#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_২৩
লাল বেনারসি শাড়িতে বীণা। আঁচলটা কাঁধ গড়িয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঘোমটা টা যেন বড় অবহেলায় কোন রকম মাথায় ঝুলে আছে। সেই ঝুলে থাকা ঘোমটা টানা মুখটা ম্লান, থমথমে। হাত ভর্তি লাল রেশমি চুড়ি। সেই চুড়ি মাখানো হাতে বড় শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরা বই, খাতা। সেই বই, খাতা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, এই যে মখমলের মতো কোমল নরম সবুজ ঘাসের উপরে মাখন রঙের স্কুলটা, তার মাঠের এক প্রান্তে । ঘন্টা পড়বে পড়বে করছে।
তখনি বীণার তনু হালকা কেঁপে উঠল। মনে পড়লো ক্লাসে যেতে হবে, কতো পড়া বাকি, পরীক্ষার ও তো সময় নেই বেশি। সে দিক বেদিক ভুলে দৌড় দিতে গেলো, কিন্তু পা আটকে গেলো কোথায় যেন। টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে গেলো মাটিতে। বই, খাতা ছড়িয়ে গেলো সবুজ ঘাসের বুকে।
বীণা চিন্তিত ভাবে পেছন ফিরে তাকায়! পায়ের গোড়ালিতে জড়ানো লোহার মোটা শেকল। ভয়ে আতঙ্কে বীণার গলা শুকিয়ে আসে। আসতেই ঝটপট দু’হাতে তা খোলার চেষ্টা করে। তার ভেতর ছটফট করে উঠে, কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে পারে না। হঠাৎ স্কুলঘণ্টা বেজে উঠল। বীণা ছলছল চোখে স্কুলের দিকে তাকালো। তাকিয়ে আর্তনাদ করে বলে উঠে , ” কেউ আসো! কেউ আমার পায়ের শেকলটা খোলো!”
কিন্তু সেই চিৎকার যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। চারপাশে অসংখ্য মানুষ, ছেলে-মেয়ে, শিক্ষক, পরিচিত মুখ কেউই এগিয়ে আসে না। সবার চোখ ফাঁকা, নির্বাক। কেউ যেন তাকে দেখতেই পাচ্ছে না।
বীণার ছটফট বাড়ে, গলায় শুকিয়ে আসে। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে একসময় ফট করে চোখ খুলে ফেলে। আর খুলতেই দেখে, আয়না চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে।
আয়না কালকে আর উপরে যায়নি। শয়তানটা নেমেছিল খাবারের সময়। আয়না আর ও মুখো হয়’ইনি। বীণা রুমে ছিল, বীণার সাথেই ঘুমিয়েছে। দাদি অবশ্য একটু গজগজ করেছে। গজগজ করতে করতে বলেছে, ” নয়া বউ জামাই রেখে অন্য ঘরে থাকবো ক্যা? এমনিতে’ই তার নাতি বাড়িত থাকে না। বউ মানুষ আঁচল দিয়া বাঁধবো তা না, নিজের’ই মন উড়ুউড়ু। ”
অবশ্য সেই পর্যন্ত’ই! হয়তো বীণার কথা ভেবে আর বেশি কিছু বলেনি। অন্য কেউও বলেনি। সে তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। যাক বাবা, এক রাত অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে।
বীণা ধীরে ধীরে উঠে বসল। ঘুম আর স্বপ্নের মাঝের সীমারেখাটা যেন তখনো স্পষ্ট হয়নি। ভেতরটা ধড়ফড় করছে এখনো। সে উঠে বসতে বসতে বললো, — খারাপ স্বপ্ন দেখেছি ভাবি।
আয়না না বললেও বুঝতো। ঘুমের মধ্যে’ই কেমন ছটফট করছিল। তাই সে কিছু না বলেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে এগিয়ে টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে বীণার সামনে ধরলো। ধরে তার নরম সুরে বললো, — তোমার লেখাপড়ার খুব শখ না?
বীণা পানির গ্লাস হাতে নিলো। নিয়ে একটু খেয়ে বললো, — হুম। তোমার ইচ্ছে করেনি?
আয়না দু’পাশে মাথা নাড়লো। সে ফাইভ পর্যন্তই পড়েছে বলতে গেলে কোন রকম। প্রতিদিন নিয়ম করে যাও, নিয়ম করে পড়তে বসো। এর চেয়ে ধান শুকানো সহজ, রান্না করা সহজ, কাপড় কাচা সহজ। বাড়িতেও তেমন কোন চাপ ছিল না। চাপও নেই, টাকাও নেই, নিজের আগ্রহও নেই। তাই বন্ধ হওয়ায় তেমন কোন দুঃখও নেই।
বীণা আরেকটু পানি খেয়ে চুপচাপ বসলো! নিজেকে সামনে নিলো। নিলেও জানে এই স্বপ্নের রেশ তার পিছু ছাড়বে না।
আয়না উঠে জানালার কপাট খুলে দিলো। দিতেই রঙ বেরঙের রুমটা ঝলমল করে উঠল। বীণার রুমটা সুন্দর। একেবারে স্বপ্নের পরীর রাজ্যের মতো। সে খুলে বললো, — আমার বড় মা বলে ভোরের খোয়াব সত্য হয়। তবে ফজরের আজানের পরে শয়তানের ভেলকি।
বীণা মলিন ভাবে হাসলো! হেসে ঘড়ির দিকে তাকালো। অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। সারারাত ঘুমাতেই পারে নি। চোখ লেগেছে শেষ রাতে। তাই হয়তো ঘুম ভাঙেনি। তা না হলে ভোরে উঠে পড়ার অভ্যাস তার আছে । সে সাইডে গ্লাস রাখতে রাখতে বললো, — শাহবাজ ভাইয়ের দু’চোখের দুশমন লেখাপড়া। অথচ তার সব সুযোগ ছিল। তবে এরশাদ ভাই, সে কিন্তু এই যে ঠিক আমার মতো। ভাইও কোন ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি। তবে পরিস্থিতি তাকে পড়তে দেয়নি। যা আমাদের হবে না, আল্লাহ সেই জিনিসের প্রতি আজন্মের এক তৃষ্ণা দিয়ে দেয়। আমার এই তৃষ্ণা’ই আমার শত্রু।
আয়না তাকিয়ে রইল, এতো ভারী ভারী কথা তার বোঝার কথা না। তার জীবন এতো বছর ছিল দিঘির পানির মতো একরকম। স্বচ্ছ, স্থির! আর এখন? আয়না আবার জানালার দিকে তাকালো। বাইরে সকালের রোদ ঝিলমিল করছে। সেই ঝিলমিল করা রোদে দিকে তাকিয়ে হিসেব করার চেষ্টা করে। ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়া কি এর চেয়ে সহজ ছিল না?
বীণা আর কিছু বলে না। গায়ের রং না দিলেও মাথা ভর্তি কোমর সমান চুল তার। যেমন ঘন, তেমনি কালো দীর্ঘ। সেই চুল’ই টেনে হাত খোঁপা করলো। করে খাট থেকে নামলো। হাত, মুখ ধুতে হবে। ফরহাদ ভাই আসার সময় হয়ে গেছে। নাকি আসবেনা? কি জানি? তার সব কিছু এতো অসহ্য লাগছে কেন?
ফরহাদ এলো তার ঠিক সময়েই। আজও জয়তুন তাকে ডাকলো, সে দেখেও দেখলো না। বরং খুব স্বাভাবিক ভাবেই বীণার রুমে ঢুকে গেলো। আর এসে স্বাভাবিক ভাবে’ই বসলো। বীণার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে এমন কোন লক্ষণ তার মধ্যে দেখা গেলো না। বরং তার হাতে একটা ব্যাগ, বীণা আগেই বসে ছিল। টেবিলের উপরে রেখে হালকা ঠেলে বীণার দিকে দিলো।
বীণার মন, মেজাজ সব খারাপ। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আরো ভয়ংকর খারাপ। সকালে না খেয়েছে খাবার, আর আয়না ছাড়া বলেছে না কারো সাথে কথা। কান্না, সারা রাত না ঘুমানোর জন্য চোখ, নাক, মুখ ফুলে আছে। সে ফোলা ফোলা চোখেই বিরক্ত নিয়ে তাকালো।
ফরহাদ অবশ্য ফিরেও তাকালো না। আজকে প্রচুর গরম। নীল রঙা শার্ট ঘামে গায়ে লেপ্টে আছে। সেই লেপটে যাওয়া শার্টের কলার পেছনে ঠেলে পানির জগ টেনে নিতে নিতে বললো, — ঘুটা দিয়ে চোখের গুটি বের করে ফেলবো ফাজিল। এভাবে ডাইনির মতো তাকিয়ে আছিস কেন? যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবি।
বীণা চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে ব্যাগ টেনে উঁকি দিয়ে দেখলো। কালকের শার্ট! আচার, ঝালমুড়িতে মাখামাখি হয়ে আছে। সে বড় একটা শ্বাস ফেললো। মনে মনে বললো, — আল্লাহ ধৈর্য্য দাও।
ফরহাদ পানির জগ রেখে বলল,– যদি শুনি কাজের লোকের কাছে দিয়েছিস। চামড়া তুলে নেবো। আর একটু দাগও যদি থাকে। টিফিনে নাকি কোথায় কোথায় যাস? জয়তুন আরা তো জানে না, কি পক্ষীকে খোলা ছেড়ে রেখেছে। তাই চিন্তা করিস না, আমি নিজ দায়িত্বে জানাবো।
বীণা কোন উত্তর করলো না। ব্যাগ নিয়ে সাইডে রাখলো। রেখে বই টেনে নিলো। কালকের কোন পড়াই পড়া হয়নি। অবশ্য পড়েই কোন লাভ। তাই বই খুলতে খুলতে মুখ ফুলিয়ে বললো, — কালকে আজিজ চাচা এসেছিল।
— তো?
— উনি আপনার আর আমার বিয়ের কথা বলেছে।
— তো?
বীণা চোখের মুখে বিরক্ত, আগুনে পরিণত হলো। সেই আগুন নিয়েই বললো, — তো, তো করছেন কেন? ছাত্রী আমি আপনার। ছাত্রীকে বিয়ে করবেন? তাছাড়া আপনাকে আমার পছন্দ না।
বীণা কথা শেষ করে নিশ্বাসও ফেলতে পারলো না। পরপর কয়েকটা খাতার বাড়ি মাথায় পড়লো। বীণা দাঁতে দাঁত চেপে বসলো। ফরহাদ তার মতোই বললো, — পড়ার সময় কোন হাবিজাবি কথা না। একদম না! আগেই বলেছি না।
বীণা আজ ভয় পেলো না। হজমও করলো না। তার সব ধৈর্য্য, সব হজম একমাত্র ছিল লেখাপড়ার জন্য। তো? পড়ালেখাই নেই, কিসের হজম? তাই আগের মতোই আগুন চোখে তাকালো, তেজ নিয়ে বললো, — একশো বার বললো। কি করবেন? মারবেন, মারেন। মারা ছাড়া পারেন কি?
ফরহাদ দু’সেকেন্ডের জন্য থামলো। অবাক হলো, কি না হলো, অবশ্য বোঝা গেলো না। তবে একটু হাসলো। হেসে বললো, — এই না হলো জয়তুনের নাতনী। স্বার্থে আঘাত লাগতে না লাগতেই ফণা তুলে ফেলেছে।
বীণা রাগে ফুসলো! ফরহাদ হাতের খাতাটা ইচ্ছে মতো মোড়ালো। মোড়াতে মোড়াতে বললো, — চোখ নামা বীণা।
— না।
— মেরে ভর্তা করে ফেলবো বলে দিলাম।
— আমি আর আপনার ছাত্রী না। এখন যান, যা খুশি করেন।
ফরহাদ হাতের খাতাটা রাখলো। রাখতে রাখতে খেয়াল করলো, আসলে এই ফাজিলের বেয়াদবিতে যতোটা রাগ হওয়ার কথা, ততোটা রাগ আসলে আজ আসছে না। তাই আবারো হাসলো! তার আর বীণার চেয়ারের মাঝে সবসময় অনেকটা ফারাক থাকে। আজ নিজেই এগিয়ে সেইটুকু মেটালো। মিটিয়ে বললো, — যা খুশি করলে তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না রে পুচকি। আর ফরহাদ কে পছন্দ করার লায়েক হতে তোর সাধনা করা লাগবে। তাই বিষ ছাড়া বিচ্ছু, ফুসফুস বন্ধ কর। পনেরো মিনিট সময় দিলাম। কি বলবি বল।
বীণা শরীরে আগুন জ্বললো, তবে শক্ত হয়ে সোজা বসে রইল। ফরহাদ ভাইকে কখনো অন্য কোন নজরে দেখা তো দূরের ভাবেওনি। তবে আজ এতো পাশে বসায়, কোথায় যেন একটু অন্য রকম লাগলো। আর লাগলো বলেই একটা শব্দও আর উচ্চারণ করতে পারলো না। আগের মতো শক্ত হয়ে’ই সোজা চুপচাপ বসে রইল।
ফরহাদও এক দৃষ্টিতে চোখ, মুখ শক্ত করে বসা বীণার দিকে তাকিয়ে রইল। পনেরো মিনিট হতেই আবার পিছিয়ে জায়গা মতো বসলো। বসতে বসতে বললো, — আমার সাথে তেজ না দেখিয়ে বাড়ির মানুষের সাথে দেখা। অবশ্য কোন লাভ হবে না। নয় ফরহাদ, নয় অন্য কেউ। পরীক্ষা তোর কপালে নেই।
বীণা এবার ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো! জানা কথা, সে বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারে না। কাঁদতে কাঁদতেই বললো, — ফরহাদ ভাই, আমি পরীক্ষা দিতে চাই, পড়তে চাই।
বীণা কখনো ফরহাদ কে ভাই ডাকে না। অন্তত ফরহাদের সামনে না। হাই স্কুলে গিয়েছে পর থেকে দেখেছে স্যার। বীণাকে পড়ানোর আগে এই বাড়িতে এতো আসা যাওয়াও হতো না। তাই যতোটুকু দেখা হয়েছে, স্যার হিসেবেই ডেকেছে। আজ কি বলছে না বলছে হয়তো খেয়ালও নেই।
আর নেই বলেই ফরহাদ নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, — নিজের কাজ নিজের করতে হয়। তাই এই মরা কান্না আমার সামনে কেঁদে লাভ নেই। পড়বি নাকি বল, তা না হলে চলে যাই। এতো ঢং তো ভালো লাগে না। এতোক্ষণ সহ্য করলাম, এই তো কতো।
বীণা আর কিছু বললো না। তবে উঠে গেলো। যাওয়ার আগে তার আচার ঝালমুড়ি মাখা শার্টের ব্যাগ দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে ছুড়ে খাটে ফেলে গেলো।
ফরহাদ চুপচাপ’ই দেখলো! দেখে হাই তুলে বললো, — জমা রইল।
পৃথিলা বাড়ি থেকে বের হতেই দেখল, ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানের এক পাশে চোখ, মুখ অন্ধকার করে বীণা বসে আছে। গায়ে নীল সাদা স্কুলের ড্রেস, এলোমেলো বেনি। মুখটা আজ একটু অন্য রকম। সে বীণা আর ভ্যান, দুটো’ই অবাক চোখে দেখলো।
সাবিহা রান্না বসিয়েছে। চুলার জাল টেনে, আধখোলা খোঁপাটা খুলে আবার করতে করতে বেরিয়ে বললো, — এটা বীণার ভ্যান। ওকেই স্কুলে নিয়ে যায় নিয়ে আসে। এরশাদ ভাই বললো তোকেও প্রতিদিন নিয়ে যাবে।
পৃথিলা অবাক হয়েই বললো, — এসবের কোন প্রয়োজন নেই। এর পর থেকে আমি নিজেই সামলে থাকবো।
— সেটা থাকবি ভালো কথা। গেলে সমস্যা কি?
এমন তো না, শুধু তোর জন্য ব্যবস্থা করেছে। আগের’ই ছিল। এখন তুইও যাবি। তাছাড়া বীণাতো একাই যায়।
— তবুও, এমনিতেই অনেকটা ঋণ জমা হয়ে আছে। আর বাড়াতে চাচ্ছি না।
— কোন ঋণটিন নেই। তোর যতো বেশি ভাবনা। তাছাড়া মাস শেষ হলে এরশাদ ভাইয়েরা যা দেয়, তুইও অর্ধেক দিয়ে দিবি। ব্যস! ঝামেলা খতম।
এবারের কথা পৃথিলার পছন্দ হলো। তাছাড়া সে আর জড়াতে চাইছে না। কিছু কিছু জিনিস আছে মেয়েরা আগেই অনুমান করতে পারে। তার ধারণা অবশ্য ভুলও হতে পারে। ঘর পোড়া গরু সে, সিঁদুরে মেঘ দেখলেও আঁতকে উঠতে হয় । তাছাড়া এরশাদ লোকটার তাকানো, কথায় কিছু একটা আছে। এতোদিন মনে না হলেও, কেন জানি এখন মনে হচ্ছে। যাইহোক, ভুল হোক ঠিক আগেই দূরে থাকা ভালো।
তাই সাবিহাকে বিদায় দিয়ে বীণার পাশে উঠে বসলো। বসতে বসতে বীণার দিকে একবার তাকালো। মেয়েটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। কিছু কি হয়েছে?
ভ্যান নিজের মতো এগুলো। সবুজ ধান ক্ষেত, আঁকা বাঁকা মেঠো পথে নিজ ছন্দে এগিয়ে গেলো। বীণা একটা শব্দও বললো না। পৃথিলা একটু অবাক’ই হলো। মেয়েটা এমন না। মিশুক! কোন কিছু নিশ্চয়’ই একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। হাজার মানুষ থাক, বাবা- মা নেই। আছে এমন একটা বয়সে। চাইলেই সবার কাছে সবকিছু বলা যায় না। পৃথিলা একবার ভ্যান ওয়ালার দিকে তাকালো। সে নিজের মতোই ভ্যান টেনে নিচ্ছে। তবুও ফিসফিস করে বললেও কথা কানে যাবে। তাই ডেকে বললো, — ভাই ভ্যানটা কি একটু থামানো যাবে ?
ভ্যান সাথে সাথে’ই থেমে গেলো। থামতেই পৃথিলা তার কাঁধের ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে,এগিয়ে দিয়ে বললো, — পানি নিতে ভুলে গেছি। একটু পানির ব্যবস্থা করতে পারবেন? গরমে গলা শুকিয়ে আসছে।
লোকটা সাথে সাথেই বোতল টেনে নিলো। নিয়ে ঝট করে নেমে হন্তদন্ত হয়েই এগিয়ে গেলো। একটু দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। হয়ত সেখানেই যাবে।
পৃথিলা লোকটার হাবভাবেও অবাক হলো! এতো হন্তদন্তেরও কিছু ছিল না। পানি সে এমনিতেই নেয় নি। ব্যাগে কাগজ, বই আছে। যদি পানিতে নষ্ট হয়। তাই ভেবেছে স্কুলের টিউবওয়েল থেকে নেবে। সে চোখ ফিরিয়ে বীণার দিকে তাকিয়ে বললো, — কোন সমস্যা বীণা?
বীণা উত্তর দিলো না। চোখ তুলে তাকালোও না। মাথা নত করেই দু,পাশে মাথা নাড়লো।
পৃথিলা হাসলো! মমতা মাখা, মায়াময় হাসি। হেসে এগিয়ে, মুখের সামনের গড়িয়ে পড়া এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, — আমি জানি, আমি মনের কথা জমা রাখার মতো কেউ না, বলার মতোও কেউ না। বা বললেও কিছু করতে পারব এমনও কেউ না। তবে কি জানো? কথা ভেতরে জমিয়ে রাখার চেয়ে, কারো কাছে বললে বোঝা কমে। এই যে, যে কষ্ট জমাট বেঁধে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছো সেটা হালকা হবে। ইচ্ছে না হলে বলার দরকার নেই, তবে যদি এই, এই একটুও মনে হয় বলা যায়, তাহলে নিশ্চিন্তে বলতে পারো।
বীণা হঠাৎ করেই এক কাজ করে ফেললো। পৃথিলার গলা জড়িয়ে ধরলো, শক্ত করে। যেন কতো আপন কেউ। ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো। পৃথিলা প্রথমে একটু থমকালো। তবে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো। নিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দিতেই বীণা ধীরে ধীরে সব বললো। পৃথিলা কোন টুু শব্দ করলো না। নিশ্চুপ শুনলো। শুনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আহা! এই পৃথিবীতে স্বপ্ন ভাঙার চেয়ে বড় কষ্ট আর কি আছে?
স্কুলে আসতেই পৃথিলা আগে ভ্যান থেকে নামলো। নেমে নিজেই ধরে বীণাকে নামালো। গলার ওড়নাটা গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, — বিয়ের জন্যতো এখনো হ্যাঁ বলেনি। তাই অযথা কোন চিন্তা করো না।
— বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলুক আর না বলুক। আমার পরীক্ষা আর দেওয়া হবে না।
— কেন?
— দাদির মাথায় একবার এসেছে না, এখন কারো কথা শুনবে না।
— তোমার ভাইয়েরা বা চাচা। কাওকে বোঝাতে পারবে না?
তখনি ফট করে বীণার, ফরহাদের বলা সেই দিনের কথা মনে পড়লো। ছোট চাচা! অবশ্য মনে পড়েও খুব একটা ভরসা পেলো না। দাদি মরে যাবে তাও হেরে যাবে না। সেখানে যে’ই হোক। তার মুখের কথা থেকে সরে যাওয়া মানেই, তার কাছে হেরে যাওয়া।
পৃথিলা বীণার নিস্তেজ হওয়া মুখটা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দেখলো। পরীক্ষার খুব একটা দেরি নেই। এই মাস খানেক। প্রি টেস্ট পরীক্ষায় মেয়েটা খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। বোর্ড পরীক্ষায় ও যে করবে তাতে কোন ভুল নেই। আবারো বড় একটা শ্বাস ফেলে বললো, — যাও, ক্লাসে যাও। মন খারাপ করে কখনোও কিছু হয় না। তাই যেটুকু সময় পাও প্রাণ খুলেই বাঁচো।
বীণা চলে গেলো। পৃথিলার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেলো। না মেয়েটা ভালো ছাত্রী এজন্য না। ভালো ছাত্রী অনেকেই হয়। লেখাপড়া অনেকেই করে। তবে লেখাপড়াকে সবাই ভালোবাসতে পারে না। এই মেয়েটা ভালোবাসে। আর এইরকম ভালোবাসার মানুষগুলো, সব সময় এমন এমন জায়গায় জন্মে। এই ভালোবাসার লেখাপড়াটুকু করতে তাদের যুদ্ধ করতে হয়।
পৃথিলা নিজেও এগিয়ে গেলো। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেছে। তাই যেতেই ঘন্টা পড়ল। পড়তেই শিক্ষকদের খাতায় সাইন করে নিজের ক্লাসে গেলো। ক্লাসে সে মন দিতে পারলো না। বার বার বীণার মুখটা ভেসে উঠল। আর উঠল বলেই, মনের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রইল। অবশ্য ভেতরে, উপরে সব সময়ের শান্ত, কোমল, নির্জীব।
টিফিনের ঘন্টা পড়তেই পৃথিলা টিচার্স রুমে এসে বসলো। স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে টিচার্স খুব কম। তবুও যেই কয়জন আছে, কয়েকজন বাড়ি আশে পাশে হওয়ায় বাড়িতেই যায়। তার মধ্যে এক দু’জন জন যা থাকে একসাথে এখানেই বসে। তাই পৃথিলাও বসলো। বসে এক নজর ফরহাদের দিকে তাকালো। সে অবশ্য এখানে বসে নি। বসেছে একটু সাইডে, নিজের মতো করে । হাতে আজকের পত্রিকা। পত্রিকা পড়ছে তাও চোখ, মুখ কুঁচকে। আশ্চর্য! দুনিয়ার সব কিছুতে এতো বিরক্ত আসে কোথা থেকে?
পৃথিলা উঠে এগিয়ে গেলো। অবশ্য উঠে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। লোকটা কোন কারণে মেয়েদের দেখতে পারে না। তবে বাবার প্রতি খুব দুর্বল। তাই বিয়ে নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও, বাবার বিয়ে নিয়ে মাতামাতিতে নাকও গলায় না। এমন ভাব যা খুশি করুক, তারা ভালো থাকলেই হলো। বাবা- মায়ের বাধ্য সন্তান। জাফর চাচা লোকটাকে এজন্যই কি খুব ভালো বলে, নাকি আসলেই ভালো। শুধু উপরে নিজেকে শক্ত খোসলে ঢেকে রাখে।
পৃথিলা ফরহাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েই থমকে গেলো। না ফরহাদের কোন কারণে না। ফরহাদ পত্রিকা মেলে নিজের মতো বসে আছে। সেই পত্রিকায় মাঝ বরাবর বড় করে তারেকের ছবি দেওয়া। সেই ছবির এক কোণে ছোট্ট একটা বিভৎস লাশের ছবি। এই ছবির উপরে মোটা করে লেখা। অফিসের সিনিয়র ম্যাডামের সাথে পরকীয়া। নিজ ফ্ল্যাটে খুন।
পৃথিলার মাথা এক চক্কর দিলো। দিতেই ফরহাদের বসা চেয়ার আঁকড়ে ধরতে চাইলো। অবশ্য লাভ হলো না। ধরার আগেই ফরহাদের পায়ের কাছেই গড়িয়ে পড়ল।
চলবে…….
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_২৪
পৃথিলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসলো। তার অবস্থা সেই আগের মতো’ই শান্ত, নিস্তব্ধ। ভেতরের ভাঙন সে কখনও প্রকাশ করতে পারে না। আজও পারলো না। যতো ভাঙে ততো শান্ত হয়। তবে শুষ্ক চোখ দুটোতে বিশাল এক শূণ্যতা। সেই শূণ্যতার গভীরতা বোঝার সাধ্য কারো নেই। সাধ্য নেই বোঝার ভেতরের এই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত ভেঙে গুড়ো গুড়ো হওয়া পৃথিলাকে।
তারেক যেমন থাক, তার সাথে একটা অধ্যায় তার ছিল। যেটা হাজার চেষ্টা করলেও পৃথিলার মুছে ফেলা সম্ভব না। যেটার শুরু হয়েছিল ভালোবাসার স্নিগ্ধ চাদরে আর শেষ কলুষিত ঘৃণায়। মানুষের রুপ বদলে যায়, কিন্তু এই যে হৃদয়, যাকে দিয়ে একবার ভালোবাসা হয়, সেই হৃদয় কি বদলানো যায়? যায় না। যায় না বলেই ঘৃণা করেছে, তবে মৃত্যু কামনা কখনোও করেনি।
ফরহাদ বিরক্ত নিয়ে আগের জায়গায় গেলো। পৃথিলা শূণ্য চোখেই তাকিয়ে দেখলো। সেও সব সময়ের মতো চোখ, মুখ কুঁচকে আছে। আর এই কুঁচকে যাওয়া মুখ যেন স্পষ্ট বলছে, ” মরার আর জায়গা পায় না, সব তার ঘাড়ের উপরেই। ”
পৃথিলা পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। এক চক্করে অন্ধকার দেখেছে । সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়েছে তাই তাল সামলাতে পারে নি। তবে এই যে বিরক্ত মুখের লোকটাই কিছুক্ষণ আগে সাহায্যের চূড়ান্ত করেছে। সাথে সাথে’ই ধরে তুলেছে। তুলে নিজের বোতল খুলে মাথায় পানি দিয়ে ফ্যানের নিচে বসিয়েছে। অবশ্য বলতে গেলে সবাই করেছে। একমাত্র নারী শিক্ষিকা, সবাই একটু অন্য চোখেই দেখে। তার মধ্যে শহরের। সবার ধারণা মমের গুড়িয়া টাইপ। তাই হয়তো গ্রামের কাঠফাটা দুপুরের গরমে মাথা চক্কর দিয়েছে। অথচ তাদের অজানা, ভাগ্যের নির্মম চাকায় পিষে পিষে ক্ষয় হয়ে ভেতরের সব নিঃশেষ হয়ে গেছে।
টিফিনের সময় শেষ। হেডস্যার পৃথিলাকে ছুটি দিলেন। আজ আর ক্লাস করার দরকার নেই। কিছুক্ষণ বসে আরাম করুক। তারপর ধীরে সুস্থে বাসায় যেতে বললেন।
সবাই যে যার ক্লাসে যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। তবে ফরহাদ আগের জায়গায় আগের মতোই বসলো। বসে সেই পত্রিকা আবার তুলে ধরলো। ধরে এক পলক পৃথিলার দিকে তাকিয়ে পত্রিকার দিকে তাকালো। এতো বড় দুনিয়া থাকতে তার ঘাড়ের উপরে এসে এমন কি হলো যে মাথা ঘুরে গেলো।
অসংখ্য নিউজের মাঝে এই পাতায় একটাই হাই লাইট করা। খুন,পরকীয়া। এসব নিউজ তাকে টানে না। বরং এক হিসেবে বলতে গেলে দেখলে গা জ্বালা করে। তার ধারণা এইসব পরকীয়া হয় সব মেয়েদের উসকানিতে। তাই হেডলাইন টুকু পড়ে বিস্তারিত কখনো পড়া হয় না। তবে আজ নিচে চোখ রাখলো।
” শহরের এক অভিজাত আবাসনের চতুর্থ তলায় পাওয়া গেল এক যুবকের রক্তাক্ত নিথর দেহ। নাম আবদুল তারেক। পেশায় একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছালে দেখে, ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে মৃতদেহ, চারপাশ রক্তে ভেসে গিয়েছে। পাশেই পড়ে ছিল এক ধারালো ছুরি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি ডিভোর্স হয় এক সিনিয়র মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে। অফিস মহলে বিষয়টি নিয়ে কম কানাঘুষো হয়নি। ডিভোর্সের কিছুদিনের মধ্যেই ঘটে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।
এই মুহূর্তে তদন্তের মূল সন্দেহভাজন হিসেবে উঠে এসেছে সেই সিনিয়র মহিলার স্বামীর নাম। তাঁকে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে, তদন্তে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় খুন হওয়া আবদুল তারেকের প্রাক্তন স্ত্রী নিখোঁজ। পুলিশ জানাচ্ছে, ডির্ভোসে পর থেকে তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মীয়স্বজনের কেউই জানে না তাঁর বর্তমান অবস্থান। তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ থাকতে পারে।
ঘটনাটি ঘিরে গোটা এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, খুনটি হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে বারবার ছুরির আঘাতে, যার থেকে পরিষ্কার রাগ ও প্রতিহিংসা ছিল গভীর।
ফরহাদ পত্রিকা থেকে চোখ না সরাতেই পৃথিলা শান্ত ভাবে বললো, — এখানে ডাকঘরটা কোথায়?
ফরহাদ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো! হেসে বললো, — ঢং বেশি হয়ে যাচ্ছে না।
— আমরা সবাই কিছু না কিছু বেশি করি। আমি হয়ত ঢংটাই বেশি করি।
— বুঝলাম, তবে সবাই বলতে কাকে বুঝালেন?
— আপনি বুদ্ধিমান মানুষ।
— সেটা তো দেখে আপনাকেও মনে হয়। তো টেনে ঘাড়ে ঝামেলা আনার মানে কি?
— আমি নিশ্চয়’ই খুনি না।
— তো কি দরকার অযথা ধোকাবাজদের জন্য ঝামেলায় জড়ানোর।
— তবুও, খোঁজা যেহেতু হচ্ছে। সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।
— বাবারে! বেগম রোকেয়া।
— হ্যাঁ! আপনার মতো সব দেখেও তো না দেখার ভান করে থাকতে পারি না।
ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পৃথিলা আর কিছু বললো না। তার গলা শুকিয়ে আসছে। সেই শুকনো গলায় ঢোক গিলে কাগজ কলম টেনে নিলো। তার হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। সেই কাঁপা কাঁপা হাতেই লিখলো। ঠিকানা দিলো। তার এখানে আসা, চাকরির ব্যাপারে যতোটুকু দরকার লিখলো। কবে নাগাদ ঢাকা যেতে হবে, সেটা যেন তাকে জানানো হয়, সেটাও লিখলো।
লিখে ভাঁজ করতেই দেখলো ফরহাদ আবার তার পাশে অবশ্য দূরত্ব রেখেই এসে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকেই পানির একটা গ্লাস হালকা ঠেলে এগিয়ে দিলো। পৃথিলা চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই ফরহাদ বললো, — চিঠিটা আমার কাছে দিন। ডাকঘর সদরে। এই অবস্থায় নিশ্চয়’ই সদরে যাবেন না।
— এতো সদয় হওয়ার কারণটা জানতে পারি?
— হ্যাঁ।
— কি?
— ভেবে দেখলাম সব ছেলেরা ধোয়া তুলসি পাতা না। আবার সব মেয়েরা কুচুরমুখিও না।
পৃথিলা মলিন ভাবে হাসলো! হেসে চিঠিটা বাড়িয়ে বললো, — ধোকাবাজের কোন জাত হয় না। সেটা মেয়ে হোক আর ছেলে।
পৃথিলাকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদও হালকা হাসলো। হেসে চিঠিটা নিয়ে বললো, — জেনে ভালো লাগলো। তবে বিশ্বাস করুন, খুনটা যে’ই করুক, করা আপনার দরকার ছিল।
— না! মৃত্যু কখনোও শাস্তির মধ্যে পড়ে না। মৃত্যু হচ্ছে সব কিছুর সমাপ্তি। সে বেঁচে থেকে যদি অনুতাপের আগুনে জ্বলতো। তাহলে সেটা হতো শাস্তি। আর তাছাড়া যে কোন অপরাধের শাস্তি নিজের হাতে নিতে নেই। তাহলে তার আর আমার মাঝে তফাত কি? সে নিকৃষ্ট, আমিও কেন সেই নিকৃষ্টের পথ বেছে নেবো। আইন আছে, উপরে আল্লাহ আছেন। আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও, উপরে যে আছেন তারটা কখনোও ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না।
— নীতি থাকা ভালো। তবে অতিনীতিবান হওয়া ভালো কথা না।
— আপনার কথা সত্য। তবে আপনিতো অতিনীতিবান না। আপনি ভালো আছেন?
— আমি সব সময়’ই ভালো থাকি।
— তাহলে কিসের এতো বিরক্ত?
— আপনার বুদ্ধি ভালো। এটা কি কেউ আপনাকে বলেছে?
— হ্যাঁ! আমার বাবা সব সময় বলতো।
— কথার মায়ায় সবাই ফেলতে পারে না। আপনি পারেন। ভালো ভাবেই পারেন।
— আপনাকে পেরেছি?
— না! তবে কারণটা অনুমান করে ফেলেছেন।
— করেছি যখন, আমি কি সহকর্মীর বাইরে গিয়ে একটা কথা বলতে পারি?
ফরহাদ ভাঁজ করা চিঠিটা পকেটে পুরলো। আগের রুপে ফিরে ক্লাসে যেতে যেতে সোজা বললো, — না।
পৃথিলা সেই যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই ভ্যানওয়ালা বারান্দায় থেকে উঁকি দিয়ে বললো, — আপা হেঁটে রাস্তা পর্যন্ত যাইতে পারবেন, না টেনে এখানেই আনবো?
পৃথিলা চমকে উঠল। উঠে আবাক হয়ে তাকালো। ভ্যানওয়ালা এখানে’ই বসে থাকে নাকি?
তার অবাক হওয়া দেখে ভ্যানওয়ালা তার পানখাওয়া ঠোঁটে হেসে বললো, — আমি ছুটির হওয়ার আগ পর্যন্ত আশে পাশেই থাকি আপা। এরশাদ ভাইয়ের হুকুম। তাছাড়া বীণা আপা মাঝে মাঝে টিফিনে বাড়িত যায় তো তাই।
পৃথিলা আর কিছু বললো না। মন মস্তিষ্ক সব এলোমেলো। তবুও আশে পাশে থাকা আর স্কুলের বারান্দায় থাকা এক কথা না। এটা কেন জানি মনে অন্য ভাবেই বাঁধলো। তাই আগের মতোই শান্ত ভাবে শুধু বললো, — আপনি যান, আমি একটু পরে আসছি।
ফরহাদ বেরুলো একেবারে ছুটির পরে। বাড়ির দিকে গেলো না, এলো সদরে। ডাকঘরের দিকে যাবে তখনি দেখলো, এরশাদ এগিয়ে আসছে। হাতে সব সময়ের মতো সিগারেট। অবশ্য মুঠোয়! খেয়াল না করলে ধরা যায় না। মুখটা দেখতে ভয়ংকর হলেও কাপড়, হাঁটা- চলা, কথায় সে পুরো দমে ভদ্র মহাসয়। তাই ভদ্র ভাবেই শান্ত প্রিয় হাসি নিয়ে এগিয়ে পাশে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে সিগারেট এগিয়ে দিলো।
ফরহাদ স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। সে সিগারেট খায় না। এরশাদ জানে, তবুও তাদের হিসেব আলাদা। তাই নিয়ে টান দিয়ে বললো, — এখানে কি?
এরশাদ তার স্বভাব মতো শান্ত ভাবেই বললো, — চিঠি।
ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো, — কিসের?
— যেটা তোর পকেটে।
— আমার পকেটের চিঠির সাথে তোর কাজ কি?
— বন্ধু তুই, তুই বল।
ফরহাদ কিছু বললো না। আগের মতোই ভ্রু কুঁচকে সিগারেটে টান দিলো। দিয়ে বললো, — ক্যাচালটা কিভাবে বাঁধলো।
এরশাদ ফরহাদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিলো। নিয়ে শেষ টান দিয়ে পায়ে পিষতে পিষতে বললো, — ব্যস, বেঁধে গেলো।
— কিভাবে?
— কি জানি?
ফরহাদ ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে পকেট থেকে চিঠি বের করতে করতে বললো, — মানুষ আর পেলিনা। পটাতে পটাতে থোবড়ানো চেহেরা বাকিটুকুও থুবড়ে যাবে।
এরশাদও হাসলো! হেসে চিঠিটা নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে করতে বললো — এই ক্ষমতা আছে বলেই তো, ক্যাচালটা বেঁধে গেলো।
— এখন?
— কি?
— সেটাই তো জানতে চাইছি।
— কোন কিছু নেই। সেধে এসেছে। বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়েছে। এখন প্রেমে পড়ে গেলে আমার কি দোষ?
— আগে থেকে চিনতি?
— না।
— তো?
— তো আবার কি?
ফরহাদ হো হো করে হাসলো! হাসতে হাসতে বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললো, — চারাগাছ যত্ন করলে অতি সহজেই ফুল ফোটে। তবে মরা গাছে সাধনা লাগে।
— আমার গাছ হলেই চলবে। ফুল লাগবে না।
— এই গাছও এতো সহজে হবে বলে মনে হয় না।
ভালোবেসে যারা ধোকা খায়। তারা সহজে আর এই পথে এগোয় না।
— দরকারও নেই। আমার ভালোবাসায় আমিই যথেষ্ট। তাছাড়া কে সেধে ভালোবাসবে আমায়?
— ভালোবাসা কখনো সৌন্দর্যে কিছু যায় আসে না। প্রমাণ তোর সামনে। ঠিক লাথি মেরে চলে গেছে। শালা, মেয়েজাত।
এবার এরশাদও হো হো করে হাসলো। হেসে বললো, — তুই এবার সত্যিই বিয়ে করছিস নাকি?
— হ্যাঁ।
— কেন?
— কোন কারণ নেই। বাবা চাইছে তাই।
— জেনে খুশি হলাম। তবে বোন আমার, সেটা যেন মাথায় থাকে। আমি বন্ধু হয়ে কিছুটা ছাড় দিলেও শাহবাজ মাথা ফাটাতে একবারও ভাববে না।
ফরহাদ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো! হেসে বললো, — নিজের চিন্তা কর।
— কেন?
— এ তোর হবে না।
— কেন, ভয়ংকর দেখতে বলে?
— না। অন্য কিছু। বাহ্যিক সৌন্দর্যে এই মেয়ের কিছু যাবে আসবে না।
— অন্য কিছুটা কি?
— আমি জানি না। কিছু কিছু মানুষ অন্য রকম হয়। তাদের ভেতরের গভীরতা কখনোও আঁচ করা যায় না। এই মেয়েটা ঠিক সেই রকম।
এরশাদ কিছু বললো না, তবে আগের মতোই হাসলো। হেসে ডাকঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ফরহাদ দেখে বললো, — সেখানে আবার কি?
এরশাদ এবারো উত্তর দিলো না। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আবার ধরালো। রাতে তার এমনিতেও ঘুম হয় না। যাও হয় শেষ রাতে। কিন্তু সমস্যা হলো সেই ঘুমটুকুও এখন হচ্ছে না।
সে ধরিয়ে পোস্ট মাস্টারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যাওয়ার কারণ, মিঠাপুকুর গ্রামে পৃথিলা নামের কোন মেয়ে আসেনি। এমনকি ঢাকা থেকে বা এখান থেকে যে কোন চিঠি, সেটা পৃথিলার হোক, তার ছোট চাচার হোক, হোক সাবিহার। সব যাবে আগে এরশাদের কাছে। কেননা পৃথিলা মিঠাপুকুরে এসেছেতো নিজের ইচ্ছায়, এখন যদি কখনোও বের হয় সেটা হবে এরশাদের ইচ্ছায়।
মোমেনা ভয়ে ভয়ে সারেং বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে একবার উঁকি ঝুঁকিও মারলো। এত বড় বাড়ি, এতো বড় মানুষের সামনে তারা ধুলিকণা। ভয় তো লাগবেই। তাছাড়া সে বউ মানুষ। কখনোও উঠান পেরিয়ে রাস্তায় নামা হয়নি। আর আজ কোথা থেকে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য তার শাশুড়ির বদলৌতে।
কেননা তার ছেলেকে তো আশে পাশে ঘেষতেও নিষেধ করেছে। তার মধ্যে তার শাশুড়ির আবার গোড়ালিতে বাতের ব্যথা। আগের মতো হাঁটতেও পারে না। তাই তাকেই ঠেলে পাঠালো। এখন সে কি করবে দিশে পাচ্ছে না।
মোমেনার এক হাতে নারিকেলের নাড়ু, গাছের কয়টা পেয়ারা। আয়না খুব পছন্দ করতো। তাই তার শাশুড়ি হাতে গুজে দিলো। সেই নাড়ু আর পেয়েরার ছোট্ট ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে, আরেক হাতে তার গায়ের মলিন কাপড়ের ছোট্ট আঁচলটা টেনে মুখ বরাবর আনলো। এনে অনেক সাহস জুগিয়ে আরেকটু এগুলো। দরজায় টোকা দেবে কি দেবেনা ভেবে পাচ্ছে না।
সন্ধ্যা নামো নামো করছে। আয়না এসেছে ছাদে, কাপড় তুলতে। অবশ্য একা না, সঙ্গে কাজের লোক আছে। কাপড় কাজের লোক তুললেও আয়না ঘুরে ঘুরে দেখছে। এত বড় বাড়ি এই এলাকায় কমই আছে। ছাদটাও কত বিশাল। আয়না উৎফুল্ল মনেই আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখল। আসার পর থেকে তো আর ঘর থেকে বের হয়নি, তাই উঁকি-ঝুঁকি দিয়েই দেখল।
কী বিশাল বাড়ি! কী সুন্দর নদীর ঘাট! ঘাট ছাড়াও পেছনে বিরাট পুকুর আছে। আগে এই পুকুরের পানিই গ্রামের মানুষ খেত, এখন টিউবওয়েল হয়েছে। তাছাড়া, আগে বাড়ি ছিল খোলা, এখন চার দেয়ালে আবদ্ধ।
আয়নার ঘোরা ফেরার মাঝেই সদর গেইটের দিকে নজর পড়ল। আর পড়তেই থমকে গেল। গেট বরাবর ছাদে গিয়েই ভালো করে তাকাল। বড় মা! বড় মা এসেছে তাকে দেখতে? আয়নার কিশোরী মন নেচে উঠল। উঠল বলেই স্থান-কাল সব ভুলে গেল, আর এক দৌড়ে ছুটল। সিঁড়ি দিয়ে নামল জলফড়িংয়ের মতো নেচে নেচে । সবুজ রঙের শাড়ির আঁচল মাথা থেকে হাওয়ায় লুটোপুটি খেল। পিঠ ছোঁয়া লালচে কালো মিশেলের চুলগুলো নদীর টেউয়ের মতো দোল খেতে লাগলো।
জয়তুন সব সময়ের মতো বসার ঘরেই বসা। তার সামনে দিয়ে বিনা অনুমতিতে আয়না, মাছরাঙা পাখির মতো ফুরুৎ করে উড়ে গেল। জয়তুনের তাতে কোনো হেলদোল হলো না। সে তার মতোই পানের পাতা থেকে আঙুল দিয়ে পান মুখে দিল।
আয়না গেটের সামনে এসে হাপাতে হাপাতে বলল,
— গেট খুলেন।
গেটের সামনে জয়তুনের লোক। আর এ বাড়িতে জয়তুনের কথা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তাই নতুন বউয়ের কথায় কি বলবে দিশে পেলো না। তবে কালাম এগিয়ে এলো, এসে বলল,
— বুবুর কাছে যান ভাবি। বুবুর অনুমতি ছাড়া মহিলাদের জন্য গেট খোলা যাবে না।
আয়নার খুশিতে ভাটা পড়ল না। সে খুশিতে ঝিকিমিকি করতে করতেই বলল,
— আমি তো বাইরে যাবো না। আমার বড় মা আইছে, তাকে ভেতরে আনবো।
— আপনি বুবুর কাছে যান ভাবি।
— বড় মা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
কালাম আর উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
আয়না তবুও দমল না। যেভাবে এসেছিল, সেইভাবেই আবার ভেতরে দৌড়ে গেল। জয়তুনের সামনে গিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,
— আমার বড় মা আইছে।
জয়তুন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তাকাল। স্বাভাবিক গলায় বলল,
— এই ভর সন্ধ্যায় তোমার মাথার কাপড় কই? চুল বাতাসে উড়ে ক্যা? তার মধ্যে আবার নয়া বউ! ঘাড়ে একটা জুটে গেলে দায় নেবে কে?
আয়না সাথে সাথে’ই খোঁপা করল, মাথায় ঘোমটা টানল। টানতে টানতেই আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, জয়তুন হাত তুলে থামিয়ে দিল। দিয়ে আগের মতোই বলল, — এটা মিঠাপুকুর গ্রামের ধানের ক্ষেত না, মন চাইলেই আইল ধরে উড়াউড়ি করবে। এটা সারেং বাড়ি। সারেং বাড়ির বউরা নেচে নেচে উড়ে বেড়ায় না। আর তোমাকে তোমার চাচার বাড়ি থেকে সম্মানে বউ করে তোলা হয় নি। আমিতো ভাই সেই রকম’ই চেয়েছিলাম। তবে কুত্তার পেটে যেমন ঘি হজম হয় না, তোমার গায়েও সম্মান হজম হয়নি। তাই বারো ঘাটের পানি খাওয়ার জন্য ডুপ দিয়েছিলে।
যখন দিছো, তখনই বাপের বাড়ির পাট শেষ। আমার বাড়ির বউ হইছো ব্যাটাগো মজলিশ থেকে। সেখান থেকে যদি আমার নাতি তুলে না আনতো। এত ফলক ফলক করার মতো এখনো বেঁচে থাকতে না। না বাঁচিয়ে রাখতে পারতো তোমার বাপের বাড়ি। আর আমার নাতির ওপরে হামলা হয়েছে, এটা চাট্টিখানি কথা না। যতোক্ষণ না বের হচ্ছে কে করেছে, ততোক্ষণ কারো সঙ্গে যোগাযোগ হবে না।
এখন যাও, ভেতরে যাও। নাতি আমার বাড়িত আসার সময় হইছে। আর কখনোও যেন আমার নাতির ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাতে না দেখি। আর একটা কথা ভালো করে মাথায় ঢুকাইয়া লও। এখন তুমি সারেং বাড়ির বউ। এই সারেং বাড়িই তোমার সব।
আয়নার চোখের টলমলো পানি গাল গড়িয়ে পড়ল। পড়তে পড়তেই সদর দরজার দিকে বড় আকুলতা নিয়ে তাকালো। তার আবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে করল এই গেইট, এই অদৃশ্য লোহার শেকল ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু সেই শক্তি তার কই?
চোখের পানি নিয়েই আয়না আবার বড় আশা নিয়ে জয়তুনের দিকে তাকালো। যদি একটু মায়া হয়।
জয়তুনের মায়া হয় না। বরং ধমকে বলে, — খাম্বার মতো দাঁড়ায় আছো ক্যা? যাও! যে কাজ করছিলে সেইটাই করো। আমি আবারো কইতাছি নয়া বউ, এত ফলক ফলক আমার পছন্দ না। আর মুখে মুখে চাপা চালানো তো একদম না। আমি কবরে যাই, দুই চারটা বংশের বাতি আনো। তার পরে যা খুশি তাই কইরো।
আয়না আর কিছু’ই বললো না। ধীরে ধীরে আবার ছাদে ফিরে এলো। এসে দাঁড়ালো সেই ঠিক আগের জায়গায়।
সন্ধ্যা নেমে গেছে, অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। তবুও যতক্ষণ দেখা যায়, আয়না তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে’ই দেখলো, তার বড় মা অনেক সাহস করে গেটে একবার মৃদু টোকা দিলো। সেই টোকায় এপারের কারো কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। যে যার কাজে ব্যস্ত।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ছোট ছোট পা ফেলে বড় মা চলে গেলো। যেতে যেতেও কয়েকবার ফিরে দরজার দিকে তাকালো।
আয়না নিশ্চুপ, শান্ত চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল। এই দেখার মাঝে এক ফোঁটা চোখের পানিও আর গাল গড়িয়ে পড়ল না। চোখদুটো শুষ্ক, শান্ত, নীরব। সেই নীরব চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে’ই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। সারেং বাড়ির বিদ্যুতের লাল বাতিগুলো জ্বলে উঠল। আয়না তবুও নড়ল না। আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।
সেই দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই গেট খুলল। না, আয়নার বড় মার জন্য না। সারেং বাড়ির ছোট নাতি ফিরেছে। ফিরতেই উঠান পেরিয়ে যেতে যেতে কী মনে করে যেন একবার উপরের দিকে তাকালো। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না, দেখা যায় শুধু একটা আবয়ব। আর এটা কার শাহবাজের কেন জানি এবারো বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না।
চলবে…..