ধূপছায়া পর্ব-৫৮ এবং শেষ পর্ব

0
5

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৮ ( শেষ পর্ব)

সালটা ১৯৯৭, মাস আষাঢ়, শুক্রবার। টানা কিছুদিন হচ্ছে বৃষ্টি। আষাঢ় মাসের সাত কন্যার বৃষ্টি। পড়ছে তো পড়ছেই। সেই পড়া আজকে এসে, এই একটু থেমেছে। শুধুই থেমেছে, তবে আকাশ অন্ধকার। একটু জিরিয়ে যে আবার নতুন উদ্যমে শুরু হবে, তাতে কোন ভুল নেই।

আর এই সাত কন্যার অবিরাম বৃষ্টিতে মিঠাপুকুর যেন কচি কলাপাতার মতো চিকচিক করছে। সবুজ গাছগুলোর মধ্যে কোমল সতেজ একটা ভাব। বাতাসে শীতল আদর। সেই আদর একটু গায়ে লাগলেই যেন নব বধুর মতো হালকা কেঁপে উঠতে হয়।

তবে উঠান, বাড়ি, ঘর কাদায় মাখামাখি। হাঁটতে গেলেই টেনে জাপটে পা মাখামাখি করে দেয় । সেই মাখামাখি পেরিয়ে সবুজ কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে মিঠাপুকুরের রাস্তা পর্যন্ত এলো।

স্টেশন থেকে সোজা বাড়িতে এসেছিল। ভেবেছে মামা ফিরেছে। তবে এসে দেখে এখনো খবর নেই। তবে কোথায় থাকতে পারে জানে। তাই আবার কাদা পানি পেরিয়ে বহুত কষ্টে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। এসেই হাঁফ ছাড়ল। ইট বিছানো সুন্দর আঁকা বাঁকা রাস্তা। বৃষ্টিতে কাদা পানি ধুয়ে আরো সুন্দর হয়ে আছে।

আর এই সুন্দর ইট বিছানো রাস্তা বছর তিনেক হলো মামা নিজে উদ্যােগে করার ব্যবস্থা করেছে। শুধু কি ইট বিছানো, না। স্কুল হোক, মসজিদ হোক, হাসপাতাল হোক, এই মিঠাপুকুর সহ আশপাশ গ্রামের সব মানুষ গত সাত বছরে যেই উপকার পেয়েছে, আগের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তার ছিটেফোঁটাও পায়নি। শুধু পেয়েছে মুখের মিষ্টি কথা, আর পিঠ পিছে ধাক্কা।

সেই ধাক্কার অবসান হয়েছে, এই বছর আট আগে। হঠাৎ করেই গালে, মুখে মারের দাগ নিয়ে চেয়ারম্যান গিন্নি থানায় গিয়ে হাজির। গিয়েই তিনি স্বামীর নামে নারী নির্যাতনের মামলা করলেন। সঙ্গে এও জবানবন্দি দিলেন। তাদের গ্রামে যতো ডাকাতি, অপকর্ম হয়েছে, সব কিছুর পেছনে চেয়ারম্যানের হাত ছিল। সারেং বাড়িতে যেটা হয়েছিল আজিজের সঙ্গে, সেও ছিল। আর আয়নার বাবা, মা কথাও বললেন। আরও বললেন, তার কথা বিশ্বাস না হলে তাদের বাড়ির চৌচালা ঘরের পেছনে খুঁড়ে দেখতে পারেন।

তখন সবে মাত্র নতুন এক অফিসার এসেছেন। আগের জন বদলি হয়েছে। তাই নতুন অফিসার আগা মাথা কিছু না বুঝলেও, সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিলেন। চেয়ারম্যান গিন্নি মিথ্যা বলেননি। প্রমাণ হাতে নাতেই পেল। তবে চেয়ারম্যান পালালো। তার পরেই তো মিঠাপুকুরে নতুন চেয়ারম্যান এলো। সেই চেয়ারম্যানের নাম ফরহাদ, আবদুল ফরহাদ। যিনি সম্পর্কে তার দূরসম্পর্কের মামা। এই মামাই বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান পার্থী হিসেবে জয়ী হলো। শুধু কি সেবার? এই যে এবারের নির্বাচনেও তো হলো। পর পর দু’বছরের চেয়ারম্যান। তাও আবার বিপুল ভোটে। অবশ্য এক হিসেবে বলতে গেলে তাকে টক্কর দেওয়ার মতো আর যোগ্য পার্থী কই?

তবে সবাই ভেবেছিল চেয়ারম্যানের ছেলে দাঁড়াবে। বাপের তো ছিল ডান হাত। তবে তাদের বাড়ি থেকে কেউই আর এগোয়নি। তখনও না, এবারও না। আশ্চর্যের ঘটনাই বটে। আরো আশ্চর্যের ঘটনা ঘটল তারও কিছুদিন পরে। মামা তখন নতুন চেয়ারম্যান। সিলেটের এক গ্রাম থেকে আগের চেয়ারম্যান আটক হলো। কিভাবে হলো, খোঁজ কিভাবে পেলো কে জানে? তবে মিঠাপুকুরে কান পাতলে অনেক কিছুই ফিসফাস শোনা যায়। এই সব নাকি মামার কাজ। চেয়ারম্যান ধরিয়ে পথের কাটা সরিয়েছেন। তবে সামনে বলার সাহস কারোর’ই নেই।

মহাজন যেমনই ছিলেন। গ্রামের মানুষের সাথে তার শত্রুতা ছিল না। সব সময় কথা বলতেন মিষ্টি সুরে, মানুষের সাথে আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। তবে তার ছাওয়াল, তার সামনে কথা বলতেও গ্রামের মানুষ দশবার ভাবে। না, সে অত্যাচারী না, বরং নিজের পকেটের টাকা ঢেলে মানুষের উপকার করে। তবে রাগটা যেন নাকের ডগায় থাকে। একবার তো এক মজলিশে চড় মেরে এক চোরের দাঁত ফেলে দিয়েছিল। গাছের চিপায় কয়েকজন ছেলে নেশার জিনিস নিয়ে বসেছিল, দেখে এক লাথিতে একটার চাপা খুলে ফেলেছিল। গ্রামের মানুষ তাকে ভয় পায়, তবে বিনা কারণে, অন্যায় বা অন্য কোন আতঙ্কে না। বরং ভালোবাসায় ভয় পায়। পায় বলেই এক ডাকে জয়ী হয়েছে।

সবুজের বয়স এবার একুশ। কলেজে পড়ছে। তার বাবা নেই, নানি মানে ফরহাদ মামার মা কলপারে পা পিছলে পড়ল। পড়ল তো পড়ল, সেই পড়ায় কুপোকাত। মামাদের বাড়িতে মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। মামা আর নানি। বড় মামা থাকে শহরে, বছরে একবার কি, দু’বার বউ ছেলে পেলে নিয়ে আসে। আগে অনেক কাজের লোক থাকলেও এখন কোন রকম একটা। না টাকা পয়সার সমস্যা না। মামা মানুষজন দেখতে পারে না। তার সব কাজ আড়তে। বাড়ি একেবারে শ্বাশান। সেই শ্বাশানও কাত চিত হলো নানির কুপোকাতে। তখন মামা তাকে সহ মাকে নিয়ে এলেন। মা সামলে নিলেন বাড়ি আর সে পড়া লেখার পাশাপাশি লেগে গেল মামার সাথে।

আবার গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। সবুজ এবার দৌড় দিল। তার গন্তব্য মিঠাপুকুরের কবরস্থান। নানি মারা গেছেন, মাস দুই হলো। প্রতিদিন যোহরের নামাজ পড়ে মামা বাবা মায়ের কবর জিয়ারতে যান। আজও যে গিয়েছে তাতে ভুল নেই। তাই দৌড়ে যেতে যেতে একটু থামলো। থেমেছে জুঁইয়ের বাড়ির সামনে। গেটটা আজকে খোলা, তাই একটু উঁকিঝুঁকি মারলো। তবে পুরো বাড়ি শুনশান। ভর দুপুর, খেয়ে দেয়ে মিচকা শয়তানি মনে হয় আরামে ঘুমাচ্ছে। তাই চলে যেতে যেতে একবার সাইডে তাকালো।

মেঘের ঘোলা ঘোলা ঘুম জড়ানো অন্ধকারে ভাঙাচোড়া, পোড়া ধ্বংসস্তুপ হয়ে বিশাল বাড়িটা কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ভাঙা চোড়া, পোড়া ইটের দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। তার মধ্যে গাছগাছালি, লতাপাতায় পুরো মাখিয়ে আছে। দেখেই গা ছমছম করে। অবশ্য ছমছম করার আরেকটা কারণ আছে। সবাই বলে এই বাড়িতে ভূত আছে। এক বুড়ির ভূত। রাতের বেলা এই রাস্তায় আসতে যেতে নাকি অনেকেই দেখেছে। সাদা ধবধবে চুলের এক বুড়ি, সাদা থান গায়ে নাকি ঐ যে ভাঙা চোড়া দেয়ালের মধ্যে একটি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকে। অবশ্য সত্য না মিথ্যা কেউই জানে না। এই যে এই বাড়ির পাশে জুঁই রা থাকছে, অবশ্যই উঁচু প্রাচীর তুলে এই বাড়ি থেকে আলাদা হয়েছে গেছে। তবুও তাদের কি কিছু হয়েছে? না হয়নি। তাও এক মুখ থেকে আরেক মুখে ছড়িয়ে পড়েছে তো পড়েছে। তাই আগেও যেমন সারেং বাড়ি আতঙ্ক ছিল, এখনো আছে। আছে বলেই এই বাড়ির সীমানায় ভয়ে কেউ পা মাড়ায় না।

সবুজ অবশ্য সব শুনেছে মায়ের কাছ থেকে। আর এও শুনেছে এটা তার মামার শ্বশুর বাড়ি। অনেক ধুমধাম করে মামার বিয়ে হয়েছিল। তবে বউ তোলা হয়নি। সেই বউ এখন কোথায় কেউ জানে না। সেই ঘটনার পরেই তারা নিজে থেকেই নাকি এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ইটের ভাটা সহ অনেক খেতটেতও নাকি বিক্রি করে ফেলেছে। তবে এই বাড়িটা আগের মতোই আছে।

নানার হত্যার পরে নানি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। কাউকে চেনে, কাউকে চেনে না। বড় ছেলের নামও শুনতে পারে না। আর মামা? সে তো চোখের বিষ। দিনরাত বকাবাজি, গালাগালি। কাছে গেলেই চড়, থাপ্পড় মারেন। স্বামীর সোহাগী ছিলেন, সেই স্বামীর এমন হত্যা মেনে নিতে পারেননি, আরও পারেননি ছেলেদের এমন নিলিপ্ততা। কেমন কু সন্তান সে জন্ম দিয়েছে। বাপের হত্যা বিচার চাইছে না।

মামা কিছুই বলতেন না, ধৈর্য্য ধরে মায়ের যত্ন নিতেন, আগলে রাখতেন। মা ছাড়া তো আর কেউ নেই। তাই সব করতেন অনেক যত্ন নিয়ে। সারা দুনিয়ার রাগ, জেদ নাকের ডগায় থাকলেও, মায়ের সামনে নেই।

সেই মা ধীরে ধীরে ঠিক হলেন। বকাবাজি কমলো, কমলো পাগলের মতো আচরণ, তবে ছেলের বিয়ে মানতে পারলেন না। তাই হাত মাথায় নিয়ে বললেন, — তোর বাপের খুনির বোনেরে যদি খুঁজতে যাস, সংসার করিস, আমার মরা মুখ দেখবি।

মামা আর কাউকে খোঁজার চেষ্টা করেননি। তবে তাকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য নানি রাজি করাতেও পারেননি। তবে নানি যখন কলপারে পড়ে বিছানায় পড়লেন, তখন তিনি পুরোপুরি বদলে গেলেন। ফিরে এলেন সেই গ্রামের মানুষের সিধেসাদা ফাতিমা। যে মানুষের বিপদে আপদে কখনোও খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। আর ফিরেই তিনি ছেলের হাত ধরে বললেন, — তোর বাবা তোকে লাশ বানিয়েছে, আর আমি সেই লাশ জাহান্নামের আগুনে ভাজা ভাজা করেছি। মাফ করে দিস, বাপজান। আমার কসম আমি ফিরিয়ে নিলাম। যা, এবার নিজের মতো বাঁচ।

মামার কোন ভাবান্তর হয়নি। কাউকে আর খোঁজার চেষ্টাও করেনি। ততদিনে যে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। নানি বুঝেনি, তবে সবুজ জানে। আর এও জানে, ঐ যে বাড়ির বসার ঘরে সাদা কালো টিভি। যেটা মামা শহর থেকে বছর দুই এক আগে নিয়ে এসেছে। খুব কসরত করে এন্টেনা লাগিয়েছে। সেটা কাটায় কাটায় ঘড়ি ঠিক রাত আটটার ঘরে গেলেই মামা সব কাজ ফেলে এই টিভির সামনে বসে। কোন খবর শুনে বলে মনেও হয় না। ব্যস, এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে।

যেখানে পরিপাটি গোছানো শাড়িতে, চোখে টানা কাজলে, মাথায় বড় একটা খোঁপা নিয়ে মায়াবি চেহারায় একটি মেয়ে সুন্দর হেসে মার্জিতভাবে বলে, — শুভ রাত্রি। আমি সুলতানা বীণা। আপনাদের সঙ্গে আজকের প্রধান সংবাদগুলো নিয়ে উপস্থিত হয়েছি। প্রথমেই বলছি, দেশের শীর্ষ সংবাদগুলোর শিরোনাম।

মেয়েটি কে সবুজ জানে। না জানার কিছু নেই। মামার রুমে ফ্রেমে বাঁধানো হলুদ শাড়ি, কাঁচা ফুলের গহনার গায়ের টলমলো চোখের একটি বধুর ছবি আছে। আর সেই মেয়েটি, এই মেয়ে। যে কিনা তার প্রিয় মামার তুলে না আনা বউ।

ফরহাদ কবরস্থান থেকেই বের হয়ে দেখল সবুজ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। কয়েকদিন টানা বৃষ্টি, গরম নেই বললেই চলে। তবুও সে নেয়ে ঘেমে একাকার।

ফরহাদের বিরক্তে কপাল, চোখ, মুখ কুঁচকে গেল। না নেয়ে ঘেমে একাকার হয়ে আসার জন্য না। কুঁচকে যাওয়ার কারণ, নামাজের পরে ইমরান এই ছেলের নামে নালিশ জানিয়েছে। জুঁই স্কুলে যায়, এই বাদর নাকি পেছন পেছন যায়। না, বিরক্ত করে না, তবুও বিরক্ত করার আগেই জানিয়ে রাখলো। তাছাড়া গ্রামের মানুষ দেখলে ভাববে কি?

তাই কাছে আসতেই গাল বরাবর দিল এক চড়। সবুজ হতম্ভভ হয়ে গালে হাত রাখল। রেখে বলল,– যাক বাবা, করলাম টা কি?

— জুঁইয়ের পেছনে কি?

সবুজের কলজে খাবলে উঠল। এই মিচকে শয়তানি তো বাবার কানে ঠিক লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ কিছুই করেনি। একটু ভালো লাগে, তাই পেছন পেছন যায়। সে গালের হাত নামিয়ে মাথা নিচু করল।

ফরহাদ দেখে এগুতে এগুতে বলল, — লেখা পড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়া। তারপর যা করার আমি করব। সেই পর্যন্ত আর কোনো কাহিনী যেন কানে না আসে।

সবুজ মাথা নিচু করেই ঠোঁট টিপে হাসল। হেসে মামার পেছন পেছন যেতেই ফরহাদ বলল, — এমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলি কেন?

সবুজ মনে পড়ার মতো চমকে উঠল। আরে বাপ, এক চড়েই মাথা থেকে সব বের হয়ে গেছে। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি কিছু বের করেই বলল, — নাও।

— কি? বলেই ফরহাদ কিছুটা ফিরে তাকাল। দুটো ট্রেনের টিকিট। সে ভ্রু কুঁচকে বলল, — টিকিট দিয়ে আমি কি করব?

— আমি কি জানি? বলেই হাতে ধরিয়ে দিল। দিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনি হন্তদন্ত হয়ে সামনে এগিয়ে গেল। ফরহাদের কুঁচানো মুখ আরো কুঁচালো। তবে আগা মাথা মাথায় এলো না। তাই বিরক্ত নিয়ে টিকিট দুটো ছুঁড়ে ফেলবে তখনই থমকালো। থমকে বিস্ময় চোখে টিকিট দুটির দিকে তাকালো।

সবুজ অনেকটা দূরে চলে গেছে। সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, — খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে? তাড়াতাড়ি স্টেশনে যাও। ট্রেন কিন্তু মিঠাপুকুরের স্টেশনে বেশিক্ষণ থাকে না।

ফরহাদ টিকিট দুটো হাতের মুঠোয়, মুঠো করেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তার ভেতর টা কাঁপছে। সেই কাঁপন নিয়েই যখন স্টেশনে পৌঁছালো, ট্রেন চলে গেছে। যাওয়ারই কথা। এই স্টেশনে ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। মিঠাপুকুরে ইট বিছানো রাস্তায় এখন তিন চাকার টুনটাং রিকশা চললেও, এই মেঘমেদুর দিনে পাওয়া যাওয়ার কথা না। তাই আগে বাড়ি গেলো। এখানে ওখানে দৌড়ানোর জন্য মোটরসাইকেল কিনেছে সে। সেটাই নিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে, শব্দ তুলে উড়ে এলো। আসলেও, আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। পুরো স্টেশন ফাঁকা। দু’একজন ছাড়া কাউকে চোখে পড়লো না।

ফরহাদ বড় এক শ্বাস ফেলে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই, ঐ যে প্রতিদিন রাতে সাদা কালো টিভির পর্দায় যেই মুখ, কণ্ঠটা শোনার জন্য বসে, সেই মিষ্টি কণ্ঠে বলল, — চা খাবেন ফরহাদ ভাই?

ফরহাদ পেছনে ফিরে তাকালো। ভেতরে কোনার সাইডে ছোট্ট চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে জলছাপার ফিরোজা রঙের শাড়িতে এক মায়াবি মেয়ে বসে আছে। চুলগুলো পিঠময় ছাড়া। হাতে চায়ের ছোট্ট কাচের গ্লাস। গরম চা ফুঁ দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে।

ফরহাদ এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। ছোট চিকন কাঠের বেঞ্চ। বীণা স্বাভাবিক ভাবেই চেপে বলল,— বসুন। নাকি চেয়ারম্যান মানুষ আবার এই ছোট্ট দোকান টোকানে বসে না?

ফরহাদ বসলো। বসতেই হালকা মিষ্টি একটা সুবাস নাকে লাগলো। মিঠাপুকুরে বীণার কোন ছায়া এই মেয়ের মাঝে নেই। এই বীণা এখন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, উচ্চ শিক্ষিত, ভালো নামকরা চাকরি করে। এই যে সিনেমার নায়িকাদের মতো কানে পাথরের দুলগুলো কি সুন্দর ঝিলমিল করছে। ঠোঁটে হালকা রঙের ছোঁয়া, চোখে গাঢ় টানা কাজল।

ফরহাদ বসেই বলল, — চেয়ারম্যান কোথায় বসে না বসে সেটা নিয়ে তোর মাথা ব্যথা কি? ডেকেছিস তো ফরহাদ ভাইকে।

— একদম ঠিক।

— তাহলে অযথা বললি কেন?

— আপনার সাথে সব কথার কারণ থাকতে হবে বুঝি?

— হ্যাঁ! কারণ ছাড়া কথা হয় কাছের মানুষদের মাঝে।

— ভাইয়ের বন্ধু, চাচার ভাতিজা, স্কুলের, বাসার শিক্ষক আর কতো কাছের মানুষ হতে চান?

— যেটা বলিস নি সেটা।

— কি বলিনি?

— তুই’ই ভালো জানিস।

— আমি তো জানি না।

— না, জানলে নেই।

বীণা হেসে ফেললো! হেসে বলল,– একটুও বাদলানি! বয়স বাড়ে মানুষ বদলায়। আপনি তো দেখা যায় সেই আগের অবস্থান’ই আছেন। ভাগ্যিস হাতে কাছে কিছু নেই। ঠিক মাথার মধ্যে কয়েকটা ফেলতেন।

— এতো ঢং আমার আসে না।

— আচ্ছা, তাহলে বিয়ে করেননি কেন?

— কোথায় করলাম না, ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরো গ্রামের মানুষ খাওয়ালাম, সেটা কি?

— সেটাকে বিয়ে বলে?

— আমি তো বলি।

— তাহলে খোঁজ জানা সত্বেও আনতে জাননি কেন?

— কোথায় খোঁজ জানলাম?

— টিভি নেই?

— আছে।

— তাহলে?

— সেটাতো অনেক পরে।

— তবুও

— এই টিভির মেয়েকে আনতে যাওয়ার সাহস হয়নি।

— আপনারও সাহসের অভাব হয়?

— আগে হয়নি, তবে সদরে একদিন টিভিতে এক মেয়েকে দেখলাম। দেখার পরে বুঝলাম। এই মেয়ের দিকে এখন হাত বাড়াতে গেলে দূর্সাহস হয়ে যাবে।

— গিয়ে তো দেখতেন।

— আমার তো যাওয়ার কথা ছিল না। ছিল তোর আসার।

— টিকেট কেটেছিলেন?

— মনে মনে প্রতিদিন হাজার বার কাটি। তুই এসে খোঁজ নিসনি। এমন ভাবে হারিয়েছিস যেন আমিও খুঁজে না পাই।

— তখন সময় ঠিক ছিল না। না আপনার জন্য, না আমার।

— জানি।

বীণা আর কিছু বললো না। বাকি চা টুকু নিশ্চুপ শেষ করলো। ফরহাদ অপলক তাকিয়ে দেখলো। তার দেখার মাঝেই কাপ রেখে বীণা উঠে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে বলল, — আগেই বলে রাখলাম, রেঁধে বেড়ে খাওয়া, বউ আমি হতে পারব না। চাকরিও ছাড়বো না।

বীণার পাশে তার স্যুটকেস। ফরহাদ হাতে তুলে নিতে নিতে বলল, — ফরহাদের বউ হলেই চলবে।

— একদম মেজাজা টেজাজ চলবে না।

ফরহাদ হাসল। হেসে বলল, — এটার গ্যারান্টি দিতে পারছি না। তবে বড় তো কম হসনি। আদরে সামলে নিবি।

বীণা অবাক হয়ে বলল, — বাবারে, বুইড়া কালে ভিমরতি।

— বউ যদি বুইড়া কালে আসে, ভিমরতি তো বুইড়াকালেই দেখাতে হবে, নাকি?

বীণা মুখ বাঁকালো। তবে এবারো কিছু বললো না। ফরহাদ এক ভ্যান ডেকে স্যুটকেস তুলে দিল। দিয়ে মোটরসাইকেলের কাছে যেতে যেতে বলল, — বাড়ির সবাই ঠিক আছে?

বীণা বড় একটা শ্বাস ফেলল। ভাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। থানার ভেতরে হত্যাকাণ্ড, ফাঁসির রায়ই হতো। তবে ফরহাদ ভাইদের পক্ষে কেউ হাজির হয়নি। ভাই সব দোষ নিজে স্বীকার করেছে। অপরাধের পরিস্থিতি, আগের বয়স, মানসিক অবস্থা সব বিবেচনায় আদালত মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছে। অবশ্য এখানে টাকার খেলা ও আছে। ছোট ভাই নিশ্চয়ই তার ভাইকে এতো সহজে ফাঁসি হতে দেবে না। আরো কিছুও করতে পারতো, তবে এখানে পৃথিলার আপার বাবা আছে। তিনি কোন বাড়াবাড়ি করেননি, অবশ্য সব পৃথিলা আপার জন্যই হয়েছে। তবে আপোসও করেন নি।

ফরহাদ বীণার মলিন মুখটা দেখলো। এরশাদের কথা সেও জানে। তবে কখনোও আর মুখোমুখি হয়নি। সব দেয়াল চাইলেই ভাঙা যায় না। তাই বাইকে উঠতে উঠতে বলল, — শাহবাজ, আয়নামতি, ছোট চাচা ভালো আছে?

বীণা এবার হাসল। হেসে নিজেও বাইকে বসল। বসে বলল, — কাঁধে হাত রাখবো, নাকি আবার রাখলে ধাক্কা টাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলবেন?

ফরহাদ উত্তর দিল না। স্টার্ট দিয়ে একটান দিল। বীণা হুমড়ি খেয়ে ফরহাদের গায়ের উপরে পড়ল। আর পড়তেই কাঁধ চেপে ধরল। ধরে বলল,– ভালো হলেন না?

— সবার ভালো হতে নেই।
— চেয়ারম্যান চাচার কান্ডে আপনার হাত ছিল?

ফরহাদ উত্তর দিল না। তখন সব কিছু এমন এলোমেলো ছিল। বাড়তি ঝামেলা পৃথিলা তখন চায়নি। তাই পরে চিঠিতে তাকে সব বলেছিল। তাই শাস্তি তো একটা হতোই।

ফরহাদ উত্তর না দিলেও, মোটরসাইকেল আরো জোড়ে টান দিলো। বীণা না পেরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আর ফরহাদ অনেক দিন পরে একটু মুচকি হাসলো।

…….

জাফরের মাত্রই চোখটা লেগে এসেছিল। তখনি বিকট শব্দ হলো। বয়স হয়েছে, খেয়ে দেয়ে একটু গা ছেড়ে বসলেই চোখ লেগে যায়। তাই শব্দ কানে যেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। আর উঠে কিসের শব্দ না বুঝলেও, এটা ঠিক বুঝলো, শব্দের উৎসকারী কে? আর এও জানে, দৌড়ে এখন কার কাছে আসবে।

হলোও তাই, দৌড়ে প্রায় খাটে ঝড় তুফান তুলে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার মাথার কাছে গুঁজে বসতে বসতে বলল,– দাদা, বাঁচাও।

জাফর নিজে সোজা হয়ে বসলো। বসে বলল — আবার কি করেছিস?

— নাড়ু পারতে গিয়ে আচারের বোয়াম সব ফেলে দিয়েছি।

জাফর ভ্রু কুঁচকে বলল,– শুধু এটাই?

আবির দু’পাশে মাথা নাড়লো। জাফর দেখে বলল,– আর?

— টিভির তার কেটে ফেলেছি।

জাফর আফসোসের সুরে মাথা নেড়ে বললো, — পাছার চামড়া আর আজকে থাকবে নারে।

আবির ভয়ে ঢোক গিললো। কথা সত্য। তার বাপ একটা জাদরের বাপ। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই উল্টো করে পাছার মধ্যে পটাশ পটাশ করে বাজি ফুটান। বাজি ফুটাতে ফুটাতে তার পাছায় দাগ বসে গেছে। সেই দাগে তার আদরের মা মালিশ করেন আর কেঁদে কেঁদে গাল ভাসান। অবশ্য ভাসিয়েও তেমন লাভ হয় না। সে তার মতো আকাম করে, তার বাপ তার মতো পটাশ পটাশ বাজি ফুটায়।

জাফর আবিরের ভয় মাখা মুখটা দেখে হাসলো। বয়স এবার ছয়। বাপের ডুপ্লিকেট। মায়ের হাড্ডি জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আজ এর থেকে নালিশ, কাল ওর থেকে নালিশ। আয়নার অবশ্য ছেলে জান প্রাণ। সে ছেলের গায়ে ফুলের টোকাও দেয় না। আর শাহবাজ, তার কোন মার আর বাঁকি নেই। তবে এই ছেলে তো জানে না, মার খেয়ে দাদার কাঁথার নিচে যখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়, তখন তার জাদরের বাপই এসেই আবার আদর করে কোলে তুলে রুমে নিয়ে যায়।

তাই হেসেই বলল,— মাকে, আম্বিয়াফুপুকে বলে দিচ্ছি। তোর বাপের কানে যেন কথা না দেয়।

আবির আবারো ঢোক গিলে বলল,– তারা এমনিও বলবে না, দাদা। তবে পাশের বাড়ির টিটুর ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছি। বাবা আসলেই ঠিক নালিশ দেবে।

জাফর অবাক হয়ে বললো,– কি করেছিস?

— ঘুষি মেরেছি।

— কেন?

— ভেংচি কাটলো।

— ভেংচি কাটলে তোর মুখ কি হয়েছে?

— কিছুই হয়নি।

— না হলে মুখ রেখে হাত ব্যবহার করেছিস কেন?

— ইট মারলে পাটকেল দিতে হয় জানো না?

— আমার জেনে আর কাজ কি? তবে আজকে তোর চামড়া সত্যিই কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আবিরের এবার ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। জাফর দেখে বলল, — চুপচাপ কাঁথার নিচে ঢুকে যা। তোর বাপ আসলো বলে।

আবির সময় নষ্ট করলো না। টুপ করে কাঁথা টেনে দাদার বুকের ভেতরে ঢুকে গেলো। নিশ্বাসের সমস্যা তার হয় না। পলাতে পলাতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই মাথা ঢেকে দাদার বুকের সাথে লেগে রইল।

জাফর আগের মতোই হাসলো। হেসে সে নিজেও শরীর এলিয়ে দিলো। সে ভালো করেই জানে, দাদা নাতি এখন দুজনেই টুপ করে ঘুমিয়ে যাবে।

শাহবাজ কারখানা থেকে ফিরলো কিছুক্ষণ পরেই। তার নিজের কারখানা। একটা সিলভারের, আরেকটা প্লাস্টিকের। প্লাস্টিকের হরেক জিনিস আজকাল খুব মার্কেটে চলছে। চলছে বলেই তার ব্যবসা রমরমা।

সেই ঘটনার পরে মিঠাপুকুরে আর থাকেনি। থাকার ইচ্ছেও হয়নি। যেই গ্রামে তার দাদি নেই, ভাই নেই, সে থেকে করবেটা কি? তাই ঢাকা তখনই চলে এসেছিল।

এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মাথা শক্ত করা সহজ কথা না। টাকা যতোই থাক, তবে সেই ঘাড়ত্যাড়া, একরোখা কাউকে পরোয়া না করা ছেলেটা, শক্ত করে দাঁড়িয়েছে। পুরো পরিবারকে দু’হাতে আগলে নিয়েছে। বট গাছের মতো সোজা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

শাহবাজ বাড়িতে ঢুকে দেখলো, সেই তার দুনিয়া ভোলানো, গোঁজ করা মুখ। যেই মুখ গোঁজ করে ঘর ভর্তি মাখামাখি আচার পরিষ্কার করছে।

আর এই অকাজ কার সে ভালো করেই জানে। বাড়ির সামনে আসতেই এক নালিশও পেয়ে গেছে। তাই চাচার রুমের দিকে এগোবে তখনই আম্বিয়া শক্ত গলায় বলল, — খবরদার, ওদিকে যাবি না। মারতে মারতে পোলাডারে শরীরে আর কিছু নাই। হাড্ডি গোনা যায়।

শাহবাজ আম্বিয়ার দিকে ফিরলো। সে বসেছে কাঁথা নিয়ে। গ্রামের বাড়ির অর্ধেক কাজও শহরের বাড়িতে নেই। আম্বিয়ার দিন কাটে এই সব হাবিজাবি করে। তাই ফিরেই বললো,– ঠিক মতো পেটে ভাতের দানা পড়ে? দিনভরে খায় হাবিজাবি। হাড্ডি গোনা যাইবো না, তো কি যাইবো।

— তো খাইবো না? একটা মাত্র বাড়ির মানিক। টাকা কবরে নিয়া যাইবি?

— আদরে, আদরে, বান্দর তোমরাই বানাইতাছো।

— বানাইলে বানাইছি, বাপ চাচারা জবর মানুষ ছিলা।

— কথায় কথায় বাপ চাচায় যাবে নাতো?

— একশোবার যাবো, কি করবি তুই?

শাহবাজ আর কথা বাড়ালো না। এই বাড়ি ঘরের প্রতিটা কোণা তার ঘামের বিনিময়ে হলেও, এই ঘরে তার দাম ছিটেফোঁটাও নাই। এই ঘরের মহারানি, ঐ যে মুখ গোঁজ করা পেন্দুনি। কিছু হলেই এমন পেন্দান পেন্দায়, সব তার পিছে দা বটি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এই যে তার পুঁচকে ছাওয়াল, এটাও বুক টানটান করে সোজা মায়ের সামনে দাঁড়ায়। কালনাগিনী সাথে বলি।

বলেই সে নিজের রুমের দিকে গেলো। ক্যারেন্ট নেই। শহরে মেঘ হলেও গরম কমে না। গায়ের শার্টটা খুলেই খাটে গা এগিয়ে দিলো। দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। করতেই তালপাখার শীতল বাতাস গায়ে লাগলো।

শাহবাজ চোখ খুললো না, তবে অদেখা হাসি ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে গেলো। যেতেই বলল, — এই অবস্থায় নিচু হয়ে আচার তুলছিলে কেন? কাজের মানুষ কোথায়? আর আম্বিয়াবুকে এখনো বলোনি?

আয়না উত্তর দিলো না, মুখ গোঁজ করেই পাখা নাড়তে লাগলো। শাহবাজ চোখ খুলে আয়নার দিকে তাকালো। তাকাতেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। ঐ যে ফর্সা গোলগাল মুখ। গরমে লাল হয়ে আছে। আগের মতো অবশ্য গায়ে হাড্ডি না। ছেলের হওয়ার পড়ে একটু ফিরেছে। আরো ফিরতো, ছেলেটা মানুষ হলে।

সে এগিয়ে হাতের পাখা টেনে নিলো। নিয়ে আবার শুয়ে হাতটা পেতে দিলো। আয়না মুখ গোঁজ করেই দাঁড়িয়ে রইল।

শাহবাজ হাল ছেড়ে বলল, — বলবো না কিছু আপনার ছেলেকে, এবার আসেন।

আয়নার ফর্সা গোলগাল মুখে হাসি ফুটলো। তারপর আস্তে করে এগিয়ে হাতে মাথা রাখলো। কিছুদিন হলো বুঝেছে, আবার মা হচ্ছে। তাই শুয়েই লেপটে গেলো শাহবাজের ঘামে ভেজা সেই সিক্ত বুকে।

শাহবাজ আগলে আরেক হাতে পাখা নাড়তে নাড়তে বলল, — একটাই জান খেয়ে ফেলছে। আরেক টা যে কি করবে, আল্লাহ’ই জানে?

আয়না খিলখিল করে হেসে ফেললো। শাহবাজ সেই হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আয়না হাত দিয়ে মুখ অন্য পাশে ঘুরিয়ে বলল, — এই মাসে এরশাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাননি?

— যাবো। মাসের প্রথম দিকে ভাবি যায়।

— আয়না শাহবাজের গালে চিমটি কাটলো। কেটে বলল, — ইশ ভাবি, বাড়িতে এলে মাথা উঁচু করে কথা বলতেও দেখি না। যদিও দু’একটা বলেন কোন নাম ডাক ছাড়া।

— ভয়ে বলি না। যদি মনে হয় এই শব্দটা বোঝা। আর একবার বোঝা মনে হলেই, সবাই বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে চায়। আর নামালে আমার ভাই বাঁচতে পারবে না।

— পৃথিলা আপা ওমন না।

— খুব চেনো মনে হয়।

— চেনবো না, এই যে কি সুন্দর খোঁজ খবর নেয়। ছোট চাচার সাথেও তো এখন টুকটাক কথা বলে।

— হুম, প্রাণের বান্ধবী।

আয়না হাসলো! হেসে একটু উঁচু হয়ে আস্তে করে শাহবাজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠা গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

শাহবাজ হাসলো! হেসে মাথাটা আস্তে করে খাটে রেখে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে দরজা লাগাতেই আয়না চাপা স্বরে ধমকে বলল, — একদম না, বাড়িতে এখন সবাই শাহবাজ।

— থাকুক! শাহবাজ গোনায় ধরে নাকি?

— ডাক্তার নিষেধ করেছে।

— করুক।

— শাহবাজ।

শাহবাজ বড় একটা শ্বাস ফেলে আবার জায়গা মতো শুলো। শুতে শুতে বলল, — শালার জীবন।

আয়না আবার খিলখিল করে হেসে ফেললো। তার হাসির শব্দ আম্বিয়া বসার ঘর থেকে শুনলো। সারেং বাড়ির মতো তো আর বিশাল বাড়ি না। তাই এই ঘরের খবর সহজেই আরেক ঘর থেকে না চাইতেও ঠিক আঁচ করা যায়। আর যায় বলেই হাতটা ক্ষণিকের জন্য থামকে যায়। থমকে আবার নিজ গতিতে নিজের মতোই চলতে যায়।

…….

সাবেত চশমাটা চোখে তুলে পত্রিকায় চোখ রাখলেন। তিনি রিটায়মেন্ট নিয়েছেন। এখন তার সময় কাটে বলতে গেলে এই পত্রিকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ বোলাতে।

পাশেই শায়লা চোখে মুখে রাগ নিয়ে ছোট মেয়ের ঘরের নাতনীর মাথায় তেল ঘষছেন, বিরক্ত মুখে। এই বিরক্ত মুখ সব সময়ই মাসে একবার হয়। কেন হয়, সাবেত জানে। তবে তিনি কিছুই বলেন না। মেয়ে বড় হয়েছে, নিজের সিন্ধান্ত নিজে নিয়েছে। এখানে সে হস্তক্ষেপ করেনি। করেনি বলেই শায়লা মেয়ে তো ভালোই, মেয়ের বাবাকেও শত্রুর দলে ফেলে দিয়েছে। শায়লা চেয়েছিল পৃথিলা নতুন করে সব শুরু করুন। সে করেছে না? আল্লাহ তাকে ভালো রেখেছে না? তো তার মেয়ের জীবন থেমে যাবে কেন?

তবে শায়লা তো বুঝেও বুঝে না। তার মেয়ের জীবন থেমে নেই। তার মেয়ের জীবন চলছে, সুন্দরভাবেই চলছে। এই চলার একমাত্র সঙ্গী পাশাপাশি না থাকলেই তাদের রুহ এক হয়ে গেছে। এই যাওয়া জাগতিক নিয়মে চলে না। চলে অন্য কোন নিয়মে। সেই নিয়ম সবার বোঝে আসে না।

তখনই পৃথিলা উঁকি দিলো। গায়ে ছাই রঙা তাঁতের শাড়ি। মাথায় সাধারণ হাত খোঁপা। বয়স মধ্যবয়স্ক নারীর কৌটায় পা রাখলেও, লম্বা চিকন শরীরটার এখনো বাঁকানো। সেই আগের মতোই। যেন কারো অপেক্ষায় বয়সটা থমকে আছে। তবে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই কয়েকটা পাকা চুল ঠিক উঁকিঝুঁকি দেয়। অবশ্য এই দেওয়া নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। তাই সব সময়ে মতো শান্তভাবে বলল, — আসি মা। আজ ফিরতে একটু দেরি হবে।

শায়লা উত্তর দিলো না। একটা হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক তার মেয়ে। তাই এখন চাইলেই চট করে রাগ দেখাতে পারে না। তাই মুখ ফুলিয়েই বসে রইল। জাফর শয়তানটা করেছে তার জীবন নষ্ট, তার ভাতিজা করছে তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট। কে শুনে তার কথা।

শায়লা উত্তর না দিলেও সাবেত দিলো। হেসে বলল, — তাড়াতাড়ি ফিরো মা। রাতের ঢাকা ভয়ংকর।

পৃথিলা তার মতোই মৃদু হাসলো। হেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে কয়েক প্যাকেট সিগারেট কিনলো। কিনে ট্যাক্সিতে উঠে বসলো।

কারাগারে যখন পৌঁছালো, দুপুরের রোদ পড়ে গেছে। গিয়েই কাগজ দেখালো। দেখাতেই তারা চেক করে ভেতরে নিয়ে গেলো। দাঁড়ালো মোটা মোটা লোহার গ্রিলের এপারে। দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ওপারের, ঐ যে দরজাটা সেখানে। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাজির হলো কাঙ্খিত মানুষটা। যার ঠোঁটে সেই সুন্দর, মার্জিত, সরলতার হাসি। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। যেই ঝিলিকটুকু একমাত্র, এই যে সাধারণ দেখতে সাদা মাটা পৃথিলা। এই পৃথিলাকে দেখলেই উপচে পড়ে। পড়ে বলেই পৃথিলা আসে, ঘুরে ফিরে আসে। কেননা এই ঝিলিকটুকু যে তারও এখন দেখতে ভালো লাগে।

#সমাপ্ত