#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
সূচনা পর্ব
সেদিন যখন জানতে পারলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা তখন বুকে একরাশ আনন্দ বাসা বাঁধে। গাইনোকলজিস্ট এর সামনে বসেই তাকে আবেগে বলে উঠি
— ম্যাম, ক্যান আই কল মাই হাজবেন্ড?
খুশিতে থরথর করে কাপছিল আমার হাত পা। বুকের মধ্যে সে কি ঝড়! অবস্থা ছিলো আমার চেয়ার থেকে উঠে লাফালাফি করার মতো। মাতৃত্ব! কি অদ্ভুত জিনিস। আলভিকে ফোন করে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলি
— আলভি খুশির খবর আছে। আমাদের বাসায় ছোট অতিথি আসছে।
আলভি এহেন খুশির খবর শোনার পর বলে
— বাসায় ফিরে কথা হবে।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়। বুকের মাঝে গুমোট মন খারাপ বাসা বাঁধে। তবুও তা দমিয়ে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসি। হয়তোবা তার কাজের চাপ বেশি। বাসায় ফিরে তার অপেক্ষা। সঙ্গে আমার অদ্ভুত আনন্দ। আলভি বাসায় ফিরল বিকেলে। চারটায় তার অফিস ছুটে হলে। ঘেমে নেয়ে একাকার সে যখন বাসায় ফেরে তখন এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিলে সে করে বসে অভাবনীয় আচরণ। আমাকে এড়িয়ে সে বিছানায় বসে। হাতের ব্যাগ ছুড়ে দেয় বিছানায় অবলীলায়। মুখ শুকিয়ে আছে তার। দু’কান লাল। সাদা শার্ট থেকে টাই খুলল এলোমেলো ভঙ্গিতে।
— কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ? অসুস্থ?
অস্থিরতা নিয়ে তাকে একথা জিজ্ঞেস করতেই সে ধাক্কা দিলো আমাকে। দুপা পিছিয়ে আসি। অবাক হই অনেকটা। আলভি দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করে
— কি এসব জারা? তুমি এতোটা কেয়ারলেস? সিরিয়াসলি? হসপিটালে গিয়ে আমাকে ফোন করে জানালে আমাদের বেবি আসছে। হোয়াট? আশ্চর্য আমি।
আমি আলভির এমন কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুক ঢিপঢিপ করছে ক্রমশই। নিজের এমন অনুভূতি পাশে রেখে জানতে চাইলাম
— তুমি কি খুশি না?
আলভি রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলো আমার দিকে। যেন কোনো ভুল প্রশ্ন করেছি আমি যা কিনা করার কথাই ছিল না। আলভি আমার দু-হাত ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো রুক্ষ কন্ঠে
— আমাদের বিয়ের দু’মাস চলছে। জাস্ট দু মাস। এতো জলদি কে বাচ্চা নেয়? আমাদের সংসারের হাল তোমার অজানা?
— তাতে কি হয়েছে? তুমি এমন করছো কেন? মনে হচ্ছে বাচ্চা অন্য কারো আমার তোমার নয়৷ তুমি বুঝতে পারছো? ও আমাদের ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী।
আলভি ক্ষেপে উঠলো। তিক্ত স্বরে উচ্চ কন্ঠে বলল
— কি ভালোবাসা? সংসার চলছে না তুমি ভালোবাসার চিন্তা করছো? শোন জারা, গ্রাম্য ভাষায় প্লিজ এটা বলতে এসো না আমাকে, মুখ কাটবেন যিনি আহার দেবেন তিনি। বি রিয়েলিস্টিক জারা। তোমার সস্তা আবেগ দিয়ে সংসার চলবে না।
আমি হা হয়ে গেলাম আলভির ব্যবহারে। তবুও তার নিকট গিয়ে পরম ভালোবাসা দিয়ে তার হাতে হাত রেখে বললাম
— আমি টিউশনি করাবো। তুমি চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে। পাশের বাসার আন্টির ছেলে ক্লাস সিক্স এ পড়ে। ওকে পড়ানোর জন্য বলেছে আন্টি। আমি পড়াবো। আর তুমি না বলেছিলে, আমি তোমার পাশে থাকলে তুমি সবকিছু পারবে। সফলতা আসবেই তোমার। আমি সবসময় তোমার সঙ্গে আছি আলভি।
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আলভি ফ্রিজের নিকট যায়। ঠান্ডা পানির বোতল বের করে বলে
— কত মাস? দেড় নাকি?
— হুম।
— অপারেশন করবে দুইদিন পর। শুক্রবারে নিয়ে যাবো।
আমার কলিজায় যেন তীর বিধলো। এমন কথা স্বপ্নেও আশা করিনি তার থেকে। ছন্নছাড়া মন নিয়ে আলভির পাশে দাড়িয়ে বলতে চাইলাম কিছু। কিন্তু সে হাত উঁচিয়ে জানিয়ে দিলো
— শুনতে চাইছি না।
আমার কন্ঠ রুদ্ধ হলো। নিমিষেই মা হওয়ার স্বপ্নের শহর বিবর্ণ হলো। সব আনন্দ মাটির নিচে বিলীন হলো। চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো মেঝেতে। আলভি ফিরেও তাকাল না৷ সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শার্ট খুলে তোয়ালে নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।
ভার্সিটির প্রথম দিনে। নিষ্পাপ মুখের যে আলভিকে দেখে আমি প্রেমে পরেছিলাম সে আলভির সঙ্গে এই আলভির যেন কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না আমি। দু মাস আগে যে আমার হাতে হাত রেখে বলেছিল নিশির আঁধারে
— এই শক্ত করে ধরলাম হাত। কখনো ছাড়ব না। তোমাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে পারবো কিনা জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে আমার সবটুকু ভালোবাসা দেব জারা।
এমন কথা শুনেই তো আমি বিয়ের পোষাকে সেই রাতেই তার হাত ধরে পালিয়েছিলাম। আজ তার এমন ব্যাবহার আমার কলিজা যেন হাজার খন্ড করে দিয়েছে।
.
রাতে আলভির সঙ্গে কথা হলো না আমার। একই ছাদের নিচে থাকার পরও কথা হলো না। একই বিছানায় থাকলেও তাকে এড়িয়ে চললাম। অনুরূপ সেও। তার মুখ আর চোখ যেন আমাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করল৷
পেরিয়ে গেলো দু’টো দিন। শুক্রবার আসতে আর কয়েক ঘন্টা বাকি। ঘুম হলো না আমার। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে বড্ড দোটানায়। আলভি বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমায়। দোটানা আর আলভির একটু আগে বলা কথা আমাকে পুরোপুরি ভাবে গ্রাস করল। ভাবতে হল আমার নতুন করে। আলভি তৈরি হয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল
— তুমি কি চাও আমাদের বাচ্চা একটা খারাপ জীবনযাপন করুক? কষ্টে থাকুক? জারা, আমার স্যালারি সামান্য। এটা নিয়ে বাসা ভাড়া, খাওয়া পড়া এসবই হয় না। বেবি আসলে অনেক খরচ। ওকে আমরা কষ্ট দেবো? আমি কি বাবা না ওর? আমিও চাই আমাদের ঘরে একটা পিচ্চি কেউ আসুক। আমার দু হাতে তাকে স্পর্শ করি। কিন্তু, কিন্তু জারা সে এসে কষ্ট পাবে তার বাবার থেকে এটা আমি কিভাবে মানবো? তখন আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। প্লিজ জারা। একটু বোঝ? আবেগ দিয়ে বিচার কোরো না। আবেগে সংসার হয় না। বাস্তব অনেক কঠিন! অনেক জারা!
তার এমন কথা আমার বুকে গেঁথে যায়। ভাবি দ্বিতীয় বার। তারপর সিদ্ধান্ত নেই আলভির কথায়। সেও তো বাবা। কষ্ট হলেও নিজেকে শক্ত রাখি। উপস্থিত হই হসপিটালে। অপেক্ষায় বসে থাকি ভেতর থেকে ডাক আসার। একটা সময় ডেকে পাঠানো হয় ডাক্তারের নিকট। ভেতরে ঢুকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালে তিনি কেমনতর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমি তাকে জানাই
— আমার বাবা-মা আমার সাইডে নেই। আমার স্বামী আমার একমাত্র আশ্রয়। আমি তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত।
ডাক্তার কেবল শান্ত কন্ঠে বলেন
— মা হওয়া গর্বের কাজ। আর মা হাওয়ায় সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার মিসেস জারা। আপনি কি আপনার সিদ্ধান্তে অটুট?
আমি তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারলাম না। ভেতর থেকে অদৃশ্য জড়তা আটকে ধরছিল। ডাক্তার পুনরায় বলেন
— দশ মিনিট দিলাম আপনাকে। ভাবুন।
এরপর আমাকে রুম থেকে বের করে দেওয়া হলো। বাইরে আসতেই আলভি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? আমি জানালাম
— কিছু না। একটু পর আবার দেখা করতে বলল।
আলভি আমাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো। বলল
— ভয় পাচ্ছো?
— উহু
— কিচ্ছু হবে না। ভয় পেও না।
কথার মাঝে আলভির ফোন বেজে ওঠে। আলভি রিসিভ করে না। অতঃপর নার্স তাকে ডেকে পাঠালে সে চলে যায়। ফেন রেখে যায় ভুল করে আমার নিকট। আমি অপেক্ষায় ছিলাম তার ফিরে আসার। এমন সময়ই দ্বিতীয় বারের মতো ফোন বাজে তার। স্ক্রিনে লেখা ওঠে ” মাই লাভ”। চোখদুটো ছানাবড়া হয় যেন আমার। নিশ্বাস আটকে আসে। চোখের পলক ফেলার কথা ভুলে যাই বেমালুম। হাত পা শীতল হয়ে জমে যায়৷ এরইমাঝে ফোনের রিং বন্ধ হয়। অতঃপর ম্যাসেজ আসে
” হেই? বউয়ের কাছে নাকি? আর ভালো লাগে না। তুমি কবে আমার হবে? বেইবি কবে? তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে।”
চলবে…..