#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৫
এরশাদ জাফরের রুমে এলো কিছু সময় পরে। ইচ্ছে করেই আসেনি। যে কোন ধাক্কায়’ই হজম করার জন্য কিছুটা সময় দরকার। ছোট চাচাকে বলতে গেলে হজম করার জন্যই দিলো। এই কিছুটা সময় সে তাদের উপরের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট গেলো। দৃষ্টি কোথায় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য বারান্দা খালি, তবে জানালা খোলা।
সেই খোলা জানালার দিকে তাকিয়েই পুরো সিগারেট শেষ করলো। করে জাফরের রুমের দিকে গেলো। জাফর ততক্ষণে নিস্তেজ ভাবে খাটে শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ, সেই বন্ধ চোখের উপরে হাতটা উল্টো করে রাখা। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পিডে।
এরশাদ এসে চেয়ার টেনে বসল। বসতে বসতেই বলল,
— বলো, কী বলবে?
জাফর যেভাবে আছে, সেই ভাবেই শুয়ে রইল। শুধু ঠোঁট দু’টো নাড়িয়ে বলল, — বলার জন্য কিছু বাকি রেখেছিস?
— তাহলে তো সব চুকেই গেলো। চলে যাই। কাল অনুষ্ঠান, কাজ আছে আমার।
জাফর চোখ থেকে হাত সরালো। সরিয়ে আস্তে করে উঠে বসলো। বসতে বসতে বলল, — আম্মা কী বলেছে, কি চাচ্ছে সেটা আমার জানার দরকার নেই। তবে এরশাদ, আমি বেঁচে থাকতে, আমার মেয়ের সাথে কোনো অন্যায় আমি দেখতে পারবো না।
— আমি বুঝি এতই খারাপ? নাকি দেখতে ভয়ংকর বলে মেয়ের হাত দিতে চাইছ না? কোথায় গেলো এতো স্নেহ? নাকি ঘুরে ফিরে আদরে এসে চাচার গলা জড়িয়ে ধরেছি। চোখের সরমে শুধু হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারোনি। হাজার হলেও পালক ভাইয়ের ছেলে।
জাফর নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এই এরশাদকে তিনি চেনেন না। এটা শুধু জয়তুন আরার নাতি। জয়তুন আরাও কথায় কথায় ভালোবাসায় আঙুল তুলেন। অথচ এরা এটা বুঝে না, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ মানে এই না, সব কিছু চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হবে। মেনে নিয়েছো তো ভালোবাসো, না নিয়েছো তো ভালো’ই বাসোনি। অথচ এই ছেলেটা জানে না, তাকে সে কতোটা স্নেহ করে। এই যে অন্যায় করছে জেনেও যেমন নিজের রক্তের জন্য কষ্ট হচ্ছে, তেমনি এই যে ভয়ংকর মুখের ভয়ংকর এরশাদ। যার হাজার অন্যায় জেনেও কখনও মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরং ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, স্নেহের হাত সরিয়ে নেয়নি। সে আজ কত অবলীলায় বলছে, স্নেহের নাটক করেছে। এজন্যই হয়তো সবাই বলে ভালোবাসা অন্ধ। তাই বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল,
— এখানে খারাপ ভয়ংকরের কথা না। কথা আমার মেয়ের ইচ্ছের। এখন বল, আছে আমার মেয়ের ইচ্ছে ?
— তোমার মেয়ের বেঁচে থাকারও ইচ্ছা নেই। তো যাচ্ছ না কেন গলা টিপে ধরতে?
— এরশাদ…
— চেঁচিয়ে তো লাভ নেই। আমি পিছু হাঁটবো না।
— ভালো! তবে আমি পৃথিলাকে কাল নিজে ঢাকায় পৌঁছে দেব। এখন তোর ইচ্ছে, তোর চাচাকে কি করবি। মানুষকে মারতে তো তোর হাত কাঁপে না। মেরে ফেলিস। তবে আমি বেঁচে থাকতে এসব দেখতে পারবো না।
এরশাদ চোখের কোণা রক্তিম হলো। রাগে না কষ্টে জাফর বুঝতে পারলো না। তবে তাকে অবাক করে এরশাদ এগিয়ে এলো। বসলো জাফরের পায়ের কাছে। বসে কিছুটা আদ্র কণ্ঠে বললো, — কখনোও তো আবদার করিনি চাচা। আজ করছি। পৃথিলাকে আমাকে দাও। কথা দিচ্ছি কোন কষ্ট তাকে ছুঁতে দেবো না। নাকি পায়ে ধরতে হবে? তাও রাজি, তবুও দাও।
জাফর হতম্বভ হয়েই তাকিয়ে রইলেন। সে ভালো করেই জানে, ভালোবাসার জন্য হাজার বছরের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কোন শক্ত কারণের। ব্যস! একটা অনুভূতি। যেই অনুভূতি যাকে দেখে যার জন্য জন্মায়। তবে এরশাদের অনুভূতিতে তিনি যেমন ভালোবাসা দেখলেন, তেমন দেখলেন পাগলামি। ভালোবাসা আর পাগলামি। দু’টো শব্দ কখনও ভালো বয়ে আনে না। তা না হলে এরশাদের মুখে এমন কথা, ভাবা যায়!
জাফর পা গুটিয়ে বসলেন। এরশাদ দেখে হাসলো। হেসে বললো, — গলা থেকে হাত ছাড়িতে নিতে পারোনি, পা থেকেও পারবে না। তাই বুঝি সরিয়ে নিলে?
— আমি তোর ভালোবাসাকে সম্মান করি এরশাদ। তবে অন্যায় অন্যায়’ই। পৃথিলাকে যেতে দে। বিশ্বাস কর, পৃথিলার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে যদি আমি দেখতে পেতাম। তাহলে তোর আবদারে আমার কোন সমস্যা হতো না।
— ইচ্ছের সময় হলো কোথায়? তার আগেই গন্ডগোল।
— সময় হলেও হতোটা। তোরা দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ।
— হ্যাঁ, ভিন্ন জগতের তো হবেই। শিক্ষা নেই, সৌন্দর্য নেই। সে শহরের আলোতে মোড়ানো। আর আমি গ্রামের কাদা মাটির গেঁয়ো ভূত। যেই ভূতের পুরো দুনিয়াই অন্ধকার। বিশ্বাস করো এই ভূতের এতোদিন মনটাও ছিল না।
— এতো কথা ভালো লাগছে না রে এরশাদ। আর ঝামেলা বাড়াস না। আমি কাল ওকে নিয়ে যাবো।
— যাও, নিয়ে যাও। মানুষ মারতে হাত না কাঁপলেও এরশাদের প্রিয় মানুষের গায়ে টোকার কথা ভাবতেও কাঁপে। তবে এটাও মাথায় রেখো গেলেই পুলিশ সাদরে তোদের মেয়েকে জেলে ঢুকাবে।
জাফর বিস্ময় চোখে মুখে বলল, — আমার মেয়েকে কেন জেলে ঢুকাবে?
— খুনের পালাতক আসামি তোমার মেয়ে।
— আমার মেয়ে কেন হবে, খুন তো করেছিস তুই।
— হ্যাঁ, তো! প্রমাণ আছে কোনো?
— আমি বলবো।
এরশাদ হো হো করে হাসলো! হেসে বললো,– দেখিয়ে দিলে তো রক্ত, রক্ত’ই।
জাফরের ভেতর ভেঙে আসে। এরশাদ দেখে। দেখে বলে, — বলবে যখন, পুলিশকে এটাও বলো। শাস্তিটা তুমিই দিতে চেয়েছিলে। কেন চেয়েছিলে? কারণ তোমার মেয়ের সাথে অন্যায় হয়েছে। মেয়ে কে? খুনির প্রাক্তন স্ত্রী। স্ত্রী কে? পৃথিলা। পৃথিলা কে শায়লার মেয়ে। শায়লা কে? জাফর নামের শায়লার এক ধোঁকাবাজ প্রাক্তন। আর প্রাক্তন কে? তারেকের খুনির প্রিয় চাচা। আর খুনি কে? তোমার মেয়ের আশিক। যে সুন্দর মতো বয়ান দেবে। প্রতিশোধ নিতে বাবা, মেয়ে তাকে সুন্দর মতো ব্যবহার করেছে। তা না হলে খুন করে কোন লাভ আমার?
জাফরের মুখে কথা আসে না। এরশাদ কাতর চোখে প্রিয় চাচা মুখটা দেখে। দেখে আগের মতোই বলে।- ” তুমি জেলে, আমি জেলে, তোমার মেয়েও জেলে। খারাপ না। যাও, নিয়ে যাও। তবে তোমার সাথে যাবে বলেও মনে হয় না। কেননা, সাবিহাদের ঘর থেকে সে বেরুবে তার রক্তের পরিচয় জেনে। আর তাছাড়া জয়তুন আরাও জানুক কার বিরুদ্ধে সে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের রক্ত। আপন রক্ত। যেই সারেং বাড়ি নিয়ে এতো গর্ব। সেই গর্বের একমাত্র রক্ত। তখন এরশাদের সাইডেই না এলেও দুনিয়া জানে, জয়তুন বাড়ির সম্মান আর বংশের জন্য কতোটা দেওয়ানা। তাই পৃথিলা এমনিতেও এই গ্রাম থেকে বের হতে পারবে না, ওমনিতেও পারবে না। মাঝে থেকে বেচারির কষ্টে পাল্লাটা আরো ভারী হবে।
জাফর নিস্তেজ কণ্ঠে ডাকে,– এরশাদ… আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম।
— আমি মূল্য রাখবো। এরশাদ ক্ষয়ে যাবে তবুও এই জবান দিয়ে এই বিষয়ে একটা শব্দও বের হবে না। তবে যেই পর্যন্ত তুমিও মুখ বন্ধ রাখবে। আর এই রাখায় এটায়ও মাথায় রেখো। এতো এতো কাহিনীতে তোমার মেয়ে বাঁচতে পারবে না। হাজার শান্ত থাকুক। এতো ধাক্কা হজম করার মতো শক্তি তোমার মেয়ের নেই।
জাফর সিধেসাদা মানুষ। এত প্যাঁচ বোঝেন কোথায়। যদি বুঝতো। তাহলে ঠিক বুঝে যেতো। চাচার সাথে সে শক্তিতে যাবে না, যাবে বুদ্ধিতে। আর বুদ্ধি দিয়েই তার ব্রেইন ওয়াশ চলছে। আর চলছে বলেই হতবাক হয়ে বসে রইলেন।
এরশাদ উঠল। উঠতে উঠতে বলল,– মিঠাপুকুরে’ই তোমার মেয়ে সবচেয়ে নিরাপদ চাচা। এখানে কোন কিছু ছোঁয়ার আগে এরশাদকে ছুঁতে হবে। ঢাকায় যাবে, কোথায় যাবে? পুলিশে না ধরলেও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। সেখানে এরশাদের চেয়েও আরো ভালো মানুষের হাতে পড়বে। তাই ভাবো চাচা, ভেবে দেখো। এরশাদের ধরণ খারাপ হতে পারে, তবে এতে তোমার মেয়ের কোন খারাপ নেই। সব কিছু’ই শুরুটা একটু এলোমেলো হয়। তবে শেষটা সব সময়’ই সুন্দর। শুধু একটু সময় দরকার। আর আমি সেই সময়টুকু চাই। বলেই বেরিয়ে গেলো।
অনুমতি চাইল, না শুধু জানিয়ে গেলো জাফর বুঝতে পারলো না। তবে আগের মতোই বসে রইল। কি করবে, কিছুই তার মাথায় এলো না। তবে এরশাদের কথা ফেলেও দিতে পারলো না। এখানে সে আর এরশাদ ছিলো বলে সব সুন্দর মতো হয়েছে। তা না হলে একা একটা মেয়ে কোথাও সম্মান নিয়ে টিকতে পারে? আর এখন ঢাকায় তো আরো পারবে না। তালাক প্রাপ্ত মেয়ে, তার মধ্যে স্বামী হয়েছে খুন। খুনের পরে লাপাতা। সেই মেয়ে হঠাৎ উদয় হলে, কে ভালো চোখে দেখবে। চরিত্রের উপরেও আঙুল উঠাতেও দু’বার ভাববে না। তাছাড়া ঢাকায় যাবেটা কোথায়, থাকবে কোথায়? মেয়েদের জন্য যে এই দুনিয়া বড়’ই কঠিন।
জাফর রাতে আর খেতে নামেনি। আয়না একবার উঁকি দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো। জাফরও আস্তে করে বললো, ” আজ খাবো না রে মা। তোমরা খেয়ে শুয়ে পড়ো”
আয়না আর ভেতরে যায়নি। বাড়িটা পুরো থমকে আছে। এরশাদ ভাই বেরিয়ে গেছেন তখনি।। শয়তান বুড়িও খেলো আজ নিজের ঘরে। আয়না নিজেই সব এগিয়ে গুছিয়ে দিলো। এই যে দিলো, কেন দিলো? একবার জিজ্ঞেসও করলো না। নিজের মতো খেলো। খেয়ে আরামে কিছুক্ষণ পান চিবুলো। আয়না ততোক্ষণে সাদা সোনালি অল্প কয়টা চুলে একটা বেনি তুলে দিলো। দিতেই বাথরুমের কাজ টাজ সেরে নিজের মতো শুতে গেলো। অথচ তার যাবতীয় কাজ আম্বিয়াবু করে।
আম্বিয়াবুও আর রুম থেকে আর বের হয়নি । আয়না গিয়েছিলো ডাকতে। বললো শরীর ভালো না। আয়না আর কি করবে, নিজের মতোই সব গোজগাছ করলো। বাড়ির প্রতিটা জানালা লাগালো। কাজের লোক নিয়ে ছাদের কাপড় তুললো। এতো ঝামেলায় আজকে বাড়ির বসার ঘর ছাড়া কোন জায়গায় সন্ধ্যার বাতি দেওয়া হয়নি। সব বাতি জালালো।
জ্বালিয়ে’ই দাদির সব কাজ করলো। করে নিজেই খাবার বাড়লো। খেতে এলো শুধু শাহবাজ, আর বীণা। বীণাকে দেখে আয়না স্বস্তি পেলো। যাক এ বেলা আর জ্বালিয়ে মারবে না। তবে স্বস্থির বারোটা বাজিয়ে শাহবাজ নিজের মতোই বললো, — কি হলো। হাত পা গুটিয়ে বসে আছো কেন? খাওয়াবে কে? নাকি একদিনেই স্বামীর সেবা করে হয়রান।
আয়না কি বলবে ভেবে পেলো না, তবে বীণার দিকে একবার তাকালো। তার এতো লজ্জা লাগলো। অবশ্য বীণা নিজের মতো খাচ্ছে। তবুও! সে মুখ গোঁজ করেই একটু শাহবাজের দিকে চেপে বসলো। বসে প্লেট তুলে নিলো। যত কথা বলবে, ততো লজ্জায় পড়তে হবে। তার চেয়ে ভালো চুপচাপ খাইয়ে দেওয়া।
অবশ্য চুপচাপ চাইলে’ই বুঝি চুপচাপ হয়। এক লোকমা মুখে পুরে আয়না বসে আছে তো আছেই। আরেক লোকমা নেওয়ার আর খবর নেই। ভাতকে চিবিয়ে মনে হয়, মুখেই হজম করে ফেলবে। দেখতো! এভাবে ভাতে হাত ডুবিয়ে বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
আয়নার ভালো লাগুক আর না লাগুন, তাতে শাহবাজের কি? সে বেশ সময় নিয়ে দ্বিতীয় লোকমা নিলো। আয়নার মনে হলো তার বাকি জীবন এই ভাতের প্লেট নিয়েই কেটে যাবে। ততক্ষণে বীণার খাওয়া শেষ। তার খাবার এমনিতেই অল্প। তার মধ্যে নতুন ভাবি, আর ভাই তাই একটু তাড়াতাড়ি’ই খেলো। খেয়ে বললো, — কিছু করতে হবে ভাবি?
আয়না দু’পাশে মাথা নাড়লো। এই বাড়ির অর্ধেক কাজটাজ কাজের লোক’ই করে। বান্ধা কাজের লোক। রাতে অবশ্যই ভেতর বাড়িতে থাকে না। তাদের পেছনে আলাদা ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে। থাকার মধ্যে শুধু আম্বিয়া বুবু থাকে। সে’ই বাকি কাজটাজ করে। আজ আম্বিয়া বদলে সে করে ফেলেছে।
বীণা আর দাঁড়ালো না, নিজের মতো চলে গেলো। যেতেই আয়না তৃতীয় লোকমা তুলে দিলো, বলতে গেলে জোর করে ঠেলে’ই ঢুকিয়ে দিলো। তার ইচ্ছে করছে এই প্লেট দিয়েই এই শয়তানটার মাথায় এক বাড়ি মারতে। সেইটা আর কি সম্ভব, তাই জোর করে ঠেলে, আপন মনেই বড় একটা শ্বাস ফেললো।
ফেলতেই শাহবাজ বললো, — মুখে কামড় লাগলো কেন?
আয়না বিরক্তের চরম পর্যায় আছে। তবুও নিজেকে ঠান্ডা রেখে আস্তেই বললো, — আপনার মুখে কামড় লাগলো না কাটা লাগলো। আমি বলবো কেমনে? ভাতের প্লেটে হাত ডুবাইয়া বসে আছি।
— ওরে বাবা! মেজাজ?
— কোথায় মেজাজ? কিছু বললেই দোষ।
— দোষ মানে? বসে বসে মনের ভেতরে আমার গুষ্টি উদ্ধার করছো। তাই তো কামড়টা লাগলো। এখন আবার চাপা চালাচ্ছো।
— বাজে বকবেন নাতো, নিন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করেন।
— যদি না করি।
আয়না হাল ছাড়লো! ছেড়ে আরেক লোকমা উঠালো। এবার অবশ্য আয়নার ঠেলে দিতে হলো না। শাহবাজ নিজে থেকেই এগিয়ে নিলো। আর বেশ কয়দা করেই নিলো।
আর নিতেই আয়না ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো।শাহবাজ ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে ঝেড়ে বললো, — হয়েছে কি?
— কিছু না।
— তাহলে তাল গাছের মতো সামনে দাঁড়িয়ে গেছো কেন?
— আমি আপনাকে খাওয়াতে পারবো না।
— তাহলে কে খাওয়াবে?
— আমি জানি না। বলেই প্লেট সামনে রাখলো। রেখে অন্য সাইডে চলে গেলো। হাত ধুলো। সে নিজেও খায়নি। তবুও সব গোছগোছ করতে লাগলো।
শাহবাজ পানির গ্লাস এগিয়ে নিলো। নিয়ে খেতে খেতে বললো, — উরের ভাত স্বামীর মুখে দাও না। পরে আবার কাহিনী শুনবা, স্বামী ভাগিদার নিয়ে আইছে।
— আনলে আনেন! তবুও আমি পারুম না। খেতে ইচ্ছে করলে হাত দিয়ে খান।
— স্বামীর মুখের উপরে, না। বউয়ের আমার ভালোই উন্নতি হয়ছে। চাপা সামলে রেখো।
— পারেন কি আর?
শাহবাজ হাসলো। হেসে বলল — কি পারি দেখাতেই তো চাইছিলাম। তার আগেই ঝট করে তাল গাছের মতো দাঁড়িয়ে গেলে।
আয়না উত্তর দিলো না। মুখ গোঁজ করলো। আয়না অবশ্য জানে না। এই গোঁজ মুখটাই শাহবাজকে টানে। আর টানে বলেই ঠোঁট টিপে হেসে বললো, — গোছাচ্ছো কেন? ভাত খাবে না?
— না।
— কেন?
— এমনিই।
— নাকি গামলা ভরে ভাত খাও সেটা দেখাতে চাইছো না?
আয়নার নিজের মাথা নিজের ফাটাতে ইচ্ছে করলো। গামলা ভরে খাই, বালতি ভরে খাই তোর কি রে শয়তান। এখন ঘাড় থেকে নাম, নেমে শান্তি দে। সারাদির মন্দিরের ঘন্টার মতো মাথার উপরে ঢং ঢং করে বেজেছে। আর কত? আল্লাহ ধৈর্য্য দাও।
শাহবাজ আয়নার চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে অসহায় মুখটাও দেখলো। দেখে আগের মতোই বললো, — ভাত খাও।
— আমি খাবো না।
— না খেলে এখান থেকে নড়তে পারবে না।
আয়নার বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলো না। কিছুটা ঝাজিয়ে বললো — এতো জ্বালিয়ে মারেন কেন? কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি আপনার?
— বাড়া ভাতে ছাই দাওনি ঠিক আছে, তবে পানি তো ঠিকিই দিয়েছো। ঐ যে দেখো প্রমাণ সামনে।
— কিসের প্রমাণ, আর পানি দিলাম কখন?
— এই যে মুখের সামনে ঠাস করে রেখে চলে গেছো। এটা পানি ঢালার চেয়ে কম নাকি?
আয়না আগের মতোই মুখ গোঁজ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ভাত না খেয়ে এই শয়তান এখান থেকে নড়বে না। বরং আরামছে তার মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। তাই গোঁজ মুখে আবার এগিয়ে গেলো। ফট করে যেমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তেমনি কিছুটা ঠাস করেই বসলো। বসে প্লেট হাতে তুলে নিলো। নিয়ে শাহবাজ কিছু বলার আগেই মুখের চেয়েও বড় এক লোকমা ঠেলে মুখে পুরে দিলো। দিয়ে মনে মনে বললো, — নে কত খাবি খা। আমার জান, শান্তি খেয়ে তো মন ভরে না। এই ভাত খেয়ে অন্তত কলিজাটা ঠান্ডা হোক।
শাহবাজ ঘাড় কাত করে তাকালো। আয়না দেখেও দেখলো না। বরং আরেক লোকমা বানালো। বানিয়ে দেবে তখনি শাহবাজ হাত ধরে ফেললো। ভালো ভাবেই ধরলো।
আয়না অবশ্য কিছু বললো না। সে ভেবেছে মুখে ভাত, কথা বলার অবস্থা তো সে রাখেনি। তাই হয়ত হাত ধরে থামিয়েছে। কিন্তু সে কিছু বোঝার আগে’ই শাহবাজ দিলো এক টান।
আয়না এমনিই বসে ছিলো, শরীর ছেড়ে। তার মধ্যে ছোট খাটো মানুষ। এক টানেই শাহবাজের উপরে চলে গেলো। হাতের ভাতের প্লেট উলটে শাহবাজের উপড়ে পড়লো। শরীর, প্লাস্টার, মাদুর সব মাখামাখি।
আয়না মাগো বলে চিৎকার দিতে’ই যাচ্ছিলো। কিন্তু আগেই তার চিৎকার গলায় আটকে গেলো। শুধু কি চিৎকার। ভাত তরকারি সব তার মুখে। কিভাবে এলো। সেটা ভাবতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো।
শাহবাজ হাসলো! হেসে মুখের কাছে মুখ রেখেই বললো, — আরো খাবে বউ? আমি তোমার মতো এতো নিষ্ঠুর নাগো। খাইলে বলো, হাত নেই তো কি হইছে। আরো কত ব্যবস্থা আছে? আর বিশ্বাস করো, আমি তোমার মতো ঢেলে ধাক্কিয়ে খাওয়াবো না। খুব আদর, সোহাগে খাওয়াবো।
আয়না উত্তর দিলো না। তার বমি আসছে। একবার তো ওয়াক’ই করে ফেললো। আর ফেলতেই মুখে হাত চেপে এক দৌড় দিলো। আর শাহবাজ হো হো করে হাসলো। নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়ানো সারেং বাড়িটার দেয়ালে দেয়ালে সেই হাসিটা ঝংকার তুলে ফেললো।
চলবে ….
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩৬
আলাউদ্দিনের দোয়ার আয়োজন শুরু হলো ভোর রাত থেকে। বেলা বাড়লো তার সাথে বাবুর্চিদের ডেগচির বাড়ি, কথা, আয়োজন, হাসি, খাবারের ঘ্রাণ সব কিছুতে সারেং বাড়ির উঠান মুখোরিত হয়ে রইল।
দোয়া পড়ানো হবে যোহরের নামাজের পরে। দোয়ার পরেই খাওয়ার আয়োজন। পুরো গ্রামের মানুষের দাওয়াত। তাই মহিলা, পুরুষদের বসার জায়গা করা হয়েছে ভিন্ন।
এমন আয়োজনে বলতে গেলে সারেং বাড়িন তিন পুরুষ’ই ব্যস্ত থাকার কথা। তবে দু’জন মহাব্যস্ত হলেও জাফর রইল কালকের মতোই। না রুম থেকে বের হলো, না সকালের নাস্তা করলো। না করার অবশ্য কারণ আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইমরানকে ডেকেছিল সে। মেয়েটার খবর জানা দরকার। সামনে দাঁড়াবে সেই মুখ কোথায়? তাই কাজের লোক পাঠিয়ে ইমরানকে ডেকে আনলো।
আর আনলো বলেই তার ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে চারগুণ হয়েছে। মেয়েটা কাল থেকে না খাওয়া। হাসপাতালে সে নিজে নাস্তার কথা বলেছিল। বলল বাসায় ফিরে খাবে। বাসায় ফিরে নাকি শুধু একগ্লাস পানি খেয়েছে। খেয়ে গোছগাছ করতে করতে বলেছে স্টেশন থেকে কিছু কিনে ট্রেনে খেয়ে নেবে।
আর স্টেশন! তারপর যা হলো। সেই থেকে মেয়েটা একেবারে না খাওয়া। ইমরান, সাবিহা বলছে তবে সে আছে একেবারে চুপচাপ শান্ত। না খেয়েছে, না তেমন কথা বলছে। শুধু নাকি পত্রিকার কথা বলেছে। পত্রিকা গত কয়েকদিন তার কাছেও আসছে না। একজন লোক ঠিক করা। সদর থেকে সেই কিছু কিছু জায়গায় পৌঁছে দেয়। তবে তার নাকি শরীর ভালো না। কিছুদিন আসতেও পারবে না।
এমন প্রায়’ই হয়। গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষ। সুযোগ পেলেই শুরু করে ফাঁকিবাজ। দেখা গেলো হালকা জ্বর এসেছে। খবর পাঠিয়ে বলবে, দুনিয়ার জ্বর, মাথা দাঁড় করাতে পারছে না, তাই আসতেও পারবে না। জাফর মাথাও ঘামায়নি। এখনও যে ঘামালো তেমন না, তবে ইমরান কে বলল, — সদর থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।
ইমরান কোন উত্তর করেনি। সে নিজেই সদর থেকে আনতে পারে। পৃথিলাকে আটকানো হয়েছে তাদের তো না। তাদের আটকানো হয়েছে হুমকিতে। তাই জাফর চাচা না জানলেও, ইমরান ভালো করেই জানে পত্রিকা কেন আসছে না। আর আসবেও না, যেই পর্যন্ত এরশাদ ভাই না চাইবে।
ইমরান চলে গেছে। জাফর আগের মতোই পড়ে রইল। সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। ঘর থেকে বলতে গেলে তেমন বের’ই হন না। তাই কি করা উচিত, কাকে ভরসা করা উচিত, তার মাথায় আসছে না। কেননা তার চোখ, কান, মুখ সব ছিল এরশাদ। তার চোখেই তো ঘরে বসে বসে মিঠাপুকুর দেখতো। অথচ এই ছেলেটাই কি সুন্দর করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আর ফেলেছে বলেই এখন সে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পারছেন না। হাতড়ে হাতড়ে কোন দিবে যাবে সেটাও বুঝতে পারে না।
তখনি বীণা উঁকি দিলো। এরশাদ ভাইয়ের কীর্তি বীণা শুনেছে। তার ভাইদের একেক কীর্তি দেখে দেখেই সে বড় হয়েছে। তাই এই কীর্তি তাকে অবাক করেনি। তবে বড় ভাই কাউকে পছন্দ করে এটা জেনে যেমন ভালো লাগছে তেমনি পৃথিলা আপার জন্য খারাপও লাগছে। অন্তত নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু হলে কেমন লাগে এখন সে জানে। তাই তার ঝামেলা একটু শেষ হলেই আপার সাথে দেখা করতে যাবে। অবশ্য এখন আর আগের মতো কথা বলবে কি না, জানে না। কেননা হাজার হলেও শত্রু পক্ষের সাইডে পড়ে গেছে। তবুও যাবে। পৃথিলা আপার কাছে যেতে, কথা বলতে তার ভালো লাগে। কেমন আদর মাখা কণ্ঠে সব বুঝিয়ে বলে। আর যখন বলে সমস্যা গুলোকে আর সমস্যা মনে হয় না।
বীণা উঁকি দিয়েই অবাক হলো। ছোট চাচা রুম থেকে বের না হলেও, খুব ভোরে উঠেন। সারেং বাড়িতে প্রথম জানালার কপাট টা হয়তো এই রুমেরটাই খুলে। তবে আজ চাচা বিছানা ছাড়েন নি। বাসি কাপড় এখনো গায়ে। পর্দা জানালা সব বন্ধ। সকালের আধো আলো আধো ছায়া রুমে বিরাজ করছে। বিরাজ করলেও রুম জুড়ে গুমোট একটা ভাব।
বীণা নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেলো। এই বাড়ির প্রতিটা কোণায় সে নিজের মতোই ঘুরতে পারে। কোন বারণ নেই, নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় বিষয়েই একেকজন নিষেধাজ্ঞার শক্ত দেয়াল তুলে বসে আছে।
বীণা এগিয়ে প্রথমে পর্দা সরালো, জানালা খুললো। খুলতেই জাফর চোখে হাত রাখলো। বীণা তাকিয়ে দেখলো। তার নিজের চিন্তায় সারা রাত ঘুমোতে পারে নি। আজকে দুপুরে আজিজ চাচা তার পুরো পরিবার নিয়ে আসবে। তাই অস্থির লাগছে। সেই অস্থির নিয়ে উঠানে পা রাখতেই আবার দেখলো ফরহাদ ভাই কে। তার আসা এমন কিছু না। ভাইয়ের সব কিছুতেই ফরহাদ ভাই থাকে। তাই এই অনুষ্ঠানে থাকবে না, এমন আশা করা বোকামি। তবুও তার কেমন জানি লাগলো। আর লাগলো বলেই যেমন টুপ করে বাইরে গিয়েছিল তেমনি তার অগোচরে টুপ করেই আবার চলে এসেছে।
এসে আর নিজের রুমে যায়নি। নিজের রুমে গেলে তার আরো অস্থির লাগছে। দাদি একগাদা গহনা আর শাড়ি স্তুপ করে রেখেছে। গায়ের রং শ্যামলা, তাই কোনটা ভালো মানাবে তা তো জানে না। তাই সব বের করে ফেলেছে। গায়ে দিয়ে দিয়ে দেখতে বলেছে।
সে ছুঁয়েও দেখেনি। কালো জেনে, দেখেই তো নিচ্ছে। তো কোন দরকার এতো সুন্দর হওয়ার। তবে আম্বিয়াবুর কোন কারণে মেজাজ খুব খারাপ। তাই তাকে তো আর কিছু বলতে পারছে না। অকারণে কাজের লোকদের একচোট ঝাড়লো। বীণা দেখেও দেখিনি। নিজের মতো ছোট চাচার রুমে চলে এসেছে। ছোট চাচার সাথে কথা বলতে তার ভালো। বলার মতো তো আর মানুষ নেই। একমাত্র ছোট চাচাই সব কিছু মনোযোগ দিয়ে শুনেন। বুঝতে চেষ্টা করেন।
তবে আজ চাচার কোন কিছুই তার ঠিক মনে হলো না। কিছু কি হয়েছে? চাচা ভাতিজার দ্বন্দের কারণ তার জানার কথা না। জানলোও না, তবে বুঝতে পারলো বড় কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে এমন ভেঙে পড়তো না।
তাই বীণা এগিয়ে এলো। এসে কোমল সুরে বললো,, — তোমার শরীর খারাপ ছোট চাচা?
জাফর চোখের উপর থেকে হাত সরালেন। মলিন মুখ তবুও একটু হাসলেন। হেসে আস্তে করে দু’পাশে মাথা নাড়লেন।
— তাহলে উঠছো না কেন?
— ভালো লাগছে না মা।
বীণা সাথে সাথে কপালে হাত রাখলো। না জ্বর নেই। হাত সরিয়েই বললো, — কিছু খেয়েছো?
জাফর আগের মতোই মাথা নাড়লো। বীণা অবাক হয়েই বললো, — কতো বেলা হয়ে গেছে। কাল রাতেও তো খাওনি। ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো। বলে’ই হাত ধরে বীণা টানলো।
জাফর আগের মতোই হাসলো। হেসে আস্তে করে উঠে বসলো। বসতে’ই বীণা বললো, — কিছু কি হয়েছে ছোট চাচা?
জাফর বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — নারে মা, কি হবে।
— তাহলে তোমার মন খারাপ কেন?
জাফর উত্তর দিলো না। বীণা দেখলো। তবে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। তবে তাড়া দিয়ে বললো, — ওঠো তো! তাড়াতাড়ি ওঠো। ওঠো হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি খাবার এখানেই নিয়ে আসছি। বলেই বীনা বেরোতে গেলো।
জাফর হাত ধরে ফেরালো। ফিরিয়ে টেনে কাছে বসালো। বসিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো, — জীবনে অনেক বড় হও মা।
বীণার চোখে পানি চলে এলো। জাফর আগের মতোই মলিন মুখে হেসে বললো, — বাবাদের অনেক সমস্যা থাকতে পারে। তবে এক সন্তানের কষ্টে, আরেক সন্তানকে কখনও অবহেলা করে না। চিন্তা করো না, আমি আজিজ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।
আরেক সন্তান বলতে কাকে বুঝিয়েছে বীণা খেয়াল করলো না। তবে চোখে পানি নিয়েই হাসলো। হেসে বললো, — তার আগে খেয়ে টেয়ে সুস্থ তো থাকো। না থাকলে সন্তানের জন্য যুদ্ধ করবে কি করে? ওঠতো!
জাফর উঠল! উঠতে উঠতে বললো, — মেয়েটা না খেয়ে আছে। একটু কি দেখবি মা।
বীণা বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে বললো, — কোন মেয়েটা?
— পৃথিলা।
বীণা অবাক হলো! পৃথিলা আপার প্রতি জাফর চাচা যেন একটু বেশি’ই অন্যরকম। সেইদিন জ্বর, হাসপাতাল এখন, এই যে এতো চিন্তা, এতো মলিনতা। সব কি পৃথিলা আপার জন্য?
বীণা মনে খটটা লাগে। তবে বুঝতে দেয় না। আগের মতোই হেসে বলে। আমি দেখছি চাচা, তুমি চিন্তা করো নাতো।
জাফর বেরিয়ে হাত মুখ ধুতে গেলো। বীণা বালিশ জায়গা মতো রাখলো। চাদর ঠিক করলো। করে খাবারের জন্য নিচে যেতেই দেখলো, ছোট ভাই সিঁড়ির ওখানে দাঁড়িয়ে। হাতের প্লাস্টারের অবস্থা কাহিল। ময়লা হলে এক কথা, এই রকম হলুদ হলো কি করে? তাই এগিয়ে বললো, — প্লাস্টারে কি হয়েছে ছোট ভাই ?
শাহবাজ একবার প্লাস্টারের দিকে তাকালো। তাকিয়ে হাসলো। হেসে বললো, — প্লাস্টার মনে রং লেগেছে।
— কিসের রং?
— কালনাগিনীর রং।
বীণা চোখে মুখে বিস্ময় নিয়েই বললো, — কিসের রং?
শাহবাজ কটমটিয়ে তাকায়! বীণা আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। কাল রাতে খাবারের আগেও তো ঠিক দেখলো। এর মধ্যে কি করেছে কে জানে। সে কথা বাড়ালো না। ছোট চাচাকে খাবার দিয়ে এক্ষুনি একবার পৃথিলা আপার কাছে যাবে। তাই এগুতে চাইলো! আর তখনি শাহবাজ বললো, — একটা কাজ করতে পারবি ?
বীণা দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — হ্যাঁ বলো।
একটা কাগজ বাড়িয়ে বললো, — এটা তোদের পৃথিলা ম্যাডামের কাছে দিবি। একদম চুপিচুপি।
বীণা দেখলো! দেখে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো। শাহবাজ তার মতোই বললো, — আমি বা অন্য কেউ গেলে ভাইয়ের সন্দেহ হবে। তোর উপরে হবে না।
— কিসের কাগজ?
— সেটা জেনে তোর কাজ কি? দিবি কিনা বল। তা না হলে আমি অন্য রাস্তা দেখছি।
বীণা হাত বাড়িয়ে নিলো। নিতে নিতে বললো, — ভাবিকে নিয়ে যাই?
শাহবাজ আর দাঁড়ালো না। নামাজের সময় হচ্ছে। গোসল করবে । কালনাগিনীকে সকাল থেকে একবারও দেখেনি। কোন কোণায় গিয়ে ফুসফুস করছে, কে জানে। তাই যেতে যেতে একটা শব্দ’ই বললো, — না।
বীণা কিছু বললো না, তবে আড়াল থেকে আয়না ঠিক মুখ বাঁকালো। বাঁকিয়ে বিরবির করে বললো, হতোচ্ছাড়া শয়তান। এক্ষুনি জান খাওয়ার জন্য ঠিক ডেকে উঠবে।
চারিদিক থেকে যোহরের আজান ভেসে আসছে। পৃথিলা শুনলো, শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়ালো। তারপর কল চেপে চোখে মুখে, মাথায় পানির দিলো। সেই দিনের বৃষ্টির পরে আর বৃষ্টির দেখা মিলেনি। উজ্জল নীল আকাশ। সাথে শুভ্র সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, রং তুলিতে আঁকা ছবির মতো ভেসে আছে। এই ভেসে যাওয়া চোখের সৌন্দর্য বাড়ায় তবে বৃষ্টি ঝড়ায় না। ঝড়ায় না বলেই গরমে হাসফাস শুরু হয়।
পৃথিলা চোখে মুখে পানি দিয়ে কল পাড় থেকে বের হতেই দেখলো সাবিহা মলিন মুখে তাকিয়ে আছে। পৃথিলা দেখলো! দেখে বললো, — দিনরাত মুখ যদি এমন করে রাখিস। অপরাধ বোধে আমি আরো আগে মরে যাবো। আমার জন্য তোদের স্বাভাবিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটছে।
— তাহলে খাচ্ছিস না কেন? তুই না খেলে আমাদের গলা দিয়ে খাবার নামে?
পৃথিলা উত্তর দিলো না। উঠান থেকে গামছাটা টেনে বারান্দায় পেতে রাখা কাঠের টুলটার উপরে বসলো। তার শরীর কিছুটা কাঁপচ্ছে। না খাওয়া, জ্বরের রেশ কাটেনি। তার মধ্যে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করেনি। এক হলো ফজরের আযানের একটু আগে। আর হতেই আজব একটা স্বপ্ন দেখলো। সে আর আলাউদ্দিন ফকির একটা গাছের নিচে বসে আছে। সেই দিনের ছেলেটা তাদের সামনে ধূলো বালি মাখিয়ে হুটোপুঁটি খাচ্ছে। সেই ধূলো বালি মাঝে দেখলো এরশাদ এগিয়ে আসছে। গায়ে কালো শার্ট, হাতের মুঠোয় সব সময়ের মতো সিগারেট। কালো শার্ট, শ্যামলা গায়ের রং, তার মধ্যে পোড়া। স্বপ্নে এতো ভয়ংকর লাগলো।
লাগলো বলেই পৃথিলা আলাউদ্দিন ফকিকের দিকে তাকালো। তাকাতেই আলাউদ্দিন ফকির হাসলেন। হেসে কিছু একটা বললেন।
কি বললেন, পৃথিলা বুঝতে পারলো না। তবে তখনি ঘুম ভাঙলো। ভাঙতেই তার অস্থির লাগা শুরু হলো। সেই অস্থির এখনো বুক থেকে নামছে না। তাই চোখে মুখে মাথায় একটু পানি দিলো। যদি ভালো লাগে।
তাই গামছা দিয়ে মুখটা আঁলতো চাপে মুছতে মুছতে বললো, — যখন কিছুই আর করার থাকার না। তখন মানুষ নিজেকে শাস্তি দেয়। মনে কর আমিও দিচ্ছি।
— মরে যাবি পৃথিলা। অন্তত নিজের প্রতি রহম কর।
— মানুষ এতো সহজে মরে নারে। আর আমি তো আরো মরবো না। মুক্তি আমার এতো সহজে হবে না।
তখনি দেখলো সারেং বাড়ির গলি দিয়ে দু’জন এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে কি পৃথিলার বুঝতে বাকি রইল না। আর সেই বোঝার মাঝেই দেখলো তাদের পেছনে এরশাদ আসছে। আসবে সেটাতো পৃথিলা জানেই। তবে সে কিছুটা চমকালো, অবশ্য কারণ আছে। এরশাদের গায়ে কালো শার্ট, হাতের মুঠোয় সিগারেট। আসার ভঙিটাও যেন স্বপ্নের সাথে হুবুহু মিল।
পৃথিলা সাথে সাথে’ই নিজেকে সামলে নিলো। এই লোক সব সময়’ই এমন। এমন ভাবেই চলাফেরা করে। তাই মস্তিষ্ক স্বপ্নে এমন ভাবেই সব মিলিয়ে চড়িয়ে উপস্থাপন করেছে। আর কিছু না। আর কিছু না হলেও, পৃথিলা মনে মনে স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করলো। শেষের কথাগুলো কি ছিল। সে মনে করতে পারে না। পারে না বলেই আরো অস্থির লাগে। আর লাগে বলেই মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আর ফেলতেই বুঝতে পারে এরশাদ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে সিগারেট, আর সিগারেটের গন্ধে তার খালি পেট আরো মুড়িয়ে উঠলো।
অবশ্য তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বরং স্বাভাবিক ভাবেই আবার সোজা হয়ে বসলো। গামছা ছড়িয়ে সুন্দর করে কোলের উপরে রাখলো। রেখে শান্ত চোখে এরশাদের দিকে তাকালো। এই দৃষ্টিতে কোন ভয় নেই, জড়তা নেই, সংকোচ নেই। না আছে কোন রকম দ্বিধা।
এরশাদ দেখে হালকা হাসলো! এই না হলে এরশাদের বাঘিনী। সে হেসে’ই সিগারেট পায়ে পিষলো। সিগারেট ছাড়া তার চলে না, আর এদিকে গন্ধ সহ্য হয় না। কত কিছু ছাড়তে হবে কে জানে?
মনের কথা মনে বলেই এরশাদ উঠান থেকে নিজেই একটা মোড়া এগিয়ে নিলো। নিয়ে বসতে বসতে সাবিহার উদ্দেশ্য বললো, — খাবার গুলো ভেতরে নাও সাবিহা। দাদি তোমাকে সকাল থেকে থাকতে বলেছিল। যাও নি কেন?
সাবিহা উত্তর দিলো না। তবে লোকগুলোর হাত থেকে খাবার নিলো। নিয়ে ভেতরে গেলো। তাদের সাধ্য আছে ছুঁড়ে ফেলার?
লোকগুলো চলে গেলো। যেতেই এরশাদ সব সময়ের মতো মার্জিত ভাবেই বললো, — না খেয়ে আছেন কেন, পৃথিলা?
পৃথিলাও তার মতো স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো, — আমার ইচ্ছে।
— ঠিক! তবে জেদ তো দেখাচ্ছেন আমাকে।
— ভুল! রাগ, জেদ, অভিমান মানুষ তার আপন জনদের দেখায়। আপনি আমার এমন কেউ নন।
— ঠিক! অসুন খাবেন।
পৃথিলা উত্তর দিলো না। চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে নিলো। এরশাদ সেই ফেরানো শুকনো মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কথা বলে স্বল্প তবে হাবভাবে অবহেলা, তিরস্কার, বিরক্তি ঠিক বুঝিয়ে দেয়। এই যে যেমন এখন দিলো।
এরশাদ ঠিক এই জিনিসগুলোই নিতে পারে না। না নেওয়ার কারণ আছে। এই পোড়া মুখ। নিজের মুখ দেখে কেউ ভয়ে থরথর করে কাঁপচ্ছে। চোখে মুখে ভয়, আতঙ্ক, তিরস্কার। এসব দেখতে দেখতে ভেতরে আগুনের মতো জ্বলে। প্রথম প্রথম কষ্ট পেতো, রাগ হতো, সবাই কে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো। এখনোও হয়, তবে হজম করা শিখে গেছে। আর গেছে বলেই এই যে ভয়ংকর মুখ। এই মুখটা এখন আর খারাপ লাগে না, বরং ভালো লাগে। ফরহাদ কতো বলেছে, চল ঢাকায় গিয়ে কিছু করি। তার ইচ্ছে’ই হয় নি। মানুষ যখন ভয় পায় তাঁর ভালো লাগে। আসলেই লাগে।
তবে পৃথিলাম কথা ভিন্ন। সবাই তার দিকে তাকালেই প্রথমে পোড়ার দিকে তাকায়। আর পৃথিলা তাকায় চোখে। তাই আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো, — আমাকে জোর করতে বাধ্য করবেন না পৃথিলা। বিশ্বাস করুন আপনার সাথে জোর করতে আপনার চেয়ে আমার’ই কষ্ট বেশি হবে ।
পৃথিলা হালকা হাসলো! তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে বললো, — আপনার যা খুশি করুন।
— বুঝে বলছেন তো?
পৃথিলা ফিরে তাকায়! আগের মতোই বলে, — আমি কোন সাহসী মেয়ে না। বলতে পারেন ভীতু’ই। এই যে শান্ত ভাবে হুমকি দিচ্ছেন। সবার মতো আমিও ভয় পাচ্ছি। তবে সত্য কি জানেন? পৃথিলাকে আপনি আটকাতে পারবেন, ভয় দেখাতে পারবেন। হয়ত আরো অনেক কিছুই করতে পারবেন তবে ভাঙতে পারবেন না। ভাঙার হলে তারেকের ধোকায় ভেঙে যেতাম। ভেঙে তার সাথে চুপচাপ সংসার করতাম। ভালোবাসার ক্ষেত্রেই ভাঙিনি। আর কি ভাঙবে আমায়?
— এরশাদ।
— চেষ্টা করে দেখুন।
এরশাদ আর কিছু বললো না। আবার পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। করে ঠোঁটের ভাজে রাখতে রাখতে বললো, — খেয়ে নিন পৃথিলা। আপনার জন্য অনেকেই খেতে পারছে না। আর এবার অসুস্থ হলে, আমি কোলে করে হাসপাতালে নেবো না। সোজা সারেং বাড়ি নেবো।
পৃথিলার শান্ত মুখটা কঠিন হলো। সে এমন কিছুই অনুমান করেছিল। আর করেছিল বলেই কিছু ভাবতে চায়নি, জানতে চায়নি। তবে তাকে ঠিক জানিয়ে দেওয়া হলো। অবশ্য এটা জানানো না, এটাও হুমকি, ঠান্ডা মাথার হুমকি। কথা না শুনলে, তুলে নেওয়ার হুমকি।
এরশাদ পৃথিলার কঠিন মুখটা দেখলো! দেখে হেসে বললো, — আপনার বুদ্ধিতে আমি মুগ্ধ হই পৃথিলা। বার বার হই। তবে বুদ্ধির সাথে আপনার আবেগও বেশি। তাই বার বার ভুল করে বসেন। এই যে অযথা জেদ, এগুলোও ভুল।
পৃথিলা উঠে দাঁড়ালো! বসে বসে তর্কের মানে হয় না। এরশাদ সিগারেটে টান দিয়ে বললো, — আপনার এই অযথা ভুলের জন্য সাবিহারা বিপদে পড়বে।
পৃথিলা শুনলো। শুনে পাশ কেটে যেতে যেতে বললো, — সাবিহা, ইমরান, জুঁই। তারপর কি? বিশ্বাস করুন! তারা আছে বলেই পৃথিলা এখনোও আপনার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে, চুপচাপ বসে আছে। তা না হলে মৃত্যুর ভয় পৃথিলার জীবন থেকে মিঠাপুকুরে পা রাখার আগেই মুছে গেছে।
চলবে……
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩৭
বেরুতে বেরুতে বীণার দেরি হয়ে গেল। ছোট চাচাকে খাবার দিল। দিয়ে’ই বুঝি ঝট করে ফিরে আসা যায়! চাচার মলিন মুখটা দেখলেই তো পীড়া হচ্ছে। তাই কিছুক্ষণ বসলো। বসতে বসতেই আজান পড়ে গেল। আর আজান পড়তেই দৌড়ে যাবে ভেবেছিল, এমন সময় দেখলো এরশাদ ভাই খাবার নিয়ে যাচ্ছে। তাই আর এতোক্ষণ এ মুখো হয়’ইনি। মাত্রই বেরুলো, একেবারে গোসল করে।
আম্বিয়াবু ঘ্যনর ঘ্যনর করে মাথা খেয়ে ফেলছে, তাই আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ গোসলে চলে গেছে। গোসল থেকে ফিরে আর কোথাও যায়নি, সোজা চলে এসেছে। অবশ্য বেশিক্ষণ বসা যাবে না, নামাজ শেষ হলো বলে।
তবুও সাবিহা ভাবির কাছে উসখুস করতে করতে বীণা কিছুক্ষণ বসলো। সাবিহা ভাবির সঙ্গে তার সম্পর্ক সব সময়ই অন্যরকম। তবুও আজ মনে হলো, সেই আগের মতো আর তাল নেই, মনের রং ও নেই। তাই মনটা খারাপ করেই বলল,– পৃথিলা আপার সাথে একটু দেখা করি ভাবি।
সাবিহা বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে বলল, — যাও, জিজ্ঞেস করার কী হলো?
বীণার, এই কথাটায়ও খুব খারাপ লাগলো। এই এক কথায় যেনো কত লুকানো আক্ষেপ। সেই আক্ষেপের মন খারাপ নিয়েই ঐ রুমে গেলো। আস্তে করে দাঁড়ালো পৃথিলার সামনে। সেই দাঁড়ানোও জড়তায় ঘেরা। অন্যায় হচ্ছে জেনেও যখন কিছু করা যায় না, তখন জড়তা তো ঘিরে ধরবেই। তবে তার আর সাধ্য কই? নিজে আছে চোরাবালির মধ্যে দাঁড়িয়ে। এই ডুবে তো সেই ডুবে। তাই জড়তা নিয়েই ডাকলো, — আপা।
পৃথিলা ফিরে তাকালো। তার দৃষ্টি শান্ত, কোন আলাদা প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।
বীণা দেখলো! দেখলো বলেই বলার মতো কোন কথা পেলো না। তাই আস্তে করে বলল, — খেয়ে নিন না, আপা। অসুস্থ হয়ে যাবেন।
পৃথিলা বীণার অবস্থা বুঝলো। আসলে মাঝে মাঝে সবাই সব বুঝে, তবে কিছুই করার থাকে না। তাই শান্ত ভাবেই বলল, — তোমার ভাই কি তোমাকে পাঠিয়েছে?
বীণা সাথে সাথে দু’পাশে মাথা নাড়লো। নেড়ে আগের মতোই বলল, — আমি নিজেই আসতাম। তবে ছোট চাচা বলেছে।
— কেন?
— আপনাকে নিয়ে সে খুব চিন্তিত।
পৃথিলা হালকা হাসলো! হেসে বলল, — জেনে ভালো লাগলো। তবে তোমার ছোট চাচাকে বলো, — অন্যায় যে করে, আর দেখেও যে চুপ থাকে, তারা সমান অপরাধী।
বীণার চোখে পানি চলে এলো। সে কখনোও বলতে পারবে না। ছোট চাচা কি এমন? একদম না। ও তো ভাইকে খুব স্নেহ করে, তাই কিছু বলতে পারছে না। নরম মনের মানুষ। তাই চোখের পানি সামলে বলল,– ছোট চাচা কি এমন?
— তোমাদের বাড়ির কে কেমন, এই বিষয়ে আমি যেতে চাচ্ছি না। তুমি এসেছো আমি খুশি হয়েছি, বসো।
বীণা আবারো দু’পাশে মাথা নাড়লো। নেড়ে হাতের মাঝে মুঠো করা কাগজটা আস্তে করে টেবিলের উপর রাখলো। রেখে বলল, — শাহবাজ ভাই দিতে বলল। চুপিচুপি। কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
পৃথিলা কিছু বললো না। না কোন আগ্রহ দেখা গেলো চিঠির দিকে। সে বসে ছিল জানালার পাশে। আগের মতোই বসে রইল। বীণা বেরিয়ে এলো। নামাজ থেকে সবাই ফিরছে। তাই চোখের কোণা মুছতে মুছতে সাইড দিয়ে এলো। আর তখনই কারো সাথে ধাক্কা খেলো।
বীণা ভাবলো, এরশাদ ভাই। চোরের মন পুলিশ পুলিশ তাই ভয়ে মুখ এতটুকু হয়ে গেল। আর হতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো — ফরহাদ ভাই দাঁড়িয়ে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। নামাজ থেকে ফিরেছে। তাই বীণা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
বাঁচলেও ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, — ঠেলে ধাক্কিয়ে গায়ের উপরে আসছিস কেন?
বীণা আস্তে করেই বলল, — আমি দেখি নি।
— দেখবি কী করে, চোখ আছে তোদের?
বীণার কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। মনটা কোন দিক দিয়েই ভালো নেই। তাই সাইড কেটে চলে যেতে নিলো।তবে ফরহাদ আগের মতোই দাঁড়িয়ে বলল, — কাহিনি কী? চোরের মতো পালাচ্ছিস কেন?
বীণা বিরক্ত হলো! তবুও শান্ত ভাবে বলল, — আমি যে ভাবেই যাই, আপনার তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
— তা ঠিক। বলেই ফরহাদ নিজেই যেতে নিলো। তবে বীণা ডাকলো,– ফরহাদ ভাই..
ফরহাদ দাঁড়ালো! দাঁড়াতেই বীণা বলল,– বড় ভাই পৃথিলা আপাকে আটকে রেখেছে। আপনি তো তার বন্ধু। একটু বুঝিয়ে বলেন না।
ফরহাদ জানতো না। এক দিনেই এই দিকে এতো কাহিনী করে ফেলেছে, তার জানার কথাও না। তাই ভ্রু কুঁচকে বলল, — আটকে রেখেছে মানে?
বীণা সব বললো! ফরহাদ চুপচাপ’ই শুনলো। সে কারো বিষয়ে’ই নাক গলায় না। নিজের মতো থাকে। এরশাদ’ই ডেকে একেকটা ঘাড়ে ফেলে। এজন্যই বিরক্তের উপরে থাকে। কেননা এমন এমন জিনিস তার ঘাড়ে ফেলে, করতে গেলে আপনা আপনি’ই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবুও সে কি’বা এরশাদ। কেউ কখনোও কারো কাজে পিছিয়ে থাকে না। তাই ভেবেছে পছন্দ করেছে ভালো কথা। তাছাড়া কে কাকে ভালোবাসবে এটা যার যার ব্যাপার। তবে এখন বেশি হয়ে গেলো না।
ফরহাদের ভাবনার মাঝেই বীণা বললো, — ছোট চাচা বলেছে আপনার আব্বার সাথে কথা বলবে।
— কি কথা?
বীণা হা হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা মানুষ কতোটা গা ছাড়া হলে এমন কথা বলতে পারে তার জানা নেই। আর এদিকে দেখো তার নিজের সব নাওয়া খাওয়া লাটে। তাই হা হয়েই বলল,– আমার সাথে আজ আপনার বিয়ের কথা পাকা হবে, মনে আছে তো?
— ওহ! তাই বল! আমি ভাবলাম কি না কি?
— এটা আপনার কাছে কি না কি, মনে হয়?
ফরহাদের বিরক্তি ফিরে এলো। এতো প্রশ্ন ভালো লাগে না। তাই বিরক্ত মুখেই বলল, — নিজের কাজে যা।
— সেটাতো যাবো’ই। আপনি বললেও যাবো, না বললেও যাবো।
— আমার এমন কেন মনে হচ্ছে আজকাল তোর চাপা বেশি চলছে।
— চললে সমস্যা কি? এখন তো আর আপনি আমার স্যার না।
— কে জানি খবর পাঠালো?
— পাঠিয়েছিলাম, আসেন তো আর নাই।
— আমাকে তোর জয়তুন আরার পোষা পাখি মনে হয়। ইচ্ছে হলে নিষেধ করবি, আবার ইচ্ছে হলে আসতে বলবি।
— পোষা পাখি না হলেও, নাতীন জামাই হওয়ার জন্য তো মরে যাচ্ছেন।
ফরহাদ শীতল চোখে তাকালো! বীণা গোনায় ধরলে তো। ফরহাদকে দেখিয়ে মুখ বাঁকালো। বাঁকিয়ে বলল, –হয়েছেন তো বাপের লেদা। বাপে যেদিকে আঙুল তাক করে সেদিকেই প্যাঁচার মতো গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন দুনিয়া চেনেন না। আবার এসেছেন আমাকে চাপা শেখাতে।
— বাপ সাইডে রেখে কথা বল ফাজিল। তা না হলে আমি ভুলে যাবো তুই কে?
— ভুলে যান, দয়া করে ভুলে। এই বীণা সারা জীবন আপনার কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।
ফরহাদ কিছু বললো না তবে রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়ালো! বীণা মুখ বাঁকিয়ে একটু হাসলো। সে ফরহাদের মতো ওতো লম্বা না হলেও, কিছুটা কাছাকাছি। তাই পা উঁচিয়ে মুখ বরাবর হয়ে বলল, — গত এক দেড় বছর যে অত্যাচার করেছেন। শুধু পড়া লেখার জন্য চুপচাপ হজম করেছি। এখন পড়াও নেই, হজমও নেই।
ফরহাদ এবারো কিছু বলল না, আগের মতোই রইল। তবে মুখের সামনে, এই যে ক্লান্ত, মলিন মুখ। সেই মুখটা ঠিক খেয়াল করলো। খেয়াল করলো, ছেড়ে রাখা আধ ভেজা কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুল। আরো খেয়াল করলো ঐ যে কানের পাশে বসে থাকা কালো ছোট একটা তিল। যা গত দেড় বছরে ফরহাদ একবারও খেয়াল করেছে কি না সন্দেহ।
—-
নামাজের পরে’ই আলাউদ্দিনের নামে দোয়া পড়ানো হলো। আত্মীয় স্বজন কেউ নেই, জয়তুন’ই সখার দুঃখে কিছুক্ষণ বিভোর হয়ে রইল। মোনাজাতে হাত তুলে চোখের পানি ফেললো। আর তারপরেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হলো।
আয়না নিচতলার এক রুম থেকে বসে বসে সেই শুরুটা দেখলো। প্যান্ডেল করা, উপর থেকে দেখা যায় না। তাই এই রুমেই এসে বসেছে। নিচের রুমগুলো থেকে পুরো উঠোন দেখা যায়। তাই সে চুপচাপই বসে দেখলো।
দেখতে দেখতে পরিচিত কত মানুষের মুখ দেখলো। এই মুখের মাঝে খুঁজে ফিরলো কয়েকটা মানুষের পরিচিত মুখ। অথচ এত মানুষ এলো গেলো, তাদের দেখা গেলো না। যাওয়ার কথাও না। হয়তো দাওয়াতই দেয়নি। আর দেয়নি বলেই আয়নার গলা চেপে কান্না দলা পাকিয়ে এলো।
সেই দলা পাকানো কান্না নিয়েই আয়না তাকিয়ে রইল। যেই পর্যন্ত মানুষ আসে যায়, সেই পর্যন্তই ঐ যে লোহার তৈরি সদর দরজা, সেখানেই তাকিয়ে রইলো। তবে যেই মুখ খুঁজে ফিরলো, তাদের দেখা গেলো না।
তখনই আম্বিয়া এসে কিছুটা ঝাঁজের সাথে বললো, — কয় দিকে আমি যাই বলতো! বীনাকে একটু তৈরি করাতেও তো পারো! ঐ মেয়েও ঢের, কিচ্ছু করবে না, মানে কিচ্ছু করবেনা। এখনো বাড়ির জামা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঐ বাড়ির মানুষ এলো বলে। সব যন্ত্রনা আমার ঘাড়েই কেন থাকে?
আয়না নিজেকে সামলে ঘুরে তাকালো। তাকিয়ে অবশ্য অবাক হলো না। সকাল থেকেই কোনো কারণে আম্বিয়াবুর মেজাজ খারাপ। আর কেন খারাপ, আয়না মনে হয় বুঝতে পারছে। আর পারছে বলেই কোনো টুঁ শব্দ করলো না। আম্বিয়াবুর মুখের দিকে শান্ত ভাবেই একবার তাকালো, তাকিয়ে বেরিয়ে এলো।
আসতেই শাহবাজের মুখোমুখি হলো। কুটুম বাড়ির জন্য খাবার দাবার আলাদা করে ভেতরে আনছে। নেয়ে ঘেমে একাকার। আয়না এগিয়ে গেলো। দাঁড়ালো শাহবাজের সামনে।
শাহবাজ ভ্রু নাচিয়ে বলল,– ব্যাপার কি? ডেকে ডেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন না চাইতেই সামনে।
আয়না কিছু বলল না, তবে শাহবাজকে অবাক করে আঁচল উঠিয়ে মুখের গলার ঘাম মুছে দিলো। শাহবাজের কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। শান্ত চোখেই এই অপরুপ সুন্দর মুখটার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল,– কি হয়েছে?
— কিছু না।
— আমি বলে ছিলাম, আমার সাথে নাটক করবি না।
— আমি যাই করি, নাটক মনে হয় কেন আপনার?
শাহবাজ উত্তর দিলো না। তবে তার চোয়াল ঠিক শক্ত হলো। অনুষ্ঠান বাড়ি না হলে এতোক্ষণে মনে হয় ধুম- ধারাক্কা শুরু হয়ে যেতো। আয়নাও আর দাঁড়ালো না। বীণার রুমে গেলো। বীণার অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। চোখ মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে আছে। আয়না মলিন ভাবে হাসলো, হেসে বলল, — চিন্তা করো না। দেখো, সব ঠিক হবে।
বীণা আয়নার হাত ঝাপটে ধরলো! ধরে বলল, — সত্যিই?
— হুম সত্যিই।
আবদুল আজিজ সারেং বাড়িতে এসেছে বলতে গেলে একটু দেরিতে। ততক্ষণে দোয়া, গ্রামের মানুষের খাবারের ঝামেলাটা শেষ। পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। এক তো বিয়ের কথা বার্তা হবে, আর দ্বিতীয়ত তার বড় বউয়ের আবার একটু ফ্যাকড়া বেশি। এক ওয়াক্ত খাওয়ার জন্য সে ভিড় ঠেলবে না। তাই ইচ্ছে করেই দেরিতে আসা। দেরিতে এলেও জয়তুন আপ্যায়নে কমতি রাখলেন না। তাদের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে ভেতরে। ভেতরে ফ্যানের নিচে আরামে আয়াশে আপ্যায়ন করলো। দুই ভাই, চাচা মিলে খেদমত নিজ হাতেই করলেন। হাজার হলেও তাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। কোন দিকে কমতি যেন না হয়। হলোও না, আপ্যায়নে সারেং বাড়ির বদনাম নেই। বরং ফাতিমা থেকে শুরু করে সবাই খুশিই হলো। এজন্যই বলে আত্মীয় সমানে সমানে না হলে ঠিক জমে না। বড়টাও আছে। তবে শহুরে, শহুরে বেয়াই বাড়ির সাথে তাদের মনের মতো মিলমেশ হয় না।
খাবারের পরে জাফর এগিয়ে আজিজের পাশে বসলো। হাতটা আলতো করে ধরলো। ধরে কোমল সুরে বলল, — একটা আবদার করবো ভাইজান। আমাদের বাড়ির সন্তান আমার কাছে প্রথম কিছু চেয়েছে। মেয়েটা তোমার ঘরে দিচ্ছি, তার শখ-আহ্লাদও সব তোমার হাতে দিতে চাই। যদি অভয় দাও আবদার টা রাখতে চাই।
আজিজ কিছুই বুঝতে পারলো না, তবে জাফর তার খুব প্রিয়। প্রিয় বলেই নিজের হাতটা জাফরের হাতের উপর রাখলো। রেখে ভরসা দিলো।
জাফর হাসলো! হেসে বলল, — আমার মেয়েটার খুব শখ ভাইজান, সে লেখাপড়া করবে। আমি জানি এমন কিছু বলে জবান দেওয়া হয়নি। তবুও অন্য কেউ হলে এই দূর্সাহস করতাম না।
আজিজের মুখে অন্ধকার ছেঁয়েছে, জাফর দেখলো। গাঁও গ্রামে বউয়ের পড়া লেখা মানা সহজ কথা না। জাফর আবার কিছু বলবে তবে তাকে অবাক করে এরশাদ এগিয়ে এলো। বসলো তাদের সামনে। বসে তার স্বভাব মতো সম্মানের সাথে বলল, — কোন জোর নেই চাচা। আমরা আপনার সব সিন্ধান্ত’ই সুন্দর ভাবে মেনে নেবো। এটা শুধু একটা আবদার। এই আবদারটা রাখলে, আমার বোনটা খুব খুশি হবে।
আজিজ নিশ্চুপ বসলো। এরশাদ শান্ত চোখেই দেখলো। দেখে আগের মতোই বলল, — আপনি’ই বলেছিলেন চাচা। আপনার বাড়ি আমার বোনের জন্য নিজেদের বাড়ি’ই। তাই আবদার রাখার সাহস আমরা করেছি। কিছু মনে করবেন না। আমার দাদির জবানে কোন হেরফের হবে না।
আজিজ বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে একপলক ছেলের দিকে তাকালো। ছেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে চোখ ফিরিয়ে বলল,– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাদের আবদার রাখলাম। ঘরের মেয়ে। তার সাথে কি আর দুনিয়ার হিসেব মেলে।
জাফর খুশি হলো। জয়তুন সব কিছুই চুপচাপ দেখলো। এত সহজে মানা যেন তার হজম হলো না। অবশ্য বেশি চিন্তা ভাবনার সুযোগ পেলেন না। আজিজ আবার বলল, — আপনাদের আবদার তো রাখলাম। এবার আমাদেরটাও রাখেন। পরীক্ষার তো দেরি নাই। এই মাস খানেক। তাই বিয়ের তারিখটা যদি তাড়াতাড়ি রাখা হয় আমরাও খুশি হবো। তাছাড়া ফরহাদ আছে, পড়ার তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
জাফর নিষেধ করতে যাচ্ছিল — মাস খানেকের ব্যাপার, বিয়েটা পরীক্ষার পরেই হোক। তবে জয়তুন নিজের মতোই বললো, — আমাদেরও কোনো সমস্যা নাই। তুমি এতোখান ছাড় দিবার পারলা, আমরা আর ঝামেলা পাকাবো কী নিয়ে।
ব্যস, সামনে জুম্মাবারে দিনক্ষণ ঠিক করা হয়ে গেলো। বীণা রুমে বসে সব শুনলো। শুনে হতবাক হয়ে বসে রইলো। সে খুশি হবে না বেজার, বুঝতে পারছে না। সেই না বোঝার মাঝেই আম্বিয়া এসে ধরে তাকে বসার ঘরে নিয়ে এলো। গায়ে তার মিষ্টি কাতান শাড়ি। সেই শাড়ি আর হতবাকে জড়সড়ো হয়ে আছে। সেই থাকার মাঝেই ফরহাদের ভাবি দুষ্টুমি করে ঝট করে টেনে ফরহাদের পাশে বসিয়ে দিলো। আর দিতে’ই গিয়ে বীণা বলতে গেলো ফরহাদের গায়ের উপরেই পড়লো। আর পড়তেই বীণা শক্ত হয়ে গেলো।
ফরহাদের অবশ্য তেমন ভাবান্তর হলো না। তবে নিজের মতোই একটু সাইড হয়ে বসলো। বসতে বসতে শুধু বললো, — পড়াও নেই, হজমও নেই। না?
বীণা উত্তর দিলো না। আসলে সে ধরেই নিয়েছিল কেউ রাজি হবে না। কিভাবে হলো?
সেই হওয়ার মাঝেই আয়না শেষ পাতে পায়েস নিয়ে এলো। সবাইকে সুন্দর করে গুছিয়ে এগিয়ে দিলো। আজিজ বসেছে একটু সাইডে। তার সামনে যেতেই আজিজ হাসলো! হেসে কোমল সুরে বলল, — ভালো আছিস রে মা?
আয়না হেসে মাথা কাত করল। করেই বলল, — ভালো, আপনি ভালো আছেন চাচা ?
— আল্লাহর রহমতে ভালো! তো সব ঠিক?
আয়না আবারও মাথা কাত করলো। করে পায়েসের বাটিটা হাতে তুলে এগিয়ে বলল, — পায়েস নিন চাচা।
আজিজ হাত বাড়িয়ে নিলো। নিতেই ভ্রু কুঁচকে আয়নার মুখের দিকে তাকালো। কেননা বাটির নিচে একটা ভাঁজ করা কাগজ।
আয়না স্বাভাবিক ভাবেই আজিজের সামনের ছোট্ট টেবিল থেকে শরবতের খালি গ্লাসগুলো নেওয়ার জন্য নিচু হলো। হতেই বলল, — আপনি বিয়ের আগে বলেছিলেন না চাচা, শক্তিশালী শত্রুর সাথে জয় হচ্ছে টিকে থাকা। এই যে দেখেন, আমি টিকে আছি। এখন শুধু ভেতর থেকে ছেদ করার পালা।
আজিজ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সাইডে বসা জাফরের দিকে একপলক তাকালো। তার বড় ছেলের সাথে কথা বলছে। এই দিকে ধ্যান নেই। তাই নিজের মতো যত্ন করে পায়েসের বাটি হাতের তালুতে রাখতে রাখতে বলল, — তোর বিশ্বাস নেই রে। কখন আবার পাল্টি মারিস।
— এবার মারবো না।
আজিজ হাসলো! হেসে সবার চোখের আড়ালে কাগজটা পাঞ্জাবির পকেটে রাখলো। রেখে পায়েস মুখে দিলো। আর আয়না গ্লাস গুলো নিয়ে নিজের মতো চলে গেলো।
গল্প কথায় কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বোঝা গেলো না। তাই আজিজ তাড়া দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো। বিদায় নেওয়ার আগে ছোট ছেলের বউয়ের হাতে ফাতিমা মোটা সোনার বালা পড়ালো। পড়িয়ে সবাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলো।
আজিজ অবশ্য বাড়িতে গেলেন না। তিনি তার পাটের আড়তে ভ্যান থেকে নেমে গেলেন। নেমে পকেট থেকে কাগজটা বের করলেন। যেখানে আয়নার ভাঙা ভাঙা হাতে বাড়ির সব ঘটনা লেখা। আর তার সাথে লেখা। পৃথিলা আপাকে ঢাকায় পৌঁচ্ছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যতো তাড়াতাড়ি পারেন। তার জীবন সংকটে।
আজিজ হাসলো! হো হো করা হাসি। হেসে চিঠিটা টুকরো টুকরো করে বাতাসে মিলিয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — তুই আমার হারিয়ে যাওয়া সুযোগ রে আয়না। বড় মূল্যবান সুযোগ।
আজিজ যেমন আয়নার চিঠি হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো, তেমনি শাহবাজের চিঠির দিকে পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এত বাজে লেখা সে তার ইহজীবনে দেখেনি। তাই অনেক কষ্টে পড়ার চেষ্টা করলো। যেখানে লেখা, ” আমি আপনাকে ঢাকায় পৌঁছে দেবো। অবশ্য এখন না, সুযোগ পেলে। সেই পর্যন্ত এই না খাওয়ার ঢং বন্ধ করেন। যতো ঢং করবেন, বিপদ ততো বাড়বে। তাই স্বাভাবিক থাকেন। তাছাড়া পালানোর জন্য শক্তি দরকার। আমি তো আর কোলে করে ঢাকায় নিয়ে যাবো না। একজনের কোলে উঠেই তো ঘণ্টা বাজিয়ে ফেলেছেন। তাই আমার ঘন্টা সহিসালামত’ই থাকুক। আর হ্যাঁ, এই চিঠি চুপচাপ হজম, এমনকি ইমরান, সাবিহাও না। যদি এই জেল থেকে মুক্তি চান, এই শাহবাজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নাই। তাই যা বলি চুপচাপ তাই করেন। ”
পৃথিলা চিঠির দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। তার কেন জানি মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই, কি ঠিক নেই? আর হঠাৎ করে তার প্রতি এতো সদয় হওয়ার কারণ কি?
চলবে…..