ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-১০

0
21

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১০

জারার ভীষণ রাগ হলো। এতোটাই রাগ যে জারা সুফিয়ার মামাতো বেনকে ঝাড়ি দিয়ে ঘরের বাহিরে বের করে দিলো। তার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটা এলোমেলো করে ফেলল। জানালার পর্দা টেনে ছেড়ার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে অতঃপর বসে পরে বিছানায়। ইউভান তো ঘরবন্দী আর কড়া পাহারার ব্যবস্থা করে দিয়েই লাপাত্তা। কোথাও একটা গেছে হয়তো। জারা ভেবে পায় না ছেলেটা সুস্থ নাকি অসুস্থ। একটা সুদর্শন, রাজার মতো জীবনযাপন করা ছেলে কিনা জারার প্রেমে পরেছে? যে বিবাহিত এবং সন্তান সম্ভাবা ছিলো! এমন মেয়ের প্রেমে পড়া সত্যিই সম্ভব? জারার মনে হয় ইউভান পাগল। একেবারে আগায় গোড়ায় পাগল।

.
জঙ্গলের ভেতর সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের কমলা আলো মাটিতে ঝিলমিল করছে, তবে সেটাও দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ক্রমশ বাড়ছে, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে এক অজানা উত্তেজনায়।

ইউভানের মুকটা জলজল করছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল জিজ্ঞাসা। ঠোঁট দাঁতে চেপে ধরে, হাতের গ্লাভস পরা আঙুলগুলো ব্যস্তভাবে মাটির ওপর কিছু খুঁজে ফিরছিল। গলায় ঝুলে ছিল ক্যামেরা। ইতিমধ্যে তাতে বন্দী করা হয়েছে কিছু রক্তের ছোপ। যা পড়ে ছিল মাটিতে। শুকিয়ে গেছে। আমাদ ফোনের ফ্লাশ জ্বালালো। ইউভান নামলো খাদটায়। সেখানে বেশ রক্ত শুকিয়ে জমে আছে শুকনোপাতায়। ইউভান এটারও ছবি তুলে নেয়। অতঃপর কিছু রক্তমাখা পাতা ও মাটি সংরক্ষণে রাখে। এগুলো যে জারার রক্ত তার প্রমাণ আদালতে তাকে দিতে হবে।

আরো কিছু সময় ইউভান পর্যবেক্ষণ করলো জায়গাটা। ভাবলো কিছু অতঃপর হঠাৎ করে আমাদ কে বলল তার একটা কাজ আছে। আমাদ যেন দ্রুত বাসায় ফেরে আর তাকে অবগত করে জারার বিষয়ে। আবার যদি জারা বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় তাহলে সে প্রথমেই আমাদ এর প্রাণে হাত দেবে।

.

ঘরজুড়ে গাঢ় অন্ধকার। জানালার বাইরে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলো একরকম নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। নীরবতা এত গভীর যে মাহার নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।আলভি নিঃশব্দে মাহার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও—জারার ফিরে আসার ভাবনায়। সেই ভাবনাই যেন একটা অদৃশ্য আতঙ্ক হয়ে বুকের ওপর চেপে বসেছে।হঠাৎ মাহা মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। অন্ধকারেও তার চোখে ধরা দেয় আলভির ভয়। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

“চিন্তা কোরো না, আমাদের উকিল এই শহরের সবচেয়ে বড় উকিল। উনি সব সামলে নেবেন। আর টাকা আছে আমার। এসব কোনো বিষয় না।”

আলভি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কথাগুলো শুনতে শক্তিশালী লাগলেও, তার মনে হচ্ছিল এই আশ্বাসের পেছনে একটা গভীর শূন্যতা আছে। আলভির ভয় হয়। জারাকে এখন তার ঠিক ঝড়ের মতোই মনে হচ্ছে। যেন জারা এসেছে সবকিছু শেষ করে দিতে। আর ইউভান? কেন যেন ওই ব্যারিস্টারকে আলভির অন্যরকম লেগেছে। জারার পানে তাক করা তার অন্যরকম দৃষ্টি আলভির চোখ এড়ায়নি। আলভির ভাবনার মাঝেই মাহা ঘুমিয়ে পরে। আলভির বুক ঢিপঢিপ করছিল অজানা কারণে। হঠাৎ আচমকা তার চোখ এমন কিছু দেখে যা তার মস্তিষ্ককে সেকেন্ড দুয়েকের জন্য যেন অবশ করে দেয়। বেলকনির গ্রিলের সঙ্গে ঠেস দিয়ে কে যেন দাড়িয়ে আছে। এক হাত তার পকেটে। অন্য হাতে ধরা আছে একটা হকি স্টিক। ধীর গতিতে তা পুরুষ অবয়ব বাম থেকে ডানে দোলাচ্ছিল। তার পায়ের পাতায় হালকা করে বাড়ি খাচ্ছিল। আলভি উঠে বসে দ্রুত। লাইট অন করার জন্য এগিয়ে যেতে চাইলে ছেলেটাই অগ্রসর হয়। হকি স্টিক দিয়ে রাস্তার ল্যামপোস্টের মৃদু আলোয় আলভির ভয়ার্ত মুখটা উঁচু করে ধরে। মুখে বলে

” ” The hockey stick wants to romance with you, Alvi. Are you ready?”

আলভি এমন কথার আগামাথা কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারে না। ছেলেটা মাথা এক পাশে কাত করে কিছু সময় নিশ্চুপ রইল। অতঃপর হঠাৎই সে আলভির মুখে সজোরে একটা আঘাত করলো। ব্যাথাতুর ধ্বনি বেরিয়ে আসে আলভির মুখ থেকে। ছেলেটা বা গালে আরো একটা লাগিয়ে দেয়। এরপর আলভির পিঠে, হাতে এলোপাতাড়ি পিটুনি। মাহা যেন তখন অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা। তার কানে পৌঁছায় না আলভির চিৎকার। কিকরে পৌঁছাবে? তারা তো একটু আগে বার থেকে ফিরেছে। আলভি ততটা না খেলেও মাহা গলায় ঢেলেছে বাজে পানি বেহিসাবি ভাবে।

আলভি ব্যাথায় ছটফট করে বিছানায় লুটিয়ে পরে। অজ্ঞাত পুরুষ হকি স্টিক কাঁধে রেখে আলভির কানে ফিসফিস করে বলে

” আই ক্যান নট বেয়ার মাই কুইনস পেইন। দ্বিতীয় বার জারার ক্ষতি করার চিন্তাও যদি করিস তাহলে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দিয়ে দেবো।”

কথাটা বলেই হেলতে দুলতে বেরিয়ে যায় সে। আলভির আড়ালে একঝলক নিয়নের আলো ছুয়ে যায় তার মুখাবয়ব। দেখা মেলে কালো শার্টের উজ্জ্বল চেহারার। পথঘাটের নিস্তব্ধতা যেন চিনে ফেলে এটা ইউভান। তার হাঁটার ধরনে রাজকীয় ভাব। এমন একটা কান্ড করার পরও ভয়ের কোনো ছিটেফোঁটা নেই মুখে।

.
হাঁটতে হাঁটতে ইউভান চলে আসে একটা ব্রিজের ওপর। হকি স্টিক ছুড়ে ফেলে সে পানিতে। হালকা শীতল বাতসে গভীর করে নিশ্বাস নেয়। হঠাৎই কতগুলো ভাবনা তার মাথায় ভর করে। চাদের পানে তাকিয়ে থাকে ইউভান একদৃষ্টিতে। ব্রিজের রেলিং এ কনুইয়ের ভর করে সে হালকা ঝুঁকে তাকিয়ে থাকে নদীর শান্ত জলে। একসময় সে এই ব্রিজ থেকে লাফিয়ে নিজের জীবনের ইতি টানতে চেয়েছিল। একের পর এক বিষাক্ত মুহূর্ত তাকে ভেতর থেকে জ্বালিয়ে দিতো৷ ইউভানের মনে পড়ে কাম্য-মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়তে চেয়ে ব্যার্থ হওয়ার পরের ঘটনা। ডাক্তার বলল ইউভানকে সময় দিতে হবে পরিবারের। বাবা ইউভান ও ইকরাকে নিয়ে চলে গেলেন নাটোরের গ্রীন ভ্যালিতে। বাবা, ইকরা আর ইউভানের দু’জন ফুফু ও তাদের পরিবার আনন্দ করছিল। তবে ইউভানের দৃষ্টিতে ছিল একই শূন্যতা। বুকে একই ব্যাথা আর মাথায় মৃত্যুর চিন্তা। কোনো কিছুতেই যেন তার ভালোলাগা ছিল না। গ্রীন ভ্যালির মনোমুগ্ধকর বাহারি ফুলও তার হৃদয় ছুতে পারেনি। পৃথিবীকে নিয়ে জন্ম দিতে পারেনি নতুন আগ্রহ। ভার্সিটি পড়ুয়া ইউভানের কাছে তাদের এমন আনন্দ আদিখ্যেতা বলেই মনে হয়েছিল। সে বাইরে এসে নিজ গাড়িতে বসে পড়ে।

আর ঠিক তখনই, তার চোখে পড়ে একটি ষোড়শী কন্যা। হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, যেন কোন এক অসম্ভব আনন্দে পূর্ণ। তার হাসি ছিল অসাধারণ। যেন পৃথিবীকে জয় করার মতো। সে কোনো কিছু নিয়ে হাসছিল, কিন্তু ইউভান জানত না কী। তবে, তার হাসি যেন ভেতরে কোথাও একটা শূন্যতা পূর্ণ করে দিয়েছিল।
এমনকি তার হাসির মধ্যে এমন কিছু ছিল যা ইউভানকে প্রথমবারের মতো জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। তার মাঝে এমন এক শক্তি ছিল, যা তাকে আকর্ষণ করেছিল—কোনো এক অজানা টানে। এটাই ছিল প্রথম প্রেমের অভ্যর্থনা। ইউভান নিষ্পলক তাকিয়ে দেখেছে। তার শুষ্ক ঠোঁটে ক্রমে ক্রমে হাসি ফোটে। মলিন চাহনি জীবন্ত হয়। বুকের হৃদপিণ্ড যেন নতুন সুরে স্পন্দন করে। ইউভান বুকে হাত রাখে। অতঃপর তার মনে হয় মেয়েটা চোখের পলকে তার বুকের খাঁচার দ্বার শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছে। যেন সেখানে মেয়েটা একাই রাজত্ব করবে। ইউভান এমন ভাবনা ভেবে বুকে দৃষ্টি রাখে। এরপর আবারও সামনে তাকাতেই চমকে ওঠে। তার চোখ মুখ শুকিয়ে যায়। কষ্ট হয়। চাতক পাখির মতো তার দৃষ্টি ছোটাছুটি করে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে সে। অনেক খোঁজে। অস্থির চিত্তে ছোটাছুটি করে। তার মন তাকে বলছিল ‘ইউভান আর একটি বার দেখতে চাই তাকে।’

ইউভান দেখা পায় অতঃপর। এরপর? এরপর ইউভান কিভাবে কিভাবে যেন খুঁজে বের করে মেয়েটাকে। তার বাসায় অব্দি পৌঁছায়। একটা সময় জানতে পারে মেয়েটার নাম ‘জারা’। ইউভান একটি বার দেখার জন্য দাড়িয়ে থাকে রাস্তায়। এভাবে দিন গড়ায় আর ইউভানের মনে হয় জারাকে সে প্রতিদিন দেখতে চায়। কিন্তু প্রতিদিন দেখত হলে তাকে বাঁচতে হবে। হ্যা বাঁচতে হবে। হাল ছেড়ে জীবনকে অবসরে পাঠানো যাবে না।

ইউভান এক নতুন জীবন শুরু করে। হঠাৎ ইউভানের এমন পরিবর্তনে বাবা খুশি হলেন ঠিকই। কিন্তু বুদ্ধি আঁটলেন অন্যরকম। ইউভানের স্নাতক যেহেতু শেষের দিকে তাই তিনি LLB. করার জন্য ইউভানকে পাঠাতে চান বিদেশে। কিন্তু তখন ইউভান যাবে না তার জারাকে ফেলে। সে বিদেশে চলে গেলে তার বুকের মরুভূমিতে বৃষ্টি আসবে কিভাবে? তা তো খরায় খরায় ফেটে চৌচির হবে। কিন্তু ভাগ্য যেন এটাই চেয়েছিল। ঠিক চেয়েছিল? নাকি পরীক্ষা নিয়েছিল ইউভানের ভালোবাসার? কে জানে! হঠাৎই আর জারাকে সেই শহরে খুঁজে পায় না ইউভান। হঠাৎ উধাও সে। ইউভান আবারও ভেঙে পরে। তার মানষিক অবস্থা পূর্বের চাইতে অনুন্নত পর্যায়ে চলে যায়। তার বাবা আরৃান শাহ তখন একপ্রকার জের করে তাকে পাঠিয়ে দেয় বিদেশে। এরপর ঘুমের ওষুধ আর মাঝে মাঝে যখন ইউভানের পাগলামি বেড়ে যেতো দেশে আসার তখন লাঠির আঘাত। এই দুই অস্ত্র দিয়ে তাকে থামিয়ে রাখা হতো। ইউভানকে এরপর তার ফুফু বোঝায় সে এলএলবি শেষ করলেই তাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে। সে না হয় তখন তার জিনিস খুঁজে নেবে। এভাবে পাগলামি করলে কি তার পড়ালেখা শেষ হবে? আরো বাঁধা পরবে সে এখানে। কথাটা ইউভানের মাথায় গেঁথে যায় বেশ ভালোভাবে। এরপর পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করে সে দেশে ফেরে।

ইউভান যখন তাকিয়ে ছিল অপলক নদীর নীরব জলে তখনই হঠাৎ তার মুঠোফোন চিৎকার করে। স্ক্রিনে ভাসে ‘আদৃত’ নাম। ইউভান রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে আদৃত জানায়

” তোর সঙ্গে আর্জেন্ট কথা আছে। তোর বাসায় আমি। একটা কেইস নিয়ে কথা বলবো।”

ইউভান ফোন কাটে। হাঁটা দেয় সে বাসার দিকে।

.
লিভিং রুমে বসে অপেক্ষায় থাকা আদৃত ঘড়ির কাঁটায় দৃষ্টি স্থির রেখেছিল। হঠাৎই কারো পায়ের শব্দে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে চায়। জারা চোখ মুখ কুঁচকে কিচেন থেকে ফিরছিলো। হাতে তার এক কাপ কফি। তাতে মেশানো আছে পাঁচ চামচ লবণ। স্বইচ্ছায় জারা এমন কাজ করেছে। এ কফির মগ বরাদ্দ ছিল ইউভানের জন্য। জারা ইচ্ছে করে শেফকে সরিয়ে নিজে বানিয়েছে। তবে কফির মগ নিয়ে সে ডিভানের নিকট যেতেই আদৃত পিছন ফিরে চায়। জারার মুখটা শুকিয়ে আসে। মনের ভাবনার উল্টো চিত্র একের পর এক তৈরি হয় মস্তিষ্কে। এমন সময় আদৃত মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করে

” আরে আপনি? এখানেই আছেন?”

চলবে….