#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৩
উপমার ভুল ভাঙিয়ে আমাদ কথা বলে জানতে পারলো জারা আবারও নিখোঁজ। একথা শুনেই আমাদ এর কাশি ওঠে। যেন চোরকে মালিকপক্ষ জিজ্ঞেস করেছে চুরি করা মালপত্র কোথায়? চোরকে চেনে কিনা আমাদ। ঠিক চোর নয়৷ তারা তো কিডন্যাপার।
জারার কথা মনে ভাসতেই আমাদ দ্রুত নিচ থেকে ওপরে ওঠে। ইউভানের এপার্টমেন্টে। সচরাচর তার আসার অনুমতি নেই। জারার উপস্থিতির দরুন তো একেবারেই নেই অনুমতি। কিন্তু আজ তাকে আসতে হলো ইউভানকে না জানিয়ে। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে সে চলে যায় ইউভানের দরজার নিকট। বাহির থেকে ডেকে ওঠে। ইউভান সারা দেয় না। দরজা কেবল ভিজিয়ে দেওয়া ছিল। আমাদ দরজা ঠেলে
ভেতরে ঢুকতেই ঠান্ডা বাতাসের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। জানালার পর্দা অল্প ফাঁক, গাঢ় নীলাভ আলো ঘরের অন্ধকারে মিশে গেছে। দেয়ালের এক কোণে আধো অন্ধকারে বসে আছে ইউভান। দীর্ঘ, প্রশান্ত ভঙ্গি, কালো শার্টের হাতা গুটানো, কব্জির শিরাগুলো স্পষ্ট। এক হাত পায়ের ওপর, অন্য হাতে ছোট এক গ্লাস ধরে আছে—হয়তো ওয়াইন, কিংবা কেবলই ঠান্ডা পানি।
তার দৃষ্টি সরাসরি আমাদের দিকে নয়, দূরে কোথাও শূন্যে আটকে আছে। যেন সে জানে কেউ এসেছে, তবু কোনো তাড়া নেই। একটা পা আলতো দোলাচ্ছে। টেবিলের কোণে রাখা লাইটারটাকে আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় সে ধীর গতিতে মাথা সামান্য কাত করে। তার চোখে ঝলসে ওঠা এক ঝলক বিদ্যুৎ। যেন সে জানে আমাদ কী খুঁজতে এসেছে। আমাদ চোখ ঘুরিয়ে দেখে—ঘরের এক কোণে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে জারা। হাত-পা দড়িতে বাঁধা, চোখে ক্লান্তি আর অস্বস্তির ছাপ। এক মুহূর্ত থমকে যায় সে, কিন্তু ভয় পায় না। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাঁধন খুলতে শুরু করে। দড়ি খুলতেই জারা কাঁপতে কাঁপতে হাত সরিয়ে নেয়, কিন্তু কিছু বলে না।
ঘরজুড়ে এখনো ইউভানের উপস্থিতি ভারী হয়ে আছে, তবু আমাদ যেন তা উপেক্ষা করেই জারার দিকে মন দেয়। তার আঙুল দ্রুত কাজ করে, কিন্তু মনে অস্থিরতা জমে আছে।
ইউভানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এক ঝটকায় উঠে এসে আমাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, যেন তার জগতের নিয়ন্ত্রণ কেউ ছিনিয়ে নিচ্ছিল। আমাদ বাধা দেওয়ার সুযোগই পায় না, পেছনে হোঁচট খায়।
ইউভান দ্রুত সুইচ টিপে ঘরের লাইট অন করতেই এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। জারার হাত-পা দড়ির দাগে লাল হয়ে গেছে, চামড়ায় গভীর ক্ষত। একগুঁয়ে নিয়ন্ত্রণের নেশায় সে এতটা শক্ত করে বেঁধেছিল যে, এখন তা দেখে নিজেরই চমক লাগে। ইউভানের চোখে অজানা এক ঝলক আতঙ্ক ফুটে ওঠে—এটা সে চায়নি।
ইউভান আঙুলের ডগা হালকা ছোঁয়ায় লাল হয়ে থাকা দাগের ওপর রাখে। জারা কেঁপে ওঠে মৃদু।
আমাদ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, কিন্তু ইউভানের দৃষ্টিতে যে শীতল হুঁশিয়ারি, তাতে আর কিছু না বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ইউভান মলম লাগিয়ে দেয় নিজ হাতে। ঠান্ডা পানিতে জারার পা ধুয়ে দেয়। জারার অস্বস্তিতে মর মর দশা জয়। বারংবার পা সরিয়ে নিতে চায় তবে ইউভানের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অতঃপর চুপচাপ বসে থাকে সে। এ নাটক দীর্ঘ করতে চায় না জারা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়। ইউভান ট্রেতে খাবার নিয়ে আসে। জারা খাবে না বলে স্পষ্ট মত প্রকাশ করে। তবে ইউভান চোখ পাকায়।
জারা বিরক্তিতে তাকায়, কিন্তু পরের মুহূর্তেই ইউভান আলতো করেই তার ঠোঁটে চামচ ছোঁয়ায়, জোর করেই খাওয়ায়।
খাওয়া শেষে ইউভান তার সামনে মাটিতে বসে পড়ে। জারার একগুচ্ছ এলোমেলো চুল কানের পিঠে গুঁজে দেয় সে। তার উন্মুক্ত গলার শিরা বলে দেয় কিছুটা একটা নিয়ে যেন সে ভীষণ অনুশোচনায় আছে। চোখ জোরা লাল। গলার স্বর ধরে আসতে চায়।
“আমি সত্যিই তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি”
স্বরটা এতটাই শান্ত যে মনে হয় যেন নিজের কাছেই নিজে কৈফিয়ত দিচ্ছে। জারা কিছু বলে না, কিন্তু তার শরীর হালকা কম্পন অনুভাব করে ইউভানের স্পর্শে। ইতিমধ্যে ইউভানের ভাইব্রেশনে রাখা ফোনটা কেঁপে ওঠে। সে দূরে সরে। বেশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে কথা বলে। মুখটা তার গম্ভীর হয়ে যায়। মনে হলো অপ্রিয় কোনো সংবাদ।
জারার নিকট ফিরে
ইউভান ধীরগতিতে বালিশ ঠিকঠাক করে জারাকে শুইয়ে দেয়। তার চোখে আদেশের ছাপ স্পষ্ট। আর জারা তা মেনে নেয়—হয়তো ভয়ে, কিংবা কেবল এই অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা দীর্ঘ করতে চায় না বলে।
চাদর টেনে দেয়ার পর ইউভান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আঙুলের ছোঁয়া অবিশ্বাস্যরকম মৃদু। তারপর ধীরে ধীরে মুখ এগিয়ে আনে, এতটাই কাছে যে জারার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে।
তার মনে হয়, কপালে নরম কিছু পড়তে যাচ্ছে—একটা চুম্বন হয়তো। কিন্তু সে প্রস্তুত, যদি ইউভান এতটুকু বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তাকে এক ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দেবে।কিন্তু তা হয় না।
ইউভান ঠিক শেষ মুহূর্তে থেমে যায়। শ্বাসের উষ্ণতা কেবল ছুঁয়ে যায় জারার ত্বক। সে ফিসফিস করে বলে
” ভয় নেই। তোমার দেহ আমি ছুঁয়ে দেখবো না যতোদিন না তোমার হৃদয় আমাকে চাইবে। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।”
একথা বলেই ইউভান পা বাড়ায় প্রস্থান করার জন্য। জারার মনে রাগের আবির্ভাব হয়। মন বলে ‘ইউভান আর নিশ্চিন্ত? শব্দ দুইটা ধাতু আর অধাতুর মতো। উপরন্তু ইউভান জারার জন্য মিনি মিনি হার্ট অ্যাটাক। ‘
ইউভান যেতে যেতেই শাসিয়ে ওঠে। মুখ না ফিরিয়ে নিজের পথে স্থির থেকে বলে ওঠে
” আমাকে নিয়ে গবেষণা করা শেষ হলে ঘুমাও এখন। কাল না হয় একটা ল্যাব দিয়ে দেবো তোমাকে। সেখানে বসে সারাদিন আমাকে নিয়ে গবেষণা কোরো। ”
জারা বিরক্ত হলো। চোখ মুখ পাকিয়ে বেশ জোরেই বলল
” কি ভাবেন নিজেকে আপনি? পৃথিবীর শেষ রাজা?”
দরজা ঠাস করে বন্ধ করা হয়ে গেছে। ইউভানের কাছে জারার উক্তি বা প্রশ্ন পৌঁছালো না।
.
বাসা থেকে বেরিয়ে কার নিয়ে ইউভান ছুটতে চেয়েছিল বাতাসের বেগে। কিন্তু তার ইচ্ছে যেন কখনো পূর্ণ হবার নয়। এই অপ্রিয় দুপুরে, উত্তপ্ত গরমে বালিমাখা বাতাসে ঠাঁই বসে থাকতে হচ্ছে। সামনে তার সারি সারি গাড়ি। একটা অপ্রিয় জ্যাম। আবার কিনা তাকে এয়ারপোর্টে যেতে হচ্ছে অপ্রিয় বাবার কারণে। রাগে ইউভানের মাথা দপদপ করছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ। শার্টের ওপরের দুখানা বোতাম খোলা। ঠা ঠা রোদ্দুরও যেন মশকরা করে ঝলসে দিতে হুমড়ি খেয়ে পরেছে ইউভানের মুখে। চেরি ফলের মতো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে ইউভান। আমাদ ড্রাইভিং সিট থেকে পাশ ফিরে চাইলো। ইউভানের এমন রূপে মুগ্ধ কি সে? তবে ঘাড় ঘোরানোর কথা ভুলে গেলো বেমালুম। ইউভান প্রায় তিন মিনিট অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলো। অতঃপর আকস্মিক আমাদ কে বলে উঠলো
” তোমার কি সমস্যা আছে কোনো? আজকাল দেখি ছেলে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে থাকা যাচ্ছে না। আমাদ?”
শেষে একটা চিৎকার। আমাদ এর হুঁশ ফেরে। ছোট করে জবাব দেয়
” জ্বি স্যার।”
ইউভান আশ্চর্য হয়। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে চায় আমাদ এর দিকে। খেয়াল করে আমাদ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে কিন্তু দৃষ্টিতে অন্য কেউ। ইউভান বামে তাকায়। খোলা জানালায় তখন বাঁধা পরে এক নারী। ইউভানের চোখ জোরা ছোট ছোট হয়ে এলো। সি এনজির কারাগারের ন্যায় আড়াআড়ি লোহার বেড়া ভেদ করে সে দেখলো মেরুণ রঙের শাড়ি পরা মেয়েটা উপমার ন্যায় দেখতে। ইউভান আমাদ এর দিকে শত্রুপক্ষের ন্যায় দৃষ্টি রাখে। হঠাৎ মনে হলো তার মাঝে এক টুকরো দায়িত্ববোধ জেগে উঠেছে। হবু শালিকার দিকে আমাদ নজর দিয়েছে? আমাদ অজান্তে আগুনে ঘি ঢালার মতো করেই বলল
” আল্লাহ এতোটা সুন্দর করে তাকে পৃথিবীতে কেন পাঠালেন? সবাই নজর দেবে তো।”
ইউভান হা হয়ে যায়। আমাদ এর তখন সংবেদনশক্তির ঘুম ভাঙে। থতমত খেয়ে সে সামনে তাকায়। ইউভনের গরম চোখ তার ওপর তখনও স্থির। আমাদ আশ্চর্যজনক ভাবে মুচকি হাসে। মাথা চুলকায় এক হাতে। বিরবির করে বলে
” মেয়েটাকে প্রথম দেখার পর থেকেই হুঁশ থাকে না আমার। কেমন যেন বোকাসোকা হয়ে যাই। কেন?”
” বাঁ শ খাওয়ার জন্য। ”
ইউভান আনমনেই বলে ফেলে ঠোঁট নাড়িয়ে। তবে আমাদ এর কানে যায় না। সে তখনও প্রশ্নের জবাব খুজতে ব্যাস্ত ইউভানের চিরন্তন সত্য জবাব শ্রবণ না করে।
চলবে…..
#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৪
অবশেষে কোর্টের দ্বিতীয় দিন চলে এলো। দেখা হলো জারার সঙ্গে আলভির। মনে হলো ও বেচারার হৃদয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। জারার দেখা পেতেই হুটহাট চোখে ফুটে উঠলো মায়া, আকুতি আর চাপা কষ্ট জমিয়ে রাখার অভিব্যাক্তি। এক হাতে ব্যান্ডেজ। মাথায় সাদা পট্টি বাঁধা। বদনে ফোলা ভাব স্পষ্ট। মাহা আগে হাঁটছিল আর আলভি মাহার পিছু পিছু। গাড়ি থেকে প্রথমে ইউভান নামলো। সাদা শার্ট তার গায়ে জড়ানো। দ্বিতীয় বার আমাদ ও তৃতীয় বার নামলো জারা। জারাকে প্রথম দেখে আলভি একটু স্বস্তি পেলেও দ্বিতীয় বার তার ভ্রু কুঁচকে আসে। মনে একটা প্রশ্ন দোলা দেয়। তাকে পিটিয়ে বেহুশ করা মানুষটা ইউভান নয়তো? কিন্তু কিভাবে সম্ভব? সে তো।একজন ব্যারিস্টার। তার নিশ্চয়ই চাকরির ভয় আছে। হতে পারে সেই অজ্ঞাত ব্যাক্তি জারাকে পছন্দ করা অন্য কেউ।
” পা চলে না নাকি? মদ খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারে না। ইডিয়ট একটা। বারান্দা থেকে কেউ নিচে পরে? ”
মাহার চক্কু গরম উক্তি। আলভির মন খারাপ হয়। ভীষণ ভাবে! এভাবে বলতে পারলো মাহা? বলতে পারলো! বলছে তো গত তিনদিন হলো। এমনকি আলভির ডান হাত বদ্ধ থাকার পরও তাকে কষ্ট করে খাবার খেতে হয় বাম হাত দিয়ে। মাহা তবুও বলে না একটিবার, ‘আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ‘
জারার সঙ্গে কাটানো তার দিনগুলো কতইনা রঙিন ছিল। কতটা ধৈর্য নিয়ে জারা তার অগোছালো, অভাবের সংসার টিকিয়ে রাখতো। অফিস থেকে ফেরার পর হাসি মুখে তার ছুটে আসা। আলভির জন্য অপেক্ষায় থাকা নিজে না খেয়ে। মাস শেষে এমন কিছু দিন গেছে তাদের যখন একটা ডিমে ভাগ বাটোয়ারা কারতে হতো। জারা নিজে না খেয়ে তার অংশটুকু রেখে দিত। অন্যসময়ে যেন আলভি খেতে পারে এই আশায়। ভাবনার মাঝেই আলভির মনে নেমে এলো অমাবস্যা। পাঁচ সাত দিনের মাথাতেই তার মনে হচ্ছে মাহার সঙ্গে সংসার করা কি সম্ভব? মনে প্রশ্ন উঠছে টাকা থাকলে সুখ হয় কিন্তু শান্তি আর সংসার কি হয়? কে জানে! আলভি ধীর পায়ে হেঁটে এগোতে থাকে কোর্টরুমের দিকে। ছেলেটা হয়তোবা জানে না, প্রতিটি নারীরই গোপনে গোপনে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভাগ্যবতী। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা প্রতিটি নারীই কারো না কারো ভীষণ শখের। স্বপ্নের রাণী।
.
উপমার সঙ্গে দেখা হলো জারার৷ ওমনি বাঁধলো ঝগড়া। উপমার উপচে পড়া রাগের সামনে জারার টিকে থাকা দায় হয়ে গেলো। কোর্ট রুমের বেঞ্চে বসে জারা উপমাকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করলো। অতঃপর বলেই ফেলল তার সমস্ত কাহিনি। উপমা যেন তখন আকাশ থেকে পড়ে। তার অগ্নি দৃষ্টি তৎক্ষনাৎ আক্রমণ করে আমাদ কে। ইউভান তাদের সামনে বসে ছিল। ইউভানের পিঠপিছে কি আর অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায়? আমাদ বেচারা প্রেমের টানে আবার তাকিয়ে ছিল উপমার দিকে। এভাবেই সে ফেঁসে যায়। উপমা আর জারার আলাপ থামে না। সময় হয় জজ আসার। এমুহূর্তে ইউভান ফিরে চায় তাদের পানে। নিজ ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারায় চুপ হতে বলে। উপমা ভদ্রতার খাতিরে চুপ হয়। কেবলই ভদ্রতার খাতিরে। সে আবার সাইকো, উন্মাদ বোঝে না, চেনে না। আজ একটা কেলেংকারী নিশ্চয়ই ইউভানের সঙ্গে তার হয়ে যাবে।
বিচারকার্য শুরু করার আদেশ দেওয়া হলে ইউভান শুরুতেই নিজ যুক্তি উপস্থাপন করবে বলে জানালো। প্রথমেই ডাকলো সে আলভিকে। জিজ্ঞেস করলো তার নাজেহাল দশার কারণ। আলভি জানালো ছাদ বারান্দা থেকে পড়ে তার এই অবস্থা যেমনটা সে জানিয়েছে মাহাকে। ইউভান ঠোঁট টিপে হাসলো। কিছু প্রশ্ন আলভিকে জিজ্ঞেস করলো। আলভি তার পুঁথি পড়নে জবাব দিলো। ইউভান বুঝলো এই মিথ্যা স্ক্রিপ্ট এডভোকেট শিখিয়ে দিয়েছে। তবুও সে মেনে নিলো সে সব। এবার ডাকলো মাহাকে। খেলা জমলো তখনই। ইউভান একটা ছোট সিম মেমোরি কার্ড টেবিল থেকে তুলে এনে হাতে রেখে বলল
” এখানে একটা রেকর্ড আছে। যেখানে আপনার আর আলভির কিছু কনভারসেশন। আমি যদি এটা চালু করি তাহলে সবাই বুঝতে পারবে আমার জারার ওপর কে আঘাত আনতে চেয়েছিল। ইভেন মহামান্য, আমি সেখানে গিয়েছিলাম। যেখানে জারার মাথায় আঘাত করে তাকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেওয়া হয়…”
” মিথ্যা কথা বললেন না। আমরা কেউ ধাক্কা দেইনি জারাকে। জারা তো এমনিই পরে গিয়েছিল ওখান থেকে। গড়ে গিয়েছিল। ”
ইউভানের ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটে ওঠে। মনে হলো যেন সে এই মুহূর্তে জয়ী হলো। এখন শুধু ঘোষিত হওয়ার পালা।
” কিভাবে পরেছে?”
মাহা দ্বিতীয়বার শোনায়। তার হাত পা কাঁপছিল। চোখের দৃষ্টিতে ছিল ইউভানের হাতের মেমোরি কার্ড।
” তাহলে প্রথম দিন যে বলেছিলেন আপনার কনুইয়ের ধাক্কায় পরে গিয়েছিল জারা?”
মাহার বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে ওঠে। সে কি ফেঁসে গেলো? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে নিজ উকিলের দিকে। ইউভান ফিসফিস করে বলে
” আপনার উকিল ডিরেক্টর হিসেবে খুবই কাঁচা। সঙ্গে আপনি অভিনেত্রীও পাকা নন। স্ক্রিপ্ট মুখস্থ হয় না তাই না? ব্যাপার না। আমাদের পুলিশ ম্যামেরা অনেক ভালো টিচার। ”
মাহার শরীর অবশ হয়ে আসে। ইউভান পুরো ঘটনাটা বুঝিয়ে বলে জজকে। অতঃপর মাহাকে ধন্যবাদ দেয় এই বলে, মেমোরি কার্ডে ইউভানের ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। এটা একটা আসল দেখতে নকল হাতিয়ার ছিল মাত্র।’ এরজন্য অবশ্য ইউভানকে ক্ষমাও চাইতে হয় জজের নিকট।
শুধু ইউভান নয়, কোর্টরুমে উপস্থিত সকলে ধরেই নিয়েছিল ইউভান জিতে গেলো আর দোষী হলো মাহা ও আলভি। ঠিক তখনই বাঁধে আরেক ঝামেলা। হুট করে মাহার উকিল দাবি করে বসে মাহা খু*ন করতে চায়নি। মানে সে চেষ্টা করেনি জারাকে মা*রার। এসবই আলভির কাজ। হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়। ইউভান নিজেও স্তব্ধ হয়ে যায়। অতঃপর যখন ঠান্ডা তর্ক শুরু হয় দুই উকিলের তখন জজ নীরব হতে বলেন সকলকে। মাহার উকিল সম্পূর্ণ দোষ গাড়িয়ে দেয় আলভির ওপর। আলভি যেন হতভম্ব হয়ে যায়। হাতে পায়ে তার জোর আসে না। ইউভান তাকে সামনে ডাকলেও সে উঠে যেতে পারে না যেন। কোর্টরুম ঝাপসা হয়ে আসে। সে এই ঝাপসা চোখে অবাক হয়ে তাকায় মাহার দিকে। মাহা প্রত্যুত্তর করছে না। মনে হচ্ছে সেও একমত উকিলের সঙ্গে। সব শেষে জারাকে ডাকা হয়। জারা জানায়, তারা দু’জনেই মারার চেষ্টা করেছে। তবে মাহা তাকে পেছন থেকে আঘাত করেছে। অপর পক্ষের উকিল বলে অন্ধকারে কি দেখা যায়? জারা কেবল অনুভব থেকে বলছে তাই এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ইউভানের রাগ হয়। তবে কিছু করার থাকে না। আলভিকে শাস্তি দেওয়া হয়’ দশ বছরের জেল। ‘ আলভি ভেঙে পড়ে ভেতর থেকে। সে সত্যিই অসহায় আজ। একবার ফিরে চায় জারার দিকে। আবার মাহার দিকে। কোনো নারীর মনেই তাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা সে দেখতে পাচ্ছে না। জীবনে এতেটা অসহায় সে কখনো অনুভব করেনি। আলভি চিৎকার করে বলে
” আমি জারাকে মা*রতে চাইনি। মাহা আমাকে জোর করেছে বারবার। আর সেদিনও আমি মাহাকে বলিনি পেছন থেকে জারাকে আঘাত করতে। মাহারই প্ল্যান ছিল এটা।”
একথা সত্যি ছিল। সকলের মনে একটু খানি সহানুভূতি জন্ম নিলেও জারা তখন বলে
” তুমি আমাকে মারতে না চাইলেও আমি যখন মরে যাচ্ছিলাম তখন বাঁচানোর চেষ্টাও করোনি।”
বিচার এখানেই সমাপ্ত হতে দিলো না ইউভান। সে মাহার বিরুদ্ধে যুক্তি দাড় করিয়ে দিলো। যদিও তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় না যে মাহা দোষী। কিন্তু জজ অবশেষে বাধ্য হন মাহাকে তিন দিনের রিমান্ডে দেওয়ার। উপরন্তু আলভির শেষ কথাগুলো ফেলনা ছিল না।
অবশেষে এখানেই শেষ হয় আলভি আর জারার বিচার। আলভিকে পুলিশ হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে। জারা সেদিকে এক পলক চায়। আলভির চোখে পানি গড়াগড়ি খাচ্ছে। আলভির মনে হচ্ছে সে এখনই এসে জড়িয়ে ধরবে জারার পা। ক্ষমা কি চাইবে? এমন সাহস হয় না। সে সত্যিই ভুল করেছে। কোর্টরুম থেকে সকলে বেরিয়ে যায়। আজ ইউভান হাত চেপে ধরে জারার। যেন সে পালাতে না পারে। এমন দৃশ্য চোখ এড়ায় না আলভির। সে পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে এগিয়ে আসে। পাগল পাগল লাগে তার। বুকে যেন ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে দিচ্ছে কেউ। আলভির ছুটে আসা দেখেই ইউভান জারাকে পেছনে সরিয়ে নেয়। আলভির রাগ চরমে ওঠে। সে পাশে থাকা টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাস ছুড়ে দেয় লক্ষ হীন ভাবে। যদিও তা ইউভানকে ক্ষত করে দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দিক হয় জারার পানে। ইউভান জারাকে আরো আড়াল করে সামনে দাঁড়ায়। গ্লাস এসে আঘাত করে ইউভানের কপালে। মুহূর্তে রক্ত ছোটে। আলভি হুংকার দিয়ে বলে
” তুই আমার জারাকে ছুবি না। তুই আমার জায়গা নেওয়ার সাহস করিস না। ”
ইউভান কপালে টিস্যু চেপে ধরে একহাতে। আর অপর হাতে জারার হাত। বলে
” ভুল করে তোকে দিয়েছিলাম। রাখতে পারিসনি। এখন আর সুযোগ নেই। ”
ভীষণ শীতল এই কন্ঠ। আলভি কে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশের গাড়ির নিকট। আমাদ এখানে ব্যস্ত হয় ইউভানের ক্ষত নিয়ে। ইউভান তখন আমাদ কে জানায় জলদি যেন জারার ডিভোর্সের কাগজ পত্র তৈরি করা হয়।
চলবে….