ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০৪

0
1

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৪

সুধীর হয়ে কিছু সময় ভাবতেই আলভি বুঝে যায় গত রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনা। নিজের ফোনটা ছিলো তার পায়ের নিকট। খপ করে ফোন হাতে নিয়ে অস্থির চিত্তে অন করতেই দেখতে পায় মাহার কল। সতেরো বার কল করেছে মাহা। আলভি উঠে দাড়িয়ে ফোন করতে যাবে তখনই চোখ পরে তার সামনে চেয়ারে বসে থাকা জারার পানে৷ এক হাত গালে রেখে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে সে। চোখে শান্ত ভাব কিন্তু যেন ভয়ঙ্কর কিছু রাখা। আলভি থতমত খেয়ে যায়। জারা আস্তে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গোছাতে গোছাতে বলে

” আসি আমি। থানায় দেখা হবে আলভি আহসান। ”

কথাটা বলেই মুচকি হাসে জারা। আলভির অন্তরাত্মা লাফিয়ে ওঠে। তড়াক করে সে জারার হাত ধরে। বিনয়ের সুরে বলে

” জারা, না প্লিজ যেও না। আমি এক্সপ্লেইন করছি। তুমি কি জানতে পেরেছো আমাকে বলো। আমি সব উত্তর দিচ্ছি। ”

জারা ঝাড়া দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে

” এ টু জেড। সবই জেনেছি। তোমার মতো কা পুরুষের সঙ্গে আমি আর থাকবো না।”

আলভি হাতের ফোন এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে। ব্যাগ থেকে অফিসের আইডি কার্ড এনে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার চোখমুখে বাসা বাঁধে রক্তিম আভা। জারা এসব শান্ত ভঙ্গিতে দেখে। আলভি এবার কাতর কন্ঠে জারার চোখে চোখ রেখে বলে

” প্লিজ জারা আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি থাকতে পারবো না। ”

জারা প্রতিত্তোরে করে না। আলভি জারার পায়ে পড়ে এবার। চোখে পানি আসে তার। রুদ্ধ হয়ে আসা কন্ঠ নিয়ে বলে

” সাময়িক মোহে না হয় একটা ভুল করেছি জারা৷ ক্ষমা করো প্লিজ। তুমি চলে যাওয়ার কথা বললে আমার নিশ্বাস আটকে আসে। ”

জারার চোখে জল জমে। আলভির চোখের পানি তার পায়ের পাতায় পড়তেই বুকে তোলপাড় শুরু হয়। আলভি কথা দেয় সে দ্বিতীয় বার এমন ভুল করবে না। কিন্তু জারা তবুও ব্যাগ নিয়ে দরজার নিকট এগিয়ে গেলে আলভি সামনে দাড়িয়ে ঢাল হয়। জারাকে কোনো ভাবেই সে যেতে দিতে রাজি নয়। আলভির এতো মেহনতের পর জারার মনে বাসা বাঁধে মায়া। রাতে আলভি জারার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্বাস দেয়, স্বপ্ন দেখায় নতুন জীবনের। তারা চলে যাবে এ শহর ছেড়ে। ছোট বাবুকে নিয়ে ঘর বাঁধবে খুব সুখে। আলভি বলে তাদের ঘরের নাম হবে ‘সুখ নীড়’। এমন নাম আর কথা শুনে কোনো রমনীর বুঝি সাধ্য নেই প্রিয় পুরুষকে অবহেলা করার। তার সঙ্গে বিচ্ছেদ টানার। ক্রমশ জারা নরম হয়। আর একটা সুযোগ কি সে দেবে আলভিকে?

.
দিনকাল বেশ গেলো। জারা ঠিকঠাক কথা বলে না আলভির সঙ্গে। তবে আলভি সঙ্গ ছাড়ে না তার। হাজারো উপায়ে মানানোর চেষ্টা করে। দু’দিন পর পরিস্থিতি পরখ করে জারা উপমাকে নিষেধ করে এডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। উপরন্তু অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডিভোর্স হয় না। সবকিছু পিছু ফেলে জারা চেষ্টা করলো নতুন ভোরে নতুন করে সংসার গুছিয়ে নিতে। আলভি সেই ভোরে জারার হাত ধরে পাড়ি জমালো নতুন শহরে। বসন্তের বাতাবরণ সেদিন আকাশে বাতাসে। কোকিলের কুহুতান মন গহীনে সুর বোনে। আলভি জারাকে নিয়ে চলে আসে মফস্বলে। বলে এটা তার নিজ গ্রাম। আলভি এতিম হওয়ার তার বাবা ছিল না। আছে শুধু মাটি, ভিটা। সেই ভিটাতে পুরোনো এক বাড়ি। বাড়ির বেছনে প্রায় দীর্ঘ এক জঙ্গলের পথ। শেয়ালের ডাক নিশিকে করে ভুতুড়ে। শুনশান নীরব এই বাড়িতে জারার প্রথম রাতে আলভি তাকে চাঁদ দেখাতে নিয়ে যায় বাড়ির উঠোনে। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে যায় অজানা কোনো জায়গায়। একটা সময় আলভি স্থির হয়। জারার চোখে চোখ আর কপোলে দুহাত রেখে গাঢ় কন্ঠে বলে

” তুমি অনেক সুন্দর জারা।”

অদ্ভুত সে সুর। জারার কেন জানিনা কেঁপে ওঠে বক্ষ। সাদা শার্ট গায়ে জরানে আলভির মুখের অভিব্যাক্তি তাকে দেখতে দেয় না নিষ্ঠুর নিশি। জারা আলভিকে বুকের সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে বলে

” জানো আলভি? কোনো মেয়ে তোমার দিকে নজর দিলে আমি সহ্য করতে পারি৷ কিন্তু আমি ছাড়া তুমি অন্য কারো দিকে তাকালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি মৃত্যু যন্ত্রণাকে অনুভব করি।”

ম্লান জ্যোৎস্নার আলো ছুয়েছিল জারার বদন। কি মোহনীয় সেউ রূপ। কতটা মায়াবী এই নারী! কিন্তু আফসোস! তার প্রিয় পুরুষের মনে এতোটুকু মায়া হলো না। এতোটুকু দাগ কাটতে পারলো না। জারার বিশ্বাস পায়ে পিষে সে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করার ইশারা করে মাহাকে। পেছন থেকে মাহা তৎক্ষনাৎ আঘাত করে। জারা যেন অবাক হয়। তার কল্পনাতে ছিল না এ দৃশ্য। মাথার পেছনে হাত রাখতেই ভেজা কিছু অনুভব হয়। সে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে আঁধারের মাঝে আলভির পানে। আলভি তাকে ছেড়ে শক্ত করে হাত ধরে মাহার। বলে

” মাত্র জীবন শুরু করছি জারা। এভাবে নষ্ট করার প্ল্যান না করলেও পারতে। এইসব জেল, পুলিশ, কোর্ট জাস্ট বিরক্তিকর। এতোগুলা মানুষের দৌড়াদৌড়ির চাইতে ভালো একটা মানুষ নীরবে শেষ হয়ে যাওয়া। ”

চোখের কোণে জল চিকচিক করে জারার। সীমাহীন কষ্ট তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে। ধুপ করে পড়ে যায় সে মাটিতে। আলভি মাহার হাতটা ধরে পেছন পথ ধরে। জারা শান্ত চোখে চাঁদের আধো আলোয় সে দৃশ্য দেখে কাতর হয়ে। কানে বাজে মাহার কন্ঠ

” শেয়াল কুকুর এসে এক রাতেই একে শেষ করবে হাহাহাহা”

মাহা কথাটা বলার পরই কিছু গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ হয়। তারা পেছন ফিরে চায়। জারার অবচেতন দেহ গড়িয়ে পরে কোনো খাদে। তারা যেন খুশি হয় আরো বেশি।

.
চাঁদের মলিন আলোয় জঙ্গলের পথটা যেন কোনো অতিপ্রাকৃত জগতে ঢুকে পড়েছে। উঁচু-নিচু, সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে একটা প্রাইভেট কার। তার হেডলাইটের আলোয় চারপাশের গাছপালার ছায়াগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে—লম্বা, আঁকাবাঁকা আঙুলের মতো এগিয়ে আসছে অন্ধকার থেকে। ইউভানের বুকে আচমা ব্যাথা হয়। অদ্ভুত সে ব্যাথা। পাঁচ বছর পূর্বের ন্যায় স্বাদ এই ব্যাথার। সামনে থেকে ছুটে আসে একটা দমকা হাওয়া। তা গাড়ির কাঁচে এসেই নিশ্বেস হয়ে যায়। ইউভান থমকে দাড়ায়। আচমকা ব্রেক কষে থামিয়ে নেয় গাড়ি। পাশে বসা আমাদের কপাল ঠাস করে এসে বাড়ি খায় সামনে ঝুলে। ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখ খোলে সে তড়িৎ গতিতে। সামনে থেকে চশমা নিয়ে চোখে দেয় দ্রুত। অতঃপর ইউভানের পানে তাকিয়ে শুধায়

” কি হয়েছে স্যর?”

ইউভান মাথা নাড়ায় হালকা। বাম থেকে ডানে। আমাদ তার অর্থ খুঁজে পায় না। তবে ভাবতেও বসে না৷ ইউভানের কিছু কিছু কথা বা আচরণের অর্থ সে উদ্ধার করতে পারে না ঘন্টার পর ঘন্টা ভেবেও। ইউভান গাড়ির কাচ নামিয়ে হাওয়া অনুভব করে। চতুর দৃষ্টিতে কিছু খুঁজে বেড়ায় সে। অতঃপর হঠাৎই দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে লাগে অজানা দিলে। আমাদও পিছু নেয়। ইউভানকে বিরবির করে বলতে শোনা যায়

” এখানেই আছে। আশেপাশেই আছে৷ হ্যা এখানেই। ”

আমাদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে

” কি আছে এখানে? ”

ইউভান আলতো করে হাত রেখে বলে

” আমার হৃদয়ের একাংশ।”

.
জারাকে গত রাত থেকে ফোন করে যাচ্ছে উপমা কিন্তু কোনো সারা নেই। এমনকি অতিরিক্ত ফোন করার কারণে এখন একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসছে। বলা হচ্ছে ফোন সুইচ অফ। উপমা অস্থির হয়ে ওঠে। ভয়ে বাবা-মা কে কিছু জানায় না। এমনকি এটাও জানায়নি যে আলভি বিপথে চলে গিয়েছিল। উপমা ঠিক করে সে পুলিশে রিপোর্ট করে নয়তো কোনো এডভোকেট সঙ্গে কথা বলবে। তার আগে সে আলভিকেও ফোন করল কিন্তু সারা পাওয়া গেলো না। বন্ধু বান্ধবদের এবিষয়ে জানিয়ে বুদ্ধি চাইলে ওরা বলল ব্যারিস্টারের সঙ্গে আলোচনা করতে। শহরে এক নতুন ব্যারিস্টার এসেছে। উনি পাঁচ মাসে মাত্র পাঁচটা কেইস লড়েছেন। আর পাঁচটাতেই জিতেছেন। কোনোভাবে তাকে রাজি করাতে পারলে বিষয়টা দ্রুত সমাধান হওয়া সম্ভব। উপমা নিশ্চিত জারা বড়সড় বিপদে আছে। তাই সকাল হতেই সে উপস্থিত এক প্রতিষ্ঠানে। যে প্রতিষ্ঠানে আছে নামকরা সেই ব্যারিস্টার। অ্যাডভেকেটের সঙ্গে কথা বলে সে অপেক্ষায় থাকে ‘ইউভান’ লিখে দরজার ঝুলিয়ে রাখা নেমপ্লেটের সামনে। বুক তার দুরুদুরু করছে। শুনেছে উনি অদ্ভুত কিসিমে’র। ওনার যদি পছন্দ হয় তবেই সেই ঝামেলা সমাধান করতে রাজি হন।

চলবে…..