠিক শাড়ি মুঠো করে ধরলো। সেই মুঠো করা হাত দু’টো হালকা বাতাসে ফুলের পাপড়ি গুলো যেমন কেঁপে কেঁপে উঠে ঠিক সেই ভাবে তিরতির করে কাঁপতে লাগলো।

শাহবাজ ভেতরে এলো স্বাভাবিক ভাবে। স্বাভাবিক ভাবেই দরজায় খিল দিলো। না নেশা হয়নি তার। খেলোই মাত্র এক ঢোক। এই এক ঢোক শাহবাজের কাছে এক বিন্দু সমান। আর এই বিন্দু পরিমাণ সে ইচ্ছে করেই খেয়েছে। সে নিজেও চায় না তার নেশা হোক।

তাই খিল দিয়ে চেয়ার টেনে আয়নার ঠিক সামনে বসলো। বোতলটা রাখলো সাইডে। রেখে বললো, — যখনি দেখি গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছো। লাজ, লজ্জা বলে কিছু আছে?

আয়না তাও চোখ ফেরালো না। আসলে সে থমকে আছে। সেই থমকে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে শাহবাজ আবার বোতল হাতে নিলো। নিয়ে আরেক ঢোক খেলো। খেতে খেতে বললো, — চিন্তা করোনা। নেশা আমার হয়নি, তাই ভুলেও ভাববে না যা বলছি, যা করছি নেশার ঘোরে করছি। আমি স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় সব করছি। বলেই বোতল তুলে পুরোটা আয়নার মাথায় ঢকঢক করে ঢাললো।

আয়নার তিরতির করে কাঁপা এখন থরথরে রুপ নিলো। আর মদের গন্ধে নাড়িভুড়ি সব উল্টে এলো। সাথে সাথে’ই হাত দিতেই নাক, মুখ চেপে ধরলো। কোন জিনিসের এমন বিশ্রী দুর্গন্ধ হতে পারে তার জানা ছিল না।

শাহবাজ যেন সেই কাঁপুনি ঠিক উপভোগ করলো। করে বুক প্যান্টের পকেট হাতিয়ে ম্যাচ বের করতে করতে বললো, — বাসর ঘর পছন্দ হয়েছে বউ?

আয়না চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে একবার ম্যাচ, একবার শাহবাজের দিকে তাকালো। শাহবাজ নির্বিকার! নির্বিকার ভাবে ঘঁষে আগুন জ্বালিয়ে খুব খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো, — কাপড় খোলো।

আয়নার মনে হলো সে ভয়, আতঙ্কে ভুল কিছু শুনেছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। শাহবাজ হেসে আগের মতোই বললো, — ভুল শুনোনি বউ! আমি কাপড় খুলতেই বলেছি। তাছাড়া এই রুমে খোলার মতো আপতত আর কিছু নেই।

আয়নার যেন বিস্ময় হওয়ার ক্ষমতাও শেষ হলো। সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আর চোখের কোণা থেকে গাল গড়িয়ে মুক্ত দানার মতো পানিরা ঝড়ে পড়তে লাগলো।

শাহবাজ দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বললো, — ওমা কাঁদার কি হলো? স্বামীর সামনেই তো খুলছো। তাছাড়া বাসর ঘরে মানুষ আর কি করে ভাই আমার জানা নেই।

আয়না আগের মতোই বসে রইল। কান্না গলায় আটকে হেচকির মতো আসছে। শাহবাজের জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি হাতেই নিভলো। শাহবাজ সেটা ফেলে আরেকটু এগিয়ে বসলো। বসতেই আয়না চোখ মুখ খিঁচে ফুঁপিয়ে উঠল। পায়ের উপরে শাহবাজ পা রেখেছে। ভালো ভাবেই রেখেছে। রেখে বললো, — আমি সব কিছু একবার’ই বলি বিবিজান। তবে আপনি আবার আমার পিরিতের বউ। তাই আরেকবার বলবো। যদি শুনেন ভালো, না শুনলে তার পরে যা হবে, সেটার সব দায়ভার আপনার। বলেই আবার ম্যাচের কাঠি জ্বালালো। জ্বালিয়ে আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে বললো, — কাপড় খোলো।

এবার অবশ্য আয়না চুপচাপ বসলো না। শাহবাজের বলতে দেরি এক ধাক্কা মারতে দেরি হয়নি। ধাক্কা মেরেছেও শরীরের সব শক্ত দিয়ে। শাহবাজ চেয়ারে বসা ছিল সাথে সাথে উলটে পড়ল। আর পড়তেই আয়না দৌড়ে দরজার কাছে গেলো। গিয়ে অবশ্য লাভ হলো না। বিশাল কাঠের দরজা। যেমন পাশে, তেমনি উঁচু। শয়তানটা লাগিয়েছে উপরেরটা। আয়নার হাতও পৌঁছালো না। আর পৌঁছালো না বলেই ভয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো।

শাহবাজ মাথায় ব্যথা পেয়েছে। আঘাত ছিল, তার মধ্যে ব্যান্ডেস করা নেই। তবুও চোখ, মুখ কুঁচকে গড়াগড়ি করে হাসল। হেসে অবশ্য উঠল না। আরেকটু আরাম করে শুলো। শুয়ে বললো, — আপনার কলিজার তারিফ না করে পারি না বিবিজান। সেইদিন স্টেশনে চাপা খোলার হুমকিতেও চুপচাপ বসেন নি। আজও চুপচাপ করলেন না। সব কিছুতে এতো মাতব্বরি ভালো বয়ে আনে না। সেইদিনও আনে নি, আজও আনবে না।

বলেই ঝট করে উঠল। উঠেই এক ধাক্কায় আয়নাকে দরজার সাথে মিশিয়ে ফেললো। মেশাতে দেরি কাপড় টেনে খুলতে দেরি হয়নি।

আয়না ব্যথায়, লজ্জায় কুকড়ে গেলো। লাল ব্লাউজ, পেটিকোটে ফর্সা নিখুঁত শরীরের দিকে শাহবাজ ফিরেও তাকালো না। তার চোখ টকটকে লাল। সেই লাল লাল চোখে তাকালো টলমলে পানি ভরা আয়নার চোখের দিকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে বললো, — সেই দিন ভরা মজলিসে যখন আমার নামে মিথ্যা বলেছিলি। আমারো ঠিক এমন লেগেছিল। মেয়েদের গায়ের কাপড় আর ছেলেদের চরিত্র দুটোই এক। কি সুন্দর টেনে খুলেছিস। কি ভেবেছিস আমার মাথার বাড়ি ঢং করে নিজের মাথায় নিলেই বেঁচে যাবি? শাহবাজ এতো সোজা! দু’জনে’ই পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। যদি গ্রামের মানুষ বিয়ে পড়াতো আফসোস থাকতো না। তবে মিথ্যা দাগ লাগালি কেন?

আয়না শাহবাজের চাপায় নড়তে পারছে না। তবুও কোন রকম হাত উঁচু করে মাথায় হাত রাখলো। রাখতেই হাত ভিজে গেলো। দরজায় বাড়ি খেয়েছে। কাঁচা সেলাই, বাড়িতে রক্ত বেরিয়ে এসেছে।

শাহবাজ সেই হাতও মুঁচড়ে ধরলো। আয়না এবার কোন শব্দ করলো না, না কাঁদলো। তবে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শাহবাজ চাপা ধরে তার দিকে ফিরিয়ে আবারো চিবিয়ে বললো, — বড় ভাইয়ের হবু বউ। তাকে নিয়ে কাদা ছুঁড়লে কেমন ঘিনঘিন লাগে জানিস। জানিস না। জানলে করার আগে দশবার ভাবতি। শুধু সারেং বাড়ির সম্মানের সাথে জড়িয়ে গেছিসরে। তা না হলে এই শাড়ি আমি মিঠাপুকুর গ্রামের বাজারের মধ্যে খুলতাম। তোর ভাগ্য ভালো সারেং বাড়ির বউ তুই।

— না। বলেই আয়না ঢলে পড়ে যেতে নিলো। মাথার যন্ত্রনায় সে দাঁড়াতে পারছে না।

শাহবাজ খুব তাচ্ছিল্যের সাথে কব্জি আঁকড়ে ধরে ফেরালো। পড়লে আয়নার মাথা আজ শেষ। এতো সহজে শেষ হতে দেবে সে। বলেই ঝট করে কোলে তুলে নিলো। আয়না শরীর ছেড়ে দিয়েছে। সেই দেওয়া আর নিভু নিভু চোখে বিরবির করে অস্ফুটভাবে বললো, — আপনিও জানেন না, বাবা মায়ের খুনিদের ভাত গলায় নামাতে কেমন লাগে, কেমন লাগে তাদের কাপড় গায়ে জড়াতে, কেমন লাগে তাদের বাড়ির বউ হতে, কেমন লাগে তাদের পাপের হাতের স্পর্শ গায়ে লাগলে।

চলবে……

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব-২০

ঘড়ির কাটা তখন চারটা ছুঁইছুঁই। ফজরের আযান দেবে দেবে করছে। আর নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়ানো সারেং বাড়ি যেন আরো নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আর এই নিস্তব্ধতার গোলকধাঁধায় শাহবাজ ঘরের মাঝ বরাবর সোজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । রাগ, জেদ না অন্য কিছু বোঝা গেলো না। তবে তার দৃষ্টি খাটে ঝিকিমিকি জড়ির, লাল সবুজ কাগজের ফুলের মাঝে বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকা রমণীর দিকে।

যাকে কিছুক্ষণ আগে বলতে গেলে বড় অবহেলায়’ই খাটে ছুঁড়ে ফেলেছে। আর ফেলতেই কিছু একটা হলো। রাগে জেদে এতোক্ষণ খেয়াল না করলেও। এখন চোখের সামনে ফর্সা গায়ে লাল রঙ ঠিক ভেসে উঠল। আর উঠতেই এই যে রাগী, জেদী, পাষাণ, মানুষকে পিষে ফেলা পুরুষের বুকে কিছু একটা হলো। আর হলো বলেই রাগ যেন আরো তরতর করে বাড়লো।
শালী, বেহুঁশ হয়েও গিড়িংগিরি বন্ধ করার নাম নেই। ঐ ফরহাদ’ই ঠিক। মেয়ে জাত’ই খারাপ। বলেই এগুলো, সাইড থেকে কাঁথা নিয়ে লাটিমের মতো পেঁচালো। তার ইচ্ছে করলো এই মুখও পেঁচিয়ে ফেলতে। পুরুষ মানুষ, মেয়ে দেখছে মাথার তার তো ছিঁড়বেই। এটা আর নতুন কি? তবে এই মুখ টানবে কেন? কালনাগিনীর ঘরের কালনাগিনী। সুযোগ পেলে’ই ছোবল মারতে এতোটুকুও দেরি করে না। বলেই ইচ্ছে মতো কাঁথা পেঁচালো। পেঁচিয়ে অন্ধকারে হনহনিয়ে নিচে নেমে এলো।

এরশাদ রাতে ফিরেনি। আম্বিয়া বসে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগেছে জানে না। আর সেই না জানার মধ্যেই দরজায় দু’টো পড়ল। আম্বিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠল। আল্লাহ হইছে কি? হড়বড় করে মশারি তুলে বের হলো। দরজা খুলতে দেরি, তবে এক হেঁচকা টানে হতম্ভব হয়ে গেলো। হতম্ভব কাটতে না কাটতেই গরুর মতো টেনে উপরে নিয়ে এলো।

আম্বিয়ার বুক ধড়ফড় করছে। সেই ধড়ফড়ের মধ্যেই হা করে চোখ বড় বড় করে তাকালো। আর কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে’ই রইল। একটু ধাতস্থ হতেই পটাপট কয়েকটা কিল ঘুসি শাহবাজের বাহুতে দিলো।

শাহবাজের চেয়ে সে দুই বছরের বড়। দুনিয়ায় এতিম হয়েছে এক সাথে, বড়ও হয়েছে এক সাথে। এখন আশ্রিতা কাজের লোক হলেও ছোট বেলায় এই ভেদাভেদ ছিল না। বরং বড় বোনের মতো ঊনিশ থেকে বিশ হলে ঠিক কান মুচড়ে ধরেছে। এখন অবশ্য ধারের কাছেও ঘেষা যায়না। বড় হতে হতে একেকজন অন্য জগৎতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। তার সাথে হয়েছে মেজাজ, রক্তে ঢুকেছে বংশের অহম , হয়েছে টাকার পয়সার গরিমা। অথচ ছোট বেলায় একটু কিছু হলেই আম্বিয়াবু, আম্বিয়াবু বলে দৌড়ে গলা ধরে ঝুলে পড়তো।

আম্বিয়া কিল ঘুসি দিতে দিতে দাঁত চিবিয়ে বললো, — মাইরা ফেলেছিস তুই?

শাহবাজ বিরক্ত হলো। বিরক্ত মুখে হাই তুলে বললো, — হ্যাঁ! এখন যা লাশ নিয়ে বিদেয় হ। খবরদার আমার রুমের আশেপাশে এই মেয়েকে যেন না দেখি।

— দেখি না মানে? বউ কার?

— আমি কি জানি? পানিতে চুবিয়ে জ্ঞান ফেরা। তার পর জিজ্ঞেস কর কার বউ।

— জ্ঞান ফেরাবো মানে? অজ্ঞান হয়ছে ক্যা ?

শাহবাজ উত্তর দিলো না। ধপ করে আয়নার পাশে’ই শুয়ে পড়লো। ফুলের সাজানো খাটে আয়না সোজা লাঠির মতো শুয়ে আছে। গায়ে কাঁথা পেঁচানো। মাথাটা অবশ্য হেলে পড়ে আছে। সেই মাথার সাদা ব্যান্ডেস লাল হয়ে আছে। শাহবাজ অবশ্য অন্য পাশে ফিরে শুয়েছে। শুয়ে চোখ বন্ধ করতে করতে বললো, — একে তুলে নিয়ে বিদেয় হ।

— তুলে নিয়ে বিদেয় হ মানে? লাদা বাবু? কোলে তুলে দৌড়ে যাবো। তাছাড়া কি করেছিস তুই?

— কিছুই না। করলে একে খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন যা নিয়ে ভাগ।

আম্বিয়ার ইচ্ছে করলো এই শয়তানের মাথায় দুটো দিতে। সে বিরক্ত মুখেই এগিয়ে গেলো। গায়ের কাঁথা টেনে সরালো। দেখতো, এমন ভাবে কেউ পেঁচায়? লাশকে পানিতে ফেলতেও তো এমন শক্ত করে কেউ পেঁচায় না।

কাঁথা সরাতেই দেখলো গায়ে কাপড় নেই। আম্বিয়া রুমের দিকে তাকালো। কাপড় এক কোণে জড়সড় হয়ে পড়ে আছে। চেয়ার উল্টো। তার পাশেই ম্যাচ। ঘর স্যাঁতসেঁতে ভেজা। কিছু একটার দুর্গন্ধ নাকে লাগছে। সেটা কি বুঝতে বাকি রইল না। তবে শয়তানটা করেছে টা কি? সে বিরক্ত মুখে বললো, — তুই উঠবি শাহবাজ। তা না হলে আমি ছোট চাচাকে গিয়ে ডেকে তুলবো।

— ডাক নিষেধ করেছে কে?

আম্বিয়া কপাল চাপড়ালো। ছোট চাচাকে ভুলেও ডাকা যাবে না। তিনি অন্য রকম। তাছাড়া ডাকার মতো অবস্থা এটা? আম্বিয়া কি করবে দিশে পায় না। সে শাহবাজ ধাক্কা দিয়ে বললো, — উঠবি শাহবাজ?

শাহবাজ নড়লো না। আম্বিয়া নিজেই খাটে উঠে গেলো। টেনে সুন্দর করে শোয়ালো। গা গরম হচ্ছে। মনে হয় জ্বর আসবে। মাথার ব্যান্ডেজের কি করবে? আল্লাহ! এই জীবনে একটা রাতও শান্তিতে দু’টো চোখ এক করতে পারলো না।

আম্বিয়া দাঁত চিবিয়ে বললো, — আমার রুম পর্যন্ত দিয়ে আয় হারামজাদা। তার পরে মরার ঘুম ঘুমা।

শাহবাজ এবার উঠল। আয়না ছোট খাটো মানুষ, এগিয়ে হাত ধরে টেনে ঝট করেই কোলে তুলে নিলো। নিতেই মাথাটা এলিয়ে পড়ল। আর পড়তেই ফর্সা গলা, কাঁধে লালচে আচড়ের দাগ গুলো শাহবাজের নজরে পড়ল। রাগের মাথায় কাপড় টেনে খুলেছে। তখন হয়ত লেগেছে। শাহবাজ চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে সাথে সাথে’ই আবার খাটে শুয়িয়ে দিলো। এবার অবশ্য আগের মতো ছুড়ে মারেনি। বরং আস্তে করেই শোয়ালো। শোয়াতেই তার কানে আয়নার অস্ফুট কথাগুলো বাজতে লাগলো। আর লাগলো বলেই শাহবাজের সাথে সাথে’ই ভ্রু কুঁচকে গেলো। এর বাবা মায়ের আবার কাহিনী কি?

আম্বিয়া বিরক্তগলায় বললো, — আবার কি হলো?

শাহবাজ উত্তর দিলো না। আয়নাকে রেখে সে নিজেই বেরিয়ে এলো। শুধু রুম থেকে না বরং ঘর থেকেই। বেরিয়েই তাদের লম্বা টানা সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বসলো। তার নিজের মাথায়ও যন্ত্রনাও হচ্ছে। চেয়ার উল্টো পড়েছে। কালনাগিনী এমনি হেবলা সেজে বসে থাকে। থাকতে থাকতে এমন এক কাজ করে বসে। মেজাজ এমনিতেই তুঙ্গে উঠে।

সেই তুঙ্গে মেজাজ নিয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। সেই দিনের পর থেকে রাতে জয়তুন আরার লোকদের ঘুমানো নিষেধ। কালাম দেখে এগিয়ে এলো। তাকে দেখে শাহবাজ মাথা তুললো না, তবে বললো, — ভাই কই?

— শহরে গেছে।

শাহবাজ কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। ভাই কখনোও গ্রামের বাইরে যায় না। যা কাজ লোক দিয়ে করায়। অতি দরকার থাকলে চাচা যায়। সে ভ্রু কুঁচকে বললো — হঠাৎ?

— কিছু বলে যায় নাই। শুধু বলেছে সকালে দিকে ফিরে আইবো।

— একা?

— হ।

শাহবাজ সেভাবেই আরো কিছুক্ষণ বসলো, তারপর বললো, — আয়নারমতির চাচার নাম যেন কি?

— বশির।

— ওর বাপের নাম কি?

— বাহার।

— মারা গেছে কবে?

— মেলা দিন, ভাবির বয়স এক দুই হতে পারে।

— মরছে কিভাবে?

— তা তো জানি না। তবে আপনাদের ইটের ভাটার লেবার ছিল। কাজের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। আর ফেরেনি।

শাহবাজের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হলো। আয়নামতির বয়স এক দুই হলে সেই হিসেবে ইটের ভাটার দায়িত্ব ছিল ছোট চাচার। বাবার মৃত্যুর পরে সে’ই সব দেখেছে। অবশ্য বেশি দিন না। বছর পাঁচেকের মতো হতে পারে। তার পর সব কিছুতে ভাই ঢুকে গেছে। অবশ্য ঢোকার আগে কেউ জানে না, জ্বলন্ত চিতার এক তান্ডব সে করেছিল। সেই দিন রাতে ডাকাতেরা পালিয়ে যেতে পেরেছিল মাত্র তিন চারজন। বাকি সবাই ছিল সারেং বাড়িতে। অবশ্য লাশ হয়ে। লাশ হলেও মুখতো না চেনার কিছু নেই। জ্ঞান ফিরতেই এক, এক করে সবার মুখ দেখেছিল সে। একটাও লাশ দাফন করতে দেয়নি । নিজের হাতে ইটের চুলায় জ্বালিয়েছে। শুধু কি তাদের? খুঁজে খুঁজে প্রত্যেকের পরিবারকে বের করেছে। তার এক কথা, এরা তার পুরো পরিবার শেষ করেছে। সেও করবে। এই পাঁচ বছরে এই গ্রাম, ঐ গ্রাম থেকে অনেকেই গায়েব হয়েছে। সবাই সব বুঝে, অনুমান করতে পারে তবে প্রমাণ বা কিছু বলার সাহস ছিটেফোঁটাও নেই। না থাকলেও গ্রামে ইটের চুলা নিয়ে সবার মাঝে আতঙ্ক আছে। শাহবাজ কেন? সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষ’ই জানে। অবশ্য কারো কিছু যায় আসে না।

তবে কি আয়নার বাবা, মা সেই পরিবারের মধ্যে থেকে কেউ। না হওয়ার চান্স’ই অবশ্য বেশি। কেননা যদি হতো আয়না তো ভালোই তার চাচা,চাচি, দাদি কাওকেই ভাই এখনো আস্ত রাখতো না। ইটের চুলায় ছাই ঠিক হয়ে যেত। তাহলে? সামান্য ইটের ভাটার লেবার। তাকে মেরে গুম করে কার কি লাভ?

শাহবাজ ভাবতে ভাবতে’ই উঠল! উঠতেই কালাম বললো, — কোথায় যান?

— তোকে বলতে হবে?

— রাতে এরশাদ ভাই বেরুতে মানা করছে।

— মানা করলে থাক। আমি কি তোকে ঘাড়ে করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি নাকি?

কালাম সেই কথায় আর গেলো না। অবশ্য বলে লাভও নেই। এই নাক বরাবর হাঁটা মানুষ। তাই অন্য ভাবে বললো, — আজ না আপনার বাসর রাত? বাসর রাত হলো কাল রাত। আযানের আগে বের হতে নাই। ভেতরে যান।

বাসরের কথা মনে হতেই আয়নার মুখ সামনে ভাসলো। ভাসলো তার সাথে অন্য কিছুও। আর ভাসতে’ই শাহবাজের ঝিমিয়ে যাওয়া রাগ তরতর করে আবার বাড়তে লাগলো। সেই রাগ নিয়েই নদীর ঘাটের দিকে যেতে যেতে বললো, — সকালে সদর থেকে ডাক্তার আনবি। সেলাইতে ঘষা লেখেছে। ব্যান্ডেজ বদলাতে হবে।

— কার?

শাহবাজ হেসে ফেললো। কার মানে? বাড়িতে মানুষ কয়জন, মাথা ফাটছে কতোজনের? সে রাগে, এতো এতো চিন্তা ভাবনায় খেয়াল করলো না, তার নিজের মাথাও ফাটা। তো কার উদ্দেশ্য বলছে কালাম বুঝবে কিভাবে?

তার কি আর এতো কিছু ভাবার সময় আছে? রাগ উঠলে সে চোখে দেখে না। তাই আবার ফিরে এলো। এসে স্বাভাবিক ভাবেই ধুম করে নাক বরাবর মারলো এক ঘুসি। মেরে বললো, — তোর! এই যে দেখ ফাটা। এখন এই নাকে ব্যান্ডেজ করবি। করে আবার সদর থেকে ডাক্তার এনে বদলাবি। বলেই আবার আগের মতোই নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলো।

কালাম নাকে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নাকে থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আম্বিয়া দেখে বললো, — সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? শাহবাজ কই?

— চলে গেছে।

— চলে গেছে মানে?

কালাম নির্বিকার চিত্তেই বললো, — নাক ফাটিয়ে, ডাক্তার আনতে বলছে।

আম্বিয়া বিরক্তমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিল। জ্বালা যন্ত্রনা আর ভালো লাগে না। সবাই সব কিছু তার ঘাড়ে ফেলে আরামছে নিরুদ্দেশ হয়।

আজ পৃথিলার জীবনের এক নতুন সকাল। অবশ্য এই নতুন শুধু শিক্ষকতার জন্য নয়, বলা যায় জীবনে নিজের মতো করে প্রথম কিছু করার।

বিয়েটা করেছিল লেখাপড়ার মাঝামাঝি। তবে তারেক লেখাপড়াটা বন্ধ করতে দেয়নি বরং হাসিমুখে বলেছিল, – “নতুন চাকরি, অনেক খাটতে হবে। ওতো সময় হয়তো তোমাকে দিতে পারবো না। একা থাকতে থাকতে এক ঘেয়ে লেগে যাবে। তার চেয়ে ভালো পড়ালেখাটা চালিয়ে যাও। সময়ও কেটে যাবে, লেখাপড়াটাও শেষ হবে।

পৃথিলাও অমত করেনি। কথা সত্য! দিন ভরে একা একা ফ্ল্যাটে করবে টা কি? ভাগ্যিস করেছিল। তা না হলে এখন কি করতো?

তবে দিন গুলো ছিল রঙিন। সকালবেলা দু’জনে একসাথে নাস্তা করত। তারপর যার যার পথে বেরিয়ে যেত। দুপুরে পৃথিলা ফিরতো, সন্ধ্যায় তারেক। তার ফেরার আগেই সব গুছিয়ে রাখতো। নিজ হাতে রান্না করতো, ঘর গোছাতো। তারেক ফিরলে বারান্দায় চায়ের কাপ নিয়ে দু’জনে বসতো। সময়গুলো বলতে গেলে একরকম স্বপ্নের মতো কেটেছিল। কে জানতো, সেই স্বপ্নই একদিন হয়ে উঠবে ফেলে আসা দিনের দুঃস্বপ্ন। যেই দুঃস্বপ্ন গুলো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। খায় বলেই মুছে ফেলার কতো তাড়া।

পৃথিলা তার প্রথম ক্লাস নিলো খুব যত্ন, আদর মেখে। গুছিয়ে বলা, কোমল স্বরে বোঝানো সব মিলিয়ে প্রথম দিনেই সে ছাত্র – ছাত্রীদের মনে নিজের একটা সুন্দর জায়গা করে নিলো।

নেওয়ার অবশ্য কারণ আছে। স্কুলে সে একমাত্র নারী শিক্ষিকা। ছেলেরা প্রথমে একটু লজ্জায় পড়লেও, মেয়েরা একদিনেই আপন করে নিলো। আসলে পৃথিলার কথা বলার ভঙ্গিই এমন। ধীর, মায়া, যত্ন,আদর মাখানো। যেন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেন সে নিজেদের কেউ।

পৃথিলার বেড়ে ওঠা শহরে শহরে হলেও, শহরের মেয়েদের মতো হাবভাব তার মধ্যে নেই। অবশ্য এর পুরো কৃত্বিত্ব তার মাকে দেওয়া যায়। তিনি পৃথিলাকে বড় করেছেন একটা খোলসের ভেতরে। আর করেছেন বলেই হয়ত পৃথিলা এমন। আবার হয়ত তার স্বভাব’ই এমন।

তা না হলেও এই যে মাটির গন্ধ, সবুজ ধানক্ষেত, এই যে স্কুলের কোণে বিশাল বট বৃক্ষ। এগুলো তাকে এতো টানে কেন? এই যে বাতাসে মাতাল করা ঘ্রাণ তাতে নেশা হয় কেন? পৃথিলা জানে না! শুধু জানে হৃদয়ের এই যে এতো কিছুু, এতো ক্ষত। এই সবকিছুতেই এই গ্রামের মন মাতানো প্রকৃতি যত্ন করে ধীরে ধীরে প্রলেপ এঁকে দিচ্ছে।

তখনি টিফিনের ঘন্টা পড়ল। সাদা- আকাশি নীল সুতির শাড়িতে, চোখে-মুখে প্রশান্তি নিয়ে পৃথিলা স্কুলের চত্বরে পা রাখলো। ছেলে মেয়েদের হুটোপুঁটি, মাঠে দৌড়ে কানামাছি খেলা, ঝালমুড়ির, আচারের দোকানে লাইন দেওয়া। পৃথিলার অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসিরা ছড়িয়ে গেলো। সেই ছড়িয়ে যাওয়া সুন্দর স্নিগ্ধ হাসির রেশ নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে তার চোখ পড়ল বীণার উপরে।

বীণা বসে আছে বটগাছের শিকড়ে। সাথে তার দুই বান্ধবী। হাতে ঝালমুড়ি আর আচার। তখনি বেণীতে টান পড়লো। বীণা চোখ, মুখ কুঁচকে পেছন ফিরে তাকালো।

তাকাতেই রাজিব এক মুঠো বকুল ফুল ছুড়ে মারলো। তাদের ঝালমুড়ি, আচার তাতে মাখামাখি হয়ে গেলো। রাজিব তাদের সহপাঠী। সব সময়’ই এমন জ্বালিয়ে খায়। তাই বীণা রাগ নিয়ে বললো, — তোর নামে সত্যিই বিচার দেবো।

— দে, দিলে আমিও বলে দেবো। টিফিনে ছুটি নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস। পাশের গ্রামের ভাঙা মন্দিরেও কে যেন গিয়েছিল। তোদের বাড়ির কেউ জানে?

বীণার রাগ হলো। তোকে তো আমি বলেই ঝালমুড়ি আর আচার মুড়িয়ে রাজিবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। রাজিব ফুরুৎ করে সাইড হয়ে গেলো। সে তো গেলো, তবে সাদা শার্ট পরনে ফরহাদের গায়ে ঠিক লেগে গেলো। আর লাগতেই থমকে দাঁড়ালো। সে মাত্রই বাসার উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো। জ্বরে নেই তবে রেশ কিছুটা আছে তাই হাফ করে ছুটি নিয়ে নিয়েছে।

আর নিয়ে যেতেই এই দশা। সে দাঁড়িয়ে একবার নিজের শার্ট আরেক বার বীণার দিকে তাকালো।

বীণা তো শেষ। ভয়ে চোখ, মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো। তখনি পৃথিলা এগিয়ে বীণার পাশে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে নম্রভাবে বললো, — মজার বয়স! মজা করতে গিয়ে লেগে গেছে। ক্ষমা করে দিন। বলেই বীণা, রাজিবের দিকে তাকিয়ে বললো, — তাড়াতাড়ি স্যারের কাছে ক্ষমা চাও।

বীণার সাহস হলো না, হাড়ে হাড়ে চিনে তো। রাজিবের আবার নতুন ম্যাডাম খুব পছন্দ হয়েছে। তাই পৃথিলা বলতেই নেচে নেচে এগিয়ে গেলো। গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই এক চটকানা তার গালে পড়ল।

পড়তে দেরি, গালে হাত রেখে দৌড় দিতে দেরি হয়নি। যমের গুরু এটা। বীণা যদি মুখ খুলে রেহাই থাকবে না। পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আগের মতোই বললো, — আপনার নিজের’ই এখনো অনেক কিছু শেখা বাকি। ছাত্র- ছাত্রীদের আর কি শেখাবেন। বলেই বীণার হাত ধরলো। ধরে বললো, — এসো, ভয় নেই।

বীণা কি করবে দিশা পেলো না। তবে পৃথিলার সাথে ঠিক গেলো। যেতে যেতেও একবার আড়চোখে ফরহাদের দিকে তাকালো। সে এখনো আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ গো, কালকে যে সকালে কি আছে একমাত্র সে’ই জানে।

চলবে……