#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৭
জারার কথার পিঠে ইউভান চুপচাপ জারার দিকে তাকিয়ে রইল। তার গভীর দৃষ্টির ভেতর এক ধরনের অদ্ভুত স্থিরতা। জারা ব্যাতিত অন্য কোনো নারী সে দৃষ্টি দেখলে ভেতর থেকে কেঁপে উঠতো। হৃদ কোঠায় স্থাপন হতো সেই দৃষ্টি প্রেম সুর নিয়ে। তবে জারা এই দৃষ্টিতে খুজতে ব্যাস্ত একটা অস্বাভাবিকতা৷
ইউভান হাসলো। গা দুলিয়ে তবে নিশ্বব্দে। জারার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অগোছালো চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলল
” খেয়ে নেবে এগুলো। ভালো লাগবে। ”
জারা এক মুহূর্ত থমকে গেল। প্রথম দেখায় তুমি? পরমুহূর্তেই মনে হলো বয়সে বড় বলতেই পারে।
ইউভান দরজার দিকে এগোলো। বেরোনোর আগে হঠাৎ থেমে গেল কিছু সময়ের জন্য । চোখ বোলাল জারার ওপর।
তার গায়ে ঢিলেঢালা একটা টপস, যা পরিষ্কারই নতুন। ইউভানের মনে পড়ে গেল, জারাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পরই এটা কেনা হয়েছিল। নার্সরা পেরিয়ে দিয়েছে ওকে। এই ভাবনাটাই তার গা জ্বলে উঠল।নার্সরা ছুঁয়েছে জারাকে!ভ্রু কুঁচকে গেল ইউভানের। ভেতরে কোথাও তীব্র অসন্তোষ জন্ম নিল। জারাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু তার—শুধু ইউভানের! অন্য কেউ জারাকে ছুঁবে, তার জন্য কিছু করবে, এটা একদমই সহ্য হয় না।একটা গুমোট অনুভূতি নিয়ে সে দরজা খুলল, বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ইউভানের এমন ব্যাবহারে জারা গায়েবি সংকেত পেলো। সংকেতের রং কমলা রঙের। পুরোপুরি বিপদ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হঠাৎ করে এই রং লালও হতে পারে। কেন যেন এবাড়ির প্রতিটি জিনিস তার অদ্ভুত লাগে। সঙ্গে এখন জিনিসের মালিককেও অদ্ভুত লাগছে।
.
জারা দরজায় পরপর কয়েকবার নক করার শব্দ শুনে একটু চমকালো। ইউভান তো মাত্র আধ ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে গেছে, তাহলে আবার কে? দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলতেই তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। দরজার ওপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মেয়ে—সবাই পরিপাটি পোশাকে, শার্ট-কোর্ট-প্যান্ট পরা। প্রথম ঝলকেই মনে হলো তারা কেউ সাধারণ কাজের লোক নয়, বরং গার্ডের মতো। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তাদের প্রত্যেকের হাতেই বিশাল বিশাল প্যাকেট। কেউ ধরে আছে শাড়ি, কেউ গাউন, কেউ চুরিদার, কেউ বা আবার দামি ওড়না আর নকশাদার গহনার বাক্স। এমনকি চুল সাজানোর জন্য খোঁপা ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রও আছে! জারা কিছুক্ষণের জন্য পুরো দৃশ্যটা বুঝে উঠতে পারল না। এত কিছু! এত মানুষ! যেন কোনো রাজকীয় আয়োজন! কিন্তু সে তো এখানে অতিথি মাত্র। তাহলে?এক মুহূর্তে মনে হলো হয়তো মেয়েগুলো ভুল দরজায় এসেছে। একটু হেসে সে নম্র স্বরে বলল,
“আপনারা হয়তো ভুল করে এখানে এসেছেন। আমি আসলে…”
কিন্তু বাক্য শেষ করার আগেই মেয়েরা হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়ল। যেন এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। জারা হতভম্ব হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। তাদের একজন, যাকে বাকিদের তুলনায় নেতা টাইপের মনে হলো, সামনে এসে শান্ত স্বরে বলল,
“এগুলো আপনার জন্যই অর্ডার করা হয়েছে।”
জারা বিস্ময়ে চোখ কুঁচকালো। তার জন্য? কিন্তু কে করল এসব? মনে মনে একটাই নাম ভেসে উঠল— ইউভান নামের ছেলেটা? সে ছাড়া অবশ্য এবাড়িতে আর দ্বিতীয় কাউকে দেখেনি জারা।
জারার ভাবনার মাঝেই মেয়েগুলো একে একে সব বাক্স, পোষাক রেখে প্রস্থান করলো। জারা কিছু সময় দরজার হাতল ধরে ওভাবেই দাড়িয়ে রইল। যেন সে প্রতিমার ন্যায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। চোখের পলকও পরছে না তার। একটু পর রয়ে সয়ে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে। সে দ্বিধায় পড়ে গেল। প্যাকেটগুলো একটার পর একটা খুলে দেখল—সব কিছুর মধ্যেই রাজকীয়তা লুকিয়ে আছে। দামি শাড়ি, মনোমুগ্ধকর গাউন, একদম মাপমতো চুরিদার—এগুলো যেন যেকোনো মেয়ের স্বপ্নের পোশাক! আর গহনার বাক্স খুলতেই জারার ঠোঁট উল্টে উঠলো। একবার দরজার পানে তাকিয়ে বিরবির করে বলল
” অতিথি আপ্যায়ন? নাকি কোনো রাজ্যের রাণীকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে? ”
সোনালি কারুকাজ করা নেকলেস, দুল, চুড়ি, এমনকি খোঁপার কাঁটা পর্যন্ত রাখা হয়েছে! সব কিছু এত নিখুঁতভাবে সাজানো যে মনে হচ্ছিল, এগুলো যেন তার জন্যই বানানো হয়েছে। জারা সবকিছু পরখ করে ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো বিছানায়। কমলা রঙের সিগনালের রং পাল্টাচ্ছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা অদ্ভুত। তার কর্মকাণ্ডও অদ্ভুত হওয়ারই কথা। মনে হচ্ছে না এসব বিপদের সংকেত। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই গেল—সে কি এগুলো পরবে? জারা প্রশ্নের পিঠে জবাব তৈরি করলো, কখনো না। কোনো আগ্রহ নেই তার। ছন্দ হারিয়ে ফেলা জীবন নিয়ে সে এখন অন্ধকারে আছে। তার জীবনের একটাই লক্ষ। মাথায় এখন একটাই চিন্তা। আলভি! আলভিকে মুখোমুখি পেলে সে কি করবে তা নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নেই। তবে এটা নিশ্চিত জারা, সে কখনো দুর্বল হবে না। পূর্বের সেই ভালোবাসা এখন দ্বিগুণ হয়ে ঘৃণায় রূপ নিয়েছে।
.
আকাশের গায়ে সন্ধ্যার শেষ আলোর রং মিশে ধীরে ধীরে নীলচে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছিল। গাছের পাতাগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে বাতাসের নরম ছোঁয়ায় আলতো দুলছিল। পাখিরা একে একে তাদের কোলাহল থামিয়ে নীড়ে ফিরছিল।
পুব দিকের দিগন্তে ধীরে ধীরে চাঁদ উঁকি দিল।তার সাদা আলো চারপাশের ধোঁয়াটে অন্ধকারকে আরও রহস্যময় করে তুলল। দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডেকে উঠল।সারা বাড়িতে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। জারার শরীর শীতল হাওয়ার স্পর্শে কেঁপে উঠলো। এবাড়িটা তার বড্ড অদ্ভুত লাগে। বড্ড! এ রাতের সমাপ্তি হলেই সে চলে যাবে এখান থেকে। এই ভাবনা জারাকে স্বস্তি দিলো। এমন সময় পেছন থেকে ডেকে উঠল নার্স। জারার দিকে তার হাতের ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল
” তোমার বোন ফোন করেছে। ”
জারা দ্রুত হাতে নিলো। উপমা তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে জানালো কাল দশটায় জারাকে কোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে। জারা জানালো সে থাকবে। উপমা ফোন কাটলে জারা নার্সকে ফিরিয়ে দিলো তা। এর একটু পরই জারার দরজায় এসে দাঁড়ালো অল্প বয়সী এক খানসামা, মাথা নিচু করে বলল,
” আপনার রাতের খাবার তৈরি। প্লিজ আসুন।”
জারার যেতে ইচ্ছা করছিল না। পেটে ক্ষুধা নেই। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিল সে, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজার দিকে পা বাড়াল। খাবার টেবিলে ইউভান ছিলো না। জারা স্বস্তি বোধ করে। হরেক পদের খাবার থেকে কেবল সাদা ভাত আর এক টুকরো মাংস দিয়ে নিজের খাওয়া চালিয়ে নেয় সে। অতঃপর খানসামা কে বলে সো ইউভানের সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। ছেলেটা জারাকে লিভিং রুমের ডিভানে বসিয়ে চলে যায়। একটু পর ইউভান আসে। জারার মুখোমুখি বসতেই জারা শুরু করে
” আপনাকে আসলে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানি না। আমার জন্য অনেক ঝামেলা হয়তো আপনাকে পোহাতে হলো। আমি আর ঝামেলা দিতে চাই না আপনাকে। কাল আমি চলে যাবো। আপনার সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না।”
ইউভানের চোয়াল অনেক আগেই শক্ত হয়ে গেছে, যখন জারা বলেছিল সে চলে যেতে চায়। তার মধ্যে যেন কিছু ভেঙে পড়েছিল।আর তা সহ্য করা ছিল তার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা সহ্য হয়নি, তা ছিল যখন জারা বলেছিল—আর কখনো দেখা হবে না।
হঠাৎ, তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় ইউভান। তার চোখে তীব্র ক্ষোভ আর পাগলামি। যেন এক মুহূর্তে তার সমস্ত পৃথিবী তছনছ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ বেগে সে ডিভানের কাছে এসে দাঁড়ায়।জারার দুপাশে শক্ত করে হাত রেখে যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তাকে আটকে দেয়।
“চলে যাবে, মামে?”
ইউভান কণ্ঠে এক ধরনের শাসকত্ব নিয়ে বলে
“তুমি কোথাও যেতে পারবে না। তুমি আমার ভালোবাসার মধ্যে আটকে আছো। তুমি আর কখনো আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না। এখানে, শুধু এখানে থাকবে তুমি।”
জারা চমকে ওঠে, তার দেহ খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ইউভানের দিকে, যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা আর অবিশ্বাস ভরে ওঠে, কিন্তু ইউভানের কথা যেন তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি তার আচরণ, যেন একটা গভীর অন্ধকারের মতো তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
চলবে……