#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৪
আয়নার খালার নাম কুলসুম। বয়সে আয়নার মায়ের চেয়ে এই বছর দুই এক বড়। অভাবের তাড়নায় শহরমুখী হয়েছিলেন। অভাব কিছুটা কমেছে তবে আর গ্রামে ফেরা হয়নি। ঝুপড়ি এলাকায় দু-রুমের টিনের ঘর নিয়ে ভাড়া থাকেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গার্মেন্টসে কাজ করেন। সন্ধ্যায় ক্লান্ত শরীরে আর ডানে, বামে চোখে দেখেন না। তাই কোন রকম কয়টা পেটে দানা ফেলেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দেন। সেই দেওয়ায় একেবারে সকাল। তবে আজ তার ঘুম ভাঙলো রাতের মাঝামাঝি প্রহরে। কেউ দু’পাল্লার কাঠের দরজায় টোকা দিচ্ছে।
কুলসুম কিছুটা ধড়ফড়িয়ে উঠল। তার স্বামী এক কারখানার দারোয়ানের চাকরিতে আছে। আজ নাইট ডিউটি। তার নাইট ডিউটি থাকলে কুলসুম কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকে। ভয়ে থাকার অবশ্য কারণ আছে। ঘরে তার সেয়ানা দুটো মেয়ে। ঝুপড়ি এলাকা, দিন যেমন তেমন, রাত নামলেই চরিত্র পাল্টাতে থাকে। তার মধ্যে চেহারা কাটিং ভালো। ভালোর দিকে নজর আগে পড়ে। মাস খানেক আগে তাদের দু’ বাড়ি পরের এক মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়েছে। তাই রাতদিন সেও খুব আতঙ্কে থাকে।
তখনই আবার দরজায় টোকা পড়লো। যারা তুলে নিতে আসে, তারা দরজায় টোকা দেয় না, লাথি বসায়। তাই নিজেকে সামলে বলল, — কেরা?
ওপাশ থেকে তার ভাসুরের ছেলে বলল, — চাচি, আমি রমিজ।
কুলসুম হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বাঁচলেও মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো। শহরে থাকার এই জ্বালা। গ্রাম থেকে কেউ এলেই রাত নাই, দিন নাই, বাড়িতে উইঠা আসে। অবশ্য বলতে গেলে রমিজ প্রায়ই আসে। গ্রামের এটা সেটা, গাছের ফল, খোয়ারের মুরগি, পিঠা চিরা দু’হাত ভরে নিয়ে আসে। কেন আসে, সে জানে। জেনেও লাই দেয়। একটা মেয়ে ঘাড় থেকে নামলে তার বোঝাই কমে। তবে সব সময় আসে দিন দুপুরে। আজকে এমন রাত বিরাতে কেন? কোন বিপদ হয়নাই তো? বলেই কিছুটা তাড়াতাড়িই উঠল। বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রমিজ একা না, বরং তার সাথে আরও দু’তিনজন। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন ঘাড় কাত করে দু’ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলল, — “আসসালামু আলাইকুম খালা শাশুড়ি। আমি সারেং বাড়ির ছোট নাতি আর আপনার প্রিয় ভাগ্নি আয়নার স্বামী।
কুলসুম ঢোক গিলল। আয়নার ব্যাপারে সে সবই জানে। এই রমিজের মাধ্যমেই সব খবরা খবর নেয়। তবে তার আর ক্ষমতা কতদূর? টেনেটুনে চলা সংসার। তবুও সারেং বাড়ির বউ সে হতে দিতে চায়নি। তাই যখন শুনেছে আয়না পালিয়ে তার কাছে আসছে, সে খুশিই হয়েছিল। দৌড়ে স্টেশনে গিয়েছিল। এক সকাল থেকে আরেক সকাল স্টেশনে বসে ছিল। আয়না আসেনি। তখনই বুঝেছে কোন অঘটন ঘটেছে। তাই ছুটে গিয়েছিল মিঠাপুকুরে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আয়না সারেং বাড়ির বউ। আর সেই বাড়ির বউকে টেনে বের করার ক্ষমতা কি আর তার আছে?
শাহবাজ তার চেলা বেলাদের নিয়ে ভেতরে এলো স্বাভাবিক ভাবে। ছোট টিনের ঘর। মালামালে ঠাসাঠাসি। তাদের তিন-চারজনেই ঘর ভরে গেছে। সেই ঘরের দরজার কোণেই কুলসুম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। শাহবাজ আগের মতোই হেসে পুরো ঘরে চোখ বুলাতে বুলাতে তার চেলার একজনের উদ্দেশ্য বলল,– দরজাটা লাগিয়ে দে মান্না। রাত বিরাতে একসাথে এতগুলো পুরুষ সেয়ানা মেয়ের বাড়িতে ঢোকাতো ভালো কথা না। পাড়ায় বদনাম রটাবে। হাজার হলেও শালি। একটা দায়িত্ব আছে না। তাই যা হোক দরজার আড়ালেই হোক।
কুলসুমের কলিজা কেঁপে উঠল। আয়না কি কিছু করেছে? কি করেছে? সিধেসাদা মেয়ে তাদের। আল্লাহ রক্ষা করো। বলেই সে ভয় মাখা দৃষ্টিতে রমিজের দিকে তাকালো। সে চোখে মুখে অপরাধ বোধ নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো চুল, ঠোঁট এক সাইডে ফোলা। অন্ধকারে এতক্ষণ বোঝা না গেলেও, ঘরের আলোতে ঠিক বুঝল, রমিজ ইচ্ছে করে আসেনি, বরং তাকে টোপ হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু কেন? নাকি সত্যি সবাই জেনে গেছে?
কুলসুমের মাথা ঘুরতে লাগল। শাহবাজ কুলসুমের রক্তশূণ্য মুখটা দেখলো। এই মুখ’ই বলে দিচ্ছে সব জট এখানেই খুলে যাবে। তাই খাটের গিয়ে আরাম করে বসলো। বসে বলল, — দেখেন, আমার হাতে সময় কম। জামাই, শাশুড়ি, তাই কোনো রকম বেয়াদবি করতে চাই না। তাই যা জিজ্ঞেস করবো, সুন্দর করে ফটাফট বলবেন। কেননা, জিজ্ঞেস একবারই করব। উত্তর দিতে দেরি হলেই আমার এই চেলা-পালারা আপনার ওই মেয়েদের রুমে যাবে। গিয়ে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। ঐ যে বললাম, সময় কম। তাই আপনার সম্মানও থাক, আমারও থাক। তাই বলেনতো, আয়নার বাবা-মা গায়েব হয়েছে কেন?”
কুলসুম থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তার চোখে পানি। তবে গলায় কথা আসে না। তার বোনের শেষ স্মৃতি। সত্য জানলে তো বাঁচতে দেবে না।
শাহবাজ বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে তার চেলা-পালাদের দিকে তাকালো। তাকাতেই তারা দাঁত বের করে হাসলো। সেই হাসি কুলসুমের কাছে দানবের হাসির মতো লাগলো। তাই তারা এগোবে তখনই তার শরীর ছেড়ে দিলো। দিতেই ধপ করে নিচে গড়িয়ে পড়ল।
শাহবাজ বিরক্ত মুখে বলল, — এই মাইয়া-মানুষের ঢং দেখে আর বাঁচি না। যেমন ভাগ্নি, তেমন তার খালা। সোজা কথা কানেই নেয় না। ঐ চোখে-মুখে পানি ঢাল। এমনিতেই সময় কম, তার মধ্যে যত ঢং।
কুলসুমের জ্ঞান ফিরলো কিছুক্ষণ পরেই। না ফিরে উপায় কী? ঘরের কলসি উপরে মনে হয় তার উপরে ঢালা হয়েছে। মাথা তো ভালোই, গায়ের কাপড়ও ভিজে একাকার। সে সেই ভেজা শরীর নিয়েই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো। তার পাশেই দুই মেয়ে। ঘুম থেকে মনে হয় টেনে তুলেছে। ভয়ে তারা আধমরা হয়ে আছে।
শাহবাজ ততক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ, সেই ভাবেই বলল, — আধা ঘণ্টা এমনিই নষ্ট করে ফেললেন। দুপুরের আগে আবার বাড়ি ফিরতে হবে আমার। এখন আপনি কী চান, আপনিই বলেন?
— আমি কিছু জানি না, বাবা।
— ছোট বোন, ছোট বোনের জামাই গায়েব, দুঃখ টুঃখ ভাগ করেও নেননি? ছ্যা! কেমন বোন আপনি?
কুলসুম কথা বলে না। শাহবাজ চোখ খুললো, ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বলল, — রাতের ঘুম হারাম করে প্রথম বার খালা শাশুড়ির বাড়িতে এসেছি। খালি মুখেই ফেরাবেন? এটা তো আমার প্রতি অন্যায় হয়ে গেলো।
— আমি সত্যি বলতাছি বাজান, আমি জানি না।
— না জানলে আর কি করার। বলেই তার চেলাদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলল,– অন্যায় যা হওয়ার আমার সাথে হোক, তোদের সাথে হবে এটাতো মানতে পারি না। তাই যা, মিষ্টিমুখ কর। তাড়াতাড়ি কর। ফিরতে হবে। ঘরে আমার সুন্দরী বউ, দূরে থাকতেও তো এখন কলিজায় টান লাগে।
মান্না দাঁত বের করে হেসেই কুলসুমের বড় মেয়ের দিকে এগুলো। বড় মেয়ে ভয়ে কুলসুমের গলা ঝাপটে ধরলো। ধরতেই কুলসুম চেঁচিয়ে বলল, — বলতাছি, বলতাছি আমি!
শাহবাজ ঝট করে উঠে বসলো। কিছুটা ঝুকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে বলল, — আয়নার বাবা, মা গায়েব। তারা দুনিয়ায় আছে না গেছে।
কুলসুম আস্তে করে দু’পাশে মাথা নাড়লো। শাহবাজ ভ্রু কুঁচকে বললো,– কে মেরেছে?
— মহাজন।
শাহবাজ শুনেই হেসে ফেললো। তার বোকা বউ। বাপ-মায়ের খুনিদের গলা জড়িয়ে ধরে, বসে বসে শোক পালন করছে। আর এদিকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি বলে তার মাথার পোকা নাড়িয়ে ফেলছে। সে হেসেই বললো,– কেন?
কুলসুমের বুক কাঁপে। গলা শুকিয়ে গেছে। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
শাহবাজ এবার অবশ্য বিরক্ত হয় না। বরং আগের মতোই বলল,– কেন?
কুলসুম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর নিস্তেজ গলায় বলল, — সারেং বাড়িতে যে ডাকাতি হয়েছিল, তার মধ্যে আয়নার বাবাও ছিল।
শাহবাজ যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল। চোখ, মুখ আগের মতোই স্বাভাবিক, নির্বিকার। যতোই বড় ভাইয়ের বিপরীত হোক। গায়ে তো একই রক্ত। তাই কিছুটা গুণ অজান্তেই মিলে যায়। তাই তো ঘরে উপস্থিত একটা মানুষও বুঝল না, কতোটা ধাক্কা সে খেয়েছে। এই যে বসে আছে, মনে হচ্ছে গলা কেউ চেপে ধরেছে। এমন ধরা ধরেছে, নিশ্বাস ফেলতে গিয়ে টের পাচ্ছে কতোটা কষ্ট। তার বাবা মায়ের খুনির মেয়েকে যে মন দিয়ে বসে আছে।
কুলসুম চোখের পানি মুছল। মুছে আগের মতোই বলল, — সেই দিন রাতে তিন-চারজন ফিরে এসেছিল। সেই তিন-চারজনের মধ্যে, একজন মহাজন, আরেকজন আয়নার বাবা। আয়নার বাবা মহাজনের ডান হাত ছিল। তোমাগো ইটের ভাটায় কাজ করতো নামমাত্র। কাজ করতো কম, খবর পাচার করতো বেশি। তবে সারেং বাড়িতে ডাকাতির লোভ কখনও করেনি। তাদের মাথা নষ্ট করেছে মহাজন। বলেছে, যা লুট হবে, সব তাদের। সে শুধু চায় রক্ত। ব্যস! ঘরে তো সবারই ভাতের অভাব। তাই এমন সুযোগ ছাড়ে কে ? তাছাড়া সারেং বাড়ির অলিগলি মহাজন চেনে। ভালো করেই চেনে। তাই আর সমস্যা হবে কি? হয়ও নাই। তারা শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সেই সুযোগ এলো সেই দিন। জাফর ভাই শহরে গেলেন, আর আকাশ ভেঙে নামলো বৃষ্টি। ব্যস! তারা তাদের কাজে নেমে গেলো। তবে তোমার ভাইয়ের রূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এতোগুলো মানুষকে এই বয়সে কেউ মাত করতে পারবে, তাদের ধারণা ছিল না। তাই জান বাঁচিয়ে পালিয়েছিল।
তবে পালালে কি হবে। তোমার ভাই যা শুরু করেছিল, মহাজনের সত্য বেশিদিন গোপন থাকতো না। তাই সে তার রাস্তা পরিষ্কার করেছে। যে তিনজন ছিল, সেই তিনজনকে মহাজন গায়েব করে ফেলেছে। আর করতে তার কোন সমস্যাও হয় নাই । সারেং বাড়ির হাজার বদনামের সাথে সেটাও জুড়ে গেছে।
আমি সব কিছু জানি অনেক পরে। আয়নার মা সব জেনেও চুপ হয়ে যায়। কেননা, মুখ খুললে হয়তো মহাজনের সত্য আসতো, তবে এরশাদ তাদের কাউকেই জীবিত রাখত না। না মহাজন, না তাদের। সে তখন উন্মাদ। নিজের, নিজের পরিবার, আর এই যে ছোট্ট আয়না তার মুখের দিকে তাকিয়ে একেবারে মুখে প্রলেপ দিয়ে বসে। তবে মহাজনের দারস্ত আর হয় নাই। স্বামী নাই, অভাবের সংসার। তাই আর কোথায় যাবে? সেই আবার সারেং বাড়ির ইটের ভাটা। তবে মহাজন আবার তার পেছনে লাগলো। এরশাদ ততদিনে সারেং বাড়ির সামনে এমন এক দেয়াল দাঁড় করিয়েছে, চাইলেই সেটা টপকানো যায় না। তাই তার ভেতরের খবর চাই। যে কোন মূল্যে চাই।
তখনই আমাকে বললো। আমি তখন বউ মানুষ। কী করবো? তাই বললাম, আয়নাকে নিয়ে পালিয়ে যা। সেও সেটাই ঠিক মনে করলো। তাই কিছুদিন ইটভাটায় আসা-যাওয়ার অভিনয় করলো। বাড়ি থেকে ইটভাটার জন্য বের হলেও, বসে থাকতো আমাদের বাড়িতে এসে। মহাজন যে তাকে যেতে দেবে না, সে ভালো করেই জানে। তাই ভেবেছিল, এমন আসা-যাওয়ার মাঝেই টুপ করে একদিন পালাবে। সেই দিনটা আর আসে নাই। একদিন বের তো হয়েছিল, তবে না আমার বাড়িতে এসেছিল, না পালিয়েছিল। ব্যস, আয়নার বাপের মতোই গায়েব হয়ে গেল। কেননা বাঁচতে হলে খবর দাও, আর না দিলে মরো। মহাজন তো সাক্ষী কোনদিনও রাখবে না।
আর আমিও সব জেনে মুখে পাথর বেঁধে বসলাম। এমন ভাব কিছু জানিই না। বোন গেছে, বোনের জামাই গেছে, অন্তত বোনের শেষ স্মৃতিটা থাক। বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল। কেঁদে উপুর হয়ে শাহবাজের পা ছুঁতে গেলো, শাহবাজ ঝট করে উঠেই সরে দাঁড়ালো।
দাঁড়াতেই কুলসুম হাউমাউ করে কেঁদে বলল, — আমার আয়না নিষ্পাপ। তার কোনো দোষ নাই। সে জানেই না কোন দোষে দোষী সে। তারে কিছু কইরো না, বাপজান। তার জীবনটা ভিক্ষা দাও।
শাহবাজ এখন আর স্বাভাবিক নেই। চোখ টকটকে লাল। স্তব্ধ, পাথরের মতো হয়ে আছে। বড় ভাইয়ের চাদরের তলে বড় হয়েছে। কখনও কি এমন পরিস্থিতির সামনে পড়েছে?
সেই ভয়ংকর ঘটনার সময় তারা ছোট। তেমন কিছু মনেও নেই। তাছাড়া তারা ছিল ছাদে, চৌবাচ্চার ভেতরে। কিছু দেখেওনি। তাই বাবা-মায়ের মৃত্যুর কষ্ট তো ছিল, তবে সেই ছায়া জীবনযাত্রার কখনও প্রভাব পড়েনি। ভাই পড়তে দেয়ওনি। সে সব কিছু নিজের ভেতরে টেনে দাফন করে ফেলেছিল। তাই তাদের জীবন ছিল আর পাঁচ দশটা মানুষের মতোই। তবে ভাগ্য আজ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করালো? বাবা-মায়ের খুনির মেয়ে তার আয়নামতি। আর মেয়ে বলেই কলিজা ছিঁড়ে এলো। এতো বড় হয়েছে শাহবাজ, ভয় তো দূরে কখনও কোন কিছু পরোয়া করেনি, কোন কিছু তার ভেতরেকে ঘামাতে পারেনি, তবে আজ অজানা কোন সঙ্কায় বুক টিপটিপ করতে লাগলো। সেই টিপটিপ বুক নিয়ে বলল,– আজিজ চাচা এসব কেন করেছে?
— আমি জানি না, বাপজান। আয়নার মাও জানতো না। তবে সে তোমাদের ঘৃণা করে। নিজের জীবনের উর্ধ্বে গিয়ে ঘৃণা করে। তবে জাফর ভাইকে না। জাফর ভাই তার খুব স্নেহের। তাই তো জাফর ভাই যেদিন শহরে গিয়েছিল, সেই দিনই হামলা করে। সে তার গায়ে তো ভালোই ছায়ায়ও ফুলের টোকা দিতে চায়নি।
শাহবাজের মাথা ঘোরে। গলা শুকিয়ে আসে। সে শুকনো গলায়ই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার সাথে তার লোকেরাও আসে। সে হাত দিয়ে ফেরায়। একা থাকতে চায় সে।
চায় বলেই কোন দিকে হাঁটে, কোন দিকে যাচ্ছে, তার দিশে নেই। তার এক মন ঘৃণায় ভরে যাচ্ছে, খুনির মেয়েকে মন দিয়েছে সে। আরেক মন বলছে, তাড়াতাড়ি গিয়ে বিয়ে ভাঙতে হবে। তার বোনের জীবন সংকটে। আরেক মন বলে, বিয়ে ভাঙতে গেলে আজিজের সত্য বলতে হবে। বললে আয়নাকে ভাই জীবিত রাখবে না। কোনদিনও না। আয়না, বীণা, ভাই তার বাবা-মা…
তখনই তার ধ্যান ভাঙলো কারো চিৎকারে। সে অনেক কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফেরে। মান্না দৌড়ে আসতে আসতে কিছু বলছে। কী? সে বুঝতে পারে না। তখনই এক চোখ ধাঁধানো আলো। সেটা সরে ট্রাক যে এগিয়ে আসছে, বোঝার আগেই এক ধাক্কায় শাহবাজ উড়ে পড়ল। পড়তে পড়তে রক্তে চারিদিক ভাসতে ভাসতেই তার একটা কথা কানে বাজলো, — আমাকে বলছেন কেন? মরেন গিয়ে!
শাহবাজ হাসলো! তার সেই চিরচেনা হাসি। হেসে বলল, — দোয়া কবুল হোক আয়নামতি।
ঠাস করেই আয়নার হাত থেকে সব গড়িয়ে পড়লো। আয়না হতম্ভব! বরযাত্রী আসবে আসরের দিকে। তাই জোহরের পর পরই গাঁয়ের মানুষের খাবারের পর্বটা শুরু হয়েছে। এদিকে বরের জন্য আলাদা করে পিঠা, পায়েশ করা হয়েছে। সাথে দেবে শরবত। সেই শরবতের জগ আর গ্রাস’ই সব লুটিয়ে তার পায়ের কাছে পড়লো।
জয়তুন বিরক্ত মুখেই ঝাঁঝিয়ে বলল,– চোখ কোন আকাশে রাইখা চলো তুমি? একটা কাজও যদি ঠিক ঠাক করা আসে।
আয়না সব সময়ের মতো কিছুই বললো না, ঢোক গিলে সাথে সাথেই আবার সব পরিষ্কার করতে লাগলো। কি থেকে কি হলো নিজেও জানে না। শয়তানটা বাড়িতে নেই, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর কথা। তবে সারা রাতে এপাশ ওপাশ করেও দু’চোখ এক করতে পারেনি। কেমন জানি একটা অস্থিরতা। হাঁসফাস করতে করতে সকাল হয়েছে। এই যে এখনও কেমন দম বন্ধ লাগছে। এমন লাগার কারণ কি? সে বড় একটা শ্বাস টেনেই নিজের কাজে মন দিলো।
তখনি এরশাদ ভেতরে এলো। সে সবসময় একা একা কাজেই অভ্যস্ত। তাই সব দিক সামলাতে তার সমস্যা হলো না। তবুও এতো ব্যস্ততার মাঝেও এসে জয়তুনকে জিজ্ঞেস করল, — শাহবাজ কই?
শাহবাজের ফেরার কথা সকালেই। জয়তুনকে এমনিই বলে গিয়েছিল। এখনো ফিরছে না কেন, বুঝতে পারছে না। তাই চিন্তিত হয়েই বলল, — গেল তো ঢাকা। বইলা তো গেলো সকালে ফিরে আসবো। দুপুর গড়িয়ে গেল, খবর তো নাই।
— হঠাৎ এতো ঝামেলার মধ্যে ঢাকা কেন ?
— আমি কেমনে কমু? কোন নাতি আমারে এখন গোনায় ধরে?
এরশাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। এমনি এমনি এতো কাজের মাঝে ঢাকায় যাওয়ার কথা না। চেলা-পেলাগুলো সব নিয়ে গেছে। কিছু একটা তো হয়েছে। তবে কি? সে বেরিয়ে কালামকে ডেকে বলল, — শাহবাজের খোঁজ বের কর।
— ঢাকা না গেছে।
— তো?
কালাম আর কিছু বললো না। কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। কোথায় খোঁজ লাগাবে সে? ঢাকা মিঠাপুকুরের মতো দুই হাত। তখনই আম্বিয়া বেরুলো। এক হাতে একটা ব্যাগ, আরেক হাতে খাবারের বাটি। এরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, — কোথায় যাচ্ছিস?
আম্বিয়া স্বাভাবিকভাবেই বলল, — সাবিহার ঘরে।
— কেন?
আম্বিয়া বিরক্ত হয়ে এরশাদের সামনে ব্যাগটা আর বাটি ধরে বলল, — সাবিহার জিনিস। সে বীণার কাছ থেকে নড়তে পারছে নাকি। এমনি কাউকে তো ওই সাইডে যেতেও দেবেন না। তাই আমাকে একটু বলল রেখে আসতে। আর আপনার পৃথিলার জন্য খাবার। নিন, আমি গেলে তো খয় হয়ে যাবে। এখন আপনেই রাইখা আসেন। এমনিতেও আম্বিয়ার কাজের অভাব নাই।
খাবার সময়মতো এরশাদই পাঠাচ্ছে। তবে খাচ্ছে বলে মনে হয় না। সেই যন্ত্রনায় নিজেও গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারছে না। এরশাদের কোন জিনিস সে হাত দিয়ে ছোঁবে না। অথচ পুরো এরশাদটা তার জন্য মরে যাচ্ছে। যে এরশাদ উপেক্ষা বিরক্তি নিতে পারে না। সে দিব্যি এই মেয়েটার উপেক্ষা হজম করে যাচ্ছে। এমন হলে আমি ধৈর্য্য রাখতে পারবো না পৃথিলা। একটু নরম হন, দয়া করে এই একটু।
— কি করুম আমি, নিলে নেন, তা না হলে পথ ছাড়েন। দুনিয়ার কাজ আমার। এক জায়গায় এমন খাম্বার মতো দাঁড়াইলে হইবো?
এরশাদ ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রাখলো। রাখতে রাখতে বললো, — যা, তবে পাঁচ মিনিটের বেশি না। রাখবি আর আসবি।
— কেন, খাইয়া ফেলব?
— তোদের বিশ্বাস নেই। বলেই পাহারায় থাকা দুজনকে ইশারা দিল। দিতেই আম্বিয়া এক নজর এরশাদের দিকে তাকালো। চুল আগের মতো বড় না হলেও, অনেকটা হয়েছে। শাহবাজ এলোমেলো, তবে এরশাদ ভাই সব সময়’ই গোছানো মার্জিত। এই যে এতো কাজের মাঝেও গায়ে গোছানো শার্ট প্যান্ট। চওড়া বুকটা টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের বাম পাশটা যদি আড়াল করা হয়, যে কোন মেয়ে অনায়াসেই ফিদা হয়ে যাবে। তবে এই সৌন্দর্যের আগে সবাই মুখের বাম পাশটাই দেখে। সেও দেখতো। ঐ ভয়ংকর রাতের পরে সে নিজেও অনেকদিন ভয়ে ধারের কাছেও ঘেষে নিই। পরে আস্তে আস্তে সয়ে গেছে। এতোই গেছে যে এখন না দেখলে অস্থির লাগে। সে অস্থির’ই এখন তার জীবনের বড় কাল।
আম্বিয়া মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে তার আর দাঁড়াল না। ধীরে ধীরে সাবিহাদের ঘরের দিকে গেলো।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৫
পৃথিলা গোসল করে বের হলো একটু দেরিতে। বেলা তখন অনেকটা গড়িয়ে গেছে। বলতে গেলে ক্লান্ত দুপুর শেষ হবে হবে করছে। আজকাল তার ঘুম, খাবার, বাকি যে কোন কাজের কোন সঠিক নিয়ম নেই। যখন যা করার করছে। তাইতো সকাল থেকে ঝিমুতে ঝিমুতে গোসলে গেলো এই যে শেষ দুপুরে এসে। যখন না গেলেই নয়।
তার গায়ে হালকা বাদামি রঙের কাপড়, পাড়টা কালো। উজ্জল রংগুলোর কাপড় তার নেই বললেই চলে। এমন না পছন্দ না, তবে কিনতে গেলে কেন জানি এই রংগুলোই বেশি চোখে পড়ে। তাছাড়া তারেকের হালকা রং পছন্দ ছিল, সেই হিসেবে এগুলোই বেশি কেনা হতো।
তারেকের কথা মনে পড়তেই পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেললো। এতো এতো ঝামেলায় স্মৃতি গুলো কেমন এই অল্প কিছু দিনেই মিলিয়ে গেছে। মনে পড়ে না বললেই চলে। অথচ এই মানুষটাকে ছাড়া একসময় বেঁচে থাকা’ই কষ্টের ব্যাপার ছিল। এজন্যই হয়ত বলে, কারো জন্য কিছুই থেমে থাকে না। চলে, আগের চেয়ে বেশ ভালো ভাবেই চলে। এই যে পৃথিলার নামক মেয়েটার জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছে।
পৃথিলা রুমে এসে ফ্যান ছাড়লো। ছেড়ে ভেজা চুলগুলো গামছার বাঁধন থেকে মুক্ত করতে করতে জানালার দিকে তাকালো। তাকাতেই আম্বিয়াকে আসতে দেখলো। দেখে অবশ্য তেমন ভাবান্তর হলো না। সারেং বাড়ির কোন কিছু নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। কে এলো, কে গেল, কেন এলো, কোন কিছুই তার ভাবতে ইচ্ছে করে না। তাই নিজের ভেজা চুলগুলো নিজের মতোই মুছতে লাগলো।
দরজা চাপানো। আম্বিয়া এসে হালকা টোকা দিলো। শিক্ষিত মানুষ, এদের আবার রংঢং থাকে বেশি। দেখা গেল সোজা ঢুকলে, মুখ ফুটে কিছু বলবে না, তবে কপালে কয়েকটা বিরক্তির ভাঁজ ঠিক ফেলবে। আবার গলা চড়িয়ে ডাকো, তাতেও সমস্যা, বলবে অভদ্র। জ্বালা তো কম না।
পৃথিলা তার মতো শান্ত ভাবে শুধু একটা শব্দই বলল, — আসুন।
আম্বিয়া সাথে সাথেই ঢুকলো। হাতে সময় কম। দেখা গেল পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই এরশাদ ভাই এসে হাজির হবে। তাই ঢুকে পৃথিলার দিকে তাকাল না। এগিয়ে টেবিলে খাবারের বাটি, আর ব্যাগ রেখে বলল,
— এই ব্যাগে কাপড়, কিছু গহনা আছে। দামি টামি তেমন কিছু না, গ্রামের সাধারণ বাড়ির বউরা যেমন পরে তেমন। এগুলো গ্রামের বউদের মতো পরে নেবেন। নিয়ে ঐ পাহারার দিকে নজর রাখবেন। আসরের আগেই বরযাত্রী আসবে। বড় যাত্রী এলেই বিয়েবাড়ি এলোমেলো হয়। কে কোন বাড়ির, কেউ ওতো খেয়াল করে না। এরশাদ ভাইও তখন পুরো ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমি শুধু ঐ গলির দুজনের একটু ধ্যান সরাবো। সরালেই মাথায় ঘোমটা টেনে গলির বাম সাইড ঘেঁষে গ্রামের মানুষের সাথে মিশে যাবেন। ভুলেও সদর দরজার দিকে যাবেন না। সেখানে এরশাদ ভাই থাকবে। তার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। তাই গলির সাইড ঘেঁষে বাড়ির পেছনে চলে যাবেন। ঘাটে নৌকা থাকবে। ওই নৌকাই আপনাকে স্টেশনে নিয়ে যাবে।
পৃথিলা চুপচাপই শুনল। শুনে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, — কোন মেহেরবানে এত করছেন, জানতে পারি?
আম্বিয়া চোখ তুলে তাকালো। ভেজা চুল, বাদামি কাপড়ে অন্য রকম সুন্দর একজনকে দেখল। কেমন জানি কোমল, সারা অঙ্গে আদুরে একটা ভাব। শহরে পেলে বেড়া উঠা মেয়ে তাই হয়তো। অথচ চোখমুখ কি কঠিন! চাইলেই চট করে এই মুখের বিপরীতে কিছু বলা যায় না। তবে সে তার মতোই বলল,– অবশ্যই পারেন। পারবেন না কোনো? বলার মতো কোন কারণ’ই নাই। আসলেই নাই। আপনে এখানে পঁচে গলে মরলেও আমার কিছু নাই, আবার চলে গেলেও নাই। ব্যস, এমনিই।
— আপনাকে শাহবাজ পাঠিয়েছে?
— না, তবে তার বউ পাঠিয়েছে।
পৃথিলা কিছুটা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,– আয়না?
— জ্বি! কী জাদু যে মানুষের ওপরে করতে পারেন, আল্লাহই জানে। একদিকে একজন দিন দুনিয়া ভুলে বসে আছে। আরেকদিকে এই ছেড়ি। জানতে পারলে এরশাদ ভাই খুন করে ফেলবো।
পৃথিলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, — আপনাকে করবে না?
আম্বিয়া হাসলো! হেসে বলল,– করলে আমার সৌভাগ্য হতো।
পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো! আম্বিয়া দেখে আগের মতোই হেসে বলল,– এতো চিন্তাগিরি এখান থেকে বের হইয়া কইরের। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ ধ্যান সরাইতে পারবো না। এরশাদের ভাইয়ের লোক এরা। নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া যতো তাড়াতাড়ি পারেন, নৌকায় উইঠা যাইয়েন।
— নৌকা কার?
— আজিজ চাচার। সে আবার আয়নাকে খুব ভালা পায়। তাই নাকি সাহায্য করছে। আমি ভাই ওতো জানি টানি না। আমার কাজ যেইটুকু, সেইটুকু কইরা দিলাম।
–ওহ।
— আর কিছু জানার আছে?
— না।
— ভালো, আসি আমি। বলেই আম্বিয়া বেরিয়ে গেল।
পৃথিলা আগের মতোই নিশ্চুপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তবে বসে থেকেও কোন লাভ। দেখা যাক, ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। তাই সবার আগে খুঁজে শাহবাজের চিঠিটা বের করলো। করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। তার জন্য আয়নার জীবনে কোনো ঝড় না আসুক। বোকা মেয়ে! একটু আদর করে মাথায় হাত রেখেছে, সব কিছু তুচ্ছ করে ভালোবাসার মূল্য দিতে নেমেছে।
তারপরই প্রথমবার সারেং বাড়ির খাবার নিজ ইচ্ছায় খেলো। কাল থেকে না খাওয়া। ইচ্ছে করলেই রান্না করে খাওয়া যেত। তবে আজকাল কিছুই তার ভালো লাগে না। তাই করেওনি। এখন শক্তির জন্য হলেও কিছুটা খাওয়া দরকার। খেয়ে কাপড়ের ব্যাগ থেকে কাপড়টা গায়ে দিল। লাল-গোলাপির টকটকে কাপড়। হাতভর্তি চুড়ি। আর কিছু অবশ্য পরলো না। তার দ্বারা আর কিছু সম্ভবও না। তাই যেটুকু চোখে পড়বে, সেইটুকুই করলো। করে জানালার কাছে বসলো। বসতেই খেয়াল করল, তার ভেতর একেবারে শান্ত। কোন উত্তেজনা নেই, ভয় নেই, আতঙ্ক নেই, নেই মুক্তির কোন সাধ। কেন? অথচ এই দিনটার জন্য সে মরমে মরমে অপেক্ষা করেছে।
পৃথিলা চোখ বন্ধ করে জানালার কপাটে মাথা রাখলো। কতোক্ষণ এভাবে বসে রইল জানে না। তখনই আতশবাজি ফুটিয়ে বর আসার হুল্লোড় পড়ে গেল। সেই হুল্লোড়ের মধ্যে সে চোখ খুলে গলির দিকে তাকালো। আম্বিয়া ছেলেদুটোকে কি যেন বলছে। বলতেই একজন একটু এগিয়ে গেল, আরেকজনের পুরো মনোযোগ আম্বিয়ার দিকে। আম্বিয়ার গায়ের কাপড়কে কখনই মার্জিত বলা যায় না। আর আজ আরো বেশি যেন চোখে বাজলো। কেন বাজলো, পৃথিলা বুঝতে এতোটুকুও সমস্যা হলো না। আসলে কোন মানুষকেই বাহির দিয়ে ভেতর মাপা যায় না। এই মেয়েটারও পৃথিলা পারেনি। এই ঋণ গুলো কি কখনও তার শোধ হবে?
পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেলে উঠল। সাবিহার ঘরটার দিকে একবার তাকাল। সাথে নিয়ে আসা কোন কিছুই নেওয়া যাবে না। একবার ঢাকায় যাক তারপরে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। তাই তাকিয়ে নাক বরারবর ঘোমটি টানলো। টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো, আর বিয়ে বাড়ির হই হুল্লোড় মানুষের মাঝে অনায়াসেই মিশে গেল।
মিশে ঘাট পর্যন্ত আসতে তার সমস্যা হলো না। গ্রামের দুই বড় বাড়ির ছেলে মেয়ের বিয়ে। অর্ধেক গ্রাম ওবাড়ি থেকে এসেছে, অর্ধেক এসেছে এবাড়ির। আর এতো এতো মানুষজনের মাঝে কে কাকে দেখবে! পৃথিলার দিকেও কেউ বিশেষ ভাবে খেয়াল কররো না।
তবুও পৃথিলা এলো কিছুটা সংকুচিত হয়ে। মিথ্যা, নাটক, অভিনয় তার দ্বারা হয় না। তাই মনে হলো এই বুঝি কেউ ধরে ফেললো।
সেই ধরে ফেলার জড়তা নিয়ে ঘাটে আসতেই কয়েকটা নৌকা চোখে পড়ল। তার মধ্যে দুটো তার পরিচিত। বিশাল, সারেং বাড়ির নৌকা। এই নৌকা করেই সারেং বাড়িতে প্রথম এসে পা রেখেছিল। এই নৌকা থেকেই পানিতে পড়েছিল। কে জানে, হয়ত তার ভাগ্যটা এই নৌকায় পা রাখার সাথে সাথেই বদলে গিয়েছিল।
আজ আবার নৌকা। ভাগ্য তাকে কোন দিকে নেবে কে জানে। অবশ্য আজ আর সারেং বাড়ির বিশাশ নৌকায় যাচ্ছে না। তাদের পাশেই মাঝারি সাইজের একটা নৌকা। যেই নৌকায় তিনজন লোক বসে আছে। তাকে দেখেই বলল,– তাড়াতাড়ি উঠে আসেন।
পৃথিলা এগিয়ে গিয়ে উঠে বসলো। শান বাঁধানো ঘাট উঠতে সমস্যা হলো না। তবে নৌকা ছাড়াতে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই ঘাটে তার আসা তৃতীয় বার। একবার একেবারে প্রথম দিন, দ্বিতীয়বার জ্বরে। অবশ্য সেই দিন হুঁশ বলতে কিছুই ছিল না। আর আজ। তাই ভ্রু কুঁচকে-ই মনে করার চেষ্টা করলো। সেই প্রথম দিন রাতে নৌকাটা কোন দিক থেকে এসেছিল। সাদা চুনকাম করা বাড়ির পেছন সাইড, অন্ধকার, গাছগাছালি, আর এরশাদ। এরশাদ তার ডান সাইডে ছিল। আগে নেমে দাঁড়িয়েছে। তারপর সে নামলো। নামতেই বাড়িটা চোখে পড়লো। এই যে এই সাইড। আর আজ নৌকাটা যাচ্ছে অন্য সাইডে। মানে স্টেশনের বিপরীত দিকে।
পৃথিলা শান্তভাবেই নৌকায় বসা তিনজনের দিকে তাকালো। বুঝতে তার সমস্যা হলো না। এক চোরাবালির থেকে আরেক গভীর অতল সাগরের দিকে যাচ্ছে সে। অবশ্য বুঝতে পারছে না, কে তাকে এই তলে নিয়ে যাচ্ছে। সারেং বাড়ির কেউই হওয়ার সম্ভবনা বেশি। আবার এমনও হতে পারে, শাহবাজই চাল খাটিয়ে বের করলো। প্রশ্ন নেই, জোর নেই, সবাই ভাববে নিজে থেকেই বেরিয়ে এসেছে। আর এই অতল সাগরের তল থেকে সে কি কখনও আর উঠতে পারবে?
ধীরে ধীরে সারেং বাড়িটা আড়াল হলো। পৃথিলা নিশ্চুপই দেখল। চাইলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতো। অবশ্য লাভ হতো বলে মনে হয় না। তার মন বলছে, এদের কাছে ধারালো অস্ত্রও আছে। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই সেটা বের হবে। তাই আগের মতোই নিশ্চুপ বসে রইল। কোথায় এলো কে জানে। তবে বসতবাড়িগুলো ধীরে ধীরে কমছে। সেই কমার মাঝেই একজন তাকে বলল, —
কোন চিৎকার-টিৎকার হাবিজাবি করার কিছু মাথায় আনবেন না। অবশ্য করেও লাভ নাই। এখানে কেউ আসবে না বাঁচাতে। বরং তখন আমাদের অন্য রাস্তা নিতে হইবে। তাই আপাতত আপনার চোখটা বান্ধুম। চুপচাপ সুন্দর মতো বানতে দেন। এতে আপনারই ভালো। বলেই এগিয়ে এলো।
পৃথিলা হাত বাড়িয়ে বলল, — আপনার বাঁধতে হবে না, আমাকে দিন, আমি বাঁধছি।
লোকটা তার হলুদ দাঁত বের করে হাসলো। পৃথিলার ভয়ে সারা শরীরে কাটা দিলো। এই হাসি কোনো মানুষের হাসি হতে পারে না। পিশাচ, পিশাচের হাসি এটা। আর এই হাসির সামনে তার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে হয়ত জ্ঞান হারাতো । তবে পৃথিলা সব সময়ের মতো নিশ্চুপ, একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। হয়ে কোনোরকম বলল, — আমাকে দিন।”
লোকটা আবারো হাসলো! হেসে হাতে দিলো। তাদের উপরে হুকুম এসেছে রাতে কাম তামাম করার, তামাম করে ইটভাটায় সামনে লাশ রাখার। তাবে শহরের এই মাল দেখে তার নিয়ত ঘুরলো। এমনিও মরবে, ওমনিও মরবে, তবে তাদের একটু মনোরঞ্জন হলে সমস্যা কী? তাই দাঁত বের করে আগের মতোই হেসে বলল, — নৌকা বিলের দিকে নে। রাত পড়তে তো অনেক দেরি। একটু আরাম আরেশ করি।
তার কথা শুনে বাকি দু’জনও ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। সেই হাসির মাঝে পৃথিলা নিজের চোখে রঙচটা, মলিন গামছা নিজ হাতেই বাঁধল। সেই বাঁধ গলিয়ে উষ্ণ পানি গুলো নিশ্চুপে গামছায় মিশে গেলো। সেই মিশে যাওয়া অন্ধকারে পৃথিলা, এতো এতো মানুষের মাঝে, কেন জানি, ঐ যে ভয়ংকর মুখের, ভয়ংকর মানুষটার মুখটাই ভেসে উঠল। আর উঠতেই পৃথিলা চমকালো।
চমকেই সেই দিন স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে গেলো। যেখানে আলাউদ্দিন ফকির এরশাদকে আসতে দেখে হেসে বলেছিল, — এই ভয়ংকর মানুষটার কাছেই তুমি নিরাপদ পৃথিলা। সবচেয়ে নিরাপদ।
আজিজের আজ খুশির বাঁধ ভেঙেছে। সেই খুশির ঝিলিক তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে। তাই খাবারের আয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে এগিয়ে জাফরের কাছে গেলো। গিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো। ধরে বলল, — বিয়ের পড়ানো শুরু করতে বলি। কি বলো জাফর?
জাফর হালকা হাসলো! হেসে এরশাদের দিকে তাকালো। এরশাদ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, ভ্রু কুঁচকানো। সেই ভাবেই বলল, — একটু অপেক্ষা করেন চাচা। একমাত্র বোন আমাদের। শাহবাজ একটু কাজে শহরে গেছে। ফিরুক।
আজিজ কিছু বললো না, বরং জাফরকে নিয়ে আরাম করেই বসলো। শাহবাজের ফেরা না ফেরা নিয়ে তাকে তেমন বিচলিত দেখা গেলো না। কোন মরার দুঃখে ঢাকা গিয়ে বসে আছে কে জানে। তবে বিয়ে তো হবেই। এক ঘণ্টা পরে হোক, আর আগে । বরং শাহবাজ ফিরলেই বিপদ। ভাইয়ের কলিজা গায়েব হওয়ার দায় যে তার ঘাড়ে। আর সাক্ষী হবে তার’ই বউ। এবার দেখি এরশাদ, কলিজার জন্য ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো হাতিয়ার উঠে।
আজিজ বিচলিত না হলেও, ফরহাদ এরশাদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বুঝল কিছু একটা হয়েছে। সে উঠতে গেলো। তার বড় ভাই হাত টেনে বলল, –কোথায় যাচ্ছিস?
— এখানেই।
— এখানে মানে? পুরো গ্রামের মানুষ আজ এখানে। কোনো ঢং করবি না বলে দিলাম। চুপচাপ বস।
ফরহাদ শুনলে তো, তবুও সে উঠতে গেলো। তার ভাই আবার টেনে বলল,– সবাই হাসবে ফরহাদ। বাবার সম্মান যাবে।
ফরজাদ বিরক্ত নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। ফরহাদের বড় ভাই দেখে বলল, — এই বিরক্তি অন্য কাউকে দেখাস। চুপচাপ বস। বিয়ে করতে এসে জামাই ঢং ঢং করে ঘুরছে, কেমন দেখায়?”
ফরহাদ কথা বাড়ালো না। বাবার উপরে তার কিছু নেই। তাই জায়গা মতো চুপচাপ বসলো। বসলেও চোখে মুখে উপচে পড়া বিরক্তি।
বীণার অবস্থা খারাপ। কেঁদে কেটে, না খেয়ে মাথাও তুলতে পারছে না। সাবিহা কোনোরকম ধরে বসিয়ে রেখেছে। তাদের পাশে আয়নাও বসে আছে কোন রকম। পৃথিলা আপাকে সাহায্য করে তার খুশি হওয়ার কথা। তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না। বরং ভেতরটা কেমন জানি ছটফট করছে। এই ছটফট সে কার কাছে বলবে? কে আছে তার? আর তার মনে পড়তেই শুধু ঘুরে ফিরে একজনের কথাই মাথায় আসছে। অথচ এ বাড়িতে পা রাখার আগে থেকে শয়তানটা জ্বালিয়ে মারছে, জীবনটা অতিষ্ঠ করে ফেলছে। তাই সব সময় যা করে তাই করলো। একচোট মনে মনে গুষ্টি উদ্ধার করলো। করবে না কেন? একটা মাত্র বোন, তাও কোথায় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে! এতো সময় লাগে? বলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এতো মানুষের মাঝে চোখ যেন একজনকেই খুঁজল। কোথায় সে?
জয়তুন আরা নিজেও অস্থির হয়ে আছে। আদরের নাতনি আজ পর হবে। তার মধ্যে শাহবাজ লাপাতা। মেজার খেই বারবার হারাচ্ছেন। একে ধমকাচ্ছেন, ওকে ধমকাচ্ছেন। বিনা কারণে আম্বিয়াকে একচোট বকাঝকাও করলেন। করে রাগে চুপচাপ ফুঁসতে লাগলেন। শয়তান টাকে আগেই বলেছে, তার নাতনির বিয়ায় কোন ঝামেলা চায় না। এদিকে শয়তানই ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছে।
আর এই সরের মাঝেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আজিজ আবার তাড়া লাগিয়ে বলল, — আর কতো, এরশাদ?
এরশাদ জাফরের দিকে তাকালো। জাফর হালকা মাথা নাড়ালো। পুরো গ্রামের মানুষ বসে আছে। কতক্ষণ রাখবে? তাছাড়া এই ছেলের কান্ডজ্ঞান তো কখনও ছিল না। আজ আর কি আশা করবে?
এরশাদ অনুমতি দিলো। দিতেই কাজি, জাফর, আজিজ, আরো কিছু মুরব্বি সবাই ভেতরে গেলো। যেতেই বীণার ছটফটানি বাড়লো। দুচোখে পানি অনবরত গড়িয়ে পড়লো। পড়তেই আশে পাশে তাকালো। তার ভাইয়েরা কই? তার দাদি কই?
জাফর বীণার পাশে বসলো। বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, — ভয় নেই রে মা, ছোট চাচা আছে না।
বীণা ঝাপটে ধরলো। ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো। কাঁদলো জাফরও। ঐ যে বসার রুমে বসা কঠিন জয়তুন আরা, সেও কাঁদলো। আর ঐ যে বাইরে, ভয়ংকর মুখের ভয়ংকর এরশাদ, সে কিন্তু কাঁদলো না।তবে শক্ত মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সেই দাঁড়ানো মাঝে ভেতরের ঝড়টা কেউ দেখলো না, এমনকি কেউ বুঝলও না। সেই না বোঝার মাঝেই বীণা কবুল বলল।
কবুল বলার সাথে সাথেই আরেক প্রান্তে আরেকজন মৃত্যুর দোয়ার থেকে প্রায় তের চৌদ্দ ঘন্টা পরে চোখ খুলে তাকালো। তাকিয়ে অস্ফুটভাবে বলল — কয়টা বাজে ?
ডাক্তার হাসলো! অবস্থা এতো নাজুক ছিল, তারা আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তবে এতো শক্ত নার্ভের মানুষ কম’ই দেখেছে। তাই হেসে বলল,– সময় বেশি হয়নি, আপনি ঘুমান।
শাহবাজ অবশ্য এমনিতেও বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না, কড়া ডোজের ঔষুধ চলছে। সেই ঔষুদের প্রভাবে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বলল,– বাড়িতে খবর পাঠাতে বলুন, আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন বীণার বিদায় না হয়।
ডাক্তার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বেরিয়ে রোগীর সাথে যে আছে তাদের কে বলল। বলতেই তার চেলা পেলারা কি করবে মাথায় এলো না। এমনিতেই তারা ভয়ে আধমরা হয়ে আছে। ভাইয়ের কিছু হলে জয়তুন আরাতো আস্ত রাখতো না। সব দোষ পড়ত তাদের ঘাড়ে। তাই একজন দৌড়ে মিঠাপুকুরের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। দিয়েও অবশ্য লাভ আছে বলে মনে হয় না। খবর নিয়ে যেতে যেতে তো রাত। এতোক্ষণ নিশ্চয়’ই কেউ বসিয়ে রাখবে না।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৬
পৃথিলা যে ঘরে নেই, সেটা সবার আগে বুঝতে পারলো ইমরান। ততক্ষণে বিয়েবাড়ির হইহুল্লোড় কিছুটা কমেছে। সন্ধ্যার আযান পড়ছে, সবাই ভেবেছিল বিয়ের পরেই বিদায়। তাই একেবারে বিদায় দেখেই যে যার মতো বাড়িতে ফিরবে।
তবে বাড়ির ছেলে নিখোঁজ। কালাম এখনও খোঁজ বের করতে পারেনি। স্টেশন থেকে খবর পেয়েছে, ঢাকার উদ্দেশ্যে তারা রেলে চেপেছে। তবে তারপর? ঢাকা তো আর চাট্টিখানি কথা না। রেল থেকে নেমে কোন দিকে গেছে, সেটাই ধরতে পারছে না। শত্রুর তো আর অভাব নেই, তাছাড়া যতোই এখানে ওখানে থাক, জয়তুন আরার কোলে সময় মতো ঠিক ফিরে আসে। এবারই যেন সব মাত্রা ছাড়ালো। তাই সবাই মুখে প্রকাশ না করুক, কিছু একটা যে হয়েছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে।
গ্রামের মানুষের কাছে আজিজ চাচা আবার দয়ার দরিয়া। বিপদে-আপদে ডাকা মাত্র সেই তো বিনা দ্বিধায় দৌড়ে যায়। তাই আত্মীয় বাড়ির এমন অবস্থায় বউ নিয়ে হইহুল্লোড় করে নিজের মতো ফিরে যাবে এমন মনোভাব যে কখনও হবে না, তারা জানে। তাই আজিজ চাচা যখন সবাইকে দুঃখভরা কণ্ঠে যার যার বাড়িতে ফিরতে বলল, কেউ অবাক হলো না। বরং তাদের মহাজনের প্রতি সম্মান কিছুটা আরও বাড়ল, আর সারেং বাড়ির মেয়ের কপালের তারিফ করলো। এমন শ্বশুর, শ্বশুর বাড়ি ভাগ্য তো শতগুণে মেলে।
তারপরেই একে একে সবাই যার যার ঘর মুখি হলো। সারেং বাড়ির উঠোন সব সময়ের মতো শূণ্য হলো। হতেই সদর দরজার পাল্লাটা আগের মতোই আটকে দেওয়া হলো। আত্মীয় স্বজন তাদের এমনিতেও নেই। তার মধ্যে পরিচিত গন্ডির মধ্যে বিয়ে। আজিজ চাচা নিজেই বলল, “বাকি যা কিছু আছে পরে করলেও চলবে। ঘরের ছেলে আগে ঘরে ফিরুক।”
তাই মহাজন বাড়ির ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাইও চলে গেলো। তাদের সাথে আজিজ চাচা বাড়িতে খবরও পাঠিয়ে দিলো। তারাও বউয়ের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে। তারপর চিন্তিত ভাবে বসার ঘরে গিয়ে বসল। কী করবে, কোন দিকে যাবে কিছুই কারো মাথায় আসছে না। তাই ইমরান বাড়ির দিকে এলো। বীণার অবস্থা বলতে গেলে খারাপ। বিয়ের ঝুট-ঝামেলা, তার মধ্যে ভাইয়ের নিখোঁজ সংবাদ। সব মিলিয়ে বেহুঁশের মতো পড়ে আছে। সাবিহা এখনও সেখান থেকে বেরুতে পারেনি। কখন পারবে, জানেও না। তবে পুরো সারেং বাড়ি থমথমে হয়ে আছে।
তাই ভাবলো, এই ফাঁকে হালকা করে হাত-মুখ ধুয়ে আসা যাক। সারাদিন গেছে দৌড়ের উপর, শরীর ভেঙে আসতে চাইছে। কিন্তু যেতেই দেখল পৃথিলার দরজা হাট করে খোলা। সে বাড়িতে চলাফেরা করে, হাজার হলেও পুরুষ মানুষ। সব সময় তাই কিছুটা আড়াল করার জন্যই দরজা চাপানো থাকে। সেই চাপানো দরজা আজ হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুরো রুম খালি।
ইমরান প্রথমে মাথা ঘামালো না। ভাবলো, হয়তো বাথরুমে গেছে। তাই নিজের মতো কলপাড় থেকে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের রুমে চলে এলো। ফ্যান ছেড়ে কিছুক্ষণ আরাম করে বসে রইল। সন্দেহটা তখনই হলো। এতক্ষণ নিশ্চয়ই বাথরুমে থাকার কথা না।
ইমরান ঝট করে উঠে এগিয়ে গেলো। গিয়ে বেশ কয়েকবার গলা খাকারি দিলো। কিন্তু বাথরুমের পাশ নীরব, একেবারে নীরব। তাই সংকোচ ফেলে এগিয়ে গেলো। গিয়ে হতভম্ব, কেউ নেই। তখনই দৌড়ে পুরো বাড়ি খুঁজলো। তার খোঁজা দেখে পাহারার দুজনও এগিয়ে এলো। বুঝতে তাদের সমস্যা হলো না। হলো না বলেই ঢোক গিললো। পুরো বাড়িতে মানুষের ছিটেফোঁটাও নেই। ইমরানের বুক ধক করে উঠলো। সাবিহা শাহবাজের ব্যাপারে বলেছিল। এই ছেলে গায়েব, পৃথিলাও গায়েব। আল্লাহ! ইমরান আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না, সারেং বাড়ির দিকে দৌড় দিলো।
এরশাদ সাইডে এসে সিগারেট ধরিয়েছে, পাশে ফরহাদ। বিয়ের পাগড়ি-টাগড়ি কিছু নেই, শুধু শেরওয়ানি গায়ে। এরশাদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে বললো, — থানায় লোক পাঠা।
এরশাদ মৃদু হাসলো। হেসে বলল — আমার লোক যদি খুঁজে না পায়, দুনিয়ার কেউ পাবে না।
— তাহলে কী করবি?
— আর কিছুক্ষণ দেখবো। তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে যাবো।
— কোথায়?
এরশাদ উত্তর দিলো না, ফরহাদ নিজেও কিছু বললো না। সিগারেটে টান দিতে দিতেই বীণার রুমের দিকে তাকালো। কিছু দেখা যায় না অবশ্য। নিচের তলায় রুম, জানালা উঠান থেকে দৃশ্যমান। সেই দৃশ্যমান জানালা থেকে চোখ সরেই ইমরানের উপর পড়লো। তার পেছনে পাহারার দুটো লোক। হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসছে। এসেই কাউকে খুঁজতে লাগলো। আর কাকে ফরহাদের বুঝতে সমস্যা হলো না।
তারা দাঁড়িয়েছে একটু আড়ালে। বাড়ি ভরা প্যান্ডেল। তারা সব দেখলেও তাদের দেখা সম্ভব না। তাই এরশাদকে বললো — ইমরান মনে হয় তোকে খুঁজছে।
এরশাদ উল্টো দাঁড়িয়ে ছিল। ফরহাদের কথা শুনেই পেছনে ফিরে তাকালো। তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো। ইমরান যেমন-তেমন, পাহারার লোক গলি থেকে সরেছে কেন? এরশাদের চোয়াল সাথে সাথেই শক্ত হয়ে গেলো।
ফরহাদ এরশাদের দিকে একপলক তাকিয়ে সিগারেট পায়ে পিষলো। পিষতে পিষতে বললো — তোর পাখি উড়াল দিয়েছে।
— অসম্ভব।
— ঠিক। তবে তোর অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেছে।
এরশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো — বীণাকে নিয়ে বাড়ি যা। বাকি যা নিয়ম-কানুন আছে, তোদের ওখানে করিস।
— না।
সব সময়ের শান্ত এরশাদ আজ আগুন চোখে তাকালো। ফরহাদ কারো কিছু গোনায় ধরেছে কবে? সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। সে ভালো করেই জানে, সারেং বাড়িতে আগুন লাগবে এখন। সেই আগুনে বন্ধুকে নিশ্চয়ই একা ফেলে চলে যাবে না।
এরশাদ সোজা এগিয়ে গেলো। পৃথিলা নিজে থেকে পালাতে পারবে না। কেউ তাকে সাহায্য করেছে। আর পুরো সারেং বাড়িতে এরশাদের উপরে যাওয়ার মতো একজনই আছে। আর সেই একজন জয়তুন আরা। তাই বসার ঘরের সবাইকে পুরো উপেক্ষা করে সোজা জয়তুনের সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বললো — পৃথিলা কোথায়?
আজিজ ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে আরাম করে বসলো। যেন যাত্রাপালা শুরু হবে। তাই ঠিক ঠাক বসে মনোযোগ একদিকে নিচ্ছে। নিতে নিতেই আশেপাশে তাকালো, জাফরটা গেলো কোথায়? বলল ভালো লাগছে না। নিজের রুমে গেছে নাকি? যাক! নরম মনের মানুষ। ঝামেলা থেকে যত দূরে থাকবে ততোই ভালো।
এরশাদ রাগ দেখালো না। তার দাদি, তার প্রিয় দাদি। নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। করতে করতে খেয়াল করলো, তার ভেতর কাঁপছে। অনেক, অনেক দিন পরে আবার এই কাঁপনটা অনুভব করছে। শেষবার করেছিল অনেকদিন আগে, ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে চৌবাচ্চার ভেতরে যখন বসে ছিল, তখন।
এরশাদের মাথায় যন্ত্রণা হতে লাগলো। এই যন্ত্রণা ভয়ংকর। সে নিজের মধ্যে থাকে না। সে অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে সব সময়ের মতো শান্তভাবেই বললো — বেশি কথা ভালো লাগছে না, দাদি। তাই সোজা বলছি। পৃথিলা কোথায় বলো।
জয়তুন রাগে ফুঁসলো। বোনের বিয়েতে গজব পড়ে গেছে। ভাই নিখোঁজ। এই ছেলে আছে এই নষ্টা মেয়েছেলে নিয়ে! তাই চেঁচিয়ে বললো — পৃথিলা, পৃথিলা, পৃথিলা! আর একবার যদি এই নাম আমার সামনে উচ্চারণ হয়, আমি সব কয়টাকে দাফন করবো।
জয়তুনের হুমকিতে এরশাদের কোন ভাবান্তর হলো না। তবে আয়না, সাবিহা বীণার রুম থেকে বেরিয়ে দরজায় দাঁড়ালো। আগা-মাথা তারা কিছুই বুঝলো না। তবে অন্য এক এরশাদকে দেখলো, সব সময়ের মতো মুখে হাসি নেই, মার্জিত ভাব নেই, চোয়াল শক্ত, চোখে আগুন। সেই আগুন নিয়ে আগের মতোই বলল — পৃথিলার গায়ে ফুলের টোকাও যদি আসে দাদি… আমি পুরো সারেং বাড়ি ধ্বংস করে ফেলবো। কসম করে বলছি, সত্যিই ফেলবো।
জয়তুন থমকালো! থমকে তার সামনে দাঁড়ানো আদরের নাতিকে দেখল। দাদির হুমকিতে তার যে ছিটেফোঁটাও কিছু আসে যায়নি, ঠিক বুঝতে পারল। তবুও সে দমল না। জয়তুন আরা সে, সারেং বাড়ির মাথা। তার মুখের ওপরে কথা? তাকে হুমকি দেওয়া। এতো সাহস! তাই আগের মতোই তেজ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, — এই, কে আছিস! এই নিমকহারামকে সারেং বাড়ি থেকে বের কর। দুধ-কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছি, এখন ছোবল মারতে ফণা তুলেছে। বের কর, এক্ষুনি বের কর! আজ থেকে সারেং বাড়ির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই।
কেউ এগিয়ে এলো না। জয়তুন আরার সব লোক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জয়তুন বিস্ময়ে তাকালো।
এরশাদ আগের মতোই বলল, — তোমার সব ক্ষমতা তোমার দু’ নাতিতে, দাদি। একজন নিখোঁজ, আরেকজনকে বিপরীতে দাঁড় করিও না। সে ছাড়া তুমি শূন্য।
জয়তুন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ঠিক’ই তো বলেছে, সে আসলেই শূণ্য। এজন্যই আলতাফ তাকে পাগলের মতো ভালোবাসা থাকা সত্যেও দ্বিতীয় বিয়ের জন্য মত দিয়েছিল। কারণ জান প্রাণ খয় করে যতোই আগলে রাখো। ওরজাত সন্তান, সন্তান’ই হয়। এই যে আজ ঠিক প্রমাণ পেলো। দু’দিনের মেয়ের জন্য কি সুন্দর দাদিকে ভুলে গেলো। নিজের রক্ত হলে আজ আর এই দিন কি দেখতে হতো?
রুমের বাকি সবাই হতবাক হয়ে আছে। কি হচ্ছে, কি হবে কিছুই তাদের মাথায় আসছে না। তবে আজিজ তো জানে। তাই ঢং করেই এগিয়ে গেলো। এরশাদকে কিছুটা ধমকে বলল, — এরশাদ! মাথা গেছে তোমার?
এরশাদ উত্তর দিলো না। একদিকে পৃথিলা, আরেকদিকে প্রিয় দাদি। রাগে-জেদে দেয়ালে এক ঘুষি মারল। তার এক ঘুষিতে সাদা চুনকাম করা দেয়ালটায় রক্তের আলপনা হয়ে গেলো।
জয়তুন আর্তনাদ করে বলল, –এরশাদ!
এরশাদ শুনলোও না, বরং আরেকটা ঘুষি দিতে গেল। তাকে দেখতে লাগছে উভ্রান্তের মতো। ফরহাদ এসে ঝাঁপটে ধরল। এই এরশাদকে সে চেনে না। সব সময় শান্ত মূর্তির মতো দেখে এসেছে। তবুও জাপটে ধরে জয়তুনের দিকে তাকিয়ে বলল, — সব সময় অহং আর জেদ ভালো বয়ে আনে না। এরশাদ বলেছিল না, দূরে থাকতে। কি সমস্যা আপনার। সব কিছু আপনার মর্জিতে চলতে হবে কেন?
জয়তুন চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। সারেং বাড়ি ধ্বংস করে ফেলবে। বাকি আছে কি ধ্বংসের? ধ্বংস কি শুধু এই ইট-পাথরের বাড়ির হয়? না, আসল ধ্বংস তো সম্পর্কের, মানের, সম্মানের। এই যে এতগুলো মানুষ। তাদের সামনে তো জয়তুন ধ্বংস হয়েই গেলো। গেলো সারেং বাড়ির সম্মানের। আর কি বাকি আছে? আলাউদ্দিনের কথাই তাহলে মিলে গেল। আহা! বিপদে-আপদে সব সময় ঢাল হয়ে পাশে থাকার সখিকে ছেড়ে চলে গেলিরে ক্যামনে আলাউদ্দিন? এই যে দেখ, আজ তোর সখির কেউ নাই।
সে গা এলিয়ে বলল, — আমি ঐ মেয়েকে কিচ্ছু করি নাই। তোর বন্ধুকে বলে দে ফরহাদ। জয়তুনের এতো খারাপ দিনও আসে নাই, মিথ্যা ছলনার আশ্রয় নিতে হইবো। কিছু করার ক্ষমতা থাকলে, জয়তুনের গলা চড়ে বলার ক্ষমতাও আছে।
জয়তুনের বলতে দেরি, সাবিহার ফুসে উঠতে দেরি হলো না। তার চোখে পানি। মেয়েটা কোন অবস্থায় আছে, কে জানে! তাই ফুসেই এরশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,– সব মিথ্যা। উনিই সব করেছেন। শাহবাজ নিজে পৃথিলাকে চিঠি দিয়েছিল। ইনিই পৃথিলাকে মারার জন্য শাহবাজকে বলছেন। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করেন। ওনাকেই করেন, তার তো গলা চড়ে সত্য বলার ক্ষমতা আছেই।
জয়তুন কোন উত্তর করলো না। সত্য না মিথ্যা এরশাদ জিজ্ঞেসও করলো না। পৃথিলার ক্ষতি করার জন্য তো এর আগেও লোক লাগিয়েছে, তাই হুঙ্কার দিয়ে একটা কথাই বলল, — দাদি, শেষবার জিজ্ঞেস করছি।
জয়তুন এবারও কিছু বলল না। আয়নার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আগুন লাগিয়ে ফেলেছে সে। কী করবে সে, কে তাকে বুঝবে। বলেই আজিজের দিকে তাকালো। আজিজ শান্ত থাকার ইশারা দিলো। চোখে বুঝালো, যা হোক মুখ খোলা যাবে না।
তখনই জাফর ওপর থেকে নামল। বারো ঝামেলায় তার ভালো লাগছে না। তাই নিজের রুমে চলে গিয়েছিল। চেঁচামেচি আগেই শুনেছে, তবে প্রথমে গা করেনি। জয়তুন সব সময়ই চেঁচায়। তার মধ্যে শাহবাজ লাপাতা। এখন কি আর চুপচাপ বসবে। তাই বের হয় নি। এরশাদের হুঙ্কারে দৌড়ে এলো। যেই ছেলের কণ্ঠ দু’হাত দূর থেকেও শোনা যায় না, সেই ছেলে চেঁচাচ্ছে! সে এসেই বলল, — কি হয়েছে?
এরশাদ এবার যেন চমকালো। শুধু কি চমকালো। না, ভয় পেলো, না পাওয়ার ভয়, পৃথিলাকে নিজের করে না পাওয়ার ভয়।
জাফরকে দেখে আজিজ আগের মতোই ঠোঁট টিপে হাসল। এই হাসি অবশ্য কারো নজরে পড়ার কথা না। পড়লও না। তাই হেসেই মুখ কালো করে বলল, — কিছুই তো বুঝতে পারছি না রে জাফর। কোথাকার কোন মেয়ে! সেই মেয়ের জন্য বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে।
জাফর বুঝতে পারে না। তাই ভ্রু কুঁচকে বলে — কোন মেয়ে?
— ঐ যে ম্যাডাম, পৃথিলা না কি যেন নাম! তাকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে শাহবাজ গায়েব। আবার এই মেয়ে বলছে, শাহবাজ নাকি গায়েব করেছে। তাও বড় ফুপুর কথায়।
জাফর চমকে উঠল। চমকে এরশাদের দিকে তাকাল। এরশাদের গলা চেপে এলো। চেপে এলো জাফরেরও। সে চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই করলো না। আস্তে করে পাশের চেয়ারে বসলো। তার চোখে পানি। পরের দোষ আর দেবে কি? ব্যর্থ পিতা সে।
আজিজ চিন্তিত হয়েই জাফরের কাছে এগিয়ে গেলো। স্নেহের ভাইকে জাপটে ধরে বলল,– কি হয়েছে রে জাফর, কি হয়েছে। আমাকে বল।
জাফর আজিজকে জড়িয়ে ধরলো! থরথর করে কাঁপছে সে। সেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,– কোথাকার কোন মেয়ে না সে। আমার মেয়ে, পৃথিলা আমার মেয়ে ভাইজান। এক সাগর কষ্ট মাড়িয়ে আমার কাছে এসেছিল। এই মানুষগুলো তাকে শান্তি দেয় নি। এক মূর্হুত্বেরও জন্যও দেইনি। আমি ব্যর্থ পিতা, তার জন্য কিছুই করতে পারিনি। একজন ভালোবাসার দোহাই দিয়ে মেয়েটার গলা চেপে ধরেছে, আরেকজন বাড়ির সম্মান। অথচ এই বাড়ির তারা কেউ না। সারেং বাড়ির কেউ না। সারেং বাড়ির কেউ যদি থাকে সেটা আমি, আর আমার একমাত্র মেয়ে। অথচ এই মেয়েটাকে তারা গায়েব করে ফেলল। মরে যাবো আমি ভাইজান, এবার আমি সত্যিই মরে যাবো।
ঘরের প্রতিটা মানুষ চমকালো। চমকালো জয়তুনও। তার যেন আজ বিস্ময়ের ক্ষমতা শেষ । সে হা করেই জাফরের দিকে তাকালো। কি বলছে জাফর!
আর সবচেয়ে বেশি চমকালো আজিজ। সে জাফরকে আগলে ধরে ছিল। হাত ছুটে গেল। যেতেই বলল, — কি বললি?
জাফর আজিজের কথা উত্তর দিল না। সে তাকালো জয়তুনের দিকে। তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল — আম্বা! ও আম্মা। আপনাকে তো কখনও সৎ মা হিসেবে দেখিনি। যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ভবিষ্যতেও করব। শুধু আমার মেয়েটাকে রেহাই দিন। আপনার সারেং বাড়ি থেকে তাকে আমি অনেক দূরে পাঠিয়ে দেবো। শুধু বলেন, শাহবাজ আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে গেছে?
আয়না ফুঁপিয়ে উঠল। তার আর এতো কিছু সইবার ক্ষমতা কই। ফুঁপিয়েই বলল, — উনি পৃথিলা আপাকে নেননি। উনি তো ঢাকা গেছেন। আমি পৃথিলা আপাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছি।
আজকে যেন সবার অবাক হওয়ার দিন। অবাক হয়েই এবার আয়নার দিকে তাকালো। তবে এরশাদ, সে তাকালো আগুন চোখে । বোকা আয়না কি বলেছে জানেও না। যেই এরশাদ প্রিয় দাদিকে ছাড়েনি, তাকে ছাড়বে কি? তাই ফরহাদকে এক ধাক্কায় সরালো। সরিয়ে তেড়ে আয়নার গলা চেপে ধরতে গেলো। বীণা আয়নাকে ঝাপটে আড়াল করে দাঁড়ালো। তার রুমের দরজায়’ই তো দাঁড়ানো। দেখেই দৌড়ে উঠেছে। তার নিজের অবস্থাও ভালো না। শরীর কাঁপছে। সেই কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে বলল,– ভাই।
এই ভাই শব্দ এরশাদের কানে গেলো না। সে বীণাকে সরাতে গেলো। ফরহাদ আবারও ঝাঁপটে ধরল। ধরে বলল,– শান্ত হ এরশাদ, কোথায় যাবে। ঢাকায়’ই তো। খুঁজে বের করবো। শান্ত হ, দোহাই লাগে শান্ত হ।
এরশাদ শান্ত হলো না। রাগলে সে কি ভয়ংকর হয় ফরহাদ জানে না। জানে জয়তুন, জানে আজিজ। তবে জয়তুন আজও কোন টু শব্দ করলো না। ঐ যে ভয়ংকর রাত, সেই দিন যেমন সব হারিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। আজও সব হারিয়ে সেই ভাবেই চুপচাপ বসে রইল। আর আজিজ তার এতোসব দেখার সময় কই। এতো ঝামেলায় কেউ খেয়ালও করেনি। পাগলের মতো দৌড়ে সে সারেং বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তার শরীরও কাঁপছে। বাজে কয়টা? তার জাফরের মেয়ে? তার প্রিয় ফুপুর রক্তের মেয়ে। বলেই দিক বেদিক ভুলে দৌড়াতে লাগলো। হারামদাজা গুলো চেয়াম্যানের লোক। কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে। আল্লাহ! শুধু বাঁচিয়ে রাখো। তা না হলে মরার পরে ফুপু কে মুখ দেখাবো কি করে।
ফরহাদের কাছ থেকে এরশাদের ছুটতে সময় লাগলো, কয়েক সেকেন্ড। ফরহাদের শক্তি থাক, তবে এরশাদের হাত পাকা। এই পাকা হাতে দু’এক জন মানুষকে সে অনায়াসেই মাত করতে পারে। তাই অতি সহজে ফরহাদকে ছুঁড়ে ফেলল। ফেলে দাঁত চিবিয়ে বলল,– খবরদার আর এগুবি না। দোয়া কর ও যেন সহি সালামত থাকে। তা না হলে খুন করে ফেলবো! সবাইকে ফেলবো। বলেই আয়নার দিকে তাকালো।
আয়না ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। তার দিকে এগুতেই বীণা আয়নার হাত ধরে এক টানে তার রুমের ভেতরে নিলো। নিয়েই দরজায় খিল দিলো। উপরে নিচে সব জায়গায়। এই ভাইকে সে চেনে না। এ তার ভাই হতেই পারে না।
এরশাদ সেই খিল দেওয়া দরজায় একের পর এক থাবা বসালো। বসাতে বসাতে বলল,– দরজা খুলবি না ভাঙবো?
তখনি মান্না দৌড়ে এলো। কিভাবে যে এসেছে, একমাত্র আল্লাহ’ই জানে। তাই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,– শাহবাজ ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টে হইছে। অবস্থা খুবই নাজুক। ঢাকার হাসপাতালে আছে। আর ভাই বলেছে, সে না ফেরা পর্যন্ত বীণা আপার বিদায় যেন না হয়।
শাহবাজের কথা শুনতেই এরশাদের হাত আপনা আপনি থেমে গেলো। থামতেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। আয়না তো শুধু এখন আর গ্রামের সাধারণ আয়না না, তার ছোট ভাইয়ের অর্ধাঙ্গিনী।
চলবে……