ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-১৫+১৬

0
16

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৫

আমাদ গাড়ির দরজা খুলে দাড়িয়ে ছিল। বাম হাতে কালো লং কোট নিয়ে এক ঝাঁক এলোমেলো চুলে ইউভান হেঁটে আসছিল গাড়ির নিকট। ডান হাতে বন্দী ছিল জারা। ইউভানের কপালে সাদা ব্যান্ডেজ। রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে ছিল তার সাদা শার্টে। শুষ্ক ঠোঁট ও চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল সামান্য অসুস্থতা। কপালে বেশ লেগেছে তার। গাড়ির দরজার থেকে পাঁচ কদম দূরে অবস্থান করার কালেই আচমকা পা থেমে যায় ইউভানের। সে পিছু ফিরে চায়। উপমা দাড়িয়ে আছে শক্ত চোখ মুখ নিয়ে। ইউভান ভ্রু উঁচিয়ে চায়।

” জারাকে ছেড়ে দিন।”

“তুমি কি সিরিয়াসলি ভাবছো, উপমা, তুমি আমায় থামাতে পারবে?”

ইউভানের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি।

উপমা বিরক্ত মুখে বলল,

“আপনি একজন ব্যারিস্টার হয়ে এভাবে জারাকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন না!”

ইউভান মাথা কাত করে তাকাল, ঠোঁটের কোণে মজার হাসি।

“এমন কোনো নিয়ম বা সংবিধান তো আমি পড়িনি। নতুন এড করা হয়েছে নাকি?”

উপমা চোখ পাকিয়ে বলল,

“মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথা শোনেননি?”

ইউভান হেসে ফেলল। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল,

” তুমি কি নিয়তির কথা শোনোনি? আমি জারার ইচ্ছা নই নিয়তি। ”

ইউভানের কন্ঠস্বরে উপমা এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় পড়ে গেল। জারা কিছু বলছিল না, কিন্তু তার চোখ বলছিল অনেক কিছু।

উপমা হাত তুলে বাধা দিতে গেল, কিন্তু ইউভান তখনই হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল

“উপমা, তুমি না থাকলে জীবন বড়ই বোরিং হয়ে যেত! কিন্তু একটা কথা মনে করিয়ে দিই। তোমার কেস লড়ার জন্য যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল, তার অর্ধেক এখনো পাইনি! আমি তো বিনা পয়সায় কাজ করি না, শালিকা।”

উপমা চোখ বড় বড় করে তাকায়। তার কন্ঠ বলে কড়া করে

“অপমান করবেন না ইউভান! টাকা তো দেব!”

ইউভান কাঁধ ঝাঁকিয়।

“আমার হাতে এখন সময় নেই! তাই আমার পেমেন্ট আগেই নিয়ে যাচ্ছি।”

উপমা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,

“মানে?”

ইউভান এবার এক ঝটকায় জারার কব্জি চেপে ধরল।

“আমি টাকা না পেলেও যা চাই, সেটা ঠিকই নিয়ে নিই। জারা এখন আমার আপনি টাকা দিতে পারেননি। ”

উপমার মুখ হা হয়। সে আমতা ভাব আর জড়তা দিকবিদিক ছুড়ে ফেলে বলে

“ইউভান, এটা কোন ধরনের লজিক?”

ইউভান চোখ টিপ দিয়ে বলল,

“এটা একেবারে ল’জিক্যাল! কেসের টাকা না আসলে ক্লায়েন্টের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস নিয়ে নেওয়া হয়।”

উপমা রাগে ফুটতে লাগল,

“ইউভান, এটা কিডন্যাপ!”

ইউভান অবাক হওয়ার ভান করে। মেকি হতবাক ভাব সুরে টেনে বলে

“সত্যি? আমি তো এটাকে বলি পাওনা আদায় করা!”

তারপর সে একটানে জারাকে নিজের কাছে টেনে নেয়
উপমা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে।

” ব্যারিস্টার ইউভান।”

ইউভান হেসে জবাব দিল

” তুমি অযথা আমার সময় নষ্ট করছো উপমা। এটা আমাদের ঝগড়ার জায়গা নয়। আমরা লড়বো কোর্টে। তুমি আমার অপজিটে আর আমি তোমার অপজিটে। পরের বার যেন তোমার আমার কোর্টে দেখা হয় আমি এটাই আশা করছি।”

কথাটা বলেই ইউভান সোজা জারাকে কাঁধে তুলে নিল, যেন এটাই স্বাভাবিক।

গাড়ির দরজা খুলে জারাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে দরজা লাগিয়ে দিল দ্রুত। ইঞ্জিন গর্জে উঠল। উপমা কিছু বলতে চাইলে ইউভান হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো। বলল

“উপমা, তোমার লেকচার পরে শুনব। এখন একটু রোম্যান্টিক সময় কাটাতে দাও!”

তারপর গাড়িটা হাওয়ার গতিতে সামনে এগিয়ে গেল, আর উপমা দাঁড়িয়ে রইল, হতবাক হয়ে। ইউভান সত্যিই থামার ছেলে না! উপমা রাগে দুঃখে মাটিতে এক পা আছড়িয়ে উঠলো। আমাদ মুখ টিপে হাসছে। ইউভানের এমন রূপ সে প্রথম দেখলো। কল্পনাতে ছিল না ইউভান এভাবে হস্য রসিকতা করতে পারে।
.
ডাইনিং হলের ভারী নকশাদার টেবিলটির পাশে বসে ছিলেন ইউভানের বাবা আরমান শাহ। তার দৃষ্টি ছিল কড়া, গম্ভীর। টেবিলের উপরে রাখা ঝলমলে ঝাড়বাতির আলো তার মুখের রেখাগুলোকে আরও স্পষ্ট করে তুলছিল। প্রতিটি ভাঁজে যেন অভিজ্ঞতা আর কঠোরতা জমাট বেঁধে আছে।

ঠিক তখনই ইউভান প্রবেশ করল। তার সাথে জারা।

জারার পরনে ছিল একদম সাধারণ, সাদা একটি গাউন—নির্ভেজাল শুদ্ধতার প্রতীক যেন। কোনো অতিরঞ্জিত সাজসজ্জা নেই, নেই কোনো বাহুল্য। তবুও কী যেন আছে তার মধ্যে, যা দৃষ্টি কাড়ে। হয়তো তার চারপাশে ঘিরে থাকা এক অদৃশ্য দৃঢ়তা।

ইউভান ছিল ঠিক তার উল্টো। সবসময়ের মতোই কালো শার্টে মোড়া, যেন নিজেকে আড়াল করেই রেখেছে। তবুও জারাকে নিয়ে প্রবেশ করার মুহূর্তে, তার চোখে এক অন্য রকম দীপ্তি।সে জারার হাত শক্ত করে ধরে টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো। তার এই হাত ধরা আগ্রাসী নয়, বরং এক ধরনের সুরক্ষার প্রতিচ্ছবি। চেয়ারের কাছে গিয়ে ইউভান নিজ হাতে চেয়ার টেনে নিল। তারপর নিঃশব্দে জারার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে আদেশ ছিল না, অনুরোধও ছিল না—ছিল একধরনের মায়াময় জেদ।

জারা এক মুহূর্ত থমকালো। হয়তো তার অবচেতন মন এখনো মানতে চায় না যে কেউ তাকে এত যত্নে স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু ইউভান অপেক্ষা করেনি। তার হাতে থাকা জারার আঙুলগুলো আরও একটু শক্তভাবে চেপে ধরে, সোজা চেয়ারের দিকে নির্দেশ করল। জারা ধীরে ধীরে বসল।

সেই মুহূর্তে যেন সারা ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ইউভান নরমভাবে একবার জারার গাউনের ভাঁজ ঠিক করে দিল, যেন সে কোনো অমূল্য সম্পদকে যত্নে রাখছে। তারপর নিঃশব্দে নিজেও বসল তার পাশে। আরমান শাহ হতভম্ব হয়ে দেখলেন এসব। চোখাচোখি হলো তার ইকরার সঙ্গে। ইকরা তাকে গতকালই অবগত করেছে এসব বিষয়ে। জারা ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। বারংবার ঘোমটার আড়ালে থাকা একগুচ্ছ চুল গুঁজে দিচ্ছিল কানের পিঠে। এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু আসতে হয়েছে ইউভানের কারণে। জারার মনে হয়েছে ইউভানের সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে তাল মিলিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাকে বিগড়ে দিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।

জারার মুখোমুখি বসে ছিল ইউভানের ফুফাতো ভাই অর্কভ। যুক্তরাষ্ট্রেই তার পরিবার থাকে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। ইউভান তাদের বাসাতে থেকেই এল.এল.বি শেষ করেছে। অর্কভ ছেলেটার দৃষ্টিতে দোষ আছে। কিশোর বয়স থেকেই। সে এক দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে জারার পানে। হলদে ভর্সা গায়ের রঙ, জামরাঙা ঠোঁট, আর প্রসাধনী বিহীন নাক, মুখ, চোখ তার চোখকে পলক ফেলতে নিষেধ করছে।

জারার আচমকা অস্বস্তি বেড়ে তুঙ্গে ওঠে। তার মনে হয় আশেপাশে কারো দৃষ্টিতে সে বাজে ভাবে আঁটকে আছে। নারী মন তৎক্ষনাৎ খুঁজে বের করে সেই দৃষ্টি। হাতে পায়ে কাঁপন ধরে জারার। ছেলেটা একেবারে তার মুখোমুখি। জারা বুঝতে পারে না সে কি করবে এই মুহূর্তে। কম্পমান হাতে সে পানির গ্লাস হাতে তুলে নেয়। ঠকঠক করে কাঁপা হাতের গ্লাস তখনই যেন উল্টো শক্তি প্রয়োগ করে টেবিলেই পরে যায়। শব্দ হয় ঝনঝন। কিছু ভাঙে না কিন্তু গ্লাসের পানি গড়িয়ে গাড়িয়ে জায়গা করে নেয় আরমান শাহর কোলে। ওনার কাপড় ভিজে যায়। শক্ত চোখে তাকান তিনি জারার পানে। ইউভান খাবারের প্লেটে চামচ রাখছিল। সে ফিরে চায়। জারার মুখ শুকনো। আরমান শাহ বিরবির করতে করতে উঠে চলে যান ওয়াশরুমের দিকে। ইকরাও বাঁকা দৃষ্টিতে চায় জারার দিকে। ইউভান আশ্বাস দিতে জারার চোখে চোখ রেখে নীরবে জানায় এটা কোনো বিষয় না। কিছু হয়নি। একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে জারা দিশেহারা হয়ে যায়। কিছুই গলা দিয়ে নামলো না তার। ইউভান হয়তোবা বুঝলো জারার অস্বস্তি। সে আধখাওয়া খাবার ছেড়ে জারাকে নিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।

.
খা খা করা রোদ্দুরের দাপটে রস্তায় টিকে থাকা বড়ই দায়। সাভার এলাকায় যেন এই গরম আরো তীব্র। উপমা কপাল কুঁচকে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা গালি দিলো ইমাকে। মেয়েটা তাকে বলেছিল জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটির সামনেই আছে সে। কিন্তু উপমা দশ মিনিট হলো অপেক্ষা করার পরও মেয়েটা ভার্সিটির সামনে আসছে না। উপমার সন্দেহ হয় ইমা আদৌও হোস্টেল রুমের চৌকাঠ পেরিয়েছে তো? উপমা কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করলো। এই বিশাল ভার্সিটির এলোমেলো গাছগাছালি দেখলে তার মন কু ডাকে। ভয় লাগে। অন্ধকারাচ্ছন্ন কিছু জায়গা দেখে উপমা এডমিশন দিতে এসেই দোয়া করেছিল

” আল্লাহ আমার যেন চান্স না হয় এখানে। এতো শান্ত পরিবেশ দেখলে আমার বুক ঢিপঢিপ করে।”

দোয়াটা কবুল হয়েছিল। ঢাকাতে সে আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। অতীত ঘেঁটে এসে উপমা হাফ ছাড়লো। চোখ জোরা বড় বড় করে সে মা’কে কিছুসময় কল্পনায় দাঁড় করিয়ে ঝগড়া করলো। এই এক সুবিধা বটে। কল্পনায় শুধু নিজেই যা-তা বলা যায়। অপরপক্ষ তেড়ে আসে না লাঠি ঝাঁটা চামচ নিয়ে। উপমা এদিক সেদিক তাকালো। উঁহু! ইমা আসছে না। উপমার মনে হলো মায়ের একটু-আধটু প্রশংসা পেয়ে তার গলে যাওয়া উচিত হয়নি৷ আর খালামণির আচারের বয়ামও নিতে আসা উচিত হয়নি। উপমা ফোন করলো ইমার কাছে। ফোন ধরছে না মেয়েটা। পায়তারা করতে লাগলো উপমা। পাশে কিছু ছেলে দাড়িয়ে ছিল। উপমা আড় চোখে পরখ করলো। সুবিধার মনে হচ্ছে না ওদের। একজন ছেলেকে দেখে তো উপমার মনে সন্দেহ জন্ম নিলো। বাবরি চুল, হাতে কিছু কালো রঙের ব্যাচ। ঠিক ব্যাচ? উপমা তো সেগুলোর নাম ঠিক করলো মেয়েদের চুলের গার্ডার। ছেলেটার গায়ের রঙ স্যামলা। গান গাইছে সে

” ও মাইয়া ও মাইয়া রে তুই অপরাধী রে….”

চলবে….

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ১৬

উপমার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো না। ইমা এলো শীঘ্রই। হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে সে দৌড়ে পালালো। উপমার আগুন বরাবর রাগের সামনে সে থাকতে চায় না। প্রয়োজনে বাকি কথা ফোনালাপে সেরে নেবে। উপমা পা বাড়ায় তখনই। তবে কি আশ্চর্য! ঝুম বৃষ্টি নিমন্ত্রণ হীনভাবে হাজির। সকলে চমকে উঠলো। উপমা দৌড়ে আশ্রয় নিলো একটা ভবনের নিচে। ছেলেগুলোও সেখানেই ছিল। বাবরি চুলের ছেলেটা একপলক উপমাকে দেখলো। তার সঙ্গে দাড়িয়ে থাকা ছেলেরা নানান কথাই বলছিল। ছেলেটা থামিয়ে দেয় তাদের। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরা আড্ডার মাতে। উপমার বিষয়টা খারাপ লাগে না। ছেলেরা নিকোটিনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়। বৃষ্টির জল আর সিগারেটের ধোঁয়া তৈরি করে এক ধোয়াসা। কাশি ওঠে উপমার তবে ওরা কেউ এ নিয়ে ভাবে না। কেউ মেতে ওঠে ক্যাম্পাসের রমণীদের নিয়ে, কেউবা পরীক্ষার চিন্তায়। উপমা ওদের কথার মাঝে জানতে পারলো বখাটে দেখতে ছেলেটার নাম কাব্য। শার্টের বোতাম খোলা রাখা। অর্ধেক বুক দৃশ্যমান। ভাবনার মাঝে বৃষ্টি থামে। উপমার পা বাড়াতে হয় নিজ গন্তব্যের দিকে। পেছন থেকে তখনই কাব্য ডেকে ওঠে

” এই যে ঢাবি, ফোন রেখে যাচ্ছো।”

উপমা পেছন ফিরে চায়। বেঞ্চে স্থির হয়ে থাকা তার ফোন যেন অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। উপমা পুনরায় যায় সেখানে। মনে প্রশ্ন জাগে ছেলেটা বুঝলো কিভাবে সে ঢাবি? এ প্রশ্নের জবাব মিলল উপমার ব্যাগে। তার আইডি কার্ড দোল খাচ্ছে উঁকি দিয়ে। উপমা ভদ্রতার খাতিরে জবাব দিলো

” ধন্যবাদ জাবি।”

পাশ থেকে এক ছেলে বলে উঠলো

” ওয়াও, ঢাবি জাবি? হবে নাকি ভবিষ্যতে ভাইয়া ভাবি?”

উপমার এবার মাথায় রক্ত উঠলো। এটা কেমন কথা? তবে বহিরাগত বলে সে কিছু বলল না। ফিরে এলো সেখান থেকে। তবে পুনরায় পিছু চাইলো। জাবির কাব্য মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এবার কি উপমার একটু মন খারাপ হলো? বোঝা গেলো না। তবে সে ফোন নিয়ে এলো ঠিকই, কিন্তু কিছু একটা রেখে এলো সেখানে।

.
আরমান শাহ ইকরার এপার্টমেন্টে থাকছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। প্রায়ই আসা হয় না দেশে। ইউভানের মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা হয়ে গেলো সকলের চোখের বালি। ইকরাও সহ্য করতে পারতো না নিজ ভাইকে। যদিও তারা সময়বয়সী ছিল কিন্তু মায়ের মৃত্যু ইকরাকে ঘাবড়ে দিয়েছে। ইউভানকে সে দেখেছে রক্তমাখা ছুরি হাতে মায়ের পাশে বসে থাকতে। আরমান শাহ অতীত ঘেঁটে মর্মাহত হলেন। ইউভানের মা চলে যাওয়ার পর থেকে সবকিছু এলোমেলো। খুবই দুর্বিষহ হয়ে গেছে তাদের তিন জনের জীবন। ইউভামকে বড় হতে দিলেন তিনি এবাড়িতেই। অনেকগুলো কাজের লোক রাখা হলো। কোনো কিছুর অভাব রাখলেন না আরমান শাহ। নিজ স্ত্রী কে মেরে ফেলার দরুন তিনি তখন ইউভান কে একটু অন্যরকম চোখেই দেখতে শুরু করেন। এরপর ইউভানের পান থেকে চুন খসলেই যার ইচ্ছে সে-ই তাকে মারধর করতো। ইউভানের মায়ের মৃত্যু একটা ধোঁয়াশা ছিল ততদিন যতদিন না দ্বিতীয় একটা খুব ইউভান করে। তাকে অত্যন্ত আদরে আগলে রাখা দিলরুবা খালাকেও ইউভান মে*রে ফেলে। একইভাবে ছুরির আঘাতে। কেন করেছিল ইউভান এমন সে কথা জানা যায়নি। ইউভান তো স্বীকারও করে না এসব।

” বাবা ”

হুঁশে আসেন আরমান শাহ। ইকরা পাশে বাসে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে চাঁদের এক টুকরো আলো এসে ছুঁয়েছিল ইকরার মুখে। তার মেয়েটাও কি সুখে আছে? তিনি ইকরাকে নিজের কাছে রাখলেও সময় দিতে পারেননি। মেয়েটাও হয়ে উঠেছে ভেতর থেকে খুবই কঠোর। ডাক্তারের পেশা যারা বেছে নেয় তারা আদোতেই হয় অনুভূতি শূন্য। ইকরা যেন এই পেশা আর নিজ জীবনের দরুন আরো এক ধাপ বেশি কঠোর হয়ে গেছে।

” আদৃত কি বলল? কাল দেখা করবে?”

” হ্যা।”

” ডিভোর্স না নিলে হয় না মা?”

ইকরার ভেতরটা গুড়িয়ে আসে। বাবাকে কি সব কথা মুখ ফুটে বলা যায়?

” আদৃত চায় ডিভোর্স নিতে। আর.. আমিও চাই।”

ইউভানের বাবা চুপ হয়ে যায়। ইকরার নামে তার শাশুড়ি ও ননদ রটিয়েছে ইকরা হসপিটালে ইন্টার্নি করা অবস্থায় অনেক ডাক্তারের সঙ্গে…। বাকি কথা আরমান শাহ আর ভাবনাতেও আনতে পারলেন না। ডাক্তার হওয়ার পরও নাকি ইকরা নাইট ডিউটিতে বাজে কাজ করে। এমনকি ওরা আদৃত কে কিছু ছবি দেখিয়েছে ইকরার বন্ধুর সঙ্গে। যেখানে ইকরা শর্ট স্কার্ট পড়ে ছবি উঠেছে তার বিদেশি ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ইকরার অতীত খারাপ। ইকরা বিদেশে বড় হওয়ায় ইকরার অতীত খারাপ। সে আদৃত কে ঠকিয়েছে। এক বছর প্রেমের পরে আদৃত ইকরার বিয়ে হয়েছে। আদৃত মানতে পারছে না তার ভালোবাসার মানুষ তাকে এভাবে ঠকিয়েছ। ইকরা আদৃত কে বুঝিয়েছে এমন কিছু না। সে বিদেশে বড় হয়েছে তাই তার লাইফস্টাইলে বিদেশি আঁচ। আদৃত চাইলে সে তা পাল্টে ফেলবে। কিন্তু আদৃত একবার বলুক ইকরার বিরুদ্ধে আদৃত এমন কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে কিনা। কিন্তু আদৃত বলে না। তার বক্তব্য সে এই বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চায় না। যা জানার তা সে জেনে গেছে।

.

আকাশের এক কোণে আবছা কমলা আভা—দিন আসছে, কিন্তু এখনো পুরোপুরি নয়। এই সময়টা অদ্ভুত, যেন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, আবার কিছু আসছে, কিন্তু তার মাঝখানে এক ধরনের শূন্যতা।

নীরবতা আছে, কিন্তু সেটা ভারী নয়। বরং মনে হচ্ছে, প্রকৃতি নিঃশ্বাস চেপে ধরে অপেক্ষা করছে—প্রথম রোদ্দুরের স্পর্শের জন্য। এমন এক মুহূর্তে জারা বেরিয়েছে হাঁটতে। নগ্ন পা ভূমিতে। বিশাল আকাশ তার মাথার ওপর। প্রকৃতি সুন্দর। সত্যিই সুন্দর। জারা আজও মনে একটুখানি দুঃখ পোষে। আলভি নামের কারো জন্য নয়। তার অনাগত সন্তানের জন্য। আজও মনে হয় তার কোল খালি হয়ে গেছে। ভাবনার মাঝে জারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর দুপা এগিয়ে যেতেই চোখ পরলো তার ইউভানের কক্ষের দিকে। সেখানে ছাদ বারান্দায় কেউ দাড়িয়ে আছে কফির মগ হাতে। জারার আরো একটা ভাবনা মাথা চাঁড়া দিলো। এখান থেকে তার মুক্তি কবে হবে? ভাবনার মাঝেই তার মনে হলো! মনে হতে না হতেই সে হাত উঁচু করলো। ভান করলো এমন যেন হাতে তীর আছে। এমনই ভঙ্গি করে সে তীরটা ছুড়ে দিলো ইউভানের পানে। তখনই ইউভান ফিরে চাইলো। জারা পড়িমরি করে গুছিয়ে নিলো হাত। ইউভান ভঙ্গি করে বুকে হাত রেখে পিছিয়ে গেলো দু’পা। যেন তার খুব লেগেছে তীরটা। অতঃপর হাসলো। জারা চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। যেন বলে দিল

‘ এই মনে আপনার জন্য কোন জায়গা নেই ব্যারিস্টার সাহেব। ‘

ইউভান ওপর থেকে ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁট বাকিয়ে যেন জানিয়ে দিলো

‘ জায়গার দরকার নেই ম্যাম। ইউভানের জায়গা জমির অভাব নেই। শুধু একটা জারার অভাব। ‘

.
সকালের খাবার খাওয়া শেষ হলে আমাদ ইউভানকে জরুরি তলবে ডাকলো। তাদের নাকি কেইস নিয়ে কথা আছে। জারা নিজ ঘরেই বসে ছিল। ইউভানকে যেতে দেখে সে কৌতুহল বশত উঁকি দিলো তার ঘরের জানালা দিয়ে। আমাদ আর ইউভান বাগানে বসে কিছু আলাপ করছিল। সেখানে হঠাৎ দেখা গেলো খাবার টেবিলের সেই অসভ্য ছেলেটাকেও। ইউভান এড়িয়ে চলছিল তাকে। তবে হঠাৎই! আচমকাই ছেলেটা কিছু একটা বলে উঠলো। ইউভান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। অতঃপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ঘুষি দিয়ে অর্কভকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। অতঃপর আবারও এগিয়ে গিয়ে কলার চেপে ধরলো। এবার মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে ছেলেটার গলা চেপে ধরলো ইউভান। আমাদ ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। জারার বুক ঢিপঢিপ করছে তখন। সে এমন দৃশ্যের সম্মুখে পড়ে বেশ ঘাবড়ে গেলো। রিয়া দৌড়ে নিচে নামছে। কৌতুহল থেকে জারাও রিয়ার পিছু নিলো।

চলবে…