ধূপছায়া পর্ব-৩৩+৩৪

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব-৩৩

আয়নার উপর দিয়ে আজকে অনেক চোট গেল। সকাল থেকেই শুধু কাজ আর কাজ। আম্বিয়াবু পড়েছে পিঠা চিড়া নিয়ে। আর এদিকে রান্নাবান্নার সব দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে। রান্না সে পারে, তবে এতো মানুষের আয়োজন কখনও করেনি। তাদের বাড়িতে অল্প কিছু মানুষ, অল্প রান্নাবান্না। তাও বেশিরভাগই বড় মা করতেন। তাই বেগ পেতে হলো। অবশ্য কোটা বাছা থেকে শুরু করে সব কাজ কাজের লোক করেছে। তবুও এতো বড় বড় হাঁড়ি ঘোটা তো কম কথা না।

তাই নেয়ে ঘেমে কান্ত শরীর নিয়ে রুমের দিকে যেতে নিল, তখনই পেছন শাহবাজ ডাকলো, — এই যে সারেং বাড়ির কামুনি বউ।

আয়না সাথে সাথেই মুখ গুঁজে ফেললো। শয়তানটা আজকে বাড়ি থেকে বের হয়নি। বাড়িতেই দুনিয়ার কাজ, তার মধ্যে গলায় হাত ঝুলানো। তাই জয়তুন আরা সোজা বলে দিয়েছে, বাসায় থেকে যেন বাইর হতে না দেখেন। এটা তো আবার দাদির ঝুনঝুনি। যা বলবে, তাই করবে। করুক, সেটা তার সমস্যা না। সমস্যা হলো, তাকে জ্বালিয়ে মারছে। একটা জিনিসও গত রাত থেকে নিজে করছে না। সব তাকে দিয়ে করাচ্ছে। এমনকি সামান্য পানি খাবে, তাও ডেকে ডেকে মাথা ঘোলা করে। আসলে সমস্যা টা কি? দিব্যি হাত নেড়ে চেড়ে সব করছে, কিন্তু কাজের বেলা তার জান খেয়ে ফেলছে।

তাই সে মুখ গুঁজেই ঘুরে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই শাহবাজ দু’ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো! হেসে বললো,– গোসল করবো আমি, বসে আছি। তোমার তো দেখি খবরই নাই।

— আপনি গোসল করবেন, তাতে আমার কী?

শাহবাজ যেন আকাশ থেকে পড়ল। পড়ে অবাক মাখা সুরের নাটক করে বললো, — এখানে আপনি কে?

আয়না উত্তর দিলো না। সে সত্যিই ক্লান্ত। এই যে কোমরটা কেমন টাটিয়ে উঠছে। এখন গা একটু না এলিয়ে দিয়ে ঠুস করে এখানেই না পড়ে যায়।

শাহবাজ এতো কিছু বুঝলে তো! সে তার রঙে বললো, — এটা অন্যায় বউ। ভাসুর, চাচা শ্বশুরের সামনে তুমি। আর একলা পেলে ‘আপনি’। এটাতো আমি মানবো না।

— সেটা তো আপনিও বলেন। একবার তুমি, আপনি, আবার তুই।

— আমার সাথে তোমার তুলনা?

আয়নার গুঁজে থাকা মুখ আরও গুঁজালো। না, তুলনা হবে কেন? জয়তুন আরার নাতি আপনারা। সাত খুন যেখানে মাফ, সেখানে তুমি আপনি কোন গাছের ছাল। তাই গুঁজে’ই বললো, — কি হয়েছে সেটা বলেন। আপনি তুমি আপাতত থাক।

— আচ্ছা থাক, দিলাম ছাড়। সারেং বাড়ির বউ বলে কথা। এখন দশ কথার এক মুদ্দা কথা আপনার প্রাণ প্রিয় স্বামী গোসল করবে, ব্যবস্থা করেন।

আয়না হাল ছাড়লো। প্রাণ প্রিয় স্বামী না, প্রাণ খেকো স্বামী। বলেই রুমে গেল। রুম থেকে গামছা, লুঙ্গি নিয়ে গোসলখানায় রাখলো। রেখে এসে বললো, — সব গুছিয়ে দিয়ে এসেছি, যান।

— যান মানে? আমি কেমনে গোসল করবো?

— সব সময় কেমনে করেন?

— সব সময় আর এখন এক হইলো?

আয়না মাথা নাড়লো। নেড়ে তবুও আস্তে করে বললো, — হাতটা একটু সাইড করেই তো পানি ঢালতে পারেন।

— বউ থাকতে আমি কোন দুঃখে সাইড করে পানি ঢালবো। বিয়ের জন্য গায়ে আগুন দিতে গেছো, আর এখন সেবার বেলায় নাই?

আয়না হাত জোড় করলো। করে বললো, — মাফ করো আমায়। আমার অনেক ভুল হয়েছে। আসো, গোসলখানায় আসো।

শাহবাজ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে এগিয়ে গেল। গিয়ে সোজা গোসলখানায় পা ভাঁজ করে বুকটা টানটান করে বসলো। তার এমন ভাব যা খুশি করো।

আয়না কিছুই করলো না। ক্লান্ত ভাবে সেও সাইডে বসলো। বসে বললো, — একটা কথা বলি?

শাহবাজ সাথে সাথেই আয়নার ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকালো। এতো স্বাভাবিক স্বরে কখনও কথা বলেছে বলে মনে পড়ে না। সব সময় ভয়, আতঙ্ক আর বলার জন্যই বলা। তাই সেও স্বাভাবিক ভাবে বললো, — বলো!

— এসব কেন করছেন?

— শুনতে পারবে?

আয়না মাথা কাত করলো। সেই কাত করা মুখটা শাহবাজ দেখলো। দেখে তার সেই চিরচেনা হাসি হাসলো। হেসে বললো, — ইচ্ছে ইচ্ছে করে আঁচল সরিয়ে কোমর দেখিয়েছো। এখন আমার এই কোমর চাই।

আয়না থমকালো! সাথে এতো লজ্জা পেলো। শয়তানটার কাছ থেকে ভালো কিছুই আশা করা যায় না। তাই সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে ঝট করেই গোসলখানা থেকে চলে গেলো।

শাহবাজ স্বাভাবিক ভাবেই ডান হাতে মগ টেনে নিল। নিয়ে গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে বললো, — যার চোখে ছিল বিষের বান, সেই করলো হৃদয় হান। জিতে গেছোস রে কালনাগিনী। রাম বলদ তো তাই বুঝতে পারছিস না।

দুপুরে খেয়ে জয়তুন কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করেন। না, ঘুম আসেন না। এই বয়সে দুপুরে ঘুমালে রাতে আর চোখের পাতায় ঘুম নামে না। তাই এমনিই একটু আরাম করেন। তবে আজ আর গা এলিয়ে দিলেন না। বসলেন তার রুমের জানালার পাশে। তার রুম নিচের একেবারে সামনে। জানালা খুললেই পুরো উঠান সামনে ভাসে। তাই আজও ভাসলো।

অনুষ্ঠানের বিভিন্ন আয়োজন চলছে। তিনি সেই আয়োজন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। কাল থেকে হচ্ছিলো সব ঝিমিয়ে। সকালে শুধু এসে হাজির হয়েছে প্যান্ডেলের লোক। তবে এরশাদ ফিরতেই কাজের ধরণ বদলে গেছে। একদিকে যেমন চলছে প্যান্ডেলের কাজ, তেমনি আরেকদিকে চলছে সমান তালে কালকের রান্নার বাবুর্চির আয়োজন। একের পর এক আসছে ভ্যানভর্তি লাকড়ি। তেমনি বসে গেছে বাজার সদাইয়ের হাট। এক হাতে দশ কাজ করার গুণ এই ছেলেটার আছে।

জয়তুন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়েই বসলেন। অনুষ্ঠানটা নিয়ে তিনি চিন্তায় ছিলেন। যাক! ব্যবস্থা হলো তাহলে। দাওয়াত পৌঁছানোর সব দায়িত্ব শাহবাজ করেছে। এখন ভালোয় ভালোয় বাকি সব মিটে গেলেই হলো।

তখনই বীণা এসে দরজায় দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বললো, — ডেকেছো, দাদি?

জয়তুন বীণার দিকে ফিরে তাকালেন। তিন দিনে বিয়ের শোকে বিছানায় লেগে গিয়েছিল। কাল সদর কী গেলো, পুরো হোলই পাল্টে গেলো। এই শোক তো ভালোই, বিয়ের কোন লক্ষণ তিনি দেখলেন না। দেখলেন সেই আগের বীণা। মাথায় গুছিয়ে লম্বা বেনি, গায়ে রঙিন ওড়না, পায়ে সেই পা ঝাপ। কিছুদিন ধরে এই গান সারেং বাড়ির কোণায় বাজে না। তবে আজ সকাল থেকে ঠিক সুর তুলে গাইছে। আর এই গান এতোদিন ভালো লাগলেও, জয়তুনের এখন ভালো লাগলো না। অবশ্য বুঝতেও দিলেন না। বরং হেসে বললেন, — এমন কী রাজকার্য আছে, দরজায় দাঁড়িয়ে তাড়া দেখাস?

বীণা জানে কেন তাকে ডাকা হয়েছে। তাই কোন ঝামেলায় গেলো না। এসে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো। বসে বললো, — তাড়া কোথায় দেখালাম? জিজ্ঞেস করলাম।

— ভালো! তয় আজকাল অনেক কিছুই বুঝি নারে বুবু। তাড়া কী, অভিমান কী? এই যে দেখ, আমার বড় নাতি গাল ফুলিয়ে আছে, সেটাও বুঝি না।

বীণা উত্তর দিলো না। এরশাদ ভাইয়ের সাথে দাদির কী হয়েছে, সে জানে না। তবে উপরে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভয় করছে। কোন দিন দাদির কথার উপরে যাইনি। আর এখন বলতে গেলে তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে।

বীণা কিছু না বললেও জয়তুন বললো, — ফরহাদকে নাকি আইতে কইছোস?

— হুম।

— ক্যা?

— পড়ার জন্য।

— কিসের পড়া?

বীণা উত্তর দিলো না। জয়তুন আবার উঠানের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললেন, — তোর অনুমতি নিয়েই জয়তুন জবান দিয়েছে। এখন আবার পড়া আসছে কেন?

— আমি তো জবানের খেলাফ করছি না। বিয়ে আমি করবো। তবে পরীক্ষাও দেবো।

জয়তুন হাসলো! তার খিকখিক করা হাসি। হেসে বললো, — আমার বাড়ির বউরে আমি উঠান পেরুতে দেই না। তবে মহাজন বুঝি তার বউকে ঢ্যাং ঢ্যাং করে স্কুলে পাঠাবে?

— না পাঠালে নিষেধ করে দিক। তবে আমি পরীক্ষা দেবো।

জয়তুন আবার বীণার দিকে ফিরে তাকালো। তার চোখ মুখ শান্ত। শান্ত চোখেই তাকিয়ে রইলেন। তখনই আম্বিয়া এলো, তার সাথে কাজের লোক। আর তাদের হাত ভর্তি বীণার বই খাতা।

বীণা দেখেই চমকে উঠলো! উঠে’ই দাদির দিকে তাকালো। জয়তুন অবশ্য তাকালেন না। সে তাকালেন আম্বিয়ার দিকে আর তাকিয়েই বললেন, — সব আগুন দিয়ে জ্বালা। আর হ্যাঁ! মহাজন বাড়ি খবর পাঠা। কাল টুকটাক কথা না, বিয়ের দিন তারিখ হবে।

বীণার চোখে পানি এসে পড়লো। তখনই জাফর উঁকি দিয়ে বললো, — এসব কী রে আম্বিয়া ?

জাফর তার কথা শেষও করতে পারলো না। বীণা দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বললো, — ও ছোট চাচা, আমি শুধু একটু পড়তে চাই। পৃথিলার আপার মতো। আমাকে একটু পড়তে দাও।

জাফর প্রথমে চমকে গেলো! চমকে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো। এদের সে স্নেহ করেন। বলতে গেলে নিজের সন্তানের মতো’ই করেন। তবে এদের জীবনে জয়তুনের প্রভাব বেশি, অনেক বেশি। তাই কখনও কোন বিষয়ে তেমন ভাবে নাক গলান না। তবে আজকে প্রথমবার শান্ত ভাবে জয়তুনের উপরে গিয়ে আম্বিয়াকে বললেন, — বই খাতা সব বীণার রুমে নে।

আম্বিয়া জয়তুনের দিকে তাকালো। তাকিয়ে অবশ্য সুবিধা করতে পারলো না। শক্ত, তবে দৃঢ় কণ্ঠে জাফর প্রায় ধমকে বললো, — বললাম না, বীণার রুমে নে।

আম্বিয়া চমকে উঠলো! চমকে অবশ্য আর সময় নষ্ট করলো না। সব আবার সাথে সাথেই নিয়ে গেলো। যেতেই জাফর জয়তুনের দিকে তাকিয়ে বললো, — কালতো আজিজ ভাইয়েরা আসছেই, এবার আমি কথা বলবো।

জয়তুনও তার তেজের সাথে বললো, — আমি মরে গেছি নাকি?

— না! তবে এবার আমাদের সন্তানের সুখের ব্যাপার। নিজেরটা নিয়ে ছিনিমিনি খেললেও সন্তানদের নিয়ে কোন বাবা, চাচাদের পক্ষে সম্ভব না।

— আমি জবান দিছি, জাফর।

— জানি! আপনার জবান আর আমাদের জবান আলাদা কিছু না। আপনার গায়ে কাঁদা উঠা মানেই আমাদের গায়ে উঠা। আম্মা তো আর শুধু মুখে মুখে ডাকি না, মন থেকেই মানি। তাই নিশ্চিন্তে থাকুন।

পৃথিলা তার সেই একটা সুটকেস, আর একটা হ্যান্ডব্যাগ। আগের মতোই গুছিয়ে নিলো। এখান থেকে তার গন্তব্যে কোথায় যাবে, সে জানে না। তবে আগের মতো আর নিজেকে নিঃস্ব লাগছে না। বরং কেন জানি মনে হচ্ছে, চলে গেলেই ভালো। তাছাড়া, জ্বরের কারণে পত্রিকায় আর চোখ রাখা হয়নি। পুলিশ কেন আর কোনো খবর পাঠালো না বুঝতে পারছে না। তাই গিয়ে আগে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করবে? নাকি আসল খুনিকে পেয়ে গেছে? কী জানি! পৃথিলা আর ভাবলো না। উঠে দাঁড়ালো। ইমরান যাবে স্টেশন পর্যন্ত।

তবে সাবিহা বসে বসে কাঁদছে। কত ভরসা করে মেয়েটাকে আসতে বলেছিল! আর হলো কী? তাই বলছে, জাফর চাচাকে একবার সব জানাতে। পৃথিলা রাজি হয়নি। কেননা, সে নিজেও চায় না আর থাকতে। তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ কী? তবে ইমরান ভাই তার সাইড হয়েই সাবিহাকে বোঝালো। বোঝালো, এটাই ভালো হবে। পৃথিলা আপা শিক্ষিত মানুষ, তার চাকরির অভাব হবে না। বরং এখানে থাকলে ঝামেলা আরো বাড়বে।

তাই সাবিহা আর কথা বাড়ায়নি। তবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঠিক কাঁদছে। সেই কাঁদার মাঝেই পৃথিলা এসে জড়িয়ে ধরলো। ধরে বললো, — তোর ঋণ জীবনেও শোধ হবে না রে। ভালো থাকিস। পৌঁছে চিঠিতে জানাবো।

সাবিহা নিজেও জড়িয়ে ধরলো। ধরে বললো, — তোর মায়ের কাছে যা না একবার পৃথিলা। এবার আর মুখ ফিরিয়ে নেবে না, দেখিস।

পৃথিলা হাসলো! তবে কিছু বললো না। এগিয়ে জুঁইয়ের কপালে চুমু খেলো। খেয়ে আর সময় নষ্ট করলো না। ইমরান ভাই ভ্যান এনেছে, সেই ভ্যানে গিয়েই উঠল।

এই দু’দিনে দেয়ালের কাজ অনেকটাই হয়ে এসেছে। তাই এই মায়াময় বাড়িটা আর ভ্যান থেকে দেখা গেলো না। তবে পৃথিলা তাকিয়ে রইল। সেই তাকানোর মাঝেই ইমরানও উঠে বসলো অন্য সাইডে। আর বসতেই ভ্যান চলতে শুরু করলো। সেই পরিচিত এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা, ধানের ক্ষেত, রাস্তার পাশের গাছগাছালি সব নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর পৃথিলার ভ্যান এগিয়ে গেলো নিজ ছন্দে।

অবশ্য এই ছন্দের পতন ঘটল মাঝ রাস্তায় এসে। সেই যে একদিন সন্ধ্যায় ধানের ক্ষেত দিয়ে এরশাদ এলো। সেখানে এসে ভ্যান থেমে গেলো। রাস্তার মাঝ বরাবর বিশাল এক গাছের গুড়ি। তার সাইডেই কিছু লোক দাঁড়িয়ে । এই লোকদের ইমরান চেনে। ইটের ভাটার লোক! সারেং বাড়িতে যেমন জয়তুনের লোক তেমনি ইটের ভাটায় শুধু এরশাদ ভাইয়ের লোক। আর এদের ভেতরে কোন দয়া মায়া নেই।

ইমরান দেখেই ঢোক গিললো। পৃথিলা প্রথমে বুঝলো না। সে ইমরানের দিকে তাকালো। ইমরার নিজেও অসহায় চোখে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — এরা এরশাদ ভাইয়ের লোক।

পৃথিলার কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না। আর এও বুঝলো তার আর স্টেশনে যাওয়া হবে না। স্টেশন কেন, কোথাও যাওয়া হবে না। এই লোক তাকে ছাড়বে না। এক ভুলের শাস্তি উপরওয়ালা তাকে আর কতো ভাবে দেবে। তার ভুলের ওজন বুঝি এতোই বেশি?

তার চিন্তার মাঝেই লোকগুলো এগিয়ে এলো। এসে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — ইমরান ভাই, ভ্যান নিয়ে বাড়িত চলে যান। যাগো নুন খান তাগো থালিতে ছেদ করতে নাই।

ইমরান কি করবে দিশে পেলো না। পৃথিলা সব সময়ের মতোই শান্ত, শান্ত কণ্ঠে বললো, — কি চান আপনারা?

— কিছু চাওয়ার মতো দুঃসাহস আমাদের নেই। তবে আপনি নামুন আপা। আমাদের সাথে যেতে হবে। বলেই ব্যাগ, সুটকেস হাতে তুলে নিলো।

— আমি যাবো না। মেরে ফেললেও না।

— মারার হুকুম নাইগো আপা। তবে জোরের আছে। তাই চাই না আপনার কোন অসম্মান হোক। ভাই আবার সোজা বলছে কোন বেয়াদবি করা যাবে না। তবে বিশ্বাস করেন, আমারা খুব’ই বেয়াদব লোক। তাই নিজে থেকে গেলে খুব ভালো হয়।

পৃথিলা আগের মতোই বললো, — আপনাদের যা করার করতে পারেন। আমি যাবো না।

— না গেলেও তেমন সমস্যা নাই। তাহলে আপনি বরং ইমরান ভাইয়ের সাথে বাসায় ফিরে যান। আমাদের কাছে থাকার চেয়ে বান্ধবীর বাড়ি থাকা ভালো।

পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। লোকগুলো দাঁত বের করে হেসে বললো, — এতো অবাক হওয়ার তো কিছু নাই আপা। এই গ্রাম থেকে আপনি আর বের হতে পারবেন না। নয় বাড়ি ফিরে যান, নয় আমরা নিয়ে যাবো। এখন যা আপনার ইচ্ছা। তবে তাড়াতাড়ি বললে সুবিধা হয়। গাছের গুড়ি আবার সরিয়ে রাস্তা ফাঁকা করা লাগবে। খাটনি তো কম না। বিশাল গাছের গুড়ি।

— আমি থানায় যাবো।

— সেটাও পারবেন না। আপনার গন্তব্যে এখন শুধু দুটো জায়গায়। এর বাইরে কোথাও পা ফেলতে পারবেন না।

— যদি ফেলি?

— ফলাফল আরো খারাপ হবে আপা। অযথা জেদ করবেন না। মিঠাপুকুরের ভেতরে আপনি কোন কিছুই করতে পারবে না। এরশাদ ভাইয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারণা নাই। অবশ্য আপনার দোষ দিয়াও লাভ নাই। আসলে কারোই ধারণা নাই।

পৃথিলা আর কিছু বললো না। বলে অবশ্য লাভ আছে বলে মনেও হয় না। সে এরশাদ নামক এক গোলক ধাঁধায় ফেসে গেছে। এখান থেকে মুক্তি পাবে কি করে।

লোকগুলো ব্যাগ সুটকেস আবার ভ্যানে রাখলো। রাখতেই ভ্যান ঘোরানোর ইশারা দিলো। ভ্যানওয়ালা তাড়াতাড়ি ভ্যান ঘোরালো। ঘুরিয়েই এক টান দিলো। পৃথিলা চুপচাপই বসে রইল। ভ্যান আবার বাড়ির সামনে থামতেই পৃথিলা নামলো। তবে ভেতরে গেলো না। গেলো সোজা সারেং বাড়িতে।

সারেং বাড়ির উঠান ভরা মানুষজন। সবাই আড়চোখে দেখলো। পৃথিলা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এগিয়ে গেলো ধীরে ধীরে। আর এই ধীরে ধীরে’ই প্রথম বার সারেং বাড়ির সিঁড়িতে পা রাখলো। রেখে খোলা দরজার সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে দরজায় দু’টো হালকা টোকা দিয়ে বললো, — কেউ আছেন?

জয়তুন ভ্রু কুঁচকে তাকালো! সে মাত্রই বসার ঘরে এসে বসেছে। কণ্ঠ চিনতে অসুবিধা হলো না। তাই ভ্রু কুঁচকেই বললো, — আরে ম্যাডাম দেখি! আসেন, আসেন। শরীর এখন কেমন আপনের?

পৃথিলা কিছু বললো না। ভেতরে এলো। সারেং বাড়ি বাহিরটা যেমন, ভেতরটা আরো ঝলমলে। কোন কমতি কোথাও চোখে পড়বে না। অথচ প্রত্যেকটা মানুষের ভেতর অন্ধকার। তাই ভেতরে আসতেই বললো, — এই ভর দুপুরে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।

— আরে বসো, বসো। জয়তুন এতো সহজে বিরক্ত হয় না। এই কে আছিস ম্যাডামের জন্য শরবত আন।

— তার দরকার নেই। আমি শুধু একটু সাহায্যের জন্য এসেছি।

জয়তুর অবাক হলেন’ই বটে। অবাক হয়ে বললেন, — কিসের সাহায্য?

— ঢাকায় যাওয়ার। আপনার বড় নাতি আমাকে যেতে দিচ্ছে না। বরং মিঠাপুকুরে পুরো আটকে ফেলেছে।

জয়তুন শান্ত চোখে তাকালো। পৃথিলার দৃষ্টিও শান্ত। শান্ত ভাবেই বললো, — আমাকে সাহায্য করুন। এতে আপনার যেমন ভালো, তেমনি আমারও।

চলবে…..

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৪

এরশাদ ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে। ততক্ষণে পৃথিলা সাবিহার ঘরে ফিরে গেছে। উপায় তো নেই। অদৃশ্য এক জেলের কয়েদি এখন সে।যেখান থেকে চাইলেই পা বাড়াতে পারছে না। তবে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হচ্ছে আরো একবার। অথচ না কেউ দেখছে, না কেউ বুঝতে পারছে। তবে জয়তুন শুনে শান্ত ভাবেই বলেছে “আমি দেখতাছি। এরশাদ ফিরুক আমি নিজে কথা বলবো। ”

বাড়িতে পা রাখতেই এরশাদের কানে সবই গেলো। এই মেয়ের বুদ্ধিতে সে ক্ষণে ক্ষণে চমকায়। লোহা দিয়েই লোহা কাটা যায়। এই মেয়ে ঠিক জানে। তবে সমস্যা হলো। লোহা কাটা যায়, থেতলানো যায়, গলানো যায়। তবে নিঃশেষ করা যায় না। তেমনি এরশাদকেও যাবে না।

জয়তুন তখনও বসার ঘরেই বসা। এরশাদের জন্যই বসা। সে অবশ্য আগেই বুঝেছে। তা না হলে তার নাতিরা এতোও মহৎ মানুষ না, যে দিন রাত এক করে এমনি’ই এক মেয়ের জন্য হাসপাতালে বসে থাকবে।

এরশাদ জয়তুনকে দেখল। দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নিজের মতোই উপরে যেতে নিলো। জয়তুন দেখে হেসে বলল,— কোকিল হয়ে কাকের ডিমে তা দিছি, বড় হয়ে কা কা তো করবেই।

এরশাদ শুনল। শুনে একটু দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আর উপরের দিকে গেলো না, দাদির দিকে এগিয়ে এলো । সব সময় দাদির পায়ের কাছে বসলেও আজ বসল একেবারে জয়তুনের সামনের চেয়ারে। যেখানে এই তো ঘন্টা দেড়েক আগে ঠিক পৃথিলা এসে বসে ছিল। একেবারে জয়তুনের মুখোমুখি।

জয়তুন দেখে আবারো হাসলো! এরশাদ নিজেও স্বাভাবিক! এতো কান্ড করে বসে আছে তেমন কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং সব সময়ের মতো সুন্দর, শান্ত, কোমল করেই দাদির কথার উত্তরে বলল, — জেনে শুনে বুঝেই তা দিছো। তো? কাক হয়ে তো আর কোকিলের সুরে গান গাইবে না।

— তা গাইবে না জানি, তবে নিজের মাথায়’ই ঠোকর বসাবে এটা ভাবিনি।

— ঢিল মারলে ঠোকর তো দেবেই। সেটা কাক হোক আর কোকিল। নিজের বেলায় সবার দুনিয়া ঠিক।

— হ্যাঁ, এতোটাই ঠিক যেই দাদি মুখের বুলি শেখাইছে, সেই বুলি’ই এখন দাদির দিকে তীরের ফলা।

এরশাদ হাসলো! তবে এবার জয়তুন হাসলো না। নিজের মতো বলল, — ম্যাডাম কী কয়?

— তুমি ভালো করেই জানো কী কয়। জানো বলেই তো সাবিহাকে শাসিয়েছো। বাড়ির ভেতরে ডেকে শাসিয়েছো। যেন সবাই দেখে। আর যেই আয়নামতির উঠানে পা রাখা নিষেধ, সেই আয়নামতি সন্ধ্যায় হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি পায়। বোকা তো বুঝে নি। তাকে আসলে জয়তুন আরা গুটি হিসেবে চালিয়েছে।

জয়তুন শীতল চোখে তাকাল। এরশাদ সেই শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,– তেমার নাতি দাদি, এতোটাও বোকা ভেবো না।

— আমি যা করি, তোদের জন্যই করি।

— না দাদি, তুমি সব করো নিজের মনের শান্তির জন্য।

— এখনতো মনে হইবোই। পিরিতের রঙিন চশমা চোখে। এখন পুরো দুনিয়া ভুল।

— হয়তো! তবে আমিতো কোনো ঝামেলা চাইনি। নিজের মতো ছিলাম। মেয়েটা একটা ধাক্কা খেয়ে এখানে এসেছে। আমি চেয়েছি, ধাক্কাটা ধীরে ধীরে সামলে উঠুক। তবে গন্ডগোল তুমি লাগিয়ে দিলে।

— তালাক! ধাক্কাটার নাম তালাক।

— তো?

— কোনো তালাকপ্রাপ্ত মাইয়া সারেং বাড়ির বউ হইবো না। অন্তত জয়তুন থাকতে তো না। অধঃপতন তোর হইতে পারে। আমাদের তো না।

এরশাদ এই কথার কোনো উত্তর দিল না।
আম্বিয়া জয়তুনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ মুখ শুকনো। এরশাদ দেখল, দেখে নির্বিকার ভাবে বলল, — ছোট চাচা, শাহবাজ কে ডেকে নিয়ে আয়। আমার কথা আছে।

আম্বিয়ার চোখে পানি চলে এলো। জয়তুন বিয়ে দিলে হয়ত, এতোটা কষ্ট লাগতো না। তবে এরশাদের মতো মানুষের এমন বেপোরোয়া ভালোবাসায় ঠিক ভেতর ভেঙে এলো। আর সেই ভাঙা ভেতর নিয়ে’ই উপরের দিকে গেলো। কখনও তো আদেশ অমান্য করেনি। আজ কিভাবে করে?

আম্বিয়া যেতেই এরশাদ আবার দাদির দিকে তাকালো। তাকিয়ে আগের মতোই বলল,– সারেং বাড়ির বউ কে হবে সেটা তুমি ঠিক করতেই পারো। সারেং বাড়ির মাথা তুমি। তবে এরশাদের বউ কে হবে, সেটা এরশাদ ঠিক করবে।

জয়তুন চেঁচিয়ে বলল, — এরশাদ…

— কাজটা তুমি ঠিক করোনি, দাদি।

— আমাদের চেয়ে এই মেয়ে বেশি হয়ে গেল তোর কাছে?

— এখানে কম বেশির কথা না দাদি? কথা অন্য কিছুর। তুমি সেই অন্যকিছুটা সব সময় নিজের দিকে টানো। যেমন টেনেছিলে ছোট চাচার টা। তবে আমিতো জাফর না। তাই ফলাফল খুব একটা ভালো হবে না।

— আমারে ডর দেখাস তুই?

— সত্য বলি, দাদি। বয়স হয়েছে, ঘর থেকে বেরোও না কতদিন! দুনিয়া পাল্টে গেছে, পাল্টেছে সারেং বাড়িও। তুমি বুঝোনি।

জয়তুন যেন হতবাক হলো। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইল। এই এরশাদকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবে আলাউদ্দিনের সেই দিনের কথা কানে বাজতে লাগল, — “এরশাদের বিয়ে এরশাদের ইচ্ছেতেই হবে, না হলে নেই। এখন যা-ই করবা, হিতে বিপরীত হইবে। সেই বিপরীতে সারেং বাড়ি ধ্বংসের দিকেই যাবে।”

জয়তুন বসে বসে হিসেব মিলায়। সেই আয়নামতির বিয়ের কথা থেকে। আলাউদ্দিন কী বলেছিল, কী বলতে চেয়েছিল, সে কূল কিনারা মেলাতে পারে না। আসলে জয়তুন কারো কথা শুনছেই বা কবে। সে নিজের মর্জির মালিক। মর্জি যখন যা হয়, তাই করে। তবে আজ উল্টো পড়ছে কেন?

তখনই শাহবাজ, জাফর এলো। জাফর আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। তবে জয়তুনের অবস্থা তার ঠিক মনে হলো না। তাই চিন্তিত সুরে বলল,
— কী হয়েছে আম্মা ?

জয়তুন উত্তর দিলো না। তবে এরশাদ উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কোন ভনিতায় গেলো না। সোজা বলল, — পৃথিলাকে আমি বিয়ে করতে চাই। এখন না, কিছুদিন যাক, তারপর। আর সেই পর্যন্ত সবাই পৃথিলা থেকে দূরে। সে তার মতো থাকবে। এখন যদি কেউ এই থাকায় বা হাত ঢোকায়, বা মাতব্বরি করে ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে, আমি তার বিপরীতে দাঁড়ালে, দোষ আমাকে দিতে পারবে না।

শাহবাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এই তাহলে কাহিনী।
জাফর হতম্ভব! হতম্ভব হয়েই বলল, — এরশাদ…

শাহবাজের কুঁচানো ভ্রু এক সাইডে বাঁকা হয়ে উঠলো। উঠে ছোট চাচার দিকে তাকালো। তাকালো জয়তুনও। তার তো পেয়ারের মানুষ’ই। খুশির বদলে এই হতম্ভবে তারা অবাক’ই হলো। জয়তুনের অবশ্য বলতে গেলে ভালো লাগলো। যাক! জাফরের তাহলে অধঃপতন হয়নি।

এরশাদ অবশ্য তার মতোই জাফরের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল, — বলেছিলাম না, এরশাদ প্রিয় কার? এরশাদ কারো প্রিয় হয়নি ছোট চাচা। হবেও না। তোমরা দেখিয়েছো দয়া। পোড়া মুখ, দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কষ্ট যাতে গায়ে না লাগে সেই দয়া। এই যে দেখো যার যার স্বার্থে আঘাত লাগতেই, কেউ এরশাদের কথা ভাবছে না, একজন ভাবছে নিজের অহমের কথা, বংশের কথা। আর তুমি…

জাফর আগের মতোই ডেকে উঠলো, — এরশাদ…

এরশাদ থামলো! থেমে হাসলো! হেসে সেই কথায় আর এগুলো না। তবে জাফরের দিকে তাকিয়ে বললো, — সবাই সবারটা ভাববে, শুধু আমি ভাবলেই দোষ।

জাফর বাক্যহারা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পৃথিলার আসার কথা আয়না সাথে সাথে’ই গিয়ে বলেছে। এও বলেছে এরশাদ কি করেছে। সে ভেবেছে, কেসের কারণে হয়তো এরশাদ এমন করছে। সে নিজেই তো বলেছে দেখে রাখতে। তাই মাথা ঘামায়নি। বরং নিশ্চিন্ত হয়েছে, পৃথিলা আর এখন ঢাকায় যেতে পারবে না। কিন্তু এইসব কী? কখন হলো? কিভাবে হলো? মেয়েটা এলোই তো কিছুদিন।

সে বাক্যহারা হয়েই বলল, — তুই কী করেছিস পৃথিলার সাথে?

— কিছু’ই না! কি করবো? তবে ঐ যে বললাম, কারো প্রিয় হবো না। তাই কারো প্রিয় হওয়ার আর চেষ্টাও করি না। আমি খারাপ’ই ভালো।

জাফর হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পুরো জয়তুনের প্রতিচ্ছবি। সে তার ইহোজীবনে কারো কাছে ভালো হওয়ার জন্য কিছু করেনি। যা করেছে সেটা তার মর্জি। আর এই মর্জির জন্য তারা হাসতে হাসতে যা খুশি তাই করতে পারে।

একটা মানুষ রক্তের কোন সম্পর্ক না থেকেও, কি সুন্দর রক্তে রক্তে মিশে গেছে। সে আর কথা বাড়ালেন না, এদের সামনে যতো বলবে, ততো বিপদ। এরা শুধু নিজেদের কথা ভাবে, তার মেয়েটার কথা একবারও ভাববে না। তাই ক্লান্ত ভাবে উপরে যেতে যেতে বললেন,– তোর সাথে আমার কথা আছে এরশাদ। আমার রুমে আয়। এক্ষুণি আয়।

এরশাদ আগের মতোই হাসল! আজ যেন তার সকল হাসির দিন। তাই হেসে’ই বলল — চলো।

তখনি জয়তুন বলল, — এই মেয়ে যদি সারেং বাড়িতে বউ হয়ে আসে, তাহলে জয়তুনের লাশের উপর দিয়ে আসবে।

জাফরের মাথা ঘুরতে লাগল। কি হচ্ছে এসব! তার মেয়ে তার বাড়ির বউ হবে কেন? মেয়েটার অবস্থা কি কে জানে? বিপদে পড়ে প্রথম বার বাপের ঘরে এসেছে। সে জেনেও এগিয়ে আসেনি। ভেবেছে, কাতর স্বরে বললে তো নিষেধ করতে পারবে না। তাই যা বলার আপাতত বলে চলে যাক। পরে এরশাদের সাথে কথা বলবে। এখন? আল্লাহ রহম করো।

এরশাদ জাফরের অবস্থা দেখল। দেখে তার স্বভাব মতো কোমল সুরে বলল,
— তুমি যাও। গিয়ে ফ্যানের নিচে বসো। আমি আসছি।

— গরু মেরে জুতা দান করছিস?

এরশাদ আগের মতোই বলল — যা মনে করো।

জাফর আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে দিকে গেলো। অস্থির লাগছে তার। কাকে বিশ্বাস করেছে সে?

জাফর চলে গেলো! এরশাদ এগিয়ে এলো জয়তুনের কাছে। এখন অবশ্য সামনের চেয়ারে বসলো না। বসলো সব সময়ের মতো জয়তুনের পায়ের কাছে। বসে কাতর স্বরে বলল, — তোমরা আমার কী, তুমি ভালো করেই জানো দাদি। আর আমি কী, সেটাও আমি জানি। এতদিন না তোমার এরশাদের ঘর বসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলে? এখন তোমার এরশাদ চাইছে, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো কেন?

জয়তুনের মন ভরে এলো। এই তো তার এরশাদ। যেই এরশাদ তার জন্য নিজের মুখে আগুন পর্যন্ত নিয়েছে। যার একটু অসুখে ব্যাকুল হয়েছে। তাই সেও মমতা মাখা হাত এরশাদের গালে রাখল। রেখে বলল, — এই বিয়েতে ঘর বসবো নারে এরশাদ, ভাঙবো। তোর দাদি ভাঙবো, ভাঙবো সারেং বাড়ি। আলাউদ্দিন বলছে। এই মেয়ে তোর, এই বাড়ি সব কিছুর জন্য ধ্বংস। যেতে দে এই মেয়েকে।

এরশাদের চোখ সাথে সাথে শীতল হয়ে এলো। এতক্ষণ দাদির প্রতি যেই আকুলতা ছিলো। আর দেখা গেলো না।

জয়তুন সবই দেখলো। চুলতো তার বাতাসে পাকে নাই। তাই হাতটা মুখে বুলিয়ে বললো, — এই মেয়ে আমাকে সোজা বলেছে, সে মরে যাবে, তবুও তোকে বিয়ে তো ভালোই মুখটাও দেখতে চায় না।

এরশাদ জয়তুনের হাত আস্তে করে গাল থেকে নামালো। নামিয়ে বললো, — আমি তাকে মরতেও দেব না দাদি। আর বাকি জীবন এই ভয়ংকম মুখটাই তার দেখতে হবে।

জয়তুন শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
তারপর বলল, — মাথা বিগড়ে গেছে তোর।

— গেলে গেছে।

— তবে শুনে রাখ। জয়তুন সব মানতে পারে, তবে সারেং বাড়ির দিকে আঙুল উঠবে, এমন কিছু সে কখনও মানতে পারবে না। পুরো গ্রামের মানুষ মুখ টিপে হাসবো। হেসে বলবো। খুঁত নাতির জন্য খুঁত ওয়ালা বউ আনছে। কোথায় গেলো এতো নাম ডাক। কুমারি মেয়ে বুঝি জোটেনি। তাই এই মেয়েকে তোর ভুলতেই হবে এরশাদ।

এরশাদ হাসল! হেসে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বলল,
— আমার কিছু আসে যায় না। তাকে নিয়ে যদি তোমার এতোই সমস্যা হয়, না এলো তোমার সারেং বাড়ি। এরশাদের বউয়ের থাকার জায়গা অভাব হবে না।

জয়তুন আগুন চোখে তাকাল। শাহবাজ এতক্ষণ চুপ থাকলেও বিরক্ত মাখা সুরে বললো, — তুমি তাহলে সারেং বাড়িকে ভাঙতে চাইছো?

এরশাদ শাহবাজের দিকে তাকাল। তাকিয়ে বলল,
— এর মধ্যে আসিস না, শাহবাজ। ভাই হয়ে ভাইয়ের বিপরীতে দাঁড়াতে আমার কষ্ট হবে।

— তবে আমার কষ্ট হবে না ভাই। বিশ্বাস করো, এতোটুকুও না। যে মানুষ আমাদের বুকে আগলে মানুষ করেছে, তার বুকে ছুরি তুমি চালাতে পারো, তবে আমি না। যেই বাড়ি, বংশের প্রকোপে এতো ক্ষমতা জহির করছো, তাকে তুমি ভাঙতে পারো, আমি না। শাহবাজের হাজার খারাপ দোষ থাকতে পারে, তবে রক্তে নিমকহারামি নেই।

— শুনে ভালো লাগলো। তবে আমি আমার জায়গা থেকে এক পাও নড়বো না। এখন যার যা খুশি। বলেই এরশাদ আর দাঁড়ালো না। তার যা বলার সে বলেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উপরে দিকে গেল।

শাহবাজ দাদির দিকে তাকাল। জয়তুন আগের মতোই বসা। বসেই হাত বাড়িয়ে শাহবাজকে কাছে ডাকল।
শাহবাজ এগিয়ে এলো। এসে দাদির সামনে বসলো। জয়তুন পরম মমতায় মুখে দু’হাত শাহবাজের মুখে রাখলো। রেখে কপালে চুমু খেল। খেয়ে সেভাবেই বলল,– দাদির জন্য কি করতে পারিস রে শাহবাজ?

— সব।
— সত্যিই।
— বলে তো দেখো।
— আমার এরশাদ ফেরত চাই।

শাহবাজ হাসল! হেসে দাদিকে সোজা বসালো। হাতটা নিজের ডান হাতের মাঝে নিয়ে বললো, — পিরিতে পড়েছে তোমার নাতি। পিরিতের আঠা সহজে ছাড়ে না।

— তাহলে আঠাই শেষ করে দে। না থাকলে গায়ে লাগবে কি করে ?

শাহবাজ আবারো হাসলো। হেসে ঘাড় কাত করে আয়নার দিকে তাকালো। তাকাতেই আয়না থতমতো খেয়ে গেলো। আসলে আম্বিয়াবু আর সে খাবার ঘরেই ছিল। আম্বিয়াবুর হঠাৎ কি হলো কে জানে। চোখ মুখ শুকনো করে চলে গেলো। আর আসেনি। তাই সে এগিয়ে এসেছে। এসে সব শুনলো। অবশ্য বের হয়নি। একটু আড়ালে দাঁড়িয়েই শুনেছে। কেউ দেখেনি, তবে দেখো শয়তানটা ঠিক দেখে ফেলেছে।

শাহবাজ সব সময়ের মতো আঙুল নাচিয়ে ডাকলো। আয়নাও সব সময়ের মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। আসতেই বললো, — আপনি কিছু শুনেছেন, বউ?

আয়না সাথে সাথেই দু’পাশে মাথা নাড়ল।
শাহবাজ দেখলো! তার ঠোঁটের কোণে হাসি। হাসি নিয়েই বললো, — বউ বউ তো অনেক খেললেন। এখন বিবি হন। আর বিবিদের কাজ কি জানেন? স্বামীর ভালো মন্দ সব জানবে, তবে মুখ খুলবে না। মরে গেলেও না। কি খুলবে না?

আয়না চোখ তুলে তাকালো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে আস্তে করে বললো, — মুখ।

— একদম ঠিক! যান, কি যেন করছিলেন?

আয়না এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না, হনহনিয়ে চলে গেল। যেতে গিয়ে খাবার ঘরের চৌকাঠে একটা উষ্টা খেলো। তবুও দাঁড়ালো না। খুঁড়াতে খুঁড়াতে’ই গেলো। দুই শয়তান এক সাথে। সে যেনো পালালেই বাঁচে।

যেতেই শাহবাজ হেসে বলল,
— বউ তো আমার ভালো লেগে গেছে দাদি।

জয়তুন হাসল! তার একেকটা নাতি একেকটা কলিজা অংশ। তাই হেসে বলল,
— আমার সখার পছন্দ। ভালো না লেগে পারে?

পৃথিলা দুপুরে খায়নি, ওষুধও খায়নি। ঐ বাড়ি থেকে এসে শুয়েছে, যে শুয়েছে। সাবিহা কয়েকবার উঁকি দিয়ে গেছে। ঘুম না জেগে, সাবিহা বুঝতে পারেনি। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। তবে এবার এসে এগিয়ে কপালে হাত রাখল। না, জ্বর নেই। বরফের মতো শরীর ঠান্ডা।

তখনি পৃথিলা নিঃস্পৃহ কণ্ঠে বলল, — কিছু কিছু মানুষ জনম দুঃখী হয়। যেখানেই যায় দুঃখও সাথে সাথে যায়। আমি মনে হয় সেই গোত্রের। এক কষ্ট থেকে পিছু ফেরাতে এখানে এলাম, এসে আরেক কষ্টের সাগরে ডুবে মরতে যাচ্ছি।

সাবিহার ভেতর ভারী হয়ে এলো। আদ্র কণ্ঠে বললো, — সব আমার জন্য।

— উঁহুম! দুঃখ যার চির সখী, যে ভাবেই হোক আসবে। পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও, সে নিঃশব্দে পাশে বসবে।

সাবিহা উত্তর দেয় না। এরশাদ ভাই এমন কিছু করবে মাথায়’ই আসেনি। শাহবাজ করলে অবাক হতো না। তবে এরশাদ ভাই? বিয়ের আজ সাত আট বছর। কতো কিছু এসে দেখলো এই গ্রামে। প্রথম প্রথম সে নিজেও মুখটা দেখলে ভয় পেতো। কিন্তু যখনি দেখা হয়েছে, কি সুন্দর সরলতার হাসি। এই হাসি দেখে’ই ভয়টা কেটে গেছে। আজ আবার ভয় করছে তবে মুখ দেখে না, এই যে ভয়ংকর মানুষটা, মানুষটাকে দেখে। কেননা পৃথিলা জানে না, তারা বেরুতেই এরশাদ ভাই এসেছিল। এসে তার স্বভাব মতো সুন্দর করে বলেছে, — “সাবিহা, এমন কিছু করো না, যাতে এই সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়। একবার নষ্ট হলেই আমি আর কাওকে চিনবো না। না ইমরান, না তোমাকে, না তোমার মেয়েকে। পৃথিলা এখানে থাকবে, শুধু থাকবে। বাড়তি কোন কিছু করার দরকার নেই। সব আমি দেখবো। ”

— এখান থেকে থানা কত দূরে?

সাবিহা অন্যমনস্ক ছিল। তাই খেয়াল করেনি। তাই ধ্যান ভাঙতেই বললো, — কি কতো দূরে?

— থানা।

— কোথায় থাকবে আবার, সদরে।

— কোন ভাবে কি বেরোনো যায় না,? গ্রামের অলি, গলি। কতো রাস্তায়’ই তো থাকে। শুধু স্টেশন পর্যন্ত গেলেই হবে। বাকি আমি দেখে নেবো।

— দেয়াল টানা তো হয়েই গেছে। কালকে গেইটের কাজও শেষ। আর এই গেইট সারেং বাড়ির মতোই হবে। চাইলে’ই না কেউ আসতে পারবে, না কেউ যেতে।

— কোন উপায় কি নেই। গ্রামের কারো কাছে সাহায্য চা। আমরা বেরুতে না পারি, গ্রামের মানুষ কি থানায় গিয়ে বলতে পারবে না?

— পারবে। তবে সমস্যা কি জানিস। তারা কিন্তু খোঁজ খবর করতে আগে সারেং বাড়িতে’ই যাবে। তারা গ্রামের মাথা। কেউ গিয়ে বললেই এসে ধরে নেবে না। আর ততক্ষণে তুই গায়েব হয়ে যাবি। কোথায় রাখবে তার ঠিকও নেই। পুলিশ তোকে পাবে না। গ্রামের মানুষ জানবে তুই চলে গেছিস। ব্যস! ঝামেলা খতম।

পৃথিলা আর কিছু বললো না। বলতে আর ইচ্ছেও করলো না। চোখ খুলে জানালা দিয়ে তাকালো। অস্থির লাগছে তার। মনে হচ্ছে, বদ্ধ একটা ঘরে সে আটকে গেছে। সেই ঘরে কোন জানালা নেই, দরজা নেই, আছে শুধু কালো রঙের চারটা দেয়াল। সময় যাবে সেই দেয়ালগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসবে।

সাবিহা পৃথিলার শুকনো মুখটা দেখল। দেখে বুকটা তার ফেটে যেতে চাইলো। নিজেকে সামলে বলল,
— কিছু খেয়ে নে, পৃথিলা।

পৃথিলা জবাব দেয় না। হিসেব মেলাতে চেষ্টা করে।
পুলিশের চিঠির কোনো উত্তর আসেনি। ভ্যানওয়ালা… ফরহাদ… এরা সব একসাথে। তাকে ঝট করে আটকে ফেলা হয়নি, এই জাল বিছানো হয়েছে ধীরে ধীরে। অথচ সে বুঝতেও পারেনি।

সে জানালার দিকে তাকিয়েই বললো, — একটা পত্রিকা আনার ব্যবস্থা করতে পারবি?

সাবিহা উত্তর দেয় না। পত্রিকা আনবে কোথা থেকে? মফস্বল গ্রাম! সদর থেকে এক লোক আসে জাফর চাচাকে দিতে। তার কাছে চাইবে, নাকি? এরশাদ ভাই যদি রেগে যায়। কি করবে সে। তাছাড়া জাফর চাচা করছে টা কি? তার কানে কি যায়নি? নাকি মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে সেও এরশাদ ভাইয়ের সাইড নিচ্ছে?

সাবিহা আর ভাবতে পারে না। বাবাকে জানাতে হবে। বাবাকে বললে নিশ্চয়ই কোন না কোন ব্যবস্থা করবে। আর সবচেয়ে ভালো হয় শায়লা চাচিকে যদি কোন ভাবে জানানো যায়।

সাবিহা ঝট করে উঠে কাগজ কলম নিয়ে বসল। লিখে ইমরান কে দিয়ে চুপিচুপি পাঠাবে। একবার ডাকঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হলো।

বোকা সাবিহা তো আর জানে না, ডাকঘরটাই এরশাদ সবার আগে দখল করে বসে আছে। আর এই চিঠি মিঠাপুকুর থেকে বেরও হবে না।

চলবে……