#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৭
ঘড়ির কাটায় সময় কতো পৃথিলা জানে না। এই টিনের ঘরে টুকটাক জিনিসপত্র থাকলেও ঘড়ি নেই। তাই তখন এরশাদ চলে যাওয়ার পরেই লোকদুটো আস্তে করে ভেতরে যাওয়ার তাড়া দিলো। পৃথিলা আর বসে নি, চুপচাপ চলে এসেছে। এসে তো আর কিছু করার নেই। জুঁইকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দিতে দিতেই সাইডে মাথাটা রেখেছিল। কখন দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। সেই চোখের ঘুম ছুটলো দরজা খোলার শব্দে। এতো রাতে এই রুমে কে আসতে পারে, সে জানে। তাই তেমন ভাবান্তর হলো না, চোখও খুললো না। তবে বুঝতে পারলো, পায়ের কাছটা ঘেঁষে সে নিচে বসেছে। অনেকটা ঘেঁষেই, এই যে তার আঙুলে লোকটার বাহুর স্পর্শ লাগছে। অবশ্য বলতে গেলে খুবই অল্প।
তবুও পৃথিলা তখনই চোখ খুললো, খুলতেই থমকালো। হারিকেনের আলোটা মৃদু করে রাখা, সেই নিভু নিভু আলোতেও পৃথিলা দেখলো এরশাদের গায়ের সাদা শার্টটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে, শুধু কি শার্ট, মাথা, মুখ, হাত, এমন কি পুরো শরীর।
সে থমকেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল! পা সরিয়ে নিলো এরশাদের কাছ থেকে। সরিয়ে বলল ,— আবার কাকে খুন করেছেন?
এরশাদ খাটে মাথা রাখলো। যেখানে পৃথিলার পা দুটো ছিলো ঠিক সেখানে। সেখানে রেখে ঘাড় কাত করে পৃথিলার থমকানো মুখটার দিকে তাকালো। তাকিয়ে হাসলো, সুন্দর, নির্মল হাসি।
পৃথিলা সেই হাসিটুকু দেখলো অসহায় চোখে। ভয়ংকর মানুষের হাসি সব সময় ভয়ংকরই হয়। তারা যতোই ভালো মানুষের মুখোশ পরুক, তবে যখন হাসবে, তখন ভেতরের শয়তানটা ঠিক উঁকি দেবে। তবে সেই ভেতরের শয়তান কোন কারণে এই লোকটার হাসিকে ছুঁতে পারেনি। বরং যখন হাসে, তখন এই মানুষটাকে মনে হয়, ঐ যে মিঠাপুকুরে নদী, সেই নদীর স্বচ্ছ পানির মতো। যেই পানি দূর থেকে দেখলে মুগ্ধ হতে হয়, ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। তবে সে জানে, এই স্বচ্ছ পানির যতো গভীরে যাবে ততোই হারিয়ে যাবে। যেখান থেকে চাইলেই আর ফিরে আসা যায় না।
এরশাদ হেসেই, পৃথিলার ঘুম জড়ানো অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, — এইতো কিছুক্ষণ। তারপর আপনার মুক্তি, সারা জীবনের জন্য মুক্তি।
পৃথিলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ’ই তাকিয়ে রইল। কি হচ্ছে বা হতে পারে হয়ত বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বলল,– কাকে খুন করেছেন?
— আজিক কে।
— খুব কি দরকার ছিল?
— হ্যাঁ।
— কেন?
— কিছু কিছুর কেন’র কোন উত্তর নেই পৃথিলা।
— এখন?
— আপনার বাবা আসছে, আপনাকে নিতে।
পৃথিলা যেন আবারও থমকালো। আর থমকানো চোখ’দুটোতে এবার পানি টলমলো করতে লাগলো। তবে পৃথিলা গাল গড়িয়ে পড়তে দিলো না। সব সময়ের মতো ফিরিয়ে শান্ত, একেবারে শান্ত হয়ে গেলো।
এরশাদ না চোখ ফিরিয়েছে, না ঘাড় সোজা করেছে। তাই তাকিয়ে সবটাই দেখলো। দেখতে দেখতে বলল,— আপনার বুদ্ধি আমাকে সব সময়ই মুগ্ধ করে। এই যে লোহার তৈরি খাঁচায় আপনাকে আটকেছিলাম। তবুও মুক্ত হওয়ার রাস্তা ঠিক বের করে ফেলেছেন। যদি না ফেলতেন, এরশাদকে থামানোর সাধ্য কারো ছিল না। না আপনার বাবা, আমার কাজের মধ্যে টপকাতো, না কোন গন্ডগোল হতো।
— তো, এখন বুঝি তার জন্য শাস্তি দেবেন?
— আপনাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
— তাহলে, এখানে কেন? উচিত তো সরে যাওয়া।
এরশাদ হাসলো! হেসে ঘাড় সোজা করে বলল,— পারলে আমার ছোট চাচাকে ক্ষমা করে দেবেন, পৃথিলা। বাবা মানতে বলছি না, শুধু ক্ষমা! আমার চাচার মতো নিষ্পাপ মানুষ এই পৃথিবীতে কেউ নেই।
পৃথিলা উত্তর দিলো না, জানালার দিকে তাকালো। মেঘ কেটে গেছে। আকাশে সুন্দর একটা চাঁদ, ঐ যে প্রথম মিঠাপুকুরে এলো, সেই দিনের মতো।
এরশাদ সোজা হয়ে বসলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে, ঠোঁটের ভাঁজে রাখলো। রেখে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, — শেষ বার একটু কষ্ট করুন। আমি জানি এই সময়টা আমার জীবনে আর আসবে না। কখনো না, তাই নিজের মতোই একটু বসি।
পৃথিলা এবারও কিছু বললো না। এরশাদ নিজের মতোই সিগারেটে টান দিলো। ধোয়া ছেড়ে বলল, — একদিন আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমি আয়না দেখি কি না? আমি সত্যিই দেখি না। আমার পুরো রুমে কোনো আয়না নেই। আয়না তো দূর, কিছুই নেই। এতো বড় সারেং বাড়িতে আমি থাকি অন্ধকার একটা রুমে। যেই রুমে আলো আসে না, বিকেলের মিষ্টি বাতাস গায়ে লাগে না। চাঁদের জ্যোৎস্না আসে না। জানালা গলিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আঁকিবুঁকি করে না।
কেন করে না? আমি জানি আপনি জানেন। না জানার কিছু নেই, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। তবে পৃথিলা, আপনার জন্য আমি প্রথম স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্নে আমার রঙিন একটা ঘর, রঙিন জানালার পর্দা। সেই পর্দা কোমল, মৃদু বাতাসে ছন্দ তোলে। রোদ ঘরের আনাচে কানাচে আঁকি বুঁকি করে। আর একটা কাঠের কারুকাজ করা আয়না। যেই আয়না প্রতিদিন সকাল, বিকাল প্রতিচ্ছবি পড়বে দুটো সাদা-কালো মানুষের। একজন পাপের কালো দুনিয়ার, আরেকজন শুদ্ধ পবিত্রতার সাদায় মোড়ানো। আর কিছু না, বিশ্বাস করুন, আর কিছুই না। আপনার কাছে এরশাদের এইটুকুই চাওয়া ছিল।
তবে আমার ভাগ্যে আপনি নেই। যা নেই হাজার চেষ্টা করলেও ধরে রাখা যায় না। এই যে পারলাম আপনাকে? আমি আমার জীবনে কিছুই পাইনি পৃথিলা। আফসোস ছিল না কখনো, তবে আপনাকে পাওয়ার আক্ষেপ এই জীবন তো ভালোই মৃত্যুর পরেও হয়তো শেষ হবে না।
বলেই এরশাদ উঠল! পৃথিলার মুখের দিকে আর তাকালো না। তাকালে আবার ভেতরের শয়তান বলবে, দুনিয়া জাহান্নামে যাক, এই মেয়েকে নিয়ে দূরে চলে যা। অনেক অনেক দূরে। যেখানে কেউ চিনবে না, জানবে না। শুধু পৃথিলা আর সে। তাই সিগারেটে শেষ টানটুকু দিলো অন্য দিকে তাকিয়ে। যদি একবার একটু ফিরে তাকাতো, তাহলে দেখতো পৃথিলা এবার চোখের পানি ফেরায়নি, বরং গাল গড়িয়ে পড়েছে। আর পড়তেই চোখের পলকে মুছেও ফেলেছে।
শেষ টানটুকু দিয়ে এরশাদ ফিল্টারটুকু পায়ে পিষতে পিষতে বলল, — আসি। ভালো থাকবেন। অনেক অনেক ভালো। মিঠাপুকুরের এই দিনগুলো দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাবেন। বলেই এরশাদ আর দাঁড়ালো না। বেরুনোর জন্য দরজার দিকে এগুলো। তখনি পৃথিলা বলল, — পালাচ্ছেন?
এরশাদ ফিরলো না, তবে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে তার মতোই বলল,— না, ইটের ভাটায় যাচ্ছি। আপনার বাবাকে বলবেন, মিঠাপুকুর থেকে এরশাদ কখনও পালিয়ে যাবে না। আর না, কেউ এখান থেকে তার ইচ্ছের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে।
— তাই বুঝি সেখানে যাচ্ছেন? নিজের জ্বলন্ত চিতায়, নিজেকে জ্বালাতে?
এরশাদ এবার ফিরে তাকালো। কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো। যতোই বুদ্ধিমতি থাক, কারো মনোভাব এতোটা সঠিক বোঝার কথা না।
পৃথিলা এরশাদের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে আগের মতোই বলল, — মাথায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে, বুঝেছেন এরশাদ। হঠাৎ হঠাৎ করে কেউ ফিসফিস করে কানের পাশে কিছু বলে। ঐ যে আলাউদ্দিন ফকিরের মৃত্যুের পরে জ্বর হলো, তখন থেকে। এই যে আপনি যখন বেরোনোর জন্য পা বাড়ালেন, তখনি একজন কেউ বলল, — কিছুতেই যেন আপনাকে এই ঘরের চৌকাঠ পেরোতে না দেই।
এরশাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কোন কারণে বুকটা ভেঙে আসতে চাইল। পৃথিলা কি সুন্দর তার সমস্যার কথা বলছে, অথচ এই সমস্যা সৃষ্টিই করেছে সে। না মেয়েটাকে এতো মানসিক চাপ দিতো, না এমন পরিস্থিতি হতো। তাই ঢোক গিলে আস্তে করে বলল, — অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে এমন হচ্ছে। ঢাকায় তো ফিরে যাচ্ছেনই। ভালো দেখে একটা ডাক্তার দেখাবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
— হ্যাঁ, ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি। তবে আমি আপনাকে এই চৌকাঠ পেরোতে দেবো না।
— কেন?
— এমনিই! ঐ যে প্রথম দিন আপনার দাদির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর আয়নার সাথে হাসপাতালে গেলাম। আমার কাছে সব এমনিই এরশাদ। আমি এমনই। এতো লাভ লোকসানের হিসেব আমি করি না।
এরশাদ বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বলল, — আপনাকে একদিন না দেখলে আমার অস্থির লাগে, পৃথিলা। জেলে থাকা, শাস্তি হওয়া, বা ফাঁসি হওয়া। এই সবকে আমি ভয় পাই না। ভয় পাচ্ছি এই শাস্তি হতে হতে, আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় ছটফট করবো, সেই ছটফট কে। আমার পুরো জীবন ফটফট করতে করতে গেছে। এই কষ্ট আপনি জানেন না, আমি জানি। সেই কষ্ট দিয়ে যাওয়ার সাহস আর আমার নেই। তাই এই দয়াটুকু আমার প্রতি করুন, পৃথিলা। আপনাকে উপেক্ষা করে আমি বেরিয়ে যাব সেই ক্ষমতাও আমার নেই।
পৃথিলা উঠল! ঐ যে এরশাদের আনা জুতো জোড়া, সেটা প্রথমবার নিজের ইচ্ছায় পায়ে দিলো। দিয়ে এগিয়ে গেলো। দাঁড়ালো এরশাদের সামনে। আজ চোখের দিকে তাকালো না। প্রথমবার তাকালো, পুড়ে যাওয়া বাম পাশটার দিকে, এই বাম পাশটার মতোই এরশাদের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত। বুঝল অনেকটা দেরিতে। তবুও স্বপ্নের মতো গালে হাত রাখলো না। সেই পাশটার থেকে চোখ ফিরিয়ে চোখ রেখে বলল, — পাপ সবাই করতে পারে, তবে শাস্তি ভার নিজের কাঁধে নিজের ইচ্ছায় সবাই নিতে পারে না। আমি জানি, আপনি পারবেন। আমার জন্য হলেও পারবেন। এই পাপ থেকে মুক্তি আপনি পাবেন কি না, আমি জানি না। তবে প্রয়শ্চিত আমি আপনাকে অবশ্যই করাবো।
বলেই এগিয়ে বাইরে সেই সন্ধ্যার মতো বারান্দায় গিয়ে বসলো। বসতে বসতে বলল, — সত্যিই বড় ভুল সময়ে আমাদের দেখা হয়ে গেছে। দেবার মতো আমার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, এরশাদ। তবে এই যে অকারণে এই মেয়েটার জন্য মরলেন, তাই কথা দিলাম। এই ভারের ওজন আপনি যতোদিন ঘাড়ে রাখতে পারবেন, ততোদিন পৃথিলা আপনাকে ওই ছটফটের কষ্টের ভিতরে আর যেতে দেবে না। এই বাকি জীবনটা আমি আপনার নামে দিয়ে দিলাম।
এরশাদ আজ হাসলো না, তবে পৃথিলা যদি পেছন ফিরে তাকাতো। তাহলে ঠিক দেখতো, সেই স্বপ্নের মতো এরশাদের চোখ দুটো খুশিতে ঝিলমিল করছে। সে করার মাঝে টলমলো পানি। সেই পানি নিয়েই এরশাদ এগিয়ে পৃথিলা পাশে বসলো। বসে পৃথিলার মতো, ঐ যে আকাশের ঝিলমিল করা চাঁদ, সেই চাঁদের দিকে তাকালো। এরশাদের আর কি কিছু চাওয়ার আছে? না নেই, তার এই জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই।
এরশাদ আটক হলো, ফজরের আযানের কাছাকাছি সময়। জাফরের অবস্থা খারাপ, এতো রাতে ভ্যান পাওয়ার কথা না। শাহবাজ এখনো ফিরেনি। ইমরান দিশে না পেয়ে অফিসারকে ধরলো। অফিসার অবশ্য নিষেধ করলো না, তাই পুলিশের জিপে করে সদর হাসপাতালে নিতে নিতে কিছুটা দেরি হয়ে গেলো।
পৃথিলা সাবেতের সামনে শক্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এগিয়ে গিয়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সাহস তার হলো না। তবে সাবেত এগিয়ে এলো। এসে জড়িয়ে ধরলো। ধরতেই পৃথিলা ফুঁপিয়ে উঠল। সাবেত মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,— কাঁদছো কেন, বোকা মেয়ে। ভুল যদি তুমি করে থাকো, ভুল আমাদেরও ছিল। সন্তান হাজার ভুল করলেও, সন্তানের হাত ছেড়ে দিতে হয় না। তবে আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর দিয়েছিলাম বলেই, সব হারিয়ে আমাদের দরজায় টোকা দেওয়ার সাহস তোমার হয়নি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতার গ্লানিতে তোমার মা বিছানায় পড়ে গেছে। আর আমাদের এই গ্নানি মুছে ফেলতে, যাবেনা বাবার সাথে?
পৃথিলা বাবার বুকে মাথা রেখেই মাথা নাড়ালো। সাবেত পরম স্নেহে পৃথিলার মাথায় চুমু খেলো। খেয়ে পুলিশের জিপে বসা এরশাদের দিকে তাকালো। তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। এরশাদ এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সাবেতের চোয়াল শক্ত হলো। শক্ত করেই বলল,— জানোয়ারটা তোমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করেছে, পৃথিলা?
পৃথিলা থমকালো। তবে চোখ তুলে তাকালো না। বাবার বুকে মাথা রেখে বলল,— মানুষ কখনো জানোয়ার হয় না বাবা, আমরা তাদের বানিয়ে ফেলি। তুমি এই কাজটা করো না বাবা। তার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকুই শাস্তি দাও।
— তুমি আবারো কোন ভুল করছো না তো, মা?
— করলে আবার হাত ছেড়ে দেবে?
— না, এবার ছাড়বো না।
— তাহলে নিশ্চিন্তে থাকো, তোমার মেয়ে আর কোন ভুল করবে না।
ফরহাদ আর শাহবাজ যতক্ষণে থানায় পৌঁছেছে, ততক্ষণে জানা কথা যা হওয়ার, হয়েই গেছে। অফিসার কেউ ছিল না, কনস্টেবলরা কেউ এরশাদের কাছে এগুনোর সাহস পায়নি। সে বেরিয়ে গেছে নিজের মতো। তার কিছুক্ষণ পরেই শাহবাজ আর ফরহাদ পৌঁছেছে। আজিজের অবস্থায় শাহবাজের কোন ভাবান্তর হয়নি, তবে ফরহাদ স্তব্ধ হয়ে বাবার বীভৎস্য ক্ষতবিক্ষত লাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফরহাদ আর শাহবাজের বনিবনা কখনোই নেই। আজও হলো না। তবে শাহবাজ আজিজের লাশের দিকে তাকিয়ে বলল,— আমার ভাইয়ের দিকে আঙুল তোলা অনেক সহজ। সে ভয়ংকর, সে খুনি, সে খারাপ, সে অসহায় মানুষদের খুন করেছে। তবে নিজে যখন একই জায়গায় দাঁড়ানো হয়, তখন বোঝা যায় কেমন লাগে। এই যে, যেই দৃশ্য তুই দেখছিস, এই দৃশ্যও আমার ভাইও দেখেছে, বহু আগে। যখন স্বপ্ন বুননের সময় ছিল, তখন। তবুও তোর পাশে মা আছে, ভাই আসে, বুকে সন্তানা হিসেবে বাপের পাপের পাহাড় আছে । আমার ভাইয়ের কি ছিল? কিছু না। আমার বাপ-মা মরেছে, বিনা দোষে। জয়তুন আরার পাপ করেছে, শাস্তিটুকুও যদি তোর বাপ তার মধ্যেই রাখতো। তাহলে না আমার ভাইয়ের জীবনে ঐ কাল রাত আসতো , না আজ তোর জীবনে আসতো। এখন দেখি, আমার ভাইতো খারাপই, তুই নিশ্চয়’ই ভালো। এই দৃশ্যটুকু ভুলে দুটো টিকিট কাটতে পারিস কি না?
বলেই শাহবাজ বেরিয়ে এলো। তাদের লোক জাফরের ব্যাপারে বললো, বলতেই সদর হাসপাতালের দিকে ছুটে গেলো। পুরো সারেং বাড়ির দায়িত্ব যে এখন তার ঘাড়ে, কি করবে, দিশে পায় না।
সকাল হতেই আজিজের মৃত্যুর খবর পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। ছড়িয়ে পড়লো এরশাদের খবর, জয়তুন আরার খবর, সারেং বাড়ির খবর, তাদের প্রিয় মহাজনের খবর। সেই খবরেই গ্রামের মানুষ থমকালো। সেই থমকানোর মাঝে ঘি ঢাললো চেয়ারম্যান। তার পাপের তো আর কোন প্রমাণ নেই। মহাজন শেষ, সারেং বাড়ির রক্ষা কবজ শেষ। ইটের ভাটাসহ আশে পাশের জায়গা জমি সব তার। তাই ঘি মসলা মাখিয়ে গ্রামের মানুষদের ফুঁসাতে লাগলো। এতো এতো মানুষ খুন, এতো এতো অত্যাচার করে এমনিই বেঁচে যাবে?
গ্রামের মানুষ অনায়াসেই ফুঁসলো। সিদেসাধা মানুষ তারা। তাই তাদের মাথায় একটা জিনিসই ঢুকলো। আজ এদের ছেড়ে দিলে, আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেনা সেই গ্যারান্টি কি? তাছাড়া আজ এমনি ছেড়ে দিলে আবার এই বাড়ি না হলেও অন্য কেউ উঠবে, গ্রামের গরীব মানুষদের উপর অত্যাচার করবে। তাই তাদের এমনি ছেড়ে দেওয়া যাবে না। শাস্তি দেবে, এমন এক শাস্তি যেন যুগ যুগ ধরে সবাই মনে রাখে। আর হলোও তাই, মশাল জ্বালিয়ে সবাই সারেং বাড়ির দিকে এগুলো। সবাইকে জ্বালিয়ে মেরেছে, তাদেরও মারবে।
সেই এগুনোর খবর হাসপাতাল থেকে শাহবাজ শুনলো। শুনে তার কলিজা খাবলে উঠল। আম্বিয়া চাচার সঙ্গে এসেছে। বাসায় বীণা, দাদি আর সবচেয়ে বড় কথা, আয়নাকে ঘরে সে নিজে তালা দিয়ে এসেছে। সে দিক বেদিক হয়ে ছুটলো। আজ বুঝল, ভাই তাদের কতোটা আগলে রেখেছে।
শুনলো পৃথিলাও। সে বসে আছে থানার আরেক রুমে। সাবেত একেবারে আসামি নিয়েই ফিরবে। তাই সেই ভাবেই সব ব্যবস্থা করছে। সে করার মাঝেই একজন এসে এই খবর বলল। পৃথিলা এরশাদের কান পর্যন্ত এই খবর যেতে দিলো না। তবে বাবার হাত ধরে কাতর স্বরে বলল,— তাদের বাঁচাও বাবা, দয়া করে তাদের বাঁচাও।
সাবেত মেয়ের কথা শুনলো। শুনেই সব ব্যবস্থা নিয়ে বেরুলো। তবে এমন গ্রামে চাইলেই কি দৌড়ে বাঁচানো যায়? তবুও আঁকা বাঁকা রাস্তায় জিপ ছুটিয়ে গেলো। গেলেই কি? পুলিশ শাহবাজ যখন পৌঁছালো, বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আগুনের ফুলকি ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে । পুলিশ সবাইকে ধমকে লাঠিপেটা করে সরালো। আর শাহবাজ সেই আগুনের মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়লো। বীণা আয়নাকে কিভাবে বের করলো, তার খেয়ালও নেই। তাদের বের করেই দাদির দরজার কাছে গেলো। গিয়েই দেখলো, ভেতর থেকে বন্ধ। সেই বন্ধ দরজায় শাহবাজ থাবা মারতে মারতে চেঁচিয়ে বলল,— দরজা খুলো, দাদি, দরজা খুলো।
জয়তুন দরজা খুলে নি। শাহবাজ পাগলের মতো দরজা ভাঙার চেষ্টা করলো। সারেং বাড়ির কাঠের দরজা। এতো সহজেই বুঝি ভাঙে। আগুন পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে গেলো। পুলিশের লোক শাহবাজকে শেষ সময়ে টেনে বের করলো। করলেও তাকে ধরে রাখা মুশকিল। সে পাগলের মতো ছুটাছুটি করলো,চেঁচালো। তার চিৎকারে সারেং বাড়ির উঠানের প্রত্যেকটা মানুষ থমকে গেলো, থমকে গেলো আগুন দেওয়া মানুষগুলোও। সেই থমকে যাওয়া মানুষগুলোর চোখের সামনেই বিশাল সারেং বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। সেই সঙ্গে জ্বললো সারেং বাড়ির মাথা জয়তুন আরাও।
চলবে…….