ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০৫

0
1

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৫

ইউভান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ঠান্ডা রাতের বাতাস ধীরে ধীরে পর্দা দুলিয়ে দিচ্ছে। তার গাঢ় দৃষ্টিটা স্থির হয়ে আছে ঘুমন্ত মেয়েটার ওপর। যেন এক ভুলে যাওয়া স্মৃতি আবার বাস্তবে ফিরে এসেছে।

জারা এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মখমলের চাদরের নিচে তার নরম নিঃশ্বাসের ওঠানামা স্পষ্ট। কপালের একপাশে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, যেমনটা পাঁচ বছর আগেও হতো। তখনও কি সে এতটাই মায়াবী ছিল?
ইউভানের ঠোঁটের কোণে একধরনের অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল যা বড়ই অপ্রতিরোধ্য, একাধিপত্যের। পাঁচ বছর আগে, এই মেয়েটা তার ভেতর এক অদ্ভুত ঝড় তুলে দিয়েছিল, প্রথম দেখায়। বুকে সেকি তীক্ষ্ণ ব্যাথা হয়েছিল ইউভাবের। অথচ একদিন হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিল দিগন্তের ওপারে। আজ, এত বছর পর, সময় যেন আবার পেছনে ঘুরে গেছে। ইউভান মুচকি হাসে। অদূরে দাড়িয়েই সে গভীর কন্ঠে বলে

” পাঁচ বছর ধরে আমি শুধু তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। কেউ একজন বলেছিল ‘যার জন্য তুমি জন্মেছ সে একদিন তোমার কাছে আসবেই।’ তুমি কি জানো আমি সেই দিনের জন্য কত প্রতীক্ষা করেছি?”

ইউভানের চোখে গভীর তৃষ্ণা, এক ভয়ংকর মোহ।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, আঙুল বাড়িয়ে জারার গালের একপাশ ছুঁয়ে দেখল। স্পর্শটা এত হালকা, যেন এই মুহূর্তটা সে কল্পনার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

“তুমি ফিরেছ” তার গলায় গভীর ফিসফিসানি।

তারপর আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেল সে। মেয়েটাকে এখনো তার ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে দিতে হবে। কিন্তু যখন সে জেগে উঠবে, তখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবে—এক বাস্তবতা যেখানে সে আর পালিয়ে যেতে পারবে না। ইউভান আর হারাতে দেবে না তার হৃদয়ের একাংশকে। ভবনটা মনে রেখেই ইউভান পা বাড়ায় অন্য এক গন্তব্যে। যাওয়ার আগে বাহির থেকে লাগিয়ে শক্ত করে লাগিয়ে দেয় দরজা।

খুব ধীর গতিতে হেঁটে হেঁটে ইউভান পৌঁছে যায় বাড়ির বেজমেন্টের লোহার দরজার নিকট।
ইউভান ধীরে ধীরে বেজমেন্টের ভারী লোহার দরজাটা খুলল। দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে একধরনের স্যাতসেঁতে গন্ধ বেরিয়ে এলো—পুরনো কাঠ, ধুলো, আর কিছু একটা, যা হয়তো সময়ের সঙ্গে পচে গেছে। নিচের সিঁড়িগুলোতে তার জুতার শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো, যেন পুরো জায়গাটার ওপর সে-ই একচ্ছত্র শাসন চালায়।

ভেতরে ঢুকতেই সোনালি আলোয় এক আশ্চর্য জগত উন্মোচিত হলো।পাঁচ বছর, সময়টা শুনতে দীর্ঘ মনে হতে পারে, কিন্তু ইউভানের জন্য প্রতিটি দিন কেবল জারার স্মৃতিতে বাঁচার আরেকটি অধ্যায়। সে ভালোবাসে নিঃশর্তভাবে, একদম নিজের সর্বস্ব দিয়ে।

বেজমেন্টের ছোট্ট ঘরটা যেন জারার অস্তিত্বের এক নীরব মন্দির। সেখানে সাজিয়ে রাখা আছে জারার ফেলে যাওয়া ছোট্ট একটি রুমাল, কখনো ভুল করে রেখে যাওয়া চুলের ক্লিপ, এমনকি একবার ব্যবহৃত একটি কফির কাপ—যেন প্রতিটি জিনিসে লেগে থাকা তার ছোঁয়া আজও উষ্ণ।

একটা দেয়ালে যত্ন করে রাখা জারার হাতে লেখা নোট, যেখানে কোনো এক ক্লাসের ফাঁকে অগোছালো হস্তাক্ষরে লেখা ছিল কিছু শব্দ, হয়তো তখন তা ছিল সামান্য, কিন্তু ইউভানের জন্য সেটাই এক অমূল্য ধন।

এই বেজমেন্ট শুধু চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ একটা জায়গা নয়; এটা ইউভানের হৃদয়ের সেই কুঠুরি, যেখানে সে জারাকে ভালোবাসার নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা বেঁধে রেখেছে। জারা হয়তো জানে না, কিন্তু তার অস্তিত্বের প্রতিটি ছাপই ইউভান নিজের আত্মার অংশ করে নিয়েছে, এক নিষ্ঠাবান আরাধকের মতো।

বেজমেন্টের দেয়ালে থাকা একটা শেলফে রাখা আছে
পুরনো লাল স্কার্ফ – জারার একসময়কার প্রিয় ছিল। কিন্তু রাগের মাথায় সেটা ছুড়ে ফেলেছিল। স্কার্ফের একপাশ এখনো ছেঁড়া।

একটা ছবি – পাঁচ বছর আগের। একটু বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো জারার মুখ স্পষ্ট। স্কুল ড্রেস পরিহিত জারা পিকনিক স্পটে বন্ধুদের সঙ্গে এই ছবিটা উঠেছিল। এটাই তো ইউভান আর জারার প্রথম দেখা। হ্যা এটাই। ইউভান সেদিন এই ছবিটা তুলেছিল জারার মোহে মোহিত হয়ে।

ইউভান ধীরে ধীরে তাক থেকে স্কার্ফটা নামিয়ে নিল। আঙুল দিয়ে সেটার ছেঁড়া দিকটা স্পর্শ করল, তারপর গভীরভাবে শ্বাস নিল—গন্ধটা হয়তো অনেক আগেই ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু তার মনে হয় এখনো সেখানে জারার অস্তিত্ব আছে।

তার চোখের গভীরে অদ্ভুত একটা শূন্যতা খেলে গেল। “তুমি যা ফেলেছিলে, আমি কিছুই হারাতে দিইনি, জারা,” সে ফিসফিস করে বলল। এরপরই ঘরময় চোখ বুলালো। বড্ড এলোমেলো এঘর। যেদিন জারা হাওয়ার মতোই উধাও হয়ে গেলো সেদিন ইউভান এখানে এসে ভাংচুর করেছে সব। তার খুব যন্ত্রণা হয়েছিল বুকে। এখন জারা ফিরে এসেছে। তারই ঘরে। নতুন করে সাজাতে হবে সবকিছু। জারা যেখানে থাকবে তার সবকিছুই হবে একদম ফিটফাট। শুভ্র, সতেজ। যেমনটা সে জারাকে প্রথম দেখায় অনুভব করতেছিল। তার কষ্টে ঘেরা অন্ধকার রাজ্যে জারা এক উজ্জ্বল জোনাকি।

.
জারার চোখ ধীরে ধীরে খুলতে না খুলতেই তার মাথার ভেতরটা যেন ঘুরে উঠল। শরীরে অস্বাভাবিক ক্লান্তি, যেন কয়েকদিন ধরে ঘুমিয়ে আছে। ধাতস্থ হতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল। চারপাশে চোখ বোলাতেই তার নিশ্বাস আটকে এল।

সে শুয়ে আছে এক অদ্ভুত সুন্দর ঘরে। চারদিকে গভীর নীল আর সোনালি অ্যাকসেন্টের খাঁটি কাঠের আসবাব, প্রতিটাই রাজকীয় কারুকার্যে মোড়া। দেয়ালে ঝুলছে দামি শিল্পকর্ম, শীতল বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে সুগন্ধি মোমবাতির হালকা সুবাস। রুমের একপাশে বিশাল জানালা, বাইরে রাতের অন্ধকারে গাঢ় সবুজ গাছের সারি রহস্যময় ভাবে দুলছে।

জারার মনে পড়ে গেল শেষ দৃশ্য—একটা ঘন জঙ্গল, ঠান্ডা বাতাস, আর আলভি। আলভির কথা মনে উদয় হতেই এক পৃথিবী ঘৃণা মনে জেগে উঠলো। সে যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারে না। সে বুঝে উঠতে পারে না আলভির কতটা নিখুঁত অভিনয় করে তাকে ঠকিয়েছে। শুধু ঠকায়নি। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। ভাবনার মাঝে জারা চমকে উঠে। মনে প্রশ্ন জাগে সেই মৃত্যুর দ্বার থেকে তাকে কে ফিরিয়ে আনলো? জারা আরো একবার গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে সবকিছু। কোন জায়গা এটা? সে বুঝে উঠতে পারে না। সামনে থাকা ড্রেসিং টেবিলে তার অবয়বের অর্ধেক প্রতিফলিত হয়ে আছে। জারা দেখে তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মাথার ওপরে স্যালাইনের প্যাকেট ঝোলানো। এমন সময়ই ঘরে প্রবেশ করে নার্সের বেশভূষার অধিকারী এক মেয়ে। হাতে একটা ট্রেতে তরল খাবার। জারা তাকে দেখেই অস্থির চিত্তে জানতে চায়

” এটা কোন জায়গা? ”

” ব্যারিস্টার ইউভানের বাসা।”

” উনি কে?”

মেয়েটা যেন অবাক হয় এ প্রশ্ন শুনে। তবে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। শুধু বলে

” আপনি অসুস্থ। দু’দিন অচেতন ছিলেন। আপনার পেটে একটা বাচ্চা ছিলো। দেড় মাস। বাচ্চাটা মা*রা গেছে। অপারেশন করা হয়েছে। ”

জারার পৃথিবী যেন ওলোট পালোট হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে যায় সে মুহূর্তের মাঝে। আপনা আপনি হাত চলে যায় নিজ পেটে। চোখ থেকে গড়িয়ে পরে এক ফোঁটা অশ্রু। নার্স মেয়েটা বেডসাইডের টেবিলে খাবার রেখে প্রস্থান করে। বলে যায়

” স্যালাইন শেষে খাবেন ”

জারার কান অব্দি এ কথা পৌঁছায় না। সে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তীব্র হতে তীব্রতর হয় ঘৃণা। যার সবটাই জমে আলভি নামক পশুর ওপর। জারা বুঝতে পারে, জীবনে অনেক ভুল হয়, কিন্তু আলভিকে ভালোবাসাটা ছিল তার সবচেয়ে বড় ভুল।একটা এমন ভুল, যা কেবল হৃদয় নয়, পুরো অস্তিত্বকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বিশ্বাসের বিনিময়ে প্রতারণা আর ভালোবাসার বদলে আঘাত পাওয়ার পর, সে উপলব্ধি করে যে আলভির প্রতি তার অনুভূতিগুলো আসলে নিজের সর্বনাশের পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

চলবে…..