#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫২
আয়না দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু উঁকি দিলো। অবশ্য উঁকি দেওয়ার কিছু নেই। পুরো দরজায়’ই হাট করে খোলা। সেই খোলা দরজা বরাবর খাটে শাহবাজ ঘুমিয়ে আছে। সব সময়ের মতো এলোমেলো, হাত-পা ছড়িয়ে। বাইরে থেকে এসে গেঞ্জি প্যান্ট কিছুই খুলেনি। যেভাবে এসেছে, সেভাবেই শুয়ে আছে।
শাহবাজ রুমে থাকলে, এই রুম তার বাঘের গুহা মনে হয়। তাই আসার ইচ্ছে, সাহস কোনটাই হয় না। আর এখন তো পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ফেলেছে, এই অবস্থায় তো আরও না। তবে কিছুক্ষণ আগে মান্না এসেছিল। ওষুধ-পত্র সব বীণাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো। দিতে দিতেই বীণা জিজ্ঞেস করলো, — অ্যাক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?
মান্নার ধ্যান ঔষুধে ছিল। তাই জিজ্ঞেস করতেই ফট করে বলল, — ভাবির খালার বাড়িত গেলাম, সেখান থেকেই এই আকামটা হলো।
আয়নার বুক তখনই ধক করে উঠল। উঠে অবাক চোখে তাকালো। মান্না সাথে সাথেই হয়তো বুঝলো, বুঝে কথা ঘুরিয়ে বললো,— আরে, তেমন কিছু না ভাবি। গিয়েছিলাম একটু কাজে। আপনার খালার সাথে দেখা হয়েছিল, এই আর কি! সে তো আমাদের সাথেই গ্রামে এলো। বলেই তড়িঘড়ি করে সব বোঝালো, বুঝিয়ে যেন পালিয়ে বাঁচলো।
তার বাপের বাড়ির মানুষ এমন কেউ না, যে দেখা হলেই সাথে করে নিয়ে আসবে। তাই অজানা কোন ভয়ে তার বুক টিপটিপ করতে লাগল। তার খালা ঠিক আছে তো? এই বাড়ির মানুষদের তার ভরসা নেই। তাই ভয় ডর সব সাইডে রেখে এখানে এলো।
এসেই ধীরে ধীরে রুমের ভেতরে এলো। কাল সারা দিন রাত আর রুমে আসা হয়নি। রাতে হয়ত কোন কাজের লোক এসে জানালা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেই লাগানো এখনো খোলা হয়নি। ফ্যান চলছে তবুও গুমোট একটা ভাব। সে এগিয়ে’ই আগে জানালা খুললো। শাহবাজ জীবনেও এখানের কোটা ওখানে নাড়াবে না। রুম তার কাছে শুধু পরে পরে ঘুমানোর জন্য। ঘুম ছাড়া বাড়তি কোন কাজ তার এই রুমে নেই। তাই জানালা খুলে, বাতি নিভিয়ে দিলো। দিতে দিতে মনে হলো, শাহবাজ অন্ধকার ছাড়া ঘুমায় না, আর কিছু করুক আর না করুক, রুমে এসেই আগে বাতি নেভাবে, নিভিয়ে খাটের উপরে ধপাস করে শুয়ে পড়বে।
আজ কিছুই করেনি। শরীর কি বেশি খারাপ? আয়না এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলো। উপুড় হয়ে শোয়া, মাথায় ব্যান্ডেজ। মুখ উল্টো পাশে থাকায় বোঝা যাচ্ছে না। জ্বর টর এসেছে নাকি? তাই দেখার জন্য নির্ভয়েই আলতো করে হাতের উপরে হাত রাখলো। কেননা সে ভালো করেই জানে, শাহবাজ ঘুমালে, দিন দুনিয়ার হুঁশ থাকে না।
তবে তাকে অবাক করেই, শাহবাজ শান্ত ভাবে বললো,— যাক, জামাইয়ের প্রতি দরদ আছে তাহলে?
আয়না বলতে গেলে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল। শয়তানটা আজকে ঘুমায়নি! লাফিয়েই রুম থেকে বেরুতে চাইলো। শাহবাজ চিত হয়ে শুতে শুতে বললো,– খুদায় আমায় ঠিক মতো ঘুম আসছে না। খাবার টাবার কিছু নিয়ে আসো। এমন মরার কপাল, হাসপাতাল থেকে এসেছি, বউ সেবা যত্ন করে মাথায় তুলবে, তা না ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে।
আয়না থমকে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালো। শাহবাজের চোখ আগের মতোই বন্ধ। তবে চিত হয়ে শোয়ায় মুখ এখন সামনে। গত দু’দিনে মুখটা শুকিয়েছে, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আয়নার কেন জানি মায়া হলো। তাই আস্তে করে বললো,– নিচে থেকে যে এলেন, তখন খেয়ে আসবেন না?
— কেন, তুমি নিয়ে এলে কোন সমস্যা? এমন ভাব যেন কেজি পাঁচেক খাই। সেই কেজি পাঁচেক খাওন নিচে থেকে উপরে আনতে আনতে ঐ চার আঙুলের কোমর খয় হয়ে যাবে।
— আমি যদি না আসতাম?
— না এলে নাই, এই খুদা টুদাকে শাহবাজ গোনায় ধরে নাকি?
— না ধরলে, ঘুমাচ্ছেন না কেন?
— সেটাইতো করছিলাম।
আয়না আর কথা বাড়ালো না। কথার পিঠে কথা রেলগাড়ি এই শয়তানের চলতেই থাকবে। চলতে চলতে দম বেরিয়ে যাবে, তবুও হার মানবে না। তাই বেরিয়ে এলো। লোকটা আসলেই হাসপাতাল থেকে এসেছে। খোঁজ নেওয়া দরকার ছিল। সে তো আর এদের মতো শয়তান না। এই যে নেয়নি বলে মন টা এখন ভার লাগছে। আর এই বাড়িটাই কেমন জানি কুফা মার্কা। কোন কিছুই ঠিক নেই। এক ঝামেলার পর একটা লেগেই থাকে।
সে বেরিয়ে নিচে গেলো। ঘর বাড়ি ভরা খাবার, বিয়েবাড়ির দুনিয়ার কিছু এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। থাকলেও কোন ভারী খাবার আয়না নিলো না। নিলো সকালের রান্না গরম ভাত, হালকা তরকারি। সাথে নিলো ঔষুধ। বীণাকে বলতেই সকালের ঔষুধগুলো দেখিয়ে দিলো। দিতেই নিয়ে আবার রুমে এলো। হাত দিয়ে যে খাবে না, আয়না ভালো করেই জানে। তাই খাটে বসতে বসতে বললো,– উঠুন।
শাহবাজ উঠল না, তবে চোখ খুলে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে কতো কেঁদেছে কে জানে। চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এমনিতেই গোলগাল মুখ, ফুলিয়ে ফালিয়ে আরো গোলগাল বানিয়ে বসে আছে। অবশ্য বলতে গেলে সারেং বাড়ির ছায়া যখন থেকে পড়েছে, তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। আবার আরেকজন আসছে, তবে মনে হয় না সে কাঁদবে। এমন ভাবে তাকাবে, এক তাকানোতেই সব ধূলিসাৎ।
আয়নাও একপলক তাকালো। শাহবাজ তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। আয়না ঢোক গিললো। গিলে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে ভাতের থালায় নিলো, নিয়ে সব সময়ের মতো বলল,— আমি কিছু করিনি।
শাহবাজের ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে গেলো। যেতেই উঠে বসলো। বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,— জানি তো।
— সত্যিই করিনি।
— ভালোতো।
আয়নার একটু হালকা হলো। হয়েই বললো, — ফরহাদ ভাই আর এলোনা কেন? আশেপাশের মানুষ কানাকানি করছে।
— করুক, বীণা ঐ বাড়ি যাবে না।
আয়না অসহায় চোখে তাকালো। এই মাত্র বললো কিছু করেনি, সেটা এক্ষুণি উল্টে ফেললো। ফেলে বললো — আজিজ চাচা আমাকে সাহায্য করেছে, এই জন্য দেবেন না? বিশ্বাস করেন তাদের কোন দোষ নেই। ঐ তো আমার জন্যই করলো। আমার ভুলের জন্য বীণার জীবনটা নষ্ট করবেন না।
অন্য সময় হলে শাহবাজ তার তেজ নিয়ে ফুঁসে উঠত। তবে আজ উঠল না। আয়নাকে কাঁদাতে ইচ্ছে করছে না। বরং এই যে ফোলা ফোলা চোখ মুখ নিয়ে, মুখ বারাবর বসে আছে, দেখতে ভালো লাগছে, মাথার যন্ত্রনাটাও মিঠে লাগছে। আশ্চর্য!
আয়না শাহবাজের দিকে সে ভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সে ভেবেছে শাহবাজ কিছু বলবে। তবে কোন হেলদোল না দেখে, চোখ ফিরিয়ে ভাতের মধ্যে নিলো। নিয়ে লুকমা মুখের সামনে ধরলো।
শাহবাজ নিলো স্বাভাবিক ভাবেই। এই মেয়ের হাতে যতবার ভাত খায়, ততবার একেক সময় একেক রকম মনে হয়। আজকে লাগছে আমৃতর মতো। কারণ কি? নাকি দুই দিন ধরে ভাত-টাত খায় না, সেই জন্য? সে সেটাই বোঝার জন্য হাত বাড়িয়ে নিজেই এক লুকমা নিলো।
আয়না হা করে তাকিয়ে কান্ডকারখানা দেখলো। হাত, পা ধোয়া নেই। সে খাইয়ে দিচ্ছে হয় না। আবার নিজের হাতেও খেতে হবে। কি পাগলের পাল্লায় যে পড়েছে, বলেই বড় করে লুকমা বানালো। বানিয়ে ঢেলে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। মনে মনে বললো, নে ব্যাটা জন্মের খাওন খা।
শাহবাজ অবশ্য কিছুই বললো না, সে আরামছেই খেলো। আয়না দেখে বললো, — পৃথিলা আপাকে কি পেয়েছে?
— হ্যাঁ।
আয়না অবাক হয়ে তাকালো। শাহবাজ সেই অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,— এতো অবাক হওয়ার কি হলো?
— আপনি মিথ্যা বলছেন?
— মিথ্যা বলে আমার কি লাভ? তাছাড়া না পেলে, আমি এখন বাসায় থাকতাম নাকি?
— তাহলে কোথায় থাকতেন?
— কি জানি। তবে মাটি ফুঁড়ে হলেও খুঁজে বের করতাম।
— খুঁজে কি করতেন?
— যার পাখি তার হাতে দিতাম।
— আপনারা অনেক খারাপ।
— খারাপ’ই ভালো, ভালো হলে দুনিয়ার জ্বালা।
— সে তো এখন আপনাদের বোন।
— আমাদের এক বোনই ঠিক আছে। আর দরকার নাই।
আয়না বড় একটা শ্বাস ফেললো। তার মতো পৃথিলা আপার জীবনটাও গেলো। সে শ্বাস ফেলেই ভাত আবার মাখালো। মাখিয়ে লুকমা তুলে শাহবাজের মুখের সামনে তুলেই থমকালো। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। শাহবাজ আর সে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। যেন তেন স্বাভাবিক না। এই যে ছোটবেলা থেকে যেমন বড় বাবা, বড় মাকে সংসারের টুকটাক কত বিষয়ে কথা বলতে দেখেছে, ঠিক যেন তেমন?
আয়নার গলা শুকিয়ে এলো। হচ্ছে টা কি?
শাহবাজ আগের মতোই খাবার নিলো। তার দৃষ্টি এখনো আয়নার মুখের দিকেই। মুখ তো না, যেন আস্ত এক আকাশ। এই থমকাচ্ছে, এই অসহায় হচ্ছে, এই ভয় পাচ্ছে, এই কি যেন ভাবছে। এক সেকেন্ডে কত ঢং যে করে! করে ভালো কথা, পেটে পেটে কর। না, সবই দেখিয়ে দেখিয়ে। তাই খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,— আবার কি হলো?
— আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?
— কীভাবে?
— অন্যভাবে?
— অন্যভাবটা কি?
— আমি জানি না।
শাহবাজ ঠোঁট টিপে হাসলো। হেসে ভাত দেওয়ার জন্য ইশারা দিলো। আয়না ঝটপটই আবার এগিয়ে দিলো। এবার আর কথা বাড়ালো না। মানুষ যখন তৃপ্তি নিয়ে খায়, বোঝা যায়। শাহবাজেরটাও আয়না ঠিক বুঝলো। বুঝেই ঝটপট খাওয়ালো, শাহবাজও সুন্দর মতো খেলো। আর এই এত সুন্দর আয়নার হজম হচ্ছে না। আসলে হলোটা কি? এই শাহবাজকে তো সে চিনতেই পারছে না। নাকি এক মাথায় দু’দুবার বাড়ি। কোন সমস্যা টমস্যা হলো নাকি?
আয়না চিন্তিত ভাবেই কোণা চোখে শাহবাজকে ভালো করে খেয়াল করলো। আসলে গন্ডগোলটা কোথায়? চিন্তা করতে করতেই ঔষুধও খাওয়ালো। খাইয়ে প্লেট, গ্লাস হাতে তুলে নিলো। নিচে যাবে, তখনই শাহবাজ ডাকলো, — আয়না…
আয়না ফিরে তাকালো! তাকাতেই শাহবাজ বলল,– ভয় নেই, আমি আছি।
আয়না বুঝতে পারলো না, তবে অবাক ঠিক হলো। পৃথিলা আপাকে তো পেয়েছেই। এরশাদ ভাই নিশ্চয়ই তাকে আর কিছু বলবে না। তবে?
সে অবাক হয়েই বলল,— আমার খালার বাসায় গিয়েছিলেন কেন?
শাহবাজ উত্তর দিলো না। শুতে শুতে সেই আগের মতো বলল, — থালা, গ্লাস রেখে তাড়াতাড়ি আসেন। বউ লাগবে আমার।
আয়না সাথে সাথে মুখ গোঁজ করলো। শাহবাজ সেই গোঁজ করা সুন্দর মুখটা দেখলো। দেখে হেসে বলল,— শরীরটা ভালো নেই গো আয়নামতি। তা না হলে, বিশ্বাস করো, এই মুখ গোঁজ করার সুযোগ’ই পেতে না।
আয়না আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। দৌড়ে বেরুলো। বেরুতে বেরুতে বলল,– ধুর! কিসের সমস্যা? এই যে শয়তান এসে ঠিক হাজির।
…….
ইটের দেয়াল ঘেরা, তার মধ্যে ছোট ছোট ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়ে লাল রঙের আগুনের ফুলকিগুলো লাল লাল জোনাকিপোকার মতো উঁকি ঝুঁকি মারছে। তার উপরে কালো ধোঁয়াগুলো মেঘ রাঙা আকাশে আঁকিবুঁকি করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পৃথিলা সেই মিলিয়ে যাওয়া দেখলো চুপচাপ। তার শরীর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পায়ে অসহ্য ব্যথা। টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলেছে, আবার টেনে হিঁচড়ে এই পর্যন্ত এনেছে। পায়ের উপর দিয়ে এক ঝড় বয়ে গেছে। তাই বেঁধে রাখা কাপড়টাও রক্তে টইটম্বুর। তবে হাত এখনও সেই শক্ত হাতের মাঝে। লাল হয়ে আছে, তবুও এক রত্তি ঢিলে হয়নি।
বরং আরও শক্তের চেয়ে শক্ত হয়েছে। শক্ত হাতে ধরেই থানা থেকে টেনে বের করেছে। করে ভ্যানের সামনে দাঁড় করিয়ে শান্ত ভাবেই বলেছে, — ভালো ভাবে নিজেই উঠে বসুন, তা না হলে আমি কোলে করে ওঠাবো।
ফিরতে তো হবেই, অবশ্য পৃথিলা জানে না কোথায়। তবুও নিজেই উঠে বসলো। বসতেই এরশাদও তার পাশে বসলো। বসতেই পৃথিলা নেমে যেতে নিলো। এরশাদ হাত শক্ত করে ধরে বলো,— চুপচাপ বসুন পৃথিলা। সবাই দেখছে। এতো মানুষের সামনে নিশ্চয়ই চাইবেন না, আমি কোমর জাপটে বসি। তাছাড়া যাই করবেন, সুবিধা আমার। আয়নার ব্যাপারটা মাথায় আছে তো? সারেং বাড়ির আজ পর্যন্ত কোন বিয়ে ঝামেলা ছাড়া হয়নি।
পৃথিলার মনে হলো, গলায় তার ফাঁসির পাট্টা। এ টানে তো, সেই টানে। নিশ্বাস আটকে আসে, ছটফট করে তবে দম বেরোয় না। রাগে, ঘৃণায় ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। এরশাদ দেখলো, দেখে আরেক হাতে সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে রাখতে রাখতে বলল, — আমাকে বাধ্য করেছেন।
পৃথিলা কিছুই বললো না। কাল রাতে ঐ তিনজনের দৃষ্টিতে যেমন ঘিনঘিন করছিল, এখনো এরশাদের পাশে বসে তার শরীর তেমনি ঘিনঘিন করতে লাগলো। আসলে তফাৎ কোথায়? এই জীবনে তার আর কতোবার মরতে হবে? কতোবার?
সে ভেতরের শ্বাসটুকু ভেতরে দমিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে রইল। এরশাদ একদলকে কোথায় যেন পাঠালো। আর দু-একজন নিয়ে এখানে এলো। নিয়ে এই যে ইটের চুলার সামনে এসে দাঁড় করালো, করে আগের মতোই শক্ত করে হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এই জ্বলন্ত চুলা, এই লোকটাকে শান্তি দেয়। দেয় বলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। থাপ্পড় মেরেছে, রাগটা তো সামলাতে হবে, তার সাথে আছে হাতে সিগারেট, একটার পর একটা টানছে। এমনিতেই কাল থেকে না খাওয়া। পেট মুড়িয়ে নাড়িভুঁড়ি যে বাহিরে চলে আসছে না, পৃথিলার জন্য এটাই অনেক।
সেই অনেক নিয়ে সেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টি ঐ যে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। তবে সে জানে এই চুলায় তাকে কখনও জ্বালানো হবে না। তাকে জ্বালানো হবে ধীরে ধীরে। সে জ্বলবে, পুড়বে তবে নিঃশেষ হবে না। বাঁচা তো দূর, তার মরার ক্ষমতাও শেষ।
তখনই এরশাদ ফিরে তাকালো। পৃথিলার নিস্তেজ মুখটা দেখলো। পায়ের দিকেও একবার তাকালো।যেখানে দাঁড়িয়ে আছে রক্তে লাল হয়ে আছে। এতো কঠিন কেন এই মেয়ে? কি চাইছে, শুধু তিনটা কবুল। আর তো কিছু না। তবুও একটু নরম হয় না, এরশাদের এতো ব্যাকুলা কি একটুও চোখে পড়ে না?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বলল, — আমার সাথে আসুন পৃথিলা।
পৃথিলা নড়লো না, দৃষ্টি আগের মতোই আগুনের দিকে রেখেই বলল, — অপেক্ষা কার জন্য হচ্ছে? সাবিহা, ইমরান, না জুই?
এরশাদ হাসলো! হেসে বললো, — আপনার বুদ্ধি আমাকে সবসময়ই মুগ্ধ করে।
— এখানে বুদ্ধির কিছু নেই। এরা ছাড়া মিঠাপুকুরে আমার কোন দুর্বলতা নেই, মৃত্যুর ভয় নেই। তো? জোর টা খাটাবেন কি দিয়ে? বিশ্বাস করুন, এই চুলা দেখে আমার ভয় করছে না। বরং আফসোস হচ্ছে। কত মানুষ এই চুলায় ছাই হয়েছে, তবে পৃথিলা পারছে না।
— এই চুলায়, পৃথিলা যাওয়ার আগে এরশাদ যাবে।
পৃথিলা হাসলো! হেসে বলল, — ভালোবাসায় জোর থাকতে হয় না, থাকতে হয় মুক্তি। সেই মুক্তির পরে যদি ফিরে আসে, তাহলে সেই ভালোবাসা নিজের। আপনি যেগুলো করছেন, সেগুলো পাগলামি।
— ধরুন, মুক্ত করে দিলাম। কখনও আমাকে ভালোবাসতে পারবেন? এই যে ভয়ংকর মুখের ভয়ংকর এরশাদ, এই সব জেনেও পারবেন?
পৃথিলা উত্তর দিলো না। এরশাদ হাসলো। হেসে বলল, — একবার হ্যাঁ বলুন, পৃথিলা। মিথ্যা করে হলেও বলুন। আমি সাথে সাথে আপনার হাত ছেড়ে দেবো। বাকি জীবন আপনার ফিরে আসার পথ চেয়ে বসে থাকবো। এখন বলুন, পারবেন?
পৃথিলা এবারো উত্তর দিলো না। এরশাদ আগের মতোই হাসলো। হেসে বলল, — সবাই তো ভালোবাসেই, আমারটা পাগলামিই থাক। একবার তো ভালোবেসে বিয়ে করলেই, এবার ঘৃণা নিয়ে করেন। আমিও দেখতে চাই কোনটায় শক্তি বেশি।
পৃথিলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, — সময় নষ্ট করছেন। আমাকে কি এমন মেয়ে মনে হয়, জোর করে কবুল বলিয়ে বিয়ে করবেন? আমি সেই কবুল পড়া বিয়ের বেড়ি পায়ে পরে বসে থাকবো? ভালোবাসার বিয়েই পারেনি, আর আপনার এখানে তো কিছুই নেই। কতদিন আটকে রাখবেন?
এরশাদ উত্তর দিলো না। ইটের ভাটায় টিনের ছাপড়ি ঘর আছে। এখানে এসে বসে হিসেব নিকেশ করে। সেই ঘরে পৃথিলাকে টেনে নিয়ে গেলো। গিয়ে বসালো।
বসিয়ে হাত ছাড়লো। ছেড়ে পায়ের কাছে বসে কোমল করে পা’টা ধরলো। ধরে দেখতে দেখতে বলল, — অনেক ভুগবেন? এতো জেদি কেন, আপনি পৃথিলা?
— আপনি কি?
— আমি পাগল। আপনিই না সেই দিন বললেন।
পৃথিলা আর কিছুই বললো না। চুপচাপ আগের মতোই বসে রইল। তবে এরশাদ কাপড়ের গিঁট খুললো, খুলে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে, অন্য কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলো। দিতে দিতে বলল, — অনেক সময় লাগবে, তাই চাইলে আরাম করতে পারেন।
— কিসের সময়?
— আমার লোকেরা শহরে গেছে।
পৃথিলার কেন জানি, বুকটা কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা স্বরেই বললো, — কেন?
— আপনার বোনের নামতো মিথিলা তাইনা। দুপুর দুটোয় আপনার বোনের কলেজ ছুটি হয়, তারপর দেড়-দুই ঘণ্টা এক স্যারের কাছে টিউশন নেয়। তারপর রিকশা করে বাসায় ফেরে। সেই রিকশা থেকে মিঠাপুকুরে আসতে সময় তো লাগবেই।
পৃথিলা শান্ত চোখে এরশাদের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন এরশাদ যা বলছে, সে বুঝতে পারছে না। তবে এরশাদ জানে, এই বুদ্ধিমতি মেয়েকে বেশি বোঝানোর দরকার নেই। তাই সেই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,— হিসেবে আপনার একটু ভুল হয়েছে। সাবিনা, ইমরান, জুঁই, এরা না। আমি এমন জায়গায় হাত দেবো, যাতে আপনার দ্বিতীয় আর কোন রাস্তা না থাকে।
— আমার বাবা জানলে আপনাকে খুন করে ফেলবে।
— জানলে তো! স্কুল-কলেজ থেকে হাজার হাজার মেয়ে প্রতিনিয়ত গায়েব হচ্ছে। এই আর নতুন কি! তাছাড়া পুলিশ যতোই ভালো, তার ততো শত্রু। আপনার বাপেরও শত্রুর অভাব নেই। তাই তারেকের কেসের যেমন কোন তাল পাচ্ছে না, তেমনি ছোট মেয়েরটাও পাবে না।
পৃথিলা বিস্ময় চোখেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার মাথা ভু-ভু করে ঘুরছে। কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে? সে তাকিয়ে বলল, — তারেককে কি আপনি খুন করেছেন?
এরশাদ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, — হ্যাঁ।
— কেন?
— এমনিই। আমার আগে সে আপনাকে পেলো কেন?
পৃথিলার মুখে আর একটা শব্দ এলো না। সে চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুসময় বসে রইল। তার নিজের জীবনতো গেছেই। এখন তার জন্য যদি, তার ছোট বোনের কিছু হয়, নিজেকে কি কখনো ক্ষমা করতে পারবে? মরে গেলেও না।
পৃথিলা চোখ খুললো! খুলে নিস্তেজভাবে বলল, — কি চান আপনি? পৃথিলার এই দেহটা? এই দেহটার জন্য এতো কিছু আপনার?
এরশাদ উত্তর দিলো না। সে বেরোনের জন্য এগুলো।
পৃথিলা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো! হেসে বললো,– যান দিয়ে দিলাম, কাজী আসতে বলুন, আর হ্যাঁ, একটু দাঁড়ান?
এরশাদ সাথে সাথেই দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই একদলা থুথু এরশাদের গায়ে এসে পড়লো। পড়তেই পৃথিলা বলল, — আজকে থেকে তো আর আমি পৃথিলা থাকবো না। লাশ হবো! তাই হওয়ার আগে শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করলাম।
এরশাদ কিছুই বললো না, শান্ত চোখে একবার তাকালো। তারপর বেরিয়ে গেলো।
…….
সোহাগ আজ লাইব্রেরি খুলেছে দেরিতে। মেঘলা আকাশ, তার মধ্যে গত কয়েকদিন আর দোকানের পাল্লা খোলা হয়নি। শ্বশুর ইন্তেকাল করেছে। না গিয়ে তো আর উপায় নেই। বড় মেয়ের জামাই, দায়িত্বও মেলা। দোয়া না পড়িয়ে তো আর ফেরা যায় না। আজই ফিরলো। ফিরতে ফিরতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তাই দোকানও খুলতে দেরি হয়ে গেলো।
আর খুলেই দেখলো, ধুলা-বালি সব বই, খাতা, মালামালের উপরে দুধের সরের মতো বিছিয়ে আছে। এবার মেঘ-বৃষ্টিতো কম। ধুলা-বালির জ্বালায় আর জান বাঁচে না। বলেই হাতে নেকড়া তুলে নিলো, নিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে কোণার দিকে যেতেই ধুলো জমা একটা চিঠির খামের উপরে চোখ পড়লো।
পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে হাতে তুলে নিলো। নিয়ে ঝাড়তেই চিঠির উপরে রাবারের সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট, সাথে দশ টাকার একটা নোট নজরে পড়লো। আর পড়তেই ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই চিঠি এলো আবার কোথা থেকে! দেখতো জ্বালা। কার না কার কে জানে। তাই টাকা রেখে ফেলে দেওয়ার জন্য হাত উঠালো। তখনি কি হলো কে জানে? রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানের চা-টা এগিয়ে দেওয়ার ছেলেটার দিকে চেঁচিয়ে বলল, — ওই জামাল….
— কি ভাই?
— এদিকে আয়।
ছেলেটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে দৌড়ে এলো। আসতেই চিঠির খাম আর দশটা দিয়ে বলল, — যা পোস্ট করে আয়। আর বাকি টাকা তোর।
ছেলেটা একগাল হাসলো! হেসে দৌড়ে গেলো।
চলবে…….
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৩
অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছোট্ট একটা রুম। চারপাশে উঁচু সাদা রঙের প্রাচীর। প্রাচীরগুলো যেন একে অপরের বিপরীতে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো প্রাচীরের বুকে ছোট্ট একটা জালি জানালা। সেই জানালা গলিয়ে ঝিরিঝিরি রোদগুলো উঁকিঝুঁকি মারছে। পৃথিলা সেই উঁকিঝুঁকি রোদের দিকে তাকিয়ে রইল। কি সুন্দর রোদের খেলা! সাধারণ, দেখতে খুবই সাধারণ। তবুও পৃথিলাকে মুগ্ধ করলো। তাই অনিমেষ তাকিয়ে রইল। অথচ চার দেয়ালের বদ্ধ ছোট্ট ঘরে দম আটকে আসার কথা। আর সে দাঁড়িয়ে আছে খুব স্বাভাবিক ভাবে। তখনই অন্ধকার ভেদ করে কেউ তার পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো।
পৃথিলা ফিরে তাকালো। চোখ দুটো সেই আগের মতো জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁটে সেই সুন্দর মার্জিত সরলতার হাসি। পৃথিলা আজ সেই হাসি দেখল না, চোখ দেখল না, তাকালো আগুনে ঝলসে যাওয়া সেই মুখের বাম পাশটায়। তাকিয়ে আস্তে করে হাতটা তুলে, আলতো করে সেই পোড়া গালে রাখল। কি খুশির ঝিলিক সেই জ্বলজ্বল করা চোখে। আর তখনি সেই ঝিরিঝিরি রোদের আঁকিবুঁকি গুলো আগুনের লালশিখা হয়ে গায়ে লাগলো। আর লাগতে পৃথিলা ধড়ফড়িয়ে উঠল।
উঠে নিজেকে আবিষ্কার করল সেই টিনের ছাপড়ি ঘরের চকিতে। চিকন একটা তোশক, রংচটা বালিশে। নেয়ে ঘেমে একাকার। এখানে ক্যারেন্ট নেই, চারিদিকে অন্ধকার। ঘরের এক কোণে টিমটিম করে ছোট্ট একটা হারিকেন জ্বলছে। তবে ঘরের দরজা হাট করে খোলা। একসাইডে নদী, আরেক সাইডে ধানের জমি। সেই খোলা দরজা দিয়ে সুন্দর মৃদু্ বাতাস বইছে। তবে এই বাতাস পৃথিলার গায়ে লাগছে না, বরং শরীর দিয়ে যেন তাপ বের হচ্ছে।
এরশাদ দরজার সামনেই দাঁড়ানো। অন্ধকার বলে পৃথিলা খেয়াল করেনি। ঘুমাচ্ছে বলে ডাকেওনি। অবশ্য হাতে সিগারেট থাকলে ঠিক বুঝতে পারতো। তবে বিকেলের পর থেকে আর সিগারেটের তৃষ্ণা পায়নি। বরং এই যে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত এক রাজকন্যাকে দেখছিল। এই মেয়ে কি জানে, এই দেখাটুকু তার একজনমের সাধ।
সে এগিয়েই কোমল স্বরে বললো,– কোন সমস্যা?
পৃথিলার মাথা ভো ভো করছে। এরশাদের কোমল স্বর তার কানে গেলো না। সে এরশাদের মুখের দিকে অচেনা ভঙ্গিতে তাকালো। যেন তাকে চিনছেই না। তবে স্বপ্নের মতো মুখের বা পাশে না। সব সময়ের মতো চোখে।
এরশাদ হয়ত বুঝল, কষ্টে ভেতরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়, উপর দেখে বোঝা যায় না। সব সময় কেমন শান্ত। দেখলে মনে হয় কোন কিছু তাকে ছুঁতে পারে না। আসলে সবার আগে এ’ই ক্ষতবিক্ষত হয়। এরশাদ যতো দেখে তত মুগ্ধ হয়, বিভোর হয়। এই মেয়ে জানে না, কখনো জানবেও না। তার সব দরজার খিল দিয়েছে। সেই খিল খোলার সাধ্য এরশাদের নেই।
সে পৃথিলা থেকে চোখ ফিরিয়ে সাইডে তাকালো। হিসেবের খাতা আছে। সেখান থেকে একটা নিয়ে বাতাস করতে করতে বললো, — মাথায় পানি দেবেন?
পৃথিলা উত্তর দিলো না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। আশ পাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাত কত হয়েছে সে বুঝতে পারলো না। কেমন জানি একটা ঘোর। সেই ঘোর ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো। পা ফুলে ব্যথায় টনটন করছে। এতোক্ষণ ঘোরে কিছু খেয়াল না করলেও। এখন শরীর, মন, আত্মার সব ব্যথা সজাগ হতে লাগলো।
পৃথিলা সেভাবেই বসে রইল। এতোক্ষণ গায়ে বাতাস অনুভব না হলেও, এই যে এরশাদের খাতার হাত পাখার বাতাস এখন ধীরে ধীরে গায়ে লাগছে। লাগতে লাগতে শরীর শীতল হলো। এখন আর তাপ নেই।
নেই হতেই পৃথিলা চোখ খুললো! খুলেই খেয়াল করলো এরশাদ ঠিক তার সামনে বসা। অবশ্য সে দূরুত্ব রেখেই বসেছে। তবুও পৃথিলার সহ্য হয় না। গা ঘিনঘিন করে, তবে কিছু বলার আর করার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
সে কোনো রকম টেনে পা নাড়িয়ে আস্তে করে সোজা হয়ে বসল। তখন এরশাদ বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। ফেরার কথাও না। থাপ্পড়, থুতু, নিজের অহম দমিয়ে এক জেদে টিকে থাকা সহজ কথা না। তাই যেই পর্যন্ত হজম না হবে, সেই পর্যন্ত পৃথিলার সামনে আসবে না। আসেওনি। এসেছে একেবারে বিকেলে। জানা কথা, একা আসেনি। বিনা ঝামেলায় সারেং বাড়ির প্রথম বিয়ে মনে হয় তাদের’ই হলো। পৃথিলা চাবি দেওয়া পুতুলের মতো কবুল বলল, সাইন করল, এরশাদেরও একই অবস্থা। তবে পার্থ্যক্য একটু তো ছিল। তার দৃষ্টি ছিল পৃথিলার উপরে, আর পৃথিলার শূণ্যে।
তার লোকের অভাব নেই, সাক্ষীরও অভাব হলো না। বিনা ঝামেলায়, খুব অল্প সময়ে খুব সুন্দর করে পৃথিলার মৃত্যু হলো। এই লোকটা সব কিছুর বিনিময়ে পৃথিলার লাশ চেয়েছে। অন্য কিছু না। তবে এই লোক বুঝেনি, বাকি সব কিছু এই লাশের কাছে নগন্য।
বিয়ের পরে সবাই বেরিয়ে গেলো। এরশাদ তখনও এই ঘরে। পৃথিলা চকিতে গা এলিয়ে দিল। লাশ হোক আর যাই হোক। রক্ত, মাংসের তো। ধকল আর কতো সইবে। তাই গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, — ভাগ্যিস দুনিয়ায় ঘৃণা মাপার কোন যন্ত্র নেই এরশাদ। বিশ্বাস করুন! যদি থাকতো, আমার ঘৃণার পরিমাণ দেখে আপনি শিউরে উঠতেন।
এরশাদ সব সময়ের মতো হেসেছে। হেসে তার মতোই বলেছে, — ভাগ্যিস নেই, ঘৃণার থাকলে হয়ত ভালোবাসারও থাকতো। আর বিশ্বাস করুন। আমার ভালোবাসার পরিমাণ দেখে আপনিও শিউরে উঠতেন।
পৃথিলা তখন শান্ত চোখে তাকিয়েছে, এরশাদ আর কিছু বলেনি। বরং বেরিয়ে যেতে যেতে বলেছে,– আমার একটু কাজ আছে। বাইরে বালতিতে পানি আছে। চোখে মুখে দিতে চাইলে দিন।
পৃথিলা আর কিছুই বলেই। উঠেও নি। বরং শরীর ছেড়ে বিছায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এতোদিন কতোকিছু হারানোর ভয় ছিল, এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই নেই বিহীন শূণ্য চোখে ঐ যে ছাপড়ি ঘরের উপরের সাদা মাটা টিন। সেই টিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষল। দু’দিন নির্ঘুম, ক্লান্ত শরীর কখন চোখ লেগে গেছে, বুঝতেও পারেনি।
পৃথিলা বসতেই সাইড থেকে ব্যাগ নিয়ে খাবার বের করতে করতে বলল,– এখন আবার জেদ দেখিয়ে বলবেন না, খাবো না।
— আমি বললে, আপনি শুনবেন?
— না।
— তাহলে আর বলে লাভ কি?
— ঠিক। তাহলে উঠুন, হাত, মুখ ধুয়ে নিন।
পৃথিলা উঠল! চুলে জট পাকিয়ে দলা হয়ে আছে। সেই দলাই আজ দু’দিন পরে টেনে টুনে হাত খোঁপা করলো। করে নামবে তা আগেই এরশাদ উঠে বালতি ভরা পানি চকির সামনেই নিয়ে এলো।
পৃথিলার কোন ভাবান্তর হলো না। সে নির্বিকার ভাবে চোখে, মুখে পানি দিলো। দিতেই এরশাদ নতুন একটা গামছা এগিয়ে দিলো। এখানে কিছুই নেই, আসার সময় হয়ত নিয়ে এসেছে।
পৃথিলা চুপচাপই নিলো। এরশাদও চুপচাপ খাবার এগিয়ে দিলো।
গলা, বুক শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে। তাই পৃথিলা আগে পানির বোতলটা এগিয়ে নিতে গেল। নতুন বোতল, মুখটা শক্ত করে আটকানো। এরশাদ দেখে নিজেই হাতে তুলে নিল। নিয়ে বোতলের মুখ খুলে এগিয়ে দিল।
পৃথিলার গা জ্বলে, এই পানির বোতল ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে। তবে ইচ্ছে হলেই সব করা যায় না। অদৃশ্য এক শেকল হাতে পায়ে। কখনো এই শেকল সে ছিন্ন করতে পারবে?
পৃথিলা ভেবে পায় না। তবে হাত বাড়িয়ে ঠিক বোতল নেয়। নিয়ে গলা ভেজায়। ভিজিয়ে শান্ত ভাবেই খাবার টেনে নেয় । সেই খাওয়া কতো কষ্টে গলা দিয়ে ঢেলে ঢেলে নামালো, এরশাদ চুপচাপই দেখল। দেখে বাকি খাবার হাত থেকে টেনে নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললো। ফেলে ঔষধ এগিয়ে দিল।
পৃথিলা ঔষধও নিলো চুপচাপ। খেতেই এরশাদ পা টা একটু দেখলো। দেখে বললো,– আমরা বেরুবো, চলুন।
পৃথিলা এবারো কোনো টু শব্দ করল না। বরং নিজেই উঠল। উঠতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। পা নাড়াতেই ব্যথা, হাঁটবে কি করে পৃথিলা জানে না। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজেই এগিয়ে গেলো। ইটের ভাটা থেকে রাস্তা অনেকটা দূরে। সেখানেই ভ্যান রাখা। সেই পর্যন্ত আসতে পৃথিলার দম বেরিয়ে গেল। এরশাদ অবশ্য সবই দেখলো, তবে কিছুই বলল না। পৃথিলা ভ্যানে বসতেই সেও চুপচাপ ভ্যানে উঠে বসল।
পৃথিলা ভেবেছিল, তাকে সারেং বাড়িতে নিচ্ছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য এক অচেনা জায়গায় এসে ভ্যান থামল। মিঠাপুকুরের সব অলিগলি তার চেনা হয়ে যাচ্ছে। ভালোতো!
ভ্যান থামতেই এরশাদ নেমে বলল, — আসুন?
পৃথিলা এবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল। যেখানে ভ্যান থেমেছে, সেখানে কোনো বাড়িঘর তো দূরের কথা, কোন কিছুই নেই। এক সাইডে সোজা রাস্তা গেছে, আরেক সাইডে ধানের ক্ষেত।
এরশাদ দেখে বলল, — এই ক্ষেত দিয়ে যাবো। বেশি দূর না, এই তো দুটো ক্ষেত। বলেই তার হাতের টর্চ টা পাশের জনের হাতে দিলো।
কেন দিলো পৃথিলা বুঝেনি, তাছাড়া কোথায় নিচ্ছে এই নিয়ে পৃথিলার মাথা ব্যথাও নেই। তবে সমান জায়গা আর ধানের ক্ষেতের আইল এক কথা না। অন্ধকার তবুও পৃথিলা বুঝতে পারছে, মানুষের তেমন চলাচল নেই। এবড়ো থেবড়ো আইল। তাই বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে এগুতেই, এরশাদ ঝট করে কোলে তুলে নিলো। নিয়ে এক দৌড় দিতে দিতে বলল,– কথা দিয়েছিলাম অনুমতি ছাড়া ছোঁব না। তাই বিশ্বাস করুন, এটাই শেষ, সত্যিই শেষ।
পৃথিলা কিছুই বলল না। চুপচাপ শক্ত হয়ে রইল। দুটো ক্ষেত বললেও, দুটো ক্ষেতের কিছুই হলো না। বরং বেশ কিছুসময় লাগলো। আর লাগতেই গাছগাছালিতে ভরা একটা বাড়ি চোখে পড়ল। হয়তো কারেন্ট টারেন্ট নেই, অন্ধকারে তলিয়ে আছে। তবে ঘরের ভেতরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হারিকে আলো ঠিক বোঝা গেলো।
এরশাদ পৃথিলাকে এনে নামালো, একেবারে ঘরের ভেতরে । আর নামতেই পৃথিলা আঁতকে উঠল। এই ঘরে টুকটাক অনেক কিছুই আছে। তার মধ্যে এক কোণে বড় সাইজের একটা খাট। সেই খাচে জুঁই শুয়ে আছে।
পৃথিলা নিজের পায়ের কথা ভুলে গেলো। চোখে, মুখে ভয় আতঙ্ক নিয়ে দৌড়ে গিয়েই হাতে মুখে হাত বোলালো। এরশাদ দেখে বলল, — কিছু হয়নি, সকাল হতেই ঠিক হয়ে যাবে।
— কি করেছেন আপনি ওর সাথে?
— কিছুই না, শরবতের সাথে একটা ঘুমের টবলেট দিয়েছি।
পৃথিলা আগুন চোখে তাকালো। এরশাদ সেই আগুন চোখের দিকে তাকালো না। দু’রাত একেবারে নির্ঘুম, তার মধ্যে এতো দৌড়াদৌড়ি। এতো ক্লান্ত লাগছে। সে জানালা খুলে দিলো। কারেন্ট নেই, তাই ফ্যানের ব্যবস্থা করা যায় নি। তাই জানালা খুলে পৃথিলার সাইড দিয়ে খাটে উঠে, জুঁইয়ের অপর পাশে শুতে শুতে বলল, — সব খেলতো মহাজন একাই খেললো, এবার আমি একটু খেলি।
— তাই বলে এই মাছুম বাচ্চাকে তুলে আনবেন? ওর মার কথা একবার ভেবেছেন?
— হ্যাঁ! ভেবেছি। তাই সে জানে তার মেয়ে তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর কাছেই আছে।
— অমানুষ।
— জ্বি শুকরিয়া।
পৃথিলা আগের মতোই তাকিয়ে রইল, এরশাদ একটু হাসলো। হেসে চোখ বন্ধ করলো। যতো ক্লান্তই থাক, সহজে তার চোখে ঘুম ধরা দেয় না। আজ শুতেই ঘুমিয়ে গেলো। আর কেন গেলো পৃথিলা না জানলেও এরশাদ জানে। ভালো করেই জানে।
ফরহাদ সারেং বাড়িতে এলো পরের দিন বিকেলে। সে ভেবেছিল ঢুকতে দেবে না, তবে সদর দরজার পাহারাদার কেউই কিছু বললো না।
বললো না বলে সে নিজের মতোই ভেতরে এলো। সব কিছু এতো এলোমেলো। হিসেব মিলাতে হিমসিম খায়। সেই খেতে খেতে ঘুরে ফিরে এক জায়গায়’ই স্থির হয়। মিঠাপুকুরে তার আর থাকা সম্ভব না। যেখানে তাকায় বাপের পাপ নজরে পড়ে, আর পড়ে বলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। অথচ এক সময় এই বাবাকে নিয়ে সে গর্ব করতো।
বাড়ির দরজা খুললো আয়না। আম্বিয়া এখন কাজ ছাড়া রুম থেকে বেরোয় না। আয়নার’ই সব করতে হচ্ছে। তার মধ্যে আরেকজন তো আছেই। ব্যথা পায় মাথায়, হাতে পায়ে কি হয় কে জানে? সব আয়নাকে দিয়ে করাবে। তবুও ভালো সাইজে টাইজে ছোট। তা না হলে, তার ধারণা, পা দিয়ে হাঁটতোও না। তার কোলে চড়ে চড়ে পুরো বাড়ি ঘুরতো। তাই দরজা খুলে ফরহাদকে দেখেই সে বড় এক ঢোক গিললো। গিললেও সুন্দর করেই ভেতরে এনে বসালো। বসিয়ে কোন দিকে যাবে বুঝতে পারল না। এরশাদ ভাই কাল রাতে তো ভালোই, এই যে এতো বেলা আজও ফেরেনি। জয়তুন আরা এই বাড়ি তো বাড়ি, দিন দুনিয়ার হিসেব নিকেষও ছেড়ে দিয়েছে। জাফর চাচা কাল থেকে গলা দিয়ে পানির ফোটাটুকুও ফেলেনি। আয়না বেশ কয়েকবার গেছে, দরজাই খুলেনি। বাড়িতে থাকার মতো পুরুষ বলতে শাহবাজ, সে আবার গো ধরে বসে আছে, বোন কে দেবে না। সে করবেটা কি?
ফরহাদ আয়নার দিকে কিছুটা শান্ত ভাবেই তাকিয়ে রইল। সত্য জানলে, এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তাদের ঘৃণা করবে। অবশ্য ঘৃণার কাজই করেছে তার বাবা। অথচ তিল পরিমাণ অনুশোচনা নেই। যদি থাকতো, তার বাবা জানে না, তার ছেলে তাকে কতোটা ভালোবাসে। মাফ করতে না পারুক তবে ঘৃণা করতো না। ভাবতো যা করেছে ভালোবাসায় অন্ধ হয়েই করেছে। তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বরং অন্যের দোষ দেখাতে ব্যস্ত।
তাই আয়নার দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবেই বললো,– এরশাদ ফিরেনি?
আয়না দু’পাশে মাথা নাড়লো। ফরহাদ সেই নিষ্পাপ মাথা নাড়ানো দেখে মৃদু হাসলো। হেসে বলল,– বীণাকে একটু ডেকে দাও আয়না।
আয়না সাথে সাথে বীণার ঘরের দিকে দৌড়ে গেলো। শাহবাজ কি বলেছে তার মাথাও নেই। তাই গিয়েই কিছু বলবে তো ভালোই, কিছু বোঝার আগেই টেনে নিয়ে এলো। এনে দাঁড় করিয়ে খাবার ঘরের দিকে গেলো। জামাই মানুষ, কিছু সামনে না দিলে কেমন দেখায়।
বীণা ফরহাদকে দেখেই হকচালো। কিছু না জানলেও, বুঝতে পারছে বড় কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে সবাই এমন বদলে যাবে কেন? বড় ভাই যাকে সব সময় সুন্দর, গোছানো, মার্জিত রুপে দেখে এসেছে, সেই আজ বড় অগোছালো, ছোট ভাই, যে দিন দুনিয়ার পরোয়াতো ভালোই। বড় ছোট কাউকে গোনায় না ধরা মানুষটা, এখন সব বিষয়ে চিন্তিত। আর এই যে সামনে বসা মানুষটা, একে সে হারে হারে চিনে। রাগ, জেদ, বিরক্ত সব সময় যার নাকের ডগায় থাকে, সে আজ শান্ত, বড়ই শান্ত। কেন? কি কারণ, সে বুঝতে পারছে না।
ফরহাদ বীণার অবস্থা বুঝলো। বুঝে বলল, — বস, আমি শুধু কয়েকটা কথা বলবো।
বীণা জড়সড় ভাবেই ফরহাদের সামনে বসলো। বসতেই ফরহাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসলো। বসে বলল,– আমি যখন ঢাকা পড়তে যাই। তখন এক মেয়ের প্রেমে পড়ি। তোর মতোই, পড়া লেখার জন্য সে জান প্রাণ দিতে পারে। লেখা পড়া ছাড়া ডান,বাম কোন কিছুতেই সে নেই। তার এই নাইতেই আমি প্রেমে পড়লাম। প্রথম প্রেম, দিন দুনিয়া ভুলেই পড়লাম। কতো সময়, কতোটা ধৈর্য্য নিয়ে আমার দিকে তাকে ফেরালাম, সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। আমরা দু’বছরের মতো সম্পর্কে ছিলাম। এই দু’বছর আমার কেটেছে স্বপ্নের মতো। আমি তার বিষয়ে খুব সিরিয়াস ছিলাম। তবে তার হয়ত অন্য কিছু চাওয়ার ছিল। থাকতেই পারে। তাই সুন্দর মতো যদি সম্পর্ক শেষ করতো, আমার আফসোস থাকতো না। তবে সে আমার সাথে করেছে ছলনা। আমার সাথে সম্পর্ক রেখেই, আরেকজনের সাথে জড়িয়েছে। আমি তাদের হাতে, নাতে ধরেছিলাম। বইয়ের নেশা ছাড়িয়ে তাকে প্রেম শিখিয়েছিলাম আমি, সেই শেখানোই আমার উপরে ভারী পড়েছে।
প্রথম ভালোবাসা তো, ধোকাটা হজম হয়নি। এতোটা ঘৃণা ভেতরে জমা হয়েছিল, কোন মেয়েকেই আর সহ্য হতো না। তার মধ্যে তার হাবভাব অধিকাংশ’ই তোর সাথে মেলানো। তাই তোকে দেখলেই চট করে রাগ মাথায় উঠে যেত। পড়াতেই চাইনি, এরশাদ জোর করলো। আর নিষেদ করতে পারিনি। তবে সেই না পারার রাগ, জেদ, বিরক্ত সব তোর উপরেই ফেলেছি। তবে সত্য বলছি, সেই প্রেমের ছিটেফোঁটাও এখন আর আমার ভেতরের কোথাও নেই।
এই শক্রবারে আমি ঢাকা চলে যাবো, একেবারে। কেউ মানুক আর না মানুক, একটা পবিত্র সুঁতোয় আমরা বাঁধা। বলেই ফরহাদ একটু থামলো! থেমে ঢোক গিলে গলাটা ভিজেয়ে বলল,– আমার সাথে যাবি, বীণা?
বীণা থমকে তাকিয়ে রইল। শাহবাজ সাইডে থেকে সবই শুনলো। সে দোতলা থেকে দেখেছে, ফরহাদ এসেছে। তাই তেজ নিয়েই নামছিল। তবে ফরহাদের কথায় থমকে সে নিজেও দাঁড়ালো। যদি আয়না দোষ না থাকে, সেখানে ফরহাদও নির্দোষ। তবে ফরহাদের সাথে জড়ালে, তার বোনের জীবনের ঝুঁকি আছে। অবশ্য যদি সব কিছুর মায়া ছাড়তে পারে, তবে আর থাকবে না। তার মনে হলো, ফরহাদ সেই মায়া ফেলেই এসেছে। তাই আর এগুলো না, বীণার যেটা ভালো লাগে করুক। তাছাড়া সারেং বাড়ি ভেঙে গেছে। সে একদিকে, ভাই একদিকে, দাদি একদিকে, জাফর চাচাতো সবাইকে ভাবছে শত্রু। তাও ভালো ঘরে খিল এটে বসে আছে। বেরুলেই সত্য কানে যাবে। তখন কি করবে কে জানে? আর এমন অবস্থায় বীণার মাথায় এর চেয়ে শক্ত হাত আর কে রাখবে?
তখনি আয়না এসে নাস্তার ট্রে রাখলো। ফরহাদ, বীণা কেউ নাস্তার দিকে তাকালো না। শাহবাজ দেখলো! এই ভেনদি তো জনমকার ভেনদি। তাই উপরে দিকে যেতে যেতে চেঁচালো, — আয়না….
আয়না চমকে উঠল। এই কণ্ঠ শুনেই চমকে উঠা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই নিজেকে সামলে মুখ গোঁজ করে উপরে দিকে গেলো। সে একটু এদের কথা শুনতে চেয়েছিল। ধুর! সব কিছুতে শয়তানটার বেগড়া না বাজালে পেটের ভাত হজম হয় না।
আয়না যেতেই ফরহাদ আগের মতোই বললো,— তোদের বাড়িতে যেই ডাকাতের ঘটনাটা ঘটেছিল। সেটায় আমার বাবার কাজ ছিল। কেন ছিল, সেটা আমি বলতে চাই না। সেটা তোর ভাইদের ব্যাপার। যদি বলতে চায় বলবে। তবে সত্য এটাই তোর বাবা, মায়ের খুনি আমার বাবা। তাই যে কোন সিন্ধান্ত নেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে নিবি। কেননা, এবার আমি, আমার বাবার জন্য কোন সিন্ধান্ত নিচ্ছি না। নিচ্ছি নিজের জন্য। তাই এই সম্পর্কে কোন ফাঁক থাকবে না। আমি নিজে তোর সব দায়িত্ব নেবো। তোর ইচ্ছা, তোর স্বপ্ন সব কিছুই আমার। তবে আমার দায়িত্ব থেকে তুইও কোন পিছ পা হতে পারবি না। না পারবি কোন অবহেলা করতে।
বীণা থমকে আছে। সেই থমকে যাওয়া চোখের কোণা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। এখন বুঝতে পারছে, সব কেন এতো এলোমেলো।
ফরহাদ সেই গড়িয়ে পড়া পানি দেখলো। দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,— আমি ট্রেনের দুটো টিকিট কাটবো। ট্রেন ছাড়ার শেষ এক সেকেন্ড পর্যন্তও তোর অপেক্ষা করবো। বাকি তোর ইচ্ছা। বলেই ফরহাদ বেরিয়ে এলো। বেরুতেই এরশাদের সাথে দেখা হলো। সে দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজার সামনে। চুপচাপ, তবে আজ সব সময়ের মকো হাতে সিগারেট নেই। ফরহাদ হাসলো। যাক, নেশা কাটানোর ঔষুধ তাহলে পেয়ে গেছে।
বলেই ধীরে ধীরে এগুলো! এগুলো এরশাদও। পাশাপাশি দাঁড়ানো বন্ধু, আজ দাঁড়ালো মুখোমুখি। দাঁড়াতেই ফরহাদ বললো,– খবর পৌঁছাতে সময় লাগেনা তোর ?
— কি করবো? মুখোশ পরা সবাই।
— সেটাতো তুই ও পরে থাকিস।
— ভালো, তবে শুনে রাখ। আমার বোন যাবে না।
— সেটা ওকে ভাবতে দে।
— ভেবেও লাভ কি? আমি তোদের ছাড়বো না।
— আমার গলায় তুই ছুরি চালাতে পারবি?
এরশাদ নির্দ্বিধায়া বললো — হ্যাঁ! পারবো।
ফরহাদও তার মতো বললো, — বেশ! তাহলে নিশ্চিন্তে থাক। তুই আসতে পারলে, আমি নিজে গলা পেতে দেবো।
চলবে……
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৪
এরশাদ আজ অনেক দিন পরে বাড়িতে ফিরেই দাদির রুমে পা রাখলো। জয়তুন তখন জানালার পাশে বসা, পিঁড়িতে। বিকেলের কোমল আলো চোখে মুখে পড়েছে। পা দুটো সামনে মুড়িয়ে সোজ করে রাখা। মুখে পান, দৃষ্টি জানালা গলিয়ে উঠানে। ফরহাদ এসেছে, গেছে, এরশাদ এসেছে। সবই সে দেখেছে। তবে তেমন কোন ভাবান্তর হয়নি। তখনও নিজের মতো ছিল, এখনো ও আছে। এই যে এরশাদ এসেছে সে বুঝল, তবে ফিরে তাকালো না। যেভাবে বসে ছিল সে ভাবেই বসে রইল।
এরশাদ এগিয়ে সব সময়ের মতো দাদির কোল ঘেঁষে নিচে বসলো। সেই দিন দাদি কিছু করেনি, তবুও অনেক রাগ জেদ দেখিয়েছে। অবশ্য দাদি নাতিদের একই সমস্যা, মাথা বিগড়ালে কাউকে চেনে না। তাই কুঁচানো চামড়ার এই নরম দুটো হাত, নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, — মাফ করে দাও দাদি।
জয়তুন আগের মতোই বসে রইল। এরশাদ হাত দুটো গালে ছুঁইয়ে বলল,– কথা বলবে না?
জয়তুন এবারো কিছু বললো না। তবে এরশাদ তার নরম স্বরে বলল,— তোমার এরশাদ বিয়ে করেছে, দাদি।
জয়তুন শুনলো, শুনেই আস্তে করে হাত সরিয়ে নিলো। পৃথিলা সারেং বাড়ির রক্ত, আসল রক্ত। জাফর জানতো, এরশাদ জানতো তবে এরা কেউ তাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ সে ভাবতো, তার ছেলে নাতিদের মাঝে কোন আলাদা পর্দা নেই। কতো মিছে দুনিয়ার বসে বসে গর্ব করতো। জয়তুন হারে না, নিচ হয় না। অথচ মরে গিয়েও জোছনা জিতে গেছে, শায়লা চলে গিয়েও তাকে হারিয়ে গেছে। সে বুঝেনি, আসলেই বুঝেনি।
এরশাদ সরিয়ে নেওয়া হাতটা দেখলো। রক্তের যোগ না থাক, তবে দু’জনেই এক নীতির মানুষ, তাই কারো দোষ, পাপই কারো চোখে বড় মনে হয় না। এরশাদের কাছে তো আরো না, পৃথিলার দিকে চোখ তুলে কেউ তাকাক, তার সহ্য হবে না। তেমনি দাদি তার ভালোবাসার মানুষের ভাগ দিয়েছে, যত্নের সংসারের ভাগ দিয়েছে। দিয়েছে সব কিছুর। তবুও তারা যদি আঘাত করতে আসে, ছেড়ে দেবে কেন? তাই তার কাছে তার দাদিই ঠিক।
সে টেনেই আবার হাতদুটো গালে রাখলো। রেখে বলল, — কিছু বলো দাদি। শাস্তি দিতে চাও দাও। আমি মাথা পেতে নেবো।
জয়তুন ফিরে তাকালো! তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, — আমার এক সন্তান। না দিলাম এই কোল থেকে জন্ম। তবুও সে আমার ছেলে। সে মারা গেছে। ব্যস, আমার আর কিছু নেই। আর কারোর দরকারও নেই। এটা আমার স্বামীর বাড়ি। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এখানেই থাকবো। তাই আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
এরশাদ তার কোমল স্বরে ডাকে — দাদি…
সেই কোমলতা জয়তুনকে ছোঁয় না। বরং নিজের মতোই বলে, — তোরা দাদিকে চিনছোস, তবে জয়তুন আরারে না। না থাক তার ক্ষমতা। তবে যে নিজের স্বামীকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়নাই, তোরা আর কী? এই যে দেখ, এই দরজা। এই দরজার ওপারে রাতের পর রাত আলতাফ দাঁড়িয়ে থেকেছে, জয়তুনের মন তখনই গলে নাই। আর তোরা ছুঁড়ে ফেলে, আবার এসেছিস দয়া দেখাতে। জয়তুন কারো দায়ায় বাঁচে না। মনের মতো বিয়ে করেছিস, যা, বউ নিয়ে থাক। তবে এই শেষ বার। আমার দরজার চৌকাঠ যেন তোকে পেরুতে না দেখি।
এরশাদ হাসলো! হেসে বলল, — কে বলেছে তোমার ক্ষমতা নেই? মুখ দিয়ে আদেশ বের করে তো দেখো।
— আমি বের করলেও তোর আর সেই সাধ্য নাই।
— ও তোমার তো কোনো ক্ষতি করেনি।
— ওই আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। এই যে দেখ, সারেং বাড়িতে পাও রাখেনাই, তবুও জয়তুনের সিংহাসনে ঠিক বসে গেছে। বসেছে বলেই সে নাই, তবুও তার হয়ে তুই গান গাইতাছোস, জাফরকে কে ডাক। সে এই মেয়ের এক ইশারায় সারেং বাড়িকে ধূলোয় মিশাতে একবার চিন্তাও করবে না।
— সে সারেং বাড়ির একমাত্র রক্ত। ছোট চাচার মেয়ে। তোমার এরশাদের বউ। আর কিছু না। বিশ্বাস করো, এই তিনের একটাও সে স্বীকার করে না। কখনো করবে বলে মনেও হয় না। ঘৃণার দিকে সে তোমার কার্বন কপি। একবার মুখ ফেরেছে তো ফেরেছে। কারো সাধ্য নেই আর কিছু করার। তাই অযথা দোষী বানিয়ে বসে আছো। তোমরাই তো নাতনি।
— নাতনি হয়ে যদি বসতো, তাহলে জয়তুনের আফসোসের কথাই আসতো না। জয়তুন বুক পেতে সিংহাসনে বসাতো। তবে সে বসেছে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। তাই মিঠাপুকুরে পা রাখতে না রাখতেই সারেং বাড়ির ধ্বংস শুরু হয়েছে। এই মেয়ের জন্যই প্রথম বার গ্রামের মানুষের সামনে আঙুল উঠেছে, এই মেয়ের জন্যই আজ আমার কেউ নাই। এই মেয়েই আমার নাতি, সম্মান, শক্তি, ভরসা, সিংহাসন সব কেড়ে নিয়েছে। তাই এই মেয়ের ক্ষমা নাই। অন্তত জয়তুনের কাছে নাই। তাই যা নিজের ইচ্ছায় বিয়া করছোস। নিজের মতো থাক।
এরশাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,— যতোই বলো, জসিম আমার ছেলে, আমার ছেলে। নিজের কোল থেকে হলে, এভাবে মুখ ফেরাতে পারতে না দাদি। আলতাফ তোমার সাথে অন্যায় করেছিল, আমরা কেউই করিনি। আর পৃথিলা, সে তোমার কোন কিছুতেই নেই।
জয়তুন উত্তর দিলো না। মুখ ফিরিয়ে আবার জানালার দিকে তাকালো। এরশাদ সেই ফেরানো মুখটার দিকে আগের মতোই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সব তার হাতে, তবুও কিছু একটা ঠিক নেই, কি নেই? সে বুঝতে পারছে না। এই যে প্রিয় দাদির মুখ। এই মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। গা ঘেঁষে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। অথচ কতবার এভাবে দাদি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, হিসেবও নেই। তবে আজ এমন লাগছে কেন?
এরশাদ উত্তর পায় না। পায় না বলেই, নিজের মতো বেরিয়ে আসে। আসতেই আয়নাকে দেখলো। সে বীণার রুমের দিকে যাচ্ছিলো। তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই ভয়ে ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
এরশাদ মুখে একটা শব্দও বললো না, তবে শান্ত, শীতল চোখে তাকিয়ে রইল। সেই তাকানোর বিপরীতে শাহবাজ আয়নার ঠিক পেছনে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবেই বলল,— আয়না, উপরে যাও।
আয়না যেন প্রাণে বাঁচলো। তাই ডানে বামে আর একবারও তাকালো না। দৌড়ে সোজা উপরে চলে এলো। আর প্রথমবার শাহবাজকে তার সবচেয়ে আপন মনে হলো। মনে হলো, এই মানুষটা তার পাশে থাকলে, আর কোন ভয় নেই।
এরশাদ শাহবাজের দিকে তাকিয়ে বলল,– মনে আছে, ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বলেছিলি, নিজ দায়িত্বে যেন ইটের চুলায় দেই।
— আছে।
— তাহলে, কিসের এতো কানামাছি খেলা?
শাহবাজ উত্তর দিলো না, এগুলো। দাঁড়ালো ভাইয়ের একেবারে সামনে। দু’ ভাইয়ের বয়সের তফাৎ অনেকটা, তবে কাঁধ বুক বরাবর। বরাবর হলেও খুব কম সময়ই এই কাঁধ দুটো একে অপরের সাথে মিলেছে। তাই শাহবাজ আজ নিজে থেকেই বড় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।
এরশাদ কি একটু থমকালো? হয়তো, ভাইবোনদের মাঝে আহ্লাদ, তাদের তিন ভাইবোন কারো মাঝেই নেই। সবার আহ্লাদ ছিল জয়তুন আরা। জয়তুন আরার কাছ ঘেঁষে যত সহজে বসতে পারে, বোনের মাথায় তত সহজে হাত রাখতে পারে না। ভাইয়ের কাঁধে কাঁধ মেলাতে পারে না। এই যে যেমন, আজও পারলো না, শান্ত হয়ে সোজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
তবে শাহবাজ ধরলো। ধরে সেই দিনের মতো বলল, — আয়না নির্দোষ, ভাই। তার বাপ পাপ করেছে, তার মা জীবন দিয়ে সেই পাপের প্রায়শ্চিত করেছে। ওর কোনো দোষ নেই।
— আমাদের বাবা-মায়ের ছিল?
— না।
— তাহলে?
— আমি আয়নামতিকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।
— বাবা-মায়ের খুনির মেয়েকে ছাড়া যদি না বাঁচিস, তাহলে মরে যাওয়া-ই ভালো।
শাহবাজ হাসলো। হেসে সরে দাঁড়ালো। এতক্ষণ যে ভাইয়ের প্রতি কোমলতা ছিল, সেটা আর দেখা গেলো না। বরং সব সময়ের সেই চিরচেনা হাসি হেসে বলল, — আয়নামতিকে কিছু করতে হলে, তার আগে আমাকে মারতে হবে। আমাকে তুমি কিছুই করবে না, আমি জানি। তবে ভাই, সোজা একটা কথা বলি, তুমি আমার গায়ে টোকা না দিলেও, আয়নামতির দিকে বাড়ানো হাতে কোপ আমি ঠিক বসাবো। আর সেই হাত কার, আমি দেখবো না। বড় ভাই তো, তাই প্রথমে আবদার রাখলাম, পরে যেন আফসোস না হয়।
এরশাদ আগের মতোই শান্ত চোখে ভাইকে দেখলো। দেখে অবাক হলো না। একই বাপের রক্ত, একই স্বভাব। তফাৎ এরশাদ বুদ্ধি খাটিয়ে করে, আর শাহবাজ যা করবে সোজা। ভয় ডর ডান বাম নেই। তারপর যা হওয়ার হোক, তাতে তার কিছু আসে যায় না। তাই সে জানে, সে যেমন পৃথিলার জন্য সব করতে পারে, তার ভাইও আয়নামতির জন্য সব পারবে। তবে তার ভাই জানে না, এরশাদ এবার নিজে হাত বাড়াবে না, হাত লেলিয়ে দেবে। যেই হাতে চাইলেও কোপ বসানো যায়না।
এরশাদ বেরিয়ে এলো। যেতে যেতে দোতালায় একবার তাকালো। সব কিছু পন্ড করার ক্ষমতা একজনেরই আছে, তার ছোট চাচা। তাই যেতে যেতে সদর দরজার পাহারার লোককে বলল, — কেয়ামত হলেও ছোট চাচা যেন এই বাড়ির সদর দরজা না পেরোয়, না বাইরের কেউ ছোট চাচার সাথে কথা বলতে পারে। কোন ভাবেই না।
পৃথিলা সুন্দর করে জুঁইয়ের মাথায় দুটো বেনি তুলে দিলো। তার পায়ের ব্যথা আজ নেই বললেই চলে। ওষুধ খাচ্ছে, কমারই কথা, তবে ফোলা আছে। সে চিরুনি রেখে জুঁইকে কোলে তুলে বসালো। মেয়েটা শান্ত, তবে ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখে অবাক হয়েছে। অবাক হয়েই বলেছে,– আমরা বেড়াইতে আইছি?
পৃথিলা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে,— হুম।
— মা আসেনাই?
পৃথিলা আস্তে করে দু’পাশে মাথা নাড়িয়েছে। তার নাড়ানো দেখে মন খারাপ করে বলেছে,– মা আসবো না?
পৃথিলা উত্তর দেয়নি। বসে থাকতে থাকতে শেষ রাতে চোখ লেগেছে, এরশাদ কখন বেরিয়ে গেছে জানেও না। দরজা বাইরে থেকে আটকানো, পাশের রুমে কোন কিছুই নেই, তবে তার সাথে পেছনের দিকে লাগোয়া টিনের বাথরুমের মতো করেছে। যেন বাইরে পা রাখার প্রয়োজনই না পড়ে। তবে বাইরে এক-দু’জন লোক আছে, তারাই নিয়ম করে খাবার, দিয়ে যাচ্ছে। সকালের নাস্তাও দিয়ে গেছে।
পৃথিলা উত্তর না দিলেও সুন্দর করে খাইয়ে দিয়েছে, হাত, মুখ পরিষ্কার করে দিয়েছে। অবশ্য এভাবে আটকে রাখার উদ্দেশ্য কী? জুঁইকে বা কেন এখানে এনে রেখেছে ? কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশ্য সে জানে, জিজ্ঞেস করলে সব সত্যি সত্যিই বলবে। তবে পৃথিলার ইচ্ছে করে না। কি হবে জেনে? এই লোক সব সত্যি সত্যি বলবে ঠিক, তবে কারো কিছুতেই কিছু বদলাবে না। যেটা ঠিক করেছে, সেটা করবেই।
তখনই দরজা খোলার শব্দ হলো। পৃথিলা ভেবেছে বাইরের লোকদের কেউ। কিছু হয়ত দিতে এসেছে। তবে তাকে ভুল প্রমাণ করে এরশাদ এলো। হাতে কয়েকটা ব্যাগ। কিসের ব্যাগ পৃথিলা ঝট করেই বুঝলো। অবশ্য না বোঝার কিছু নেই। গত দু’দিন একই কাপড় গায়ে। কাদা, ময়লা শুকিয়ে চট হয়ে আছে। তার মধ্যে আঁচল ছেঁড়া। তাই কাপড় টাপড় ছাড়া আনবেই বা কি?
পৃথিলা জুঁইকে বুকে জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইল। এরশাদ ফিরে এই দৃশ্যটুকুই দেখলো। এই মেয়েটা যেভাবে থাকে, সেভাবেই তার দেখতে ভালো লাগে।এই যে জুঁইকে বুকে জড়িয়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে বসে আছে। এই দৃশ্যটুকুতেও সে মুগ্ধ হয়ে গেলো। আর মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে রইল। আর খেয়াল করলো, মনের যতো অস্থিরতা সব কেমন হাওয়ায় মিশে গেলো।
মিঠাপুকুরে সন্ধ্যার আগে আগে এক ঘটনা ঘটে গেলো। মহাজন বাড়িতে পুলিশের পা পড়ল। আশপাশ তো ভালোই, এলাকার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গ্রামগঞ্জে পুলিশ সহজ বিষয় না। এক তো নাম শুনলেই সবাই আতঙ্কে থাকে, তার মধ্যে মহাজন তাদের প্রিয়, সম্মানের ব্যক্তি যেমন তেমন, তেমনি আবার প্রভাবশালী একজন। আর এই রকম মানুষের বাড়িতে পুলিশের আগমন আশ্চর্যের ঘটনাই বটে।
আজিজ পুলিশকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এরশাদ চুপ বসবে না, সে জানে। তবে সব সময় যা করে, ভেবেছিল সেই রকমই করবে। ভেবেছিল, অন্য সব মানুষের মতো রাতের আঁধারে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তাই নিজের দিক থেকে সে ঠিক তৈরি হয়েই বসে ছিল। তার লোক তো আর কম নেই। তাছাড়া সারেং বাড়ি একা, আর তার সাথে আছে চেয়ারম্যান। চাইলেই ঝট করে কিছু করতে পারবে না, এরশাদের যত ক্ষমতাই থাক। সে তো অন্য সবার মতো গ্রামের সাধারণ মানুষ না। মহাজন, গ্রামের মহাজন সে । নিজের লোক তো যেমন তেমন গ্রামের অধিকাংশ মানুষও তার সাথে। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তেই ছিল। সেখানে পুলিশের কাহিনী কী?
সে ভ্রু কুঁচকেই পুলিশদের বসার ঘরে বসালো। বসিয়ে চা নাস্তার কথা বলতেই অফিসার বলল,
— এই সবের প্রয়োজন নেই, মহাজন সাব। তাছাড়া আমাদের ফিরতে হবে। এখন আপনি গণমান্য ব্যক্তি। চেয়ারম্যান শুনতেই রেগে আছেন। তবে আমাদের কিছু করার নেই। জলজ্যান্ত সাক্ষী হাতে। তাই চাইছি, যা হওয়ার এখানেই শেষ হোক। না হলে আমাদের আর উপায় থাকবে না।
আজিজ আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না, সে আগের মতোই ভ্রু কুঁচকে বললো, — হয়েছে টা কী?
— আপনাদের গ্রামের ছেলে ইমরান, তার বউ। আপনার নামে কেস ফাইল করেছে। তার বান্ধবী দু’টো দিন ধরে গায়েব। সারেং বাড়িতে বিয়ে ছিল, সেই সুযোগে আপনি নাকি তাকে সরিয়েছেন?
আজিজের রাগে চোয়াল শক্ত হলো। শক্ত করেই বললো,– কথা সত্য! তবে আমি সরাইনি, কিন্তু তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। সারেং বাড়ির ছোট বউ আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আমি তাকে সাহায্য করেছি।
— কেস সারেং বাড়ির ছোট বউয়ের নামেও হয়েছে। তবে আপনি তাকে গুটির চাল হিসেবে চালিয়েছেন, সেই হিসেবে। তাছাড়া আটকে রাখা হয়েছিল এমন কোন প্রমাণও নেই। যেহেতু বান্ধবীর বাড়িতে এসেছে, বান্ধবীর বাড়িতেই তো থাকবে। অসুস্থ ছিল, স্কুল থেকে ছুটির দরখাস্ত নিয়েছে, তাই বাড়ি থেকে আর বের হয়নি।
— সব সাজানো নাটক।
— হতে পারে। তবে আপনি মেয়েটাকে খুন করার জন্য আপনাদের এলাকার তিনজন লোক ভাড়া করেছেন। প্রমাণ মেটাতে তাদের খুন করে সারেং বাড়ির ইটের ভাটার নদীর পারে ফেলেছেন। তবে ভাগ্য আপনার খারাপ। দু’জন মরলেও একজন বেঁচে আছে। অবশ্য বলতে গেলে অবস্থা খুবই খারাপ। সদর হাসপাতালে এই যাচ্ছে তো ঐ যাচ্ছে। চোখ উপড়ে ফেলেছেন, হাত-পায়ের হাড্ডি তো ভালোই, আসল জায়গাও ছেঁচে ভর্তা। এতোটা নির্দয় না হলেও পারতেন। মানে মারবেন, মারেন, কী দরকার এত টর্চার করার? তবে যেমন করেছেন, তেমন সুন্দর করে আপনার কাহিনী বলে দিয়েছে।
আজিজ দাঁতে দাঁত চাপলো। এই সব কার কাজ, সে ভালো করেই জানে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— এমন পিশাচের মতো কাজ এই গ্রামে একজনই করে। আর কে, আপনি ভালো করেই সেটা জানেন।
— সেটাতো আপনের টাও জানতাম। তবে মানুষের কতো রুপ যে থাকে।
— কি বলতে চান আপনে?
— আমি কিছুই বলতে চাই না। তবে প্রমাণ যেই দিকে, আমাদের দৌড়ও সেই দিকে। তাই মেয়েটা কোথায় বলে দিন, ঝামেলা শেষ হোক।
— কত টাকায় এই বুলি বের হচ্ছে?
অফিসার হাসলো! আজিজ সেই হাসি দেখে বললো, — তার ডাবল পাবেন।
অফিসার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, — এখন আর সম্ভব না, মহাজন সাব। লোক জানাজানি হয়ে গেছে। আমাদেরও গায়ের ড্রেস সাদা রাখতে হয়। তাই মেয়েটা কোথায় আছে বলুন। আর কেন দুনিয়া থেকে সরাতে চেয়েছিলেন, সেটাও যদি একটু খোলাসা করেন, তবে আপনার হয়ে কিছু একটা করা যেত পারতো। তাছাড়া অচেনা একটা মেয়ে, দু’দিন হলো গ্রামে এসেছে, তার সাথে আপনার শত্রুটা কিসের?
আজিজ কিছুই বললো না। তবে ঠিক বুঝল, তাকে চারদিক থেকে আটকে ফেলা হয়েছে। এখন নয় পৃথিলাকে খুনের দায় শিকার করতে হবে, না হয় বলতে হবে কেন পৃথিলাকে সরাতে চেয়েছিল। সেটা বলতে গেলেই সেই ডাকাতির প্রসঙ্গ আসবে। আর আসলেই এক খুনের জায়গায় লাগবে পুরো সারেং বাড়ির খুনের দায়।
পুলিশ আফসোসের মতো মাথা নাড়ালো। নাড়িয়ে বলল, — উপায় রাখলেন না। আসুন, মহাজন সাব। আমাদের যেতে হবে।
এই কথা শুনেই মহাজনের লোক সব ক্ষেপে গেলো। তাদের জীবন যাবে, তবে মহাজনকে নিতে দেবে না। আশপাশের মানুষ, তাদের লোক মিলে পুরো গন্ডগোল লেগে গেলো। পুলিশ সেই ব্যবস্থা নিয়েই এসেছে। গ্রামের মানুষদের আবার কলিজা এ। তাই বন্দুক তাক করে বলল, — আমাদের কাজ, আমাদের করতে দিন। তা না হলে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
গ্রামের মানুষ সরলো, তবে মহাজনের লোক সরলো না। পুলিশ আজিজের দিকে তাকিয়ে বলল, — এখন একদিকে ঝামেলা আছে, পুলিশের গায়ে হাত দিলে আরেক ঝামেলা হবে। এতো দিক সামাল দিতে পারবেন?
আজিজ আগুন চোখে তাকালো! তাকিয়ে বলল,
— দেখে নেবো আমি সবাইকে।
— তার জন্য আগে বাঁচতে হবে, মহাজন সাব। বিশ্বাস করেন, আপনার এই মহলের চেয়ে জেলে আপনি বেশি নিরাপদ। তাই দোয়া করেন, এমন কিছু মিরাক্কেল হোক, পাশার চাল উল্টে যায়। তা না হলে আপনি বাঁচতে পারবেন না।
আজিজ আর কথা বাড়ালো না। ইশারায় সব লোককে সরতে বললো। তারা সরতেই এক গ্রাম লোকের সামনে মহাজন পুলিশের জিপে উঠে বসল। ফাতিমা মরা বাড়ির মতো চিৎকার শুরু করলো। গ্রামের মহিলারা তাকে গিয়ে ধরলো। ধরলেও সবার চোখে মুখে বিস্ময়। যার গায়ে আজ পর্যন্ত কোন ফুলের দাগ পড়েনি, আজ সে আসামী হয়ে থানায় যাচ্ছে! তারা বিস্ময় নিয়েই মুখে আঁচল চাপলো। চেপে বলতে লাগলো, — পাপ লাগবো গো, পাপ। ফেরেশতার মতো মানুষ। এই পাপেই সব ধ্বংস হইবো।
তবে এতো মানুষের ভিড়ে আরেকজনও শান্ত চোখে প্রিয় বাবাকে দেখল। সে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। এতো লোকজন দেখে আর ভেতরে যায়নি। রাস্তার পাশেই চুপচাপ দাঁড়ালো। পুলিশের জিপ গাড়ি পাশ দিয়ে যেতেই আজিজ ছেলের দিকে তাকালো। তাকাতেই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,– দুইটা কুপুত্র জন্ম দিয়েছি আমি।
ফরহাদ হেসে ফেললো। অবশ্য এই হাসি তার বিষন্নতাকে আড়াল করতে পারে না। বরং আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
চলবে…..