#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪১
পৃথিলাদের ভ্যান একেবারে লাইব্রেরির সামনে এসে থামলো। সামনে মানে একেবারে সামনে। ভ্যান থেকেই দোকানের সিঁড়িতে পা রাখা যায়। একটা দোকানে মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা দেখবে, এমন মনোভাব গ্রামের মানুষের নেই। গ্রামের মহিলারা অতিরিক্ত দরকার ছাড়া সদরে পা মাড়ায় না। কিছু কিছু যদিও দেখা যায় তারা অতি নিম্নবিত্ত। পেটের দায়ে কাজের খোঁজে। এর বাইরে কিছুটা বাঁকা চোখেই তাকায়। তাই সেই বাঁকা নজর থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়ত সোজা এই রাস্তা। অথচ পৃথিলা এক দুনিয়া থেকে আরেক দুনিয়ায় এসেছে সম্পূর্ণ একা। এখন তার জন্য এই রাস্তার ব্যবস্থা হাসি’ই বটে।
অবশ্য তার চোখে মুখে হাসির ছিটেফোঁটা ও নেই। সে ভ্যান থেকে নামলো চোখ, মুখ কুঁচকে। নিজের গা থেকেই সিগারেটের গন্ধ আসছে। কেউ সাইড দিয়ে হেঁটে গেলে ভাববে সে নিজেই সিগারেট খেয়েছে। আর সেই গন্ধে তার গা গুলিয়ে আসছে।
এরশাদ ভ্যান থামার সাথে সাথেই নেমেছে। সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেও, এখন দাঁড়ালো পাশাপাশি। দাঁড়িয়ে সব সময়ের মতো সুন্দর মার্জিত স্বরে বলল, — আপনি ঠিক আছেন?
পৃথিলা ঠান্ডা ধরনের মানুষ। কাউকে আঘাত বা আক্রমণাত্মক মনোভাব কখনও হয় না। তবে আজ কেন জানি এই লোকটাকে ঠাটিয়ে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে হলো। এ জন্যই হয়ত বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। এমন পরিবেশে এমন মানুষদের মাঝে আটকে আছে। না চাইতেও স্বভাবে পরিবর্তন আসছে। তাই কোন উত্তর দিলো না। আস্তে করে শুধু একটু সরে দাঁড়ালো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।
এরশাদ দেখলো! দেখে ভ্যানওয়ালাকে বলল, — এক বোতল পানি নিয়ে আয়।
এই ভ্যানওয়ালা সেই ভ্যানওয়ালা। তাই বলতে দেরি দৌড়ে যেতে দেরি হয়নি। যেতেই এরশাদ আস্তে করে বলল, — বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করবেন না, পৃথিলা। যদি মনে করে থাকেন, এতো মানুষ দৌড়ে গিয়ে সাহায্য চাইবেন, আর তারা আপনার কথা শুনেই সারেং বাড়ির কারো উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেটা একদম ভুল। তাই যা করতে এসেছেন, শুধু সেইটুকুই করুন। বিশ্বাস করুন এতে আপনার’ই ভালো।
— হ্যাঁ, কতো ভালো তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
— না, পাচ্ছেন না। তাই মনে করুন অনুরোধ করছি। যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন পৃথিলা।
— কেন, ভয় পাচ্ছেন?
এরশাদ হাসল! হেসে বলল, — অতি বুদ্ধিমতিদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
— না, আপনি ভয় পান নিজেকে। আপনি কখনও আয়না দেখেন এরশাদ?
এরশাদ উত্তর দিলো না। সে আয়না দেখে না বললেই চলে। অনেকদিন পরে একবার দেখেছিল, পৃথিলা যেদিন মিঠাপুকুরে এলো তার পরের দিন। তাও ছোট চাচার রুমে। তার পুরো রুমে কোন আয়না নেই।
পৃথিলা উত্তরের আশাও করলো না। সে এগিয়ে গেলো! যেতে যেতে বলল, — নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি যেইটুকুর জন্য এসেছি, সেইটুকুই করবো।
পৃথিলা একাই দোকানে ঢুকলো! এরশাদ ভ্যানের গায়ে হেলান দাঁড়ানো। দাঁড়িয়ে’ই সিগারেট ধরালো। তবে দৃষ্টি এক জায়গাতে। সেটা কোথায় বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিলা নিজেও বুঝল। তবে এবার কোনো বাড়তি ঝামেলায় গেলো না। এই দোকানেই নিয়মিত পত্রিকা আসে। সামনেই রাখা। পৃথিলা দুটো বইয়ের নাম বলে বলল, — আমি কি পত্রিকাটা একটু দেখতে পারি?
দোকানদার বই বের করতে করতে হেসেই বলল, — দেখেন আপা, জিজ্ঞেস করার কী হলো!
পৃথিলা পত্রিকা টেনে নিলো। এই পৃষ্ঠা ওই পৃষ্ঠা, সব ভালো করে দেখলো। প্রতিদিন নিত্য নতুন অপরাধ হচ্ছে। তারেক তো এমন কেউ না, যে প্রতিদিন নিয়ম করে সেই খবর ছেপে যাবে। তাছাড়া, বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। তাই কিছুই চোখে পড়ল না।
সে বড় একটা শ্বাস ফেললো, ফেলতেই না চাইতেও এরশাদের দিকে নজর পড়ল। সোজা চোখ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। না পড়ে উপায় কি? তাই পড়তেই দেখল, এরশাদ ঠোঁট টিপে হাসছে। তারা পত্রিকা না পড়তে পারলেও, এই লোকটা নিয়ম করেই পড়েছে। তাই জানতো, জানতো বলেই সহজে রাজি হয়েছে।
পৃথিলা চোখ ফিরিয়ে নিলো। টাকা বের করার জন্য হ্যান্ডব্যাগ হাতে নিলো। তখনই দেখলো ভ্যানওয়ালা ফিরে এসেছে, আর এরশাদের দৃষ্টি সরেছে। আর সরতেই ঝট করে পৃথিলা ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে হালকা ধাক্কায়, দোকানের কাচঘেরা সামনের টেবিলের আরেক কোণায় পাঠিয়ে দিল। সে অবশ্য জানে না, দোকানদারের নজরে পড়বে কি না। তবে ভাগ্য ভালো হলে পড়তেও পারে। চিঠিটার ওপরে ছোট্ট একটা চিরকুট। না, বাড়তি কিছু লেখেনি। এই গ্রামে কে ভালো, কে মন্দ, কে সারেং বাড়ির লোক সে কিছুই জানে না। তাই শুধু লিখেছে, “চিঠিটা দয়া করে ডাকঘরে পৌঁছে দেবেন।” যদি ভালো মনের হয়, দেবে, না হলে ফেলে দেবে। এখন দেখা যাক, ভাগ্য তাকে কোন প্রান্তে নিয়ে যায়।
পৃথিলা টাকা দিয়ে, বই হাতে নিয়ে বেরুতে গিয়েও থামকে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবেই এরশাদের দিকে আবার তাকালো। সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। তবে হাতে এখন একটা পানির বোতল। ঠোঁটে সেই আগের হাসি। সেই হাসিকে পুরো উপেক্ষা করে পৃথিলা আবার দোকানের ভেতরে এলো। এসে দোকানদারকে বলল, — আপনার দোকানে তো নিয়মিত পত্রিকা আসে?
— জ্বি আপা।
— কিছুদিন আগে ঢাকার একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে তারেক নামের এক লোকের খুন হয়েছিল। সেটার ব্যাপারে কিছু জানেন?
দোকানদার হাসলো! হেসে বলল,– জ্বি আপা! জানবো না কেন? দু’দিন আগেও পত্রিকার হেডলাইন ছিল।
— সেই খুনটার কী হয়েছে? খুনি কি ধরা পড়েছে?
— না আপা, পড়েনি। প্রতিদিন কত খুন হয়! কয়টা ধরতে পারে! তবে সন্দেহ এখন সব আগের স্ত্রীর দিকে। সেই মেয়ের খবর নাই। তবে মেয়ে নাকি আবার বিরাট পুলিশের মেয়ে। তার বাপেই তো কেসটা এখন হাতে নিছে। সে বলছে ” তার মেয়ে কখনও খুন করতে পারে না। বরং হয়ত সে নিজেই বিপদে আছে। তা না হলে পালিয়ে থাকবে এমন মেয়ে সে না। ”
পৃথিলা চমকে উঠলো। চমকে বলল, — কে কেসটা নিয়েছে?
— ওই যে, খুনির আগের স্ত্রীর বাপে।
পৃথিলার বিশ্বাস হয় না। তাই আগের মতোই বলল, — আপনি কি তার নামটা বলতে পারবেন?
— মনে নাই গো আপা। তবে দাঁড়ান, পত্রিকা আছে তো! মাসেরটা জমা করি। তারপর কেজিদরে বিক্রি করি।
বলেই দোকানের এক কোণায় থেকে দু’দিন আগের পত্রিকা টেনে বের করলো। ধুলো ঝেড়ে সামনে মেলতেই, কষ্ট করে আর খুঁজে নাম পড়তে হলো না। তার বাবা, তার স্নেহের বাবার ছবিটা ভেসে উঠল।রক্তের সম্পর্ক না থাক, কখনও ভালোবাসায় কমতি রাখেনি। মিথিলার চেয়ে ভালোবাসার পাল্লা বরং সব সময় তার দিকেই ছিল ভারি।
তবে পৃথিলা সব পৃষ্টা নেড়ে চেড়ে তার কোন ছবি পেলো না। অথচ তার টাই আগে দেওয়ার কথা। তারেকের সাথে বিয়ের পরে মা তার সব ছবি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হয়ত তাই তার কোন ছবি বাবা দিতে পারেনি। তবে তারেকের ফ্ল্যাটে তো থাকার কথা, পুলিশ পায়নি কেন? সে তো কয়েকটা কাপড় ছাড়া কিছুই আনে নি।
পৃথিলার আর ভাবতে পারলো না। চোখে পানি চলে এলো। সেই পানি নিয়েই পাশে রাখা কাঠের টুলটার ওপরে বসে পড়লো। কতদিন পর বাবার মুখটা দেখলো! আর মা, মা কি তাকে ক্ষমা করেছে?
এরশাদের মুখে এখন আর আগের মতো হাসি নেই। সোজা দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে সিগারেট পায়ে পিষলো। পিষে দোকানদারের দিকে শীতল চোখে তাকালো।
দোকানদার আগা মাথা কিছুই বুঝল না। তবে এরশাদের দৃষ্টিতে ঢোক গিললো। সারেং বাড়ির মানুষদের ভয় পায় না, এই অত্র গ্রাম, বাজার, সদরে এমন মানুষ কমই আছে।
আয়না আস্তে করে উঁকি দিল। অবশ্য স্বাভাবিক ভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেও সমস্যা নেই। পুরো দরজা হাট করে খোলা। এই বান্দা ঘুমালে দিন দুনিয়ার হুঁশ থাকে না। এখনও নেই। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। প্লাস্টারের হাবভাবও নেই। লুঙ্গি উঠে আছে হাঁটুর উপরে। হাত সুস্থ হাতের মতো ছড়িয়ে।
আয়না উঁকি দিয়েই কিছুক্ষণ সেই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। হাবভাব তো ভালো না। গেলেই যদি আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে! অবশ্য দিনের বেলা। দরজাও হাট করে খোলা। মনে হয় না এখন শয়তানগিরি কিছু করবে।
আয়না ঢোক গিলে আস্তে করে এগিয়ে গেল। দাঁড়ালো শাহবাজের মুখোমুখি। বাচ্চাদের মতো হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। ঘাড় ছোঁয়া চুল এলোমেলো। শ্যামলা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আয়না এতদিনে একবারও ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। আজ দেখল। বরং খুঁটিয়ে খুঁটিয়েই দেখল। তবে ডেকে তোলার সাহস হলো না। বুকে কাগজ গুলো চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
শাহবাজ ঘুমের ঘোরেই চিত হয়ে শুলো। আয়না দেখে আস্তে করে বলল, — শুনছেন?
শাহবাজের গাঢ় ঘুমে আয়নার কথা কানে ধারের কাছেও যায়নি। বরং সে আরও নড়ে চড়ে আরাম করে শুলো। আয়না আবার ডাকলো, — শুনছেন?
এবারও কোনো হেলদোল নেই। আয়না মুখ গোঁজ করলো। করে নিজের মাথা নিজে চুলকালো। চুলকে আস্তে করে হাতে ছুঁয়ে বলল,– শুনছেন?
এবারো খবর নেই। দিন দুনিয়ার আচার বানিয়ে এ লোক ঘুমাচ্ছে। আয়না হাল ছাড়লো, ছেড়ে এক ধাক্কা দিল। এবার কাজ হয়েছে। শাহবাজ চোখ, নাক মুখ কুঁচকে ঝাড়ি মেরে বলল, — কি হয়েছে?
আয়না ভয় মাখা কণ্ঠে বলল, — দরকার আছে উঠেন।
শাহবাজ আগের তেজেই বলল — কি দরকার?
— উঠেন তারপর বলি।
শাহবাজ বিরক্ত নিয়েই উঠল। উঠে ভালো করে চোখ খুলতেই নজরে পড়ল লাল টকটকে দু’টো ঠোঁট। যেই ঠোঁট দু’টো ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ঠোঁট, গোঁজ করা মুখ শাহবাজকে কেমন টানে, এই মেয়ে যদি জানতো, তাহলে দিন রাত আঁচলে পুরো মুখ ঢেকে রাখতো।
তাই সেই টেনে নেওয়া ঠোঁটের দিকে চোখ রেখেই বলল — কী হয়েছে, সাত সকালে এমন ধাক্কাধাক্কি কেন?
আয়না আর ডানে বামে গেল না। যত তাড়াতাড়ি ফেরা যায় ততই ভালো। তাই হাত বাড়িয়ে সাজেশন দেখিয়ে বলল, — এটা ফরহাদ ভাইদের বাড়িতে দিতে হবে। বীণার পড়া।
— কিসের পড়া?
— কিসের পড়া আবার কি? পরীক্ষার পড়া। রাতের মধ্যে লাগবে। আপনি তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেন।
— দাদি বলেছে?
আয়না মিথ্যে বলল, — হুম।
দিচ্ছি বলেই শাহবাজ পা গুটিয়ে বসলো। বসে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, — দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসো। আমার কথা আছে। আর ভুলেও দৌড় দেবে না।
আয়নার কলিজা ধক করে উঠল। যেমন উঠেছিল, ওই যে প্রথম দিন। সামনে সোজা এসে বলেছিল, “কাপড় খোলো” ঠিক তেমনি। শুরু হয়ে গেছে রে শয়তানের শয়তানগিরি।
— কি বললাম?
আয়নার মুখে কথা আসে না। এ কেমন মানুষ? কোনো সংকোচ নেই, জড়তা নেই। সব পুরুষমানুষ এমন নিলজ্জ, ঠোঁটকাটা হয়? কী জানি! আল্লাহ।
— আমি উঠবো?
আয়না ঢোক গিললো, গিলে আস্তে করে বলল, — কথা বলতে দরজা চাপানো লাগবে কেন?
— কারণ, আপনাকে দেখে আজকাল মাথা ঠিক রাখতে পারি না, তাই। দেখা গেল কথা বলতে বলতে মাথা বিগড়ে গেল। আমার কিছু না হোক, কেউ কিছু দেখলে আপনাকে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি আপনার কথা ভেবেই বলছি।
আয়না আপনি শুনেই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা চাপালো। মাথা বিগড়োবে কি, তার তো ধারলা বিগড়েই গেছে। অবশ্য খিল ফেলল না। সে দৌড় দেবে, অবশ্যই দেবে। তবে কী বলবে, সেটা আগে শোনা যাক।
সে দরজা চাপিয়ে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে পাশের চেয়ারে আগে সাজেশনটা রাখল। দেখা গেল এইটুকুর জন্য আবার আসতে হয়! তাই আগেই সাবধান। তারপর ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বলল, — বলুন।
শাহবাজ আয়নার হাবভাব সবই দেখল। দেখে শান্ত ভাবেই বলল, — খাটে এসে বসো।
— আমি এখানেই ঠিক, আপনি বলুন।
শাহবাজ হাসল! হেসে উঠবে তখনই আয়না হাত উঁচিয়ে থামিয়ে বলল, — বসছি, বসছি তো। বলেই শাহবাজের ঠিক বরাবর, খাটের আরেক প্রান্তে কোনো রকম বসল। বসতে গিয়ে কিছুটা কুঁকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে কোমরে হাত রাখল। তার কোমরের বারোটা এমনিতেই বেজে আছে। আবার কি করবে কে জানে?
শাহবাজ আবারো ঠোঁট টিপে হাসল। হেসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, — দৌড়াদৌড়ি, মারামারি, ঝাঁকাঝাঁকি তো অনেক হলো। এত ঢং আমার ভালো লাগছে না। এখন দশ কথার এক কথা, আমার বউ চাই।
আয়না নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কতো বউ লাগবে আল্লাহ্’ই জানে। তাই বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। নেড়ে বলল, — আচ্ছা।
শাহবাজ অবাক হলো। অবাক হয়ে বলল,– আমি কী বলেছি, আপনি বুঝেছেন?
আয়না সাথে সাথেই মাথা নাড়ল। নেড়ে বলল, — আপনার বউ লাগবে। এখন আমার তো কিছু করার নাই। দাদিকে বলেন।
শাহবাজ ভ্রু কুঁচকালো। কুঁচকে বলল, — দাদিকে বলব মানে?
— মানে আবার কী? আপনার বউ লাগবে। এখন আমি কী করব? আমি থাকি চার দেয়ালের ভেতরে। যা করার দাদিই তো করতে পারবে।
শাহবাজ নিজেও বুঝদারের মতো মাথা ঝাঁকাল। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তার সাথে সাথে আয়নাও উঠে দাঁড়াল। তবে হাবভাব কোন দিকে, সে বুঝতে পারছে না। কথা তো সুন্দর ভাবেই বলছে।
শাহবাজ স্বাভাবিক ভাবে দরজার দিকে এগোল। আয়না ভেবেছিল কথা শেষ, বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে অবাক করে শাহবাজ দরজায় খিল দিল। তাও উপরেরটা। যেটায় আয়না মরে গেলেও হাত পৌঁছাবে না।
আয়না ঢোক গিলল। গিলে বলল, — দাদি আমাকে এটা দিয়েই নিচে যেতে বলেছে।
শাহবাজ উত্তর দিল না। এগিয়ে আয়নার সামনে এল। এসে আগের মতোই বলল, — আমার হাতে প্লাস্টার। বেশি দৌড়ঝাঁপ করলে নাক বরাবর, বেশি না একটা ঘুঁষি মারব।
আয়না সাথে সাথে নাক চেপে ধরল। ধরে বলল, — আমি বাইরে যাব।
— কেন?
— কাজ আছে।
— কিসের কাজ?
— সারেং বাড়ির বউ আমি, কাজের অভাব আছে?
— উঁহুম, ভুল।
— কী ভুল?
শাহবাজ আরো এগোল। একদম আয়নার কাছাকাছি। আয়না সাথে সাথে পিছাতে গিয়ে খাটে ধপ বসে পড়ল। শাহবাজ ঝুঁকে বলল, — আজ থেকে আপনি শাহবাজের বউ। আর এই বউকে’ই শাহবাজের চাই। এখন চাই। এই মুহূর্ত্বে চাই। বুঝেছেন, শাহবাজের বউ?
আয়না আবার ঢোক গিলল। গিলে বলল, — আমাকে না আপনি ঘৃণা করতেন? ভাইয়ের হবু বউ না কি যেন বলেছিলেন।
— এখনও করি।
— তবে ?
— তা তো জানি না। তবে এটুকু জানি, আমার বউ লাগবে।
— ওহ।
— আর কিছু বলার আছে?
আয়না উত্তর দিল না। দিয়ে লাভ আছে বলেও মনে হলো না। তাই সাইড কেটে বেরোতে চাইল। পারল কই? ঝট করে শাহবাজ কোমর চেপে ধরল। ধরে আর সময় নষ্ট নেই। ঝাপটে আয়নাকে নিয়েই খাটে পড়ল। আয়না ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। শাহবাজ অবশ্য কিছুই করল না। শুধু আয়নার পাশে আরাম করে কাত হয়ে শুয়ে বলল, — কাঁদছো কেন?
— আমার কোমরে ব্যথা, টাটাচ্ছে।
— ওহ বলেই পেটের আঁচল ঝট করে সরিয়ে বলল, — দেখি। মালিশ করে দেই।
আয়না “মাগো!” বলেই ঘুরে গেল। ঘুরতেই পিঠে সেই যে শাহবাজের লাঠির বাড়ি, সেই বাড়ির দাগটা শাহবাজের নজরে পড়ল। লম্বা সোজা দাগ। ফর্সা পিঠে হালকা কালো হয়ে আছে। বোঝা’ই যাচ্ছে অনেক দিন আগের।
শাহবাজ সেই দাগে আঙুল ছুঁয়ে বলল, — পিঠে কী হয়েছিল?
আয়না উত্তর দিল না। সে বরং সরার তালে আছে। আর সরতে গিয়েই শাহবাজ কোমর ঝাপটে আবার টেনে কাছে নিল। আয়না অবশ্য আর ফেরেনি। তার পিঠ শাহবাজের বুকে। সে আছে বাঁকা কুঁজো হয়ে । শাহবাজও তার মতোই বাঁকা হয়ে শুলো। শুতে শুতে বলল, — যত ঢংই করো, আজকে আমি ছাড়ব না।
ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। কাজের লোক টোকা দিয়ে বলল, — আয়না ভাবি, দাদি ডাকে। পান নাকি খাইবো?
আয়না হাঁফ ছাড়ল। আল্লাহ বাঁচাইছে গো। বলেই ঝট করে উঠতে গেল। শাহবাজ আগের মতোই চেপে ধরে স্বাভাবিক ভাবে বলল, — দাদিকে গিয়ে বল, আয়না ভাবি, শাহবাজ ভাইয়ের কাছে।
আয়না আবার কেঁদে ফেলল। শাহবাজ কোমর ছেড়ে চিত হয়ে শুতে শুতে বলল, — আজকে আমি সত্যিই ছাড়ব না আয়নামতি।
আয়না ফুঁপাতে ফুঁপাতেই বলল — আমি আপনাকে ঘৃণা করি।
— মা বাবার খুনিদের ঘৃণা তো করবেই। বরং ভালোবাসলেই অবাক হতাম।
আয়না অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল। শাহবাজ সব সময়ের মতো তার চেনা ভঙ্গিতে হাসল। হেসে আয়নার লাল টুকটুকে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলল, — এত ঘৃণা গায়ে আগুন দিয়ে বিয়ের সময় কোথায় ছিল?
— ছিল। ছিল বলেই বিয়ে করেছি।
— কেন?
— কারণ, আমি আপনাকে খুন করতে চেয়েছিলাম। আমার জীবন তো নরক বানিয়েছেন আপনি’ই। কি হতো আমাকে যেতে দিলে। তাই বিয়ের দিন রাতে যে হামলা হলো, সেটায় আমি ছিলাম। তো এখনও আপনার বউ চাই?
শাহবাজ অবাক হলো না। অনুমান সে আগেই করেছে। সেই দিন চিঠিটা কিছুটা হলেও দেখেছে। তবে কে পাঠিয়েছে ধরতে পারছে না। আর যার কথা ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে, সেটা মানতে পারছে না। তার সাথে সারেং বাড়ির শত্রুতা কী? সম্পর্ক তো আর একদিনের না । তাদের জন্মের আগের। নাকি অন্য কেউ। আয়নার চাচা। না তার এতো সাহস হবে না। তবে? আর কে? সারেং বাড়ির ক্ষতি করে কার লাভ? আর এইসবের একমাত্র উত্তর আয়না। তবে সে জানে, আয়না মরেও গেলেও মুখ খুলবে না। অবশ্য আয়নার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে চাপা খুলে মুখ খুলিয়ে ফেলতো। তবে সে আয়নামতি, শাহবাজের পিরিতের বউ। চাইলেই কি আর এখন কিছু করা যায়? তাই তার মতোই বলল, — হ্যাঁ চাই।
— আপনি আমার কাছে এলে গলায় দড়ি দেব। আজই দেব। এই ঘরের ফ্যানের মধ্যে দেবো।
— দাও, সমস্যা নাই। তবে কার সাথে হাত মিলিয়েছো, সেটা বলে যাও।
— কেন? সারেং বাড়ির এত ক্ষমতা? যান, খুঁজে বের করেন।
শাহবাজ আগের মতোই হাসল। হেসে ঝট করে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দরজার খিল খুলল। খুলে নিজের মতো বেরিয়ে গেলো। বোকা আয়না বুঝল না শাহবাজ কেমন প্যাঁচে ফেলে তার পেটের কথা বের করল। এখন বাকি শুধু মুখ খোলার ব্যবস্থা করা। আর তার মুখ তার বাবা মায়ের খুনি কে জানতে পারলেই খুলবে। আপনা আপনি’ই খুলবে। তা না হলে, শাহবাজের বউ লাগবে, আবার অনুমতি চাইবে, এতো ভদ্র শাহবাজ হলো টা কবে?
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪২
সারেং বাড়িতে বিয়ের সানাই না বাজলেও মহাজন বাড়িতে ঠিক বেজে গেলো। ভালো ভাবেই গেলো। তাদের আত্মীয় স্বজন অনেক। ফাতেমা আশপাশের মানুষের সাথে মিল মহব্বত দিয়ে মিলেমিশে থাকে। মহাজন হলেও মিঠাপুকুরে আজিজের সুনাম অনেক বেশি। বিপদে আপদে, দান খয়রাতে সব কিছুতেই আগে। গ্রামের মানুষ সারেং বাড়িকে যেমন ভয় পায়, ঘৃণার চোখে দেখে, তেমনি মহাজনকে ভরসা করে ভালোবাসে। তাই তাদের বাড়ির বিয়ের আয়োজনে তারা মন থেকে’ই লেগে গেছে। কাল গায়ে হলুদ, তার নানা আয়োজনে পুরো বাড়ি এমনিতেই মুখরিত হয়ে আছে। তার মধ্যে ফাতেমার অনেক খাতিরের মানুষ তো টিপ্পনী কেটে বলছে, “মেয়ে আর পাও নাই? জয়তুন আরার নাতনি।”
ফাতেমা সিধেসাদা মনের মানুষ। তিনি শুনে হাসেন। ফরহাদ তাদের প্রিয় সন্তান। তার স্বামীর উপরে তার পুরো বিশ্বাস। সে জেনে শুনে ছেলের খারাপ হবে, এমন কিছু করবেই না। বরং এই বিয়েতে সবচেয়ে খুশি সে। এতো লোক থাকতে নিজ হাতে সব করছে। ঘুরে ফিরে আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নিচ্ছে। আশে পাশের, গ্রামের মানুষদের নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছে।
তখনই মনে পড়ল, দুপুরে আড়ত থেকে তিনি বীণার পড়ার কিসের কাগজ যেন পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ফরহাদ স্কুল থেকে ফিরলে দিতে। স্কুল থেকে ফিরেছে বিকেলে, এখন সন্ধ্যা হয়ে চলল। এতো ঝামেলায় মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।
ফাতেমা কাগজ নিয়ে দৌড়ে গেলেন। কথায় আছে যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই। তাদের হয়েছে সেই অবস্থা। তারা বিয়ে বিয়ে করে মরছে, এদিকে যার বিয়ে সে দিব্যি আরামছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, স্কুল করছে। এমনি সোজা ঘোষনা দিয়েছে, তার রুমে যাওয়া নিষেধ, একদম নিষেধ।
বিয়েবাড়ি, এতো আত্মীয় স্বজনে খেয়াল রাখা যায়? পোলাপান সব যে যেখানে পাচ্ছে, হুটোপুটি খাচ্ছে। ঐ রুমে কখন গেছে বলতেও পারে না। স্কুল থেকে ফিরে দেখে একটাকে তো প্রায় তুলে আছাড় মেরেছে। তার ভাগ্নির ছেলে, ভাগ্যিস দেখে নাই। এমনিতেই সাত ঝামেলা ছাড়া বিয়ে হয় না, এদিকে তার ছেলেই হচ্ছে মহা ঝামেলা। তাই জয়তুন আরার নাতনি বলে তারা ভয় পাবে কি? তার তো এই মেয়েটার জন্যই ভয় করছে।
ফরহাদ পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসেছে। চোখ, মুখ কুঁচকে এমনভাবে খাতা দেখছে, যেন খাতার মালিককে পেলে ছাল তুলে নেবে।
ফাতেমা দেখে বড় একটা শ্বাস ফেললো। ফেলে এগিয়ে এসে ছেলের সামনে সাজেশন ধরে বলল,– নে ধর, তর ছাত্রী পাঠিয়েছে।
ফরহাদ বিরক্ত মুখেই চোখ তুলে তাকাল। দেখে চিনতে এতটুকুও সমস্যা হলো না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই টেনে হাতে নিল। ভ্রু কুঁচকে গোল গোল লাল বৃত্তগুলো দেখল। বইয়ের পড়া বীণা পারে। ভালো ভাবেই পারে। তবে নিয়ম ঠিক রেখে কিছু কিছু প্রশ্নে পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বাভাবিক, পরীক্ষা একটু অন্যভাবে তো আসবেই। তাই তার প্রস্তুতি হিসেবে স্কুল থেকে সেইভাবেই দিয়েছে। ক্লাসে অবশ্য বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্কুলে যাচ্ছে না, তাই সে জানেও না।
ফরহাদ দেখে সাইডে রাখল, খাতা দেখা বাকি আছে দু-তিনটা। সেই খাতায় আবার মনোযোগ দিল। ফাতেমা দেখে বলল, — কাল থেকে কিন্তু আর স্কুলে যেতে পারবি না।
ফরহাদ এমনিতেই যেত না। পুরো গ্রামের মানুষ জানে বিয়ে। গেলে সবাই অন্য চোখে দেখবে। তাই খাতা দেখতে দেখতেই শুধু মাথা নাড়ল।
— বিয়ের কোনো কিছুই তো দেখলি না।
— দেখার কী হলো?
— ওমা! তোর বউ সব ঠিক আছে কি না, দেখবি না?
— আমার বউ এখনো হয়নি।
— বাকি আর কী?
— অনেক কিছু।
ফাতেমা আর কথা বাড়াল না। বিয়েবাড়ি, কাজের তো অভাব নেই। এদিকে তার বড় বউ হচ্ছে ঢেপের রানি। কাজের বেলা কিচ্ছু নাই। তাই নিজের মতো চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে বলল— এর আগে তোর আরো দু’বার বিয়ের কথা বার্তা হয়েছে। ঠিক আছে ঝামেলা করিস নি, তবে আগ্রহও দেখাসনি। তাই তারা নিজেরা সরে গেছে। এবার এমন কিছু করিস না বাপ, মেয়েরা শুধু ভাত কাপড়ের জন্য স্বামীর বাড়ি আসে না।
ফরহাদ উত্তর দিলো না। নিজের মতো খাতা দেখতে লাগলো। ফাতেমা ছেলের প্রতি তবুও বিরক্ত হলেন না। বরং মাথায় স্নেহ নিয়ে একবার হাত বুলিয়ে দিলেন। দিয়ে নিজের মতো চলে গেলেন। আর যেতেই ফরহাদ সাজেশন টার দিকে তাকালো। নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে’ই রইল। তারপর হাতের খাতাগুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
সারেং বাড়িতে বিয়ের আয়োজন বলতে এরশাদ দুনিয়ার বাজার সদাই করে পাঠিয়েছে। যেমন বিয়ের বাজার, তেমনি ছেলে থেকে ছেলে বাড়ির জন্য যাবতীয় যা লাগবে, সব। এছাড়া আর তেমন কিছু নেই। বাইরের আয়োজন যা, তা সব কালকে সকাল থেকে শুরু হবে। অন্য সময় হলে আম্বিয়া নিজ থেকেই বিয়ের আয়োজনে লেগে যেতো। তবে এখন যেটুকু দরকার শুধু সেইটুকুই করছে। আর আয়না এতো কাজে কোন দিকে যাবে দিশে’ই পাচ্ছে না। তবে আম্বিয়ার সাথে বেশ ভাব জমেছে। কিছু করুক আর না করুক, তার পেছন পেছন ঠিক ঘুরছে।
জয়তুন বসে বসে সবই দেখল। তার মন একটু আদ্র হয়ে আছে। বিয়ে বাড়ি অথচ বিয়ের কোনো আমেজ নেই। কাজের লোক হাজার থাক, বাড়ির কর্ত্রী না থাকলে, কোনো আয়োজনই আয়োজন হয় না। এই যে মেয়েটার বিয়ে, ভালো মন্দ কেউ বুঝিয়ে বলবে সেই মানুষটাও নাই।
তখনই দেখল, ফরহাদ আসছে। হাতে মোড়ানো একটা কাগজ। জয়তুনের আদ্র মন ফুরুৎ করেই উড়ে গেল। যেতেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আজকালকার ছেলেমেয়েদের রংঢং তার মাথায় কুলোয় না। রাত পোহালে গায়ে হলুদ, আর এদিকে জামাই শ্বশুরবাড়ি এসে হাজির।
তাই ভেতরে আসতেই ভ্রু কুঁচকেই বলল, — কাহিনী কি রে ফরহাইদা?
ফরহাদ শান্ত চোখে তাকাল। এই বুড়ি আর জীবনে ভালো হবে না। তাই শান্তভাবেই বলল,– কোনো কাহিনী নেই, বীণা কোথায়?
— বীণা কোথায় মানে? বিয়ের আগে জামাই বউর যে মুখ দেখতে হয় না জানিস না?
— না জানি না, প্রথম বিয়ে তো তাই। আবার করতে গেলে তখন ঠিক জেনে যাবো।
— আবার করতে গেলে মানে, তোর কয়টা করার ইচ্ছা?
— দেখি, মন কয়টা করতে চায়।
— ইতরামি করোস?
ফরহাদ আর দাঁড়াল না, তাকে আবার ফিরতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্টের মানে হয় না। বিদ্যাসাগরি বিদ্যার জাহাজেই থাকার কথা। তাই বীণার রুমে যেতে যেতে বলল, — করলেও দোষ কী? সম্পর্ক তো ইতরামিরই।
— তোর ইতরামির খেতা পুড়ি। খবরদার, আমার নাতনির রুমে যাবি না।
ফরহাদ শুনলও না, তবে যেই উত্তর তার মাথায় এসেছে, সেটা দিলে এই বুড়ি এখানেই টাসকি খেয়ে পড়ে যাবে। তাই চুপচাপ নিজের মতো চলে এলো। আর আসতেই একটা ভুল করে ফেলল। জয়তুন আরার কথার তালে তালে এসেছে। তাই সোজা ঢুকে গেছে। দরজায় টোকা দিতে ভুলে গেছে। আর গেছে বলেই থমকে দাঁড়াল।
বীণা পড়ার টেবিলেই বসা। চুল ছাড়া, গায়ে ওড়না নেই। পা দুটো গুটিয়ে চেয়ারে তুলে বাচ্চাদের মতো পড়ছে। তাকে খেয়াল করেনি। করেনি বলেই ফরহাদ হাঁফ ছাড়ল। ছেড়ে আস্তে করে দু’কদম পেছাল। পিছিয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিল।
বীণা বলতে গেলে লাফিয়ে উঠল। এই খাঁকারি কার সে জানে, ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই কোন দিকে যাবে, দিশে পেলো না। ওড়না কই, চুলের রাবার কই। হাতের নাগালের জিনিসও তার চোখে পড়ল না। তাই একবার রুমের এদিকে গেলো, আরেকবার ঐদিকে। পায়ে তার পা ঝাপ, সেই ধ্বনি পুরো রুমে ঝমঝম করতে লাগল। তার এই ঝমঝম সুর আর ঢেউ খেলানো চুল উড়িয়ে পুড়িয়ে দৌড়াদৌড়ি ফরহাদ পর্দার আড়াল থেকে দেখল, দেখে আজকে আর বিরক্ত হলো না, বরং নিজের অজান্তেই ঠোঁট টিপে একটু হাসল।
সেই হাসি অবশ্য খনিকের। বীণা একটু ধাতস্থ হতেই স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গেল। গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। চোখ তুলে অবশ্য তাকালো না। বিয়ে নিয়ে হাজার গা ছাড়া থাক, বিয়ে তো বিয়ে’ই। তাই না চাইতেও একটা অস্বস্তি ঠিক জেগে ওঠে। বীণার ক্ষেত্রেও তাই হলো। এই বেলা পর্যন্ত বিয়ের কোনো কিছু মনে না হলেও, এই যে কালো শার্ট গায়ে মানুষটাকে দেখল, দেখতেই মাথার ভেতরে ভো ভো করতে লাগল। কাল বাদে পরশু তাদের বিয়ে। এই যে তার এতোদিনের নিজের হাতের সাজানো গোছানো চেনা পরিচিত রুম, রুমের জিনিস, প্রতিটা কোণা, এই যে ছোট বেলা থেকে বেড়ে ওঠা নিজের বাড়ি। সব, সব পর হয়ে যাবে। এদের মায়া ছিঁড়ে ছেড়ে যেতে হবে।
যেতে হবে এই যে, এই মানুষটার ঘরে। যাকে নিয়ে কিছু ভাববে তো ভালোই, দেখতেই পারে না। বীণার চোখে মুহুর্তেই পানি চলে এলো। সেই পানি সে লুকাতে পারল না, বরং এই হাত, ওই হাত দিয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছতে লাগলো।
ফরহাদ না তাকিয়েও বুঝল। বুঝে তার মতোই বলল,– পড়বি, না চলে যাবো?
বীণা মুখে কিছু বলল না, তবে চোখে পানি নিয়েই চেয়ার টেনে বসলো। বসতেই ফরহাদ তার মতো খাতা কলম টেনে নিলো।
জয়তুন আরা বসার ঘরে বসেই গজগজ করতে লাগল। আয়না দেখে ঠোঁট টিপে হাসল। হেসে নিজে থেকেই সন্ধ্যার নাস্তা পানি দিয়ে এলো। হাজার হলেও বাড়ির জামাই। অবশ্য জামাই বউয়ের কোন কিছুই তার নজরে পড়ল না। দু’জন টেবিলের দু- প্রান্তে বসা। ফরহাদ ভাই নিজের মতো অংক বুঝাচ্ছে, বীণা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তবুও আয়নার দেখতে ভালো লাগলো। পর্দার আড়ালে বেশ কয়েকবার উঁকিও দিলো।
দিয়ে মনের আনন্দে টুকটাক কাজে লেগে গেলো। সে আছে বলতে গেলে মহা আনন্দে। শয়তানটা তাকে আর জ্বালিয়ে মারছে না। এমনকি তাকিয়েও দেখছে না। অবশ্য বিয়ে নিয়ে ঝামেলার কারণেও হতে পারে। তবুও এর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে! মনে হয় গলায় দড়ি দেওয়ার কথায় কাজে দিয়েছে।
তখনই কালাম খবর নিয়ে এলো, এরশাদ ভাইয়ের উপরে হামলা হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হামলা করেছেন চেয়ারম্যানের লোক। অন্ধকার হলেও তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। এখন চেয়ারম্যানের নামে এরশাদ ভাই মামলা দেবে।
আয়না, বীণা বলতে গেলে চমকে উঠল, তবে জয়তুনের তেমন হাবভাব হলো না। শাহবাজ আগেই বাড়িতে নেই। তবে জাফর আর ফরহাদ শোনা মাত্রই দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
তেমনি দৌড়ে গেল আবদুল আজিজ। তবে হাসপাতাল না, বন্ধুর বাড়ি। মামলা টামলা নির্বাচনের জন্য ভারি পড়বে। তাছাড়া সারেং বাড়ির সাথে একমাত্র তার জন্যই লাগতে গেছে। অবশ্য লোভে পড়েই গেছে। কেননা আজিজ বলেছে, সারেং বাড়ির জায়গা দখল নিতে পারলে, তার জায়গাও দিয়ে দেবে। আর সেগুলো নিতে পারলে ইটের ভাটায় কব্জা করতে চেয়ারম্যানের বেগ পেতে হতো না। তাই অনায়াসেই রাজি হয়েছে। অবশ্য চেয়ারম্যান জানে না, জমি তো শুধু বাহানা। সে তো সারেং বাড়িকে ধ্বংসের জন্য নেমেছে। শুধু ভেতর থেকে না, বাহির, ডান বাম, উপর নিচ সব জায়গা থেকে। অনেক আগে একবার এভাবেই নেমেছিল। তবে ভাগ্যে জোরে বেঁচে গেছে। এবার বাঁচতে দেবে না। তাই সবার আগে সারেং বাড়ির রক্ষাকবচ এরশাদকে ভাঙতে হবে। আর সেই ভাঙার চাবি দিয়েছে, সারেং বাড়ির নয়া বউ আয়নামতি। আহা আয়নামতি, তুই তো তোর বাপের চেয়েও বেশি উপকারে আসলিরে মা।
এরশাদরা ফিরল মধ্যরাতে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে। তার মাথায় ব্যান্ডেজ থাকলেও আজ শাহবাজের হাতে প্লাস্টার নেই। খোলার ডেট আরও পরে। তবে ধৈর্য আর কুলালো না। তাই খবর শুনে হাসপাতালে যখন গিয়েছে এক কাজে দু’ কাজ করেছে। একদিকে ভাইয়ের মাথায় পেঁচিয়েছে আরেক দিকে তার হাতের টা খুলেছে। খুলেই গেছে থানায়। চেয়ারম্যান মানুষ, শুধু মামলায় কি আর হবে? তাই ওসির পকেট একটু মাল পানি ঢেলেছে। যাক বাবা এক দিক ঠান্ডা। এতো ঝামেলা আর ভালো লাগছে না।
তাই সেই খুশিতেই হেলে ঢুলে নিজের রুমে চলে এলো। এসেই দেখলো পুরো রুম আলো করে আয়নামতি শুয়ে আছে। তার ভয়ে তো এখন আর দরজায় খিল দেয় না। তবে বাতিও নেভায় না। এতো আলোতে ঘুমায় কী করে কে জানে। তবে ঘুমায় খাটের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে। এক কাতেই রাত শেষ। কোনো নড়চড় নেই।
শাহবাজ দরজায় খিল দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। দিয়ে এগিয়ে জানালা খুলে দিল। আজ আকাশে চাঁদও নেই, মেঘও নেই। তবে মৃদু একটা আলো পুরো রুমে ছড়িয়ে গেল।
সেই আলোতে শাহবাজ একধ্যানে ঘুমন্ত আয়নার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নিজেকে কোনো কিছুর জন্য শাসালো। সে এক পাগল। তার কপালে জুটেছে আরেক পাগল। সত্যি সত্যিই ফ্যানে ঝুলে গেলে আরেক সমস্যা। তাই চুপচাপ সাইডে শুয়ে পড়ল। শুলেই বুঝি ঘুম আসে। এই যে খাটের কোণায় মানুষটা, চম্বুকের মতো টানতে লাগলো। চোখ বুঝে দাঁত চেপে অনেকক্ষণ পড়ে রইল। তারপর ফট করে চোখ খুলল। খুলে দাঁত চিবিয়ে বলল, শালার ঘরে ফ্যানই রাখবো না। বলেই এগিয়ে এক ঝটকায় আয়নাকে ঘুরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
আয়নার ঘুম পাতলা। তার মধ্যে থাকে আতঙ্কে । এক ঝাঁকিতেই তার ঘুম ছুটে গেল। আর ছুটতেই পুরো শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। না, আজকে আর শক্ত মূর্তি হওয়ার সুযোগ পেল না। না পেলো মাগো বলে চিৎকার দিতে। বরং কেঁপে উঠল, এই কেঁপে উঠা শুধু শরীরে না, মনে, মস্তিষ্কে, অন্য কোন অচেনা জগতের। আর এই জগতের বেপরোয়া এক ঢেউয়ে আয়না লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।
……
সকালে উঠে সাবিহা প্রতিদিনের মতো উঠান ঝাড়ল, খোয়ার খুলল। মোরগ, মুরগিকে চাল ছিটিয়ে, বাসি কাপড়গুলো উঠানে মেললো। তখনি দেখল এরশাদ ভাই আসছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। হামলার কথা ইমরানের কাছে রাতে শুনেছে। শুনে পৃথিলাকে বলল। পৃথিলা সবই শান্তভাবে শুনল। শুনে শান্তভাবেই বলল,– এটা সারেং বাড়ির মানুষেরই কাজ। জমি নিয়ে ঝামেলা। তার মধ্যে সেইদিন গন্ডগোল হয়েছে। ব্যস, এক কোপে দু’ মাথা ফেলেছে।
সাবিহা তখন হাঁ হয়ে বলেছে,– মানে?
— মানে আবার কী? ভর সন্ধ্যায় কে হামলা করতে যাবে? তাও আবার এমন মানুষদের, তাও পুরো গ্রাম জানে তাদের মধ্যে গন্ডগোল হয়েছে। গাধাও আসবে না এখন হামলা করতে। আর আমার চেয়ে সারেং বাড়ির মানুষদের তুই ভালো জানিস। এরা মাথার বদলে মাথা নেয়। থানা পুলিশের ধার ধরে নাকি? এই থানা পুলিশ পর্যন্ত যাওয়ার জন্যই এই হামলা। এখন চেয়ারম্যানের মানুষ নিজের সম্মান বাঁচাতে মামলা নিয়ে উঠে পড়ে লাগবে। আর জায়গার কথা চুপচাপ হজম হয়ে যাবে।
সাবিহা আর কিছু বলেনি। এতো প্যাঁচ কি আর তার মাথায় ধরে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়াল। পৃথিলা এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। মেয়েটার খাওয়া ঘুম সব অনিয়মিত হচ্ছে।
সাবিহা ভেবেছিল এসে সোজা পৃথিলার কথা জিজ্ঞেস করবে। তবে তাকে অবাক করে সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবে বলল,– বীণা কাঁদছে, তুমি কি একটু যাবে, সাবিহা? ও তোমাকে খুব পছন্দ করে। মা, চাচির মতো তো কেউ নেই। যে একটু বুঝিয়ে মাথায় হাত রাখবে।
সাবিহা বড় একটা শ্বাস ফেলল। সারেং বাড়িতে বিয়ের আয়োজন ভালোভাবেই শুরু হয়েছে। এই যে সূর্য উঠতে না, উঠতেই ভ্যানের লাইন লেগে গেছে। জয়তুন আরা কালকেই খবর পাঠিয়েছে। তবে তার যেতে ইচ্ছে করেনি। তবে আজ আর নিষেধ করল না। বরং হালকা হাসলো! হেসে বলল,– আমি যাবো।
এরশাদ নিজেও হাসলো। হেসে জানালার দিকে এক পলক তাকালো। তাকিয়ে বলল,– আমি জানি সে যাবে না। তবুও ইচ্ছে হলে নিয়ে যেও। আর যদি না যায়, রুম থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। যে কেউ আসুক, একদম দরকার নেই।
চলবে……
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৩
আয়নার ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড গরমে। রাত দিন টানা বৃষ্টি গেছে। গতকাল বৃষ্টি না থাকলেও সূর্য তার তেজ তেমন ভাবে তুলেনি। তবে আজ সারেং বাড়ির বিয়ের আয়োজনের মতো রোদও যেন পাল্লা দিয়ে ঠিক ঝিলমিল করছে। সেই ঝিলমিল আলো জানালা গলিয়ে আয়নার রুমে হুটোপুটি খাচ্ছে । সেই হুটোপুটিতে আলো ছায়ার খেলা রুম জুড়ে বিরাজ করছে নিজ ছন্দে। সেই ছন্দের সাথে রুম জুড়ে চিমটি কাটার মতো উষ্ণ গরমের ছোঁয়া। সেই ছোঁয়া কোমল নরম করতে ফ্যান চলার কথা, চললে সকাল বেলাতেই এতো গরম লাগার তো কথা না।
তাই আয়না হাঁসফাঁস করতে করতেই চোখ খুলল। খুলতেই চোখ, মুখ, শরীর সব বরফের মতো জমাট বেঁধে গেলো। গত রাতে এই জমাট বাঁধার সুযোগ না পেলেও এখন ঠিক জমাট বেঁধে সোজা হয়ে গেলো। দৃষ্টি সোজা উপরে, ফ্যানের জায়গায় ফ্যান নেই, না থাক। সেটা বড় কথা না। বড় কথা, শয়তানটা তার পাশে তার মতোই শুয়ে আছে, সোজা স্বাভাবিক ভাবে । দেখতে সতেজ লাগছে, গোসল-টোসল করেছে মনে হয়। গায়ে সাদা গেঞ্জি, প্যান্ট, চুল গুলো আধভেজা। ঠিক করে মনে হয় মুছেও নি। কিছুটা জমাট বেঁধে আছে। অবশ্য কখনও চিরুনি লাগায় কি না সন্দেহ। তবে বিয়েবাড়ি, দুনিয়ার কাজ। হয়ত বেরোবে, তাই সাত সকালে বাবু সেজেছে। তো বেরিয়ে যা। বউ দরকার, বউ পেয়েছিস। আবার কি?
আয়না যেমন ছিল, সে ভাবেই শুয়ে রইল। তাকে দেখতে লাগছে মৃত মানুষের মতো। গায়ে একটা কাঁথা পেঁচানো। সোজা লম্বা শুয়ে আছে। এই কাঁথা সে গায়ে দেয়নি। এমনকি কাপড়ও না। অথচ এই কাঁথার নিচে দিব্যি এগারো হাত কাপড় ছাড়া বাকি সবই আছে। তবে ব্লাউজের বোতাম মনে হয় উপর নিচ হয়েছে। তাই নিশ্বাস ফেলতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া কি হয়েছে, কখন, কিভাবে ঘুমিয়েছে সে ভাবতে পারছে না। মাথায় কেমন যেন জট পাঁকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখেছে। এই যে দেখেই মাত্র ঘুম ভাঙল। তবে সে জানে কিছুই স্বপ্ন না, সব সত্য, একেবারে সত্য। এই যে তার পাশে শুয়ে আছে এই শয়তানটার মতো সত্য।
আয়না চোখ বন্ধ করে ফেললো। বেলা বেশি হয়নি। তবে বাইরে মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। তার নিজেরও ওঠা দরকার। বীণা কাল কেঁদেছে। অনেক রাত পর্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। তার এতো খারাপ লাগলো। এমন একটা রাত তার জীবনেও গেছে। তাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমিয়েছেও গেছে অনায়াসে। বীণার ঘুমের পরেই সে এসে ঘুমিয়েছে। মাত্রই চোখটা লেগেছিল, তারপর’ই এক ঝাটকা। যেই ঝটকায় আয়না ভেঙেচুড়ে নিস্তেজ। তাই ওঠার কোনো রকম ইচ্ছা বা আগ্রহ আয়নার মাঝে দেখা গেল না। যেমন আছে, সেভাবেই শুয়ে রইল। গায়ের উপরে পেঁচানো কাঁথা। সেই কাঁথার নিচে গরমে নেয়ে ঘেমে এক গোসল তার এমনিতেই হয়ে গেলো।
শাহবাজ ঘাড়ের নিচে দু’হাত দিয়ে একটু নড়েচড়ে আরাম করে শুলো। মিষ্টি আদুরে কথা তার আসে না। তাই তার মতোই বলল,– কাজ আছে আমার, নিচে যাব।
আয়না উত্তর দিল না। রাগ, জেদ কিছুই তার হচ্ছে না। এ তো হওয়ারই ছিল। বরং আরও আগে হলেও সে অবাক হতো না। তবে কোথাও জমাট বাঁধা একটু কষ্ট। সেই কষ্টের ওজন আয়না অনুমান করতে পারে না। পারে না বলেই নিজের অজান্তেই চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
তখনই শাহবাজ আয়নার মুখের দিকে ফিরে তাকালো। তাকিয়ে কাত হয়ে শুলো। পাশাপাশি শুয়ে কাত হতেই একদম কাছাকাছি হয়ে গেল। শাহবাজের দৃষ্টি সেই চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়া চকচকে পানির দিকে। সেখানে দৃষ্টি রেখেই আয়না যেমন দুনিয়ার অকাজ করে সোজা বলে, “আমি কিছু করিনি”, ঠিক সেই ভাবেই বলল,– আমি কিচ্ছু করিনি।
আয়না সাথে সাথেই শাহবাজের দিকে মুখটা ফেরালো। ফেরাতেই দুজনের মুখ হলো একদম সামনা সামনি। শাহবাজ হাসল। হেসে বলল — বশীকরণ চেয়েছো, হয়েছি। এখন এত জ্বলছো কেন? আমি তো ভাই ভালোই ছিলাম। এটা দেখিয়ে, ওটা দেখিয়ে মাথা নষ্ট কে করেছে?
আয়না রাগে ফুঁসলো। ফুঁসে ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। শাহবাজ সেই রাগ দেখে বলল, — কালনাগিনী তো আর এমনি এমনি বলি না। এই যে এতো সুন্দর করে ফুঁসফুঁস করেন। কোন মানুষের দ্বারা তো আর সম্ভব না। তাই আর যাই করেন, শাহবাজের বউ হয়েই যখন গেছেন, আপনার আর মুক্তি নেই। তাই নিচে যাব আমি। কোনো কাজ-টাজ থাকলে বলেন। যে মরা মানুষের মতো পড়ে আছেন। ভয়ে আমার জান যায় যায় অবস্থা।
আয়না চোখ মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিল। শাহবাজ আগেন মতোই হাসলো। তার সেই চিরচেনা হাসি। হেসে আশীর্বাদের মতো মাথার উপরে হাত রেখে বললো, — বউয়ের মুখ দেখে নাকি কিছু দিতে হয়। আমি তো ভাই দুনিয়া দেখে ফেললাম। তাই যাও, দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবাদ জিনিস, দোয়া দিয়ে দিলাম। বিবাহ জীবন সুখের হোক, স্বামীর সোহাগী হও, দশ বাচ্চার মা হও।
শান্ত শিষ্ট আয়না নিজেকে আর দমাতে পারল না।
ঝট করে ঘুরেই এক ধাক্কা দিতে গেল। শাহবাজ যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাই আয়নার আগে সে’ই ঝট করে ঝাঁপটে ধরে চেপে ধরলো। ভালো করেই ধরল। ধরে বললো, — খুন করতে চেয়েছো, হয়ে গেছি খুন। যাও তুমি সফল।
আয়না ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। শাহবাজ আয়নার গড়িয়ে পড়া চোখের পানিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল — এই কান্না তোমার সারা জীবনের হোক।
— শয়তান আপনি।
— জানি তো।
— ঘৃণা করি আমি আপনাদের।
— আমিও করি।
— ঘৃণা করে আবার ঝাঁপটে ধরে আছেন কেন? ছি!
— ঘৃণার সাথে জড়িয়ে ধরার সম্পর্ক কী?
আয়না উত্তর দিল না, ঠেলে সরাতে চাইলো।
শাহবাজ আরও আঁটসাঁট করে ধরতে ধরতে বলল — ঘৃণা নিয়ে গায়ে আগুন দিয়ে বিয়ে করতে পারে, আমি কিছু করলে’ই দোষ!
— পাগল কুত্তায় কামড়ে ছিল যে, তাই তো গিয়েছিলাম বিয়ে করতে।
— হক কথা।
তখনই দরজায় টোকা পড়ল। শাহবাজ তার তেজ নিয়ে বলল — কি?
— দাদি ডাকে।
— যা, ভাগ।
কাজের লোক ভাগলো কি না কে জানে। তবে আয়না দাঁত চেপে বললো — ভুল হয়েছে আমার, মরণ ভুল। সেইদিন রাতে বাড়িটা ঠিক মাথায় ফেলা দরকার ছিল।
— ভুল করেছো মাশুল তো গুণতে হবেই।
— আমি না, আপনারা গুণবেন।
শাহবাজ বড় একটা শ্বাস ফেলল। ফেলে বলল, — কাজ টাজ গুছিয়ে রাতের ট্রেনে ঢাকা যাব আমি। সকালের মধ্যে ফিরে আসব।
— আমাকে বলছেন কেন? যান, গিয়ে মরেন।
শাহবাজ হাসল। হেসে বললো, — এতো তাড়াতাড়ি মরছি না গো বউ। এখনো অনেক জ্বালানো বাকি। বলেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দরজার খিল খুলল। খুলে আয়নার দিকে আর তাকালো না। ধস্তাধস্তিতে কাঁথা সরে গেছে। তাকালে আর বেরোনো হবে না। তাই এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলতে ঠেলতে নিজের মতোই বেরিয়ে গেল।
ঢাকায় সে যাবে আসলে আয়নার খালার খোঁজে। প্রমাণ ছাড়া কিছুতেই কিছু করা যাবে না। এটা এক দিনের সম্পর্ক না। অনেক পুরনো সম্পর্ক, তার মধ্যে আছে ফরহাদ আর ভাইয়ের বন্ধুত্ব। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাদের একমাত্র বোন। গ্রামগঞ্জে বিয়ে ভাঙা সহজ কথা না। টাকা যতোই থাক, ভালো ঘর থেকে আর সমন্ধ আসবে না। তাই যে করেই হোক, বিয়ের আগে তার সত্য জানতে হবে। সত্য জানলে আঙ্গুল তার বোনের দিকে আর আসবে না।
আয়না নিচে নামলো অনেকটা সময় পরে। সে ভালো করেই জানে, নামতেই জয়তুন আরা এক গাদা কথা শোনাবে। হলোও তাই। তাকে দেখেই বিরক্ত মুখে বলল,
— কাম দেখলেই তোমাগো অসুখ শুরু হয়। শরীর খারাপ বুঝলাম, তা না খেয়ে পড়ে থাকলে হইবো? যাও আগে খাইয়া লও। বীণারে গোসল দিবে। ভাবি ননদের বিয়ায় থাকবো সবার আগে। না, তারে খুঁজেই পাওয়া যায় না। পরের বাড়ি বউ আইয়া সব করতাছে। যাও, তাড়াতাড়ি খেয়ে সাবিহার হাতে হাতে করো। যোহরের আজান পড়লো বলে। আর সময় পাওয়া যাবে না। সেই বাড়ি থেকেও তো মানুষ আইবো। আর শোনো নাইচা নাইচা আবার তুমিও গায়ে হলুদে ও বাড়ি যাইওগা না আবার। আমার এই সব একদম পছন্দ না। বউ মানুষগো কিয়ের এতো ফালাফালি।
আয়না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু শুনলো। তার শরীরটা সত্যিই ভালো লাগছে না। তাই কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে খাবার ঘরে গেলো। মন মেজাজ শরীর কিছুই ঠিক নেই। খেলে যদি একটু ভালো লাগে। তাই নিজের হাতেই খাবার নিলো। নিয়ে বসবে, তখনই আম্বিয়াবু এলো, আয়নাকে দেখে বলল,– শরীর নাকি ঠিক নাই?
— কে বলল?
— শাহবাজ ।
— ওহ। বলেই খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
আম্বিয়া কাজ করতে করতে আড়চোখে তাকালো। চোখ মুখ ফুলে আছে। মাথায় ঘোমটা। তবুও বুঝল চুল ভেজা। সে চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল, — শরীর বেশি খারাপ থাকলে শুয়ে থাকো। আমি, তো আছিই।
আয়না মলিন হাসলো! হেসে বলল,– মন ঠিক নাই গো আম্বিয়াবু। সেটার জন্য কি করবো?
আম্বিয়ার হাত থেমে গেলো। থেমে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো। আয়না আগের মতোই খেতে খেতে বলল– এই বাড়িতে আমরা কেউ ভালো নেই আম্বিয়াবু। আমি আমার নসিব মেনে নিয়েছি। তুমিও নিয়েছো। তবে আমরা চাইলে একজনকে বাঁচাতে পারি।
আম্বিয়ার কিছুই বুঝে আসে না। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আয়না দেখে আবার মলিনভাবে হাসলো।
মহাজন বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের মানুষ এলো বিকেলে। ততক্ষণে সারেং বাড়িও বিয়ের রঙে রাঙা হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজন না থাক, আশে পাশের গ্রামের মানুষ আছে। বিয়ে বাড়িতে আর যাই হোক মানুষজন আসবে যাবেই। তাই আজ সদর দরজা হাট করেই খুলে দেওয়া হয়েছে। বসার ঘরে বসেছে জয়তুনের সাথে মুরব্বিদের পানের আড্ডা। উঠানে জাফরের সাথে পুরুষের জমজমাট আলাপ। বাচ্চা কাচ্চা, মহিলাদের গীতে বাড়ি মুখরিত হয়ে আছে। আর এত কিছুর মাঝে বীণা বসে আছে মুখ কালো করে। গায়ে তার পাকা হলুদ রংয়ের হলুদের শাড়ি, কাঁচা ফুলের গয়না। হাতে মেহেদী। বিয়েতে যে মেয়েদের রূপ খোলে, বীণা হচ্ছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। দেখতে লাগছে ভারী মিষ্টি !
সাবিহা কাজল দানি থেকে আঙুলের ডগায় কাজল নিয়ে কানের পেছনে দিয়ে দিলো। দিতে দিতে বলল,
— নজর না লাগুক, আমাদের বীণার গায়ে।
বীণা কিছুই বলল না। সে যেভাবে বসে ছিল, সে ভাবেই বসে রইল। তার ভালো লাগছে না। কেমন যেন দমবন্ধ করা একটা অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার মাঝেই ফরহাদের ভাবি এলো। তার হাতে ক্যামেরা। এই ক্যামেরা অত্র গ্রামে কারো কাছে নেই। শহরের বাজারে নতুন এসেছে। কী সুন্দর ছবি উঠে। উঠার সাথে সাথেই নিচ দিয়ে প্রিন্ট হয়ে বের হয়। ফরহাদের ভাবি শহরের সৌখিন মেয়ে। তাই শখ করেই একটা কিনে ফেলেছে।
গ্রামের মানুষের কাছে এটা খুবই চমকপ্রদ। তাই তার পিছু পিছু বিয়েবাড়ির অর্ধেক মানুষও চলে এসেছে। সেই ভিড় বাট্টা কমিয়ে সে খুব সুন্দর করে অনেকগুলো বীণার ছবি তুললো। টলমলে চোখের কী সুন্দর ছবি!
সেই ছবি তুলেই ফরহাদের ভাবি বাসায় গিয়ে ফরহাদের হাতে দিলো। ফরহাদের ভাবি ভেবেছিল, ছিঁড়ে ফুঁড়ে উড়িয়ে ফেলে দেবে। বিয়ের কোন আমেজ এই ছেলের মাঝে নেই। তার মধ্যে বান্দার মেজাজ আছে চড়ে। হলুদের দিন, সবাই তো হলুদের ছোঁয়া দিতে চাইবেই। আর ছোঁয়াতে মেজাজ মহাজন বাড়ির ছাদ ফুটো হয়ে বেড়িয়ে গেছে।
কিন্তু তাকে অবাক স্বাভাবিক স্বরে বলল, — কতগুলো তুলেছো?
ফরহাদের ভাবি সবগুলো দেখালো। ফরহাদ স্বাভাবিক ভাবেই দেখলো। দেখে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, — নাও, আমার ক’টা তোলো। তুলে পাঠিয়ে দাও। কে বেশি সুন্দর দেখুক। তোমার দেবর কে নাকি তার পছন্দ না। ভাবা যায়?
ফরহাদের ভাবি খিলখিল করে হাসলো। এই বাড়ির কেউই তাকে দেখতে পারে না। ফরহাদ তো আরও না। তাই ভাবি হিসেবে দুষ্টুমি করবে দূরের কথা, সাধারণ কথাবার্তাও বলে না। তাই আজকে সহজভাবে বলায় খুব মজা পেল। পেয়ে ফরহাদেরও সুন্দর করে অনেকগুলো ছবি তুলল। ফরহাদের গায়ে নতুন ভাঁজ ভাঙা লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। কপালে হালকা করে একটু হলুদের ছোঁয়া। সেটাও শুধু তার বাবা, মায়ের। আর একজনকেও ছোঁয়াতে দেয়নি। তবুও দেখতে একেবারে সত্য ফোটা জামাইয়ের মতোই লাগছে। আর ছবিও তুললো খুব ডাট বাট নিয়ে।
সেই ডাট বাটের ছবিই পাঠানো হলো বীণার কাছে। বীণা হাতে নিয়ে অবাক চোখে দেখলো। পছন্দ টছন্দ দূরের কথা, বীণার মাথায় এটাই এলো না, এই ছবি তাকে পাঠানো হলো কেন ? সে কি ফরহাদ ভাইকে নতুন করে দেখছে?
তার অবস্থা দেখে আয়না মন খারাপের মাঝেও একটু হাসলো। হাসলো সাবিহাও। কী পাগল-টাগল যে নিয়ে সে পড়েছে!
পৃথিলা সাবিহার খাবার ঘরে বসে স্টোভ ধরালো। ধরিয়ে চা বসালো। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগে। আজকে অবশ্য সন্ধ্যাকে সন্ধ্যা মনে হচ্ছে না। বিয়ে বাড়ির ঝিলমিল আলো, গীত সঙ্গীতে আশপাশ সব মুখরিত হয়ে আছে। তবে এই সাইডটা নীরব। একেবারেই নীরব। সাবিহার গেটও আজকে সন্ধ্যার আগেই তালা ঝুলানো হয়েছে। ঐ যে সারেং বাড়ি থেকে আসার গলির মাথা, সেখানে বসানো হয়েছে দুই জনকে। বিয়েবাড়ি থেকে না কোনো মানুষ এই সাইডে আসবে, না যাবে।
সাবিহা অবশ্য একবার জিজ্ঞেস করেছে, যাবে কি না? পৃথিলার মরে গেলেও যাওয়া সম্ভব না। এমনকি এই যে ঐ বাড়ি থেকে খাবার এসেছে, পৃথিলা ছুঁয়েও দেখেনি। সারাদিন অবশ্য সমস্যা হয়নি। একা একা ভালোই ছিল। তবে আসরের পরে চোখ লেগে গিয়েছিল। তখনই একটা বাজে স্বপ্ন দেখলো। সে একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে। চারিদিকে অন্ধকার। কোনো আলো নেই, বাতাস নেই। মাথার উপরে ছোট্ট একটা বাল্ব, টিমটিম করে জ্বলছে। সেই জ্বলার মাঝেই ফট করে কেউ দরজা খুলে ভেতরে এলো। অন্ধকারে মুখ দেখেনি। তবে তখনই কেউ কানের পাশে ফিসফিস করে বলল — পালাও পৃথিলা, পালাও।
তখনই ঘুমটা ছুটে গেল। আর ছুটতেই ধড়ফড়িয়ে উঠেছে। তখন থেকেই মাথাটা এতো ধরা ধরেছে। তাই বসেছে একটু চা করতে। খেলে যদি হালকা হয়।
পৃথিলা চা নিয়ে টুলে বসলো। বসার আগে বারান্দার লাইটটা নিভিয়ে দিল। আজকে আকাশে সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। দেখতে ভালো লাগছে। আর বসতেই ঐ যে গলির মাঝামাঝি গাছটা, ওখানে সিগারেটের আলোটা জ্বলজ্বল করে উঠল।
পৃথিলার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই চায়ে চুমুক দিল। এতক্ষণ দেখা গেলেও সে জানে, এখন আর দেখা যাবে না। তাই হয়তো চলে যাবে। তবে তার ধারণাকে ভুল করে আলোটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। পৃথিলা মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো। সিগারেটের গন্ধে মাথা আরও যাবে।
— কোনো সমস্যা পৃথিলা?
পৃথিলা একটু চমকালো। লোকটা মুখ দেখেই কেন জানি তার না বলা অনেক কথাই বুঝে যায়। তাই সাথে সাথেই নিজেকে সামলে বলল,– আমার সব সমস্যা আপনি। তাই আপনার কাছ থেকে এই প্রশ্নটা আমার কাছে হাস্যকর।
এরশাদ হাসলো! পৃথিলা টুলে বসলেও এরশাদ বসলো খোলা বারান্দায় নিচে। ঠিক তার সামনে। বসে বলল, — আমি তো আপনাকে কোন বিরক্ত করছি না।
— খোলা আকাশের পাখিকে খাঁচায় বন্দি করাই শাস্তি। সেই খাঁচাটা সোনার হোক রুপার বা তাকে যতোই খাবার দিন, পানি দিন। তাতে তার কষ্ট বিন্দু পরিমাণও কমবে না।
— কষ্ট কমানোর সুযোগ তো দিচ্ছেন না।
পৃথিলা চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কথা বলাই বৃথা। এরশাদ অবশ্য পৃথিলার কঠিন মুখটা অন্ধকারে দেখলো না। তবে ঠিক বুঝল। তাই কথা ঘুরিয়ে বললো, — খেয়েছেন পৃথিলা?
পৃথিলা এবারও উত্তর দিল না। এরশাদ নিজের মতোই বললো, — আমি নিজেও খাইনি।
পৃথিলা উঠে চলে যেতে নিল। এরশাদ দেখে বলল,– বসুন পৃথিলা, আমি বেশিক্ষণ বসব না। কাজ আছে।
পৃথিলা তাও দাঁড়ালো না। ভেতরে যাবে, তখনই এরশাদ বলল, — আমি যতক্ষণ বসব, আপনার আশেপাশেই বসব। এখন আপনার ইচ্ছা, সেটা ভেতরে না বাহিরে। একদিন আপনার মুখটা না দেখলে আমার অস্থির লাগে পৃথিলা।
পৃথিলা ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিল। এরশাদ আগের মতোই হাসলো। এই মেয়েটার কলিজা কোনো কিছুতেই কাঁপে না। এরশাদের হুমকি ধমকিতে তো আরো না। তাই উঠে গিয়ে জানালার পাশে পা ছড়িয়ে বসলো। সে ভালো করেই জানে পৃথিলা এখানেই বসবে। তাই বসে বলল, — আপনি সেইদিন জানতে চাইলেন না, আপনার প্রতি আমার এতো এই দয়া কেন? কেন জানেন? আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমাকে টানতে পারে নি। তবে পৃথিলা নামের মায়াবি, শান্ত, ভয়ংঙ্কর কঠিন মনের একটা মেয়ে টেনেছে। কারণ কী জানেন? একমাত্র এই মেয়েটা প্রথম দেখার পর থেকে একবারও আমার মুখের এই বাম পাশে তাকায়নি। তাকিয়েছে চোখে। আর চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে। না ভয়, না ঘৃণা। বাকি সবাই আগে আমার এই ভয়ংকর মুখটা দেখে। ভয় আতঙ্কে গলা শুকায়, তার পরে কথা বলে। একমাত্র আপনি আমার ভয়ংকর মুখটাকে কখনও ঘৃণার চোখে দেখেননি। এই যে এত কিছু করছি, এখনও দেখছেন না। রাগ, ঘৃণা যা করার এরশাদকে করছেন। তবে একবারও এই ভয়ংকর মুখটাকে করেননি।
পৃথিলা জানালার পাশ থেকে সবই শুনলো। সাধারণ কাঠের দু’পাল্লা। কাছ ঘেঁষে বললে রুম থেকে সবই শোনা যায়। তাই সেও শান্তভাবে বলল, — আপনি কি জানেন, আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ একটা মানুষ। অবশ্য এতে আপনার দোষ নেই। পুরো পরিবারকে চোখের সামনে নির্মমভাবে মরতে দেখা সহজ কথা না। তার মধ্যে নিজের মুখের সৌন্দর্য হারানো। একদিকে পরিবারের মানুষদের হারানোর ক্ষত, আরেকদিকে নিজের জন্য মানুষের চোখে ভয়, আতঙ্ক। এই অবস্থায় অনেকে বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি আছেন, ভালোভাবেই আছেন। এমনকি এই ভয় আপনি উপভোগ করেন। এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ না। আর এমন মানুষদের সমস্যা কী জানেন? তারা যে কোনো এক জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ব্যস, সেখানেই আটকে যায়। যেমন আপনি গেছেন। এখন ডান বাম আশপাশ কিছুই দেখছেন না। তাই প্লিজ! টাকা-পয়সার অভাব আপনাদের নেই। ঢাকায় ভালো একটা ডাক্তার দেখান। আর আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। অনুরোধ করে বলছি, আমাকে যেতে দিন।
এরশাদ এই অনুরোধের উত্তর দিল না। আগের মতোই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আবার আগের মতোই বলল, — আমাকে বিয়ে করবেন পৃথিলা? কথা দিচ্ছি, রাগাবো না, বিরক্ত করবো না, কষ্টও দেবোনা। এমনকি আপনার অনুমতি ছাড়া আপনাকে স্পর্শ ও করবো না। আপনার যা খুশি তাই করবেন। শুধু আমার হয়ে এক ছাদের নিচে থাকবেন। আমার পাশাপাশি শোবেন। যখন বসে বসে জোছনা দেখবেন, রাস্তায় হাঁটবেন, বৃষ্টিতে ভিজবেন। শুধু একটু পাশে রাখবেন। রাখবেন পৃথিলা?
পৃথিলা কোন শব্দ করলো না। সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার মন বলল,– এই মানুষটা অসুস্থ, ভয়ংঙ্কর ভাবে অসুস্থ। কোনো সুস্থ মানুষের চিন্তা এমন হতে পারে না। না এমন এক জায়গায় আটকে যেতে পারে।
চলবে…