ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-১১+১২

0
13

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১১

আদৃতের ঠোঁটে মুচকি হাসি। চোখে যেন রহস্য ধরে ফেলার ঝলক। জারা পড়িমরি করে জবাব দেয়

” না স্যার, আসলে…… ”

” আসলে?”

আসলে আসল কি তা যেন জারার নিজেরই অজানা। সে এই মুহূর্তে এখানে সহকারী জজ আদৃত কে প্রত্যাশা করেনি। ভেবেছিল ইউভান এসেছে। জারা নতজানু হয়ে জবাব দিলো

” ব্যারিস্টার ইউভানের কাছে আমিও একটা কাজে এসেছি। ”

আদৃত মাথা ঝাঁকাল। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে সে এমন কথা বিশ্বাস করেনি।

” সেদিন তো গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দিলেন। একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেননি। আজ কি কফি দিয়ে অভিনব কায়দায় ধন্যবাদ দেবেন?”

জারা ঘাবড়ে গেলো।এই কফি? কথার মাঝেই আদৃত উঠে দাঁড়ালো। জারার নিকট গিয়ে হাত বাড়ালো কফির দিকে। তবে তা ছোঁয়ার আগেই যেন চিলের গতিতে আগমন ঘটল ইউভানের। সে ছো মেরে কফি নিজ হাতে উঠিয়ে নিয়ে গরম চোখে চাইলো জারার পানে। অতঃপর আদৃতের উদ্দেশ্যে বলল

” আমার রুমে যা। লিভিং রুমে বসে কে কথা বলে?”

আদৃত হতবাক হলো না একটুও। সে ছোট করে ‘ওকে’ বলে চলে গেল ইউভানের রুমে। ইউভান তৎক্ষনাৎ জারার ওড়নায় হাত রাখলো। জারা চমকে উঠলো। সে বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ইউভানকে। মুহূর্তে তার চোখে জমল রাগ। তবে ইউভান কি পরোয়া করার ছেলেটা? সে দ্বিগুণ বেগে এগিয়ে গেলো। জারার ওড়না ভালোভাবে পেচিয়ে দিলো জারার গায়ে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে তা পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে দিল। গলা এঁটে এল জারার। ইউভান বলতে ব্যাস্ত

” বাইরে বের হওয়ার সময় এইভাবে বের হতে হয়। নেক্সট টাইম মাথায় এইরকম করে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে বের হবা৷ ”

কথাটা বলেই সে কফির মগে এক চুমুক দিয়ে ঘরের পানে পা ফেলে। জিহ্বা স্পর্শ করে কফি গলনালিতে পৌঁছানোর আগেই মনে হল প্রবল আন্দোলনে গরম কফি বেরিয়ে আসতে চাইলো মুখ থেকে। ইউভান ভ্রু কুঁচকে ঘুরে চাইলো জারার পানে। জারা হাসলো। যেন বুঝিয়ে দিল মাত্র এটা শুরু হলো। সামনে অনেক কিছুই হয়তো অপেক্ষা করছে। তবে জারাকে অবাক করে দিয়ে ইউভান গিলে ফেলে মুখের নোনতা কফি। পরপর আবারও দু চুমুক দেয়। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় কফি সুস্বাদু। জারা অবাক নয়নে তাকায়। ইউভান শব্দহীন একটা হাসি দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। জারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

.
” কোন কেইসের বিষয়ে কথা বলবি?”

” তোর বোনের আর আমার। ”

” আমি এখানে ইন্টারফেয়ার করতে পারবো না।”

” তোকে বলছি না ইন্টারফেয়ার করতে। যেখানে ইকরা আর আমি দু’জনেই তৈরি ডিভোর্সের জন্য সেখানে বাইরের কারো কথায় মত বদলানোর প্রশ্নই আসে না।”

” ওকে”

এরপর নীরবতা। আদৃত বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ইউভানের পানে। এরপর রয়ে সয়ে বলে

” ডিভোর্স নেয়াটা কম্পলিকেটেড হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তুই কি কোনো সমাধান দিতে পারবি?”

” উঁহু।”

আদৃত উঠে দাঁড়ায়। নিজের ওপর রাগ হয়। ভেবেছিল ইউভান অন্তত এমন সময়ে তার অথবা ইকরার পাশে থাকবে। কিন্তু না। সে এখনও আগেরই মতো আছে। আদৃত গটগট করে চলে আসতে চায়। ইউভান পেছন থেকে বলে ওঠে

” নেক্সট টাইম এখানে কোন আশা নিয়ে আসিস না। আর যদি বউয়ের কথা মনে পড়ে তাহলে সরাসরি তোর বউয়ের রুমে যাবি।”

আদৃত কথা বাড়ায় না। সে চলে যায়। জারা আদৃতের রক্তিম মুখ দেখে দুঃখ প্রকাশ করে। কি হয়েছে সে জানে না। কিন্তু তার ভাবতে খারাপ লাগে আজও সে আদৃতকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারলো না। সে যদি গতকাল ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে গেইটের কাছে হাজির না হতো আর জারাকে কোর্ট অব্দি পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছে পোষণ না করতো তবে হয়তো জারার কোর্ট পর্যন্ত পোঁছাতে পৌঁছাতে বিচারকার্যই শেষ হয়ে যেত।

.
ছাদ বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের তারাভরা আকাশ দেখছিল ইকরা। চোখে ছিল একরাশ শূন্যতা। মন কুঠুরিতে আনাগোণা ছিল প্রিয় মানুষটার৷ পেরিয়ে আসা দিনগুলো কতই না মধুর ছিল। কোনো এক দমকা হাওয়া আকস্মিক দু’টো হাতকে আলাদা করে দিলো। সেপারেশন তৈরি হলো। এখন কিনা তা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াবে। ভাবতেই বুকে ব্যাথা হয়। মনে জমে থাকা অভিমানের পাল্লা ভারি হয়ে ওঠে। ইকরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে, এই শহরের বাতাসেই তার প্রিয়র অস্তিত্ব মিশে আছে। একই আকাশের নিচে তারা অবস্থান করছে কিন্তু ছুঁতে পারছে না একে অপরকে। আচ্ছা আদৃতের কি একটুও মনে পড়ে না ইকরার কথা? একটুও না? ভাবনার মাঝেই ইকরার চোখ আঁটকে যায় বাড়ির গেইটে। আদৃতের অস্তিত্ব! হ্যা আদৃতই হেঁটে যাচ্ছে গাড়ির নিকট। ক্ষনিকের জন্য ইকরার মুখে হাসি ফোটে। তবে তা সেকেন্ড দুয়েক পরই বিলীন হয়। হঠাৎ মনে পড়ে আদৃত চলে যাচ্ছে। সে এসেছিল এখানে। কিন্তু ইকরার কাছে নয়। মুহূর্তেই ইকরার মন পাথরে পরিণত হয়। সে বুকে কয়েকটা আঘাত করে। হাত মুঠ পাকিয়ে আঘাত করে ব্যাথা আর যন্ত্রণা প্রশমিত করার চেষ্টা করে।

.
সকাল সাতটা। জারা দাড়িয়ে ছিল বিশাল জানালার পাশে। তার কক্ষের পর্দা পাল্টে ফেলা হয়েছে। ঘরময় এখন সাদা ও নীল রঙের সমাহার। আসবাবপত্র সব নীল করা হয়েছে। প্রশান্তির এক ছায়া পিছু পিছু ঘোরে জারার। কিন্তু ছুঁতে পারে না তা।

” ম্যাম, আপনি কি মর্নিং ওয়াক করতে চান? আপনার ড্রেস রেডি আছে। ”

জারার দৃষ্টি ছিল বাড়ির বাহিরে। যেখানে ইকরা দৌড়াদৌড়ি করছিল।

” লাগবে না আমার। কিন্তু আমি একটু বাগানে যাব।”

রিয়া পিছু নেয় জারার। বাগানে গিয়ে তারা হাঁটতে লাগে। জারা ঘুরে দেখে চারিপাশ। তার মন খুঁজে বেড়াচ্ছিল ফাঁক ফোকর। সে ম্যাপ তৈরি করতে চাইছিল এখান থেকে পালানোর।

” তুমি জারা?”

হঠাৎ একটা রিনরিনে কন্ঠ কানে বাজে জারার। সে পেছন ফিরে চায়। ইকরা দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের ছোঁয়া। জারা সরু কন্ঠে বলে

” হ্যা”

” ইউভানের সাধনা।”

অস্পষ্ট ছিল কথাটা। জারার কানে পৌঁছায় না। ইকরা কপালের ঘাম মুছে বলে

” তুমি কি জানো ইউভান একটা সাইকো? ও নিজের মা’কে মেরেছে? ”

জারার বুক কেঁপে ওঠে। চোখ জোরা গোল হয়। সে অবাক দৃষ্টিতে চায় ইকরার পানে। ইকরা ভীষণ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে

” এখানে থেকো না৷ ও কিন্তু ভালো না। আস্ত পাগল। হতে পারে তোমাকেও ওপরে পাঠিয়ে দেবে। রাগ উঠলে কি করে না করে নিজেও জানে না।”

কথাটা বলে ইকরা শান্ত দৃষ্টিতে চায় জারার পানে। রিয়া মেয়েটা তখন ইতস্তত করে ইকরার বিরুদ্ধে আওয়াজ দেয়

” ম্যাম, আপনি যা-তা বলে জারা ম্যামকে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। আর নিজের ভাই সম্পর্কে আপনি এসব কথা কিভাবে বলতে পারেন?”

ইকরা শান্ত দৃষ্টিতে চায় রিয়ার পানে। তবুও সেই দৃষ্টি বুক কাপিয়ে দেয় রিয়ার। সে নতজানু হয়ে যায়। ইকরা এরপর জারার পানে এক পলক চায়। বলে

” জানিয়ে রাখলাম। নিজের ভাইয়ের কাজকর্মের অভিশাপ অল্প হলেও আমার ওপর আসে তো তাই।”

কথাটা বলেই ইকরা পা বাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই আচমকা শব্দ হয় দুম করে। যেন মাটিতে কিছু পরলো। সকলে একযোগে ওপরের দিকে তাকায়। ইউভান পকেটে হাত রেখে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে ইকরার পানে। সে আরো একটা ব্যাগ ফেলে। অতঃপর আরো একটা। ঝনঝন শব্দ হয়। ইকরার চোখ মুখ লাল হয়ে আসে। মাটিতে ফেলা ব্যাগ থেকে অর্ধেক কাপড় বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ঘাসের ওপর। জারা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ইকরা কঠিন সুরে বলে

” তুই আমার রুমে কেন? তোর সাহস কিভাবে হয় আমার রুমে গিয়ে আমার জিনিস ফেলে দেওয়ার? ”

ইউভান শান্ত কন্ঠে বলে

” আজ থেকে এই এপার্টমেন্টও আমার। বাসা থেকে বের হ। আমি ঘরে নাগিন রাখি না। তুই আমার সংসার গড়ার আগেই গুড়িয়ে দিচ্ছিস। তাই তোকে বাসা থেকে বের করে দিলাম। টেক দা ব্যাগ এন্ড গেট আউট।”

ইকরা ফুসে ওঠে। সে চোখে দাবানলের অগ্নি ধারণ করে রিয়ার পানে তাকায়। রিয়া তখন কানে হাত দিয়ে ব্লুটুথ চেপে ধরে। বলে ওঠে মিনমিন করে

” ইট’স মাই ডিউটি।”

ইকরার বুঝতে বাকি থাকে না রিয়া কোনো এক সময় তার অগোচরে ইউভানকে ফোন করেছিল। ইউভানের পানে তাকিয়ে ইকরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে

” বাবাকে বিচার দেবো আমি।এক্ষুনি।”

চলবে…..

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১২

তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইকরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে। আর ঠিক তখনই, ইউভান বাগানে এসে দাঁড়ালো জারার সামনে।

হতভম্ব জারার মনে একটা অজানা সন্দেহ গোপনে জায়গা করে নেয় । ইউভান কি সব জানে? জানে কি তার মনের গোপন ম্যাপ, তার অস্থিরতা, তার অজানা ভয়?মোলায়েম অথচ দৃঢ় স্বরে ইউভান বলল,
“ইকরা যা বলল, তা সত্যি। তবে তার মানে এই নয় যে আমি তোমার ক্ষতি করব, জারা।”

সেই কণ্ঠে কেঁপে ওঠে জারার হৃদয়। এ কেমন আবেগ? এ কেমন দৃঢ়তা? ইউভানের চোখে আকুলতা, আবদার, একধরনের অদ্ভুত মায়া। ঢলঢলে চাহনিতে গুপ্ত কিছু জ্বলজ্বল করছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় ইউভান তার জন্মদাত্রী জননীর প্রাণ সংশয়ের কারণ?

জারা দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। পা বাড়ায় প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু হঠাৎই থেমে গিয়ে পিছন ফিরে বলে,
“আমাকে আটকে রাখার মানে কি? কেন আটকে রাখতে চাইছেন আপনি?”

ইউভানের কণ্ঠ দৃঢ়, স্পষ্ট, ভয়ংকরভাবে স্থির।
“ভালোবাসি তাই।”

জারা তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করে,
“কিন্তু আমি তো বাসি না! আমার স্বামী আছে, আমি বিবাহিত। আমার গর্ভে সন্তান ছিল! দু’দিন পর আমার ডিভোর্স হবে! এসব কি আপনি বোঝেন না? আমি থাকতে চাই না আপনার সঙ্গে!”

হঠাৎ যেন কিছু একটা ভেঙে পড়ে ইউভানের মধ্যে। তার চোখ মুহূর্তেই বদলে যায়, গভীর থেকে গভীরতর হয়। সে ঝড়ের বেগে জারার দিকে এগিয়ে আসে। এক ঝটকায় তার হাত ধরে নিজের বুকের উপর চেপে ধরে অস্থির চিত্তে বলে

“না, জারা! তুমি কোথাও যাবে না! এই কথা বললে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন এক শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ে। অনুভব করো তো! অনুভব করো আমি কতটা ভালোবাসি তোমাকে! আমি তোমাকে কখনো ছাড়তে পারব না!”

জারা ধাক্কা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। উত্তাল কণ্ঠে বলে,
“আমার কাউকে দরকার নেই! আমি একা বাঁচতে চাই! আপনি দূরে থাকুন!”

একথা বলেই সে দ্রুত পা বাড়ায় গেটের দিকে।
ইউভানের চোখ ধপ করে জ্বলে ওঠে। যেন শিকারের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে এক ক্ষুধার্ত বাঘ। পরমুহূর্তেই সে জারার হাত পেছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরে।

“তুমি ভুল করছো, জারা!”

তার কণ্ঠে ছিল এক ভয়ংকর আশ্বাস, এক অদ্ভুত দাবি।

“তুমি আমার।”

এক ঝটকায় সে জারাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। তার শ্বাস ভারী, চোখে দখলদারিত্বের দাবানল।

“আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না, জারা। তুমি আমার! শুধু আমার!”

এবার সে জারাকে রুমের দিকে টানতে শুরু করে। জারা ছটফট করে, কিন্তু ইউভানের শক্ত হাতে সে যেন বন্দী।
তার চোখে এক ভয়ংকর পাগলামির ছায়া।
আর সেই ছায়ার নিচে, জারার নিয়তি আটকে যেতে শুরু করেছে এক অন্ধকার আবেগের ফাঁদে।
জারা পাগলের মতো ছটফট করছে, কিন্তু ইউভানের শক্ত হাতের বাঁধনে সে অসহায়।

“ছাড়ুন আমাকে!”
জারা চিৎকার করে ওঠে, হাত-পা ছুঁড়ে মুক্তির চেষ্টা করে। মরিয়া হয়ে কাঁধ থেকে নামার চেষ্টা করে, কিন্তু ইউভানের শক্ত বাঁধনে সেটা অসম্ভব। সে হাত চালিয়ে, লাথি মেরে নিজেকে ছাড়াতে চায়, অথচ ইউভানের হাত এক মুহূর্তের জন্যও শিথিল হয় না।ধীর, স্থির পায়ে সে জারাকে নিজের রুমে নিয়ে ঢুকে দরজা পেছন থেকে বন্ধ করে দেয় ইউভান। এবার বন্দী কেবল জারা নয়, পাহারাদারও ইউভান নিজে।

“এবার তুমি কোথাও যেতে পারবে না।”

জারা ধপ করে বিছানায় পড়ে যায়। ক্ষিপ্ত চোখে ইউভানের দিকে তাকায়।

“আপনি কি ভেবেছেন, আমাকে এভাবে আটকে রাখলে আমি আপনাকে ভালোবাসব?”

ইউভান একপলক চেয়ে থাকে, যেন জারার প্রতিটি শব্দ তার অস্তিত্বের গভীরে বিধে যাচ্ছে। তারপর হালকা হাসে। ভয়ংকর এক হাসি।

“ভালোবাসতে হবে না, জারা। শুধু আমার থাকতে হবে।”

কথাটা বলেই সে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। হয়তোবা বেঁধে রাখতে চাইছে সে জারাকে। এমন সময়ই
জারা রাগে, ক্ষোভে চিৎকার করে উঠল,

“আপনি পাগল! সম্পূর্ণ পাগল!”

ইউভান জারার নিকট এগিয়ে যায়। একটু ঝুঁকে এসে গভীর কন্ঠে বলে

“পাগলামি ছাড়া কি ভালোবাসা হয়, জারা? যার প্রেমে পাগলামি নেই, সেটা ভালোবাসা নয়, বরং একটা হিসাব-নিকাশ মাত্র। আর আমি তোমার জন্য পাগল।”

.

শহর ছেড়ে একটু দূরের রেস্টুরেন্টটি ছিল আধুনিক সজ্জায় সাজানো। নরম হলুদ আলো আর মৃদু জ্যাজ মিউজিক পরিবেশকে স্নিগ্ধ করে রেখেছিল। কাঁচের বিশাল জানালা দিয়ে বাইরের ব্যাস্ততা আর যানযট দেখতে খারাপ লাগছে না। ইকরা কোণের এক টেবিলে বসে কফির কাপ হাতে নিয়ে অধীর তাকিয়ে আছে সেদিকেই। অপেক্ষার প্রহর কাটছে না যেন। বান্ধবী আলেয়া আসবে কখন? দুপুরের পর? ইকরা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ঘাড় ঘুরালো। তখনই তার দৃষ্টি হঠাৎই আটকে গেলো এক অযাচিত দৃশ্যে।

কিছুটা দূরে আদৃত বসে আছে। মুখে হালকা হাসি, আর সঙ্গে এক অপরূপা তরুণী। ইকরা সন্ধানী দৃষ্টিতে চায়। মেয়েটির স্কিন টোন উজ্জ্বল, চুলগুলো খোলা, আর চোখ দুটো গভীর, যেন রহস্যে ভরা। প্রথম দেখাতেই বোঝা যায় সে বিদেশি।

ইকরার বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ব্যথা টনটন করে উঠে। সে মেয়েটাকে চেনে! আদৃতের বড় ফুফুর মেয়ে—নাম সম্ভবত ইসাবেলা। বিয়ের আগে একবার দেখেছিল কিন্তু তখন এতটা খেয়াল করেনি। বিদেশে বড় হওয়া মেয়েটি যেন পুরোপুরি অন্য এক জগতের মানুষ। ইকরার মনে পড়ল, আদৃত একসময় প্রায়ই উদাস ভঙ্গিতে আকাশের পানে তাকিয়ে বলত—সে বিদেশি মেয়েদের বিয়ে করতে চায়। আগ্রহের সঙ্গে মত প্রকাশ করতো “দেশি মেয়েরা খুব ইমোশনাল, ঝামেলা বেশি। বরং স্মার্ট ইনডিপেনডেন্ট একটা বিদেশি মেয়ে হলে বেশ হতো!”

ইকরার আঙুলের মধ্যে ধরা কফির কাপটা খানিকটা কেঁপে উঠল। সেই পুরনো কথাগুলো হুট করেই বড় বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করল ইকরার মনে। উশখুশ করে উঠলো সে। আদৃতের ঠোঁটে ঝুলে রাখা হাসি তার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। আচমকা ইকরা হাতের গরম কফি ছুড়ে মারলো আদৃতের দিকে। সামনে মাত্র এক টেবিলের দূরত্ব থাকায় টার্গেট মিস হলো না। গরম কফির ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ভিজে গেলো আদৃত। সাদা শার্ট মুহূর্তের মাঝে কালচে হলো। পিঠে গরম কিছু অনুভব করে সে তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরে চায়। ইকরার চোখ শান্ত। চট করে সে সরিয়ে ফেলে দৃষ্টি। আদৃত কিছুসময় তাকিয়ে থাকে শান্ত দৃষ্টিতে। অতঃপর হঠাৎই ইকরার সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে

“তোমার মাথা ঠিক আছে?”

আদৃতের কণ্ঠে বিস্ময় কম রাগ বেশি। রেস্টুরেন্টের কয়েকজন কাস্টমার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কেউ ফিসফিস করছে, কিন্তু আদৃত বা ইকরা কেউই তাদের তোয়াক্কা করছে না।

ইকরা ঠান্ডা গলায় বলল

“তোমার শার্ট নষ্ট করলাম বলে এতো অবাক হচ্ছো? অথচ তুমি তো মানুষের অনুভূতি নষ্ট করো চোখের পলকেই!”

আদৃত একটু হেসে ফেলল।

“তোমার এই ড্রামাটিক রিয়্যাকশনটা আমার বেশ ভালো লাগছে, জানো?”

ইকরা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তার রাগ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল আদৃতের এই নির্লিপ্ত আচরণে। সে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, কিন্তু আদৃত আচমকাই তার হাত চেপে ধরল।

” হিংসা হচ্ছে? ”

” হিংসা? তোমার ওপর? হতো যদি তুমি স্ত্রীকে মর্যাদা দিতে পারতে তাহলে। ”

মুহূর্তের মাঝে আদৃতের চোখমুখ লাল হয়ে এলো। ইকরা তোয়াক্কা করলো না। সে বরং রেস্টুরেন্টের কাঁচের টেবিলে ওয়েটারের উদ্দেশ্যে কিছু টাকা রেখে বেরিয়ে এলো। মুখটা যখন আদৃতের চোখের আড়াল হলো তখনই, তখনই এক ফোঁটা অশ্রু আশ্রয় পেলো ভূমিতে। এতোটা কষ্ট কেন হয় প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে? এমন অনুভূতি লালন করা অন্যায় ইকরার জন্য। যে স্বামী মা-বোনের এক কথায় ইকরাকে অবিশ্বাস করে সেপারেশনে চলে যায় সে স্বামীর জন্য কি এমন ভালোবাসা মনে রাখা উচিত? জানে না ইকরা।

.
হাওয়ার মতো আসা আর পরির মতো উধাও হওয়ার বিষয়টা উপমা মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। তার বোন এমন কেন? চিন্তা হয় তার। আবার ক্ষণে ক্ষণে মাথা চুলকিয়ে ভাবে জ্বীন ধরলো কিনা। কোনো পাহাড় পর্বতে উঠিয়ে নিয়ে যায়নি তো? সেকেন্ডের মাঝে কিভাবে উধাও হলো? কিভাবে? একরাত একদিন ভাবার পর উপমার আজ হঠাৎ মনে হলো ইউভানের কথা। তাকে একবার জানাতে হবে বিষয়টা। আলভি আবার কোন ক্ষতি করে দিলো না তার? ভাবতেই উপমা ফোন নিয়ে ডায়েল করলো ইউভানের এসিসট্যান্টের নিকট। একবার রিঙ হতেই ওপাশ থেকে আমাদ ফোন তুলল। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলো

” জ্বি মিস ? কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

” সরি, আমি মনে হয় কাস্টোমার সার্ভিসে ফোন করে ফেলেছি রাইট? সরি এগেইন। রং নাম্বারে চলে গেছে। ”

কথাটা বলেই উপমা ফোন কাটলো। মনে তার হতাশা বিঁধল। একটা নাম্বার কিনা সে ভালোভাবে ওঠাতে পারেনি? পায়তারা করছিল তার মন। রিং হয় তখন ফোনে। সেই নাম্বার থেকেই। উপমা রিসিভ করেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে

” হ্যালো মিস, আপনার কন্ঠ শুনে মনে হলো আপনি রেগে আছেন। আমি ভুল কিছু বলেছি? আপনি ঠিক আছেন তো?”

উপমার মনে খটকা লাগে। মনে হয় বিষয়টা ফ্লার্ট সংক্রান্ত ব্যাপার। ভাবতেই উপমার মাথা গরম হয়। বলে ফেলে আগপিছ না ভেবে

” এই মিস্টার, কি হ্যা? মেয়ে কন্ঠ পেয়ে আবার ফোন দিয়েছেন? ভেবেছেন বুঝবো না কিছু? শুনেন ধর্ম ভাই, আমি প্রেম পছন্দ করি না। তাই আপনি ফোন করে ব্যালেন্স শেষ না করলে আপনারই ভালো। ”

আমাদ ভরকে যায়।তার গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বেরোনো পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। খুব কষ্টে তিন চারটা ঢোগ গিলে সে বলে

” মিস উপমা, আমি আমাদ। ব্যারিস্টার ইউভানের এসিসট্যান্ট।”

উপমা এবার বেশ খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে। এতক্ষণ যার প্রেমের টোপ ধরানোর অপবাদ দিচ্ছিল, সে তো ইউভানের মানুষ! উফ, লজ্জাই লাগছে এখন!

চলবে…..