#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ২৭
শাহবাজের ঘুম ভাঙলো ভ্যাপসা গরমে। ক্যারেন্ট নেই, ফ্যান বন্ধ। তার মধ্যে টিনের দোকান। সেই দোকানের নিচে সারা রাত শোয়ায় শরীর ব্যথায় টো টো করছে। তার মধ্যে খেয়েছিল তাড়ি। মাথাটা এখনোও হালকা ঝিমঝিম করছে।
সেই ঝিমঝিমে মাথা নিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে’ই শাহবাজ বাইরে এলো। এখনো ভালো করে আলো ফুটেনি। যাও ফুটতো মেঘের কারণে তা পারেনি। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আছে। এমন ভাব এক্ষুনি আকাশ ভেঙে নামবে। তবে শাহবাজ জানে, দুপুরের আগে এই বৃষ্টি হবে না। থম মেরে থাকতে থাকতে, শরীরের সব পানি গরমে চিপড়ে বের করে তারপর গিয়ে স্বস্থির বৃষ্টি হবে।
তাই শাহবাজ নিশ্চিন্তেই স্টেশনের চায়ের দোকানে বসলো। বসতেই দোকানদার হাসি মুখে চায়ের গ্লাস এগিয়ে দিলো। শাহবাজ নিলো, নিয়ে চমুক দিতেই তার চেলাপেলার দু’ জন সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। বসে বললো, — কালকে মনিরের বাড়িত গেছিলাম ভাই। আপনের মাথা গরম ছিল। তার মধ্যে খাইলেন তাড়ি। তাই আর বলার সুযোগ পাই নাই।
শাহবাজ স্বাভাবিক ভাবেই চায়ে আবার চমুক দিলো। দিয়ে বললো, — তারপর?
— ব্যাটারে তো যমে ধরে টানাটানি করছে। এই যায় তো সেই যায়। বয়সতো কম না, তাই অনেক কষ্টে বাহার উদ্দিনরে চিনলো।
— কি বললো?
— বলার মতো কিছু নাই। সব লেবার যেমন সেও তেমন।তবে কাহিনী তো তার বউরে নিয়া।
শাহবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে তাকাতেই মান্না বললো, — পুরো এলাকায় রটাইছে, ইটের ভাটায় কাজ নিছে। তবে কাজ করছে হাতে গোনা কিছু দিন। তারপরে আর আসে নাই।
— আসে নাই মানে?
— তা তো ভাই জানি না। তবে গায়েব হওয়ার আগতরি ইটের ভাটার নাম করেই বের হইছে।
শাহবাজ আর কিছু বললো না। চুপচাপই চা শেষ করলো। করে বললো, — আয়নামতির এক খালা আছে না শহরে।
— জ্বি ভাই।
— তার খোঁজ রাখ। মাঝে মাঝে গ্রামে আসে। দুনিয়ায় হাজার মানুষ থাক। দুঃখ রাখার জন্য বাপের বাড়ির মানুষকে’ই মেয়েরা খোঁজে। আর যদি মায়ের পেটের বোন হয়। তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
— জ্বি ভাই।
— খোঁজ পেলেই আমাকে বলবি। আমি এবার নিজে কথা বলতে চাই।
শাহবাজের চ্যালারা মাথা নাড়লো। নাড়তেই শাহবাজ চায়ের গ্লাস রাখলো। রেখে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। ঘুম হারাম করে, আমার বাড়ি, আমার ঘরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ভাবা যায়?
জয়তুন এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। সবার আগে আম্বিয়া উঠে। তাই সেই উঠেছে। উঠে দরজা খুলতেই শাহবাজ সোজা উপরে এলো। আর এসেই বন্ধ দরজায় ধরাম করে একটা লাথি মারলো।
আয়না ধড়ফড়িয়ে উঠল। সে ভেবেছিল শান্তিতে বুঝি ঘুমাবে। তবে এতো বড় রুমে সে বুঝি কখনও একা থেকেছে। তাই ভয়ে সারা রাত দু’ চোখ এক করতেই পারে নি। ঘুমালো এই তো কিছুক্ষণ আগে। তাও দরজা জানালা সব ইচ্ছে মতো লাগিয়ে। হাওয়া বাতাসতো ভালোই সকালের আলোর ছিটেফোঁটাও এখনো রুমে ঢুকেনি।
তখনি দরজায় আরেকটা পড়ল। গরমে আয়না গায়ে কাপড় রাখেনি। সব নতুন ভাঁজ ভাঙা কাপড়। খসখসে, মচমচে। এই গরমে গায়ের মধ্যে ফোসকার মতো জ্বলে। তাই খুলে রেখেছে।
সেই কাপড়’ই ফট করে উঠে গায়ে জড়াতে লাগলো। হয়েছে কি তার মাথায় ঢুকছে না। তার মধ্যে নতুন কাপড়। আয়না বলতে গেলে গায়ে কোন রকম পেঁচালো। পেঁচিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যেই দরজা খুলবে তখনি বুঝতে পারলো কে? কেননা এমন শয়তানগিড়ি এই বাড়িতে একজন’ই করে। তাই আর কোন চিন্তা হলো না। আরামছেই দরজার কাছে গেলো, গিয়ে দরজা খুললো। খুলে শাহবাজ দাঁত চিবিয়ে কিছু বলবে, তার আগেই আয়না তার স্বভাব মতো আস্তে করে বললো, — রাতে কোথায় ছিলে? আমি না ভয়ে ঘুমাতেই পারি নাই। এতো বড় রুমে কি কখনো একা থাকছি?
শাহবাজের বুক ধক করে উঠল। কোন মেয়ে আজ পর্যন্ত এভাবে তার সাথে কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না। তাই একটু অন্য রকম’ই লাগলো। আর লাগলো বলেই মেজাজ খারাপ হলো। আর হতেই এমন এক ধাক্কা দিলো। আয়না দেয়ালের সাথে একেবারে মিশে গেলো। ব্যান্ডেজ এখন আর নেই। ঘা শুকিয়েছে। তবুও ব্যথা পেলো । তাই সাথে সাথেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।
শাহবাজ সব’ই দেখলো! তবে হাত ঢিলে হলো না। বরং আরো শক্তি দিয়ে চেপে ধরলো। ধরে দাঁত চিবিয়ে বললো, — নাটক করিস আমার সাথে? চিপড়ে তোর নাটক বের করে ফেলবো। শালীর ঘরের শালী।
আয়না ফুঁপিয়ে উঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে। গোলাপি ঠোঁটটা তিরতির করে কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতেই আস্তে করে বলে, — তো কি করবো? বিয়ে হয়েছে মানিয়ে নেওয়া চেষ্টা করছি। তাতেও দোষ?
শাহবাজের সেই চিরচেনা হাসি ঠোঁটে আসে। আর আসে বলেই গলা থেকে হাত সরায়। সরিয়ে বুকটা সোজা করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে বলে, — জড়িয়ে ধরো।
আয়না ফট করে চোখ খুলে। খুলতে’ই শাহবাজ বলে, — শুধু মুখে তুমি তুমি এগুলো হবে? আসল মানিয়ে নেওয়াও তো এটা। আসো! বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করি।
আয়না নিষ্পলোক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। শাহবাজ সেই নিষ্পলোক চোখের দিকে তাকিয়ে তার তেজ নিয়েই বললো, — শাহবাজ বাইরেও যা, ভেতরেও তা। নাটক, মিথ্যা শাহবাজে নাই। তাই এরপর থেকে যা করবি চিন্তা ভাবনা করে করবি।
আয়না পলক ফেললো! শাহবাজ ভেবেছিল ভয়ে সেই দিনের মতোই কিছু করবে। তবে শাহবাজকে পুরো অবাক করে দিয়ে আস্তে করে শাহবাজের বুকে শুধু গালটা হালকা ছুঁয়িয়ে রাখলো। শুধু গাল! শরীর দু’জনের দু’জায়গায়। সেই দুই জায়গায় এক জায়গা থেকে আয়নাও তার মতো আস্তে করে বললো, — কবুল।
আলাউদ্দিন রাস্তায় নামলো তার হাতের মোটা লাঠি নিয়ে। গায়ে গেরুয়া আলখেল্লা, মাথার এলোমেলো চুলগুলো যেন আজ অন্য রকমের রুক্ষ, শুষ্ক, এলোমেলো। সব সময়ের মুখের অমায়িক হাসিটা আজ কিছুটা ম্লান। সেই ম্লাল মুখেই আবার ফিরে তার কুঁড়েঘটার দিকে তাকালো। মায়া, আহা মায়া। যার কিছু নেই, সে তার গায়ের একটা সুতোর মায়ায় হলেও পড়বে। আর এই মায়া ধরেই বুকটা চিনচিন করবে, হাহাকার করবে। এই দুনিয়ায় হাহাকার ছাড়া এমন একটা মানুষও নাই।
আলাউদ্দিন তার হাহাকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই দুনিয়ায় চোখের দেখার বাইরেও অনেক কিছু আছে। ছোট বেলায় আলাউদ্দিন একবার হাত, মুখ ধুতে সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে গেলো। গিয়ে তার মতো হুবুুহু একটা ছেলেকে দেখলো। ব্যস, চিৎকার দিয়ে দাঁত দু’পাটি সেখানেই লেগে গেলো। সবাই ধরাধরি করে উঠানে আনা হলো। মাথায় পানি টানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো। জ্ঞান ফিরলেও তার জীবন আর স্বাভাবিক হয়নি। হয়নি বলেই বুঝলো তার হাহাকার আর মিটবেনা।
আলউদ্দিন মুখ ফিরিয়ে সোজা হাঁটা ধরলো। তার উদ্দেশ্য এখন সারেং বাড়ি। তার সখী তাকে ডেকেছে, সে না গিয়ে পারে? তবে যেই উদ্দেশ্য ডেকেছে, সেটা নিষেধ করতে হবে, কড়া ভাবেই করতে হবে। এখন কোন বিয়ে সারেং বাড়ির জন্য ভালো বয়ে আনবে না।
তবে সমস্যা হলো শরীরটা তার ভালো নেই। এই জীবনে হেঁটে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছে, কখনও ক্লান্ত হয়নি। তবে আজ শরীর ঝিমিয়ে আসছে। অবশ্য ঝিমানোর কারণ আছে। গতরাতে অনেক দিন পর মাকে খোয়াবে দেখেছে। উঠানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে বললো, — কত বললাম বিয়ে কর। কি ছায়ের ঝাড়ফুঁক শুরু করলি। এখন বল, ভিটায় বাতি দেবে কে?
তখনি ঘুমটা ভেঙে গেলো। ভেঙে দেখে ফজরের আজান পড়ছে। এই সময় খোয়াব দেখা ভালো কথা না। সে যেমন জানে, দুনিয়ার সবাই জানে। ব্যস, তখন থেকেই মনটা বিক্ষপ্ত, আর মনের প্রভাব শরীরে পড়বে না, তা হয় নাকি?
আলাউদ্দিন আপন মনেই হেঁটে চললো । মিঠাপুকুরের সকালটা আজ যেন আর পাঁচ দশটা সকালের মতো না। খরখরে রোদের বদলে আকাশজুড়ে ছায়া ফেলছে কালো মেঘের দল। সোনালি রোদ্দুর উঁকি দিয়েও হার মেনেছে মেঘেদের ঘনঘটায়। সেই ঘনঘটায় চারিদিকে ভ্যাপসা গরম। যেই গরম’ই বলে দিচ্ছে, আজ মিঠাপুকুরকে ভাসিয়ে দেবে দূর অজানায়।
আর তখনি আলাউদ্দিন একটা ধাক্কার মতো খেলো। মনে হলো কলিজাটা কেউ মুঠো করে ধরেছে। সে বুকে হাত রেখেই ধীরে ধীরে রাস্তার সাইডে গিয়ে বসলো।
পৃথিলার গায়ে আজ কুসুম রঙা কাপড়। সেই কাপড়ের আঁচলটা ভালো করে টেনে ব্যাগটা কাঁধে ফেললো। ফেলে হাতে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলো । সাবিহা তখন তড়িঘড়ি করে খড়িগুলো ভেতরে তুলে রাখছে। বৃষ্টিতে ভিজলে আর চুলোয় তোলা যায় না। পচে গলে পড়ে। তারচেয়ে ভালো একটু কষ্ট করে তুলে রাখা। সেই রাখতে রাখতে পৃথিলাকে দেখে বলল — এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে না যা পৃথিলা। ঘরের কোণায় তো না। তাছাড়া সারা রাত দুচোখের পাতা এক করিসনি।
পৃথিলা হালকা হাসলো। সাবিহাদের বাকি বেড়া খোলার লোক এসেছে। তারাই নিজেদের মতো কাজ করছে। মেঘ না এলে মনে হয় ইট বালুও এসে পড়বে। বাড়িটার যে মায়াময় একটা ভাব ছিল সেটা আর থাকবেনা। পৃথিলা হেসেই বললো, — সমস্যা নেই। তাছাড়া কালকেও পুরো ক্লাস করিনি।
— হেড স্যার জানে তুই অসুস্থ। কিচ্ছু হবেনা।
পৃথিলা এবারো শুধু হাসলোে। বাসায় বসে বসে ঝিমানের চেয়ে ব্যস্ত থাকা ভালো। অন্তত হাবিজাবি চিন্তা মাথায় জেঁকে বসে না। তাই হেসে আকাশের দিকে একবার তাকালো। তাকিয়ে সাবিহাকে বিদায় জানিয়ে বাইরে এলো। ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। আজকে অবশ্য বীণা নেই। খালি ভ্যান। ভ্যানওয়ালা বসে বসে পান চিবুচ্ছে।
পৃথিলা এগিয়ে গেলো তবে ভ্যানে উঠল না। সে আর ভ্যানে যাবে না। কোন কিছু একটা ঠিক নেই। কি নেই সে ধরতে পারছে না। এই ভ্যান ওয়ালার আচরণও তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। তাই দাঁড়িয়ে বললো, — বীণা স্কুলে যাবে না?
— না আপা।
— কেন?
— তা তো আমি জানি না আপা। শুধু বললো আর নাকি যাবে না।
পৃথিলা বুঝতে পারলো কেন? আর পারল বলেই খারাপ লাগলো। সে ঠিক করলো বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জাফর চাচার সাথে কথা বলবে। তার ধারণা এই বাড়িতে কথা বলার মতো একজন’ই আছে। সেটা তিনি। বাকি গুলো প্রত্যেকটার মাথায় সমস্যা আছে।
তাই বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পৃথিলা বলল,
— তাহলে আপনাকেও আর আসতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করে নেবো।
ভ্যানওয়ালার পান চিবানো বন্ধ হয়ে গেছে। সে মুখে একটু আতঙ্ক এনেই বলল, — আমি থাকতে আপনি ব্যবস্থা করবেন কেন আপা?
— আপনি তো বীণার জন্যই আসতেন। তাই আমি রাজি হয়েছিলাম। এখন যেহেতু ও যাবে না, আমার আর প্রয়োজন নেই।
ভ্যানওয়ালা তাড়িঘড়ি করে বলল,
— না না, এইডা কেমন কথা। এরশাদ ভাই তো আমাকে বলেছেন, আপনার যাওয়া-আসার সব দায়িত্ব আমার।
পৃথিলা ব্যাগ থেকে টাকা বের করল। কাল ভাড়া দেয়নি, ভেবেছে মাসকাবারি। আর যেহেতু যাবেনা তাই টাকাটা ভ্যানের ওপর রেখে তার স্বভাব মতো হালকা হেসে শান্ত ভাবে বলল, — আপনার এরশাদ ভাইয়ের কথা শুনে ভালো লাগলো। তবে আমার দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার আপনার এরশাদ ভাই কেউ না, ভালো থাকবেন। বলেই পৃথিলা এগুলো। এগুতে এগুতে হাতের কালো ফিতের ঘড়িটার দিকে একবার তাকালো। ইমরান ভাইকে দিয়ে ঠিক করিয়েছে। এখন বেশ চলছে। বেশ চললেও তার সময় খারাপ’ই যাবে। কেননা এই মেঘ বৃষ্টির মাথায় হাতে গোনা কয়েকটা ভ্যানের একটাও পাওয়া যাবে না। তাই হেঁটে যেতে হবে। এখন সময় মতো পৌঁছুতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।
সেই সন্দেহ নিয়ে পৃথিলা বলতে গেলে দ্রুত’ই পা চালালো। কাপড়, গরম সব কিছু নিয়ে অল্পতেই নেয়ে ঘেমে একাকার হলো । একাকার হতেই খেয়াল করলো, ছাতা নিতে নিতে পানির বোতল নিতে ভুলে গেছে। ধুর!
তখনি তার পাশ ঘেঁষে ছোট্ট এক ছেলে দৌড়ে গেলো। ছোট্ট মানে অনেকটা ছোট। খালি গা, নিচে কালো মলিন হাফ প্যান্ট। পৃথিলা বলতে গেলে একটু চমকে’ই উঠল। কেননা ছেলেটা বলতে গেলে অনেকটা ঘেঁষে গেছে। এমন ঘেঁষে যেতে যেতে মনে হলো আঁচলা টেনে নিয়ে গেছে। যেদিকে গেছে পৃথিলা তাকাতেই দেখলো, বৃদ্ধ এক লোক হাত পা ছড়িয়ে তপ্ত রাস্তার মধ্যেই শুয়ে আছে। বুকে হাত। স্বাভাবিক যে নেই পৃথিলা দেখার সাথে সাথেই বুঝলো, বুঝলো বলেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো। গিয়ে সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কোমল সুরে বললো, — আপনি ঠিক আছেন?
আলাউদ্দিন সব সময়ের মতো অমায়িক হাসেন। হেসে বলে, — ঠিক থাকলে তো মা, রাস্তায় পড়ে থাকি না।
— আমাকে ধরে উঠে বসুন।
আলাউদ্দিন পৃথিলার হাত ধরে। ধরতেই একটা ঝটকার মতো খেলো। এতোটাই যে আবার পড়ে যেতে নিচ্ছিল। পৃথিলা বলতে গেলে ঝাপটে ধরলো। ধরতেই আলাউদ্দিন বললো, — কে তুমি?
— আমি পৃথিলা। হাই স্কুলের শিক্ষক। আপনি কষ্ট করে একটু সোজা বসুন তো। বসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলুন।
আলাউদ্দিন সোজা বসতে চায়। তবে শরীরে কুলোয় না। পৃথিলা বুঝে। বুঝে বলেই চিন্তিত ভাবে আশে পাশে তাকায়। বয়স্ক মানুষ, গরমে ডিহাইড্রেশন হয়েছে নয়ত স্ট্রোক করেছে। এখন সে কি করবে?
আলাউদ্দিনের চোখে মুখে অবশ্য চিন্তার রেশ নেই। যা আছে তা একটু যন্ত্রনার। সেই রেশ নিয়েই বলে — সত্যি করে বলতো মা, কে তুমি?
পৃথিলা ফিরে তাকায়। তাকিয়ে হালকা হেসে বলে — আমি সব সময় সত্যিই বলি চাচা।
আলাউদ্দিন আবার কিছু বলতে চায়। তবে পারে না। সে অবাক চোখে পৃথিলার পেছনে তাকায়। তার পেছনে ছোট আলাউদ্দিন দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি। যেন খুব মজা পাচ্ছে। সেই হাসিতে আলাউদ্দিনও হাসে। কারণ সে বুঝতে পারছে, এই মেয়েটা কে?
পৃথিলা আলাউদ্দিনের চোখ দেখে একবার পেছনে ফিরে তাকালো। শূণ্য ধূ ধূ রাস্তা। সে দেখে আবার ফিরে বললো, — আপনার কি অনেক খারাপ লাগছে।
আলাউদ্দিন পৃথিলার দিকে তাকায়। তাকিয়ে সুন্দর করে আবারো একটু হাসেন। এই দুনিয়া সব হজম করতে পারে তবে পাপ না। সেটা একদিন না একদিন বের হবেই। মানুষ যতো পর্দা ফেলুক, না থাকুক কোন প্রমাণ। ঐ যে উপরে যিনি আছেন, সে জানে। জানে বলেইতো কথায় আছে, তিনি ছাড় দেন, তবে ছেড়ে দেন না।
তখনি পৃথিলা ভ্যানের শব্দ পেলো। এই ভ্যান দেখলে অন্য সময় হলে পৃথিলা মুখ ফিরিয়ে নিতো। তবে এখন দেখেই ডেকে উঠলো, — এরশাদ…
এরশাদ সাথে সাথে সাইডে তাকালো। তাকাতেই কুসুম রাঙা শাড়িতে পৃথিলাকে দেখলো। দেখলো আলাউদ্দিনকেও। যাকে পৃথিলা ঝাপটে ধরে বসে আছে। এরশাদ সাথে সাথে’ই ভ্যান থামার জন্য বললো। অবশ্য বললেও ভ্যান থামার আগেই সে লাফিয়ে নামলো। আর নামতে গিয়ে দেখলো তার বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। ঐ যে প্রথম দিন পৃথিলাকে ঝাপটে ধরে নদীর পাড়ে নিল। সেই দিনের মতো। আর মাথায় ঝিঝিপোকার মতো বেজে চলছে — এরশাদ।
আলাউদ্দিন ফকির মারা গেলো রাস্তায়, ভ্যানে পৃথিলার কোলে মাথা রেখে। মিঠাপুকুরের সদর হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার সময় সে দেয়নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৃথিলার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটে সব সময়ের মতো হাসি। সেই হাসির দিকে পৃথিলা শক্ত হয়ে বসে তাকিয়ে রইল। কেননা এতো গরমের মাঝেও তার মনে হলো, কিছুক্ষণ আগে হালকা একটা শীতল বাতাস তাকে ছুঁয়ে গেলো। আর যেতেই প্রথম যেই কথাটা মাথায় এলো, সেটা হলো সেই ছোট্ট ছেলেটা কোথায় গেলো?
দুপুরের পরে আকাশ বাতাস ভেঙে বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টি মাথায় করেই মিঠাপুকুর গ্রামের অলি গলিতে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেলো। আল্লাউদ্দিন যেমন সারেং বাড়ির জন্য সম্মানের ছিল তেমনি তার নিজের কারণে ভালোবাসারও ছিল। সেই ভালোবাসার ফল হিসেবেই সারেং বাড়ির উঠানে মানুষের ঢল নামলো। এতো এতো মানুষের ভিরে জয়তুন বসে রইল পাথরের মূর্তির মতো। তার যে সবচেয়ে ভরসার স্থান ছিল। সেই স্থান নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে আজ হারিয়ে গেলো।
এই মেঘ বৃষ্টি মাথায় করেই বাদ আছর আলাউদ্দিনের জানাজা হলো। হতেই প্রত্যেক মানুষ কাকভেজা হয়ে নিজ নিজ গৃহে ফিরলো।
গৃহে ফিরলো সারেং বাড়ির তিন পুরুষ। গায়ে শুভ্র পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। ফিরেই জয়তুনের পাশে বসে। দুনিয়া যেমন জানে, তেমনি তারাও জানে জয়তুনের কাছে আলাউদ্দিন কি ছিল। আর ছিল বলেই জয়তুন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সারেং বাড়ির প্রতিটা কোণা আজ অনেক অনেক দিন পরে জয়তুনের চোখের পানিতে ভিজলো।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ২৮
পৃথিলার সারা দুপুর বিকেল বলতে গেলে গেছে চুপচাপ বসে। স্কুলে আর যাওয়া হয়নি। মৃত্যুর পরে আলাউদ্দিন ফকির কে নিয়ে সোজা আসা হয়েছে সারেং বাড়িতে। এই সখী ছাড়া তার তিন কুলে কেউ নেই। কিছু খাদেম লোক ছিল। তারা’ই দাফনের আগে এক ঝলক নিজ ভিটায় নিয়েছিল। সেখান থেকেই সোজা কবরস্তান।
কবরস্তান নিলেও সারেং বাড়ির উঠান থেকে লোকারণ্য কমেনি। এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করেও অনেকে এলো, অনেকে গেলো। সাথে কতো গল্প। আলাউদ্দিন ফকির এমন ছিল, ওমন ছিল। অনেক নাকি ক্ষমতাও ছিল। গরীর মানুষদের সহায় ছিল। মিঠাপুকুরের বিপদ আপদের মাথা ছিল।
পৃথিলা বসে বসে সব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। কতোটা অন্ধ বিশ্বাস এই মানুষগুলো আলাউদ্দিন ফকিরকে করতো সারা দুপুর, বিকেল পৃথিলা তাই বসে বসে শুনলো, ভাবলো। তবে টু শব্দও করেনি। বেঁচে থাকলে হয়তো করতো। তবে যে নেই, দুনিয়ার সব হিসেব নিকেশের পাট চুকিয়ে অজানা গন্তব্যে চলে গেছে। তাকে নিয়ে তর্কে যাওয়া যায় না। কেননা তারটুকু বলার জন্য সে নেই। তর্ক দু’পক্ষের হতে হয়। একজনের অনুপস্থিতিতে তা হয় না। তাছাড়া কারো ক্ষতি তো করেনি।
সারা বিকেল সন্ধ্যায় এই রকম হাজার ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পৃথিলার আজকের দীর্ঘ দিনটা গেলো। তবে কথায় আছে না বিপদ, মৃত্যু, কষ্ট এগুলো কখনও একা আসবে না। তারা আসবে দল বেঁধে। দল বেঁধে হোক আর ভাগ্যের অন্য কোন ইশারা, ফাঁদে পড়ে গেলো পৃথিলা। কেননা অনেক অনেক দিন পর তার মনে হলো গা গরম হচ্ছে, মাথা ভারী হয়ে আসছে। তার অসুখ বিসুখ কম। কম বলতে অনেক কম। সামান্য জ্বরও শেষ বার কবে এসেছে, পৃথিলা মনে করতে পারে না। তবে হঠাৎ আজ কি হলো?
পৃথিলা অবশ্য কাওকেই কিছু বললো না। নিজের মতো হালকা পাতলা কিছু খেলো। তার কাছে ঔষুধ ছিল। সেখান থেকে ঔষুধ খেলো। খেয়ে কাঁথা টেনে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এমন ঝড় বৃষ্টির রাতে কাওকে আর বাড়তি ঝামেলায় ফেলার মানে হয় না।
তবে মানুষের চাওয়া মতো হয় আর কখন? যেভাবে যা ভাগ্য আছে তা ঠিক হতে থাকে। আর থাকে বলেই রাত বাড়তে লাগলো, তার সাথে পৃথিলার শরীরের তাপমাত্রাও। বাড়তে বাড়তে আসলে কতোটা খারাপ হলো পৃথিলা নিজেও বুঝতে পারলো না। তবে অনেক কষ্টে টেনে ভারী হয়ে যাওয়া চোখের পাতা দুটো খুললো। খুলে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মাথাটা ঘুরছে, গলা শুকিয়ে আসছে। হঠাৎ করে এমন জ্বরের আগা মাথা পৃথিলা কিছুতেই পেলো না।
তাই অনেক কষ্টে’ই উঠে বসলো। শরীর তার কাছে লাগছে পাথরের মতো ভারী। সেই ভারী শরীর নিয়েই উঠে পানি খাওয়ার চেষ্টা করলো। রাত কতো সে জানে না। তবে বৃষ্টি এখনোও থামেনি। টিনের চালে ঝুমঝুম করে পড়ছে আর গায়ে শীতে কাটা দিচ্ছে। সে কি সাবিহাকে একবার ডাকবে? পৃথিলার বিবেকে বাঁধে। সারাদিন ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে কতো কাজ যে করে। তার মধ্যে আলাদা ঝামেলা হিসেবে ঘাড়ে সে বসে আছে। একটা মানুষের খাওয়া, রান্নার ঝামেলাতোও কম না।
তাই না ডাকার’ই সিন্ধান্ত নিলো। কোন রকম রাতটা গেলেই জ্বর কমতে শুরু করবে। জানে তো! মিথিলার দু’দিন যেতে না যেতেই জ্বর হতো। সারা রাত যেতো উথাল-পাতাল, তবে সকাল হওয়া সাথে সাথে’ই শেষ।
তারটাও নিশ্চয়’ই এমন হবে। তবে পানি মুখে নিতেই হলো আরেক বিপত্তি। পেট মুড়িয়ে এলো। যেন তেন মোড়ানি না, এমন এক মোড়ানি দিলো পৃথিলার মনে হলো, ভেতরের সব বেরিয়ে আসবে। সে তাড়াতাড়িই দরজা খুলে বারান্দায় চলে এলো। খোলা বারান্দায় বৃষ্টির ছাটে পৃথিলাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। দিতেই পৃথিরার মনে হলো রাস্তায় ওপাড়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বাকি বেড়া খুলেছে। তাই বারান্দা থেকে সোজা দৃশ্যমান।
দৃশ্যমান হলেও পৃথিলা তাকালো না। নিজের মনেই বড় একটা শ্বাস ফেললো। সে বলতে গেলে ভীতু টাইপ মেয়ে। ভীতু হলেও বাস্তবতার জ্ঞান প্রখর। আর প্রখর বলেই সে জানে, সারাদিন আলাউদ্দিন ফকির নিয়ে হাবিজাবি শুনেছে। তার মধ্যে জ্বর। এমন সময় মস্তিষ্ক অনেক কিছুই কল্পনা করতে পারে। এটা আহামরি কিছু না। গ্রাম গঞ্জে এভাবেই অন্ধ বিশ্বাস ছড়ায়। আলাউদ্দিন ফকিরেরটাও কি ছড়ায়নি? তার যদি সত্যিই এমন কোন ক্ষমতা থাকতো, তাহলে এভাবে মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকতে হতো না।
সে শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বমি ভাবটা কমেছে। বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতে ভালোও লাগছে। আর লাগলো বলেই কাঁপা কাঁপা শরীরে বারান্দায় রাখা স্টিলের বালতির কাছে এগিয়ে গেলো। সাবিহা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য রেখেছে। সেই পানি চোখে মুখে দেওয়ার জন্য উপুর হতেই আর ভারসাম্য রাখতে পারলো না। ঠাস করে বালতির উপরে’ই পড়লো।
আর পড়তেই ইমরান ধড়ফড়িয়ে উঠল। কিসের শব্দ হলো প্রথমে বুঝতে পারলো না। টিনের চালে এমনিই বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। আলাদা শব্দ কোথায় হলো দেখার জন্যই উঠল। উঠে দরজা খুলতেই হতবাক হয়ে গেলো। আর হতেই দৌড়ে সাবিহাকে ডাকতে গেলো ।
জয়তুন চোখের পাতা এক করলো প্রায় মধ্য রাতে। তখনও ঝড় তুমুল বেগে নিজ গতিতে চলছে তো চলছে। এই চলার মাঝেই কিছুক্ষণ আগে সারেং বাড়ির নদীর পাড়ে বরইগাছটা বিকট শব্দে উপড়ে পড়েছে। তার মধ্যে ক্যারেন্ট নিয়ে রেখেছে সেই দুপুরে। হারিকেনের আলোগুলো প্রায় নিভু নিভু করছে। সেই সাথে নিভু নিভু করছে সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষের চোখের পাতা।
এরশাদ জয়তুনের শিওরে বসা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম যত্ন নিয়ে। বয়স হলেও এতোদিন যে ডাট বাট নিয়ে থেকেছেন তা একদিনেই যেন ভেঙে চুড়ে শেষ। মৃত্যুর ভয় এমন এক জিনিস। যেটা শুধু যার মৃত্যু হয় তাকে ছোঁয় না, তার সাথে জড়িত প্রত্যেকটা মানুষকে ছোঁয়। এই যে যেমন জয়তুনকে ছুঁয়ে গেছে। গেছে বলেই এতোক্ষণ পাগলের মতো প্রলেপ বলেছে।
এরশাদ জয়তুনের গায়ে কাঁথাটা আস্তে করে টেনে দিলো। বৃষ্টির কারণে শীত পড়েছে। টেনে বীণার দিকে তাকালো। সেও দাদির পাশে চুপচাপ বসে আছে। মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু। সারাদিন কারো পেটে দানা পানি পড়েনি। তাই আম্বিয়া, আয়না গেছে হারিকেন থাকতে থাকতে সবার জন্য হালকা কিছু করতে।
এরশাদ হালকা হেসেই বোনের মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — কিছু খেয়ে টুপ করে দাদির পাশেই আজ শুয়ে পড়।
বীণা শুধু মাথা নাড়লো। তখনি সারেং বাড়ির দরজায় কেউ জোরে কড়া নাড়লো। ঝড় বৃষ্টির মধ্য রাতে কড়াটায় সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষ’ই যেন একটু চমকেই উঠল। আর সবচেয়ে বেশি চমকে উঠল আয়না। এতো রাতে আর কি করবে। তাই স্টোভে গরম দুধ আর সাদা রুটি করেছে। সেই সাদা রুটির গরম দুধটাই মাত্র নিয়ে সে বসার রুমে এসেছে। নিচু হয়ে রাখবে তখনি দরজায় কড়া পড়ল। আর পড়তেই ছলকে দুধ ফেললো তো ফেললো একেবারে শাহবাজের হাতের উপরে।
শাহবাজ অবশ্য আজকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তবে ঘাড় কাত করে ঠিক তাকালো। আর তাকালো বলেই আয়না আস্তে করে একটা ঢোক গিললো। পড়ার আর জায়গা পায়না। সামান্য তুমি বলেছে, গলায় এমন চেপে ধরার ধরেছে, এই যে ঢোক গিলতে গেলেও এখন গলা টো টো করছে । এখন আবার গরম দুধ। মাথা যে এখনোও সেহি সালামাত আছে এ’ই তো কত?
সাইডে’ই জাফর বসা। নিভু নিভু আলো। সেই আলোতে জাফরের চোখের আড়ালে আস্তে করে আয়না আঁচল দিয়ে’ই হাত মোছার চেষ্টা করলো।
শাহবাজ আবার এতো চাচার টাচারের ধার ধরলে তো। সে বরং ঝাড়া মেরে নিজেই আঁচল টেনে নিলো। নিয়ে মুছে ঝট করে উঠে দরজার দিকে গেলো। অবশ্য এগিয়ে এলো এরশাদও। বৃষ্টি হলেও জয়তুনের সব লোক’ই সজাগ। তবুও চিন্তিত ভাবেই এগিয়ে এলো।
আর আসতেই দেখলো শাহবাজ দরজা খুলেছে। খোলা দরজার ওপারে ভিজে চুপচপে ইমরান দাঁড়িয়ে আছে। শাহবাজ দেখে বিরক্ত হলো। কোন দরকার এতো রাতে। নিজেদের জ্বালায় বাঁচে না। তাই বিরক্ত মাখা কণ্ঠে কিছু বলবে। তার আগেই ইমরান জাফরের দিকে তাকিয়ে বললো, — ছোট চাচা, পৃথিলা মানে ওনার অবস্থা খারাপ। সারা দিন সন্ধ্যা তো ভালো’ই ছিল। হঠাৎ করে কি হলো, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বারান্দায় বেহুঁশ হয়ে গিয়েছে। এখন জ্ঞান তো আসবে ভালো’ই, হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জাফর মাত্রই পানির গ্লাস নিয়েছিল। সেই গ্লাস’ই হাত থেকে ছিটকে পড়ল। সেই পড়ার দিকে অবশ্য জাফর ফিরেও তাকালো না। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো। ঝড় না বৃষ্টি সে কিছুই খেয়াল করলো না। ভিজেই ইমরানের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলো। তার পিছু পিছু ইমরানও গেলো।
আয়না নিজেও হতম্ভব। তার অসুখে মানুষটা কতোকিছু করলো। এখন তার বিপদে আয়না কি কিছু করবে না। সে কাচুমাচু করতে করতেই শাহবাজ আর এরশাদের দিকে তাকালো। সে যে নিজেও যেতে চায়। আলাউদ্দিনের মৃত্যুতে তার ভেতরে ভালো মন্দ কিছুই হয়নি। তার জীবনের আসল শনিটা তো সে’ই ডেকেছে। তবে পৃথিলার কথা শুনেই তার চোখে পানি চিকচিক করতে লাগলো। এমন ঝড় বৃষ্টির রাতে কে কি করবে? ভ্যান তো দুনিয়া উল্টে গেলেও নেওয়া যাবে না।
শাহবাজ দাঁড়িয়ে আছে বিরক্ত নিয়ে। কোথাকার কে? তাদের এসে বলার কি হলো। আর চাচা’ই এমন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো কেন? সে জাফরের মেজাজ আয়নার উপরে ঝাড়ল। এমন এক ধমক দিলো।
আয়নার সাথে সাথে’ই ঠোঁট কেঁপে উঠল। সেই কেঁপে উঠা ঠোঁটের দিকে শাহবাজ একবার তাকালো। তাকিয়ে’ই চোখ ফিরিয়ে নিলো। তবে আয়না নিলো না। যখনি মনে করে মানুষগুলো একটু ভালো। তখনি ভালোর পর্দাটা টেনে নিজেরাই সরিয়ে ফেলে। এদের নিজেদের ছাড়া আর কারো জন্য পুড়ে না। সব সার্থপরের দল।
এরশাদ সব চুপচাপই দেখলো, শুনলো। হন্তদন্ত, ঘাবড়ানো, চেঁচানো তার ধাতে নেই। বড় বড় যে কোন জিনিসও সে ঠান্ডা মাথায় হজম করতে পারে। এই যে পৃথিলার খবরে যে জাফরের মতো সে নিজেও ধাক্কা খেয়েছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় আছে? না নেই।
বরং শান্ত ভাবেই শার্টের হাতা গুটালো। গুটিতে বাইরের দিকে যেতে যেতে বললো, — আমি না ফেরা পর্যন্ত কোথাও যাবি না। কালামকে নৌকা বের করতে বল।
শাহবাজ রাগে ফুসলো। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে নৌকা! বাতাসে ঠিক উলটে ফেলবে। তাই রাগ নিয়েই বললো, — আমাদের কোন ঠেকা? তাছাড়া দাদির শরীর ঠিক নেই। তাকে ফেলে কোথাও যাবে না।
— দাদির কিছু হয়নি। ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বীণা আছে তার পাশে।
— দাদির চেয়ে কোথাকার কোন রাস্তার মেয়ে বড় হয়ে গেলো তোমাদের কাছে?
এরশাদ থামলো। থেমে শান্ত চোখে শাহবাজের দিকে তাকালো। একজনের চোখ গহীন অরন্যের মতো রহস্য মাখা শান্ত। আরেকজনের জ্বলন্ত আগুন। সেই আগুনের দিকে এরশাদ একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে আয়নার উদ্দেশ্য যেতে যেতে বললো — দরজাটা লাগিয়ে দাও তো আয়না।
আয়না অবশ্য লাগানোর সময়ও পেলো না। তার আগেই শাহবাজ দরজায় এমন এক লাথি মারলো। আম্বিয়া খাবার ঘর থেকে দৌড়ে এলো। তার চোখে মুখে বিস্ময়! হচ্ছে কি এই বাড়িতে?
এরশাদ আসতেই দেখলো জাফর পৃথিলার মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছে। ভেজা চুলগুলো বারান্দায় ছড়িয়ে আছে। যেই মানুষের সামান্য আঁচলের আগাটাও একটু নড়চড় হয় না। সেই কাপড়’ই আধভেজা হয়ে গায়ে লেপটে আছে। কপাল কেটেছে। সেই কাটা থেকে রক্তগুলো চুইয়ে বৃষ্টির পানিতে মিশে যাচ্ছে।
এরশাদ এগুলো! এগুতে এগুতে খেয়াল করলো। তার শরীর কাঁপছে। পৃথিলার চোখ, মুখ মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে। নিশ্বাস ফেলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
সাইডেই সাবিহা কাঁদছে। জাফর এরশাদকে দেখে’ই ছোট মানুষের মতো চোখে পানি নিয়ে বললো, — এই এরশাদ শরীর এমন বরফ হচ্ছে কেন?
এরশাদ উত্তর দিলো না। সে এগিয়ে ঝট করে ঘরে গেলো। খাটের বিছানো চাদর একটানে হাতে নিলো। নিয়ে পৃথিলার কাছে এসে পেঁচিয়ে ঝট করে কোলে তুলে নিলো। নিয়ে একসেকেন্ডও দাঁড়ালো না। বৃষ্টি কাঁদা পানির মধ্যেই ঘাটের দিকে দৌড়ে গেলো। তার পিছু পিছু জাফর ইমরানও গেলো।
এই ঝড় বৃষ্টি পেরিয়ে কি ভাবে নৌকা সদরের ঘাট পর্যন্ত এরশাদ আনলো, পৃথিলা জানলো না। সে তখন বাবার কোলে মাথা রেখে দিন দুনিয়া ভুলে বেহুঁশ হয়ে নৌকার ছাউনির ভেতরে। নিশ্বাস পড়ছে খুব ধীরে ধীরে। ডাক্তারা দেখেই আঁতকে উঠে বললো, — এই রোগীকে তো বাঁচানো যাবে না।
এরশাদ শাহবাজের মতো না। যদি হতো তাহলে ডাক্তারের মুখ এখনি বিগড়ে যেতো। তবে এরশাদ, এরশাদ’ই। সে এগিয়ে ডাক্তারের সামনে সোজা দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে তার স্বভাবমতো শান্ত ভাবে বললো, — আপনাদের সাধ্যে যা আছে করেন। করেন আর দোয়া করেন। রোগীর যেনো কিছু না হয়। হলে এই যে আসতেই কলিজা কাঁপালেন। এর জন্য আপনার কলিজা আমি নিজ হাতে পিছপিছ করবো।
ডাক্তার আতঙ্ক নিয়েই দৌড়ে ভেতরে গেলো। সারেং বাড়ির মানুষের ধরণ এই গ্রামে কারো’ই আজানা না। আর আজানা না বলেই পৃথিলাকে নিয়ে মূহুর্তে পুরো হাসপাতালে হুড়তুল পড়ে গেলো।
এর মধ্যে জাফর হাসপাতের চেয়ারে’ই শরীর ছেড়ে দিল। এরশাদ এগিয়ে ধরলো। জাফর শ্বাস ফেলছে হাঁপানি রোগীর মতো। সেই ভাবেই বললো — আমার মেয়ে এরশাদ, আমার মেয়ে। কিছু কর। আমার মেয়ের কিছু হলে। আমি বাঁচতে পারবো না।
এরশাদ কিছু’ই বললো না। জাফরকে জাপটে ধরেই চুপচাপ বসে রইল। আর এই বসে থাকতে থাকতে ফজরের আজান পড়ল। আর সবাই কে অবাক করে দিয়ে পৃথিলার শরীরের তাপমাত্র ফিরে আসতে লাগলো।
নার্স এসে দৌড়ে বলে গেলো। যেতেই জাফরের কলিজায় যেনো পানি ফিরে এলো। আর আসতেই কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে পৃথিলার দিকে গেলো।
তবে এরশাদ সেদিকে গেলো না। সে এলো বাইরে। এখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সে বৃষ্টির মধ্যেই পা ছড়িয়ে হাসপাতালের সিঁড়িতে বসলো। আর বসতেই খেয়াল করলো। তারা তো একা আসেনি। কালাম, জয়তুনের আরো লোক এসেছে। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে একা নৌকা ঠিক রাখা সম্ভব না। তাই তারাও এসেছে। আর ছোট চাচার আহাজারি সবাই ঠিক শুনেছে। বাসায় যেতে দেরি হবে তবে জয়তুনের কানে কথা তুলতে দেরি হবে না।
তাই হাত বাড়িয়ে কালামকে কাছে ডাকলো। কালাম আসতেই বললো, — সিগারেটের ব্যবস্থা কর আর এই হাসপাতালের সব কথা এই হাসপালতালেই শেষ । যদি জয়তুনের কানে গেছে, এরশাদের আগুনের চুলা আবার জ্বলবে, ভালো ভাবেই জ্বলবে।
জয়তুন, জয়তুনের ভাবে ফিরে এলো সকালে ঘুম থেকে উঠেই। উঠে সব’ই শুনলো। শুনে স্বভাব মতো খিকখিক করে না হাসলেও, তবে হাসলো। হেসে শাহবাজকে বললো, — আজিজকে খবর পাঠা, আমরা সম্বন্ধে রাজি। আর চারদিনে আলাউদ্দিনের নামে বড় দোয়া রাখবো। তারও দাওয়াত পাঠা। গ্রামের এক ঘরও যেন বাকি না থাকে। আর ঘটককে আসতে বল। আমি এরশাদের জন্য মেয়ে দেখবো। বাঁচি কয়দিন আর ঠিক নাই। মরার আগে গলায় ঘন্টা বেঁধে যাই। তা না হলে অঘাটে ডুবে মরতে সময় লাগবে না।
জয়তুনের জয়তুনগিরিতে শাহবাজের তেমন ভাবান্তর হলো না। সে বরং আরাম করে শুতে গেলো। সারা রাত ঘুমায়নি। তাই ফট করে বিছানায় শুলো। আর শুতেই চমকে উঠল। পুরো বিছানা ভেজা। যেন তেন ভেজা না। পানিতে চুপসে আছে। সে চেঁচাবে তখনি আয়না ধীর পায়ে তার সামনে এসর দাঁড়ালো। স্বভাব মতো আস্তে কোমল সুরে বললো, — এতো ঝামেলায় জানালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। এলোমেলো ঝড়। সব ভিজে শেষ। রোদ একটু উঁকি দিক। ঠিক ছাদে দিয়ে দেবো।
শাহবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার তাকানো পুরো উপেক্ষা করে আয়না আলমারি খুললো। খুলে চেয়ার টেনে কোমর বাঁকিয়ে আলমারির সামনে বসলো। ফিরোজা রঙের কাপড়ের আড়ালে কোমরের ভাঁজগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে শাহবাজের চোখে ভাসলো। আর ভাসতে ভাসতে’ই আয়না নড়ে চড়ে, উঁচু নিচু হয়ে ভাঁজ করা কাপড়গুলো আবার ভাঁজ করতে লাগলো।
চলবে…….