ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০২

0
1

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ২

[ লেখার সুবিধার্থে এখন থেকে নাম ধরে বর্ণনা করবো গল্প ]

চৈত্রের শেষ বিকেলের শুষ্কতা যেন বাসা বাঁধে জারার চোখেমুখে। দৃষ্টি ফেরাতে পারে না সে আলভির ফোনের স্ক্রিন থেকে। দলিতমথিত হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে। কখন যেন চোখ ভরে ওঠে লোনাজলে। ঘোলা হয়ে যায় দৃষ্টি। আকাশ যেন ভেঙে পড়ে তার মাথায়। এমন সময়ই ডেকে ওঠে পেছন থেকে আলভি। বিদ্যুৎ গতিতে চোখের জল হাতের পিঠে মুছে সারা দেয় জারা। আলভির চোখমুখ ভরা রাগে। নিজের মাথার চুল অস্থির ভঙ্গিতে টেনে সে জারাকে বলে

” যাই হয়ে যাক তুমি আমার কথা শুনবে জারা। ডাক্তারের কি আসে যায় বাচ্চা নিয়ে? বুঝলাম না আমি৷”

জারা একটু আগের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। তবুও চোখে মুখে সজীবতা ফুটিয়ে বলল

” তুমি ভেবো না৷ আমাকে ডাকছে বোধ হয়। আমি ভেতরে যাই।”

আলভির ফোন তার হাতে স্থানান্তর করে দিয়ে জারা ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করে। হেঁটে যাওয়ার মুহূর্তে সে ফিরে চায় একবার পেছন পানে। আলভির ঠোঁটে মুচকি হাসি। চোখ নিবদ্ধ ফোনে। হাতের আঙ্গুল খেলছে কিবোর্ডকে কেন্দ্র করে। জারা বিমর্ষ হয়ে এলো। কাচ ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার মতোই সে গুড়িয়ে যাচ্ছে ভেতর ও বাহির থেকে। হন্টন দশায় ভেবে নিলো জীবন দিয়ে হলেও সে আগলে রাখবে তার অনাগত সন্তানকে।

দশ মিনিট পর আলভির অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দিয়ে জারা জানালো অপারেশন দু’দিন পর করা হবে। যে কথাটা ছিল নিছকই মিথ্যা। জারা কখনো অপারেশন করাবে না। উপরন্তু সে আলভির ঘনিষ্ঠতা দেখার জন্য তার ভেতরের ঝড়ও প্রকাশ করবে না। আলভি বাচ্চার বিষয়ে জেনে কিছুটা হতাশ হলো যেন। তবে বেশি কিছু প্রকাশ করল না। বাড়ি ফিরতে চাইল জারাকে নিয়ে। পথিমধ্যে তার ফোন বাজে। জারা আড় চোখে পরখ করে বোঝে এটা সেই নারীর ডাক। যে নারী তার ঘরে ঢুকেছে সাপ হয়ে। আবারও দমকে আসতে চায় কান্না। তবে তা খুব কষ্টে দমিয়ে রাখতে হয়। আলভি মাঝপথে সিএনজি থেকে নেমে যায়। জারাকে বাড়িমুখো হতে হয় একাকী। সুযোগ হাত ছাড়া করে না দুঃখরা৷ কষ্ট জারাকে ডাকে হাতছানি দিয়ে। গুমড়ে মরা আর্তনাদ ঠেলেঠুলে বাইরে আসতে চায় যেন। জারা নি:শব্দে কেঁদে যায়। বাসার সামনে সিএনজি এলে সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে লাগে। পেছন থেকে ডেকে ওঠে চালক। অদ্ভুত দৃষ্টিতে জারার পানে তাকিয়ে বলে

” আপনার ব্যাগ।”

জারা ফিরে আসে। ব্যাগ নিয়ে পুনরায় সে ছুটে প্রবেশ করে বাসায়। আলভি ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিল রাস্তায় বিধায় চালক চলে যায় নিজ গন্তব্যে। জারা ঘরে ফিরে শাড়ির আঁচল মুখে ঠেসে দেয়। চিৎকার গুলো বেরিয়ে আসে। তবে শব্দ হয় ক্ষীণ। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পায় জারা। হাতের নিকট থাকা ফুলদানি ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। ভেঙে গুড়িয়ে যায় তা। হঠাৎ জারার চোখ পড়ে ওয়ারড্রবের দিকে। সে হন্যে হয়ে ছুটে। পথিমধ্যে থাকা ভাঙা ফুলদানি খচ খচ করে বিঁধে যায় তার পায়ে। তবুও যেন ব্যাথা অনুভব হয় না। প্রিয় পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার কষ্টের কাছে এ কষ্ট যেন বড্ড নগন্য। চারটা ড্রয়ার তোলপাড় করে, কাপড় মেঝেতে ছুড়ে, ছিটিয়েও জারা কোনো হদিস পায় না পরনারীটির। জারা এবার যায় ড্রেসিং এর নিকট। তবে সে হয়তোবা ভুলে গেছে আলভি বোকা নয় এমনকি পরকীয়ায় আসক্ত কোনো পুরুষই বোকা হয় না। পর নারীতে আসক্ত হয়ে ওরা শুধু দক্ষ হয় ঘরের নারীকে বোকা বানাতে। সত্যিই কি দক্ষ হয়? নাকি সুযোগ নেয় নারীর তীব্র ভালোবাসার, কোমলতার।

.
ফাঁকা একটা এপার্টমেন্ট শুনশান। জানালা দিয়ে ছুটে আসা হাওয়া পর্দা দুলিয়ে বিদায় হচ্ছে। লিভিং রুমে বসা আলভি হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে চারিপাশ। দামি আসবাবপত্র আর এপার্টমেন্টের মনোমুগ্ধকর নকশায় সে হারিয়ে যাচ্ছে যেন স্বপে। সামনে বসে থাকা মাহা ফোল্ডেবল সোফায় গা এলিয়ে দেয়। ঠোঁটে উদয় হয় তার বাঁকা হাসি। আলভির উদ্দেশ্যে বলে

” এটুকুতেই তুমি এতো খুশি? আমাদের বিয়ের পর আমরা বিদেশে যাবো সপ্তাহে সপ্তাহে। আমাদের প্রাইভেট কার নিয়ে লং ড্রাইভে যাবো অফিস শেষে। শুধু এই এপার্টমেন্ট কেন? পুরো একটা বাড়ি পাবে তুমি। ”

চকচক করে ওঠে আলভির দু’চোখ। মাহা আরো বলে

” শুধু কি এগুলো? সঙ্গে তো আমাকেও পাবে তুমি। আচ্ছা বলো তো আলভি কে বেশি সুন্দরী? তোমার বউ নাকি আমি?”

আলভি সেকেন্ড পরিমাণ সময়ও ব্যায় না করে বলে দেয়

” অবশ্যই তুমি। তুমি কি জানো? এই বাড়ি, এপার্টমেন্ট এসবের চাইতে সবচেয়ে বেশি দামি তুমি?”

” যাহ! এতোটাও সুন্দরী নই আমি।”

মাহা লজ্জা পায়। আলভি শব্দ করে হাসে। চোখে মুখে ফুটে ওঠে তার কামনা। বাসনার তাড়নায় এগিয়ে যায় মাহার নিকট। ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। মাহার মাথার পেছনে হাত দিয়ে ক্রমশ তার মুখটা এগিয়ে নিতেই মাহা ধাক্কা দেয়। আলভির দেহ সরে মাটিতে লুটিয়ে যায়৷ মাহা তার বুকের ওপর পা রেখে ফিসফিস করে বলে

” আগে বিয়ে তারপর সব। বিয়ের আগে এতো সুযোগ দিলে তুমি ছেড়ে যাবে আমাকে। আমি তো জারা নই আলভি।”

” তুমিই তো বলছিলে আমাকে ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করছে তোমার। ”

” ইচ্ছেটা তুলে রাখলাম। এবার বলো বিয়ে করবে কবে?”

” জারা বিদায় হলে।”

” তো বিদায় করছো না কেন?”

” বুঝতে পারছি না কি বলল।”

মাহা রক্তচক্ষুতে তাকায়। আলভি আলগোছে মাহার পা বুকের ওপর থেকে নামিয়ে বলে শান্ত হতে। একটা ব্যাবস্থা সে শীঘ্রই করবে। মাহার মন শান্ত হয় না। আলভি উপায়ন্তর না পেয়ে মাহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর হাতের ফোনটা নিয়ে জারার নাম্বারে টেক্সট পাঠায়

” আমার বাসায় ফিরতে রাত হবে। ”

.
এলোমেলো ভঙ্গিতে মেঝেতে স্তুপ হয়ে ছড়িয়ে থাকা কাপড়ের ওপর মাথা রেখে জারা শয়ন দশায় ফোনের শব্দ শ্রবণ করে। উঠে যাওয়ার শক্তি বা সাধ্য হয় না। পায়ের ক্ষত থেকে গড়িয়ে পরছে রক্ত। খুবই শান্ত গতিতে। মেঝের একাংশ লাল হয়ে গেছে সেই রক্তের ছোপে। নয়ন জল নয়নেই শুকিয়ে যায় জারার। এই শোকে কখন যেন সে বন্ধ করে নিয়েছিল চোখ। এশার আজান বাতাসে বাতাবরণ করলেও তা পৌঁছায় না জারার কানে। আবারও টুং করে শব্দ হয়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আলভির দ্বিতীয় ম্যাসেজ।

” আজ ফিরতে পারবো না জারা। অফিসে আছি। প্রচুর কাজ। কাল অফিস করে তারপর বাসায় ফিরব। ”

.
ঘুম ছুটে যায় কলিং বেলের ধ্বনিতে। পিটপিট করে চোখ খুলে জারা সন্ধান পায় আঁধারের। খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে এসেছে এক ফালি চাঁদের আলো। সেই আলোয় আবছা দেখে জারা উঠে দাঁড়ায়। কে যেন দরজার ওপাশে অস্থির হয়ে বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। জারা ঘরের লাইট জ্বালায় ব্যাথায় জর্জরিত পা নিয়ে। অতঃপর খুব ধীর পায়ে সে এগিয়ে যায় দরজার নিকট। ছিটকিনি খুলে সামনে তাকাতেই দেখা মেলে উপমার। গম্ভীর চোখ মুখ। হাতে ব্যাগ সমেত কালো কোট। পরনে সাদা শাড়ি। জারা সামান্য অবাক হয়। আচমকা উপমার উপস্থিতি তাকে ভরকে দেয়। উপমা জারাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। জারা ব্যাথাতুর শব্দ করে। উপমা আতঙ্ক নিয়ে পিছনে ফেরে। জারা বসে পরেছে মাটিতে। দু’পা ভাজে মুড়িয়ে সে দেখছে ক্ষত। রক্তের ধারা বেড়ে গেছে উপমার ধাক্কায়। উপমা চিৎকার দিয়ে ওঠে আপু বলে। জারা হাত দিয়ে বোঝায় সে ঠিক আছে। উপমা চিৎকার করে।

” কি ঠিক আছিস? কিছুই ঠিক নেই তুই। বারবার বলেছিলাম এই থার্ডক্লাস ছেলেকে বিয়ে করিস না আপু। কিন্তু তুই মা, বাবা, আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এলি। ”

” তুই ঠিকানা পেলি কোথায়?”

” জোগাড় করেছি।”

জারা কথা বাড়ায় না। দু মাস পর বেনকে দেখে তার অনুশোচনা বেড়ে পাহাড়সম হয়েছে। উপমা জারাকে দাড় করায়। বেডরুমের আগে একটা ছোট রুমের ন্যায় কক্ষ আছে এখানে। সে কক্ষ দরজার নিকট। পুরোটা ফাঁকা। কেবল একটা সিঙ্গেল সোফা আছে। উপমা সেই সোফাতেই বসিয়ে দেয় জারাকে। অতঃপর গভীর কন্ঠে বলে

” আলভি কোথায়?”

জারা ঠাট নিয়ে বলে

” তোর বড় আলভি। সম্মান দিয়ে কথা বল।”

” একজন ল পড়ুয়া স্টুডেন্ট হিসেবে অপরাধীকে সম্মান করলে পুরো ল ডিপার্টমেন্টকে অসম্মান করা হবে। ওর মতো জা*নো*য়া*র কে আমি হাতের কাছে পেলে টুকরো টুকরো করে দেবো বুঝলি?”

জারা অবাক হয়। ভয় জেঁকে ধরে তাকে। উপমা কি কিছু জেনে গেছে?

চলবে…