ধূপছায়া পর্ব-৩১+৩২

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩১

জয়তুন ভ্রু উঁচু করে চোখে মুখে কিছুটা বিস্ময় নিয়েই আয়নার দিকে তাকালো। সে দাঁড়িয়ে আছে কাচুমাচু হয়ে। গায়ের কাপড় কুঁচানো, এলোমেলো, চুলের খোঁপাও এলোমেলো। যেন এক ঘূর্ণিঝড় গেছে উপর দিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, চোখে চিকচিক করছে পানি। নাকও কিছুকক্ষণ পর পর টানছে।

যতোদূর দেখছে ব্যথা পাইছে তার নাতি। এর এমন ফুঁলিয়ে ফুঁপিয়ে চোখের পানি আসার মানে ডা কি? তাই সেই বিস্ময় নিয়েই বললো, — তুমিও ব্যথা পাইছো নি?

আয়না দু’পাশে মাথা নাড়লো। জয়তুন বিরক্ত চোখেই দেখলো। এর সাথে বিয়ের আলাপের পর থেকে যতো গন্ডগল শুরু হইছে, আলাউদ্দিন বললো সোনা কপালি।যেই ঘরে যাইবো ঘর আলো হইবো। আলোর কোন লক্ষণ তিনি দেখছেন না। বরং একটার পর একটা কিচ্ছা চলছে তো চলছে। আর এই চলাতে সারেং বাড়ির আলো দূর দূর পর্যন্ত চোখেও ঠেকছে না, ঠেকছে ঘুটঘুটা অন্ধকার।

তাই বিরক্ত মুখেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিতেই শাহবাজ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। সে বসে আছে বালতির ঠান্ডা পানিতে হাত ভিজিয়ে। অবশ্য ভালো করেই জানে এই ভেজানোতে কিচ্ছু হবেনা। হাত শেষ! ভালো ভাবেই শেষ। পাকা রেলিং, বাড়ি খেয়েছে শক্ত ভাবেই। তাই ভার হয়ে আসছে। এখন শুধু ভার হলেও কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে টাটানি। তাই মুখ বাঁকিয়ে হেসেই বললো, — ব্যথা পাবে কেন রে বুবু? কাঁথার মতো পেঁচিয়ে রাখছি। ঝড় তুফান যা যাওয়ার, তা তো গেলো আমার উপর দিয়ে।

বীণা আয়নার পাশে দাঁড়ানো। আজকাল কোন কিছুই তার ভালো লাগে না। তবুও শাহবাজের কথা শুনে কয়েকটা দিন পরেই একটু ঠোঁট টিপে হাসলো। আম্বিয়া শাহবাজের পাশেই বসা। বালতিতে সে’ই বলতে গেলে জোর করে হাত ভিজিয়ে রেখেছে। তা না হলে কোন কিছু নিয়ে এই বান্দার মাথা ব্যথা আছে? দেখা যাবে এই হাত নিয়েই দিব্যি পুরো বাড়ি ঘুরছে। তাই শাহবাজের বাহুতে এক থাপ্পড় মেরে বললো, — অন্তত ছোট বোনের তো লেহাজ কর।

শাহবাজ চোখ কপালে তুলে বললো, — সত্য তো সত্যিই! তাই লেহাজের হলো টা কি? যা হয়েছে তাই তো বলছি। তাইনা আয়নামতি?

আয়না কিছু বলবে তো ভালো কথা চোখ তুলে তাকালোও না। তবে তার ফুঁপানি আরেকটু বাড়লো। কেন ফুঁপাচ্ছে সে নিজেও জানে না।

নাতিদের জন্য জয়তুনের সাত খুন মাফ। তাই শাহবাজের কথা জয়তুনের কিছুই এলো গেলো না। বরং পা ছড়িয়ে আরাম করে বসতে বসতে বললো, — তোর বউ, কাঁথার মতো ধরবি না লেপের মতো আরামে আদরে নরমে ধরবি সেটা তোর ব্যাপার। তবে ভাত খাস না ছাই খাস। একটা তোশক জামাই বউ মিলে নিতে পারিস না। গড়াগড়ি করে কাহিনী করিস। আবার বড় বড় কথা।

শাহবাজ আগের মতোই হাসলো। যেনো দাদির কথায় দুনিয়ার মজা পেয়েছে। হেসে আয়নার দিকে একবার তাকালো। পড়ে এই মেয়ে আহাম্মক। কোন নড়চড় নেই। শাহবাজের লম্বা, চওয়া শরীরের নিচে শক্ত লাঠির মতো সোজা হয়ে আছে। শাহবাজের তখন হাত বাড়ি খেয়ে ঝিমঝিম করছে, তবুও এই যে খুব কাছে শক্ত মুখটা দেখতে ভালো লাগলো। আর সেই ভালো লাগার মাঝেই শক্ত লাঠির মতো পড়ে থেকেই কোন রকম ফিসফিস করে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — আমি কিচ্ছু করিনি।

এই রামবলদ মেয়ের কান্ডকারখানায় তার আর এখন রাগ, বিরক্তি আসে না। আসে হাসি! কি করে, কি বলে, কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সিঁড়ি ভরা চন্দন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সে নিজেই দেখেছে ছাদ থেকে চন্দন কুড়াতে। তাই কি ভাবে পড়েছে না বোঝার কিছু নেই। তাই সেও তার মতো মাথা নাড়িয়ে বলেছে ” ভাগ্যিস কিছু করোনি, তা না হলে এখন আমি অনেক কিছুই করে ফেলতাম। ”

বলেই ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে অবশ্য আয়নার দিকে একবারও তাকায়নি। তাকাতো কি করে, এই রামবলদ মেয়ে জানেও না, গড়াতে গড়াতে কাপড় উঠেছে কোথায়। তাই তখনের কথা মনে করেই শাহবাজ এখন হেসে বললো, — বউ নিয়ে গড়াগড়ি করে কাহিনী করাও যেন তেন কথা না।

আম্বিয়া আরো দু’ইটা দিলো হাতে। দিতে দিতে বললো, — হইছে থাম! লাজ লজ্জার বালায় নাই। এখন হাত নিয়ে করবিডা কি সেইটা বল? বাড়িতে দুনিয়ার কাজ। দুইজনতো হাসাপাতাল গিয়া ফেরার নাম নাই। এখন? এই হাত ডাক্তার ছাড়া ঠিক হইবো না।

হাসপাতালের কথা শুনতেই জয়তুন হাসলো! হেসেই বললো, — যা ডাক্তোরের কাছে যা। রাত বেশি হইলে আর পাবি না।

শাহবাজ কথা বাড়ালো না। এমনিতেও সে বেরোতো। সারাদিন কাজ ঝামেলায় বেরোনো হয়নি। তাই উঠতেই বীণা বললো, — ছোট ভাই আমিও যাবো।

শাহবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — কই?

— পৃথিলা আপাকে দেখতে।

শাহবাজ নিজের রুপে ফিরে এলো! এসে তার মতোই বললো, — কোন দরকার নেই। দাদির শরীর ভালো না, চুপচাপ দাদির কাছে থাক।

— আম্বিয়াবু আছে তো। তাড়াছা দেখেই তো চলে আসবো।

— না, মানে না।

বীণার মুখ অন্ধকার হলো। একটা কদমও যদি নিজ ইচ্ছায় ফেলা যায়। তবে সবাইকে অবাক করে জয়তুন বললো, — যা, এই শাহবাজ নিয়ে যা। ও আয়নামতি তুমিও যাবা নাকি?

আয়না হা হয়ে গেলো। এতোক্ষণের ফোঁপানি ফুরুৎ করেই গায়েব হয়ে গেলো। বাবারে, সূর্য আজকে কোন দিকে ডুবলো। ধুর! বারো ঝামেলায় সে তো খেয়াল’ই করেনি।

শাহবাজ বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বললো, — কোন দরকার?

— আহা যা তো নিয়ে। আজ বাদে কাল যাইবো শ্বশুর বাড়ি। তখন আর কই আবদার রাখবো। মাইয়াগো তো যতো আবদার বাপ ভাইগো কাছে’ই।

শাহবাজ আর কিছু বললো না। নিজের মতো বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে বললো, — নৌকায় আছি আমি।

শাহবাজ বেরুতেই বীণাও নিজের রুমের দিকে গেলো। যাওয়ার সময় টেনে আয়নাকেও নিয়ে গেলো। এর যে অবস্থা আগে একে তৈরি করতে হবে। আর যেতেই আম্বিয়া পানির বালতি হাতে নিতে নিতে বললো, — কোথাকার কোন মেয়ে, তার জন্য সবার এতো মাতামাতি। তোমার চোখে বাজে না?

জয়তুন তার চিরচেনা খিক খিক করে হাসলো! হেসে বললো, — দুই দিনের গ্রামের মেহমান। করুক না একটু মাতামাতি। মেহমানদের নিয়ে মাতামাতি না করলে আল্লাহ নারাজ হয় রে আম্বিয়া।

আম্বিয়া মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। প্রাণের সখা মরছে দু’দিন। দেখো তার মধ্যে’ই শুরু হয়ে গেছে জয়তুনের জয়তুনগিরি।

সন্ধ্যার পরে ফরহাদ আবার এলো। এসে এবারো এরশাদ কে পেলো না। এই ছেলে বসে থাকে কখন? ইটের ভাটায় কাজ পড়েছে, তাই সেখানেই নাকি গেছে। তাই সোজা পৃথিলার কাছেই এলো। ছোট চাচা আগের মতোই আছে। তবে সকালের চেয়ে চোখ মুখ আরো শুকনো দেখলো। সে এগিয়ে বললো, — কোন সমস্যা ছোট চাচা?

জাফর বড় একটা শ্বাস ফেললো। আসলে টেনশনে তার হাত পা ঘামছে। এরশাদ এক ফাঁকে হাতে তুলে দিলো। ইমদাদুল কি লিখেছে চিঠিতে! আর পৃথিলাকে খুনি ভাববে কেন? সে এখানে ছিল। তাছাড়া খুন তো করেছে। জাফর আর ভাবতে পারলো না। রক্ত আর স্নেহের মাঝামাঝি পড়ে তার অস্থির লাগছে। আর এতো এতো অস্থিরে চিঠিতো পড়েছে তবে হাতের লেখা খেয়ালও করেনি। তাছাড়া সময় ভেদে মানুষের লেখার ধরণও পরিবর্তন হয়। ইমদাদুলের সাথে বলতে গেলে চিঠি আদান প্রদান হয় অনেকটা সময় পরপর। তাই ধরতেও পারলো না।

পৃথিলা নিজেও খেয়াল করেছে। ক্লান্ত ছিল, তবে দুশ্চিন্তায় না। হঠাৎ করেই কোন টেনশন লোকটাকে জেঁকে ধরেছে। সিধেসাদা মানুষ। মুখাবয়বে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাই সে একবার মুখ ফুটে জিজ্ঞেস’ই করলো,- কোন সমস্যা হচ্ছে আপনার?

আর সে সব সময়ের মতো’ই স্নেহভরা মুখে হাসলো। হেসে বললো, — তুমি চুপচাপ আরাম করো তো। আমাদের চারিদিকে দুনিয়ার কাজ। কতো নানান ঝামেলা। এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।

পৃথিলা আর ভাবেনি। তাছাড়া ভাববে সেই অবস্থা তার বলতে গেলে নেইও। জ্বর নেই। তবে মাথা সোজা করতে পারছে না। কেমন ঘেন ঘোলা ঘোলা। আর এই কারণে’ই ডাক্তার আজকে আর তাকে ছাড়ার অনুমতি দেয় নি। একেবারে কাল।

পৃথিলা শুনে’ই খুব করে জাফরকে বললো সবাইকে নিয়ে চলে যেতে । নার্স আছে, তাছাড়া সে থাকতে পারবে। এখন তেমন সমস্যাও নেই। এরা শুনলে তো। আর শুনছে না বলেই, পৃথিলার অস্বস্তি কিছুতেই কাটছে না। ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর এই বোঝা কমাবে কি করে?

জাফর ফরহাদের কথার উত্তর দিলো না। হালকা হাসলো! হেসে পাশে’ই বেডে টেনে বসালো।

ফরহাদ বসলো! বসতেই চিঠির কথা মনে পড়লো। আর পড়তেই ছোট চাচার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝতে বাকি রইল না। তাই মনে মনেই বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে পৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — আপনি ঠিক আছেন?

পৃথিলাও হালকা হেসে বললো, — ভালো।

— এমন বিপজ্জনক জ্বর বাঁধালেন কি করে?

— বুঝতে পারছি না। হয়তো আপনাদের মিঠাপুকুর আমাকে পছন্দ করছে না।

ফরহাদ হাসলো! হেসে বললো, — এমনও হতে পারে অনেক বেশি’ই পছন্দ করে ফেলেছে।

— না, যেখানে পছন্দ শব্দ আছে, সেখানে কষ্ট শব্দটা আসে না।

— ওহ আপনি তো আবার জ্ঞানী মহীয়সী নারী। বলছেন যখন ঠিক’ই হবে।

— আপনি বুঝি না?

ফরহাদ আবারো হাসলো! হাসতেই আয়না, আর বীণা এসে দাঁড়ালো। আয়না স্বাভাবিক তবে বীণা হকচকিয়ে গেলো। সে ভাবেনি ফরহাদ ভাই এখানে থাকবে। জানলে কখনও আসতো না।

ফরহাদ অবশ্য স্বাভাবিক। স্বাভাবিক ভাবেই একবার তাকালো। তাকিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে সাইড হলো।

জাফর হালকা হেসে অবাক মাখা কণ্ঠে’ই বললো, — তোরা এখানে?

বীণা নিজেকে সামলে নিলো। নিয়ে বললো, — ছোট ভাই হাতে ব্যথা পেয়েছে।

বীণার বলতে দেরি, ফরহাদের হাসতে দেরি হয়নি। সে হেসেই বললো, — ছোট চাচা, সারেং বাড়ি এবার ছাড়ো। এই সদরে একটা বাড়ি করে ফেলো। বিশ্বাস করো যেই ভাবে তোমার গুষ্টির মানুষ সিরিয়াল বাই সিরিয়াল আসা শুরু করেছে। এ ছাড়া আর উপায় নেই। একদম নেই।

বীণা কটমটিয়ে তাকালো! ফরহাদ ফিরে দেখলে তো। সে দেখলো আয়নাকে। যে তার সাথেই ঠোঁট টিপে হাসছে। তাই তাকেই বলল,– কি খবর আয়নামতি। সারেং বাড়ির ভাত কেমন লাগছে?

আয়না মুখে কিছু বললো না, তবে আস্তে করে ঘাড় কাত করলো। এই কাতের অর্থ কি ফরহাদ বুঝলো না। তবে হাসলো। হাসলো জাফরও। হেসে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, — শাহবাজ কই?

— হাড়ের ডাক্তারের কাছে গেলো।

জাফর আর কিছু বললো না, এগিয়ে গেলো। পাগল ওইটা। নিশ্চয়’ই মুখ ফুলিয়ে আছে। দাদি ছাড়া এটা কাওকে চেনে না। ফরহাদ নিজেও যাওয়ার জন্য এগুলো। এখানে দাঁড়ালে তার মেজাজ খারাপ ছাড়া কিছুই হবে না।

তবে দাঁড়ালো পৃথিলার কথার। সে বললো, — ফরহাদ সাহেব, বিয়ে কখনও হেলাফেলার জিনিস হয় না। এখানে দু’টো মানুষের সারা জীবনের ব্যাপার।

ফরহাদ ফিরে তাকালো। তাকিয়ে আরেকবার বীণার দিকে তাকালো। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ ফিরিয়ে বললো, — দুনিয়ার সব কিছুই হেলাফেলা। এই যে আপনি এতো সিরিয়াস হয়ে ভালোবাসলেন, বিয়ে করলেন, সংসার সাজালেন। আপনাদেরও সারা জীবনের ব্যাপার হওয়ার কথা ছিল, হয়েছে?

পৃথিলা মলিন ভাবে হাসলো! হেসে বললো, — আমার হয়নি বলে অন্য কারো হবে না, এমনতো কথা নেই।

— সত্য, তাই হেলাফেলায়ও সারা জীবনের ব্যাপার হবে না এমন কোনও কথা নেই। হয়ত হবে, আপনার চেয়েও ভালো হবে। তবে আমি তো এই হেলাফেলার বিয়ের জন্য জোর করছি না, এখানে যার যার পরিবারের মানুষ, সেই পরিবারকে যদি কেউ বোঝাতে না পারলে সেই দায় আমার না।

— বুঝলাম, অন্য বাড়ির মেয়ের দায় আপনার না। তবে এই যে হেলাফেলা বিয়ে, এই বিয়ের পরে সেই দায়টা কি নেবেন?

ফারহাদ উত্তর দেয় না। শান্ত চোখে তাকালো। পৃথিলা আগের মতোই হেসে বললো। আমার সিরিয়াস বিয়ে সারা জীবনের ব্যাপার স্যাপার না হলেও। যেই কয়দিনের ছিল আমার সব দায় তার’ই ছিল। আমার ভুল, আমার কষ্ট, আমার স্বপ্ন। কোন কিছুই সে হেলাফেলা করেনি। বরং নিজে আগলে নিয়েছে। দোয়া করি আপনার হেলাফেলার বিয়ে সারা জীবনের হোক। বাপের ঘাড়ে সব দায় ফেলে হলেও হোক।

ফরহাদ এবারো উত্তর দিলো না। উত্তর না দিলেও পৃথিলা সেই প্রথম দিকের মতো শক্ত চোয়াল দেখলো, চোখে আগুন দেখলো। দেখে বললো, — রক্ত মাংসের তৈরি একটা মানুষের বিয়ে করছেন। সে বয়সে ছোট হোক বা বড়। আগে সম্মান করতে শিখুন। আল্লাহ আপনাকে সব কিছুই দিয়েছে তবে এই একটা জিনিসের বড়’ই অভাব। হয়তো কোন কারণে। তবে সব মানুষ এক হয় না। এই যে দেখেন আমি কিন্তু দুনিয়ার সব পুরুষকে ঘৃণা করছি না। অথচ মাপার যদি পাল্লা থাকতো আপনার চেয়ে আমার ধোকার পাল্লার ওজন অনেক বেশি হতো।

ফরহাদ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। হেসে এবারো কিছু বললো না। বীণার দিকে আবারো এক পলক তাকালো। তাকিয়ে চলে গেলো। আর বীণা অবাক হয়ে আগের মতোই বসে রইল। ফরহাদ ভাই কারো কাছে ধোকা খেয়েছে নাকি?

পৃথিলা বীণার অবস্থা বুঝলো। বুঝে বললো, — মেয়েদের জীবন, সেটা স্বপ্নের দুনিয়া হোক আর সংসারের। কোনটাই ফুলে বিছানো হয় না। এবড়ো থেবড়ো কাটা যুক্ত। যেই রাস্তায়’ই যাও। ক্ষত বিক্ষত হতে হবেই।

বীণা বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — স্বপ্নের জন্য ক্ষত বিক্ষত হলেও কষ্ট লাগে না।

— তা লাগে না। তবে স্বপ্নের সেই ক্ষত বিক্ষত হতে হলে চেষ্টা করতে হয়। তুমি কি কোন চেষ্টা করেছো বীণা?

বীণা উত্তর দেয় না। অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। পৃথিলা সেই অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, — আয়না আর তোমার মাঝে পার্থক্য কি জানো? সে কিন্তু তার জন্য চেষ্টা করেছে, জীবন সম্মান সব বাজি রেখে চেষ্টা করেছে। তবে ভাগ্যের কাছে হেরে গেছে। তবে তুমি বিনা চেষ্টায় হেরে গেছো।

— আমি কি করবো?

— সেটা তোমার ঠিক করতে হবে।

— সেই শক্তি কি আমার আছে?

— স্বপ্নের পেছনে দৌড়াতে হলে শক্তি লাগে না। লাগে ইচ্ছে।

বীণা আর কিছু বলে না। আয়না এগিয়ে বীণার হাত ধরলো। শক্ত করেই ধরলো। সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষকে ঘৃণা করলেও এই মেয়েটাকে আর করে না। করে না বলেই, তিন প্রান্তের তিনটা মানুষ কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল। বলার মতো তো কিছু নেই। তিনজন হলো খোলা বইয়ের তিনটা পৃষ্টা। যার শব্দ গুলো ভিন্ন, তবে শুরু আর শেষ একই মলাটে আবদ্ধ।

সেই বসার মাঝেই কালাম এসে তাদের ডেকে গেলো। রাত হচ্ছে বাড়ি ফিরতে হবে। বীণা চুপচাপই উঠে গেলো। তবে আয়না গেলো না। সে এগিয়ে পৃথিলার বেডের কাছে গেলো। গিয়ে চিন্তিত ভাবে দাঁড়ালো।

পৃথিলা দেখে বললো, — কিছু বলবে আয়না?

আয়না মাথা নাড়ালো। পৃথিলা হেসে বললো, — কি?

আয়না তার স্বাভাব মতো আস্তে করে বললো, — আপনি এখান থেকে চলে যান আপা।

পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাঁকাতেই আয়না সাবিহাকে জয়তুনের বলা সব কথা বললো। বলতে বলতেই বললো, — সারেং বাড়ির একটা মানুষটা ভালো না আপা। এরা নিজেদের জন্য সব করতে পারে। আমাদের তো যাওয়ার জায়গা নেই। আপনার আছে। তাই সময় থাকতে চলে যান। এখানে থাকলে এই বুড়ি আপনাকে ছাড়বে না।

পৃথিলা কিছু বলতে পারলো না। তার নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই। তবে সাবিহার জন্য খারাপ লাগলো। তার জন্য মেয়েটার সাজানো গোছানো দুনিয়া এলোমেলো হচ্ছে। তাই তার শান্ত কণ্ঠে’ই বললো, — ধন্যবাদ আয়না! তুমি না বললে হয়তো আমি বুঝতেও পারতাম না।

— আপনি কষ্ট পেয়েছেন?

— না! বরং এই যে আমার জন্য ভাবছো। এটা জেনে ভালো লাগছে।

— আসি।

— যাও, নিজের খেয়াল রেখো।

আয়না বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আপন মনেই বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে একবার যদি একটু দরজার সাইডে তাকাতো। তাহলেই তার অসুর নামের ভাসুরকে ঠিক দেখতো। যে সব সময়ের মতো শান্ত ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই শান্ত ভাবেই পকেট থেকে সিগারেট ঠোঁটে রাখলো।

তখনি পৃথিলা চোখ বুঝলো। মিঠাপুকুরের পাট হয়তো তার জন্য শেষ হলো। আর ঠিক তখনি নাকে সিগারেটের গন্ধ লাগলো। লাগতেই ফট করে তাকালো। তাকিয়ে অবশ্য কাউকে’ই দেখলো না। তবে হাসপাতালের ভেতরে সিগারেট খাওয়ার মতো সাহস একজনেই আছে। সেটা কে বুঝতে তার এক সেকেন্ডও লাগলো না।

চলবে…..

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩২

ঘড়ির কাঁটা তখন এগারোটা ছাড়িয়ে গেছে। নিস্তব্ধ সারেং বাড়ি রাতের নিস্তব্ধতায় তখন আরও মুড়িয়ে গেছে। সেই নিস্তব্ধতার চাদর ভেদ করে শাহবাজ ফিরল ক্লান্ত ভাবে। হাত তার গলায় ঝুলানো। অতিরিক্ত কিছু না হলেও, হালকা নাকি চির ফাটা মতো হয়েছে। তাই প্লাস্টার করে একেবারে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন রাখতে হবে। তারপর গিয়ে খুলবে। নড়াচড়া একদম বন্ধ।

সবই ঠিক আছে, তবে নড়াচড়া বন্ধের কোনও লক্ষণ তার মধ্যে দেখা গেল না। একবার এদিকে নিচ্ছে তো আরেকবার ওদিকে। একবার দেখা গেল গলার রশি গলায় ঝুলছে, হাতের মতো হাত । কয়েক ঘণ্টায় মাঝেই এই বান্দা বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে ।

সেই বিরক্তি নিয়েই বন্ধ দরজায় একসাথেই ধুমধুম করে কয়েকটা ফেলল। আম্বিয়া দৌড়ে এলো, এসে সঙ্গে সঙ্গে খুলল। খুলতেই বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল,
— এর চেয়ে ভালো ভাইঙা ফালা। অযথা আর খোলার ঝামেলা নাই।

শাহবাজ উত্তর দিল না। ঘেমে শরীর কুটকুট করছে। ফ্যান ছেড়ে আয়েশ করে বসার ঘরে বসলো। বসে বললো, — ভাঙা আমার জন্য ব্যাপার না। কিন্তু সমস্যা হলো তোমরা বাড়িতে বসে বসে করবাটা কি?

আম্বিয়া অবাক হয়ে বলল, — তোর ধারণা দরজা খোলা ছাড়া আর কোন কাজ করি না?

— না!

— ভালো! তয় একদিন নিজ ঘাড়ে এই কাজ নিলেও তো পারেন।

— না পারিনা, তাহলে তোমাদের রাখছি কি জন্য?

— তাও কথা! দরজা খোলার বান্দি আমরা।

শাহবাজ হাসলো! হেসে বললো, — দাদি ঘুমিয়ে গেছে?

— হুম!

— বীণা?

— ঘুমে।

— আয়নামতি ?

আম্বিয়া থমকালো! শাহবাজ বেশিভাগ সময়’ই রাত করে ফেরে। মাঝে মাঝে তো হুঁশও থাকেনা। তবে যেইদিন মন ভালো থাকে, সেই দিন এভাবে বিনা কারণে কথা বলবে। সবার খোঁজ টোঁজ নেবে। তবে আয়নামতিরও নেবে, এটা অবাক হওয়ার’ই ব্যাপার। যাক মন লাগলো তাহলো। সে হেসে’ই দরজা লাগাতে এগুলো। লাগাতে লাগাতে বলল, — ঘুমিয়ে গেছে হয়ত। সদর থেকে ফিরে কোনরকম কয়টা খেয়ে’ই উপরে গেছে। আর নিচে নামেনি।

শাহবাজ হাসল! তার সেই চিরচেনা হাসি। হেসে ঝট করেই উঠল। উঠে উপরে যেতে নিল। আম্বিয়া দেখে বলল, — ভাত খাবি না?

— খাবো।

— তাহলে?

— তুমি শুয়ে পড়ো।

আম্বিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকাল। প্রথমে সে বুঝতে পারল না। বুঝল, দু’তলার রুমের দরজাতেও যখন ‘ধরাম’ করে দুটো পড়ল। এই মেয়েটাকে আর শান্তি দেবে না।

আয়না আজকেও ধড়ফড়িয়ে উঠল। শাহবাজের হাতে কী কী নাকি করবে, সময় লাগবে, তাই কালাম ভাইকে দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আর এসে কিছু তো করার নেই। খেয়ে শুতেই চোখ লেগে গেছে।

আবার দরজায় ‘ধরাম’ করে একটা পড়ল। আয়না তাড়াতাড়িই উঠল। কে সে ভালো করেই জানে। আর উঠেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলল। খুলতেই দেখল, সাদা আবরণে মুড়ে, গলায় হাত ঝুলিয়ে শায়তানটা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। সেই বিরক্তি নিয়েই দু’ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসল। হেসে বলল, — প্রথম আর শেষবার বলছি, আমার রুমে আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন দরজায় খিল না পড়ে।

কাঁচা ঘুম ভাঙায় আয়না এমনিতেই হতভম্ব হয়ে আছে। তার মাথায় আগা, মাথা কিছুই ঢুকল না। তবুও ঘাড় কাত করল।

শাহবাজ পুতুলের মতো সেই ঘাড় কাতটুকু দেখল। আর দেখতেই খেয়াল করল, সব বিরক্তি, ক্লান্তি, এই যে হাতে যন্ত্রতা হচ্ছে তাও হাওয়ায় মিশে গেলো। অবশ্য আয়নাকে বুঝতে দিল না। আগের মতোই চোখ মুখ কুঁচকে ভেতরে এলো। খাটে বসলো। বসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
— হাত, মুখ ধোব। গরমে ঘামে গা কুটকুট করছে। গেঞ্জিটা খুলে দাও।

আয়নার ফট করেই ঘুমের তন্দ্র কেটে গেল। হা হয়ে বলল,– কী করবো?

— কী করবো মানে কী? হাত ভেঙেছে কার জন্য? তাছাড়া স্বামীর সেবা করবেটা কে?

আয়না মাথা নাড়লো। তাও ঠিক! তাছাড়া এই হাত দেখে তার নিজের আবার আফসোস হচ্ছে। ইশ! সারেং বাড়ির মানুষ শয়তান। সেও কি দিন দিন তাই হয়ে যাচ্ছে নাকি?

শাহবাজ আয়নার মুখটা দেখলো! দেখে বললো, — খুলবে ভালো কথা, তবে খুব সাবধানে। হাতে আমার দুনিয়ার ব্যথা। ছুঁলেও ব্যথা, দেখলেও ব্যথা। আর ডাক্তারে সোজা বলেছে, কোন নড়চড় করা যাবে না।

— না নড়ালে খুলবো কেমনে?

— সেটা যদি জানতাম, তাহলে তোমার আশায় বসে থাকতাম?

— তাও কথা। বলেই আয়না তার ঘুম ঘুম মায়াময় মুখটায় দুঃখের ছায়া নিয়ে এগিয়ে গেল। শাহবাজের গায়ে কালো গেঞ্জি, আটসাঁটভাবে লাগানো। এটা সে কীভাবে খুলবে, তার মাথায় ধারের কাছেও এলো না। সে একবার এই দিক, আরেকবার ওই দিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে কপালে কয়েকটা ভাঁজ নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে দেখতে লাগল। হাত না নাড়িয়ে আসলে খুলবেটা কি করে?

শাহবাজের দৃষ্টি আয়নার মুখের ওপর। ঠোঁটে কোণে হাসি! সেই হাসি নিয়েই আরও আয়েশ করে বসল। তার বউ প্রথম তার শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ভালো করে দেখুক। সে আয়েশ করেই বসে বলল,– দেখতে সমস্যা হচ্ছে না তো? আরেকটু নড়ে চড়ে ভালো করে বসবো?

আয়না শাহবাজের খোঁচা বুঝল না। সে মুখ গুঁজ করে আবারো বলল,– এই গেঞ্জি কেমনে খুলবো ?

— আমি কী জানি?

আয়না বড় বিপদে পড়েছে এমন মুখ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,– আপনাদের তো টাকা পয়সার অভাব নাই। কেটে ফেলি? একটা গেঞ্জিতে আর এমন কি হইবো?

— অভাব নেই বলে কেটে সব ফালাফালা করে ফেলবে? তোমার মতো বিনাশকারী বউ তো সারেং বাড়িতে এই পর্যন্ত আর একটাও আসেনি।

আয়না অসহায়বোধ করলো। করে মুড়িয়ে মুড়িয়ে কোন রকম গলা পর্যন্ত আনলো। তারপরে শেষ! করবেটা কি? দুনিয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে, বলতে গেলে গেঞ্জির পেছনে উঠে পড়ে লাগল। লাগতে লাগতে অনেক কষ্টে কনুই পর্যন্ত আনলো। এমন ভাবে আনলো, শাহবাজের গায়ে যেন না লাগে। আর এনে বিশ্বজয়ের হাসি হাসলো। এই তো আর একটু আনতে পারলেই হলো।

বলতেই তার টনক নড়লো। সে শাহবাজের দু’পায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মাঝেই নয়, বলতে গেলে অনেকটাই কাছে। গলায় দু’হাত। নিচু হয়ে খোলার জন্য মুখটাও কাছাকাছি হয় আছে। আর আছে বলেই পিঠ বেয়ে শীতল একটা স্রোত তার বয়ে গেল।

শাহবাজ বসে আছে আগের মতোই। আগের মতোই দৃষ্টি আয়নার মুখে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— হাতটা ভাঙা, তার মধ্যে এই প্লাস্টার… আফসোস হচ্ছে।

আয়না তার মতো আস্তে করেই বললো — কিসের?

— জানতে চেয়েও না। রাগ ঢাক আমার মুখে নেই। তাই নাও, বাকিটুকু খুলো। নাকি সারা রাত এমন উধুম ভধুম করে বসিয়ে রাখার ইচ্ছা?

আয়না এতোক্ষণ খেয়াল করেনি তবে চোখের সামনে শাহবাজের খালি গা দেখে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। তাই আর কোন কথা বাড়াল না। বরং এতোক্ষণ হাত না কাঁপলেও এখন কাঁপা শুরু হলো। আর সেই কাঁপা কাঁপা হাতে’ই গেঞ্জি খুলতে খুলতেই আস্তে করে পায়ের মাঝ থেকে বেরোতে চাইলো। আর ঠিক তখনই শাহবাজ কোমর চেপে ধরলো। আর আয়না “মাগো” বলে লাফিয়ে উঠল। উঠে আর ঘরের মেঝেতে পা রাখল না, রাখল একেবারে শাহবাজের পায়ের পাতায়।

শাহবাজ চোখ মুখ কুঁচকালো। কুঁচকে বলল,
— শালার বিয়ে! আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ঘুম তো ভালোই হাত, পা সব যাচ্ছে। বলেই কোমর ছেড়ে দিলো। দিয়ে চোখ মুখ কুঁচকেই ধমকে বলল,
— বাকিটুকু আমি খুলছি। যাও, খাবার নিয়ে আসো।

আয়না বলতে গেলে দৌড়ে পালালো। এই ব্যাটার আজ মতিগতি ঠিক নাই, ঠিক বুঝল। আর বুঝল বলেই, হাত ভাঙার জন্য আর আফসোস হলো না। বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তবে সেই বাঁচা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খাবার আনতেই বলল,
— খাইয়ে দাও।

আয়না অবাক হয়েই বলল,
— হাত ভেঙেছে বামটা, ডান হাতে কী?

— ডান হাতে আফসোস। আসেন এদিকে আসেন, বুঝিয়ে বলি।

আয়না গেল না। বরং তাড়াতাড়ি ভাতের প্লেট হাতে নিল। আবার ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’! এইটার মাথা বিগড়াতে সময় লাগে না। তাছাড়া, এই রাত-বিরাতে যাবে কোথায়? সেই তো এই রুমেই মরতে হবে। তাই যেভাবে বলে, সেভাবেই করা ভালো।

আয়না সুন্দর করেই চুপচাপ খাওয়াল। খাইয়ে ঔষুধ খাওয়ালো। ঔষুধ পাঠিয়েছে এরশাদ ভাই। এই শয়তান প্লাস্টার করেই গায়েব। এই যে ঔষুধ খাওয়ালো, কোথা থেকে খাওয়ালো। সেই খবরও নাই। এমন আজব কিসিমের মানুষ সে ইহজীবনেও দেখেনি।

খাইয়ে সব কিছু নিয়ে আবার নিচে গেলো। গুছিয়ে রেখে এসে দেখল শাহবাজ শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ, হাত গুছিয়ে বুকের উপরে রাখা।

আর এই শোয়া দেখেই আয়নার মাথায় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজতে লাগল। বিয়ের পরে বলতে গেলে এই প্রথম, একই রুমে এক’ই খাটে পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে থাকা। আর থাকা বলেই আয়নার গলা শুকিয়ে এলো। এমনিতেও এই শয়তানের হাব ভাব তার ভালো ঠেকছে না। তাই শুকনো একটা ঠোক গিলেই আস্তে করে দরজায় খিল দিল। বাতি কি নেভাবে? সেটা জিজ্ঞেস করারও সাহস হলো না। সে ঘুমিয়েছিলো বাতি জ্বালিয়ে, এখন নিশ্চয়’ই তা সম্ভব না। তাই বুকে সাহস নিয়ে আস্তে করে বাতি নেভাল। নেভাতেই পুরো রুম অন্ধকারে তলিয়ে গেল। ভয়ে সে সব জানালা টানালা লাগিয়ে দিয়েছে, পর্দা ফেলেছে। তাই আলোর ছিটেফোঁটাও নেই।

সেই অন্ধকারে হাতড়ে এগুতে গিয়ে খাটের পায়ে তার পা খেলো এক বাড়ি। বাড়ি খেয়েই কুঁকিয়ে উঠল। শাহবাজ ভালো মন্দ কিছুই বললো না। নড়ে ওপাশে শুতে শুতে শুধু বলল,– শালার প্লাস্টার!

আয়না শুনলো! শুনে সেও কিছু বললো না। খুঁড়াতে খুঁড়াতে’ই আস্তে করে শাহবাজের ঠিক বাম পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।

সকালে পৃথিলার ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। ঔষুধের প্রভাব থেকে হোক, আর জ্বরের রেশ থেকেই হোক। ঘুম দিয়েছে গাঢ় । সেই গাঢ় ঘুম ভাঙতে ভাঙতেই বেশ বেলা হলো। বেলা হলেও মাথাটা আজ আর ঘোলা ঘোলা লাগছে না। বরং বেশ হালকা লাগছে। সেই হালকা মাথা নিয়ে’ই চোখ খুলল।

তার জায়গায় অন্য কোনও মেয়ে হলে হকচকিয়ে যেত, নয়ত বিস্ময়ে বাক্য হারা হতো। তবে পৃথিলাম মাঝে তেমন কিছুই দেখা গেলো না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই উঠে বসলো। হাসপাতেলর সাদা চাদরের নিচে গায়ের কাপড় একদম ঠিক। তবুও আঁচলটা পেছন থেকে এনে সুন্দর করে গায়ে জড়ালো।

জড়িয়ে দরজার বাইরে তাকালো! জাফর চাচা কোথায়?

এরশাদ পৃথিলার ঠিক সামনে বসা। চেয়ারে! দৃষ্টি অবশ্য পৃথিলার দিকে নেই। তার দৃষ্টি তার পায়ের দিকে। আর সেখানে রেখেই তার সুন্দর, শান্ত, মার্জিত সুরে বললো, — ছোট চাচা নাস্তা করতে গেছে। এসে পড়বে।

গত দু’দিন এই লোক তাদের সাথেই হাসপাতালে ছিল। তবে কোন কারণে দরজা পেরিয়ে কেবিনে আসেনি। এক বারের জন্যও আসেনি। কেন আসেনি পৃথিলা এখন বুঝলো। তার আসায় সে স্বাভাবিক থাকতে পারতো না। এই যে অন্য রকম একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে। হয়ত এটার জন্যই আসেনি। তবে আজ কেন?

পৃথিলা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। লোকটা এখনো চোখ তুলে তাকায়নি। কিন্তু সে দরজার দিকেই তাকিয়েছে, ঠিক বুঝেছে। কিছু কিছু মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় খুব তীক্ষ্ণ হয়। হয়তো এই লোকটারও এমন কিছু। অথচ এই ঘাগু রকমের লোকটাকেই পৃথিলার সারেং বাড়িতে পা রেখেই খুব পরিচিত মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, কিছু লোক দেখলে দ্বিধা আসে না, সংকোচ আসে না, ভয় আসে না। অথচ কি সুন্দর মানুষের চোখে পর্দা ফেলে।

পৃথিলার নিজের প্রতি নিজের’ই হাসি পেলো। আবারো হাতে নাতে প্রমাণ পেলো, মানুষ চিনতে কতোটা অপটু সে। প্রথমে তারেক, আর এখন এই যে সামনে বসা মানুষটা।

তখনি এরশাদ চোখ তুলে তাকালো! তাকিয়ে দরজার দিকে ফেরা পৃথিলার মুখটা দেখলো। দেখে বললো, — আপনি ঠিক আছেন?

পৃথিলা সে কথা উত্তর দিলো না। বরং তার শান্ত স্বরে বললো, — আমাকে ছাড়বে কখন?

— সব হয়ে গেছে। আপনি ঘুমে ছিলেন তাই ডাকিনি।

— ওহ!
— নাস্তা দিতে বলি?
— না! একেবারে বাড়িতে ফিরে খাবো।
— ঔষুধ আছে আপনার।
— একটু পরে খেলে সমস্যা হবে না। আমি নার্সদের সাথে কথা বলে নেবো।

বলেই পৃথিলা ধীরে ধীরে নামল। এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তবে তার পা খালি। সেই দিন কিভাবে এসেছে সে জানে না। তবে খুব যে ভালোভাবে আসেনি, সেটা ঠিক জানে। জানে বলেই কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না। খালি পা নিয়েই নামার চেষ্টা করল। আর করতেই এরশাদ দাঁড়াল। সাইডের একটা ব্যাগ থেকে নতুন একজোড়া জুতা পৃথিলার পায়ের কাছে রাখল। রাখতে গিয়ে সে ঝুঁকলো একেবারে পৃথিলার পায়ের কাছে। পৃথিলা হকচকিয়ে গেল।

এরশাদ স্বাভাবিক! স্বাভাবিক ভাবেই রেখে উঠতে উঠতে বলল, — আর কোন সমস্যা নেই তো?

পৃথিলা আগের মতোই শান্তভাবে বলল, — না। না বলেই যেভাবে বসে ছিলো সে ভাবেই বসে রইল। জুতার ধারের কাছেও পা নিলো না। এরশাদ সেই জুতার দিকে তাকিয়ে বলল, — সিগারেট ধরালে সমস্যা হবে?

পৃথিলা আগের মতোই শান্তভাবে একটা শব্দই বলল, — না।

এরশাদ সিগারেট ধরালো। ধরিয়ে নিজের মতো টান দিলো। দিয়ে শান্ত স্বরে’ই বলল, — সোজাই বলি। অবশ্য ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললেও সমস্যা নেই। আপনি বুদ্ধিমতি মানুষ। ঝট করে বুঝে ফেলবেন। অবশ্য আমার ধারণা এতোক্ষণে বুঝেই গেছেন। তাই ছোট করে এক বাক্য’ই বলি, — আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

পৃথিলা অবাক হলো না। কোনো বাড়তি বিস্ময়ও দেখালো না। আসলে সে এমনি। তারেকের ব্যাপারটা জেনে যেমন শান্ত ছিল, এই যে সামনে বসা লোকটার সোজা কথায়ও তেমনি শান্ত’ই রইল। হ্যাঁ, না, হুঁ, কিছুই বলল না। তার দৃষ্টি আগের মতোই। দরজার দিকে। সে অপেক্ষা করছে জাফর চাচার। জাফর চাচা এলেই বাসায় ফিরবে। ভেবেছিল আরও দুটো দিন থাকবে। শরীরটাও ঠিক হলো, স্কুল, সবার কাছ থেকে সুন্দর করে বিদায় নেওয়া হলো। তবে সেটা আর সম্ভব নয়। এখন ফিরেই গোছগাছ করবে, সোজা দুপুরে ট্রেনে উঠবে।

এরশাদ শান্ত চোখেই দরজার দিকে তাকানো পৃথিলার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়েই সিগারেটে একের পর এক টান দিল। ছোট্ট কেবিন, ধোঁয়ার গন্ধে জমাট বেঁধে গেল।

পৃথিলার কষ্ট হচ্ছে। তবুও আগের মতোই বসে রইল। না ফিরে তাকালো, না টু শব্দ করলো। তবে এরশাদ উঠল। উঠে বাইরে যেতে যেতে বলল, — জুতাটা পায়ে দিন পৃথিলা। বিরক্তি, অবহেলা আমি নিতে পারি না।

পৃথিলা শুনল। শুনে আগের মতোই বসে রইল। তার কিছুক্ষণ পরে জাফর এলো। এসে ফেরার প্রস্তুতি নিলো। পৃথিলা তাকেও কিছু বললো না। শুধু একবার ইমরানকে খুঁজলো। সকাল থেকে আর দেখেনি। তার জন্য না এরা বিপদে পড়ে।

সব ঠিক হতেই পৃথিলা বেড থেকে নামল। খালি পায়েই নামল। নেমে নিজের মতোই এগিয়ে গেল।

এরশাদ ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিলাকে এগিয়ে আসতে দেখলো। খালি পায়েই দেখল! দেখে হাসল। সে প্রথম দিনের মতো সরল এক হাসি। পৃথিলাও সেই হাসি দেখল। দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল।

বীণা আজ টানা তিনদিন পরে বইয়ে হাত রাখলো। বেশ দৃঢ়তার সাথেই রাখলো। দুনিয়ার পড়া জমা হয়ে গেছে। তাই রেখেই ঝটপট খাতা কলম টেনে নিলো।

সারেং বাড়িতে আজ দুনিয়ার কাজ। কাল আলাউদ্দিনের জন্য দোয়া। পুরো এলাকার মানুষ খাবে। তাই তার আয়োজন চলছে। প্যান্ডেলের লোক এসেছে। তাদের হাক ডাকে সকাল সকাল’ই পুরো বাড়ি মুখরিত হয়ে গেছে। সেই মুখরিত কাজের মাঝে’ই আম্বিয়া বীণার রুমের দিকে গেলো ব্যস্ত ভাবে। বাসি কাপড় কি কি তুলে রেখেছে কে জানে। ঘরের কাজ টাজের ধারের কাছেও যায় না। রান্না পারে না । এই মেয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে করবেটা কি?

সেই গজগজ করতে করতেই রুমে এলো। এসে দেখলো বীণা বই খাতায় ডুবে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — বই খাতা রেখে, একটু ঘরের কাজ টাজে মন দে বীণা। শ্বশুর বাড়ি গেলে তো মান থাকবে না।

বীণা আম্বিয়ার কথা ধারের কাছেও গেলো না। বরং নিজের মতো অংক কষতে কষতে বললো, — কাউকে পাঠিয়ে ফরহাদ ভাইকে একটু খবর পাঠাও তো। বলো পড়াতে আসতে।

আম্বিয়া অবাক হলো। যার সাথে বিয়ে তাকে ডাকছে ভাই। আবার কি অবলীলায় বাড়ি আসতে বলছে। এই বাড়ির ছেলে মেয়েরা সব লাজ লজ্জা বেঁচে খেলো নাকি?

সে অবাক হয়েই বললো, — কিসের পড়া?
— আমার পরীক্ষার পড়া।
— কে পরীক্ষা দিচ্ছে?
— আমি।
— পাগল হয়েছিস?

বীণা উত্তর দিলো না। নিজেই বেরিয়ে গেলো। বাইরে এসে কালামকে দেখে বললো, — কালাম ভাই, কাউকে পাঠিয়ে ফরহাদ ভাই কে আসতে বলো। বলো আমি পড়ার জন্য আসতে বলেছি।

আম্বিয়া বিস্ময়ে খাবি খেলো। খেয়ে জয়তুনের রুমের দিকে গেলো। জয়তুন শুনলো শান্ত ভাবেই। তার অভিব্যক্তির তেমন পরির্বতন হলো না। তবে আম্বিয়া অবাকের পর আরেক অবাক হলো। কেননা এরশাদ ভাই তখনি ফিরলো। ফিরে সোজা নিজের রুমে গেলো। যেই দাদির সাথে দেখা না করে কখনোও বাড়িতে ঢুকে না, বাইরে যায় না। আজ দু’দিন পরে ফিরে না খবর নিলো না নিজে এগিয়ে গেলো। আসলে হচ্ছে ডা কি এই বাড়িতে?

চলবে…..