ধূসর অবেলায় সন্ধি পর্ব-০১

0
222

#ধূসর_অবেলায়_সন্ধি
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_এক

” আমার মেয়েটাকে দুমুঠো ভাত দিবি, বউমা!”

দুমুঠো ভাত চাওয়াতে মামুনের বউ হালিমা মিশুর মাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো। ফুল একমাত্র ঐ ঘটনার সাক্ষী ছিলো, সে দৌড়ে মিশুকে খরবটা দিতে গেলো। মিশুর কানে কথাটা পৌঁছানোর সাথে সাথেই বইখাতা ফেলে মায়ের কাছে ছুটে আসলো। দুয়ারে থালা হাতে মাকে পড়ে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরলো সে। মিনারা বেগম মেয়ের চোখের দিকে তাকালেন, দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,” তোর না আজ পরীক্ষা, উঠে আসলি কেনো?”

মিশু মাকে ধরে উঠে দাঁড়ালো। মায়ের গায়ে লেগে থাকা ধুলোবালি ঝেড়ে দিলো। চোখে তার অশ্রু কিন্তু মুখে কাঠিন্যের ছাপ! মায়ের হাত ধরে বলল,” দশদিন ভাত না খেলে মানুষ মরে না, মা! তুমি আর কখনো যার তার দুয়ারে ভাত চাইবে না।”

” ভাত না খেলে শক্তি পাবি কীভাবে? পড়া মাথায় ঢুকবে নাকি? তুই ঘরে যা মা, রাসু বুবুর কাছে নিশ্চয়ই ভাত আছে। আমি যাবো আর আসবো।”

মিশু মাকে একা ছাড়তে নাকচ করলো উলটো মায়ের হাত শক্ত করে ধরে মামুনের বউয়ের দিকে তাকালো।
” তোমার মা হলেও কী এভাবে ধাক্কা দিতে পারতে,ভাবী?”

মিশুর ভাবী হালিমা মুখ বেঁকিয়ে ঘরের দোর লাগিয়ে দিলো।

মামুনের বউ হালিমা, মিশুর ভাবি। মিশুর আপন ভাই মামুনের বউ। এক সন্ধ্যা লগনে বিয়ে করে আনে হালিমাকে। দীর্ঘদিনের প্রেম ছিলো তাদের। হালিমাকে অথবা মিনারা বেগমকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। বড়িতে পা রাখার পরদিনই পাতিল আলাদা করে ফেলল হালিমা। আস্তে আস্তে মামুনকেও মা বোনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। প্রথমে তাদের দুয়ার এক থাকলেও একটা সময় আলাদা হতে হয়। চাল ডাল মিলিয়ে একটি মুদির দোকান আছে মামুনের। মিনারা বেগমের বিয়ের পর শাশুড়ির থেকে সোনার বালা পেয়েছিল সেটা বিক্রি করেই মামুনকে দোকান দাঁড় করাতে টাকা দেন। সবকিছুই ঠিক ছিল, নতুন দোকান দেয়ার পর থেকে ভালো ক্রয় বিক্রয়ও হচ্ছিল। তিনজনের সংসারে প্রাচুর্যে ভরা না থাকলেও দুমুঠো ভাত পেতো এখন তো সেটাও পায়না মিশু ও তার মা।

ঘরে এসে দোর লাগালো মিশু। মাকে বসিয়ে কৌটা থেকে একটা বিস্কুট চিবিয়ে পানি পান করে নিলো সে। ওড়নার সাহায্য ঠোঁট সহ গলা মুছে মায়ের পাশে বসলো,” এই দেখো, তোমার সামনে বিস্কুট পানি খেলাম। পেট ভরে গেছে।”
মিনারা বেগম আঁচলে মুখ লোকালো। মিছে হেসে উত্তর দিলো,” পাগলি মেয়ে, একটা বিস্কুট খেয়ে কী আর ভাতের স্বাদ মিটে! বাঁচবি কীভাবে?”

” ভাতের অপর নাম যদি জীবন হতো, তাহলে পৃথিবীতে হাজারো দরিদ্ররা বেঁচে থাকতো না। পানির অপর নাম জীবন এজন্যই বলা হয়েছে যেন, আমাদের মত দরিদ্রদের পেট ভরতে পারে। পানির তো দাম নেই। এরজন্য কারো লাথিও খেতে হবে না। আমি পানি খেয়ে দিব্যি থাকতে পারব। তুমি অযথাই চিন্তা করছো,মা।”

মিশুর কথাগুলোতে কতোটা কষ্ট লুকায়িত আছে তা মিনারা বেগমই জানে। হায় হুতাশ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই তাদের কাছে। মিশুর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আর চারদিন বাকী আছে অথচ ঘরে চাল, ডাল কিছুই নেই। পরীক্ষা না থাকলে হয়তো মিশু ধার দেনা করে কিছু নিয়ে আসতো এখন তো সেটাও পারছে না।

তিনটা বাজতে চলল অথচ মা মেয়ে কারো পেটে কিছুই পড়লো না। কিছুক্ষণ যাবত মিনারা বেগমেরও কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না মিশু। বইখাতা বন্ধ করে মায়ের ঘরে আসলো মিশু। মিনারা বেগম তখন পশ্চিমমুখী হয়ে শুয়ে আছে, মিশু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে আর ডাকলো না। দুয়ার চেপে দুমুঠো চালের সন্ধান করতে বের হয়ে গেলো সে।

সন্ধ্যা নাগাদ দুই কেজি চাল ও এক কেজি ডাল হাতে করে ফিরলো মিশু। টাকার বন্দবস্ত করেছে কলেজের বান্ধবীর থেকে ধার করে। এই বাজারে তিনদিন চালিয়ে দিতে পারবে দুজন। দুয়ার খুলে সারাঘর অন্ধকার দেখতে পেলো মিশু। অন্ধকারে হাতড়ে পলিথিন টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল,” ও মা! আজ আলো জ্বালালে না?”

বলতে বলতে আলো জ্বালালো মিশু। মাকে তখন বিছানার উপর সেইভাবেই শোয়া অবস্থায় দেখতে পেলো সে। যেমনটা বিকালে দেখে গিয়েছিল মিশু। মায়ের কাছে এসে দুইতিনবার ডাকলো সে। মায়ের কোনো নড়চড় না দেখে গায়ে হাত রাখলো মিশু। বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আছে পুরো শরীর। মিশু দু কদম পিছিয়ে গেলো। শরীর কাঁপছে তার! শরীর তো তাদেরই বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় যারা মারা যায়। বইয়ে পড়েছে সে, মাও বলেছিল মিশুকে। মাথায় হাত দিয়ে মা বলে আর্তচিৎকার করে উঠলো মিশু। তারপর মিশুর আর কিছু মনে নেই।

———————-

আতরের সুঘ্রাণে সারা বাড়ি সুগন্ধিত। মিশু দুয়ারে মাথা ঠেকে বসে আছে। আগামীকাল তার ইন্টার পরীক্ষা সেদিকে তার কোনো চিন্তা নেই। অথচ পড়াশোনার জন্য কতোই না যুদ্ধ করেছে গোটা পৃথিবীর বিপরীতে! টেবিলের উপর চাল ডালগুলো ঐরকমভাবেই পড়ে আছে। মা হারা মিশু আবারও এতিম হয়ে গেলো। কালচক্রে আবারও মিশুকে সেই জায়গায় দাঁড় করালো যখন মিশুর বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তফাত শুধু এইটুকুই, তখন মিশুর মাথায় হাত রাখার জন্য তার মা ছিল আর আজ কেউ নেই। মামুন রাতে হালিমাকে নিয়ে আসছলো। মা মারা গিয়েছে বলে মামুনের চোখে দুঃখ দেখা গেলেও হালিমার চোখে লালসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না মিশু। কথায় কথায় হালিমা যখন বলে ফেলল,” তুই একা এতো বড়ো ঘরে কীভাবে থাকবি রে মিশকা? আমি বরঞ্চ খাইরুন আপাকে আসতে বলি, কেমন? তোর একটা সঙ্গীও হবে! মেয়েটাও মাথার ছায়া পাবে।”

খাইরুন হালিমার আপন বোন। মেয়েটা ডিভোর্সি, স্বভাবগতভাবে কেউ পছন্দ করে না। বলাবাহুল্য বাজারে অনেকেই বলাবলি করে, খাইরুনকে নাকি প্রায়ই হোতাপাড়া ব্রীজের নিচে দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে খদ্দরের আনাগোনা বেশি। হালিমার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সাথেই হাসলো মিশু। ভাইয়কে উপেক্ষা করে বলেছিল,” বোঝ একজন ম’রে গেছে কিন্তু আরেকটা বেঁচে আছে বলেই কী অত্যাচার করতে চাইছো?”

” মাথার উপর ছাউনি নাই তবুও মেয়ের তেজ কমেনি। এতো ঢং করে কী হবে, আসলে তো ভাইয়ের কাছেই আসতে হবে।”

” আমার অভিভাবক একজনই ছিল, আমার মা। মা বেঁচে থাকতেই যেই ভাই বউয়ের ভয়ে দায়িত্ব পালন করেনি, সে এখন কীসের স্বার্থে অভিভাবক সাজতে এসেছে; তা কী আমি বুঝি না!”

মামুন মিশুর গালে সজোড়ে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,” আজই তুই আমার বাড়ি থেকে বের হবি। গার্ডিয়ান মানবি না তো আমার বাড়িতে কেনো পড়ে থাকবি?”

মিশু গালে হাত রেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠস্বরে বলল,” আমি যাব না।”

হালিমা ননদের মার খাওয়া দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেলো। মামুনের রাগ বাড়ানোর জন্য বলল,” ঐ পাড়ার মনসুরের সাথে তো ঠিকই পিরিতের কথা বলতে যাস। এতোদিন আম্মা ছিল বলে আমরা কিছু বলিনি। এখন তো মানুষ আমাদের উপরই থু থু দিবে।”

মিশু বিস্মিত হয়ে গলার আওয়াজ নিচু সুরে বলল,” উনি আমার শিক্ষক, ভাবী!”

মনসুর মিশুদের বাংলা শিক্ষক। খুবই ভদ্র ও সম্মানিত মানুষ। আজ পর্যন্ত কোনো ছাত্রীকে খারাপ নজরে দেখেওনি এবং কোনো অযাচিত কথাও বলেনি। সেই মানুষটার সাথে মিশুকে নিয়ে এমন মন্তব্য? কতোটা কুৎসিত মনোভাব হালিমার? মিশু ভাইয়ের দিকে তাকালো সেও বউয়ের কথায় সহমত পোষণ করছে বুঝাই গেলো। মিশু সত্যি সত্যিই এতিম হয়ে গেলো। আপন ভাইও আজ পর হয়ে গেলো।
মিশু ভাইয়ের উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো। মামুন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলো,” থাকতে হলে খাইরুনের সাথেই থাকতে হবে, নইলে এই বাড়িতে তোর জায়গা নেই।”

মিশু মামুনের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। চোখে তার দুঃখের অশ্রুপাত। মানুনের হৃদয়ে বোনের অশ্রুকণা দেখেও কোনো প্রভাব ফেলল না। মিশু অনুনয় করে বলল,” ও ভাই, এতোটা পাষাণ হয়ো না। কথা দিচ্ছি, তোমার কাছে কোনো কানাকড়ি চাইবো না শুধু আমার মাথার ছাদটা কেড়ে নিও না।”

” খাইরুনের সাথেই তোর থাকতে হবে। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা দিবে বলেছে।”

মিশু স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো। জীবনের এই সময়টা তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলো। হালিমার দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো,” পরীক্ষা শেষ হলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তখন না হয়! নিজেদের জন্য ঘরের মধ্যেই কবর খুঁড়ো! ”

মামুন হুঙ্কার স্বরে ডাকলো,” মিশু?”

মিশু আগের মতোই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,” আমি গেলেই তো তুমি বাঁচো তাই না! আজ বউয়ের বোনকে জায়গা দেয়ার জন্য নিজের বোনকে বের করছো, দেখবে একদিন এই বউ এবং তার বোনই তোমার কাল হয়ে দাঁড়াবে।”

হালিমা তেড়ে আসছিল মিশুর দিকে মামুন বাঁধা দিলো। বউকে জোর করে টেনে বাহিরে বের হয়ে গেলো। পিছনে ফিরে একটিবারের জন্যও মিশুর দিকে তাকালো না।

মিশু হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,” এ কেমন পরীক্ষায় ফেললে খোদা!”

চলবে…………..